অবিভক্ত বঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিবৃত্ত, উত্থান ও পতন - এক অজানা ইতিহাস ।। রানা চক্রবর্তী


● ছবিতে - অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান (৯৮২ খ্রিস্টাব্দ - ১০৫৪ খ্রিস্টাব্দ)। বৌদ্ধধর্ম প্রচারে ও প্রসারে এই বঙ্গ সন্তানের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।

অতীশ দীপঙ্কর ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমপুর পরগনার বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এটি বর্তমানে বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত। অতীশ দীপঙ্করের বাসস্থান এখনও 'নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা' নামে পরিচিত। অতীশ দীপঙ্কর গৌড়ীয় রাজ পরিবারে রাজা কল্যাণশ্রী ও প্রভাবতীর মধ্যম সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছোটবেলায় তাঁর নাম ছিল আদিনাথ চন্দ্রগর্ভ। তিন ভাইয়ের মধ্যে অতীশ ছিলেন দ্বিতীয়। তার অপর দুই ভাইয়ের নাম ছিল পদ্মগর্ভ ও শ্রীগর্ভ। অতীশ খুব অল্প বয়সে বিয়ে করেন। কথিত আছে তার পাঁচ স্ত্রীর গর্ভে মোট ৯টি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। তবে পুন্যশ্রী নামে একটি পুত্রের নামই শুধু জানা যায়। বৌদ্ধ ধর্মে সংস্কারের মতো শ্রমসাধ্য কাজ করতে করতে দীপঙ্করের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে ১০৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ৭৩ বছর বয়সে লাসা নগরের কাছে চে-থঙের দ্রোলমা লাখাং তারা মন্দিরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

(একসময় অবিভক্ত বঙ্গদেশ ছিল বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম প্রধান পীঠস্থান ও চর্চাকেন্দ্র। বঙ্গদেশে পাল বংশের প্রায় চারশো বছরের রাজত্বে বৌদ্ধ ধর্ম এখানে বিস্তার লাভ করেছিল। বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চট্টগ্রাম ছিল বৌদ্ধ ধর্ম চর্চার মূল কেন্দ্র। বঙ্গের প্রাচীন নথি পুঁথিতে অবিভক্ত বঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারের কথা জানা যায়। কিন্তু কি কারণে বঙ্গদেশ থেকে বৌদ্ধ ধর্ম ও বৌদ্ধরা নির্বাপিত হয়ে গেলেন, সেই রহস্যের উন্মোচন সন্ধানে এই লেখা।)

বঙ্গের ইতিহাস লিখতে গেলে যেমন বঙ্গদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রসঙ্গ উঠে আসে অনুরূপ অবিভক্ত বঙ্গের বৌদ্ধধর্ম আলোচনায় বঙ্গদেশের ইতিহাস সম্পর্কেও বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত উঠে আসা স্বাভাবিক। পাশাপাশি বঙ্গের ইতিহাস পর্যালোচনায় বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতি-জীবনধারার ক্রমবিকাশে বৌদ্ধধর্ম-সংস্কৃতির ব্যাপক ভূমিকাও রয়েছে। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাব সাম্প্রতিক কালের ঘটনা হলেও বর্তমানের স্বাধীন বাংলাদেশ এবং পূর্বের অবিভক্ত বঙ্গ একটি প্রাচীন সভ্যতার আবাসভূমি। সুপ্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে বাঙালি জাতির উৎপত্তি হয়েছে। যথা - আদি অস্ট্রেলীয়, মঙ্গোলীয়, দ্রাবিড়, আর্য বা ইন্দোআর্য, শক, আরব, ইরানি, আবিসিনীয়, তুর্কি, আফগান, মুঘল, পর্তুগিজ, মগ প্রভৃতি নরগোষ্ঠীর রক্ত বাঙালির ধমনীতে প্রবাহিত বলে অনুমান করা হয়। আবার এ কারণে অনেকে 'বাঙালি জাতি সঙ্কর জাতি' হিসেবে মন্তব্য করেন। বঙ্গদেশের মূল অংশ বঙ্গোপসাগর থেকে জেগে উঠেছে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই এর কিছু অংশে মানব বসতির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। হিন্দু পৌরাণিক গ্রন্থ 'মহাভারত' মতে – দীর্ঘতমা মুনি বলিরাজের অনুমতিক্রমে সুদেষ্ণার গর্ভে পাঁচটি সন্তান অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সুহ্ম। তন্মধ্যে 'বঙ্গ' নামক সন্তান বঙ্গদেশের পত্তন করেছিলেন। তবে বঙ্গ-রাজার রাজত্বের কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। এর পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী রাজারা একালের বঙ্গদেশে (অখণ্ড বাংলা) এক সময় রাজত্ব করত তার নমুনা পাওয়া যায় প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারগুলোর সূত্রে। এখন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনা অনুসারে 'উয়ারী-বটেশ্বর' নমুনাকেই প্রাচীনতম নমুনা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুযায়ী বাংলাদেশ অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠেছিলো প্রায় ৪ হাজার বছর আগে। ধারণা করা হয় দ্রাবিড় ও তিব্বতীয়-বর্মী জনগোষ্ঠী এখানে সেসময় বসতি স্থাপন করেছিল। পরবর্তীতে এই অঞ্চলটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয় এবং স্থানীয় ও বিদেশী শাসকদের দ্বারা শাসিত হতে থাকে।

বঙ্গদেশে কখন বৌদ্ধধর্ম প্রচার হয়েছিল তার সঠিক তথ্য এখনও নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে অনুমান করা হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে গৌতম বুদ্ধের সময়কাল হতেই সদ্ধর্মের আলো অবিভক্ত বাংলায় বিকীর্ণ হয়েছিল। ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, ড. নীহার রঞ্জন রায় প্রমুখ মনে করেন, অশোকের আগেই বৌদ্ধধর্ম প্রাচীন বাংলায় কোনো কোনো স্থানে বিস্তার লাভ করেছিল (মজুমদার, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২০৯; রায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৯৪-৯৬)। নলিনীনাথ দাশগুপ্ত মনে করেন, মগধ ও বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান এত কাছাকাছি যে, বুদ্ধের জীবিতকালেই মগধ হতে বৌদ্ধধর্মের ঢেউ এসে বাংলাকে প্লাবিত করা মোটেই অসম্ভব নয়। পরবর্তীতে খৃষ্টপূর্ব ৩য় শতকে সম্রাট অশোকের ধর্মাভিযানের সময় তা আরো বিস্তার লাভ করে। যদিও বা অশোক কর্তৃক ধর্মদূত প্রেরিত দেশসমূহের তালিকায় বঙ্গের নাম নেই। এছাড়া অশোকের কোনো শিলালিপিতেও (ধর্মলিপি) বঙ্গদেশের নাম পাওয়া যায়নি। তদুপরি, বৌদ্ধ ঐতিহ্য, পালি ও বৌদ্ধ সংস্কৃত সাহিত্য, প্রচলিত কিংবদন্তী, চৈনিক পর্যটকদের বিবরণ, ঐতিহাসিক ও গবেষকদের অভিমতের পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলা যায় যে, বুদ্ধের সময়কাল খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতক থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় শতকের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম বঙ্গদেশে প্রচার লাভ করেছিল এবং মৌর্য সম্রাট অশোকের সময়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। পরবর্তীতে স্থানীয় রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এটি সমগ্র বঙ্গদেশে প্রধান ধর্ম হিসেবে সুদীর্ঘকাল ছিল এবং এদেশের সমাজ, ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, সভ্যতা প্রভৃতির সামগ্রিক বিকাশে অসীম অবদান রেখেছিল।


কিন্তু কালের বিবর্তনে বৌদ্ধদের মধ্যে বুদ্ধের ধর্ম, শিক্ষা, দর্শন এবং অনুশীলনে বিভাজন-মতান্তর দেখা দিলে বঙ্গদেশও এর হাত থেকে রক্ষা পায়নি। প্রাক্-গুপ্তযুগের মেদিনীপুর জেলার তমলুক থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে খরোষ্ঠী-ব্রাহ্মী অক্ষরে উৎকীর্ণ একটি অস্থিখন্ড। খরোষ্ঠী-ব্রাহ্মী অক্ষরের লেখাটির ঐতিহাসিক অনুসন্ধান অনুসারে, প্রাক্ গুপ্তযুগে বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রতিস্থাপিত হয়েছিল (ইতিহাস অনুসন্ধান: প্রবন্ধ-প্রাক্-গুপ্তবঙ্গে বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব, সরিতা ক্ষেত্রী, ২০০০, পৃ: ৮৭-৮৮)। পরবর্তীতে খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে কুষানরাজ কণিষ্কের সময়কালে মহাসাংঘিকদের উদ্যোগে ভারতে চতুর্থ সংগীতির অধিবেশন হয়। এ সময় ত্রিপিটক সংস্কৃত ভাষায় পরিবর্তিত হয়। তখন ভারতবর্ষ এবং তার পার্শ্ববর্তী দেশ সমূহে মহাযান বৌদ্ধধর্ম শাখার ব্যাপক প্রচার-প্রসার ঘটলে অবিভক্ত বাংলায়ও এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে তা চুরাশি সিদ্ধাচার্য ও তাদের রচিত দোঁহা বা চর্যাপদ গ্রন্থ অধ্যয়নের মাধ্যমে অবগত হওয়া যায়। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পন্ডিত শীলভদ্র এবং বিক্রমশীলা মহাবিহারের প্রধান আচার্য অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান ছিলেন বঙ্গদেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁরা উভয়ে ছিলেন যথাক্রমে মন্ত্রযান এবং বজ্রযানের প্রবক্তা। খরোষ্ঠী লিপি, ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম বর্ণমালা ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী, বাংলা বর্ণমালার আদি উৎস বলে কথিত আছে। গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক কালে ধাতু পাত্রের গায়ে উৎকীর্ণ পিপরাওয়ার ব্রাহ্ম লিপিকেই আদি ব্রাহ্মী লিপি বলে মনে করা হয়।

বংশ সাহিত্য অনুসারে (মহাস্থবির, ধর্মাধার; অনুঃ শাসনবংস পৃঃ ৫৫) গৌতম বুদ্ধ বৌদ্ধত্ব লাভের আট বছর পর গবম্পতি স্থবিরের আরাধনায় অধুনা মায়ানমারের প্রাচীন রামঞ্চ রাষ্ট্রের সুধর্মপুরে উপনীত হয়ে সেখানে ধর্ম প্রচার করেছিলেন। মায়ানমারে প্রাপ্ত এক শিলালিপিতে উল্লেখ আছে, (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৫) বুদ্ধের সাথে বিশ হাজার অর্হৎ ভিক্ষু সেদেশে গমণ করেছিলেন। বুদ্ধ যদি স্বয়ং বার্মায় গমণ করে থাকেন তাহলে বুদ্ধকে অধুনা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম হয়েই যেতে হয়েছিল, কেননা তখন এটাই ছিল মায়ানমারে যাবার প্রশস্ত ও সহজ পথ। কাজেই তখন চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হওয়া স্বাভাবিক। এছাড়া, কিংবদন্তী আছে যে, বুদ্ধ স্বয়ং একবার অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চট্টগ্রামের হস্তীগ্রামে এসে পক্ষকাল অবস্থান করে ধর্ম প্রচার করেছিলেন। সেই হস্তীগ্রাম পটিয়ার হাইদগাঁও বলে পণ্ডিতগণ ধারণা করেন। এ সম্পর্কে ছোট্ট মতভেদও রয়েছে, সে মতভেদ অনুসারে বুদ্ধের আগমন ঘটেছিল হস্তিপৃষ্ঠে এবং গ্রাম হিসেবে হাইদচকিয়া গ্রাম কথিত। এখানে একটি বিহার বা কেয়্যাংও ছিল (আলম, ওহিদুল; চট্টগ্রামের ইতিহাস 'প্রাচীনকাল থেকে আধুনিককাল' চট্টগ্রাম, ১৯৮২, পৃঃ ৮)। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদও উল্লেখ করেছেন যে, বৌদ্ধরা প্রাচীন বঙ্গদেশের তথা অধুনা বাংলাদেশের আদি অধিবাসী (ইসলামাবাদ, পৃঃ ১২)। সাহিত্যসেবী পূর্ণ চন্দ্র চৌধুরীও একই মতে বিশ্বাসী। তাঁর মতে, মগধদেশ হতে বৌদ্ধধর্মের প্রচারকগণ পূর্ব দেশে এসে ধর্ম প্রচার করেন এবং চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্ম প্রাচীনতম ধর্ম (চট্টগ্রামের ইতিহাস, চট্টগ্রাম, ১৯২০, পৃঃ ২)।


খৃষ্টীয় চতুর্থ হতে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত গুপ্ত রাজবংশ বাংলা শাসন করেছিল। এর ঠিক পরেই শশাঙ্ক নামের একজন স্থানীয় রাজা স্বল্প সময়ের জন্য এ এলাকার ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হন। প্রায় একশ বছরের বিশৃঙ্খলা-অরাজকতা (যাকে মাৎস্যন্যায় পর্ব বলে অভিহিত করা হয়) দমনের জন্য বাংলার মানুষ নির্বাচনের মাধ্যমে গোপাল নামক এক সামন্তরাজাকে বাংলার রাজা হিসেবে গ্রহন করার মধ্য দিয়ে, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজবংশ বাংলার অধিকাংশের অধিকারী হন, এবং পরবর্তী চারশ বছর ধরে শাসন করেন। এসময় বাংলার সংস্কৃতির অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছিল। অতীশ দীপঙ্কর ছিলেন সে যুগের বাঙলার মনীষার এক আশ্চর্য প্রতিচ্ছবি। বারো শতকের মাঝামাঝি পাল রাজত্বের অবসানের পর দক্ষিণ ভারত থেকে আগত সেন রাজবংশ বঙ্গদেশের উপর আধিপত্য স্থাপন করে। সেন রাজারা ছিলেন নিষ্ঠাবান হিন্দু এবং এদেশে ব্রাহ্মণ ধর্মকে সুদূঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য উত্তরভারত থেকে বেশ কিছু সংখ্যক ব্রাহ্মণদের এনে তাদের বসতি স্থাপন করান। কিন্তু সনাতন হিন্দু ধর্ম বাংলাদেশে গভীরভাবে শেকড় গাড়তে পারেনি । দ্বাদশ শতকে সুফি ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে বাংলায় ইসলামের প্রবর্তন ঘটে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে সামরিক অভিযান এবং যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে মুসলিম শাসকেরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ১২০৫-১২০৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে তুর্কী বংশোদ্ভূত সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে সেন রাজবংশের পতন ঘটান। তের শতকের প্রথম দিকে মুসলিম বিজয়ের সময় পর্যন্ত বঙ্গদেশের সাধারণ মানুষের ধর্মমতে তান্ত্রিক বৌদ্ধ উপাদানের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। বস্তুত সেনবংশের শাসনামলে বাংলায় ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং জনগণ অন্ধবিশ্বাসের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। পাশাপাশি ব্রাহ্মণদের বহু শতাব্দী অবধি বপন করা জাতিভেদের বিষ-বীজ জাতিকে টুকরো টুকরো বিভক্ত করে ঘোর গৃহ-কলহ সৃষ্টি করেছিল । সেসময় অনেক বৌদ্ধতীর্থ হিন্দুতীর্থে পরিণত হয়। তখন এক ধরণের সমন্বয়ের চেষ্টা চলতে থাকে। হিন্দু-তন্ত্র ও বৌদ্ধ-তন্ত্র মিশ্রিত হয়ে ধর্মের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। সে সময়কার পরিস্থিতি এমনই শোচনীয় ছিল যে, তুর্কী সমরনায়ক ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর পক্ষে মুষ্টিমেয় সৈন্য (কথিত আছে মাত্র দু’শত সৈনিক) নিয়ে অতি সহজে বাংলা জয় করা সম্ভব হয়েছিল। ষোড়শ শতকে মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে আসার আগে পর্যন্ত বাংলা স্থানীয় সুলতান ও ভূস্বামীদের হাতে শাসিত হয়। মোঘল বিজয়ের পর ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থাপিত হয় এবং এর নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীর নগর।

জ্ঞানাচার্য অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান বাঙালির চিরগৌরব। তিনি বাঙালি সংস্কৃতির সার্থক প্রতিনিধি এবং বাঙালির জ্ঞানচর্চার পথিকৃৎ। তাঁর জন্ম হয়েছিল অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিক্রমপুরের অন্তর্গত বজ্রযোমিনী গ্রামে। তিনি সে সময়ের প্রখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত অবধূত জেতারির কাছ থেকে ব্যাকরণ ও অংক শাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী হয়ে ওঠেন। সারা জীবন জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান বিতরণে নিজেকে নিবেদন করেছেন এই মহান জ্ঞানমনীষা। বাঙালির জ্ঞানজগতের চির উজ্জ্বল বাতিঘর অতীশ দীপংকর বাঙালিকে আপন আলোয় উজ্জ্বল করেছেন। বাঙালির শৌর্য-বীর্য, যশখ্যাতি বিশ্বের মানুষকে জানিয়ে বাঙালিকে মহিমান্বিত করেছেন। জ্ঞানের দীপবর্তিকা হয়ে তিনি জগৎবাসীকে উদ্ভাসিত করেছেন আপন প্রজ্ঞামহিমায়। তিনি বাঙালিকে সবসময় আলো দেখিয়েছেন।  বাঙালির সার্থক প্রতিনিধি দীপংকর সত্যিই জ্ঞান বিতরণের মহান ব্রত পালনে সার্থকতা অর্জন করেছেন এবং বাঙালির মর্যাদা সমুন্নত রেখেছেন। দশম পাল রাজা ন্যায় পালের সময় এই প্রখ্যাত বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং পণ্ডিত বার্মা (বর্তমান মায়ানমার), শ্রীলংকা, নেপাল, তিব্বত, চীন প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করে বুদ্ধ বানী প্রচারের মাধ্যমে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। চীনা সম্রাট দীপঙ্করের পাণ্ডিত্য ও বিজ্ঞতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ‘অতীশ’ (শ্রেষ্ঠ) উপাধিতে ভূষিত করেন। তার রচিত বহু মূল্যবান গ্রন্থ ইতালির টুচি ও পণ্ডিত হরপ্রসাদ আবিষ্কার করেন। এছাড়াও বাঙালির জ্ঞানজগতে আলোক বর্তিকা দানে বৌদ্ধ মনীষা পণ্ডিত শীলভদ্র, চন্দ্রগামি, ধর্মপাল, ধর্মকীর্তি, শান্তিদেব, চন্দ্রকীর্তি, জেতারি সহ অনেকের গৌরবদীপ্ত অবদান রয়েছে। বাঙ্গালীর গৌরবরবি অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞানের অবদান সম্পর্কে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সেই অবিস্মরণীয় উক্তি -

"বাঙ্গালী অতীশ লঙ্খিল গিরি
তুষারে ভয়ংকর,
জ্বালিল জ্ঞানের দীপ তিব্বতে
বাঙ্গালী দীপংকর"।

চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম কাব্য তথা সাহিত্য নিদর্শন। নব্য ভারতীয় আর্যভাষারও প্রাচীনতম রচনা এটি। খৃষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত এই গীতিপদাবলির রচয়িতারা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ। বৌদ্ধ ধর্মের গূঢ় অর্থ সাংকেতিক রূপের আশ্রয়ে ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যেই তাঁরা পদগুলি রচনা করেছিলেন। বাংলা সাধন সংগীতের শাখাটির সূত্রপাতও এই চর্যাপদ থেকেই হয়। অসমীয়া ও উড়িয়া ভাষার সাথে অনেক মিল থাকায়, অসমীয়া এবং উড়িয়া ভাষারও আদি নিদর্শন হিসেবে দাবী করেন অনেক ভাষা পন্ডিত। একে চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, চর্যাগীতিকোষ বা চর্যাগীতি নামেও অভিহিত করা হয়। বৌদ্ধ ধর্মমতে এর বিষয়বস্তু সাধন ভজনের তত্ত্ব প্রকাশ। চর্যাপদের তিব্বতীয় ভাষার অনুবাদটি ‘Tibetan Buddhist Canon’ বা ‘তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ’ হিসেবে সংরক্ষিত। এই বিবেচনায় এটি ধর্মগ্রন্থজাতীয় রচনা। একই সঙ্গে সমকালীন বাংলার সামাজিক ও প্রাকৃতিক চিত্রাবলি এই পদগুলিতে উজ্জ্বল। এর সাহিত্যগুণ আজও চিত্তাকর্ষক। কলকাতার সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বহু ভাষাবিদ, সাহিত্যিক ও ইতিহাসবিদ পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবার লাইব্রেরির পুঁথিশালায় ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে ১৯০৭ সালে বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণসম্ভার ভূর্জপত্রে (তালপাতা) হাতে লেখা চর্যাপদের পুঁথি 'চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়' খুঁজে পান। এ চর্যাগীতির ভাষা বিশ্লেষণ করে তিনি প্রমাণ করেন, এটি বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন, যা হাজার বছরের পুরনো। এটি এখন সে যুগের এ অঞ্চলের ধর্মীয়, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনাচারের প্রামাণিক দলিল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পাশাপাশি 'চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়' শুধু বাংলা ভাষার উৎপত্তির দিক থেকেই মহামূল্যবান নিদর্শন নয়, উপমহাদেশের আরো কয়েকটি ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীও এর উত্তরাধিকার দাবি করছে। পরবর্তীতে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে চর্যাপদের সঙ্গে বাংলা ভাষার অনস্বীকার্য যোগসূত্র বৈজ্ঞানিক যুক্তিসহ প্রতিষ্ঠিত করেন।

সিদ্ধাচার্যদের মধ্যে অনেকের জন্মস্থান অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন জনপদে। চর্যাপদ বা চর্যাগীতি রচয়িতা সিদ্ধাচার্যদের মধ্যে লুইপাদ (পশ্চিমবঙ্গ), কাহ্নুপাদ (পশ্চিমবঙ্গ), জালন্ধরীপাদ (চট্টগ্রাম), ধর্মপাদ (বিক্রমপুর), বিরুপাপাদ (কুমিল্লা), ডোম্বীপাদ (কুমিল্লা), চাটিলপাদ (চট্টগ্রাম), তিলোপাদ (চট্টগ্রাম), নারোপাদ (চট্টগ্রাম), গোরক্ষপাদ (কুমিল্লা), চৌরঙ্গীপাদ (কুমিল্লা), মীননাথ (বরিশাল), সহ অনেকেই ছিলেন বাঙালি। বর্তমানে বাংলাদেশের  কুমিল্লার শালবন বিহারকে আজও সেখানকার স্থানীয় লোকেরা বলে হাড়িপা সিদ্ধার বাড়ি।  অনেকে বলে গোরক্ষ সিদ্ধার বাড়ি, আবার কেউ বলে চৌরঙ্গী সিদ্ধার বাড়ি। এই সিদ্ধাচার্যরাই বাংলাদেশে অবস্থিত সোমপুরী, শালবন, বিক্রমপুরী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিত হিসেবে  জ্ঞানচর্চায় নিবেদিত ছিলেন বলে জানা যায়।
বর্তমানে বঙ্গদেশের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীকে শ্রেণী ও স্থানগত অবস্থান বিবেচনায় চার ভাগে ভাগ করা যায়। এদের অধিকাংশই অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বাসিন্দা। যথা-

(ক) সমতলীয় বাঙালি বৌদ্ধ - বাংলাদেশের কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী এবং কুমিল্লা জেলায় সমতলীয় বাঙালি বৌদ্ধরা বাস করেন।

(খ) পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী বা উপজাতীয় বৌদ্ধ - বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি পার্বত্য চট্টগ্রামের এ তিন জেলায় মূল অধিবাসীরা হল দশ ভাষাভাষি এবং চাকমা, মগ বা মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, বম বা বনযুগী, চাক, মুরং, লুসাই, খুমী, কুকি, রিয়াং, পাংখো ও খিয়াং সহ তেরটি আদিবাসী জাতিসত্বা। তাঁরা সুদীর্ঘ কাল থেকে এখানে বসবাস করে আসছেন।  ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসী জনগোষ্ঠৗরা এক সময় ছিলেন অধিকাংশ বৌদ্ধধর্মের অনুসারী।

(গ) সমতলীয় রাখাইন বৌদ্ধ - সমতল রাখাইন বৌদ্ধরা বাংলাদেশের সমতল ভূমি বৃহত্তর চট্টগ্রামের কক্সবাজার, মহেশখালী, রামু, চকরিয়া, টেকনাফ, হারবাং, হ্নীলা, চৌফলদন্ডী, বাজালিয়া, মানিকপুর এবং পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার আমতলী, বরগুনা, গলাচিপা, কলাপাড়া ইত্যাদি উপজেলায় বসবাস করেন। তাঁরা মঙ্গোলীয় নৃগোষ্ঠীভুক্ত থেরবাদী বৌদ্ধধর্মের সমর্থক।

(ঘ) উত্তর বঙ্গের আদিবাসী বৌদ্ধ - উত্তর বঙ্গের আদিবাসী বৌদ্ধরা দিনাজপুর, রাজশাহী, নওগাঁ, জয়পুরহাট, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, পঞ্চগড়, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, সিলেটের হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার এবং গাজীপুর জেলার শ্রীপুরে বাস করেন।

ইতিহাস অধ্যয়নে জানা যায়, মহাভারতের যুগে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো সমুদ্রগর্ভ হতে উঠেছিল এবং তিবেতো বার্মানগণ বর্তমানে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন জাতি। শারীরিক বৈশিষ্ট্য এবং কর্মক্ষমতার দিক দিয়ে বাংলাদেশর পাহাড়িয়া জাতিদী অধিকাংশকে 'তিবেতো বার্মান' বলে অভিহিত করা হয়। তন্মধ্যে চাকমা জাতি বর্তমান ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত চম্পক নগরের অধিবাসী হিসেবে পরিচিত। চম্পক হতে চাকমা জাতির উদ্ভব। আবার কোন কোন পণ্ডিতের মতে, আরকানীয় শাক্যবংশকে 'চাকমাং' (চাক্ অর্থ শাক্য এবং মাং অর্থ রাজবংশ) এবং কালক্রমে চাকমাং রূপান্তরিত হয়ে 'চাকমা' হয়েছে।

নবম শতাব্দীর শেষভাগে আরাকানরাজ 'ন্যা-সিং-ন্যা-নৈ' ৯৯৪-৯৫ খৃষ্টাব্দে চাকমাগণের সাহায্যে চট্টগ্রাম অধিকার করেন। এরপর হতে আরাকান রাজবংশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেখতে পাওয়া যায়। একাদশ শতাব্দী মধ্যভাগে ব্রহ্মদেশের একটি রাজ্য পঁগা বা অরিমর্দনপুর আরাকানের উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। তৎকালে ব্রহ্মদেশে মোগং বৃহত্তম রাজ্য ছিল। কিন্তু রাজা অনরটার অধীনে এদিকে পঁগাও বিশেষ ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। রাজা অনরটা আরাকান দখল করে চট্টগ্রাম অধিকার করেন। আরাকানের অধিবাসীবৃন্দ তথা মোগংরাজ্যের অধিবাসীবৃন্দ এই 'মাগং' শব্দ হতে 'মোগ' অপভ্রংশে 'মগ' শব্দে পরিচিত।

অবিভক্ত বঙ্গে বৌদ্ধ ধর্ম চর্চার মূল কেন্দ্র ছিল বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চট্টগ্রাম। রাজা থুরথুনকে ৯৫৩ খৃষ্টাব্দে আরকানরাজ ষোলসিংহ চন্দ্র নিজ রাজ্যের উপকণ্ঠে পরাজিত করে চট্টগ্রাম অধিকার করেন এবং বিজয় স্মৃতি চিহ্ন স্বরূপ তিনি একটি প্রস্তর বিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করেন। এই বিজয় স্তম্ভে - 'চিৎ-ত-গৌং' (চিৎ-ত-গৌং শব্দের অর্থ যুদ্ধলব্ধ স্থান) লিপিবদ্ধ ছিল। পণ্ডিতদের অনেকের মতে,  চিৎ-ত-গৌং শব্দ হতে চট্টগ্রাম নামের উদ্ভব হয়েছে। বকতিয়ার খিলজি কর্তৃক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের পূর্ব হতে নবম শতাব্দীতে চট্টগ্রাম বৌদ্ধধর্ম চর্চার প্রধান কেন্দ্রস্থান ছিল। চীনা পরিব্রাজক 'হিউয়েন সাঙ' এর ভারত ভ্রমণ বৃত্তান্তে জানা যায়, সেসময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য 'চৈত্যগ্রাম' (চৈত্য শব্দের অর্থ - বৌদ্ধ বিহার এবং গ্রাম শব্দের অর্থ - সমূহ) নির্মিত হয়েছিল। আবার কোন কোন পণ্ডিতের মতে, এ চৈত্যগ্রাম হতে চট্টগ্রাম শব্দের উৎপত্তি।

চট্টগ্রামের অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য এবং কারুকার্য খচিত সুশোভিত অসংখ্য চৈত্যগ্রাম সকলকে আকর্ষণ করত। এ সময়ে মহাযান সম্প্রদায় কর্তৃক বৌদ্ধ গ্রন্থাদিতে চট্টগ্রামকে 'রম্য ভূমি ও পণ্ডিত বিহার' নামে উল্লেখ করা হয়েছে। এ পণ্ডিত বিহার তৎকালীন পালবংশীয় রাজন্যবর্গের রাজত্বকালে পূর্ববঙ্গের প্রধান বিহার। তৎকালে পণ্ডিত বিহারের নামানুসারে চট্টগ্রামের সমগ্রস্থানকে নির্দেশ করলেও এটি চট্টগ্রামের কোন স্থানে অবস্থিত তা প্রত্নতত্ত্ববিদগণের খনন কার্য ব্যতীত সঠিক নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। তবে কোনও কোনও পণ্ডিতগণের মতে, এ পণ্ডিত বিহার ছিল কর্ণফুলী নদীর তীরে আনোয়ারা অন্তর্গত বটতলায় নিকটবর্তী ঝিয়রী গ্রামে অর্থাৎ আনোয়ারা থানার দেয়াং পাহাড়ে। কিন্তু ঐতিহাসিকের ধারণা, অন্দরকিল্লার রংমহল পাহাড় ও জুম্মা মসজিদ সংলগ্ন অঞ্চলেই এ পণ্ডিত বিহার অবস্থিত ছিল। ইংরেজ রাজত্বকালে আন্দরকিল্লার জেনারেল হাসপাতাল নির্মাণের সময় সেখানে একটি বুদ্ধমূর্তি পাওয়া যায়, যেটি অদ্যাপি চট্টগ্রাম নন্দন কানন বৌদ্ধ বিহারে সংরক্ষিত রয়েছে।

চট্টগ্রামের ইতিহাস লেখক পূর্ণচন্দ্র চৌধুরী'র বর্ণনায় প্রথম খৃষ্টাব্দের প্রারম্ভে মগধদেশ হতে মহাযান বৌদ্ধধর্ম প্রচারকগণ পূর্ববঙ্গে এসে ধর্মপ্রচার করেন। সুতরাং, বৌদ্ধধর্মই চট্টগ্রামের প্রাচীনতম ধর্ম। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের পর দেবরাজগণের সময় চট্টগ্রামের পণ্ডিত বিহার বৌদ্ধধর্ম চর্চার প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠে। পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানের পণ্ডিতগণ এই পণ্ডিত বিহারে এসে ধর্মচর্চায় নিয়োজিত হন। তন্মধ্যে - নাড়পাদ, লুইপাদ, অঙ্গবজ্র তঘন, সবরিপদ, অবধুদপদ, নানাবোধ, জ্ঞানবজ্র, বুদ্ধজ্ঞানপ্রদ, অমোঘনাথ, ধর্ম-শ্রীচৈত্র  ইত্যাদি নাম উল্লেখযোগ্য। ত্রয়োদশ শতকের ধ্বংসলীলা ক্রমে ওদন্তপুর, বিক্রমশীলা, সোমপুর, ময়নামতী, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড় , জগদ্দল, কণকস্তূপ প্রভৃতি বিহার ভস্মীভূত করে সপ্তদশ শতকে পণ্ডিত বিহার ধ্বংস করা হয়।
ওদন্তপুর, বিক্রমশীলা, সোমপুর, ময়নামতী, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, জগদ্দল, কণকস্তূপ ধ্বংসাবেশ এবং প্রাপ্ত কিছু প্রত্নসামগ্রীর খণ্ডচিত্র আজও বিদ্যমান। এসব আজ বাংলার কৃষ্টি-ঐতিহ্য এবং বৌদ্ধধর্মের স্বর্ণযুগ ও আধিপত্যের সাক্ষী হয়ে রয়েছে।

পাল সাম্রাজ্যের পতনের পর দ্বাদশ শতাব্দীতে সেন রাজবংশের অভ্যূত্থান হয়। সেন আমলে বৌদ্ধ, বৌদ্ধমঠে ধ্বংসলীলার সূত্রপাঠ হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে তুর্কী বীরেরা ওদন্তপুরী, নালন্দা, বিক্রমশীলা, বঙ্গদেশ প্রভৃতি জয় করার পর সমস্ত মূর্তি ও অগণিত আদর্শ শিল্পকলা ধ্বংস, শত শত ভিক্ষুকে শিরচ্ছেদ করে বখতিয়ারের নেতৃত্বে, গ্রন্থসমূহ ভস্মসাৎ করা হয় এবং ধ্বংস করা হয় শতাধিক কলা-কৌশলের নমুনা। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ঐতিহাসিক শ্রী রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় প্রণীত বাংলার ইতিহাস দ্বিতীয় ভাগে এবং খ্যাতনামা লেখক মীন-হাজ-উস-সিরাজী বিরচিত তবকৎ-ই-নাসীরী নামক সুবৃহৎ গ্রন্থের ৫৫০ পৃষ্ঠায় বিবরণ পাওয়া যায়।

এভাবে উপর্যুপরি পুনঃপুনঃ মর্মান্তিক বৌদ্ধ নির্যাতন ও বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলি সমূলে ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে বৌদ্ধদের রাজকীয় ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা হয়। এ কারণে দেখা যায়, ধ্বংসপ্রাপ্ত বৌদ্ধ বিহারের সংলগ্ন অঞ্চলে বড় বড় মুসলমান বসতি গড়ে উঠেছে। ওদন্তপুর বিশ্ববিদ্যালয় বিহারশরিফে পরিণত হয়। সোমপুর, জগদ্দল সর্বত্র মুসলিম প্রধান অঞ্চলে পরিণত হয়। পক্ষান্তরে চণ্ডীদাসের ন্যায় অনেকে হিন্দু হয়ে যান। তখন দেখা যায় যে বাঙ্গলার অর্ধেক বৌদ্ধ মুসলমান হয়ে গেল এবং অপর অর্ধেক ব্রাহ্মণের শরণাপন্ন হল, আর বৌদ্ধদের মধ্যে যারা নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করল, মুসলমান ও ব্রাহ্মণ উভয় পক্ষ হতে তখন তাদের উপর নির্যাতন চালানো হল।

সেসময় কিছুসংখ্যক বৌদ্ধ নেপাল ও তিব্বতে পলায়ন করেন। আর মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত বৈশালীর বর্জি বংশীয় এক ক্ষত্রিয় রাজপুত্র বহুসংখ্যক অনুচরবৃন্দসহ মগধ সাম্রাজ্য হতে প্রাণভয়ে পলায়ন করে আসাম, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন। মগধের বর্জিবংশ সম্ভূত 'বর্জি' শব্দ হতে 'বড়ুয়া' শব্দের উৎপত্তি। বড়ুয়া জাতি মগধের বর্জি বংশীয় ক্ষত্রিয় জাতি। বর্জি শব্দের অর্থ বড়ুয়া বা উৎকৃষ্ট। আবার বড়ুয়া শব্দের উৎপত্তি সম্বন্ধে কোনও কোনও পণ্ডিতের মতে, ভগবান বুদ্ধ দুঃখ মুক্তির লক্ষ্যে যে সত্যপথ প্রদর্শন করেছেন তা হল পালিতে - 'অরিয সচ্চং'; বাংলায়- 'আর্যসত্য' । যারা বুদ্ধের দেশিত ধর্ম তথা আর্যসত্য গ্রহণ করেন, তারা বড় আর্য (বুদ্ধের উপাসক বা শিষ্য) নামে অভিহিত হন। এ 'বড় আর্য' হতে বড়ুয়া শব্দের উৎপত্তি। ত্রিপুরার রাজাদের ইতিহাস 'রাজমালা'-তে বড়ুয়া জাতির উল্লেখ রয়েছে। সেকালে পার্বত্য প্রধানগণ তাদের অধীনস্থ প্রজাগণের নায়করূপে নির্বাচিত হতেন এবং তাদের সর্দার, হাজারী ও বড়ুয়া  উপাধিতে ভূষিত করতেন।

"বিজয়মাণিক্য রাজার জমিদার আমি,
সে রাজার বড়ুয়া হৈয়া রাজা হৈলা তুমি"। - (রাজমালা, ১২০ পৃঃ)

সাহিত্যসেবী দ্বিজেন্দ্র নাথ ঠাকুর তাঁর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ১৮৯৪ খৃষ্টাব্দে চৈত্র সংখ্যায় উল্লেখ করেন -

"দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বৌদ্ধরা অমানুষিক নিষ্ঠুর অত্যাচার সহ্য করে মগধ সাম্রাজ্য পরিত্যাগ করে এদেশে আরাকান বৌদ্ধরাজার আশ্রয় গ্রহণ করে"।

আরাকানী মগদের সঙ্গে বসবাস করার ফলে তাদের সাথে পরস্পর সৌহৃদ্যতা উঠে । এর ফলে বড়ুয়া বৌদ্ধদের মাঝেও মগানাম প্রচলিত হয়। যেমন - চাইলপ্রু বড়ুয়া, ছাদপ্রু বড়ুয়া, কেওজপ্রু বড়ুয়া ইত্যাদি। আবার সুদীর্ঘ কালের সম্পর্ক হেতু আজও বহু আরকানী শব্দ বাঙ্গালী বৌদ্ধ সমাজে মাতৃভাষারূপে ব্যবহৃত হচ্ছে। শব্দগুলি প্রায়ই ধর্মীয় সংস্কৃতিমূলক । যেমন -
কেয়াং = বিহার,
ফাং = নিমন্ত্রণ,
ছোয়াইং = ভাত (পিণ্ডদান),
থাগা = গৃহী উপাসক,
কারেঙ্গা = সেবক,
মইসাং = শ্রামণের,
চনী = অস্থায়ী শ্রামণের,
ছাদাং = ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত আরম্ভ ও পরিসমাপ্তির দিন,
থাংথুং = স্তুপাকৃতি অন্ন,
ঘেইং = ভিক্ষু সীমা,
ছাবাইক = ভিক্ষাপাত্র,
চাঁই = চীবর,
ফারিক = সূত্রপাঠ,
ভং = বড় ঘন্টা,
লোথক = ভিক্ষু ধর্ম পরিত্যাগী, গৃহী ইত্যাদি।

পাশাপাশি, মুসলমান রাজত্বকালে মুসলমানদের সাথে সুদীর্ঘকাল মেলামেশার ফলে বড়ুয়া সমাজে বিভিন্ন ফরাসী শব্দও ঢুকে পড়ে। অদ্যাবধি এসব শব্দের
গোছল = স্নান;
ঘরছালামী = বৈবাহিক অনুষ্ঠানে গৃহদেবতা, বয়ঃবৃদ্ধ-বৃদ্ধাদিগকে নমস্কার করা;
পানছল্লা = নিমন্ত্রণ করার পূর্বে সুশৃঙ্খলতার সাথে কর্মপরিধি প্রণয়ন-আলোচনা করার সামাজিক বৈঠক
ইত্যাদির প্রচলন দেখা যায়। আরাকানী বৌদ্ধরা বাঙ্গালি বৌদ্ধদের ব্রহ্মভাষায় 'মার্মাগ্রী' (মার্মাগ্রী শব্দের অর্থ উচ্চবংশীয় ক্ষত্রিয় বৌদ্ধ) বলে সম্বোধন করত। আবার এ রাজবংশের ক্ষত্রিয়গণ 'মগধ সাম্রাজ্য দেশাগত' বলে তাদের সংক্ষেপে 'মগ' নামেও অভিহিত করত। এর পক্ষে যুক্তি হচ্ছে - মগধ সাম্রাজ্য দেশাগত বড়ুয়াগণ (মগগণ) তাদের পৈতৃক দেশমাতার স্মৃতিকল্পে-স্মরণার্থে পাঁঠি বলি দিয়ে মগধেশ্বরীর সেবা-পূজা। ভিন্নরূপে হলেও অদ্যাবধি প্রায় বৌদ্ধগ্রামে এক একটি সেবা খোলা রয়েছে। উপাসনাকালে 'আয়রে মা মগধ রাজার ঝি' ইত্যাদি বলে নিঃসন্তানের সন্তান লাভ এবং ভূত-প্রেতাদি তাড়াবার মন্ত্র জপ করত। পাশাপাশি, এখনও বিভিন্ন বড়ুয়া বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকাকে 'মগ পাড়া' এবং বাজারকে 'মগের (মইগ্যের) হাট/বাজার' ইত্যাদি রূপে সম্বোধন শ্রুত-দৃষ্ট হয়।

আরাকান রাজার রাজত্বকালে পর্তুগীজ বণিকেরা চট্টগ্রাম বাণিজ্য করার মধ্য দিয়ে সেখানে বসতি স্থাপন করে। তারা নৌবিদ্যা বিশারদ বলে আরাকানরাজ তাদের নৌসৈন্যে ভর্তি করেন। ১৬৬৬ খৃষ্টাব্দে বাংলার নবার সায়েস্তা খান কর্তৃক সর্বশেষ আরকানরাজ পরাজিত হলে অধিকাংশ আরাকানী স্বদেশে চলে যায়। এবং যে কিছু সংখ্যক আরাকানী স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেননি তাদের বংশধরগণ কক্সবাজার, রামু, নীলা, টেকনাফ, হারবাং প্রভৃতি স্থানে এবং বরিশাল ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় বসবাস করতেন। এ সময় চট্টগ্রামের পণ্ডিত বিহার সমূলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং রাষ্ট্র বিপ্লবে বৌদ্ধগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ার ফলে আবার বৌদ্ধধর্মে পরিহানি চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে। তবে তদানীন্তন মুসলমান শাসনামলে অনেক বৌদ্ধদের উচ্চ রাজকর্মচারীর পদেও অধিষ্ঠিত করা হয়েছিল।

সমগ্র বঙ্গদেশে বৌদ্ধদের মধ্যে মুৎসুদ্দী (যারা স্টেটের ম্যানেজার ছিলেন, তাদের পদবী ছিল মুৎসুদ্দী), তালুকদার (ভূমির রাজস্ব আদায়ের জন্য ভূমিখণ্ড তালুক ও তরফে বিভক্ত করা হয়। যাদের তালুক (ভূ-সম্পত্তি) ছিল, তাদের পদবী ছিল তালুকদার),
চৌধুরী (যাদের তরফ (জমিদারির অংশ) ছিল তারা হলেন তরফদার বা জমিদার। এই তরফদারের পদবী ছিল চৌধুরী বা ভূইঞা),
শিকদার (বিভাগীয় রাজস্ব আদায়কারী বলে শিকদার পদবী। এর অন্য অর্থ- সর্দার।), সিংহ (ক্ষত্রিয় জাতির উপাধি ছিল সিং বা সিংহ। ক্ষত্রিয় শাক্যকুল তথাগত গৌতম বুদ্ধের প্রবর্তিত বৌদ্ধধর্মে ক্ষত্রিয়গণ শরণাগমন করলেও পূর্ব বংশগত ঐতিহ্য সিং বা সিংহ পরিত্যাগ না করায় বর্তমানেও বৌদ্ধদের মধ্যে সিং বা সিংহ পদবী পরিদৃষ্ট), হাজারী (এটি সামরিক বিভাগের পদবী। এক হাজার সৈন্যের অধিনায়ককে হাজারী পদবী/উপাধিতে ভূষিত করা হত। এই পদবীধারী বৌদ্ধ নোয়াখালীতে পরিদৃষ্ট হয়।) উপাধির (যা কালক্রমে পদবিতে পরিণত হয়েছে) প্রচলন দেখতে পাওয়া যায়। এগুলি মুসলিম শাসক দ্বারা প্রদত্ত উপাধি। এছাড়াও উত্তরবঙ্গের আদিবাসী বৌদ্ধদের মধ্যে টিকরি, কুজর, মিনজু, টোপোর বা টোপ্প, এক্কা, লাকড়া সহ বিভিন্ন পদবী বর্তমানে পরিদৃষ্ট হয়।

কোন এক অশুভ সময়ে বৌদ্ধধর্মাচার্যদের মধ্যে বিবাহপ্রথা প্রচলিত হল, তা এখনও অজ্ঞাত। বাংলার প্রাচীন সাহিত্য আলোচনায় আউল, বাউলদের ন্যায় 'রাউল' নামে একটি পুরোহিত সম্প্রদায় 'গোর্থবিজয়' গ্রন্থেও পরিদৃষ্ট হয়। এসকল পুরোহিতেরা বৌদ্ধসমাজে লক্ষ্মীপূজা, সরস্বতীপূজা, কার্তিকপূজা, শিবপূজা, শীতলাপূজা, শনিপূজা, অশ্বিনী কুমারদ্বয়ের (নাসত্য ও দস্র) ব্রত উপবাস, সত্যপীরাদির সিন্নিদান প্রথা প্রভৃতি অবৌদ্ধোচিত কার্যকলাপ এমনকি কালীপূজা, দুর্গাপূজা, মনসাপূজা প্রভৃতিতে পশুবলিও নিজ হাতে সম্পাদন করত। পরবর্তীতে থেরবাদের সংস্পর্শে এসে তারা বিবাহ ও পশুবলি প্রথা ত্যাগ করলেন। কিন্তু এসকল রাউলী পুরোহিতেরা থেরবাদ ভিক্ষু হতে দীক্ষা গ্রহণ করলেও সপ্তাহকাল দশশীল পালন করে, অতঃপর গৃহী হয়ে কাষায়বস্ত্র ঘরে রাখতেন এবং গৃহস্থালী সমস্ত কার্যাদি সম্পন্ন করতেন। আর ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময় কাষায়বস্ত্র কণ্ঠে জড়িয়ে পৌরোহিত্য করতেন। পরবর্তীকালে ভিক্ষুদের মধ্যে তিনটি শ্রেণী ছিল। যথা:
১) মাথে - নিমন্ত্রণে যাওয়ার সময় মাথেগণ বৃহৎ ছত্রধারণ করে যেতেন।
২) কামে - কামেগণ হুতুক পরিতেন।
৩) পাঞ্জাং - এবং পাঞ্জাংগণ মস্তক বস্ত্রাবৃত করে যেতেন।
তাঁরা শ্রামণেরকে সীমায় নিয়ে কর্মবাক্য পাঠে উপসম্পদা দিতেন বটে, কিন্তু সীমা হতে বিহারে এসে দশশীল প্রদান করতেন। এ প্রেক্ষিতে এটা প্রতীয়মান যে, তদানীন্তন রাউলী পুরোহিতদের কারো থেরবাদ উপসম্পদা ছিল না। এতটুকু বলা যায়, তাঁরা ছিলেন দশশীলধারী শ্রামণের মাত্র।

রাউলীদের পাশাপাশি ওঝা-বৈদ্যের প্রভাবে সমগ্র বৌদ্ধ সমাজের উপর নেমে আসে এক চরম বিপর্যয়। বৌদ্ধদের এমন তমসাচ্ছন্ন সন্ধিক্ষণে দেবদূতের মতো সংঘরাজ সারমেধ মহাথেরো’র আবির্ভাবে বাংলার মাটিতে সদ্ধর্মের পুনরুত্থান ঘটে। সংঘরাজ সারমেধ মহাথেরো চকরিয়ার হারবাং গ্রামে এক রাখাইন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বিভিন্ন গ্রন্থে, সংঘরাজ সারমেধ মহাথেরো আরাকান রাজ পরিবারের বংশধর হিসেবে পরিদৃষ্ট হয়। শৈশবে তিনি আরাকানে গমন করে থেরবাদ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিয়ে ত্রিপিটক শাস্ত্রের অগাধ পান্ডিত্য অর্জন করার পর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে তিনি সদ্ধর্মের আলোক মশাল ধারণ করে সমগ্র বৌদ্ধ সমজের তান্ত্রিক মতের অসারতা এবং দেব-দেবীর পূজা, পশুবলির বিরুদ্ধে প্রচার চালান। যার ফলে বৌদ্ধ সমাজ থেকে ধীরে ধীরে অন্ধ কুসংস্কার তিরোহিত হতে থাকে। পূণ্যশীলা চাকমা রাণী কালিন্দী সংঘরাজ সারমেধ মহাথেরো’র সদ্ধর্ম দেশনায় আকৃষ্ট হয়ে ‘থেরবাদ বৌদ্ধধর্মে’ দীক্ষিত হন। সারমেধ মহাথেরো'র ধর্মাচরণে ও বিনীত ব্যবহারে রাণী কালিন্দী এতই শ্রদ্ধা সম্পন্ন হন যে, তিনি ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দে ‘রাজ পুণ্যাহ’ উপলক্ষে মহা সমারোহে আরাকানী ভাষায় উপাধি যুক্ত সীলমোহর প্রদানের দ্বারা গুরুর প্রতি অকৃত্রিম সন্মাননা জ্ঞাপন করেন।

১৮৬৪ খৃষ্টাব্দে সংঘরাজ সারমেধ মহাথেরো চট্টগ্রামে মহামুনির পূর্ব পার্শ্বে হাঞ্চরঘোনা নামক এক পার্বত্য ছড়ায় প্রথম বিনয় সম্মত উপসম্পদার আয়োজন করেন। এতে সাতজন রাউলী পুরোহিত পাহাড়তলী গ্রামের জ্ঞানালঙ্কার মহাথেরো (প্রকাশ লালমোহন ঠাকুর) ও কমল ঠাকুর, ধর্মপুরের হরিঠাকুর, মির্জাপুরের সুখচাঁন ঠাকুর, গুমানমর্দনের দুরাজ ঠাকুর, দমদমার অভয় শরণ ঠাকুর, বিনাজুরীর হরি ঠাকুর থেরবাদ সম্মতভাবে উপসম্পদা গ্রহণ করেন। এঁদের উপসম্পদা গ্রহণের মাধ্যমে বাংলার থেরবাদ বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘ পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয়। সংঘরাজ সারমেধ মহাথেরো’র প্রতিষ্ঠিত ভিক্ষু সংঘকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের মাটিতে যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করেন অনেক ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। তাঁদের পূণ্য হস্ত স্পর্শে গড়ে উঠে বহু জন হিতকর প্রতিষ্ঠান এবং অনেক ভিক্ষু সশিষ্যে মহাযানী ও তন্ত্রযানী মতবাদ বাংলাদেশ হতে অন্তর্হিত হবার মধ্য দিয়ে থেরবাদ বা হীনযান মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়।

বঙ্গদেশের বৌদ্ধ সমাজে বিনয় বহির্ভূত বহু অবৌদ্ধচিত প্রথা ছিল যা পূর্বোক্ত আলোচনায় পরিদৃষ্ট। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সংঘরাজ পণ্ডিত প্রবর বিনয়ধর সারমেধ মহাথেরো'র নেতৃত্বে ১৮৬৪ খৃষ্টাব্দে বিনয় সম্মত নতুন উপসম্পদা প্রদানে এদেশে থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। নতুন উপসম্পন্ন ভিক্ষুসংঘের নাম হল 'সংঘরাজ নিকায়' এবং রাজগুরু সারমেধ মহাথেরো হলেন এ সংঘরাজ নিকায়ের প্রথম সংঘরাজ। সংঘরাজ নিকায় প্রতিষ্ঠার পর তিনি আরাকানে প্রত্যাবর্তন করেন। এদিকে যেসকল ভিক্ষু-রাউলী-মাথে প্রভাব-প্রতিপত্তি-বর্ষাবাস অক্ষুন্ন রাখার জন্য বিনয়সম্মতভাবে সংঘরাজ সারমেধ মহাথেরো'র নেতৃত্বে পুনরায় উপসম্পদা গ্রহণের সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করে পৃথক রয়ে গেলেন, সে সকল ভিক্ষুসংঘের নাম হল 'মাথের দল বা মহাস্থবির নিকায়'। আর সেই হতে নিকায়ভেদের বিষবৃক্ষ অদ্যাবধি বৌদ্ধ সমাজে বিষফল প্রদান করে চলেছে!

বঙ্গদেশের অতীত ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় বৌদ্ধধর্মের আধিপত্যের যুগ। উত্তর ও মধ্য ভারতে লাখ লাখ বৌদ্ধ নিধনের প্রেক্ষাপটে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সেখান থেকে এই (অবিভক্ত) বাংলায় সরে আসতে বাধ্য হন। এভাবেই এই বাংলায় সূচনা হয় বৌদ্ধধর্মের স্বর্ণযুগের। প্রায় হাজার বছর অবিভক্ত বঙ্গদেশ ছিল সারা পৃথিবীর বৌদ্ধধর্মের পুণ্যতীর্থ। ময়নামতী, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড় প্রভৃতি সে ইতিহাস ধারণ করে আছে। সবদিক বিবেচনায় বাংলায় বৌদ্ধ, বৌদ্ধধর্মের অবদান শীর্ষস্থানীয়। আর বাংলার মাটির নিচে আজও লুকিয়ে রয়েছে বৌদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য; লুকিয়ে রয়েছে বাংলার অমূল্য সম্পদ। তদুপরিও বাংলাদেশী বৌদ্ধদের উপর নির্যাতন প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে নিয়ত বিরাজমান। পাক-ভারত উপমহাদেশ থেকে বৃটিশ সাম্রজ্যবাদ আন্দোলন-সংগ্রামের মুখে বিদায় নেয়ার সময় সুকৌশলে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে। হিন্দু প্রধান অঞ্চলকে ভারত ও মুসলমান প্রধান অঞ্চলকে পাকিস্থান নামক রাষ্ট্রে বিভক্ত করে। পাকিস্থান রাষ্ট্রে পূর্ব পাকিস্থান তথা পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্থান অংশে বিভক্ত করে। সেসময় পার্বত্য অঞ্চলে ৯৮% অমুসলিম (বৌদ্ধ, হিন্দু এবং খ্রিষ্টান) ছিল যাদের সিংহ ভাগই ছিলেন বৌদ্ধ। কিন্তু পার্বত্য অঞ্চলে বহিরাগত বাঙ্গালিদের অবস্থান, জমি দখল, নির্যাতনের মধ্য দিয়ে পর্যায়ক্রমে ১৯৭১ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পার্বত্য অঞ্চলে ৬% মুসলিম এবং ২০১১ সালে তা বেড়ে  ৬৫% হয়! আদিবাসী নিধনে ১৯৮০-৯০ সালে তেরটি গনহত্যায় প্রায় ১৫০০০ আদিবাসী মারা যায় আর প্রায় ৭০০০০ মানুষ দেশান্তরী হয় । পাশাপাশি রাজনৈতিক ডামাডোলে খ্রিস্টান মিশনারিরা সাধারণ মানুষের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মান্তরিত করার প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত (বর্তমানেও)। এভাবে পর্যায়ক্রমে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বঙ্গের বৌদ্ধরা আদিবাসী হতে উপজাতি, উপজাতি হতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠিতে এসে ঠেকেছে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৃথিবীর এই হিংসা-বিক্ষুদ্ধ অবস্থা দেখে বুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে কবিতায় লিখেছিলেন -

"হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী হেথা নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব,
হেথা ঘোর কুটিল পন্থ তার লোভ জটিল বন্ধ।
নতুন তব জনম লাগি কাতর যত প্রাণী
কর ত্রাণ মহাপ্রাণ, আনো অমৃত বাণী।
বিকশিত করো প্রেম পদ্ম চিরমর্ধ নিস্যন্দ
শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্ত পুণ্য।
করুণাঘন ধরণীতল কর কলংকশূন্য।"

(তথ্যসূত্র:
১ - সদ্ধর্মের পুনরুত্থান - ধর্মাধার মহাস্থবির।
২ - চট্টগ্রামের বৌদ্ধ জাতির ইতিহাস - নূতন চন্দ্র বড়ুয়া।
৩ - বাঙালি বৌদ্ধদের ইতিহাস ধর্ম ও সংস্কৃতি - ড. দীপংকর শ্রীজ্ঞান বড়ুয়া।
৪ - প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট - সুনীল চট্টোপাধ্যায়।
৫- চট্টগ্রামের ইতিহাস - পূর্ণচন্দ্র চৌধুরী।
৬ - বাংলার বৌদ্ধ ইতিহাস- ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি - শিমুল বড়ুয়া।
৭- উইকিপিডিয়া।
৮- বাংলাপিডিয়া।
৯- https://nirvanapeace.com/history-heritage/bangladeshi-history-heritage/457)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ