লেখক: মণীশ রায়চৌধুরী
গোদী মিডিয়া নামটা সম্পর্কে আজকাল বহু মানুষই ওয়াকিবহাল। বর্তমান ভারতে যেসব ডিজিটাল এবং প্রিন্ট মিডিয়া প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার এবং আর প্রধান নরেন্দ্র মোদীর চাটুকারিতা করে থাকে তাদেরই গোদী মিডিয়া নামে সম্বোধন করা হয়। বর্তমান মিডিয়া হিন্দুত্ববাদী সরকারের বদান্যতায় মুসলমান, খৃষ্টান এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচার করে থাকে। ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রবৃত্তিই হল তারা নিজেদের সিংহাসন সুরক্ষিত রাখতে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের বন্ধু সেজে তাদের সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেয়। এবিষয়ে হিটলার এবং মুসোলিনির প্রচারতন্ত্রের ভূমিকা তো প্রবাদপ্রতিম হয়ে আছে। মজার বিষয়, যারা লড়াই করে মরে তাদের অধিকাংশই কিন্তু দরিদ্র, নিপীড়িত জনগণ। এদের নিজেদের ভিতর ঐক্য বজায় রেখে শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াই করা উচিত ছিল অথচ শাসকের প্রচারের মোহে পড়ে তারা নিজেদের ভিতর লড়াই করে চলে।
মিডিয়া বা সরকারের দালালি করা প্রচারতন্ত্র কোন দেশের জন্য কতদূর বিধ্বংসী পরিণাম ডেকে আনতে পারে এরকমই একটা ঘটনা আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরব। যদি ধর্মান্ধ না হয়ে চোখ কান খোলা রেখে পড়েন তাহলে গোদী মিডিয়ার 'হিন্দু খতরেমে হ্যায়' প্রোপাগাণ্ডার সাথে অবশ্যই মিল পাবেন।
রেডিও রোয়ান্ডা, বিশেষ করে রেডিও টেলিভিশন লিব্রে দে মিলে কোলিন্স (RTLM), ১৯৯৪ সালের রোয়ান্ডা গণহত্যার সময় সাম্প্রদায়িক বিষাক্ত সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে হুটু ও টুটসি সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্র করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই গণহত্যায় প্রায় ৮০০,০০০ টুটসি ও মধ্যপন্থী হুটু নিহত হয়।
রেডিও রোয়ান্ডার ভূমিকা এবং সাম্প্রদায়িক বিষাক্ত সংবাদ
রেডিও টেলিভিশন লিব্রে দে মিলে কোলিন্স (RTLM) ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটি হুটু চরমপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এটি ছিল রোয়ান্ডার প্রথম বেসরকারি রেডিও স্টেশন, যা সরকারি রেডিও রোয়ান্ডার পাশাপাশি কাজ করত। RTLM-এর প্রচারণা ছিল অত্যন্ত উস্কানিমূলক এবং টুটসি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য ডিজাইন করা। বোঝার সুবিধার জন্য এর কদর্য ভূমিকাকে কতগুলো ভাগে ভাগ করা যাক।
1. বিদ্বেষমূলক প্রচারণা (Hate Propaganda):
- RTLM টুটসিদের বিরুদ্ধে অপমানজনক ও মানবিকতাবিরোধী ভাষা ব্যবহার করত। তারা টুটসিদের "ইনিয়েনজি" (তেলাপোকা) বলে অভিহিত করত এবং তাদের হুটু সম্প্রদায়ের জন্য হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করত।
- রেডিওতে টুটসিদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও উস্কানিমূলক গল্প প্রচার করা হতো, যেমন টুটসিরা হুটুদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে বা তারা হুটু নেতাদের হত্যার পরিকল্পনা করছে।
- এই প্রচারণা হুটু জনগণের মধ্যে ভয়, ক্রোধ ও বিদ্বেষ জাগিয়ে তুলতে সফল হয়েছিল, যা সহিংসতার জন্য মানসিক প্রস্তুতি তৈরি করে।
2. সরাসরি হত্যার আহ্বান:
- RTLM শুধু বিদ্বেষ ছড়ানোতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তারা সরাসরি টুটসিদের হত্যার জন্য হুটু মিলিশিয়া ও সাধারণ জনগণকে উৎসাহিত করত। তারা টুটসিদের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য প্রচার করত, যেমন কোন এলাকায় টুটসিরা লুকিয়ে আছে বা কারা তাদের আশ্রয় দিচ্ছে।
- উদাহরণস্বরূপ, রেডিওতে প্রচার করা হতো: "তোমরা এই তেলাপোকাগুলোকে খুঁজে বের করো এবং ধ্বংস করো।" এই ধরনের বার্তা সাধারণ হুটুদের মধ্যে গণহত্যায় অংশ নেওয়ার জন্য উৎসাহ যোগাত।
3. সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রভাব:
- RTLM জনপ্রিয় সঙ্গীত, হাস্যরস এবং স্থানীয় ভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এটি গ্রামীণ এলাকায় ব্যাপক শ্রোতা পেত, যেখানে রেডিও ছিল তথ্যের প্রধান মাধ্যম।
- তারা হুটু জনগণের মধ্যে এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করে যে, টুটসিরা তাদের ক্ষমতা ও সম্পদ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, যা হুটু জনগণের মধ্যে এক ধরনের "আত্মরক্ষার" মানসিকতা তৈরি করে।
4. অস্ত্র বিতরণ ও মিলিশিয়ার সংগঠন:
- RTLM হুটু মিলিশিয়া গোষ্ঠী, যেমন ইন্টারাহামওয়ে, এর সাথে সমন্বিতভাবে কাজ করত। তারা মিলিশিয়াদের জন্য তথ্য সরবরাহ করত এবং সাধারণ জনগণকে অস্ত্র গ্রহণ ও সহিংসতায় অংশ নিতে উৎসাহিত করত।
- রেডিওর মাধ্যমে টুটসিদের বিরুদ্ধে সহিংসতার পরিকল্পনা সমন্বিত করা হতো, যা গণহত্যার সংগঠিত প্রকৃতিকে আরও তীব্র করে।
সরকারের পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা
রোয়ান্ডার তৎকালীন হুটু-নিয়ন্ত্রিত সরকার, যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাবিয়ারিমানা, গণহত্যার সময় RTLM-এর বিষাক্ত প্রচারণাকে সমর্থন ও সহায়তা করেছিল। সরকারের পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা নিম্নলিখিত উপায়ে এই ন্যাক্কারজনক ঘটনাকে ত্বরান্বিত করে:
1. RTLM-এর প্রতি সরকারি সমর্থন:
- RTLM ছিল হুটু চরমপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে, তবে এটি সরকারি কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী হুটু নেতাদের আর্থিক ও রাজনৈতিক সমর্থন পেত। সরকারি রেডিও রোয়ান্ডার সাথে RTLM-এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, এবং অনেক সময় তারা একে অপরের সম্প্রচার শেয়ার করত।
- সরকার RTLM-এর বিষাক্ত প্রচারণাকে নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এটি তাদের টুটসি-বিরোধী এজেন্ডার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।
2. সরকারি প্রশাসনের সহযোগিতা:
- সরকারি কর্মকর্তারা, স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশ বাহিনী গণহত্যার সময় ইন্টারাহামওয়ে মিলিশিয়ার সাথে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করত। তারা টুটসিদের তালিকা তৈরি করত এবং তাদের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য মিলিশিয়াদের কাছে পৌঁছে দিত।
- সরকারি বাহিনী অনেক ক্ষেত্রে গণহত্যায় সরাসরি অংশ নেয় বা হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
3. প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানার হত্যা ও সরকারি প্রতিক্রিয়া:
- ১৯৯৪ সালের ৬ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানার বিমান ভূপাতিত হওয়ার পর (যার জন্য টুটসিদের দায়ী করা হয়েছিল), হুটু-নিয়ন্ত্রিত সরকার এই ঘটনাকে টুটসি-বিরোধী সহিংসতার জন্য অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে। RTLM এই ঘটনার পরপরই টুটসিদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ডের আহ্বান জানায়।
- সরকার এই সহিংসতাকে থামানোর পরিবর্তে এটিকে উৎসাহিত করে এবং সামরিক ও প্রশাসনিক সমর্থন প্রদান করে।
4. অস্ত্র সরবরাহ ও প্রশিক্ষণ:
- সরকার হুটু মিলিশিয়াদের জন্য অস্ত্র সরবরাহ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। মাচেতে, বন্দুক এবং অন্যান্য অস্ত্র বিতরণ করা হয়, যা গণহত্যার সময় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
-সরকারি বাহিনী এবং মিলিশিয়ার মধ্যে সমন্বয় ছিল, যা গণহত্যার পরিকল্পিত ও সংগঠিত প্রকৃতিকে নির্দেশ করে।
5. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি ভুল তথ্য প্রদান:
-সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গণহত্যাকে "গৃহযুদ্ধ" বা "উপজাতীয় সংঘর্ষ" হিসেবে উপস্থাপন করে, যা আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপকে বিলম্বিত করে। এটি তাদের পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকার আরেকটি দিক ছিল।
RTLM-এর বিষাক্ত প্রচারণা এবং সরকারের পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকার ফলে ১৯৯৪ সালের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত মাত্র ১০০ দিনে প্রায় ৮০০,০০০ মানুষ নিহত হয়। এই গণহত্যা রোয়ান্ডার সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি সাধন করে।
বর্তমান ভারতেও কিন্তু সরকারের বদান্যতায় এক অলিখিত ফ্যাসিবাদের আগ্রাসন শুরু হয়েছে, মিডিয়া যার অন্যতম হাতিয়ার। আমরা যদি এখনো সাবধান না হই তাহলে দেশের সর্বনাশ কেউ আটকাতে পারবেনা।
চিত্রঋণ: newslaundry
0 Comments