ভারত কি সত্যিই জাপানকে অর্থনীতিতে ছাপিয়ে গেছে?


লেখকঃ মনীশ রায়চৌধুরী

হঠাৎ করে প্রচন্ড ঢক্কানিনাদে ঘোষণা করা হল ভারত অর্থনীতিতে সুপার পাওয়ার হয়ে উঠেছে। জাপান কে ছাপিয়ে গিয়ে সে এখন চতুর্থ স্থানে উঠে এসেছে। জাপান, সাধারণ ভারতবাসীর কাছে এক স্বপ্নের দেশ, সেই জাপানকে কিনা ভারত হারিয়ে দিয়েছে চাট্টিখানি কথা। কথায় আছে, রাজা যাহা বলে বিদূষক বলে শতগুণ। ফলে মন্ত্রীসান্ত্রী, গোদী মিডিয়া থেকে শুরু করে আইটি সেলের চাড্ডি নেতা উচ্ছ্বসিত হয়ে জয়ধ্বনি দিয়ে বলল, "মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়"।

পাগলা জগাই এতক্ষণ এইসব মহোৎসব দেখছিল। বেশ একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছিল সে। হঠাৎ ক্ষিদে পেতেই পকেট হাতড়ে দেখে পকেটে একটা ফাটা দশ টাকার নোট ছাড়া কিছুই নেই। তবে যে সব্বাই বলছে আমরা জাপান কে হারিয়ে দিয়েছি।

হ্যাঁ, আমরা সবাই হচ্ছি সেই পাগলা জগাই যাদের বছরের পর বছর ধরে একের পর এক জুমলা শুনিয়ে আচ্ছে দিনের স্বপ্নে বিভোর করে রাখা হয়েছে, অথচ আমাদের পেটও খালি, আবার পকেটও গড়ের মাঠ। তাহলে আসুন এই ফাঁকা পেটেই কিছু নীরস হিসাব কষতে বসা যাক।

ভারত অর্থনৈতিকভাবে জাপানকে ছাড়িয়ে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে বলে সাম্প্রতিক প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণে দাবি করা হয়েছে। এই তথ্যটি ভারতের নীতি আয়োগের সিইও বিভিআর সুব্রহ্মণ্যম এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)-এর পূর্বাভাসের ভিত্তিতে প্রকাশিত হয়েছে। তবে, এই দাবির সত্যতা এবং এর প্রকৃত তাৎপর্য বোঝার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক বিবেচনা করা প্রয়োজন।




১. নীতি আয়োগের দাবি


- ২০২৫ সালের ২৪ মে নীতি আয়োগের দশম গভর্নিং কাউন্সিলের বৈঠকের পর সিইও বিভিআর সুব্রহ্মণ্যম ঘোষণা করেন যে ভারতীয় অর্থনীতি ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ছুঁয়েছে এবং জাপানকে ছাড়িয়ে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে।

- এই দাবি সমর্থন করে ভারতীয় মিডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ভারতের (Nominal GDP) জাপানের তুলনায় এগিয়ে গেছে।

২. আইএমএফ-এর পূর্বাভাস


- আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এপ্রিল ২০২৫-এর পূর্বাভাসে বলেছে যে ভারত ২০২৫ সালের মধ্যে জাপানকে ছাড়িয়ে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি হতে পারে।

- আইএমএফ-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালে ভারতের নমিনাল জিডিপি প্রায় ৪.২৭ ট্রিলিয়ন ডলার হবে, যেখানে জাপানের জিডিপি ৪.২২ ট্রিলিয়ন ডলার হবে।

৩. জাপানের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট


- জাপানের অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরে মন্দা, জনসংখ্যার বয়স্কতা, এবং কম উৎপাদনশীলতার কারণে সঙ্কুচিত হয়েছে। ২০১০ সালে জাপানের জিডিপি ছিল প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪ সালে কমে ৪.২ ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

- জাপানের মুদ্রা (ইয়েন) এর বিনিময় হারের অস্থিরতা এবং কম সুদের হারও এর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত  করেছে। (https://en.wikipedia.org/wiki/Economy_of_Japan)

৪. নমিনাল জিডিপি বনাম প্রকৃত সমৃদ্ধি

- ভারতের জিডিপি জাপানকে ছাড়িয়েছে নামমাত্র মূল্যে (Nominal GDP), যা মোট অর্থনৈতিক উৎপাদন নির্দেশ করে। তবে, প্রতি ব্যক্তি আয় (Per Capita Income) এর দিক থেকে জাপান অনেক এগিয়ে। জাপানের প্রতি ব্যক্তি আয় প্রায় ৫২,৬৪০ মার্কিন ডলার, যেখানে ভারতের মাত্র ২,৪৮১ মার্কিন ডলার।

- এর মানে হলো, যদিও ভারতের মোট অর্থনৈতিক আকার বড়, তবুও জনগণের জীবনযাত্রার মান এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিক থেকে জাপান অনেক এগিয়ে।

৫. জনসংখ্যার প্রভাব

- ভারতের জনসংখ্যা (১৪২.৮৬ কোটি) জাপানের (১২.৪৫ কোটি) তুলনায় অনেক বেশি। ফলে, মোট জিডিপি বেশি হলেও, প্রতি ব্যক্তি সম্পদ ভাগ করে নিলে ভারতের অবস্থান অনেক পিছনে।

৬. অর্থনৈতিক গঠন


- জাপান একটি উন্নত, শিল্পোন্নত অর্থনীতি, যেখানে উচ্চ প্রযুক্তি, উৎপাদনশীলতা, এবং রপ্তানি-ভিত্তিক শিল্প রয়েছে।
(https://en.wikipedia.org/wiki/Economy_of_Japan)

- ভারতের অর্থনীতি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে পরিষেবা এবং শিল্প খাতে, তবে এটি এখনও উন্নয়নশীল দেশের শ্রেণীতে রয়েছে।

৭. ভূ-রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রেক্ষাপট


- ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগ, ডিজিটাল অর্থনীতি, এবং সরকারি সংস্কারের মাধ্যমে ত্বরান্বিত হয়েছে।(https://www.newsonair.gov.in/bn/%25E0%25A6%25AD%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25A4-%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%25B6%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25AC%25E0%25A7%2587%25E0%25A6%25B0-%25E0%25A6%25A4%25E0%25A7%2583%25E0%25A6%25A4%25E0%25A7%2580%25E0%25A7%259F-%25E0%25A6%2585%25E0%25A6%25B0%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25A5%25E0%25A6%25A8/)

- জাপানের অর্থনীতি কম রপ্তানি প্রবৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদার মন্দার কারণে স্থবিরতার সম্মুখীন।[]()

৮. আরও একটি বিচার্য বিষয় হল ঋণ


- ভারত জাপানের কাছে ৩৬০০ বিলিয়ন ইয়েন (প্রায় ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ঋণী, যা অর্থনৈতিক তুলনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।


৯. আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান অনুসারে ভারতের জিডিপি র‍্যাঙ্ক ৪ হয়েছে বলে লাফালাফি করলেও মনে রাখা দরকার পার ক্যাপিটা জিডিপি র‍্যাঙ্ক হল ১৩৪।


১০. শুধুমাত্র জিডিপি র‍্যাঙ্ক দ্বারা দেশের জনগণের অবস্থা নির্ধারণ করতে গেলে ভুল হতে বাধ্য। এখানে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হল ভারতীয় অর্থনৈতিক অসাম্যের করাল রূপ।

এই অসাম্যের ভয়াবহ পরিচয় পেতে হলে নিচের পরিসংখ্যান অত্যন্ত জরুরি।

ক. সম্পদের অসম বণ্টন

ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট ২০২২: এই প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের শীর্ষ ১০% জনগোষ্ঠীর হাতে দেশের মোট সম্পদের ৫৭% কেন্দ্রীভূত রয়েছে, যেখানে নিম্ন ৫০% জনগোষ্ঠীর হাতে মাত্র ১৩% সম্পদ রয়েছে। এটি ভারতে অর্থনৈতিক অসাম্যের তীব্রতার একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে।

শীর্ষ ১% এর প্রভাব: সাম্প্রতিক একটি পোস্ট অনুসারে, ভারতের শীর্ষ ১% জনগোষ্ঠী দেশের ৪৫% সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে নিম্ন ৫০% জনগোষ্ঠীর কাছে মাত্র ৩% সম্পদ রয়েছে। এটি সম্পদের চরম কেন্দ্রীভূতকরণের ইঙ্গিত দেয়।

অক্সফাম রিপোর্ট (২০২৩): অক্সফামের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের শীর্ষ ১% ধনী ব্যক্তিদের সম্পদ ২০১২ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৮ সালে শীর্ষ ১% এর সম্পদ বৃদ্ধি ছিল ২০.৯ লক্ষ কোটি টাকা, যা ভারতের মোট বাজেটের সমতুল্য।

খ. আয়ের অসাম্য


ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ডাটাবেস (২০২৪): ভারতের শীর্ষ ১% জনগোষ্ঠী মোট জাতীয় আয়ের প্রায় ২২% নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে নিম্ন ৫০% জনগোষ্ঠী মাত্র ১৫% আয় অর্জন করে।

মাসিক আয়ের তথ্য: সাম্প্রতিক পোস্ট অনুসারে, ভারতের ৯০% জনগোষ্ঠীর মাসিক আয় ২০,০০০ টাকার কম, যা জনগণের মধ্যে আর্থিক দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে।

গ. ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধান


- ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাম্প্রতিক দশকগুলোতে উল্লেখযোগ্য হলেও, এই প্রবৃদ্ধির সুবিধা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধনী শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০০-এর দশক থেকে ভারতের অর্থনীতি তথ্যপ্রযুক্তি, ই-কমার্স এবং উৎপাদন খাতে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, কিন্তু এর ফলে উৎপন্ন সম্পদের একটি বড় অংশ শীর্ষ পুঁজিপতিদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে ভারতীয়দের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমশ ইংরেজি K অক্ষরের মত হয়ে যাচ্ছে যাতে ধনী গরিবের ব্যবধান ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

অত:পর, পাগলা জগাই শ্রী কাক্কেশ্বর কুচকুচের দিকে তাকিয়ে বলল, "তাহলে অঙ্কটা কী দাঁড়ালো মশাই?" কাক্কেশ্বর গম্ভীরমুখে পেনসিল দিয়ে শ্লেটের উপর এতক্ষণ কীসব যেন আঁকিবুঁকি কাটছিল। হিসাব কষা থামিয়ে বলে উঠলো, "হয়নি হয়নি ফেল ফেল।"
Author bio image

মণীশ রায়চৌধুরী


পেশায় ব্যাঙ্ক কর্মী। ২০০৭ সালে প্রবীর ঘোষের বই পড়ে যুক্তিবাদী আন্দোলনের আদর্শে উজ্জীবীত হয়ে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতিতে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসাবে যুক্তিবাদী আন্দোলন কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় রত আছেন। 


Post a Comment

0 Comments