বঙ্গদেশের লোকনৃত্য: উভয় বঙ্গের ২৬টি প্রাচীন লোকনৃত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ।। রানা চক্রবর্তী



লোকনৃত্য কোনো জনগোষ্ঠীর জীবনঘনিষ্ঠ নৃত্য। এ নৃত্য বিশেষ কোনো নরগোষ্ঠী, অঞ্চল বা উপজাতীয় সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে উদ্ভূত ও বিকশিত। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর জীবিকা নির্বাহ, সামাজিক রীতিনীতি ও ধর্মীয় সংস্কারের একটা গভীর সম্পর্ক থাকে। বাংলাদেশে সুদূর অতীত থেকে নৌকা বাওয়া, মাছ ধরা, ফসল কাটা, বিবাহ ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করে লোকনৃত্যের উদ্ভব ও চর্চা হয়ে আসছে।

লোকনৃত্য ও শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে পার্থক্য অনেক। শাস্ত্রীয় নৃত্যের গতি, ছন্দ ও মুদ্রা জটিল এবং দীর্ঘ সাধনার দ্বারা তা আয়ত্ত করতে হয়। কিন্তু লোকনৃত্য সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত। মুদ্রা ও অঙ্গভঙ্গির জটিলতা এবং কঠিন নিয়মতান্ত্রিকতা না থাকায় এ নৃত্য সহজেই আয়ত্ত করা যায়। জীবনের সঙ্গে অধিক সম্পৃক্ত বলে স্থান-কাল-পাত্রভেদে লোকনৃত্যের বিভিন্ন রূপপরিবর্তন ঘটে। এ পরিবর্তন কেবল মুদ্রা ও অঙ্গক্রিয়ার ক্ষেত্রেই নয় সাজসজ্জা, মঞ্চ, উপলক্ষ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও লক্ষণীয়। বংশপরম্পরায় এ নৃত্য শেখা হয়। প্রয়োগক্ষেত্রে শিল্পীর ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকলেও নৃত্যের মূল কাঠামো অপরিবর্তিত থাকে।

লোকনৃত্য একক বা দলবদ্ধ উভয় প্রকারেরই হতে পারে, তবে দলবদ্ধ নৃত্যের প্রচলনই বেশি। গোষ্ঠী বা সমষ্টিচেতনা থেকে এর উদ্ভব। এতে ব্যক্তি অপেক্ষা সমষ্টির চিন্তাভাবনাই বেশি প্রতিফলিত হয়। গান এ নৃত্যের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিল্পীরা নিজেরাই গান গায়, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্যরা গান গায়, শিল্পীরা নাচে। এ ক্ষেত্রে গানের কথাকে নৃত্যের মাধ্যমে রূপ দেওয়াই শিল্পীদের কাজ।

নৃত্য বা নৃত্যকলার ইংরেজি প্রতিশব্দ Dance এসেছে প্রাচীন ফ্রেঞ্চ শব্দ Dancier থেকে, যা মূলত শারীরিক নড়াচড়ার প্রকাশভঙ্গীকে বোঝায়। নাচ বা নৃত্য হলো দৈহিক প্রতিভঙ্গিমা, তবে তা প্রতিদিনের ব্যবহার জীবনের প্রতিভঙ্গিমা নয়। এ প্রকাশভঙ্গী সামাজিক, ধর্মীয় বা মনোরঞ্জনের ক্ষেত্রে দেখা যায়। এতে আছে গতি, মুদ্রা, সংযম ও ছন্দ।

নৃত্যকলা শিল্পের এমন একটি শাখা, যা খুব সম্ভবত প্রাচীনতম। প্রাচীন সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শন হিসেবে নানা বস্তু পাওয়া গেলেও নৃত্যের তেমন কিছু পাওয়া যায় না। তবে প্রাচীন জনপদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে নাচ প্রচলিত ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। মিশরীয় দেয়ালচিত্রে ও ভারতীয় গুহাচি
ত্রে নৃত্যকলার বিভিন্ন ভঙ্গী দেখতে পাওয়া যায়। নৃত্যকলার ব্যবহার যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় চলে আসছে। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে নাচের এই ব্যবহার ব্রাজিলীয় সংস্কৃতি থেকে শুরু করে ভারতীয় সংস্কৃতি পর্যন্ত বিস্তৃত। লোকসংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়া এই নৃত্যকলাই হচ্ছে লোকনৃত্য। লোকনৃত্য নৃত্যকলার অন্তর্ভুক্ত হলেও কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে তা শাস্ত্রীয় বা ক্লাসিক নৃত্য থেকে কিছুটা আলাদা। লোকনৃত্য ছন্দের কঠোর নীতি খুব একটা অনুসরণ করে না। ক্লাসিক নৃত্যের তুলনায় লোকনৃত্যে সংযম ও ছন্দের অভাব রয়েছে, কারণ এতে মুদ্রার ব্যবহার খুব একটা নেই। লোকনৃত্যের গতি, ছন্দ, অঙ্গকৌশল অনেকটা বাস্তব জীবনের কাছাকাছি।

শাস্ত্রীয় নৃত্যের ক্ষেত্রে পোশাক ও সাজসজ্জা একটি অপরিহার্য বিষয়। কিন্তু লোকনৃত্যের ক্ষেত্রে পোশাক তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। লোকনৃত্য সাধারণত দলবদ্ধভাবে পরিবেশিত হয়। কারণ জীবনচক্রের গতিময় দলবদ্ধ আচরণই লোকনৃত্য বা পল্লীনৃত্যের অনুপ্রেরণা। বঙ্গদেশে ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এই তিন ধারার লোকনৃত্যের প্রচলন আছে। এর মধ্যে ধর্মীয় নৃত্যের সংখ্যাই বেশি। এর কারণ এ নৃত্যের উদ্ভব হয়েছে প্রাচীন ও মধ্যযুগে, যখন লোকসমাজে ধর্মীয় প্রভাব ছিল বহুবিস্তৃত। কীর্তননাচ, ব্রতনাচ, বাউলনাচ, গম্ভীরানাচ, জারিনাচ, ফকিরনাচ ইত্যাদির উৎসে বিভিন্ন ধর্মবোধ ও আচার-সংস্কার জড়িত আছে। ঢালিনাচ ও লাঠিনাচে সামাজিক উপযোগ এবং ছোকরানাচ, ঘাটুনাচ ও খেমটানাচে সাংস্কৃতিক বিনোদনের প্রেরণা আছে। কোনো কোনো নাচে হিন্দু ও ইসলাম এ দুটি ধর্মের বিশেষ প্রভাব রয়েছে। সেগুলিতে প্রধানত এই দুই ধর্মের লোকেরাই অংশগ্রহণ করে এবং তারাই উপভোগ করে। আবার কতক নৃত্য সমাজের সব শ্রেণির মানুষই উপভোগ করে। যেমন কীর্তননাচে হিন্দু এবং জারিনাচে মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরাই প্রধানত অংশগ্রহণ করে। কিন্তু লাঠিনাচ ও ঢালিনাচে কোনো সাম্প্রদায়িক ভেদ নেই। আবার ছোকরানাচ, ঘাটুনাচ ও লেটোনাচের প্রধান পৃষ্ঠপোষক মুসলমান সমাজ হলেও রসোপভোগ ও চিত্তবিনোদনের জন্য এর দ্বার সকলের জন্য উন্মুক্ত। বঙ্গদেশে কয়েকটি জনপ্রিয় প্রাচীন নাচের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে দেওয়া হলো, এর কিছু এখনো প্রচলিত আছে ও কিছু ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে গেছে -

১) অবতার নাচ: অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ফরিদপুর অঞ্চলে প্রচলিত। চড়ক ও  গম্ভীরা উৎসবে মন্ত্রপূত মুখোশ পরে এ নৃত্য পরিবেশন করা হয়। এটি বৈচিত্র্যময় ভাবভঙ্গিসমৃদ্ধ একটি নৃত্য। সাঙ্কেতিক ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে হিন্দুধর্মের দশ অবতারের রূপ প্রকটিত করাই এ নৃত্যের উদ্দেশ্য।

২) কালীনৃত্য: কালীর কৃষ্ণবর্ণ মুখমন্ডল ও রক্তবর্ণ প্রসারিত জিহ্বার মুখোশ পরে এবং এক হাতে খড়্গ ও অপর হাতে নরমুন্ড (রেপ্লিকা) নিয়ে নৃত্য করা হয়। এতে প্রধান  বাদ্যযন্ত্র থাকে ঢাক। এ নাচে বীররস ও বীভৎসরসের প্রাধান্য থাকে।

৩) খ্যামটা নাচ: আজ থেকে প্রায় কয়েক দশক আগেও খ্যামটা নাচ উভয় বাংলায় জনপ্রিয় ছিল। মহিলা নৃত্যশিল্পীরা দল বেঁধে এই নৃত্য পরিবেশন করতেন। জমিদার বাড়ির অনুষ্ঠান, বারোয়ারি অনুষ্ঠান, দুর্গাপুজো, দোল প্রভৃতি উৎসবে খ্যামটা নাচের চাহিদা ছিল ব্যাপক। রাধা-কৃষ্ণের লীলা ও বিভিন্ন সামাজিক বিষয় ছিল খ্যামটা নাচের অঙ্গ
খেমটানাচ খেমটা তালের সঙ্গে পরিবেশিত হয়। এর সঙ্গে গানও সম্পৃক্ত। খেমটা নাচ-গানের প্রধান বিষয় রাধাকৃষ্ণের প্রেম। ঢোল, কাঁসি ও করতাল বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। খেমটানাচের কোনো নির্দিষ্ট উপলক্ষ নেই। যেকোনো সামাজিক ও লৌকিক অনুষ্ঠানে এর আয়োজন হতে পারে। এক সময় বিয়ের আসরে খেমটানাচের বিশেষ আকর্ষণ ছিল।
হিন্দুদের পূজোৎসবেও এর প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। মূলত মেয়েরাই এ নাচের শিল্পী। কোনো কোনো অঞ্চলে  হিজড়া শ্রেণির লোকেরাও দল গঠন করে নাচ দেখায়। বর্তমানে লুপ্তপ্রায় এ নাচটি তারাই ধরে রেখেছেন। পায়ের জটিল গতিভঙ্গি ও চোখমুখের সূক্ষ্ম ক্রিয়া খেমটানাচের প্রধান বৈশিষ্ট্য। মুসলিম সমাজেও এক সময় খেমটানাচের প্রচলন ছিল। অধুনা বাংলাদেশের বগুড়া জেলা থেকে সংগৃহীত একটি মেয়েলি গীতে খেমটার কথা পাওয়া যায়। এতে কোমর দুলিয়ে নাচার উল্লেখ আছে। বিনোদনমূলক এ নাচকে শহরের বাইজি নাচের গ্রামীণ সংস্করণ বলা যায়।

৪) গম্ভীরানাচ: গম্ভীরা পূজা ও উৎসব এবং  গম্ভীরা গানে পরিবেশিত হয়। অবিভক্ত বাংলার মালদহ জেলায় এ নাচের ব্যাপক প্রচলন ছিল। বর্তমানে এর প্রভাব হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশের রাজশাহী জেলায় মুসলিম সমাজের পৃষ্ঠপোষকতায় গম্ভীরা নাচগানের বিস্তর রূপান্তর ঘটেছে। দুজন নট নানা-নাতির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সমকালীন সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, নৈতিকতা ইত্যাদি সংক্রান্ত সমস্যা নৃত্যগীতের মাধ্যমে তুলে ধরেন। এতে গদ্যেপদ্যে সংলাপও থাকে। আসরে দোহাররা ধুয়া গায়, বাদ্যকাররা বাদ্য বাজায়।  হারমোনিয়াম,  বাঁশি, ঢোল, জুড়ি এর প্রধান বাদ্যযন্ত্র। সংলাপ, নাচ-গান ও বাদ্য সহযোগে গম্ভীরানাচ লোকনাট্যের বৈশিষ্ট্য বহন করে। দোহাররা যখন ধুয়া গায় তখন নানা-নাতি উভয়ে সরল ভঙ্গিতে হাত-পা নেড়ে ও কোমর দুলিয়ে নাচে। নাতির পায়ে থাকে ঘুঙুর। এ নাচে তেমন কোনো বৈচিত্র্য নেই, তবে মালদহের গম্ভীরানাচে মুখোশের ব্যবহার আছে।

৫) ঝুমুর নাচ: পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমান ও মেদিনীপুর অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যে জনপ্রিয় নাচ ও গান হল ঝুমুর। আসামের আদিবাসীদের মধ্যেও এই নাচের প্রচলন রয়েছে। অল্পবয়সী মেয়েরা পায়ে ঝুমুর পরে দল বেঁধে নাচ করেন। ছেলেরা মাদল, বাঁশি ও বয় করতাল বাজিয়ে গানে তাল দেয়। মেয়েরা একে অপরের কোমর ধরে সেই গান বাজনার তালে তালে নাচ করেন। কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বর্ষার আহ্বান বা কোনও শুভ কাজের সময় ঝুমুর নাচ-গান করা হয়ে থাকে। ঝুমুর গানের ভাষায় সাধারণত দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, সুখ-দুঃখ ইত্যাদির প্রভাব থাকে।

৭) ঘাটুনাচ বা ঘেটুনাচ: ঘেটু বা ঘাটু গানের সঙ্গে পরিবেশিত হয়। এর ধর্মীয় বা সামাজিক কোনো উপলক্ষ নেই, লোকমনোরঞ্জনই এর মুখ্য উদ্দেশ্য। নটীবেশী এক বা একাধিক কিশোর এর প্রধান আকর্ষণ। প্রধানত রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা নিয়ে গান রচনা করা হয় এবং একজন মূল গায়েন গান গায়, আর ঘাটুরা তার সঙ্গে নাচে। নরনারীর লৌকিক প্রেমের গানও আছে। ঢোল, মন্দিরা, বাঁশি ও  সারিন্দা বাদ্যযন্ত্রের কাজ করে। বর্তমানে হারমোনিয়াম ব্যবহূত হয়। এ নাচ দীর্ঘ রাত ধরে চলে। কখনো কখনো তা অশ্লীলতার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এ কারণে লোকালয়ের বাইরে ঘাটুর আসর বসে। প্রধানত মুসলমানরাই ঘাটুর দল গঠন করে এবং নাচগান পরিবেশন ও উপভোগ করে। সিলেটের বিথঙ্গলের জগন্মোহন প্রবর্তিত ‘কিশোরীভজন’ নামে বৈষ্ণব উপসম্প্রদায়ে কিশোরীদের নিয়ে  ভজন ও নাচের প্রচলন আছে। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা প্রভাবিত ঘাটু নাচগানে এই কিশোরীভজনের প্রভাব থাকতে পারে। বর্তমানে কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোনা শহরের আধুনিক মঞ্চেও ঘাটুনাচ পরিবেশিত হয়।

৮) ব্রিতা নাচ: অবিভক্ত বাংলার গ্রামগঞ্জের সন্তানহীন মহিলারা বহুদিন পর সন্তান লাভের পর দেবদেবীর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে দল বেঁধে ব্রিতা নাচ করেন। আবার গুটিবসন্ত ইত্যাদি রোগের থেকে পরিবারের লোকজন সুস্থ হলেও মহিলারা এই নাচ করে থাকেন। গ্রামের মহিলারাই শুধুমাত্র এই নাচে অংশগ্রহণ করতে পারেন।

৯) ছোকরানাচ: আলকাপ গানের সঙ্গে পরিবেশিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ-মালদহ জেলায় বহুকাল থেকেই এর প্রচলন আছে। আমবাগান বা খোলা মাঠে বাঁশের ঘের দেওয়া চাঁদোয়া খাটানো মঞ্চে ছোকরানাচ পরিবেশিত হয়। এর প্রধান পরিচালককে বলা হয় সরকার। সরকার, গায়ক, বাদক, দোহার, নট-নটী ও সঙ মিলে এর একটি বড় দল থাকে। বাজনাদাররা মঞ্চের পাশে থেকে গান ও নাচে তাল সঙ্গত করে। অন্যরা সাজঘরে থাকে এবং প্রয়োজনমতো মঞ্চে প্রবেশ করে স্ব-স্ব ভূমিকা পালন করে। নটীবেশী একটি ছোকরা নাচে অংশ নেয়। ঘাটুনাচের ঘাটু হয় কম বয়সী একটি সুন্দর বালক, কিন্তু আলকাপের ছোকরা হয় তরুণ যুবক।
নারীর সাজসজ্জায় ভূষিত হয়ে সে যখন মঞ্চে প্রবেশ করে তখন তাকে পূর্ণ যুবতীর মতোই মনে হয়। লঘু রঙ্গরসের  আলকাপ গান ও নাচের কোনো কোনো অংশ বেশ অশ্লীল হয়। এজন্য গভীর রাতে ছোকরানাচের আসর বসে এবং এর দর্শক হয় সাধারণত প্রাপ্ত বয়স্করা। রাধাকৃষ্ণের প্রণয় কাহিনী, পৌরাণিক ঘটনা এবং সামাজিক বিষয় এ নাচের বিষয়বস্তু। দেহের ভঙ্গিসর্বস্ব স্নায়ু উত্তেজনাকর এ নাচ সাধারণ দর্শকদের নিকট খুবই উপভোগ্য হয়।

১০) ছৌ-নাচ: পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া-বাঁকুড়া অঞ্চলে প্রচলিত এক প্রকার মুখোশ নৃত্য। ছৌ বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধনাচ; ঢাল, তলোয়ার ও লাঠি নিয়ে এ নাচ অনুষ্ঠিত হয়। রামায়ণ-মহাভারতের বিভিন্ন ঘটনা অবলম্বনে ছৌ-নাচের পালা রচিত হয়। পালার দেব, দানব, পশু প্রভৃতি চরিত্রানুযায়ী মুখোশ ও পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহৃত হয়। এ নাচে অনেক শক্তির প্রয়োজন হয় বলে শিল্পীদের সবল স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হয়। এতে মুখোশ ও অলঙ্কার পরে পুরুষরাই নারীচরিত্রে নৃত্য করেন। ছৌ-নাচ শিবের গাজন উপলক্ষে বৈশাখ মাসে বেশ ঘটা করে অনুষ্ঠিত হয়। তবে বর্তমানে উপলক্ষ ছাড়াও যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে এ নাচ প্রদর্শিত হয়।  বাগদী ও ভুঁইয়া সম্প্রদায়ের অন্ত্যজ শ্রেণির লোকদের মধ্যে এ নৃত্যের প্রচলন বেশি। বীররসের এ নৃত্যে মস্তক, গ্রীবা, হস্ত, বক্ষ, পদ প্রভৃতি অঙ্গের কাজ বেশি। এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিভিন্ন কৌশলের
মাধ্যমে বীরভাব, শান্তভাব বা ক্রোধভাব ফুটিয়ে তোলা হয়। তবে এ নৃত্যে পায়ের কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পী কখনো একক, কখনো সমবেতভাবে লম্ফঝম্ফ দেয়, ঘুরপাক খায়, হাঁটু গেড়ে বসে, আবার হঠাৎ উঠে প্রতিপক্ষের দিকে তেড়ে যান।
ছৌ-নাচের আসরটি হয় বৃত্তাকার অঙ্গনে। বৃত্তের মধ্যে বাজনদাররা থাকে এবং চরিত্রের গমনাগমনের জন্য একটা সরু পথ থাকে। দর্শকরা থাকে বৃত্তের বাইরে। ধামসা, ঢোল ও সানাই এ নৃত্যের প্রধান বাদ্যযন্ত্র। ছৌ-নাচ শুরু হয় গণেশের বন্দনা দিয়ে; পরে চরিত্রের আগমন উপলক্ষে দুই চরণের সংক্ষিপ্ত গীত গাওয়া হয়। ছৌ-নাচে গান অপেক্ষা নাচ ও বাদ্যের অংশই বেশি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আশুতোষ ভট্টাচার্যের উদ্যোগে ছৌ-নাচ গ্রাম থেকে প্রথমে শহরে এবং পরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রচার লাভ করে।
ছৌ নাচের নামকরণ সম্বন্ধে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রকমের মত রয়েছে। ডঃ পশুপতি প্রসাদ মাহাতো ও ডঃ সুধীর করণের মতে এই নাচের নাম ছো, আবার বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত ও ডঃ বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতোর মতে এই নাচের নাম ছ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র অধ্যাপক ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য সর্বপ্রথম ছ বা ছো নাচের পরিবর্তে ছৌ নামে অভিহিত করেন এবং বিদেশে এই নাচের প্রদর্শনের ব্যবস্থা করার পরে এই নাচ ছৌ নাচ নামে জনপ্রিয় হয়ে পড়ে।
রাজেশ্বর মিত্রের মতে, তিব্বতী সংস্কৃতির ছাম নৃত্য থেকে ছৌ নাচের উদ্ভব ঘটেছে। ডঃ সুকুমার সেনের মতে শৌভিক বা মুখোশ থেকে নাচটির নামকরণ ছৌ হয়েছে। কুর্মালী ও ওড়িয়া ভাষায় ছুয়া বা ছেলে থেকে এই নাচের নামকরণ হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন, কারণ ছৌ প্রধানতঃ ছেলেদের নাচ। ডঃ সুধীর করণের মতে ছু-অ শব্দের অর্থ ছলনা ও সং। কোনো কোনো আধুনিক গবেষক মনে করেন, ছৌ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ছায়া থেকে। কিন্তু সীতাকান্ত মহাপাত্র মনে করেন, এই শব্দটি ছাউনি শব্দটি থেকে এসেছে।
১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে কুপল্যান্ডের ডিস্ট্রিক্ট গ্যাজেটিয়ার মানভূম গ্রন্থে ছৌ নাচের কোনো উল্লেখ না থাকায় অনেকে মনে করেন ১৯১১-এর পরে ছৌ নাচের উদ্ভব হয়েছে। মানভূম গবেষক দিলীপ কুমার গোস্বামীর মতে শিবের গাজনে মুখে কালি মেখে বা মুহা বা মুখোশ পরে নাচকেই ছৌ নাচের আদি রূপ বলে মনে করেছেন। এরপর অনাড়ম্বর মুখোশ সহকারে একক ছৌ বা 'এ কৈড়া ছো' নাচের উদ্ভব হয়। এ কৈড়া ছো নাচের পরে 'আলাপ ছো' বা 'মেল ছো' নাচের উদ্ভব হয়, যেখানে মুখোশ ছাড়া দুইজন বা চারজন নর্তক নাচ করতেন। এছাড়া সম্ভ্রান্ত বাড়ির নর্তকরা আড়ম্বরপূর্ণ সাজপোশাক পরে 'বাবু ছো' নামক একপ্রকার নাচের প্রচলন করেন। এই নাচে ধুয়া নামক ছোট ঝুমুর গান গাওয়া হয়ে থাকে। ১৯৩০-এর দশকে 'পালা ছো' নাচের সৃষ্টি হয়।

১১) জারিনাচ: জারিগানের সঙ্গে পরিবেশিত হয়। মুসলমান সমাজে, বিশেষ করে  শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে এ নাচের প্রচলন বেশি।  মুহররম উপলক্ষে বছরে একবার জারিনাচের আয়োজন করা হয়। এ কারণে জারিনাচে ধর্মীয় আবেগ সংযুক্ত হয়েছে। জারিনাচের মৌলিক আবেদন করুণ রস এবং এটি দলবদ্ধ নৃত্য। আশুরাকে কেন্দ্র করে গ্রামের আট-দশ জন তরুণ যুবক মিলে এই দল গঠন করে। দলের প্রধানকে বলা হয় ওস্তাদ এবং অন্যরা দোহার নামে পরিচিত। জারিয়ালরা নিত্য ব্যবহার্য পোশাক পরে এবং হাতে ও মাথায় লাল রুমাল বাঁধে। কোনো কোনো অঞ্চলে পায়ে নূপুরও পরে। ওস্তাদ চটি বাজায় এবং কোনো কোনো অঞ্চলে দোহাররা বাঁশের তৈরি ঝার্ণি বাজায়।
এগুলি তালবাদ্যের কাজ করে। কোথাও হাততালি দিয়ে তাল রক্ষা করা হয়। জারিনাচ বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে অনুষ্ঠিত হয়। মূল গায়েন বা ওস্তাদ বৃত্তের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গান গায়, আর দোহাররা নেচে নেচে ধুয়া গায়। গানের ভাবের সঙ্গে নাচের কোনো সম্পর্ক থাকে না, কেবল গানের ছন্দে হাত-পা নেড়ে ও মাথা দুলিয়ে শোক প্রকাশ করা হয়। মুহররমের চাঁদ দেখার রাত থেকে জারিনাচ শুরু হয়। এ সময় জারির দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাচগান করে এবং গৃহস্থরা তাদের অর্থ বা চিড়ামুড়ি উপহার দেয়। আশুরার দিন স্থানীয় কৃত্রিম কারবালায় সকল দলের সমাবেশে নাচগান জমে ওঠে।

১২) টুসু নাচ: পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম, পুরুলিয়া, মেদিনীপুরের আদিবাসী সম্প্রদায়ের টুসু পরবে এই নাচ হয়ে থাকে। মকর সংক্রান্তি সময় টুসু পরব হয়। পৌষ মাসের বিকেল বেলায় ধর্মীয় রীতি মেনে গ্রামের অল্পবয়সী মেয়েরা দল বেঁধে টুসু নাচ নেচে থাকে। আসলে ফসল ফলানোর কৃতজ্ঞতায় আদিবাসীরা তাদের ভগবান টুসুর মূর্তি গড়ে পুজো করে থাকে। এই পরবের নামই টুসু পরব। আর এই পরবে যে নাচ গান হয় তা টুসু নাচ বা গান নামে পরিচিত।

১৩) নাচনি: নাচনি নৃত্যের উৎপত্তি পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডি এলাকায়। প্রাচীনকালে স্থানীয় প্রথা অনুযায়ী, ছোট ছোট মেয়েদের নাচের গুরুর কাছে বেচে দেওয়া হতো
তাদের প্রশিক্ষণ দিতে নৃত্য শিল্পী তৈরি করতেন নাচের গুরুরা। ওই সমস্ত গ্রাম্য নৃত্য শিল্পীদের বলা হত নাচনি। তাঁদের নাচকে বলে নাচনি নৃত্য। এখনো গ্রামেগঞ্জে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই নাচ হয়ে থাকে।

১৪) লাঠিনাচ: মহরম উপলক্ষে পরিবেশিত হয়। যুবকরা লাঠি হাতে নিয়ে দলবদ্ধভাবে নাচেন। লাঠিনাচের তাল ও ছন্দ রক্ষা করা হয় ঢোল ও কাঁসির সাহায্যে। লাঠিয়ালরা আঁটসাঁট পোশাক পরে, কোথাও পায়ে ঘুঙুর বা মেকুর পরেন। বাঁশের তৈরি তিন-চার হাত লম্বা লাঠি এ নাচের প্রধান উপকরণ। তবে তলোয়ার, ছোরা এবং থালাও ব্যবহার করা হয়। লাঠিনাচ প্রকৃতপক্ষে আধা নাচ, আধা খেলা। লাঠি-তলোয়ার নিয়ে কৃত্রিম যুদ্ধের ভঙ্গিতে নেচেখেলে বীরত্ব প্রকাশ করা হয়। এতে লাঠি ঘুরানোর বিভিন্ন কৌশল আছে। লাঠিয়াল হাতের লাঠি সামনে, পাশে, দুপায়ের মাঝে এবং মাথার ওপরে দ্রুত ঘুরিয়ে থাকে। বাদ্যের তালে তালে হাতের এরূপ কুশলী ঘুর্ণনে এবং পদবিক্ষেপে নাচের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে।
দুজনে লাঠির আঘাত-প্রত্যাঘাত হেনে দ্বৈত যুদ্ধের রূপকে নাচ দেখায়। লাঠিনাচে ঢুলির বিরাট ভূমিকা থাকে। ঢুলির তাল অনুযায়ী নাচের চাল, গতি ও ছন্দ পরিচালিত হয়। এ নাচ আরম্ভ, পাঁয়তারা, লড়াই, বিরতি প্রভৃতি কয়েকটি অংশে বিভক্ত। লাঠিনাচ প্রধানত ধীর লয়ে শুরু হয় এবং দ্রুত লয়ে শেষ হয়। মহরমের চাঁদের দশ দিন ধরে লাঠিয়াল দল গৃহস্থের বাড়ির উঠানে, রাস্তার মোড়ে এবং শেষ দিন কৃত্রিম কারবালায় লাঠিখেলা ও নাচ প্রদর্শন করেন।

১৫) রায়বেঁশে নাচ: লাঠিনাচের অনুরূপ একটি বীরত্বসূচক নৃত্য। রায়বাঁশ নামে এক প্রকার শক্ত বাঁশের লাঠি এর উপকরণ; এছাড়া তলোয়ার-বল্লমও থাকে। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদের নিম্ন শ্রেণির হিন্দু ও মুসলমান জনগণ এ নাচে অংশ নেয়। হাতের কৌশলে অস্ত্র ব্যবহারের ভঙ্গি প্রদর্শন এর প্রধান আকর্ষণ। এ নাচে বাদ্যের তালে তালে একই অঙ্গভঙ্গি করে নাচতে হয়। বাদ্য ও নৃত্যের এই সম্মিলিত গতি ও ছন্দে রায়বেঁশে নাচের স্বাতন্ত্র্য ও সৌন্দর্য নিহিত। নাচের সময় শিল্পীরা তির ছোড়া, বর্শা ছোড়া ও তলোয়ার খেলার অভিনয় করে থাকেন। শিল্পীদের ডান পায়ে ঘুঙুর পরা থাকে। ঢোল ও কাঁসির তালে এই নাচ নাচেন শিল্পীরা।

১৬) সাঁওতালি নৃত্য: ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে সাঁওতালরা অন্যতম। পশ্চিমবঙ্গে ও ঝাড়খণ্ডে সবথেকে বেশি সাঁওতাল বসবাস করেন। সাঁওতালদের নাচ অন্যান্য নাচের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এদের নিজস্ব সংগীত রয়েছে। চাঁদনী রাতে মাদল বাজিয়ে, সাঁওতালি নাচের আনন্দ উপভোগ করার অনুভূতিই আলাদা।

১৭) করম নাচ: করম নাচ হল ফসল কাটার নাচ। গ্রাম বাংলায় ফসল কাটার আগে মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে এই নাচ করে থাকেন। মহিলা ও পুরুষদের দুটি আলাদা দল থাকে। পুরুষদের মধ্যে একজন প্রধান থাকেন। তাঁর হাতে একটি বড় তাল পাতার হাতপাখা থাকে। তিনি সেটি দিয়ে পাকা ফসলে হাওয়া দিতে থাকেন। ফসল পাকার আনন্দে সকলে নৃত্য করেন। এই নাচ সাধারণত মঞ্চে বা কোনও অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়।

১৮) কাঠি নাচ: কাঠি নাচ প্রকৃতপক্ষে রণপা নাচ। রণপার ওপর দাঁড়িয়ে পুরুষশিল্পীরা এই নাচ পরিবেশন করেন। এই নাচ যথেষ্ট বিপজ্জনক। এর জন্য দীর্ঘদিনের অনুশীলন প্রয়োজন।

১৯) ডাকনাচ: পুরুষের যুদ্ধনৃত্য। অধুনা বাংলাদেশের ঢাকার মানিকগঞ্জে এর প্রচলন আছে। এ নাচের মাধ্যমে সঙ্গীদের যুদ্ধে আহবান করা হয়। শত্রু হানা দিয়েছে এরূপ ভাব দেখিয়ে সরকার বা দলপতি উচ্চৈঃস্বরে একটানা কণ্ঠধ্বনি করে। কম্পনসহ এ ডাক ধীর গ্রাম থেকে উচ্চ গ্রামে চড়ে। তার ডাক শুনে সহযোদ্ধারা চারদিক থেকে এসে জড়ো হয়। নাচের এ অংশটিকে বলা হয় ডাক। দ্বিতীয় অংশে লাঠি নিয়ে যুদ্ধের নানা কলাকৌশল দেখানো হয়। ঢোল ডাকনাচের প্রধান বাদ্যযন্ত্র।

২০) ঢালিনাচ: পুরুষের দ্বৈত যুদ্ধের অভিনয় বিশেষ। বেতের ঘন বুনটে তৈরি ঢাল এবং বাঁশের তৈরি শক্ত লাঠি এর প্রধান উপকরণ। ঢোল ও কাঁসি নাচের তাল রক্ষা করে। ঢালিনাচের মূল লক্ষ্য দৈহিক শক্তির প্রকাশ ও নানা আঙ্গিকে যুদ্ধের কৌশল প্রদর্শন করা। নাচের শুরুতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী মুখোমুখি হয়ে ঢোল-কাঁসি বাদ্যের তালে তালে কিছুক্ষণ পাঁয়তারা করে, আর হাবভাবে বীরত্ব প্রকাশ করে। পরে তারা আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ শুরু করে। কখনও দাঁড়িয়ে, কখনও বা হাঁটু ভেঙে বসে তারা সুযোগমতো আক্রমণ চালায়। ঘাত-প্রতিঘাত চূড়ান্ত পর্যায়ে না পৌঁছা পর্যন্ত এ নৃত্য চলতে থাকে। লৌকিক মেলাদি উৎসবে ঢালিনাচের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের যশোর ও খুলনা জেলায় এর প্রচলন বেশি।

২১) পুতুলনাচ: পুতুলের অভিনয়াত্মক নাচ। কাঠ-কাপড়-শোলা নির্মিত ও বসন-ভূষণে সজ্জিত এক বা একাধিক  পুতুল নিয়ে এক শ্রেণির পেশাদার শিল্পী এরূপ নৃত্যাভিনয় দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। তারা হাতে বাঁধা সুতার সাহায্যে পুতুলের নানা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে নিজেদের মনেরই বিভিন্ন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। বাজনাদার ঢোল, মাদল, কাঁসি ও বাঁশি বাজান এবং শিল্পী গান গান ও পুতুল নাচিয়ে সে গানের ভাব ফুটিয়ে তোলেন। বঙ্গদেশে পুতুলনাচের ইতিহাস কত প্রাচীন তা সঠিক জানা যায় না, তবে পনেরো শতকে রচিত  ইউসুফ-জুলেখা  কাব্যে এর প্রথম উলে­খ পাওয়া যায়। তখন পুতুলনাচ চিত্তবিনোদনের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল।
বাংলায় পুতুলনাচের তিনটি ধারা প্রচলিত: ডাঙের পুতুল (Rod Puppet), সুতাটানা পুতুল (String Puppet) এবং দস্তানা পুতুল (Glove Puppet)। প্রথম দুটি ক্ষেত্রে নৃত্য ও অভিনয়ের মাধ্যমে  পালাগান পরিবেশন করা হয়। সাধারণত রাধাকৃষ্ণ ও রামসীতার পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে এসব পালা রচিত হয়। সমসাময়িক সামাজিক ঘটনা নিয়েও পালা রচিত হয়। ধর্ম ও নীতিশিক্ষা এসব পালার মুখ্য উদ্দেশ্য, সেই সঙ্গে আনন্দ বিধানেরও উপাদান থাকে। পালার ফাঁকে ফাঁকে ‘সখি-পুতুলে’র একক নাচ দেখানো হয় দর্শকদের বাড়তি আনন্দ দেওয়ার জন্য। পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনায় ডাঙের পুতুল এবং নদীয়া জেলায় সুতাটানা পুতুলের নাচ আজও প্রচলিত।
নারীপুরুষ দুটি পুতুলের নাচ দস্তানা পুতুলনাচ। পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর ও বর্ধমানের কাহার শ্রেণির কিছু লোক এ ধরণের নাচ দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। একজন শিল্পী দুহাতে দুটি পুতুল নিয়ে নিজেই গান করে আর পুতুল নাচান। হাল্কা বিষয় নিয়ে ব্যঙ্গ ও কৌতুকরস সৃষ্টি করে দর্শকদের আনন্দ দেয়াই এর মুখ্য উদ্দেশ্য। এতে পৌরাণিক বিষয় থাকলেও লৌকিক দিকটাই প্রাধান্য পায়; কোনো ধর্মীয় আবেদন থাকে না। অতীতে সম্পন্ন গৃহস্থঘরে  অন্নপ্রাশন, বিবাহ ইত্যাদি অনুষ্ঠানে এ ধরণের পুতুলনাচের আয়োজন করা হতো। বিভাগপূর্ব বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ, ময়মনসিংহ এবং কুমিল্লায় পুতুলনাচের ব্যাপক প্রচলন ছিল। বিভাগোত্তর কালে শিল্পীদের অনেকেই পশ্চিমবঙ্গে চলে যাওয়ায় ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পের চর্চা ব্যাহত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দু-একটি পরিবার  পুতুলনাচ দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে এবং এর আধুনিকায়নের চেষ্টাও চলছে।

২২) ফকিরনাচ: পীরের উরস উপলক্ষে পরিবেশিত নৃত্য। পীরের অনুসারী ফকিরেরা এর আয়োজন করেন। তারা ঢিলেঢালা পোশাক পরেন এবং লম্বা বাবরি চুল রাখেন। তাদের কেউ গৃহী, কেউ বা ভিক্ষোপজীবী। চৈত্রসংক্রান্তিতে তারা পীরের দরগায় জড়ো হন এবং মোমবাতি ও আগরবাতি জ্বালিয়ে মাযার আলোকিত ও সুরভিত করেন। পীরের নামে একটি বাঁশ লাল কাপড়ে জড়িয়ে তার মাথায় চামর বা পরচুলা বাঁধা হয়। এটি পীরের প্রতীক। একজন ভক্ত বাঁশটি ঘাড়ে নেন, অন্যরা তার সঙ্গী হন। তাদের পায়ে থাকে ঘুঙুর।
আসরে একটি অগ্নিকুন্ডে মাংস পোড়ানো হয় পীরের প্রসাদরূপে। পরে ভক্তরা এর চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাচেন। তারা বাদ্যের তালে তালে পা ফেলে এগিয়ে যান আর মাথা দোলান। তাদের এই পা-ফেলা ও মাথা নাড়ার ভঙ্গিই এ নৃত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এতে পা ও মাথা ছাড়া দেহের অন্য কোনো অঙ্গের তেমন ক্রিয়া নেই। ফকিরনৃত্যের মূল উদ্দেশ্য ভক্তিভাব ফুটিয়ে তোলা। পাকিস্তানের খটকনাচের ভাব ও ভঙ্গির সঙ্গে ফকিরনাচের সাদৃশ্য আছে।

২৩) বাউলনাচ: বাউলদের ধর্মাচারের অঙ্গ।  বাউল একটি লৌকিক ধর্মমত। এর গানগুলি তত্ত্বভিত্তিক। বাউলরা এই গান গাওয়ার সময় আবেগে আত্মহারা হয়ে নাচেন এবং অধ্যাত্মরস উপভোগ করেন। তাদের ডান হাতে থাকে  একতারা এবং কোমরে বাঁধা থাকে বাঁয়া নামক একটি বাদ্যযন্ত্র। কেউ কেউ পায়ে ঘুঙুরও পড়েন। বাউল নিজেই বাদ্য বাজিয়ে গানের সুর ও নাচের তাল রক্ষা করেন। বাউলনাচ মূলত পুরুষের একক নাচ, তবে কখনও কখনও দ্বৈত নাচ এবং আখড়াদিতে দলবদ্ধ নাচও হয়ে থাকে।
বাউলনাচে মুদ্রা ও অঙ্গভঙ্গির কোনো স্থান নেই। হাত-পায়ের কিছু ভঙ্গি ও গতি আছে। একতারাটি কখনও কানের কাছে ধরে, কখনো ঊর্ধ্বে প্রসারিত করে তারা নাচেন। বাউলের বিচিত্র পদচালনা ও গতিবিধিতে এ নাচের প্রকৃত সৌন্দর্য ও মাধুর্য নিহিত। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া ও যশোর এবং পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান ও বীরভূমে এ নাচের প্রচলন বেশি।

২৪) মুখোশনৃত্য: হিন্দুসমাজে শিব, ধর্ম ও নীলের গাজন উৎসবে বিভিন্ন দেবদেবীর মুখোশ পরে গান ও নৃত্য প্রদর্শনের প্রচলন আছে। বোলান গাজনে শ্মশান জাগানো নৃত্যে শব ও গৃধিনীর মুখোশ পরে গৃধিনীর শব ভক্ষণের অভিনয়-নৃত্য হয়। এছাড়া আরও দুটি মুখোশনৃত্য হলো নৃসিংহনৃত্য ও মুখাখেলনৃত্য। নৃসিংহনৃত্যে নৃসিংহের দানবমূর্তির মুখোশ পরে নানা ভঙ্গির পদচারণা ও ভ্রমর-ঘুর্ণন প্রদর্শন করা হয়। মুখাখেলনৃত্য উত্তরবঙ্গে প্রচলিত। এতে গ্রামের সাধারণ মানুষ নিজেদের রচিত পালার চরিত্র অনুযায়ী কাঠ, কাপড়, কাগজ ইত্যাদি দিয়ে মুখোশ তৈরি করেন এবং তা পরে নৃত্যাভিনয় করেন। রাজা-মন্ত্রী থেকে গৃহস্থ-কাঠুরিয়াসহ বিভিন্ন চরিত্রের সমাবেশে এ নৃত্য পরিবেশিত হয়।

২৫) লেটোনাচ: লেটো গান ও অভিনয়ের অংশরূপে পরিবেশিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান-বীরভূম অঞ্চলে এর প্রচলন আছে। এ ক্ষেত্রেও নটীবেশে একটি সুন্দর বালক নাচগান করেন। কবির লড়াইয়ের ফাঁকে ফাঁকে দর্শকদের বাড়তি আনন্দ দেওয়ার জন্যই লেটো নাচগানের ব্যবস্থা রাখা হয়। এটি এক সময় খুবই জনপ্রিয় ছিল। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্বয়ং কিশোর বয়সে লেটো রচনা ও নাচগানে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

২৬) হুদমানাচ: অধুনা বাংলাদেশের রংপুরের রাজবংশী কৃষকরমণীদের মধ্যে প্রচলিত। ‘হুদুমা দেও’র পূজা উপলক্ষে এ নাচের আয়োজন করা হয়। হুদুমা হচ্ছেন বৃষ্টির দেবতা। অনাবৃষ্টি দেখা দিলে কৃষকরমণীরা রাতের বেলা দল বেঁধে মাঠে যান এবং হুদুমা দেও’র পূজাশেষে নগ্ন হয়ে নৃত্যগীত করেন। বলা বাহুল্য, এ সময় কোনো পুরুষ উপস্থিত থাকে না। প্রজননের সঙ্গে এ নাচের সম্পর্ক আছে।

 

(তথ্যসূত্র:
১- শান্তিদেব ঘোষ, গ্রামীণ নৃত্য ও নাট্য, কলকাতা, ১৯৫৯।
২- A Halim, ‘Music and Dance of East Pakistan’, East Pakistan : A Profile, Dhaka, ১৯৬২।
৩- ড. মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন, বাংলার লোকনৃত্য পরিচিতি।
৪- Rahul Mahata, The Journey of Purulia Chhau Dance. from Vague to Vogue।
৫- উইকিপিডিয়া।
৬- বাংলাপিডিয়া।)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ