'ধর্মীয় সংখ্যালঘু' কি আমাদের কল্পনায়! || রাণা

 


ইতিহাসের অন্যতম সংখ্যালঘু নিধনের ঘটনা ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমকালীন সময়ে। তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যে প্রায় ১৫ লক্ষ আর্মেনীয়দের হত্যা করা হয় বা রাষ্ট্রীয় মদতে গণহত্যা সংঘটিত হয়। প্রায় লক্ষাধিক আর্মেনীয় মহিলা ও শিশুদের জবরদস্তিপূর্বক ইসলামে দীক্ষিত করা হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসীদের হাতে জার্মানি ও পূর্ব ইউরোপে প্রায় ষাট লক্ষ ইহুদী গণহত্যা সংঘটিত হয়। ইহুদীরা ওইসব অঞ্চলে সংখ্যালঘু হিসেবে বাস করত।

১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় প্রায় আট লক্ষ মানুষের গণনিধন সংঘটিত হয়।

পৃথিবীর যেদিকেই নৃশংসতম গণনিধনের দিকে যখন ফিরে তাকানো হয়, তখন মূল উদ্দেশ্য দেখা যায় সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে সংখ্যালঘুদের ভূমি ও সম্পদের উপর সংখ্যাগুরুদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা।

ভারতে এই সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু ভিন্নরূপে দেখা হয়। ভারতে একই জাতিকে ধর্মের ভিত্তিতে দুই জাতিতে দেখা হয়। 

একই বাঙালি জাতি ধর্মের নামে একে অপরকে নিধনে মেতে ওঠে।

হিন্দু ও মুসলিম দুই ধর্মের লোক কখনো ভিন্ন জাতি হতে পারে না। মারাঠি হিন্দুর সাথে বাঙালি হিন্দুর পার্থক্য আছে জাতিগত ও সংস্কৃতিগত ভিন্নতায়। কিন্তু ধর্মীয় একাত্মবোধে একজন মারাঠির সাথে একজন বাঙালি একীভূত চেতনায় উদ্বেলিত হয় শুধুমাত্র এক ধর্মীয় বিশ্বাসে।

হায়দ্রাবাদের মুসলিমের সাথে বাঙালি মুসলিমও সম কারণে মননে একীভূত হয়।

ঠিক এক কারণে দুই বাঙালি প্রতিবেশি ধর্মীয় বিভেদে হিংসায় মেতে ওঠে। যদিও দুইয়ের জৈবিক ও সংস্কৃতিগত মিল অনেক বেশি। 

একই পরিচ্ছেদে বাঙালি ও পাঞ্জাবিকে যত সহজে আলাদা করা যায়, বাঙালি হিন্দু ও মুসলিমকে একই পরিচ্ছেদে আলাদা করা সম্ভব নয়।

দুই ধর্মের বাঙালির খাদ্যাভ্যাস একই, মাছে-ভাতে বাঙালি। কেউ গোমাংস নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। যদিও বাঙালি মুসলিম সমাজে গোমাংস ধর্মীয় প্রতীকস্বরূপ, যা কখনোই বাঙালির স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস নয়। 

আফ্রিকা থেকে যে প্রথম মানবগোষ্ঠী চারণ শুরু করে, কয়েক হাজার বছরের মধ্যে এই মানবগোষ্ঠী শতধা বিভক্ত হয় এবং অঞ্চলভেদে দৈহিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হতে শুরু করে। গোষ্ঠী থেকে জাতির উন্মেষ হয়। কৃষি ও শিল্পবিপ্লবের ফলে ভূমি ও ভূমিজ সম্পদের উপরে দখলদারির ধারণা গড়ে ওঠে। জাতিগত ভিত্তিতে এক জাতি অন্যদের উচ্ছেদ করে বা বাধ্য করে। ইতিহাসের চলমান পথে প্রায় সবক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু দ্বারা সংখ্যালঘু নিধন সংঘটিত হয়।

বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর পীড়ন হলে ভারতীয় হিন্দুরা যতই শঙ্কার ভাব দেখিয়ে মুসলিম বিদ্বেষের উগ্রতায় মেতে উঠুক, ইতিহাসের দেওয়াল লিখন ধার করে এটা বলা যায় ভারতে মুসলিমরা নিপীড়িত হতে পারে, হিন্দুদের উপর গণনিপীড়ণ সম্ভব নয়।

ঠিক যেমন ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের হিন্দুদের উপর নির্মমতা নেমে আসে, দুই দেশের হিন্দুদের পক্ষে কখনোই সংখ্যাগুরু মুসলিমদের উপর গণনৃশংতা চালানো সম্ভব নয়।

মায়ানমারের ঘটনাও উল্লেখনীয়।  রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা তথাকথিত মায়ানমারের সৈন্যদের উপর হামলার অজুহাতে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করা হয়। এটাও সংখ্যাগুরুদের আগ্রাসী মনোভাব। যে আগ্রাসী মনোভাবে নোবেল শান্তি প্রাপক সু চি রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে ন্যুনতম নিন্দাসূচক মন্তব্য করেন না। সংখ্যালঘুদের ন্যুনতম ভোগাধিকার দিতে সংখ্যাগুরুরা ইচ্ছুক নয়। যদিও এখানে ধর্মীয় বিদ্বেষের থেকে বড় জাতিগত বিদ্বেষ। 

ঠিক শ্রীলঙ্কায় যখন তামিলদের উপর সংখ্যাগুরু সিংহলিরা গণনিধনে মেতে ওঠে, সেখানে বৌদ্ধদের দ্বারা লক্ষাধিক হিন্দু গণহত্যা বা ধর্ষণ নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া ও হিন্দু দলগুলো ন্যুনতম নিন্দাসূচক বক্তব্য প্রয়োগ করে না। বাংলাদেশে মুসলিম কর্তৃক হিন্দুদের ঘর ভাঙচুর হলেই এদেশের হিন্দুদের রক্ত গরম হয়ে ওঠে, ঠিক যেমন কাশ্মীরে মুসলমানদের মৃত্যুতে পাকিস্তানেরা মুসলিমেরা উদ্বেলিত হয়।

শ্রীলঙ্কায় তামিল মৃত্যুতে তামিলনাড়ুর তামিলেরা বিক্ষুব্ধ হয়, কিন্তু সারা ভারতের হিন্দুদের তা নিয়ে ভ্রুকুঞ্চিত হয় না। ঠিক যেমন খান সেনাদের হাতে এক কোটি উদ্বাস্তু বাঙালিকে পশ্চিমবঙ্গ বরণ করে নেয়, সেই জাতিগত কারণে স্বাভাবিক পথে সহানুভূতি গড়ে ওঠে।

ধর্ম ভিত্তিতে কখনো জাতি গড়ে ওঠে না। ফলে ধর্মের নামে যে জাতিগত একাত্মতা দেখানো হয় তা নিতান্তই কৃত্রিম ও রাষ্ট্রীয় মদতে গড়ে ওঠা। 

নাহলে তথাকথিত মুসলিম জাতির পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান এক দশকেই বিচ্ছিন্নতা বোধ করে না  ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে বিচ্ছিন্ন হয় না। আজ বাংলাদেশ শত বিপদের মাঝেও একীভূত আছে এক জাতিগত প্রেরণায়।

এই উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলিম জাতি, সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু ধারণা রাষ্ট্রীয় মদতে বেড়ে উঠেছে। একমাত্রা ধর্ম পারে মানব একতাকে রোধ করতে, শাসকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণজোয়ার গড়ে উঠতে। 

রাষ্ট্র গাজোয়ারি ছাড়া এই উপমহাদেশে গণজোয়ার ও গণজাগরণ রুখে দিতে পেরেছে। 

ধর্মীয় সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু ধারণা থেকে বেরোলে এই উপমহাদেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

X

Never Miss an Update!

Join my newsletter to get the latest posts from littlemag.in directly to your inbox.