মাঘমণ্ডল ব্রত ও সূর্যমঙ্গলের কথা।। রানা চক্রবর্তী


ধর্মঠাকুরের পূজার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে সূর্যপূজার তিনটি ধারা একসঙ্গে এসে মিশেছে - বৈদিক, স্কাইথীয় ও অনার্য, কিন্তু পূর্ববঙ্গে ধর্মঠাকুরের পূজার প্রচলন না থাকায় সেখানে এই স্বতন্ত্র ধারাগুলি বিশেষ একটা ধর্মাচারকে অবলম্বন করে বিকাশ লাভ করার কোন সুযোগ পায়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা স্বতন্ত্রতা রক্ষা করে প্রায় স্বাধীনভাবেই বর্তমান রয়েছে। গবেষকরা একথা স্বীকার করে নেন যে, এদের উপরে হিন্দুধর্মের সর্বজয়ী প্রভাবের ফলে এই স্বাতন্ত্র্যগুলো অনেক সময় খুব পরিষ্কারভাবে অনুভব করা যায় না - তথাপি বৈদিক সূর্যোপসনার সঙ্গে এদের মোটা দাগের পার্থক্য অনুভব করতেও বিশেষ বেগ করতে হয় না। পূর্ববঙ্গের কুমারী মেয়েদের দ্বারা অনুষ্ঠিত 'মাঘমণ্ডলব্রতের' ভেতর দিয়ে প্রাচীন বাংলার সূর্যোপসনার একটা বিশিষ্ট ধারা বিকাশ লাভ করেছে। এটা ধর্মপূজার দেশ পশ্চিমবঙ্গে একেবারেই অপরিচিত। মাঘমণ্ডল ব্রতের বৃত্তান্ত থেকেই এর বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে পরিচয় পাওয়া যায়।
                            
চার-পাঁচ বছর বয়স থেকেই কুমারী মেয়েরা এই ব্রত আরম্ভ করে থাকে। এই ব্রত আরম্ভ করবার পরে পাঁচ বছর পর্যন্ত প্রতি মাঘ মাসের প্ৰত্যেক দিন এটি উদযাপন করা হয় এবং পঞ্চম বছরে গিয়ে এই ব্রত শেষ হয়। সূর্যোদয়ের আগেই কুমারী মেয়েরা শয্যা ছেড়ে উঠে পড়ে, তারপরে মাঘের শীতে কাঁপতে কাঁপতে পুকুরঘাটে বা নদীতীরে গিয়ে উপস্থিত হয়। তাঁরা হাতে এক-একটি করে ফুল নিয়ে জলের একেবারে ধারে গিয়ে বসে এবং এই ব্রতের বিষয়ে অভিজ্ঞ একজন বয়ঃজ্যেষ্ঠ মহিলার নির্দেশ মতন সূর্য-দেবতা বিষয়ক কয়েকটি লৌকিক ছড়া আবৃত্তি করে যায়। এই ছড়াগুলোর ভেতর দিয়ে তাঁরা সূর্যঠাকুরের শৈশব, যৌবনপ্রাপ্তি, বিবাহ ও পুত্রলাভ ইত্যাদি বর্ণনা করে। এই সব ছড়ার মধ্যে দিয়ে তাঁরা নিজেদেরও ভবিষ্যৎ বিবাহিত জীবনের নানান আশা-আকাঙ্খা ব্যক্ত করে থাকে। এই ব্রতের সাথে তাঁদের ব্যক্তিগত অনুভূতির যোগ এতটাই নিবিড় হয় যে, এই ব্রত কোন ধর্মীয় আবহাওয়া সৃষ্টি করার পরিবর্তে, একান্ত গার্হস্থ্য অনুভূতির সৃষ্টি করে। ভোরের উদিত সূর্যের দিকে তাকিয়ে কুমারী মেয়েরা আবৃত্তি করে -

"উঠ উঠ সুরজাই ঝিকিমিকি দিয়া।
তোমারে পূজিব আমি রক্তজবা দিয়া।।
উঠ উঠ সুরজাই ঝিকিমিকি দিয়া।
উঠিতে পারিনা হিমানীর লাগিয়া।।"

দুরন্ত মাঘের শীতে সূর্য উদয় হতে যতই দেরি হয়, কুমারী ব্রতিনীগণ ততই অধৈর্য হয়ে গাইতে থাকে -

"... উত্তর আলা কদম গাছটি দক্ষিণ আলা বাওবে।
গা তোল গা তোল সূর্যাই ডাকে তোমার মাও রে।।
শিয়রে চন্দনের বাটি বুকে ছিটা পড়েবে।
গা তোল গা তোল সূর্যাই ডাকে তোমার মাও রে।।"

শীতের অলস সূর্য কুয়াশা-ধোঁয়াশার ভিতর থেকে উদিত হবার পরে - সূর্যের ধুতি-গামছা পড়া, সূর্যের পূজা, আকাশ রথে সূর্যের যাত্রা, খেয়াপার, সূর্যের বিয়ে করার ইচ্ছা, ঘটকের আগমন, সূর্যের বিয়ে, সূর্যের শ্বশুরবাড়ি যাত্রা, গৌরার সঙ্গ বিবাহান্তে তার স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি কাহিনী গাওয়া হয়। এই মাঘমণ্ডল ব্রতের ভেতর দিয়ে বঙ্গদেশের সূর্যোপসনার প্রাক-পৌরাণিক যুগের একটা সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় লাভ করা যায়।
                             
এরপরে শীতের সকালে, পুকুরে বা নদীতে স্নান করে কুমারী ব্রতিনীগণ বাড়িতে ফিরে আসে। বাড়ির সমস্ত উঠান জুড়ে বিচিত্র আল্পনা আঁকা হয়। আল্পনার পূর্বদিকে একটা বৃত্ত ও পশ্চিমদিকে একটা অর্ধবৃত্ত আঁকা হয় - এগুলো যথাক্রমে সূর্য ও চাঁদের প্রতীক। কুমারী ব্রতিনীগণ সেই বৃত্তাকৃতি সূর্যের আল্পনার পাশে বসে সূর্য বিষয়ক বিবিধ লৌকিক ছড়া আবৃত্তি করতে থাকেন। প্রতি বছর সূর্যের আল্পনায় এক-একটা নতুন বৃত্ত যোগ করতে হয়। পাঁচ বছরে পাঁচটা বৃত্ত পূর্ণ হলে এই ব্রত শেষ হয়। এই বৃত্তগুলো নানা ধরণের রঙিন গুঁড়ো দিয়ে সুরঞ্জিত করা হয়। সূর্য-চাঁদের আল্পনা ছাড়াও সেই একই উঠানের মধ্যে দৈনন্দিন জীবনের নানা ব্যবহারিক বস্তু, যেমন - আয়না, চিরুনি, দোলা, থালা, গ্লাস ইত্যাদি আঁকা হয়। এই সব রঙিন আল্পনা আঁকার জন্য চালের গুঁড়ো, ইঁটের গুঁড়ো ও ছাই ব্যবহার করা হয় - এইসব গুঁড়ো দিয়ে যথাক্রমে সাদা, লাল ও কালো রঙের কাজ চালানো হয়। প্রতিদিন এই ধরণের আল্পনা করে আঁকা প্রত্যেকটি জিনিষের কাছে কুমারী ব্রতিনীগণ নানা ঐহিক বর প্রার্থণা করে থাকে, যেমন - চিরুনির কাছে এই বর প্রার্থনা করে, 'আমি পূজি গুঁড়ির চিরুনি, আমার লাগি থাকে যেন সোনার চিরুনি'। আবার আয়নার কাছে প্রার্থনা করা হয়, 'আমি পূজি গুঁড়ির আয়না, আমার লাগি থাকে যেন আভের আয়না'।

পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক আদিম জাতির মধ্যেই সূর্য উর্বরতা বা উৎপাদন বৃদ্ধির দেবতা বলে কল্পিত হন, এখানেও বাংলার কুমারীকন্যাদের সূর্যের কাছে নানা ঐহিক বর প্রার্থণার মধ্যে যে তাঁদের মাতৃত্বের একটি সলজ্জ কামনা প্রচ্ছন্ন ভাবে থাকে, তা অতি সহজেই বুঝতে পারা যায়। সেইজন্য আদিম সূর্যদেবতার সঙ্গে নারী, বিশেষতঃ কুমারী নারীরই সম্পর্ক বেশি। গবেষকদের মতে, পশ্চিমবঙ্গের কুমারী পূজার শিব, পূর্ববঙ্গের উক্ত কুমারী ব্রতের সূর্য ছাড়া আর কিছুই নন - এই বিষয়ে পূর্ববঙ্গ পশ্চিমবঙ্গ থেকে বেশি রক্ষণশীল। মাঘমণ্ডল ব্রত যে সময়ে উদযাপন করা হয়ে থাকে, সেই সময়টিও বিশেষভাবে লক্ষণীয় - তখন থেকেই সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু হয়। এই সময়টা প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর বহু আদিম ও সভ্যজাতির সূর্যোৎসবের অন্যতম সময়।
                             
মাঘমণ্ডল ব্রত উপলক্ষে একটা সূর্যের পাঁচালী গাওয়া হয় - গবেষকদের মতে এটি শিথিলবদ্ধ কয়েকটি খণ্ড গীতকবিতার সমষ্টি - সেগুলো পূর্ণাঙ্গ আখ্যায়িকা কাব্যের রূপ লাভ করতে পারেনি। এর বিষয়বস্তুর মধ্যে যে একটা বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়, সেটা অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের বিষয়বস্তু থেকে অনেক বেশি প্রত্যক্ষ। এই সূর্যের পাঁচালী মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একটা বিশিষ্ট নিদর্শন। সূর্যের পাঁচালীর গল্পটি অনেকটা এরকম -

শীতকালে ঠান্ডার জন্য কিছুতেই সূর্যঠাকুরের ঘুম ভাঙতে চাইছিল না। অবশেষে তাঁর মায়ের অবিশ্রাম ডাকাডাকিতে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। কুজ্ঝটিকার ভেতর দিয়ে পূর্ব আকাশে সূর্য উঁকি দিলেন - তাঁর আভা ক্রমে রক্তিম থেকে স্বর্ণবর্ণে পরিণত হল - পল্লীর গৃহচূড়া সেই অভায় রঞ্জিত হয়ে উঠল। এবারে সূর্যঠাকুর রূপার বাটি থেকে তেল ও সোনার বাটি থেকে গন্ধদ্রব্য নিয়ে ক্ষীরসাগরে স্নান করতে চললেন। স্নান করে সূর্যঠাকুর একটা গামছা পড়লেন, তারপরে তিনি ভক্তের পূজা গ্রহণ করতে লাগলেন। পূজা গ্রহণ করে বারুইবাড়ি গিয়ে পান-হরতকি দিয়ে মুখশুদ্ধি করলেন, তারপরে যেখানে তাঁর মঙ্গলগান হচ্ছে, তিনি সেখানে চললেন। যাবার পথে তিনি যখন খেয়া নৌকায় নদী পার হচ্ছিলেন, তখন নদীর অপর পাড়ে থাকা দুই ব্রাহ্মণ কন্যার দিকে তাঁর দৃষ্টি আকৃষ্ট হল,

"ঐ পার দুই বাউনের কন্যা মেল্যা দিচ্ছে শাড়ী।
তাস্থা দেখ্যা সূর্যাই ঠাকুর ফেরেন বাড়ী বাড়ী।।"

দুই ব্রাহ্মণ কন্যাকে দেখে সূর্যঠাকুরের মনে পূর্বরাগের সঞ্চার হল। পাড়ার লোকের কাছে একথা গোপন থাকল না। তাঁরা সূর্যঠাকুরের মায়ের কাছে গিয়ে বলল,

"ওগো সূর্যাইর মা!
তোমার সূর্যাই ডাঙ্গর হৈছে বিয়া করাও না।।"

কিন্তু সূর্যের মা জানেন তাঁর ছেলে সেদিনের শিশু মাত্র! সে এখনই কি বিয়ে করবে? তিনি পাড়ার লোকের কথায় কান দিলেন না। এদিকে সূর্যঠাকুরের কি অবস্থা?

"ও পার দুইটি বাউনের কন্যা মেল্যা দিছে কেশ।
তাহা দেখ্যা সূর্যাই ঠাকুর ফেরেন নানা দেশ।।"

সূর্যের মায়ের কাছে গিয়ে পাড়ার লোকেরা আবার বলল,

"ওগো সূর্যাইর মা!
তোমার সূর্যাই ডাঙ্গর হৈছে বিয়া করাও না।।"

সূর্যের মা এবারে সংশয়ে পড়লেন, ছেলের হাবভাব তো নিজে এখনও কিছু বুঝে উঠতে পারেন না। কিন্তু সূর্যঠাকুর নিজের মনের ভাব আর কিছুতেই গোপন করতে পারেন না।

"ওপার দুইটি বাউনের কন্যা মল খাড়ুয়া পায়।
তাহা দেখ্যা সূর্যাই ঠাকুর বিয়া করতে চায়।।"
                             
সূর্যের মা পুত্রের বিবাহে আর আপত্তি করলেন না। এই সূর্যঠাকুরই বাংলার ছেলে-ভুলানো ছড়ার শিবঠাকুর - বাংলার লৌকিক ধর্মে সূর্যই যেমন পরবর্তীকালে শিব হয়ে গেছেন, এদেশের লোকসাহিত্যেও তেমনি সূর্য ও শিব একাকার হয়ে আছেন। এবার সূর্যঠাকুরের বিয়ের পালা। বিয়ে পাকা করার জন্য একজন ঘটক নিযুক্ত করা হল। অবিলম্বে সূর্যের সঙ্গে গৌরার বিয়ে ঠিক হল। কন্যার বয়স মাত্র আট বছর। সূর্যঠাকুর শ্বশুরবাড়ি যাত্রা করলেন - সেখানে কি রকম আচরণ করতে হবে, তাঁর মা তাঁকে তা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। নির্বিঘ্নে বিয়ে শেষ হল। এরপরে বধূ নিয়ে সূর্যঠাকুরের নিজের বাড়ি ফেরার পালা। গল্পের মধ্যে এই অংশটাই সবচেয়ে করুণ। বিয়ের উৎসব-আড়ম্বর শেষ হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই গৌরা বুঝতে পারল, এবারে তাঁকে পিতৃসংসার থেকে বিদায় নিতে হবে। সে নীরবে নিজের মায়ের আঁচলের নীচে গিয়ে লুকালো। তাঁর মা তাঁর মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন,

"টাকা নয় রে কড়ি নয় রে কোটরে রাখিব।
পরের লাগ্যা হইছ গৌরা পরেরে সে দিব।।"

সমাজের নির্মম বিধানকে মাথা পেতে নিয়ে জননীর অন্তরের স্নেহবোধকে স্তম্ভিত করে নিতে হবে। শিশুকন্যা এ'যাবৎ মায়ের আঁচলের নীচে নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে এসেছিল, কিন্তু আজ সে সেটা পেল না -

"অর্ধেক গাঙ্গে ঝড় বৃষ্টি অর্ধেক গাঙ্গে খুয়া।
মধ্য গাঙ্গে বাদ্য বাজে গৌরা লবার লইয়ঞা।।
আড়শী কান্দে পড়শী কান্দে কান্দে রইয়া রইয়া।
গৌরার জনকে কান্দে গামছা মুড়ি দিয়া।।
গৌরার যে ভাই কান্দে খেলার সজ্জ লইয়া।
গৌরার যে মায়ে কান্দে শানে পাছাড় খাইয়া।।"

মায়ের কোল ছেড়ে অসহায় ক্ষুদ্র বালিকা অবশেষে নৌকায় উঠে স্বামীর সঙ্গে শ্বশুরবাড়ির দিকে যাত্রা করল। অশ্রুতমুখী জনতা নদীরতীরে দাঁড়িয়ে তাঁকে বিদায় দিল - নৌকার ভেতর থেকে জনতার দূরগত ক্রন্দনধ্বনি শোনা যেতে লাগল,

"ভাঙ্গা নাও মাদারের বৈঠা চলকে ওঠে পানী।
ধীরে ধীরে বাওরে মাঝি মায়ের কান্দন শুনি।।
নাইয়ারে দিয়াম তাড় বালা মাঝিরে দিয়াম কড়ি।
ধীরে ধীরে বাওরে মাঝি ভায়ের কান্দন শুনি।।
ভাঙ্গা নাও মাদারের বৈঠা চলকে ওঠে পানী।
ধীরে ধীরে বাওরে মাঝি বাপের কান্দন শুনি।।"

অভিমানিনী কন্যা পিতার কান্না শুনে বলছে,

"এখন কেন কান্দন বাপধন মুখে গামছা দিয়া।
তখন নি কইছিলাম তোমায় দূরে না দেও বিয়া।।"

এমনকি এরজন্য কন্যা তাঁর মা ও শিশু ভাইটিকে পর্যন্ত দোষী করছে,

"এখন কেন কান্দ মাগো শানে পাছাড় খাইয়া।
তখন নি কইছিলাম তোমায় দূরে না দেও বিয়া।।
এখন কেন কান্দ ভাইগো খেলার সজ্জ লইয়া।
তখন নি কইছিলাম তোমায় দূরে না দেও বিয়া।।"

একটা অশ্রুভরাক্রান্ত হৃদয় বুকে করে নিয়ে নৌকা নদী প্রবাহে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল - ক্ষুদ্র আনন্দ প্রতিমাকে নদীর জলে বিসর্জন দিয়ে অশ্রুমুখী জনতা তাঁদের শূন্য গৃহে ফিরে গেল। কন্যা-বিদায় বাঙালির গৃহের বিজয়া। এর বেদনা যে কত গভীর - সেটা বাঙালিকে বুঝিয়ে বলতে হয় না। সাহিত্যে এর অনুভূতি বাঙালিকে কবি করেছে, এটাই মৃন্ময়ী দেবী প্রতিমাকে চিন্ময়ী করেছে।
                             
বহুদূরাগত ক্রন্দন যখন আর নদীতীর থেকে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না, তখন অশ্রুমুখী গৌরা তাঁর নববিবাহিত স্বামীর দিকে ফিরে তাকাল। তাঁর আশঙ্কা কিছুতেই যেন দূর হচ্ছে না - স্নেহময়ী স্বামী তাঁর সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর সকল অপরিচয়ের আশঙ্কা এইভাবে দূর করছে,

"তোমার দেশে যাব সূর্যাই বাপ বলিব কারে।
ঘরে আছে আমার বাপ, বাপ বলিবে তারে।।
তোমার দেশে যাব সূর্যাই মা বলিব কারে।
ঘরে আছে আমার মা, মা বলিবে তারে।।
তোমার দেশে যাব সূর্যাই কাপড়ের দুঃখ পাব।
নগরে নগরে আমি তাঁতিয়া বসাব।।"

বাঙালি কবির দৃষ্টিগুণে আকাশের দেবতা যে কিভাবে মাটির মানুষ হয়ে গিয়েছেন, এখানে সেটাই লক্ষ্য করার বিষয়।

এতক্ষন উপরে যে গল্পটির উল্লেখ করা হল, সেটা নিয়ে কোন পূর্ণাঙ্গ আখ্যায়িকা-কাব্য রচনা করা হয়নি। এটি শিথিলগ্রন্থি কতগুলি গীত-কবিতার আকারেই মুখে মুখে প্রচলিত। গার্হস্থ্য স্নেহ-সম্পর্কের বাস্তব অনুভূতির উপরেই এর ভিত্তি। এর মধ্যে কোন আধ্যাত্মিক সুর নেই। এদের উদ্ভবের কোন ইতিহাস এবং এদের রচয়িতারও কোন পরিচয় পাওয়া যায় না। এটি প্রকৃতপক্ষে বাংলার লোকসাহিত্যেরই অন্তর্গত। বাংলার লৌকিক সূর্যকাহিনীর বিশিষ্ট একটি ধারার সঙ্গেই এখানে পরিচয় হয় - এই ধারাটিরও সঙ্গে এই বিষয়ক স্বতন্ত্র ধারাটির যোগ নেই।
                            
বাংলার লৌকিক সূর্যকাহিনীর একটি স্বতন্ত্র ধারা গতানুগতিক পথে অগ্রসর হয়ে মঙ্গলকাব্যের রূপের ভেতর দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু এই ধারাটি অত্যন্ত ক্ষীণ - মাত্র কয়েকজন কবি এই বিষয় অবলম্বন করে সাধারণ কয়েকটি মঙ্গলকাব্য রচনা করেছিলেন। এদের মধ্যে যে কাহিনীটি সাধারণতঃ বর্ণিত হয়ে থাকে তা সংক্ষেপে হল -

এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের দুই কন্যা ছিল - রুমুনা ও ঝুমুনা। ব্রাহ্মণের স্ত্রী বিয়োগ হবার পরে তিনি অত্যন্ত কষ্টে তাঁর দুই কন্যাকে নিয়ে দিন যাপন করছিলেন। ভোরবেলায় ব্রাহ্মণ ভিক্ষা করতে বের হতেন, সারাদিন ঘুরে যা পেতেন, তা নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেন - যা সংগ্রহ করতে পারতেন, তাতেই তিনজনের কোন রকমে দিন কাটাত। একদিন ব্রাহ্মণ ভিক্ষায় বের হয়ে যাবার পরে, তাঁর দুই কন্যা কাছের এক বনে শাক তুলতে গেল। তাঁদের পিতা বাড়ি ফেরার আগেই তাঁরা শাক তুলে বাড়ি ফিরে এল। পরের দিনও তাঁরা এরকম করল। এইভাবে প্রত্যেক দিন তাঁদের পিতা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাবার পরে তাঁরা বনে শাক তুলতে যেত, আবার তাঁদের পিতা বাড়িতে ফেরার আগেই তাঁরা বন থেকে শাক তুলে বাড়িতে ফিরে আসত। একদিন এইভাবে যখন তাঁরা বনের মধ্যে শাক তুলতে গেল, তখন দেখল যে, দেবকন্যারা বনের মধ্যে এক সরোবরের পাশে বসে সূর্যদেবতার পূজা করছে। সূর্যপূজার কারণ জিজ্ঞেস করায় দুই বোনকে দেবকন্যারা জানাল যে, সূর্যদেবতার পূজা করলে সকল বিপদ দূর হয়ে যাবে। দুই বোন সেখানেই দেবকন্যাদের সাথে সূর্যপূজায় যোগ দিল। সূর্যদেবতা তাঁদের ভক্তিতে প্রীত হয়ে তাঁদের সামনে দেখা দিলেন ও খুব তাড়াতাড়ি তাঁদের সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে বলে দুই বোনকে বর দিলেন। দুই বোন বাড়িতে ফিরে দেখল যে তাঁদের ভাঙা কুটিরটি একটি বিশাল রাজপ্রাসাদে পরিণত হয়েছে। প্রথমে তাঁরা নিজেদের বাড়ি দেখে চিনতেই পারল না - পরে সূর্যদেবতার বরের কথা মনে করে অতি সংকোচের সঙ্গে তাঁরা নিজেদের প্রাসাদে প্রবেশ করল। দিনের শেষে ব্রাহ্মণ ভিক্ষা করে বাড়িতে ফেরার পরে দুই বোন তাঁদের পিতাকে সব কথা জানাল। অতুল সম্পদের অধিকারী হয়ে যাওয়ায় পরের দিন থেকে ব্রাহ্মণকেও আর ভিক্ষা করতে বের হতে হল না। ওদিকে সেই রাজ্যের রাজা হঠাৎ একদিন দেখলেন যে, রাজকন্যার অনেক বয়স হয়েছে - তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন যে পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে উঠে যাঁর মুখই প্রথমে দেখবেন, তাঁর হাতেই রাজকন্যাকে সমর্পণ করবেন। সূর্যদেবতা রুমুনা ও ঝুমুনার স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে তাঁদের সব কিছু খুলে বললেন ও তাঁদের পিতাকে পরের দিন ভোরবেলা রাজবাড়ীতে পাঠানোর পরামর্শ দিলেন। দুই বোন ভোর না হতেই ব্রাহ্মণকে রাজবাড়ী পাঠিয়ে দিল - রাজা ঘুম ভেঙে উঠে সবার আগে তাঁরই মুখ দেখতে পেলেন। নিজের প্রতিজ্ঞামতন রাজকন্যাকে তিনি ব্রাহ্মণের হাতে সমর্পণ করলেন। রাজকন্যাকে নিয়ে ব্রাহ্মণ নিজের বাড়িতে ফিরে আসলেন। দুই বোন তাঁদের বিমাতাকে পেয়ে প্রথমে খুব খুশি হল, কিন্তু অল্পদিনেই তাঁরা বুঝতে পারল যে, বিমাতার কাছ থেকে তাঁদের কোন সুখের আশা নেই। এরপরে একদিন দুই বোন যখন সূর্যদেবতার পূজা করছিল তখন তাঁদের বিমাতা তাতে বাধা দিলেন ও ব্রাহ্মণকে তাঁর দুই কন্যাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে বললেন। ততদিনে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণও তরুণী ভার্যার প্রতি বশীভূত হয়ে পড়েছিলেন, তাই তিনি এতে আপত্তি করতে পারলেন না। তাঁর দুই কন্যাকে তাঁদের মাসির বাড়িতে রেখে আসার জন্য তাঁদের সঙ্গে নিয়ে ব্রাহ্মণ বেড়িয়ে পড়লেন। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে তাঁরা এক গভীর বনের মধ্যে প্রবেশ করলেন। বনের পথে বিশ্রাম নেবার জন্য তাঁরা একটা গাছের নিচে বসলেন। পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে দুই বোন সেখানে ঘুমিয়ে পড়ল। এই সুযোগে ব্রাহ্মণ তাঁর দুই কন্যাকে বনের মধ্যে একাকী ছেড়ে দিয়ে নিজের বাড়িতে পালিয়ে চলে এলেন। দুই বোনের ঘুম ভাঙল গভীর রাতে, তাঁরা নিজেদের অবস্থা বুঝতে পারল। বনের হিংস্র পশুর হাত থেকে বাঁচার জন্য তাঁরা উপায় খুঁজতে লাগল। কিন্তু তাঁরা যখন কোন উপায় দেখতে পেল না, তখন বনের মধ্যে এক অশ্বত্থ গাছকে সম্বোধন করে বলল - 'যদি সত্যযুগের অশ্বত্থ হও, তবে আমাদিগকে আশ্রয় দাও।' এই কথা বলার পরেই অশ্বত্থ গাছ নিজের ডালপালা মাটিতে নামিয়ে দিল। দুই বোন গাছের ডালে উঠে বসা মাত্রই সেই গাছ আবার খাড়া হয়ে গেল। এইভাবে হিংস্র পশুর আক্রমণের হাত থেকে তাঁরা সেই রাতে রক্ষা পেল। পার্বতীপুরের রাজা অনঙ্গশেখর পরের দিন বনে শিকার করতে এসে দুই কন্যাকে দেখতে পেয়ে, তাঁদের উদ্ধার করে নিজের রাজপ্রাসাদে নিয়ে গেলেন। বড় কন্যাকে তিনি নিজে বিয়ে করলেন ও ছোট কন্যাকে তিনি তাঁর কোটালের হাতে সমর্পণ করলেন। কালক্রমে তাঁরা উভয়েই অন্তঃসত্বা হল। এক রবিবারে রাণী যখন সূর্যদেবতার পূজা করছিলেন, তখন রাজা হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন যে তিনি কার পূজা করছেন। যখন রাজা জানতে পারলেন যে রাণী সূর্যদেবতার পূজা করছেন তখন রাজা ভীষণ রেগে গিয়ে লাথি মেরে পূজার ঘট ভেঙে দিলেন ও রাণীকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করার জন্য তাঁকে কোটালের হাতে তুলে দিলেন। কোটাল দয়াবশতঃ রাণীকে মুক্তি দিয়ে দিলেন ও রাণী গভীর বনে পালিয়ে গেলেন। যথাসময়ে দুই বোনের দুই ছেলে জন্মাল - রাণীর ছেলের নাম হল 'দুখরাজ' আর কোটালের ছেলের নাম হল 'সুখরাজ'। দুখরাজ নিজের জন্মের পরে তাঁর পিতাকে কোনদিন দেখে নি - সেইজন্য তাঁর মনে কোন শান্তি ছিল না। একদিন বনবাসিনী রাণী তাঁর ছেলেকে তাঁর মাসির বাড়িতে পাঠাল, তাঁর মাসি তাঁকে অনেক উপহার দিলেন। উপহার নিয়ে দুখরাজ যখন তাঁর মায়ের কাছে ফিরে আসছিল, তখন এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশ ধরে সূর্যদেবতা তাঁর কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিলেন। দুখরাজ শূন্য হাতে কাঁদতে কাঁদতে নিজের মায়ের কাছে ফিরে এল। এর কিছুদিন পরে বনবাস থেকে রাণী নিজেই দুখরাজকে নিয়ে তাঁর নিজের বোনের বাড়িতে আসলেন। কোটালের সংসারে তাঁর বোন স্বামী ও পুত্রকে নিয়ে সুখেই বাস করছিল। ইতিমধ্যে সূর্যদেবতার কৃপায় রাজা অনঙ্গশেখরেরও রাণীর কথা মনে পড়ল। তিনি কোটালকে বললেন তাঁর রাণীকে ফিরিয়ে দিতে। কোটালের গৃহেই রাজা-রাণীর পুনরায় মিলন হল। কোটালের বাড়ি থেকে রাজা যখন স্ত্রী ও পুত্রকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন তখন পথের মধ্যে এক অমঙ্গল দেখতে পেয়ে তিনি সাতজন হাড়ীর শিরোচ্ছেদ করার আদেশ দিলেন। কোটাল বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে অবিলম্বে সেই সাতজন হাড়ীর শিরোচ্ছেদ করল। এই সংবাদ পেয়ে সেই সাতজন হাড়ীর মা পুত্রদের শোকে বিলাপ করতে লাগল। সূর্যদেবতা দয়াপরশ হয়ে তাঁদের প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন। এই দৃশ্য দেখে রাজা অবাক হলেন ও সূর্যদেবতার প্রতি রাজার বিশ্বাস জেগে উঠল। তিনিও তখন থেকে পরম ভক্তিভরে সূর্যদেবতার পূজা করতে লাগলেন। সূর্যের কৃপায় তিনি পরম সুখে রাজত্ব করে বৃদ্ধ বয়সে পুত্রকে সিংহাসনে বসিয়ে স্বর্গে আরোহণ করলেন।
                             
উপরে বলা গল্পটি নিয়ে যে কয়টি মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে মাত্র একটির কবির পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর নাম ছিল 'রামজীবন'। ১৬৩১ শকাব্দ অর্থাৎ ১৬০৯ খ্ৰীস্টাব্দে তিনি তাঁর সূর্যমঙ্গল বা 'আদিত্যচরিত' রচনা করেছিলেন। তিনি একটা মনসামঙ্গল কাব্যও রচনা করেছিলেন। মনসামঙ্গল রচনার ছয় বছর পরে রামজীবন সূর্যমঙ্গল রচনা করেন। তিনি এটিকে 'আদিত্যচরিত' বলেও উল্লেখ করেছেন। তিনি এতে প্রচলিত সূর্যব্রতের গল্পকে একটা পাঁচালীর রূপ দিয়েছেন বলে নিজেই উল্লেখ করেছেন। তার আগে এই বিষয়ে অন্য কোন পদ্য-রচনা প্রচলিত ছিল বলে তিনি জানতেন না। কিন্তু তথাপি তাঁর কাহিনীটি মৌলিক নয়। পূর্ব ময়মনসিংহে প্রচলিত 'করমাদি' ব্রতে এই কাহিনীটি শুনতে পাওয়া যায়। করমাদি ব্রত আদতে সূর্যেরই ব্রত। মেয়েদের মুখে মুখে প্রচলিত ব্রতকথার গল্পকে কোন কোন সময় পুরোহিত পদ্যরূপ দিয়ে থাকেন, কদাচিৎ তাতে কবিত্বের স্পর্শও অনুভব করা যায় - এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে দেখতে পাওয়া যায়। রামজীবনের রচনা কবিত্বের বৈশিষ্ট্য বর্জিত ও সর্বাংশেই শেষ যুগের মঙ্গল-কাব্যসমূহের বৈচিত্র্যহীন ও গতানুগতিক প্রণালীতে রচিত। এতে লক্ষ্য করার মতন কোন বিষয় নেই।

মালাধর বসু নামে একজন কবি প্রায় অনুরূপ গল্প নিয়ে 'অষ্টলোকপাল কথা' নামে একটা ছোট কাব্য লিখেছিলেন। সেখানে সূর্যকেই অষ্টলোকপাল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও কালীদাস নামে একজন কবি সূর্যমঙ্গল বা সূর্যের পাঁচালী নামে একটা আখ্যায়িকা কাব্য রচনা করেছিলেন বলে জানতে পারা যায়। তিনি নিজেকে 'দ্বিজ' বলে উল্লেখ করেছিলেন, এছাড়া তাঁর বিষয়ে আর কিছু জানতে পারা যায়নি। গবেষকরা অনুমান করেন যে তিনি খ্ৰীস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তবে দ্বিজ কালীদাস নামে অন্যান্য বিষয়ক মঙ্গলকাব্যের একজন কবির সাথে তাঁর কোন সম্পর্ক আছে কিনা, তা জানার কোন উপায় নেই।
                               
(তথ্যসূত্র:
১- বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য, এ মুখার্জী এন্ড কোং প্রাঃ লিঃ (২০০০)।
২- লোকসংস্কৃতির আলোকে বাংলা মঙ্গলকাব্য: একটি তুলনামূলক পথ, দীপঙ্কর মল্লিক, দিয়া পাবলিকেশন।
৩- মঙ্গলকাব্য পুচ্ছগ্রাহিতা ও মৌলিকতা, স্মৃতিকণা চক্রবর্তী, বিদ্যা।)
                         

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ