যুক্তিবাদীরা এখন ঠিক কোন জায়গায়? ।। রাণা



এই লেখা কোন বিশেষ গোষ্ঠী বা ব্যক্তিবিশেষকে সমর্থন বা আক্রমণ করে নয়। যেহেতু নিজেও কোন এক সময় যুক্তিবাদী আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম, সেই তাগিদ থেকে লেখা। যদিও বর্তমানে পিঠে সরকারি 'আর' চিহ্ন বা দুলাল চন্দ্র ভড়ের সহি ও স্ট্যাম্প না থাকায়, যুক্তিবাদী মাদুলি যথাস্থানে খুলে রেখেছি। 

বাংলায় যখন বিজেপি ১৮টা আসন পায়, বিধানসভায় ৪০%-র কাছাকাছি ভোট মেলে; তা তৃণমূল বা বামফ্রন্টের ব্যর্থতার থেকেও যুক্তিবাদীদের হতশ্রী দশাকে বেআব্রু করে। বরাবরের ৫-৬% ভোট পাওয়া বড়বাজারের দল যখন গোটা বাংলা জুড়ে দাপিয়ে বেড়ায়, তখন কি যুক্তিবাদীদের মাথা হেঁট হওয়া উচিত নয়?

যুক্তিবাদীদের মূল কর্মসূচিগুলো দেখি অথবা তাদের কার্যকলাপের বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করি। 'উৎস মানুষ' ও বি প্রেমানন্দের ধারা থেকে বাংলায় যে যুক্তিবাদী ধারা উজ্জীবিত হয় সেই সময়কে প্রেক্ষাপট হিসেবে ধরার চেষ্টা করেছি। এখানে যুক্তিবাদী বলতে মানুষ তাদের বোঝে, যারা কুসংস্কার নিয়ে ক্রমাগত লড়ে চলে। সেই কুসংস্কার হতে পারে সাপে কাটা নিয়ে, জ্যোতিষীদের ভাগ্য বদলানোর দাবি নিয়ে, বিভিন্ন অযৌক্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি, ম্যাজিক্যাল বিষয়কে হাতিয়ারধারী 'অতিপ্রাকৃত শক্তিধারী'দের বিরুদ্ধে, ডাইনি প্রথার বিরুদ্ধে।

এরপর অনেকেই তুলে ধরতে পারে, বিভিন্ন সামাজিক কর্মে সারাবছর নিজেদের জড়িয়ে রাখাকে। তবে তা বিচ্ছিন্ন ভেবেই এগোতে হবে। কারণ মানুষ যুক্তিবাদী মানে বোঝে কুসংস্কার বিরোধী যোদ্ধাদের।

যুক্তিবাদী কর্মীরা এজন্য সারাবছর বিভিন্ন সচেতনতামূলক পাবলিক শো করে, স্লাইড শো করে, লিফলেট বিলি করে, তথাকথিত গডম্যানদের মুখোমুখি বা দূর থেকে চ্যালেঞ্জ করে, পথসভা করে, বই প্রকাশ করে। সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানে আগুনে হাঁটা, মুখে আগুন, আঙুল দিয়ে মিষ্টি করা, বেগুন বা লেবুতে রক্ত, প্ল্যানচেট, কুলো ঝেড়ে মুড়ি এমন বিষয় দেখায় ও শেখায়।

এখন বেশ কিছু প্রশ্ন এর মধ্যে উঠে এসেছে। যেমন এই কদিন আগে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। তেমন বক্তব্য অনেকের। ১৯৮৬ সালে বি প্রেমানন্দ যে ম্যাজিক জনতার সামনে তুলে ধরে সচেতন করতেন, আজ ৪০ বছর পরেও কি সেই ম্যাজিকগুলো প্রাসঙ্গিক? গত দুই দশকে কজন কুলো ঝেড়ে মুড়ি বের করে মানুষদের ঠকিয়েছে? কতবার মিঠেবাবাদের জন্ম নিয়েছে?

গডম্যানেরা, ভন্ডবাবারা নিজেদের পাল্টে ফেলেছে, যুক্তিবাদীরা কিন্তু সেই চার দশক ধরে নিজেদের একই জায়গায় ধরে রেখেছে। ম্যাজিকে হয়তো বিপুল মানুষের মনোরঞ্জন হয়, কিন্তু মস্তিষ্কে ধর্মীয় উগ্রবাদীতার বিরুদ্ধ মত প্রবেশ করে না। ম্যাজিক উৎসাহী জনতা অপরিবর্তিত যুক্তিবাদী প্রচারে কতটুকু উজ্জীবিত হন, তার বিশ্লেষণ দরকার।

১৯৮০ সালে সাইবাবার ম্যাজিক ভন্ডামিকে পিছনে ফেলে ২০০০ সালে ফেংশুই, রেইকি যে উর্ধ্বগগনে ওঠে, আজ তার জায়গা করে নিয়েছে বিভিন্ন ধর্মগুরুদের মোটভেশনাল স্পিচ ও 'বৈজ্ঞানিক' পদ্ধতিতে সনাতন ঔষধ বিক্রি। স্যোশাল মিডিয়া ও ইউটিউবকে ব্যবহার করে অ বা অর্ধশিক্ষিত বাবাজিরা দ্রুত পকেট ভারি করে চলছে, সেখানে অতিশিক্ষিত  যুক্তিবাদীদের কর্মসূচি পড়ে আছে সেই পুরনো পদ্ধতিতে। গুরুরা খুব দ্রুত নিজেদের পালটে ফেলে, কিন্তু সামাজিক আগুয়ান যোদ্ধাদের এখনো শেখানো হয় কিভাবে কর্পূর দিয়ে মুখে আগুন জ্বালতে হয়। যুক্তিবাদীরা এগোতেও জানেনা, পিছোতেও জানেনা - তাই কি ধরে নিতে হবে? 

আন্না হাজারের লোকপাল সমাবেশের প্রধান উদ্যোক্তা ছিল ধর্মগুরু রবিশঙ্কর। মোটিভেশনাল স্পিচের মাধ্যমে তাদের নিজেদের ব্যবসাও যেমন গুছিয়ে নেয়, তেমন ঠিক জায়গায় ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিতেও কসুর করে না।

যে যুক্তিবাদীদের দাপটে ব্ল্যাক ম্যাজিকাশ্রয়ী গুরুরা একসময় নিজেদের লোকঠকানো ব্যবসার ধরন পাল্টে ফেলে, এখন সেই উদ্যমী ও রূপান্তরিত ভূমিকায় থাকতে যুক্তিবাদীরা এত উদাসীন কেন?

ডাইনি হত্যায় বা চেষ্টায় যুক্তিবাদীরা যত দ্রুততায় পদক্ষেপ নেয়, গোকান্ডে গণপীড়ন বা ধর্মীয় কারণে গণপ্রহারে যুক্তিবাদীদের ভূমিকা কি ট্যুইটার ও ফেসবুকের বিবৃতিতে শেষ হয়ে যায়? 

রাষ্ট্রশক্তি আশ্রিত ধর্মীয় পীড়নে যুক্তিবাদীরা নিজেদের কিভাবে পরিমার্জিত করবে তা তাদেরকেই ভেবে দেখতে হবে, ইতিহাসের পাতায় নব্বই দশকের আগুন বিপ্লবীরা কি এক লাইনেই শেষ হতে চাইবে?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ