আন্দামান ভ্রমণের কারিগর না নীল সাগরের বিশ্বাসঘাতক || সুমন দাঁ


ভারতের নীল সমুদ্র ভাবলেই আন্দামানের কথা মনে হয়। আজ যে আমরা মরিশাস, বালি, ব্যাংকক এর নীল সমুদ্রের স্বাদ দেশের মধ্যেই আন্দামানে পাই, সেটা কার জন্য? জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে প্রায় দেড়শো বছর আগে। চিনতে হবে পোর্টব্লেয়ার এর বালি-তে মিশে যাওয়া সেই রক্তের দাগগুলোকে। আন্দামান ঘুরতে গিয়ে, আবেরদীন বাজারের মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে, সী বীচের জন্য কেনা টুপিটা একবার অন্তত খুলে মাথাটা যদি নত করতে পারেন, তবেই এই গল্প সার্থক।

ঐতিহাসিক গল্পটা শুরু থেকেই শুরু হোক তাহলে।
স্থান কাল আর পাত্র টা প্রথমেই বলে দি।
স্থান দক্ষিণ আন্দামান। অর্থাৎ আজকের পোর্টব্লেয়ার এর উত্তর দিকের বেশ কিছু কিলোমিটার ভিতরে। যার তিন দিক সমুদ্র দিয়ে ঘেরা। ঘন জঙ্গল দিয়ে শরীরটা ঢাকা। তারই মাঝে এক জায়গায় কয়েকটি ইতস্ততঃ ছড়ানো ছিটানো পর্নকুটির। ঠিক যেন "Apocalypto" সিনেমার গ্রামটা ।

কাল 1858। সিপাহী বিদ্রোহের পরের বছর।
পাত্রের বদলে দুটি পাত্রী। আদিম গ্রেট আন্দামানিজ জাতির দুই বোন লিপা ও জিগা । বড় বোন লিপার বয়স কুড়ি, ছোট জিগার ষোলো। তাদের বাবা "প্রতিয়া", মানে তাদের জাতির প্রধান। সবাই তাদের বাবার কথা বিনা বাধায় মেনে নেয়। সেটাই নিয়ম। কিন্তু প্রতিয়া আবার তার ছোট মেয়ে জিগার জেদের কাছে হার মানে বারবার। জিগা মেয়েটা বড্ড একগুঁয়ে।
এক রাতে প্রতিয়ার কাছে খবর আসে, তিনটে অদ্ভুত লোক সমুদ্রের ধারে ডিঙি নৌকা বানানোর চেষ্টা করছে। প্রতিয়া অবাক হয় না। দু রাত আগে বিশাল একটা 'অদ্ভুত লোকেদের দল'-কে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে দেখেছিল তারা। লোকগুলোকে ঘিরে ফেলে বিষমাখানো তীর মেরে এসেছিল প্রতিয়া ও তার দলের শিকারি তীরন্দাজরা। তাদেরই মধ্যে এই তিনজন বেঁচে গিয়ে থাকবে হয়তো!
এই এখন একটা নতুন সমস্যা প্রতিয়ার! এরা কারা, কোথা থেকে মাঝে মাঝে চলে আসছে , বোঝা দুস্কর! দক্ষিণে জঙ্গিল, দক্ষিণের সমুদ্রের ওপারে ওঙ্গি, পশ্চিমে জারোয়া, পশ্চিম সমুদ্রের ওপারে সেন্টিনেল, উত্তরে তাদেরই স্বজাতিদের তারা ভালোমত চেনে। ওদের সাথে বন্ধুত্বও নেই, নেই শত্রুতাও । এই লোকগুলো ওই জাতিগুলোর মত নয়। এদের শরীর তাদের আদিম জাতিগুলোর মত নগ্ন নয়, পোশাকে ঢাকা।
যাই হোক, প্রতিয়া তার দলের সেরা চার পাঁচ তীরন্দাজকে তৎক্ষণাৎ ডেকে নেয়। এই তিন জন অদ্ভুত লোকগুলোকে বেঁচে ফিরতে দেওয়া যাবে না। যে নির্দয়তা তার পূর্বপুরুষরা দেখিয়ে এসেছে উপকূলে ভেঙে পড়া জাহাজ, নৌকার নাবিকদের প্রতি, জাতি রক্ষার স্বার্থে তাকেও সেই নির্দয়তার উদাহরণ হয়ে উঠতে হবে।
একগুঁয়ে জিগা যেতে চাওয়ায় তাকেও সঙ্গে নিলো প্রতিয়া।
এরপর সমুদ্রের ধারে যে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল সেইসময়, তা যদি নাট্যকার একটু অন্যরকম ভাবে শেষ করতেন, তা হলে আমার আপনার সাধের আন্দামান ট্যুর এর স্বপ্ন সেই দেড়শো বছর আগেই সলিলসমাধি ঘটত। তা যখন হয়নি, তাহলে নাটকটাই সংক্ষিপ্ত করে বলে ফেলা যাক।

প্রতিয়ার দল দূর থেকে ঘিরে ধরল ওই তিন অদ্ভুত দর্শন ধারী লোকদের। যথারীতি বিষ তীর ছুঁড়ল। দুজন লুটিয়ে পড়লো। বাকি একজন কোমড়ে তীর বেঁধা অবস্থায় টালমাটালভাবে জঙ্গলের দিকে ছুটে গেল লুকিয়ে পড়বে বলে। কিন্তু জঙ্গল যে বড্ড চেনা জিগাদের! ধরে ফেলতে সময় লাগলো না। প্রতিয়া এক তীরন্দাজকে আদেশ করলো ওকে মেরে ফেলতে। অদ্ভুত লোকটির করুণ মুখখানি জিগার ষোলো বছরের আদিম মনে কি ছাপ ফেললো কে জানে, জিগা তার বাবার কাছে লোকটার প্রাণভিক্ষা করে বসলো। প্রতিয়া আরো একবার হার মানলো ছোটো মেয়ের জেদের কাছে। উঁচিয়ে থাকা তীরের ফলাটা নামিয়ে দিয়ে তীরন্দাজকে আদেশ দিল ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, আহত অদ্ভুত লোকটাকে ওদের গ্রামে নিয়ে যাওয়ার।

প্রতিয়া -জিগা দের আদিম ভাষা না বুঝলেও, জীবনটা যে এ যাত্রায় টিকে গেছে, বুঝতে পারলো দুধরাম !!
হ্যাঁ, লোকটা আমাদের ভারতের নাগরিক দুধরাম তিওয়ারি, জন্ম উত্তরপ্রদেশে। আন্দামান বাসীরা আজও তার কথা স্মরণ করে। নতুন আন্দামান গড়ে তোলার সে একমাত্র কারিগর, বলে বিশ্বাস আদি আন্দামানবাসীর। ব্রিটিশ সরকারও প্রায় সেকথা স্বীকার করে নিয়েছে। সে কথায় পরে আসছি।
গ্রেট আন্দামানিজ আদিম জাতির প্রধান প্রতিয়া, তার মেয়ে জিগা শুদ্ধু জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আহত সভ্য জাতির প্রতীক দুধরাম এর অচৈতন্য শরীরটাকে তাদের গ্রামে নিয়ে যেতে থাকুক, আমরা বরং এই সময় টুকুতে দুধরামের পিছনের জীবনটায় ফিরে তাকাই।
দুধরামের জন্ম উত্তরপ্রদেশে, আগেই বলেছি। 1857 র সিপাহী বিদ্রোহে সে অংশ নেয়। তারপর ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়ে। বিচারে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে দণ্ডিত হয়। কালাপানি পার হয়ে আন্দামানে এসে তাকে ছুঁড়ে ফেলা হয় রস দ্বীপ এর জেলে। সেলুলার জেলে নয় !
সেটা 1858-র 6 এপ্রিল।
আপনারা অবাক হবেন না! সেলুলার জেল তখন তৈরিই হয়নি। 1858 তে যদি আপনি সপরিবার আন্দামান ঘুরতে যেতেন, তাহলে দেখতে পেতেন এক টুকরো প্যারিসকে সাজানো হয়েছে ওই রস দ্বীপ-এ। কি নেই সেখানে! মুখ্য সচিব এর বাংলো ওই সবচেয়ে উঁচু টিলাটার উপরে, সৈন্যদের ব্যারাক, অফিসারদের কোয়ার্টার, নাচ গানের হল, গির্জা, সুইমিং পুল, অনবরত কারেন্ট সাপ্লাই এর ব্যবস্থা, জল পরিশোধন ব্যবস্থা, পোস্ট অফিস, বাজার, হাসপাতাল, ভারতীয় বিদ্রোহীদের কারাগার ইত্যাদি ইত্যাদি। সব ওইটুকু দ্বীপের মধ্যে সুন্দর করে সাজানো, আজ যার ভগ্নাবশেষ দেখার সময়সীমা মাত্র এক ঘন্টায় বাঁধা।
দুধনাথ এই রস দ্বীপের কারাগারে মাত্র 15 দিন বন্দী ছিল। দুরন্ত বিদ্রোহীদের বোধহয় তার বেশি ধরে রাখা যায় না ! দুধনাথ যখন জেল থেকে পালানোর ফন্দি করছে অন্যান্য বন্দীদের একজোট করে, ততক্ষণ ধান ভাঙতে শিবের গীতের মত আন্দামান নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের তখনকার মনোভাব জানা যাক।

বার্মা, থাইল্যান্ড, মালয়, ইন্দোনেশিয়ার সাথে ভারতের মূল ভূখণ্ডের জাহাজ চলাচলের জলপথে অনেক ছোট বড় দ্বীপ পরে, এটা ব্রিটিশ সরকার আগেই লক্ষ্য করেছিল। তারা এটাও বিশ্বাস করত, ওইসব দ্বীপগুলোতে নরখাদকদের বাস। ভগ্ন জাহাজের বিপন্ন নাবিকরা ওইসব দ্বীপগুলোতে আশ্রয় নিলে, কেউ আর ফিরত না। তাই 1788-89 সালে আন্দামানের এক উপযুক্ত জায়গার খোঁজ চালাতে শুরু করে, যেখানে বন্দর গড়ে তোলা যাবে। ইউরোপিয়ান নাবিকদের একটা আশ্রয় আর ভাঙা জাহাজ সরানোর ব্যবস্থা করা জরুরি হয়ে পরে। আর যদি তার সাথে সাথে একটা জেলখানা তৈরি করা যায়, তাহলে মূলভুমির বিদ্রোহীগুলোকে দ্বীপান্তরের জেলে পাঠানো যায়।
এই উদ্দেশ্য নিয়ে সার্ভে করতে আসেন অর্চিবোল্ড ব্লেয়ার। এর নামেই আজ পোর্ট ব্লেয়ার। তিনি আজকের পোর্টব্লেয়ার সংলগ্ন চ্যাতথাম এলাকা বেছে নেন উপনিবেশ বানানোর জন্য। এর সাথে দু বছর পর উত্তর আন্দামানের ডিগলিপুর অঞ্চলকে বেছে নেওয়া হয় বন্দর গড়ার জন্য। বন্দর গড়ার শ্রমিক - ভারতীয় দণ্ডিত অপরাধীরা!
তখনকার জল আবহাওয়া এতটাই খারাপ ছিল আন্দামানের, যে বেশিরভাগ কয়েদির শরীর খারাপ হয়ে মৃত্যু হয়। ব্রিটিশ সরকার আন্দামানে উপনিবেশ বানানো বন্ধ করে দেয়।
প্রায় 70 বছর পর মূল ভূ-ভাগের সিপাহী বিদ্রোহ আবার উপনিবেশ গড়ার চিন্তাকে উস্কে দেয়। 1858 সালের 4 মার্চ 200 জন বন্দি সিপাহীকে নিয়ে জে. পি. ওয়াকার রওনা দেন আন্দামানের উদ্দেশ্যে ও 10 মার্চ চাতথাম দ্বীপে পৌঁছান। এই 10 মার্চ আন্দামান দিবস হিসাবে পালিত হয়। আর ওয়াকার সাহেব পরিচিত হন আধুনিক আন্দামানের জনক হিসাবে।
এরপর উপনিবেশ তৈরি হতে থাকে দুদিকে। একদিকে পোর্টব্লেয়ার সংলগ্ন এলাকায় কয়েদিদের জন্য, আর অন্যদিকে রস দ্বীপে সাহেবদের জন্য। পরিকাঠামোর পার্থক্য চোখে পড়ার মত। রস সেজে ওঠে প্যারিসের পোশাকে আর পোর্টব্লেয়ার গরিব দুয়োরানীর বেশে। রাত্তিরে রসের আলোর রোশনাই, পানশালার অট্টহাসি, গান বাজনার আওয়াজ পোর্টব্লেয়ার এর কয়েদি ব্যারাক এর বন্দীদের কাছে ছিল জেলের চাবুক খাওয়ার শব্দের চেয়েও নিষ্ঠুরতম।

এরপর ধাপে ধাপে আরো কয়েদি আসতে থাকে মূল ভারত থেকে, উপনিবেশ গড়ার কাজে। আমাদের কাহিনীর দুধনাথ আসে 6 এপ্রিল।

মাত্র 15 দিন পর, আরো 90 জন সঙ্গীর সাথে রস আইল্যান্ড ব্যারাক থেকে সাঁতরে পোর্টব্লেয়ার চলে আসে দুধনাথ। রস আইল্যান্ডে ব্রিটিশ অফিসারদের বড় বড় কাঠের বাংলোর জন্য কাঠ আনা হত বার্মা (বর্তমান মায়ানমার) থেকে। গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল বিদ্রোহী কয়েদিদের মধ্যে, যে , 15 দিন 15 রাত টানা উত্তর দিকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটলে বার্মা পৌঁছানো যায়। আর সেখানে পৌঁছালে বার্মা রাজার সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে সম্মানের সাথে জীবন কাটানো যাবে। এই মিথ্যে কল্পনায় আলোড়িত হয়ে , দুধনাথ ও তার সঙ্গীরা পোর্টব্লেয়ার থেকে উত্তরপানে মানে আজকের বাড়াটাঙ্গ এর দিকে জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে শুরু করে। ওদিকে পোর্টব্লেয়ার এর 130 জন কয়েদির দল পালিয়ে এসে দুধনাথদের সাথে যোগ দেয়।

কিন্তু এক মাস চলার পরও তারা বার্মাদেশ খুঁজে পায় না। ক্ষুধা তৃষ্ণায় কিছু সঙ্গী ততক্ষনে ইহলোক ত্যাগ করেছে, বাকিদের শুধু সময়ের অপেক্ষা। এইসময় হঠাৎ 100 জনেরও বেশি আদিম জনজাতি তাদের ঘিরে ফেলে। তাদের নিক্ষেপ করা এক ঝাঁক তীর বুকে নিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সমস্ত পলাতক কয়েদি। না, সবাই না। তিন জন আহত অবস্থায় বেঁচে থাকে। আমাদের দুধনাথ তাদেরই একজন।
তারপরের ঘটনা আগেই বলেছি। সেখান থেকে জুড়ে নিন। এবার চলুন ওই আদিম পাতা ছাওয়া ঘরগুলোর গ্রামে।

দুধনাথ এখন সুস্থ। চার মাস তাকে সেবা করে সারিয়ে তুলেছে জিগা। যারা তীর দিয়ে ক্ষত করতে জানে, তারা শরীর থেকে তীর বের করে ক্ষত সারাতেও জানে! দুধনাথ এখন জঙ্গল থেকে কাঠ বয়ে আনে, জঙ্গলের ফল-মূল চিনতে শিখেছে। যাযাবর জীবনে অভ্যস্ত হচ্ছে ধীরে ধীরে। আদিম মানুষগুলো তাকে বিশ্বাস করে। সেও ভাবে ব্রিটিশদের জেলে কয়েদি থাকার চেয়ে এই জীবন অনেক ভালো। শুধু মাঝে মাঝে রসের কারাগারে বন্দী দেশমাতৃকার ভাই বন্ধুগুলোর জন্য মনটা কেঁদে ওঠে।
জিগার ভালো লেগেছে দুধনাথকে। বাবা প্রতিয়ার কাছে আবদার করে বসলো দুধনাথকে বিয়ে করবে। বড় মেয়ে লিপারই তখনও বিয়ে হয়নি। তাই প্রতিয়া দুই মেয়ের সাথেই দুধনাথের বিয়ে দিয়ে দিলো। দুধনাথকে উলঙ্গ করা হলো, মাথা ন্যাড়া করা হলো, কপালে বাঁধা হল লাল ফেট্টি। দুধনাথ এখন থেকে গ্রেট আন্দামানিজদের একজন !
এরপর সামনের আট মাস নির্বিঘ্নেই কাটছিল দুধনাথের। অল্প অল্প শিখে নিচ্ছিল ওদের ভাষা " আকা বি"। সুযোগের অপেক্ষায় দিন গুনছে সে!

প্রতিয়ার মাথায় নতুন দুশ্চিন্তা এসেছে এরই মধ্যে। ব্রিটিশদের পোর্টব্লেয়ার আর রস দখল তার নজর এড়ায়নি। যে সমুদ্র- জঙ্গল তার পূর্বপুরুষরা রক্ষা করেছে সভ্য জগতের ছোঁয়া থেকে, আজ তা বিপন্ন। আর দেরি না করে জরুরি সভা ডাকে প্রতিয়া। দুধনাথও আসে সেখানে। প্রতিয়ার আগুন ঝরানো বক্তৃতায় আদিম গ্রেট আন্দামানিজরা প্রতিশোধ এর শপথ গ্রহণ করে। তারা এক্ষুনি ব্রিটিশদের উপনিবেশ ধ্বংস করে সভ্য জগৎকে শিক্ষা দিতে চায়।
দুধনাথ বুঝতে পারে ওদের পরিকল্পনা। সভ্য জগতে ফিরে যাওয়ার বাসনা তখনও তার মন থেকে মুছে যায়নি। এই সুযোগ!
10ই মে প্রায় 300 জন আন্দামানিজ যোদ্ধা তীর ধনুকে সজ্জিত হয়ে রওনা দেয় আবেরদীন এলাকার কয়েদি ব্যারাকের দিকে। দুধনাথকেও সঙ্গে নিয়েছিল ওরা। 16 মে এসে পৌঁছায় আজ যেখানে আপনি ওয়াটার জেট স্কুটি চালান, সেই করবিন কোভ বীচে, যা পোর্টব্লেয়ার থেকে মাত্র 4 কিমি দূরে। এখন থেকে তারা নজর রাখতে থাকে উপনিবেশের উপর।

গভীর রাতে যখন আন্দামানের আদিম সন্তানেরা ঘুমে আচ্ছন্ন, দুধনাথ চুপি চুপি শুরু করে তার দৌড়। পৌঁছায় আবেরদীন-এ। দেখা করে ওয়াকার এর সাথে। জানিয়ে দেয় আন্দামানিজদের পরিকল্পনা।

ফল যা হওয়ার তাই হয়। 17 মে ভোরবেলায় আন্দামানিজরা আবেরদীন এলাকায় উপনিবেশের ছাউনিগুলোতে আক্রমণ শুরু করলে, প্রস্তুত থাকা ব্রিটিশ সৈন্যদের বন্দুকের গুলি ও কামানের গোলার সামনে প্রাণ হারাতে থাকে। আন্দামানের আদিম সন্তানদের রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল সেদিনের আবেরদীন, আজকের আবেরদীন বাজার।

ইতিহাসের পাতায় আবেরদীন যুদ্ধ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়নি এ এক আদিম জনজাতির "মুক্তি যুদ্ধ"। আদিম অরণ্যচারী জনজাতির প্রতীক গ্রেট আন্দামানিজদের প্রতি সম্মান দেখাতে কুণ্ঠা বোধ হয় আমাদের। এই যুদ্ধের ফল অন্যরকম হলে, বা বলা ভালো দুধনাথ বিশ্বাসঘাতকতা না করলে, আজ হয়তো আমরা আন্দামান ঘুরতে যেতে পারতাম না, সেন্টিনেল দ্বীপের মত একেও অভ্রম্য করে রাখা হত!
ব্রিটিশরা তাদের নথিতে এই মুক্তিযুদ্ধকে পাত্তাই দেয়নি, সাধারণ এক বর্বর জাতির আক্রমণ বলে খালাস হয়েছে। আর আবেরদীন বাজারের মাঝখানটায় আন্দামানিজদের স্মৃতিস্তম্ভের বদলে বানিয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিজয়গাথা। তাই আজ যদি যান আন্দামান ঘুরতে, একবার অন্ততঃ আবেরদীন বাজারের মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে টুপিটা খুলবেন। দুধনাথের প্রতি শ্রদ্ধায় নয়, লজ্জায়। মাথাটা আপনা থেকেই ঝুঁকে পড়বে ওই অসভ্য, ইতর, বর্বর জনজাতির প্রত্যেক সদস্যের প্রতি, জিগার প্রতি। যারা আমাদেরই এক সভ্য জাতির সদস্যকে বিশ্বাস করেছিল, আর তার মাশুল গুনে আজ নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে।
এরপর আর বেশি কিছু বাকি নেই।

ব্রিটিশ সরকার চিরকালই বিশ্বাসঘাতক দের প্রতি সদয়। দুধনাথ বন্দিজীবন থেকে মুক্তি পায় ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখানোর জন্য। চাকরি জোটে সৈন্যদের খাদ্য সরবরাহ বিভাগে। ফিরে যায় উত্তরপ্রদেশে নিজের গ্রামে।

এসব কিন্তু জানতে পারে না ওই জঙ্গলে পরে থাকা বাকি আন্দামানিজরা। তারা ভাবে দুধনাথ মারা গিয়েছে ব্রিটিশ সৈন্যদের হাতে, শহীদ হয়েছে সে। দুধনাথের মৃত্যুর মিথ্যে খবর শুনে জিগা আত্মহত্যা করে।
ব্রিটিশ সরকার আবেরদীন যুদ্ধকে স্বাধীনতাকামী আদিম জাতির যুদ্ধ মেনে না নিলেও মনে নেয়। ভয় পায়। এরপর পদ্ধতি বদলিয়ে তারা আন্দামান হোম বানায়, যেখান থেকে আদিম জনজাতির প্রতি সেবামূলক কাজকর্ম চালানো হত। আন্দামানিজদের রাখা হত, অসুস্থ হলে চিকিৎসা করানো হত। কারণটা পরিষ্কার। খুব বেশি সৈন্য পোর্টব্লেয়ার-এ পাঠানো হয় না। আদিম জাতিগুলোর সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে উপনিবেশ গড়ার স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেওয়া সম্ভব নয়। প্রতিবার দুধনাথ বাঁচাবে না!
আবেরদীন যুদ্ধের সাত বছর পরে, দুধনাথ আর একবার আন্দামানে আসে। সেই সময় হোমগুলো ঘুরে দেখতে যায়। দুধনাথ সেখানে যাওয়া মাত্র গ্রেট আন্দামানিজরা তাকে চিনে ফেলে ও তাকে ঘিরে আনন্দ প্রকাশ করে! গ্রেট আন্দামানিজরা আজও দুধনাথের আসল রূপ জানতে পারেনি।
যদি আপনি আন্দামানে এসে স্ট্রেট দ্বীপ-এ যান, গ্রেট আন্দামানিজদের সাথে কথা বলেন, দেখবেন ওদের কাহিনীর মধ্যে দুধনাথ আজও সম্মানীয় ব্যক্তি।
এবার আপনারাই বিচার করে বলুন, দুধনাথের কি হিসাবে পরিচিত হওয়া উচিৎ? আন্দামান ভ্রমণের কারিগর না নীল সাগরের বিশ্বাসঘাতক?

---------------------------------
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: উইকিপিডিয়া , রতন চন্দ্র করের লেখা 'কালাপানির কথা' বই।
বিশেষ বক্তব্য: উপরের কাহিনীটি ঐতিহাসিক সত্য। গল্পের প্রয়োজনে কিছুটা কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়েছে। সে জায়গাগুলো আপনারা ঠিকই বুঝতে পারবেন।

অতিরিক্ত তথ্য:
1. আন্দামান হোম তৈরি করে সেবার নামে পরাধীন ভারতবর্ষের ব্রিটিশ সরকার পরবর্তীকালে আন্দামানিজদের দিয়ে জেল পালানো কয়েদিদের জঙ্গল থেকে ধরে আনার কাজে ব্যবহার করে। আন্দামানিজদের ব্যবহার করে জারোয়া ও ওঙ্গি দমনে সফল হয়।
কিন্তু সভ্য মানুষদের সাথে মিশতে মিশতে সভ্য জগতের ছোঁয়াচে মারন রোগগুলো আদিম আন্দামানিজ জাতির মধ্যে ছড়িয়ে যায়। আমাদের যক্ষা, ম্যালেরিয়া, কলেরা ইত্যাদি রোগের ইমিউনিটি ওদের জিনে ছিলো না। এর ফলে, যে আবেরদীন যুদ্ধের সময় গ্রেট আন্দামানিজদের সংখ্যা প্রায় 3500 ছিল, কালক্রমে 1951 তে সেটা গিয়ে দাঁড়ায় মাত্র 25 এ।

স্বাধীন ভারতের সরকার 1969 সালে 23 জন আন্দামানিজ কে স্ট্রেট দ্বীপে বিচ্ছিন্ন করে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। আজ ওদের সংখ্যা 59। ওদের ভাষা আজ অবলুপ্ত। সবাই হিন্দিতে কথা বলে। কেউ কেউ পোর্টব্লেয়ার-এ চাকরিও করে।

2. গ্রেট আন্দামানিজদের অনেক উপজাতি ছিল ভাষার ভিত্তিতে, প্রায় দশ। যেমন আমরা বাঙালি হয়েও বর্ধমান, পুরুলিয়া, মুর্শিদাবাদ বা দক্ষিণ 24 পরগনার লোকেদের ভাষা আলাদা রকমের, সেইরকমই। ওরা পুরো আন্দামানের উত্তর থেকে দক্ষিণে এলাকা ভাগ করে বসবাস করত।

3. ভারত সরকারকে সাধুবাদ জানাই, যে সেন্টিনেলদের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষার নাম করে রিসার্চ দলকে সেন্টিনেল দ্বীপ এ পাঠানো বন্ধ করেছে। পোর্টব্লেয়ার থেকে মাত্র 50 কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ওদের দ্বীপটাতে সভ্য মানুষের যাতায়াত আইনত বন্ধ। ওরা এখনও প্রস্তর যুগেই পড়ে আছে। শিকার করা, আর মাছ ধরা প্রধান জীবিকা। ওদের সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমান সংখ্যা 100 থেকে 200-র মধ্যে।

4. ওঙ্গি-রা লিটল আন্দামানের এক কোণায় বস্তির মত থাকে। তীর ধনুক ভুলে গেছে। পুরুষরা হাফ প্যান্ট, মহিলারা নাইটি পরে। ওখানে বাঙালি উদ্বাস্তুদের(যারা 1947 আর 1971 এ গিয়েছিল) সাথে মিশে গেছে। আমাদের দাবি, ওরা সভ্য হচ্ছে। বর্তমান সংখ্যা 100 র কাছাকাছি।

5. জারোয়ারা দক্ষিণ থেকে মধ্য আন্দামান এর লম্বা জঙ্গলের মধ্যে থাকে। আমরা বাড়াটাঙ্গ এ লাইমস্টোন কেভ দেখতে গেলে আশায় থাকি ওদের যদি একবার দেখতে পাই। তাহলেই ফিরে গিয়ে সবাইকে বলবো জারোয়া দেখে এসেছি! তারা আমাদের দেখতে চায় কিনা, জানতে আমাদের বয়েই গেছে।
জারওয়ারা দক্ষিণ আন্দামানের একদম নিচের দিকে থাকত। গ্রেট আন্দামানিজদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এখন ওদের জঙ্গল দখল করেছে। জারওয়ারা পোর্টব্লেয়ার এ যাতায়াত করে। চিকিৎসার জন্য পোর্টব্লেয়ার এর জি. বি. পান্থ হাসপাতালে আসে, বা নিয়ে আসা হয়। এরাও সভ্য মানুষের সাথে মিশেছে, তবে গভীর জঙ্গলের জারওয়ারা আজও তীর ছোঁড়ে।
বর্তমান সংখ্যা 400 র কাছাকাছি।

6. জঙ্গিলরা আন্দামানে সর্ব নিম্ন দক্ষিণ প্রান্ত রাটল্যান্ড দ্বীপে থাকত। 1931 এর মধ্যে এরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

7. গ্রেট আন্দামানিজ, জারোয়া, ওঙ্গি, সেন্টিনেল, জঙ্গিলরা কেন এতবছর আদিম হয়েই রইলো, তার কারণ হিসেবে ঐতিহাসিক দের অনেক মতবাদের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য মত হল - আনুমানিক 60000 বছর আগে আফ্রিকা থেকে নেগ্রিটো প্রজাতির মানুষ আন্দামানে আসে। তারপর সমুদ্রের জলস্ফীতির কারণে এরা মূল ভূ-ভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সভ্য মানুষের সাথে যোগাযোগ না থাকার কারণে, ইউরোপিয়ানদের আসার আগে পর্যন্ত আদিম জীবনযাপন করত।

পুনশ্চঃ সর্বোপরি, দুধনাথকে বিশ্বাসঘাতক বলে চিহ্নিতকরণ বিতর্কিত, আপনি নাই করতে পারেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ