‘রাজা কাহিনী ।।রানা চক্রবর্তী




ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে কোনও এক ইংরেজ বন্ধুর উপরোধক্রমে রাজা রামমোহন রায় তাঁর একটি সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত পত্রাকারে রচনা করেছিলেন। এই বৃত্তান্তটি প্রথমে সেদেশের এথিনিয়াম লিটারারি গেজেট ও পরে অন্যান্য পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

‘‘প্রিয়বন্ধু,
আমার জীবনের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত আপনাকে লিখিয়া দিবার জন্য আপনি আমাকে সর্বদাই অনুরোধ করিয়াছেন। তদনুসারে আমি আহ্লাদের সহিত আমার জীবনের একটি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত আপনাকে লিখিয়া দিতেছি।
আমার পূর্ব্ব পুরুষেরা উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণ ছিলেন। স্মরণাতীত কাল হইতে তাঁহারা তাঁহাদিগের কৌলিকধর্ম্ম সম্বন্ধীয় কর্ত্তব্যসাধনে নিযুক্ত ছিলেন। পরে প্রায় একশত চল্লিশ বৎসর গত হইল, আমার অতি বৃদ্ধ প্রপিতামহ ধর্ম্মসম্বন্ধীয় কার্য পরিত্যাগ করিয়া বৈষয়িক কার্য ও উন্নতির অনুসরণ করেন। তাঁহার বংশধরেরা সেই অবধি তাঁহারি দৃষ্টান্ত অনুসারে চলিয়া আসিতেছেন। সভাসদদিগের ভাগ্যে সচরাচর যেরূপ হইয়া থাকে, তাঁহাদিগেরও সেইরূপ অবস্থার বৈপরীত্য হইয়া আসিয়াছিল; কখন সম্মানিত হইয়া উন্নতিলাভ, কখনও বা পতন; কখনও ধনী, কখন নির্ধন; কখন সফলতালাভে উৎফুল্ল, কখন বা হতাশ্বাসে কাতর। কিন্তু আমার মাতামহ-বংশীয়েরা কৌলিক ধর্ম্মানুসারে ধর্ম্মযাজক-ব্যবসায়ী; এবং উক্ত ব্যবসায়িগণের মধ্যে তাঁহাদিগের পরিবারের অপেক্ষা উচ্চতর পদবীস্থ অপর কেহই ছিলেন না। তাঁহারা বর্ত্তমান সময় পর্য্যন্ত সমভাবে ধর্ম্মানুষ্ঠান ও ধর্ম্মচিন্তাতে অনুরত ছিলেন। সাংসারিক আড়ম্বরের প্রলোভন ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার আগ্রহ অপেক্ষা, তাঁহারা মানসিক শান্তি শ্রেয়স্কর জ্ঞান করিয়া আসিয়াছেন।
আমার পিতৃবংশের প্রথা ও আমার পিতার ইচ্ছানুসারে আমি পারস্য ও আরব্য ভাষা শিক্ষা করিয়াছিলাম। মুসলমান-রাজসরকারে কার্য্য করিতে হইলে উক্ত দুই ভাষার জ্ঞান একান্ত প্রয়োজনীয়। আমার মাতামহ-বংশের প্রথানুসারে আমি সংস্কৃত ও উক্ত ভাষায় লিখিত ধর্ম্মগ্রন্থ সকল অধ্যয়নে নিযুক্ত হই; হিন্দু সাহিত্য, ব্যবস্থা ও ধর্ম্মশাস্ত্র সকলই উক্ত ভাষায় লিখিত।
ষোড়শ বৎসর বয়সে আমি হিন্দুদিগের পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে একখানি পুস্তক রচনা করিয়াছিলাম। উক্ত বিষয়ে আমার মতামত এবং ঐ পুস্তকের কথা সকলে জ্ঞাত হওয়াতে আমার একান্ত আত্মীয়দিগের সহিত আমার মনান্তর উপস্থিত হইল। মনান্তর উপস্থিত হইলে আমি গৃহ পরিত্যাগপূর্বক দেশভ্রমণে প্রবৃত্ত হইলাম। ভারতবর্ষের অন্তর্গত অনেকগুলি প্রদেশ ভ্রমণ করি। পরিশেষে বৃটিসশাসনের প্রতি অত্যন্ত ঘৃণাবশতঃ আমি ভারতবর্ষের বহির্ভূত কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করিয়াছিলাম। আমার বয়ঃক্রম বিংশতি বৎসর হইলে, আমার পিতা আমাকে পুনর্বার আহ্বান করিলেন, – আমি পুনর্বার তাঁহার স্নেহ লাভ করিলাম। ইহার পর হইতেই আমি ইয়োরোপীয়দিগের সহিত সাক্ষাৎ করিতে ও তাঁহাদিগের সংসর্গে আসিতে আরম্ভ করিলাম। আমি শীঘ্রই তাঁহাদিগের আইন ও শাসনপ্রণালী সম্বন্ধে এক প্রকার জ্ঞানলাভ করিলাম। তাঁহাদিগকে সাধারণতঃ অধিকতর বুদ্ধিমান, অধিকদৃঢ়তাসম্পন্ন এবং মিতাচারী দেখিয়া তাঁহাদিগের সম্বন্ধে আমার যে কুসংস্কার ছিল, তাহা আমি পরিত্যাগ করিলাম; তাঁহাদিগের প্রতি আকৃষ্ট হইলাম। আমার বিশ্বাস জন্মিল, তাঁহাদিগের শাসন, বিদেশীয় শাসন হইলেও, উহাদ্বারা শীঘ্র দেশবাসীগণের অবস্থান্নোতি হইবে। আমি তাঁহাদিগের মধ্যে অনেকেরই বিশ্বাসপাত্র ছিলাম। পৌত্তলিকতা ও অন্যান্য কুসংস্কারবিষয়ে ব্রাহ্মণদিগের সহিত আমার ক্রমাগত তর্কবিতর্ক হওয়াতে এবং সহমরণ ও অন্যান্য অনিষ্টকর প্রথা নিবারণ বিষয়ে আমি হস্তক্ষেপ করাতে, আমার প্রতি তাঁহাদিগের বিদ্বেষ পুনরুদ্দীপিত ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইল; এবং আমাদিগের পরিবারের মধ্যে তাঁহাদিগের ক্ষমতা থাকাতে, আমার পিতা প্রকাশ্যরূপে আমার প্রতি পুনর্ব্বার বিমুখ হইলেন। কিন্তু আমাকে কিছু কিছু অর্থসাহায্য প্রদত্ত হইত। আমার পিতার মৃত্যুর পর আমি অধিকতর সাহসের সহিত পৌত্তলিকতার পক্ষ সমর্থনকারীদিগকে আক্রমণ করিলাম। এই সময়ে ভারতবর্ষে মুদ্রাযন্ত্র সংস্থাপিত হইয়াছে। আমি উহার সাহায্য লইয়া তাঁহাদিগের ভ্রমাত্মক মত সকলের বিরুদ্ধে দেশীয় ও বিদেশীয় ভাষায় অনেক প্রকার পুস্তক ও পুস্তিকা প্রচার করিলাম। ইহাতে লোকে আমার প্রতি এরূপ ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল যে, দুই তিন জন স্কটল্যান্ডনিবাসী বন্ধু ব্যতীত আর সকলেই আমাকে পরিত্যাগ করিলেন। সেই বন্ধুগণের প্রতি ও তাঁহারা যে জাতির অন্তর্গত তাঁহাদিগের প্রতি আমি চিরদিন কৃতজ্ঞ।
আমার সমস্ত তর্ক বিতর্কে আমি কখন হিন্দুধর্ম্মকে আক্রমণ করি নাই। উক্ত নামে যে বিকৃত ধর্ম্ম এক্ষণে প্রচলিত, তাহাই আমার আক্রমণের বিষয় ছিল। আমি ইহাই প্রদর্শন করিতে চেষ্টা করিয়াছিলাম যে, ব্রাহ্মণদিগের পৌত্তলিকতা, তাঁহাদিগের পূর্ব্বপুরুষদিগের আচরণের ও যে সকল শাস্ত্রকে তাঁহারা শ্রদ্ধা করেন ও যদনুসারে তাঁহারা চলেন বলিয়া স্বীকার পান, তাহার মতবিরুদ্ধ। আমার মতের প্রতি অত্যন্ত আক্রমণ ও বিরোধ সত্ত্বেও, আমার জ্ঞাতিবর্গের ও অপরাপর লোকের মধ্যে কয়েকজন অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি আমার মত গ্রহণ করিতে আরম্ভ করিলেন।
এই সময়ে ইয়োরোপ দেখিতে আমার বলবতী ইচ্ছা জন্মিল। তত্রত্য আচার ব্যবহার, ধর্ম্ম ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে অধিকতর জ্ঞানলাভ করিবার জন্য, স্বচক্ষে সকল দেখিতে বাসনা করিলাম। যাহা হউক, যে পর্য্যন্ত না আমার মতাবলম্বী বন্ধুগণের দলবল বৃদ্ধি হয়, সে পর্য্যন্ত আমার অভিপ্রায় কার্য্যে পরিণত করিতে ক্ষান্ত থাকিলাম। পরিশেষে আমার আশা পূর্ণ হইল। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নতুন সনন্দের বিচারদ্বারা ভারতবর্ষের ভাবী রাজশাসন ও ভারতবাসিগণের প্রতি গবর্ণমেন্টের ব্যবহার বহুবৎসরের জন্য স্থিরীকৃত হইবে, ও সতীদাহ নিবারণের বিরুদ্ধে প্রিভি কৌন্সলে আপিল শুনা হইবে বলিয়া আমি ১৮৩০ সালের নবেম্বর মাসে ইংলন্ড যাত্রা করিলাম। এতদ্ভিন্ন, ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিল্লীর সম্রাটকে কয়েকটি বিষয়ে অধিকারচ্যুত করাতে, ইংল্যন্ডের রাজকর্ম্মচারীদের নিকট আবেদন করিবার জন্য, তিনি আমার প্রতি ভারার্পণ করেন। আমি তদনুসারে, ১৮৩১ সালের এপ্রেল মাসে, ইংলন্ডে আসিয়া উত্তীর্ণ হই।
আমি আশা করি, এই বৃত্তান্তটি সংক্ষিপ্ত হইল বলিয়া আপনি মার্জনা করিবেন; কেননা এখন বিশেষ বিবরণ সকল লিখিবার আমার অবকাশ নাই।
                                                 - রামমোহন রায়।।’’

তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন আধুনিক এক ভারতের। দেশের মানুষকে অতীতমুখী, মধ্যযুগীয় মানসিকতার গণ্ডি থেকে বের করে এনে এক নতুন যুগের জীবন দর্শনের আলো দেখানোই ছিল উদ্দেশ্য। গভীর ইতিহাস চেতনা, দৃঢ়তা আর ঈশ্বরবিশ্বাস তাঁর জীবন সংগ্রামে বার বার প্রকাশ পেয়েছে। তবু, তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য তৎকালীন হিন্দু পণ্ডিতসমাজ তাঁকে ‘পাষণ্ড’, ‘ম্লেচ্ছ’, ‘বকধূর্ত’, ‘কাপটিক’, কিংবা ‘নগরান্তবাসী’ নামে সম্বোধন করেছিলেন। এমনকী, এক সময় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের গোঁড়া, ধর্মান্ধ, অসহিষ্ণু কিছু মানুষ তাঁর প্রাণনাশেরও চেষ্টা করেছিল। সে জন্য তাঁকে কম হেনস্থাও হতে হয়নি। তবু, চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও মানুষকে ভালবেসে, বদ্ধ এই সমাজের মধ্যে আলোড়ন তুলে তিনি চেয়েছিলেন সমাজ ব্যবস্থার ক্ষতিকারক নানা দিক বদলে ফেলতে। - তিনি রাজা রামমোহন রায়।
                      
ছেলে বিধর্মী, তাই পৈতৃক সম্পত্তির অধিকারী যেন সে না হয় তার জন্যে মামলা করলেন মা। ছেলে প্রথমে মায়ের বিরুদ্ধে মামলা লড়তে চাইলেন না। কিন্তু পরে ঠিক করলেন, তিনি মামলা লড়বেন। কারণ ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধেই তাঁর লড়াই। আর ধর্মের সাথে আইনের কোনো সম্পর্ক নেই। মামলা কোর্টে উঠল। মা তারিণী দেবী কোর্টে বিচারের সময় বললেন, ‘‘ধর্মত্যাগী পুত্রের মস্তক যদি এখানে ছিন্ন করা হয় তাহলে তা আমি অত্যন্ত পুণ্য কাজ বলে মনে করব।’’ কিন্তু আইন যে ধর্মের দোহাই দিয়ে চলে না। ছেলে মামলায় জয়ী হল। কিন্তু মামলায় জয়ী হওয়ার পর ছেলে তাঁর প্রাপ্ত সম্পত্তি মাকে সসম্মানে ফেরত দিয়ে দিলেন। কারণ, তাঁর যুদ্ধ মায়ের করা মামলার বিরুদ্ধে নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সমাজের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় গোঁড়ামি-কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।

তাঁর পূর্বপুরুষ রাজ সরকারের কাজ করে ‘রায়রায়ান’ উপাধি লাভ করেছিলেন। যদিও তাঁদের কৌলিক উপাধি ছিল ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’। পিতা রামকান্ত ও মা তারিণী দেবী দুইজনই ছিলেন ধর্মপ্রাণ মানুষ। রামাকান্ত শেষ জীবনে বৈষ্ণব হয়েছিলেন এবং হরিনাম করে জীবনের শেষ দিনগুলো অতিবাহিত করেন। শেষে তাঁদের ছেলে কিনা বিধর্মী হবে! পিতার মৃত্যুর পর তাই সম্পত্তির অধিকার নিয়ে বিরোধ বাধলে, মা তারিণী দেবী কোর্টে পুত্রের বিরুদ্ধে মামলা-ই করে বসেন! ভারতের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা এক সমাজ সংস্কারকের প্রথম বিরোধিতার সূত্রপাত খুব সম্ভবত তাঁর নিজ বাড়ি থেকেই।

একদিন তিনি মধু দিয়ে রুটি খাচ্ছেন ঠাকুরবাড়ির দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে। দেবেন্দ্রনাথ রামমোহনের থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট। রামমোহন খেতে খেতে  দেবেন্দ্রনাথকে বললেন - ‘‘বেরাদর, আমি মধু আর রুটি খাচ্ছি, কিন্তু লোকে বলে আমি নাকি গরুর মাংস দিয়ে ভোজন করে থাকি।’’

তাঁর পুত্র রাধাপ্রসাদের বিয়ে। তাঁর বিরুদ্ধপক্ষ উঠেপড়ে লাগল সে-বিয়ে ভাঙার জন্য। এমনকি তাঁকে এক ঘরে করে রাখার আয়োজন অবধি করল। ব্যর্থ হল তাঁরা। তাঁর বিরোধী পক্ষরা কিন্তু সহজে দমে যাওয়ার পাত্র ছিল না। খাস কলকাতার বিরোধী পক্ষ বলে কথা! তাঁর বাড়ির কাছে এসে তাঁরা সকালে মুরগির ডাক ডাকত, কেউবা বাড়ির ভেতরে গরুর হাড় ফেলে দিত। এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে গান রচনা করে শহর কলকাতার রাস্তায় সেই গান গাইবার ব্যবস্থা অবধি তাঁরা করল।

কলকাতায় তখন সেই সবে ব্রাহ্মধর্মের ভিত তৈরি হচ্ছে, তিনি প্রায়শই ব্রাহ্মসভায় উপাসনা করতে যাচ্ছেন। কলকাতার কিছু লোক শুরু করল তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে ঢিল ছোঁড়া। প্রতিদিন একই ঘটনা ঘটতে লাগল। নিরুপায় হয়ে তিনি বাধ্য হলেন বেশিরভাগ সময় গাড়ির জানালা বন্ধ করে রাখতে। শুধু তাই নয়, তাঁর বিরোধীপক্ষের তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা পর্যন্ত করল। আশ্চর্যের কথা, এই বিরোধীপক্ষের কেউই কিন্তু বিদেশি নয়, খাস কলকাতার ‘বাঙালি’। শেষে তিনি আত্মরক্ষার জন্য সঙ্গে পিস্তল সঙ্গে নিয়ে বের হওয়া শুরু করলেন।

স্বাস্থ্যসচেতন ব্যক্তিটি প্রতিদিন প্রায় বারো সের দুধ খেতেন। শোনা যায়, আস্ত একটি পাঁঠার মাংস খেতে পারতেন তিনি। কলকাতায় যখন তাঁর এই ব্রাহ্মভাবধারা প্রচার করা নিয়ে নানান মহলে প্রতিবাদ চলছে, তখন তাঁরই ঘনিষ্ঠ একজন একদিন তাকে এসে জানালেন, তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই কথা শুনে তিনি হেসে বললেন, ‘‘কলকাতার লোক আমাকে মারবে? তারা কী খায়?’’

তিনি ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সপ্তাহে একদিন এই আত্মীয় সভা অনুষ্ঠিত হত। সেখানে বেদান্ত অনুযায়ী এক ব্রহ্মের উপাসনা এবং পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কথা বলা হত। সভায় বেদপাঠের পর ব্রাহ্মসঙ্গীত গাওয়া হত। সভা সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল না, কেবলমাত্র তাঁরই কয়েক জন বন্ধু তাতে যোগদান করতেন। সে-সময় নিন্দুকেরা আত্মীয় সভার বিরুদ্ধে গুজব রটাল যে, আত্মীয় সভায় লুকিয়ে লুকিয়ে গো মাংস খাওয়া হয়। ব্যাস! তাঁর অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু একথা শুনে তাঁকে ত্যাগ করল। কিন্তু তা সত্বেও তিনি নির্বিকার।

যে বেদ শূদ্র সম্প্রদায়ের শোনার অধিকার ছিল না, আর তা উচ্চারণ করলে নাকি জিহ্বা কেটে দেওয়ার রীতি ছিল সেই বেদ-কে অনুবাদ করে সাধারণ মানুষের কাছে উন্মুক্ত করে দিলেন তিনি। ব্যাস! সর্বসাধারণের জন্যে বেদ ছড়িয়ে দেওয়ার ফলে তাঁর বিরুদ্ধে হিন্দু সমাজে চাঞ্চল্য ও উত্তেজনার সৃষ্টি হল। শুরু হল তাঁর প্রকাশ্য বিরোধিতা। ইংরেজি বেদান্ত গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখলেন, “আমি ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করে বিবেক ও সরলতার আদেশে যে পথ অবলম্বন করেছি তাতে আমার প্রবল কুসংস্কারাচ্ছন্ন আত্মীয়গণের তিরস্কার ও নিন্দার পাত্র হতে হল। কিন্তু যাই হোক না কেন, আমি এই বিশ্বাসে ধীরভাবে সমস্ত কিছু সহ্য করতে পারি যে, একদিন  আসবে, যখন আমার এই সামান্য চেষ্টা লোকে ন্যায় দৃষ্টিতে দেখবে।”

এরই মধ্যে তিনি যীশুখ্রিস্টের উপদেশ - ‘শান্তি সুখের পথ’, ইংরাজিতে- ‘Precepts of Jesus-Guide to Peace and Happiness’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই বইটি লেখার জন্য তিনি শুধুমাত্র বাইবেল কিংবা ওল্ড টেস্টামেন্টের ইংরেজি পড়েই ক্ষান্ত হননি, গ্রিক ও হিব্রু ভাষাও আয়ত্ত করেছিলেন। এতদিন তিনি হিন্দু সমাজ ও ধার্মিকদের সাথে বিবাদে জড়িয়ে ছিলেন, এই বই প্রকাশের পর এবার খ্রিস্টান পাদ্রীদের বিরোধিতার সম্মুখীন হলেন। মিশনারি পাদ্রী উইলিয়াম কেরি ও মার্শম্যান সাহেবও এই বইয়ের বিরোধিতা করলেন। ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা “ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া”য় তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করলেন কেরি ও মার্শম্যান। তাঁদের বক্তব্য, লেখক যীশুর উপদেশ মান্য করেছেন ঠিক কথা, কিন্তু প্রভু যীশুর অলৌকিক ঘটনাগুলোকে অস্বীকার করেছেন। ব্যাস! এই নিয়ে উভয়পক্ষের বিরোধ চরমে উঠল। এতদিন ধরে ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস তাঁর সমস্ত বই ছাপতেন। খ্রিস্টানরা বিরোধিতা করার ফলে ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস তাঁর নতুন বই ‘Final Appeal’ ছাপাতে অস্বীকার করল। কিন্তু তিনি হারতে শেখেননি। তিনি নিজেই ‘ইউনিটেরিয়ান প্রেস’ নামে একটি প্রেস নির্মাণ করলেন। আর সেই প্রেস থেকে ‘Final Appeal’ বইটি ছাপা হল। তাঁর লেখা শেষ এই গ্রন্থে তাঁর মেধা ও পাণ্ডিত্য দেখে সবাই অবাক হয়ে গেলেন। তিনি মার্শম্যানের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যে খ্রিষ্টধর্ম নিয়ে তাঁর ভাবনার মধ্যে কোনো যুক্তি নেই এবং তাঁর ভুল কোথায়। মার্শম্যান ভুল বুঝলেন এবং নীরব থাকলেন।

সতীদাহ বিরুদ্ধে প্রথম রামমোহন একটি গ্রন্থ রচনা করেন এবং তার ইংরেজি অনুবাদও প্রকাশ করেন। তিনি প্রমাণ করে দেখান যে এই প্রথা শাস্ত্রবিরোধী। তাঁর এসব কর্মকাণ্ডের ফলে গোঁড়া রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ আবার তাঁর বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হল। তাঁকে মেরে ফেলার জন্য আবার ষড়যন্ত্র শুরু হল। তিনি সতীদাহ নিয়ে শুধু বই লিখেই থেমে থাকলেন না কিংবা ইংরেজদের এই প্রথার বিরুদ্ধে আইন করার জন্যে আবেদন করেই বসে থাকলেন না। তিনি নিজের বন্ধুদের নিয়ে একটি দল গঠন করলেন। তাঁরা সতীদাহ বন্ধ করার জন্যে বিভিন্ন শ্মশানে ছুটে যেতেন। মানুষকে এই প্রথার বিরুদ্ধে বোঝাতেন। চেষ্টা করতেন এই প্রথা বন্ধের। আর এই কাজ করতে গিয়ে তাঁকে প্রতিনিয়ত অনেক লাঞ্ছনা, অপমান ভোগ করতে হল। তারপরও তিনি থেমে থাকেননি। পরের ঘটনা ইতিহাস।

তিনি নারীর সম্পত্তি লাভের জন্যে আন্দোলন শুরু করলেন। তিনি শাস্ত্র ঘেঁটে বলেন- প্রাচীন ঋষিগণ ব্যবস্থা করেছিলেন যে, মৃত-স্বামীর সম্পত্তিতে পুত্রের সাথে স্ত্রীও সমান অধিকারী। একাধিক পত্নী থাকলেও তারা সবাই সমানভাবে সম্পত্তির অংশীদার। ব্যাস! আবার অগ্নিতে ঘৃতাহুতি। কলকাতার রক্ষণশীল সমাজ আবার তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা করল। কিন্তু তিনি মরিয়া। এই আইনও তিনি পাশ করালেন।
                                   
এক যুগ সন্ধিক্ষণে রামমোহনের জন্ম - সে সময় ভারতের ইতিহাসে মধ্যযুগের অবসান শুরু হয়েছে তবু জীবনের সর্বস্তরে আসন্ন নতুন যুগকে বরণ করে নেওয়ার মতো উদারতা কিংবা সাহস খুব কম মানুষেরই ছিল। আর কঠোর জীবন সংগ্রামের মধ্যে রামমোহন হয়ে উঠেছিলেন ঊনবিংশ শতকের বাংলার নবজাগরণের অন্যতম এক নায়ক। কর্মজীবনের প্রথম দিকে রামমোহন পৈতৃক জমিদারির দেখাশোনা করতেন, পরে ১৭৯৬-এ নাগাদ কলকাতায় জোড়াসাঁকো অঞ্চলে এসে জমি, বাড়ি, বাগানের মালিকানা লাভ করেছিলেন। পরে অবশ্য ১৮১৪ থেকে তিনি কলকাতায় বসবাস শুরু করেন এবং চৌরঙ্গী ও মানিকতলায় সম্পত্তিও কিনেছিলেন। আনুমানিক ১৮০৩-০৪ সালে রামমোহন মুর্শিদাবাদ গিয়েছিলেন। সেখানেই আরবি ও ফারসি ভাষায় একেশ্বরবাদ বিষয়ে তাঁর প্রথম লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘তুহফাৎ উল মুবাহ‌্‌হিদ্দীন’। রামমোহনই প্রথম বাঙালি তথা ভারতীয় মনীষী যিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের আড়ালে থাকা জ্ঞানবিজ্ঞান এবং নানা প্রকার প্রয়োগবিদ্যার বৃহৎ সভ্যতা এ দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে। যদিও ব্রিটিশদের শোষণনীতি তিনি কখনও সমর্থন করেননি। তবুও রামমোহন মনে করতেন ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন অন্তত কিছু সময়ের জন্য ভারতের পক্ষে লাভজনক হয়েছিল। কেননা আধুনিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হওয়ার জন্য দেশের মানুষের সঙ্গে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির যোগাযোগের একান্ত প্রয়োজন ছিল। আর আধুনিকতার সেই মন্ত্র এ দেশ রামমোহনের কাছ থেকে লাভ করেছিল।

রামমোহনের ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে তাঁকে কেন্দ্র করেই একটি মিত্রগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। ১৮১৫-তে তাঁদের নিয়েই প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ‘আত্মীয় সভা’। প্রতি সপ্তাহে এক দিন এর অধিবেশন হত বিভিন্ন সদস্যদের বাড়িতে। সেখানে উপস্থিত থাকতেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, গোপীমোহন ঠাকুর, কালীশঙ্কর ঘোষাল, রাজনারায়ণ সেন, কৃষ্ণমোহন মজুমদার, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, নন্দকিশোর বসু প্রমুখ। সেখানে শিবপ্রসাদ মিশ্র যেমন বেদ ও উপনিষদ পাঠ করতেন তেমনই গোবিন্দ মাল ব্রহ্মসঙ্গীত পরিবেশন করতেন। সেখানে জাতিভেদ, সতীদাহ, বহুবিবাহ, বিধবাবিবাহ প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা হত সদস্যদের মধ্যে। বিশেষ উল্লেখযোগ্য ১৮১৬-তে এই সভারই এক অধিবেশনে ডেভিড হেয়ার হিন্দু কলেজ স্থাপনের প্রস্তাব রাখেন। আর যে গোষ্ঠীটি আত্মীয় সভাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ১৮২৮-এ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার পরে তা আরও উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছিল। তবে এই সভার সকলে কিন্তু রামমোহনের মতো সংস্কার বিষয়ে মুক্তমনা ছিলেন না। ‘আত্মীয় সভা’-য় সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে সমালোচনা হতেই বেশ কিছু সদস্য এর সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করেছিলেন। তবে দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রমানাথ ঠাকুর, হরিহর দত্ত, মথুরানাথ মল্লিক, কালীনাথ রায়চৌধুরী প্রমুখ এই আন্দোলনে রামমোহনকে শেষ পর্যন্ত সমর্থন করেছিলেন। এ ছাড়াও ডিরোজিওর তরুণ শিষ্যরা রামমোহনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তবে রামমোহন পরিণত বয়সে ব্যক্তিগত জীবনে খুবই নিঃসঙ্গ ছিলেন। তাঁর ছিল দুই পুত্র, রাধাপ্রসাদ ও রমাপ্রসাদ।

সংবাদ মাধ্যমকে উন্নত করতে রামমোহন তিনটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। দ্বিভাষিক ‘ব্রাহ্মনিক্যাল ম্যাগাজিন ব্রাহ্মণ সেবদি’, বাংলায় ‘সংবাদ কৌমুদি’, ও ফরাসি ভাষায় ‘মীরাৎ-উল-আকবর’। রামমোহনকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়। প্রায় ৩০টি বাংলা গ্রন্থের তিনি রচয়িতা। তাঁর রচিত ‘ব্রহ্মসঙ্গীত’, ‘গৌড়ীয় ব্যকরণ’ উল্লেখযোগ্য। শোনা যায়, সে কালের বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ কালীমির্জার কাছে রামমোহন সঙ্গীতশিক্ষা লাভ করে বাংলায় ধ্রুপদ রচনা করেছিলেন। পরে ব্রাহ্মসমাজে এই গান গাওয়ার প্রচলন হয়েছিল। ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে নিজ খরচে তিনি অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল স্থাপন করেছিলেন। এ ছাড়াও ইংরেজি ভাষায় হিন্দুধর্মের প্রতিশব্দ ‘হিন্দুইজম’ শব্দটি তাঁরই সৃষ্টি।

তিনি দিল্লির বাদশার দূত হিসেবে ইংল্যান্ডে তৎকালীন রাজার কাছে গিয়েছিলেন। সেখানে লি‌ভারপুল বন্দরে তিনি সংবর্ধিত হয়েছিলেন। ১৮৩২ সালের শেষের দিকে তিনি প্যারিসে গিয়ে সম্রাট লুই ফিলিপের দ্বারা সংবর্ধিত হয়েছিলেন।

১৭৭৪ সালের ২২শে মে হুগলি জেলার রাধানগরে জমিদার পরিবারে রামমোহনের জন্ম। পরিবারে রায় পদবীর ব‍্যবহার শুরু হয় প্রপিতামহের সময় থেকে। ফারুখশিয়ারের আমলে প্রপিতামহ কৃষ্ণকান্ত বাংলার সুবেদারের আমিনের কাজ করতেন। ধারণা করা হয় সেই সূত্রে ‘রায়’ পদবীর ব্যবহার। কৃষ্ণকান্তের ছোট ছেলে ব্রজবিনোদ হচ্ছেন রামমোহনের পিতামহ। পিতার নাম রামকান্ত রায়। মায়ের নাম তারিণী দেবী।

তখন শিক্ষার তিনটি ধরণ ছিলো। গুরু মহাশয়ের পাঠশালা, ভট্টাচার্য্যদের চতুষ্পাঠি এবং ফারসি ও আরবি শেখার জন্য মৌলবীদের মক্তব। পাঠশালায় মুসলমানরা যেতেন কিনা, সন্দেহ থাকলেও হিন্দুরা ঠিকই মক্তবে যেত। কারণ মুসলমান শাসকদের রাজকাজে নিয়োগ পেতে হলে আরবি-ফারসি জানা থাকা জরুরী। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের ইতিহাস দেখলে বুঝা যায় রাজপ্রশাসনে সেনাপতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে হিন্দুরা অধিষ্ঠিত ছিলেন। যাহোক, রামমোহনের শিক্ষার শুরু হয় গুরু মহাশয়ের পাঠশালায়। গুরুর নাম নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কার। তার কাছে সংস্কৃত ভাষা রপ্ত করেন। নয় বছর বয়সে রামমোহনের পিতা তাকে পাটনায় পাঠিয়ে দেন আরবি ও ফারসি ভাষায় অধিকতর শিক্ষালাভের জন্য। এখানে লেখাপড়ায় একটু ছেদ কেটে দিই। পাটনা পাঠানোর আগে রামমোহনকে বিবাহ দেন তাঁর পিতা। বালকের উপর নির্যাতন বটে! কিন্তু নির্যাতনের মাত্রা কতটুকু ছিলো বুঝতে পারবেন, যখন জানবেন এটি তাঁর দ্বিতীয় বিবাহ ছিলো। আরো দুঃখের বিষয় প্রথম স্ত্রীর অকাল মৃত্যু হয়েছিলো। দ্বিতীয় বিবাহ দেয়ার বছর কয়েকের মধ্যে ছেলেকে তৃতীয়বার বিয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে রামমোহন রায় বাল্য বিবাহ এবং বহু বিবাহ দু’টিই করেছেন। যদিও এর জন্য তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। কারণ বিয়ের বয়সে এসে তিনি আর কোন বিয়েই করেননি। বরং সে বয়সে গিয়ে বাল্য বিবাহ এবং বহু বিবাহের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন। পিতা রামকান্ত রায়ের মনে কী খেয়াল ছিলো, কে জানে। একদিকে ছেলেকে বিয়ে করিয়ে যাচ্ছেন, আবার অন্যদিকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য একবার এখানে, আবার ওখানে পাঠাচ্ছেন। পাটনা থেকে আরবি ফারসি শিখে বাড়ি ফেরার পর এবার ১২ বছর বয়সে রামমোহনকে যেতে হলো কাশীতে। সেখানে গিয়ে আরো ভালোভাবে সংস্কৃত শেখেন তিনি। এমন হুলস্থুল শিক্ষাসফরে রামমোহনের মাথায় যে জিনিস সবচে বেশি দখল বসিয়েছে, তা হলো ধর্মচিন্তা। আরবি ফারসি শিখতে গিয়ে মৌলবীদের কাছে পেলেন একেশ্বরবাদের চিন্তা, সংস্কৃতি শিখতে গিয়ে পেলেন হিন্দুশাস্ত্রের ব্রহ্মজ্ঞান, যা একেশ্বরবাদ ঘনিষ্ঠ। দু’য়ে মিলে তাঁর মাথায় জন্ম নেয় শত শত চিন্তা ও নতুন ধর্মের রূপ রেখা।
                               
ছেলেকে একাধিক বিয়ে করিয়ে বিপদে না পড়লেও একাধিক ভাষা শেখাতে গিয়ে দারুণ বিপদে পড়লেন রামকান্ত রায়। তাঁর পরিবার অত্যন্ত ধর্মপরায়ন। দিনের অধিকাংশ সময় তিনি ধর্মকর্মে ব্যয় করতেন। রামকান্ত রায়ের স্ত্রীর ধর্ম পালন তখনকার ধর্মঘন সমাজেই ব্যাপকভাবে আলোচিত ছিলো। সম্ভবত তিনি যত দেব দেবীর সন্ধান পেয়েছেন, সবার পূজা করতেন। এমন পরিবারে জন্ম নিয়ে রামমোহন এখন ধর্ম নিয়ে কীসব বলে! ধর্ম বিষয়ক আলোচনায় বাবা রামকান্ত যখন নিজে কোন যুক্তি দেন, রামমোহন তার জবাব শুরু করেন ‘কিন্তু’ শব্দটি দিয়ে। ছেলের এমন ঔদ্ধত্যপনা দেখে তিনি ভীষণভাবে রাগ করেন। ছেলেকে তিরস্কার করেন। এসব রাগ, তিরস্কার, চিন্তা ভাবনার মাঝে মাত্র ষোল বছর বয়সে হিন্দু ধর্মের সমালোচনা করে বই লিখে ফেলেন রামমোহন রায়। বইয়ের নাম ‘হিন্দুদের পৌত্তলিক ধর্মপ্রণালী’। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! যদিও এই বইটি ছাপিয়ে প্রকাশ করার সুযোগ তাঁর ছিলো না, কিন্তু পরিবারের লোকজনকে ঠিকই পড়িয়েছেন। পড়িয়ে উচিত কাজ করেছেন। এবার ফল ভোগ করার পালা। পিতার সাথে আর সম্পর্কই রইলো না। টাকা পয়সা যা ভাগিয়ে নেয়ার তা নিয়ে সেই বছরই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন রাজ্য ভ্রমণ করে নেপালে যান। সেখান থেকে বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার বাসনায় হিমালয় ডিঙিয়ে তিব্বত যান। তখন হিমালয়কে পৃথিবীর সীমান্ত ভাবতো ভারতের লোকজন। সেই সীমান্তে বিচরণ করতে গিয়ে বেশ রোমঞ্চিত ছিলেন তিনি, বোঝা যায়। তিব্বতে গিয়েও বসে থাকলেন না। তাঁদের ভ্রান্ত ধারণাগুলো নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। বালক বয়সে কথার কোন সীমা থাকে না। পদে পদে ‘সীমালংঘন’ হয়। রামমোহনও করলেন। তখন তিব্বতের মানুষের বিশ্বাস ছিলো ‘লামা’ পদবীর মানুষরাই পৃথিবী পরিচালনা করে, মানে ঈশ্বর! তাদের একজন নেতা থাকে, সে মারা গেলে নতুন নেতা আসে। অর্থাৎ ঈশ্বরের আত্মা তার শরীর বদল করেন মাত্র! এ নিয়ে কথা বলে তিব্বতিদের ক্ষেপিয়ে তোলেন। বিচার ও শাস্তির মুখোমুখিও হতে হয়। কিন্তু তিব্বতি নারীরা রামমোহনকে কয়েকবার শাস্তির হাত থেকে রক্ষা করেন। এখান থেকেই নারীজাতির প্রতি তিনি বিশেষ শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কারণ তাঁর ধারণা হয়, পুরুষের চেয়ে নারীরা অধিক মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন। এক সময় তিব্বত থেকে নিজ দেশে ফিরে আসেন। ভারতের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের কোন এক রাজ্যে অবস্থান নেন। খবর পেয়ে লোক পাঠিয়ে ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে আসেন পিতা রামকান্ত রায়। তিনি ভাবলেন প্রায় চার বছর ধরে বনে-বাঁদাড়ে আর বরফে কষ্ট করে ছেলে নিশ্চয় ‘ভালো’ হয়ে গেছে। এখন ধর্মানুরাগী হবে। ধর্ম নিয়ে উল্টাপাল্টা বলে বিরক্ত করবে না। তার উপর মহাজনের কাজে যোগ দিয়ে অর্থ উপার্জনও শুরু করেছে। এক আরামদায়ক সুবাতাসের লক্ষণ পান রামমোহনের পিতা। কিন্তু যত দিন যেতে থাকে, পিতার প্রিয় ‘রাম’ এর আচরণ তাঁর কাছে ‘রাবন’ এর মত ঠেকতে শুরু হয়। ছেলে আগের চেয়ে অধিকমাত্রায় উগ্র ও চরমপন্থী হয়েছে। আগে তবু ভয়ভীতি সহকারে রাখঢাক রেখে মূর্তিপূজা নিয়ে কথা বলতো, এখন আর নূন্যতম সম্মানটুকুও দেখায় না। পিতা ভাবলেন ছেলে উচ্ছন্নে গেছে। দেরি না করে এবার নিজ উদ্যোগে বাড়ি থেকে বের করে দেন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আগের মতই বিস্তর পড়াশোনা ও চিন্তা ভাবনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন রামমোহন রায়। আসলে শিশুকালে পরিবারে অত্যধিক ধর্মাচার, পরবর্তীতে হিন্দু, ইসলাম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্ম নিয়ে লেখাপড়া করার কারণে কিশোর মগজে ধর্ম ছাড়া আর কিছু ছিলো না। তাঁর চিন্তার পুরোটা জুড়ে ছিলো ধর্ম। ফলে নানান প্রশ্ন, যুক্তি, ভাবনা খেলা করে। এই খেলা খুব ভালো খেলা। মজার খেলা। তাই মজায় মজায় দিন পার করতে থাকেন রামমোহন। ১৮০৩ সালে গেলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানিতে, চাকরির উদ্দেশ্যে। ভাবলেন শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত হয়েছেন, দেওয়ানী কাজকর্মে পরিবারের ঐতিহ্য আছে, একটা ভালো চাকরি অবশ্যই পাওয়া যাবে। কিন্তু লাভ হয়নি, শুরুতে কেরানীর চাকরি নিতে হয় তাঁকে। এমনিতেই ব্রিটিশ কম্পানি শাসনে দেওয়ানির (কালেক্টরের সেরেস্তাদারি) উপরের কোন পদে স্থানীয়রা চাকরি পেতেন না। রামমোহন এই দেওয়ানি পদটাই আশা করেছিলেন। এই সময়, অর্থাৎ ১৮০৩ সালে তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। পিতার মৃত্যুর কিছুদিন তিনি আগে রাগ ক্ষোভ ভুলে বাড়ি ফিরে আসেন। মৃত্যুর আগে পিতা রামকান্ত রায় সব সম্পত্তি তিন ছেলের মাঝে ভাগ করে দিলেও রামমোহন দীর্ঘদিন পর্যন্ত পিতার সম্পত্তি গ্রহণ করেননি। পরে গ্রহণ করেও বিপদে পড়েছেন। সে বিষয়ে পরে বলছি। আপাতত পিতৃশোক পালন শেষ হলে পুনরায় কাজে ফিরে যান রামমোহন রায়। কর্মজীবনের শুরুর তিন বছর রামগড়ে, মাঝখানে এক বছর ভাগলপুরে এবং শেষ পাঁচ বছর রংপুরে ছিলেন। রংপুরে থাকা অবস্থায় প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে নিজ প্রবর্তিত ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচার শুরু করেন। কেরাণী হলেও রামমোহনের মাঝে এক ধরণের জমিদারি ভাব ছিলো। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া হয়তো। তিনি তাঁর গৃহে লোকজনকে আমন্ত্রণ দিয়ে এনে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতেন। আলোচনা যে বিষয়ে শুরু হোক না কেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই তা পৌত্তলিকতা, একেশ্বরবাদ, ব্রহ্মা, পরমেশ্বর -এসব বিষয়ে গিয়ে ঠেকতো, এবং শেষ হতো অম্ল মধুর উচ্চবাক্যের মাধ্যমে। ১৮১৪ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবার গ্রামে ফিরে আসেন। চাকরীজীবনের পুরোটাতে তার উপরস্থ কর্মকর্তা ছিলেন মিস্টার ডিগবি নামে এক ইংরেজ লোক। শুরুর দিকে রামমোহনের সাথে রুঢ় আচরণ করলেও ধীরে ধীরে মেধা ও পরিশ্রমের গুণে তাঁর কাছ থেকে সম্মান আদায় করে নিতে সক্ষম হন। এবং তাঁর সাথে থেকেই ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। গ্রামে ফিরে এসে পারিবারিক ব্যবসার দায়িত্ব বুঝে নেন। পাশাপাশি ধর্ম নিয়ে আরো বেশি পড়াশোনা এবং লেখালেখি করতে থাকেন। ততদিনে বহু ঈশ্বরবাদে বিশ্বাস হারিয়ে পুরোপুরি একেশ্বরবাদে ঝুঁকে পড়েন। তাঁর এই বিশ্বাস পরিবর্তনের ফলে তৎকালীন হিন্দু সমাজে দারুণ এক ঝাঁকুনি লাগে। রামমোহন রায় একে একে সকল ধর্মীয় আচারাদি বর্জন করতে থাকলেন। ১৮১৫ সালে নিজ মতের পক্ষে রচনা করেন ‘বেদান্তভাষ্য’ নামে এক গ্রন্থ। এরপর ১৮১৯ সাল পর্যন্ত সময়ে হিন্দু ধর্মের ময়নাতদন্ত করে আরো ছয়টি গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থগুলোর নাম বেদান্তসার, কেনোপনিষদ, ঈশোপনিষদ, কঠোপনিষদ, মাণ্ডূক্যোপনিষদ ও মুণ্ডকোপনিষদ। এসব বইয়ে হিন্দু ধর্মের গ্রন্থগুলোর অংশবিশেষ বাংলায় অনুবাদ করে বিভিন্ন ধর্মীয় কুসংস্কারের অসারতা প্রমানের চেষ্টা করেন। এসময় গ্রামে রামজয় বটব্যাল নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি, রামমোহন ও তাঁর পরিবারকে উত্যক্ত করতে শুরু করেন। আসা যাওয়ার পথে কটুক্তি, বাড়িতে ঢিল ছোঁড়া, হামলায় ভয় দেখানো সহ আরো অনেক কিছু। কিন্তু রামমোহন রায় কখনোই মেজাজ হারাননি। তিনি উত্যক্তের জবাবে চুপ থেকেছেন। এভাবে দীর্ঘদিন বিরক্তি সহ্য করার পর দেখলেন বিরক্তকারীরা ক্ষান্ত হয়েছে। বাইরের উৎপাত বন্ধ হলো। খুব ভালো কথা। এবার শুরু হলো ঘরের উৎপাত। মায়ের শাস্ত্রীয় নাম তারিনীদেবী হলেও পরিবার ও সমাজের লোকজন আদর করে ‘ফুলঠাকুরাণী’ নামে ডাকতেন। রামমোহন রায় এতদিন ধরে ফুলের সৌরভে বড় হয়েছেন, এবার কাঁটা দেখার পালা। ধর্ম নিয়ে ‘বাড়াবাড়ির’ কারণে ছেলে, ছেলের বৌ এবং ছেলের পুত্রবধুকে এলাকা ছাড়া করার পরিকল্পনা নেন। একটু খটকা লাগলো, তাই না? রামমোহনের পুত্রবধূ! হ্যাঁ, ১৮১৪ কি ১৮১৫ সালে প্রথম ছেলেকে বিয়ে দেন। তবে এটা বাল্য বিয়ে ছিলো কিনা বলা যাচ্ছে না। এসময় রামমোহনের বয়স ৪২ বছর। সুতরাং তাঁর পুত্র প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। যাইহোক, একেবারে এলাকা ছাড়া করতে না পারলেও ‘পাপিষ্ঠ’ রামমোহনকে বাড়িছাড়া করা গেছে। বাড়িছাড়া হয়ে পাশের এলাকার শ্মশানের জমিতে তিনি নিজে বাড়ি নির্মাণ করেন। একই সাথে বাড়ির সামনে একটা মঞ্চও নির্মাণ করেন। এই মঞ্চ ছিলো আসলে তার ব্রাহ্মধর্মের উপসনালয়। মঞ্চের চারপাশে খোদাই করে লিখে দেন ‘ওঁ তৎসৎ’ এবং ‘একমেবাদ্বিতীয়ং’। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় এবং বাড়িতে প্রবেশ করার সময় প্রথমে এই মঞ্চের চারপাশে ঘুরপাক খেতেন। এটা ছিলো তাঁর নিজস্ব মতে আরাধনার একটা উপায়। এই উপনাসনালয় ঘিরে তৈরি করলেন ‘আত্মীয় সভা’, যা পরবর্তীতে ‘ব্রাহ্মসভা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পরিচিত বন্ধুবান্ধব ও অপেক্ষাকৃত শান্ত প্রকৃতির লোকজনকে সভায় অন্তর্ভুক্ত করে নেন। আত্মীয় সভায় তাঁরা সমাজ ও ধর্ম নিয়ে আলোচনা করতেন। এসব আলোচনায় রামমোহন হিন্দু ধর্মের প্রাচীন রীতিনীতি পরিবর্তন ও সংস্কারের পক্ষে যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপন করতেন। আসলে কোন বাধাই আর রামমোহনকে আটকে রাখতে পারল না। কারণ তিনি তার নিয়তি ঠিক করে নিয়েছিলেন।
                              ©️রানা©️
এই নিয়তি ঠিক করে নেয়ার পেছনে এক ভয়াবহ কারণ আছে। সে কারণ জানতে একটু পেছনে যেতে হবে। কয়েক বছর আগে রামমোহনকে তাঁর জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনার সাক্ষী হতে হয়েছিল। সেটি ছিল সহমরণ বা সতীদাহ। পিতার মৃত্যুর আট বছর পর ১৮১১ সালে রামমোহনের বড় ভাই জগন্মোহনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় জগন্মোহন যুবকই ছিলেন। অর্থাৎ তাঁর স্ত্রী ছিলেন যুবতী। যুবতী স্ত্রী স্বামী ছাড়া থাকবে কিভাবে! তাই স্বামীর সাথে তাঁকেও পুড়িয়ে মারার ব্যবস্থা করা হয়। রামমোহন রায় তাঁর বৌদিকে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। কোন একজন পুরুষ বা নারী রামমোহনের পক্ষ নেননি, জগন্মোহনের স্ত্রীর পক্ষ নেননি। বৌদির জ্যন্ত দগ্ধ হওয়ার দৃশ্য দেবর রামমোহনের মনে গভীর বেদনার জন্ম দেয়। এই বেদনা থেকেই সতীদাহ প্রথা বন্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন তিনি। রামমোহনের বৌদিকে জ্যন্ত পুড়িয়ে ফেলার দৃশ্যটি নন্দকিশোর বসু নামের এক ব্যক্তি পরবর্তীতে তাঁর পুত্রের কাছে বর্ণনা করেন। সেই বালকের নাম রাজনারায়ণ বসু। যিনি রামমোহনের মৃত্যুর পর এক স্মরণসভায় পিতার বর্ণিত কথাগুলো সবার সামনে বলেন,

‘‘চিতানল ধূধূ করিয়া জ্বলিতেছে, সহগামিনী স্ত্রীর আর্ত্তনাদ যাহাতে কাহারও কর্ণে প্রবিষ্ট না হয়, তজ্জন্য প্রবল উদ্যমে বাদ্যভান্ড বাজিতেছে, সে প্রাণভয়ে চিতা হইতে গাত্রোত্থান করিবার চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু স্বজনেরা তাহার বক্ষে বাঁশ দিয়া চাপিয়া রাখিতেছে; এই সকল নির্দ্দয় ও নিষ্ঠুর কাণ্ড দেখিয়া রামমোহন রায়ের চিত্তে দয়া উদ্বেলিত হইয়া উঠিল, এবং তদ্বধি তিনি প্রতিজ্ঞা করিলেন যে, যে পর্যন্ত সতীদাহ প্রথা রহিত হয়, সে পর্যন্ত তাহা নিবারণের চেষ্টা হইতে তিনি কখনোই বিরত হইবেন না।’’

রামমোহনের আত্মীয় সভা ততদিনে জমে উঠেছে। স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি ইউরোপরীয়রাও উক্ত সভায় অংশ নিতে থাকেন। ১৮১৬ সালে আত্মীয় সভার এক আড্ডায় উপস্থিত হন বাঙালি হিতৈষি সুইস ঘড়ি ব্যবসায়ী ডেভিড হেয়ার। আড্ডা শেষে মিস্টার হেয়ার ইংরেজি শিক্ষা নিয়ে কথা তোলেন। অনেক আলাপ আলোচনার পর একটি ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তুাব নেয়া হয়। বিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব গড়াতে গড়াতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হাই ইস্ট পর্যন্ত পৌঁছায়। এর সাথে যুক্ত হন আরো অনেকে। শেষে একটি কলেজ স্থাপনের উদ্দেশ্যে কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শহরে খবর ছড়িয়ে পড়ে কলকাতায় ‘হিন্দু কলেজ’ নামে একটি কলেজ স্থাপিত হবে। এই প্রস্তাবের সাথে রামমোহন রায় জড়িত আছেন এবং তিনি এ সংক্রান্ত কমিটিতেও থাকবেন। তখন হিন্দু নেতারা বেঁকে বসেন। তাঁরা বললেন রামমোহন কমিটিতে থাকলে তাঁরা থাকবেন না। বিষয়টা রামমোহনের কানে গেলে তিনি খুশি মনে প্রস্তাব ও কমিটি থেকে সরে যান। এবং বলেন, তাঁর কারণে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ থেমে যাবে, এটা তিনি কোনভাবেই চান না। এর পরের বছর ১৮১৭ সালের ২০শে জানুয়ারি কলকাতার গরাণহাটায় হিন্দু কলেজ এর দ্বার উন্মোচন হয়। কলেজ প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত কমিটিতে না থাকলেও কলেজ স্থাপনে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন রামমোহন রায়। এটিই কলকাতায় উচ্চশিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান। যদিও কেবল হিন্দু এবং অবশ্যই উঁচু জাতের হিন্দু ছাত্রদের পড়ার সুযোগ ছিলো এই কলেজে। মুসলমান জনগোষ্ঠী তখনো ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলেও রামমোহন রায় এই কলেজে শিক্ষা নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। বহুঈশ্বরবাদ ত্যাগ করলেও ঈশ্বরবাদ ত্যাগ করতে পারেননি তিনি। তার একেশ্বরের প্রতি তিনি সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাসী ও সমর্পিত ছিলেন। তাই হিন্দু কলেজে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মহীন শিক্ষায় তিনি বিশেষ খুশি হননি। খ্রিস্টান মিশনারিদের শিক্ষা পদ্ধতি ছিলো তাঁর বিশেষ পছন্দের। হোক সেটা খ্রিস্ট ধর্ম, কিন্তু ধর্মতো! সঙ্গত কারণে তিনি ধর্মহীন মানুষকে পছন্দ করতেন না। নাস্তিকদের প্রতি তাঁর বিরূপ মনোভাবের প্রমাণ বিভিন্ন বইয়ে পাওয়া যায়।
                                
তিনি ধর্মহীন শিক্ষায় শংকিত ছিলেন, আবার পুরোনো (সংস্কৃত) শিক্ষা পদ্ধতিতেও রাজি ছিলেন না। কলকাতায় ব্যাপকভাবে ইংরেজি ভাষায় বিজ্ঞান, ভুগোল ও দর্শনসহ অন্যান্য শিক্ষা চালুর বিষয়ে তিনি জোর দিতেন। কিন্তু অল্প কিছু আধুনিক স্কুল কলেজ স্থাপিত হলেও, শিক্ষাখাতে সরকারি ব্যয়ের প্রায় পুরোটাই প্রাচীন শিক্ষাপদ্ধতির পেছনে চলে যেতো। তাই ১৮২৩ সালে তিনি এই বিষয়ে গভর্নর জেনারেল লর্ড আমহার্ষ্টকে একটি চিঠি লিখেন। যদি ইংরেজ জাতিকে প্রকৃত জ্ঞান বিষয়ে অজ্ঞ রাখাটাই উদ্দেশ্য হতো, তা হলে প্রাচীন স্কুলমেনদের বিদ্যার পরিবর্তে বেকন প্রবর্তি জ্ঞান প্রতিষ্ঠা না করলেই হতো। কারণ প্রাচীন জ্ঞানই অজ্ঞতাকে বহাল রাখতো। ঠিক একইভাবে ভারতবাসীকে অজ্ঞতার অন্ধকারে রাখার সবচে উৎকৃষ্ট উপায় প্রাচীন শিক্ষাপদ্ধতি বহাল রাখা। কিন্তু এদেশবাসীর উন্নতিই যদি সরকারের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে শিক্ষা বিষয়ে উন্নত ও উদার রীতি অবলম্বন করা আবশ্যক। অন্যসব বিষয়ের সাথে গণিত, জড় ও জীব বিজ্ঞান, রসায়নতত্ত্ব, শরীর-বিদ্যা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিজ্ঞানশিক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যে টাকা এখন প্রাচীন শিক্ষার পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে, সেই টাকা দিয়ে ইউরোপের কয়েকজন প্রতিভাবান ও জ্ঞানী ব্যক্তিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষার জন্য একটি কলেজ, পাঠাগার, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগার স্থাপন করলে সৎ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারে। পূর্বে গঠিত আত্মীয় সভাকে ১৮২৮ সালে ব্রাহ্ম সমাজে রূপান্তর করেন রামহোমন রায়। নিজে প্রধান থেকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তারাচাঁদ চক্রবর্তীকে নিযুক্ত করেন। সে বছরের শুরু দিকে তারাচাঁদ চক্রবর্তী ও চন্দ্রশেখর দেবের সাথে একটি খ্রিস্টান উপাসনালয় থেকে ফেরার সময় ব্রাহ্ম সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির কথা উঠে। গাড়িতে বসে চন্দ্রশেখর দেব বিদেশীদের উপসানলায়ে যাওয়া নিয়ে আপত্তি তুলে নিজেদের একটি উপাসনালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। তার এই প্রস্তাব রামমোহনের মনপূত হলে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের অপরাপর সদস্য যেমন কালীনাথ মুন্সী, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, মথুরানাথ মল্লিকদের সাথে এই বিষয়ে কথা বলেন। এবং ফিরিঙ্গি কমল বসুর বাড়ি ভাড়া করে ব্রাহ্ম সমাজের জন্য একটি উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের সমস‍্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে সভার সদস‍্যরা আলোচনা করতেন। সভার সকলেই যে রামমোহন রায়ের মত আগ্রাসী সংস্কারমনা ছিলেন, তা বলা যাবে না। কিন্তু সামাজিক সংস্কার ও আধুনিক শিক্ষার বিস্তারে রামমোহনের সাথে ঐক‍্যমত ছিলেন। এই উপাসনালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ‘ব্রাহ্মধর্ম’ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। সে বছর মার্চ মাসে গভর্নর জেনারেল লর্ড আমহার্ষ্ট তার দায়িত্ব শেষে ভারতবর্ষ ত্যাগ করেন। আমহার্ষ্টের স্থলাভিষিক্ত হন উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক। তিনি জুলাই মাসে ভারতে আসেন, দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বেন্টিঙ্ক ছিলেন অপেক্ষাকৃত উদার এবং আধুনিকতা মনস্ক ব্যক্তি। তাই রামমোহনের কাজকর্মে নতুন গতি আসে। কিন্তু এই গতি তাঁকে নতুন কিছু সমস্যার মুখোমুখি করে। রামমোহনের ইংরেজ বন্ধু উইলিয়াম অ্যাডাম খ্রিস্টধর্ম ত্যাগ করে রামমোহন প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। ফলে খ্রিস্টান মিশনারিরা রামমোহনের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উইলিয়াম অ্যাডামকে খ্রিস্টসমাজচ্যুত করে। এসময় ব্রাহ্মসমাজ ও খ্রিস্টসমাজ তুমুল তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধে জেতার জন্য খ্রিস্টধর্মের সমালোচনা ও নিজ ধর্মের গুণগান গেয়ে প্রায় হাফডজন বই লেখেন রামমোহন রায়।

রামমোহন ছিলেন রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ। তিনি তাঁর ঝুঁকি এবং বিপদসমূহ সম্পর্কে সম‍্যক অবগত ছিলেন। তাই নিজের দল ভারী করার কাজে মনোনিবেশ করলেন। অল্পদিনেই পেয়ে গেলেন এমন কিছু বন্ধু, যারা তৎকালীণ সমাজের অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ব‍্যক্তিত্ব ছিলেন। এদের মধ‍্যে দ্বারকানাথ ঠাকুর ও প্রসন্নকুমার ঠাকুর অন‍্যতম। শুধু ভারতীয় নয়, বরং কিছু ইউরোপীয় বন্ধুবান্ধবকেও পাশে পান, যাদের সাথে বাণিজ‍্যিক কারণে পূর্বসম্পর্ক বিদ‍্যমান ছিলো।

কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ব্রাহ্মসমাজে ভাঙ্গন শুরু হয়। যখন রামমোহন রায় সহমরণ রীতি বা সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন, তখন কেউ কেউ ব্রাহ্মসমাজ ত্যাগ করেন। তাতে সতীদাহ প্রথা নিয়ে রামমোহনের মুখ বন্ধ করা যায়নি। আসলে শুধু কথা বলা নয়, এই হত‍্যাপ্রথা বন্ধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন তিনি। সমাজনেতা রাধাকান্ত দেবসহ কট্টর হিন্দুজোটের তীব্র বাধা সত্ত্বেও তিনি ব্রিটিশ সরকারকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হন। ১৮২৯ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর বৃটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীতে সতিদাহ প্রথাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল ঘোষণা করা হয়।

‘‘It is hereby declared, that after the promulgation of this regulation, all persons convicted of aiding and abetting in the sacrifice of a Hindu widow by burning or burying her alive, whether the sacrifice be voluntary on her part or not, shall be doomed guilty of culpable homicide and shall be liable to punishment by fine or imprisonment or both by fine and imprisonment.’’ — Regulation of 4th December, 1829.

এজন‍্য রামমোহন রায়কে কম মূল‍্য দিতে হয়নি। হিন্দু পন্ডিতরা তাঁকে পাষন্ড, বকধূর্ত, কাপ্টিক, নগরান্তবাসী সহ নানাবিধ অপমান ও অবজ্ঞাসূচক বিশেষণে বিশেষায়িত করেন। ব্রাহ্মসমাজের উপাসনালয়ে আসা যাওয়ার পথে উগ্র, উচ্ছৃঙ্খল যুবকেরা তার প্রাণনাশের চেষ্টা পর্যন্ত করে। প্রাণ রক্ষার্থে নিরাপত্তা প্রহরীবেষ্টিত হয়ে শহরে চলাফেরা করতেন তিনি। আইন পাশ হওয়ার পর কট্টর হিন্দুরা থেমে থাকেনি। রামমোহনের যাত্রাভঙ্গ করার জন‍্য ১৮৩০ সালের ১৭ই জুন প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ধর্মসভা’ নামে হিন্দু ধর্মের বর্বরতা রক্ষার এক সমিতি। রাজা রাধাকান্ত দেব, রামকমল সেন, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বেশ কিছু গোঁড়া হিন্দু একত্রিত হয়ে সংস্কৃত কলেজে এক সভায় হিন্দুধর্ম রক্ষার জন্য এই সংগঠনের পত্তন করেন। তাঁদের উদ‍্যোগে লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে সতীদাহ প্রথা রদের দাবিতে মামলা করা হয়। ১৮৩২ সালে প্রিভি কাউন্সিল বাংলার গভর্ণর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের ১৮২৯ সালের আদেশ বহাল রাখেন। খুব অল্পসময়ের মধ্যে ভারতের অন্যান্য কোম্পানি অঞ্চলেও সতীদাহ প্রথাকে বাতিল ঘোষণা করা হয়।
                          
ততদিনে রামমোহন রায়ের চিন্তা চেতনা ছড়িয়ে পড়ে ব‍্যাপকভাবে। তাঁর সংস্কার যুগের স্বর্ণসময়ে শহরে নানান প্রগতিশীল সংগঠন জন্ম নেয়। যাদের মধ‍্যে ইয়ং বেঙ্গল তথা অ‍্যাকাডেমিক অ‍্যাসোসিয়েশন অন‍্যতম। হিন্দু কলেজকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নব‍্যবঙ্গ আন্দোলন বা ইয়ং বেঙ্গল ছিলো তরুণদের মুক্তবুদ্ধির আন্দোলন। নেপথ‍্যে ছিলেন এক ইউরেশীয় কবি ও কিশোর শিক্ষক ডিরোজিও। ১৮২৮ সালে তিনি যখন হিন্দু কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন, তখন এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটে যায়। তাঁর চিন্তা ও দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একদল হিন্দু যুবক একরোখা সংস্কারে নেমে পড়ে। তাঁরা ইয়ং বেঙ্গল নামে সুপরিচিত ছিলেন। ডিরোজিওর শিষ‍্যরা সবাই ছিলেন তরুণ হিন্দু ছাত্র। আর এই হিন্দু ছাত্রদের সাহস ও প্রেরণার উৎসে ছিলেন রামমোহন রায়। কিন্তু রামমোহন যখন ধর্মত্যাগী হিন্দুদের জন্য অপেক্ষাকৃত কম ঈশ্বরসম্পন্ন ব্রাহ্ম ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন, তখন ইয়ং বেঙ্গল নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠার বিষয়টি ভালো চোখে দেখেনি। এবং রামমোহন রায় ও ব্রাহ্মসমাজকে আধা ‘উদারবাদী’ বলে তাঁরা সমালোচনা করতেন। যদিও সেই অর্থে রামমোহনের সাথে ইয়ং বেঙ্গলের তেমন কোন বিরোধ ছিলো না। বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা ঐক্যমত ছিলেন। এমনকি বর্তমান সময়ে এসেও রামমোহন রায় আমাদের সামনে প্রেরণার উৎস হয়ে টিকে আছেন, থাকবেন। তিনি যদি তৎকালীন হিন্দু ধর্ম ও সমাজ সংস্কারে আগ্রাসী ভূমিকা পালন না করতেন, তাহলে বর্তমানে ধর্মের শিকল ভেঙে বেরিয়ে আসার প্রয়াস এত অগ্রগামী হতো না। তিনি তাঁর সময়ে ধর্ম বিশ্বাসের জঞ্জালে সংস্কারের কাঁচি চালিয়েছেন বলেই আজ আমরা এ অঞ্চলে মুক্তচিন্তার ফসল ফলাতে পারছি।

রামমোহনের কলম ও কণ্ঠ কেবল ধর্ম ও সমাজ সংস্কারে নিহিত ছিলো না। ব্রিটিশ সরকারের অনুগত হয়েও বিভিন্ন অন‍্যায় উদ‍্যোগে তার প্রতিবাদী ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়। রামমোহন রায়সহ তখনকার শিক্ষিত সমাজের একাংশ মনে করতেন ব্রিটিশ শাসনের সূত্র ধরে পশ্চাৎপদ, কুসংস্কারচ্ছন্ন ভারতবর্ষে ইউরোপের আধুনিক চিন্তা চেতনার প্রবেশ ঘটানোর সুযোগ নেয়া জরুরী। তাঁরা মনে করতেন ইংল্যান্ডের মানুষ যে স্বাধীনতা ও ব‍্যক্তি স্বাতন্ত্রবোধ উপভোগ করেন, তার স্বাদ যদি ভারতের জনগণ পায়, তাহলে সমাজ অন্ধকারে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটতে বেশি সময় লাগবে না।

ভারতীয় জনগণের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন বৈষম্যমূলক আচরণে রামমোন রায় ও তাঁর বন্ধুরা ক্ষুব্ধ ছিলেন। ১৮২৩ সালে গভর্নর জেনারেল জন অ্যাডাম ভারতীয় প্রেসের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন। এই বিধিনিষেধ আরোপের পর রামমোহন ও তাঁর বন্ধুগণ প্রিভি কাউন্সিলে স্মারকলিপি পেশ করে বলিষ্ঠভাবে এর প্রতিবাদ করেন। কিন্তু প্রথম চেষ্টায় স্মারকলিপিটি প্রত্যাখ্যাত হয়। প্রত‍্যাখ‍্যান করার সময় বলা হয়, যে দেশ রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করে না সেখানে প্রেসের স্বাধীনতা থাকতে পারে না। রামমোহন ও তাঁর বন্ধু দ্বারকানাথ ঠাকুর আবার উদ্যোগী হন। ১৮২৬ সালে হিন্দু ও মুসলমান নাগরিকদের পক্ষে একটি আবেদনপত্র ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রেরণ করেন। যার প্রতিপাদ‍্য ছিলো ভারতীয় জুরি আইনের নির্দিষ্টসংখ‍্যক বৈষম‍্যমূলক ধারার প্রতিবাদ। এছাড়াও বিভিন্ন সময় তিনি ব্রিটিশ সরকারের উপর মহলে নানান বিষয়ে তাঁর অসম্মতি এবং অস্বীকার জানিয়ে পত্র প্রেরণ করেন। যেসব অসম্মতি ও অস্বীকারের সাথে ভারতবর্ষের জনস্বার্থ সরাসরি জড়িত ছিলো। তিনি ছিলেন জনগণের স্বাধীনতার পক্ষে এবং স্বৈরতন্ত্রের বিপক্ষে। তাঁর মতে স্বাধীনতার শত্রুরা এবং স্বৈরতন্ত্রের দোসররা কখনও সাফল‍্যমন্ডিত হয়নি এবং কখনও হবেও না। ১৮২২ সালের ১১ই আগস্ট তারিখে জেমস সিল্ক বাকিংহামের নিকট লেখা চিঠিতে তিনি একথা উল্লেখ করেন। ১৮৩০ সালে ইংল্যান্ড ভ্রমণে যাওয়ার আগে কিছুদিন ধরে সরকারের উচ্চপদে স্থানীয় ভারতীয়দের নিয়োগ দেয়া নিয়ে ব্রিটিশ রাজের সাথে দরকষাকষি করেন। তিনি দেশের শাসনব্যবস্থায় স্বদেশীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উপর গুরুত্বারোপ করেন। ফলে ১৮৩৩ সালে ভারতীয়দের সরকারের উচ্চপদে নিয়োগের সুবিধা দিয়ে নতুন আইন প্রয়োগ করা হয়।

হিন্দু ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের বাইরে সাধারণ মানুষের চিন্তায় পরিবর্তন আনতে তিনি আরো কিছু কাজ করেছেন। সংবাদ মাধ‍্যমের উন্নতি সাধন যার মধ‍্যে অন‍্যতম। তিনি মোট তিনটি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। দ্বিভাষিক ব্রাহ্মনিক্যাল ম্যাগাজিন ‘ব্রাহ্মণ সেবদি’, বাংলায় ‘সংবাদ কৌমুদি’, ও ফার্সি ভাষায় ‘মীরাৎ-উল-আকবর’।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ‍্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হলেও অনেকেই মনে করেন রামমোহন রায় হচ্ছেন বাংলা গদ‍্যের জনক। বাংলা গদ‍্য সাহিত‍্য সমৃদ্ধিলাভ করে তাঁর হাত ধরে। বাংলা ভাষায় তিনি প্রায় ৩০টি গ্রন্থ রচনা করেন। ইংরেজদেরকে বাংলা ভাষা শেখানোর জন্য তিনি ইংরেজিতে বাংলা ব্যাকরণগ্রন্থ রচনা করেন। ওই সময়ের বিখ‍্যাত সঙ্গীতজ্ঞ কালীমির্জার কাছে সঙ্গীত শিক্ষা লাভ করে বাংলায় ধ্রুপদী রচনা করেছিলেন রামমোহন রায়। এক জীবনে এত এত সৃজনশীল কাজ ও প্রতিবাদের সম্মিলন বিরল।

১৮৩০ সালে পুতুল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর রামমোহন রায়কে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এরপর তিনি ইংল‍্যান্ড ভ্রমণে যান। ইংল‍্যান্ডে ব্রিটিশ সমাজের নেতৃবৃন্দ রামমোহনকে আন্তরিক সংবর্ধনা জানান। ১৮৩২ সালে ফ্রান্স সফর করেন। ১৮৩৩ সালে আবার ইংল‍্যান্ডে ফিরে আসেন এবং অ‍্যাভন (Avon) নদীর তীরে অবস্থিত ঐতিহাসিক ব্রিস্টল শহরে বেড়াতে যান। সেখানে তিনি হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন। আট দিনের জ্বর ভোগের পরে ব্রিস্টলে ১৮৩৩-এর ২৭শে সেপ্টেম্বর রাজা রামমোহনের মৃত্যু হয়েছিল মাত্র ৬২ বছর বয়সে। তবে তাঁর মৃত্যুর কারণ আজও পরিষ্কার নয়। মৃত্যুর দশ বছর পরে দ্বারকানাথ ঠাকুর তাঁর সমাধির উপর একটি সুদৃশ্য স্মৃতি সৌধ তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন।
                           
(তথ্যসূত্র:
১- বাংলাপিডিয়া।
২- উইকিপিডিয়া।
৩- রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ – শিবনাথ শাস্ত্রী।
৪- রামমোহন রায় - জাহান ইমরান, বণিক বার্তা।
৫- বাংলার রেনেসাঁ - অসীমকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত।
৬- মহাত্মা রাজা রামমোহন রায় এবং ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে তাঁহার উপদেশ ও মতামত - নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রণীত।)
                         ©️রানা চক্রবর্তী©️

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ