ডিরোজিওর শিক্ষকের কথা।। শিবাশীষ বসু



আঠেরো শতকের শেষার্ধের কলকাতা। সে সময় কলকাতার ফিরিঙ্গি সমাজ ছিল ভারতীয় সমাজে একটি নিপীড়ীত সম্প্রদায়। ফিরিঙ্গিদের ইউরেশীয় তথা অ্যাংলো ইন্ডিয়ানও নামেও পরিচিত ছিলেন।কোনো এক অদ্ভুত কারণে আইন আদালতের ক্ষেত্রেও তাঁদের জন্য ছিল বিচিত্র সব নিয়ম কানুন। উকিল কিংবা অন্যন্য বেশ কিছু পেশায় তাঁদের যোগদান করবার নিষেধাজ্ঞা ছিল। সুযোগ মিলত না সরকারি স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করবারও। ১৭৯২ খ্রীস্টাব্দে এক আইন জারি করে সরকারি চাকরিতে এদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। বাস্তবিক অর্থেই আঠেরো শতকের শেষার্ধ থেকেই অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিকাশের সমস্ত দ্বার রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল এই অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের কাছে। ফলে মর্যাদাহীন ভবিষ্যৎহীন এই প্রতিকুল পরিবেশ কোনও প্রতিভার বিকাশের সহায়ক ছিল না। এই ধরনের দমবন্ধকরা পরিস্থিতি থেকেই উনিশ শতকের গোড়ায় ধুমকেতুর মতো উঠে এসেছিলেন হেনরী লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে অন্ধকারাচ্ছন্ন বাংলার বুকে জ্ঞানের প্রথম আলোটি জ্বালিয়েছিলেন ডিরোজিও, এ আমরা প্রায় সকলেই জানি। কিন্তু ডিরোজিওর বুকে আলো জ্বালানোর কারিগরটি কে? কোথায় পেয়েছিলেন তিনি সেই শিক্ষা, যা তাঁকে বঙ্গীয় নবজাগরণের অন্যতম রূপকার করে তুলেছিল?

এই শিক্ষার উৎস ছিলেন একজন শিক্ষক, ড্রামন্ড, যাঁর স্কুলে অর্থাৎ 'ধর্মতলা একাডেমি'-তে ১৮১৫ সালে ছয় বছর বয়সে ভর্তি হয়ে একাধিক্রমে আট বছর পড়াশোনা করেছিলেন ডিরোজিও। নিজে ব্যাকস্টেজের অন্ধকারে থেকে ডিরোজিওকে আলোকিত করে তোলা এই ড্রামন্ড সম্বন্ধে আজ দুকথা আলোচনা করা নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

ডেভিড ড্রামন্ড ছিলেন স্কটল্যান্ডের একজন সুপরিচিত কবি। জন্ম ১৭৮৭ খ্রীস্টাব্দে। পিঠে একটি কু্ঁজ ছিল বলে লোকে বলতো কুঁজো স্কচম্যান। ড্রামণ্ড কেবল কবি ও শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন একজন পণ্ডিত এবং দার্শনিকও। ধর্ম ছাড়াও অন্য অনেক বিষয়ে তাঁর প্রগতিশীল ভাবনার সঙ্গে অন্যদের ভাবনার বৈপরীত্য ছিল উল্লেখ করার মতো। বিখ্যাত পজিটিভিস্ট দার্শনিক ডেভিড হিউমের ভক্ত ড্রামন্ড প্রকৃতপক্ষে ছিলেন একজন ঘোর সংশয়বাদী ও প্রায় নাস্তিক। যুক্তিবিচারের কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে কোনোকিছুই তিনি মেনে নিতেন না। তাঁর মতে অতীন্দ্রিয় কোনও জ্ঞান নয়, বরং ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতাই মানবজাতির যাবতীয় জ্ঞানের উৎস। স্বভাবতই, নাস্তিক ড্রামন্ডকে তাঁর পরিবার ও আত্মীয়স্বজনরা মেনে নেয়নি। তাই সাহিত্য খ্যাতি পেছনে ফেলে তিনি বাড়ি ছেড়ে ১৮১৩ খ্রীস্টাব্দেের জুন মাসে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
কলকাতায় এসে দিনদশেক কাটিয়ে তিনি বহরমপুরে জনৈক ক্রিস্টির বাড়িতে গমন করেন। ড্রামন্ড ওখানে থাকাকালীনই ১৮১৪ খ্রীস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বার্ষিক ১৫০ পাউন্ড মাইনেতে কলকাতার ধর্মতলা একাডেমিতে শিক্ষকের পদে যোগদান করেন।

ধর্মতলায় চাঁদনির নিকট ছিল ড্রামন্ড সাহেবের স্কুল। জাতশিক্ষক ড্রামন্ড যোগ দেওয়ার পরে ধর্মতলা একাডেমির খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিদ্যায়তনে সব সম্প্রদায়ের এবং সকল শ্রেণীর ছাত্রদের জন্য অবারিত দ্বার ছিল। ১৮৩০ খ্রীস্টাব্দের ২০শে ডিসেম্বরের 'ইন্ডিয়া গেজেট' পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়, "It was very pleasing to see so many Hindoo youths, as belong to this School (Durrumtollah Academy), besides their Christian fellow students entering the sane lists with them, and with them contending for fame." তবে প্রথমদিকে ড্রামন্ডের স্কুলে ছাত্রের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম। এর কারণ, "ভারতীয়রা দূরে থাক, ভারতবাসী ইংরেজরাও ড্রামণ্ডের স্কুলে তাদের বাচ্চাদের পাঠাতো না ; বাচ্চারা যদি নাস্তিক হয়ে যায় ! - এই ভয়ে।"

হেনরী ডিরোজিওর বাবা কিন্তু তাঁর ছেলেকে ড্রামণ্ডের স্কুলেই ভর্তি করান, কারণ তিনি চেয়েছিলেন ছেলেকে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে। নিঃসন্দেহে, পিতা এবং শিক্ষকের কাছ থেকে পাওয়া পাথেয়র পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছিলেন ডিরোজিও। সে সময়ে কলকাতায় এদেশীয়দের ইংতেজদের অধীনে চাকরি-বাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্য করবার প্রয়োজনে চলনসই ইংরেজি শিক্ষ‍র জন্য একাধিক স্কুল গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এইসব স্কুলের সঙ্গে পার্থক্য ছিল ড্রামন্ডের স্কুল ধর্মতলা একাডেমির। অন্যান্য স্কুলে যেখানে স্রেফ ওয়ার্ড বুক ও স্পেলিং বুক থেকে নিত্যব্যবহার্য কিছু ইংরেজি শব্দ শেখানো হত, সেখানে ড্রামন্ড তাঁর স্কুলে ব্যাখ্যা করতেন শেক্সপিয়ারের নাটক। এছাড়া ড্রামন্ড তাঁর স্কুলে নুতন যেসব ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন তা হল ; বার্ষিক পরীক্ষাগ্রহণ, ভূগোল পড়ানোর জন্য গ্লোবের ব্যবহার, ইংরেজি ব্যাকরণের পঠনপাঠন, ইংরেজি ও রোমান ক্লাসিকাল সাহিত্য পাঠ ইত্যাদি। ডঃ জন গ্রান্ট তাঁর বিদ্যালয়ের প্রশংসা করে বলেছিলেন, "এর জন্য কৃতিত্ব কেবল ছাত্রদিগের প্রাপ্য নহে, শিক্ষকেরও প্রাপ্য।"

শুধু তাই নয়, জীবন ও জগত সম্বন্ধে দার্শনিক ড্রামন্ডের উপলব্ধি প্রতিফলিত হত তাঁর শিক্ষাদানেও। বাস্তবিক অর্থেই ডিরোজিওর জীবনে ড্রামন্ডের শিক্ষানিকেতন 'ধর্মতলা একাডেমি' হয়ে উঠেছিল আলোর উৎস। "স্বাধীন চিন্ত‍া, স্বাধীন মনন, স্বাধীন জীবনচর্যা, অনুসন্ধিৎসা ও মানব প্রেম - ইহাই ড্রামন্ডের শিক্ষার মূল কথা।" চলতি মুল্যবোধ ও সংস্কারগুলিকে আঘাত করতে হবে, আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে যুক্তির দ্বারা তাদের যাচাই করে নিতে হবে, এককথায় মনের বন্ধ কপাটগুলিকে খুলে দিতে হবে - এভাবেই শিক্ষা দিতেন ড্রামন্ড। তাঁর বক্তব্য ছিল, সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রেখে, মানবিক রুচি বিকৃত না করে, আত্মতৃপ্তি ও আত্মবিকাশের জন্য ইচ্ছানুযায়ী কাজ করবার অধিকার প্রত্যেক ব্যক্তির আছে। "ঈশ্বর যদি কেউ থাকেন তো থাকুন, যাঁদের অফুরন্ত অবসর আছে তাঁরা স্বর্গলোক কোথায় তার হদিশ করুন, কিন্তু ইহজীবনে মানুষই ঈশ্বর, মানুষই তার সর্বময় প্রভু, এবং মানবচিন্তাই ঈশ্বরচিন্তার নামান্তর। মানুষের চেয়ে বড় সত্য আর কিছু নাই পৃথিবীতে।" এই ড্রামন্ডের প্রভাবেই ডিরোজিওর মধ্যে গড়ে ওঠে স্বাধীন চিন্তাশক্তি, সাহিত্য-দর্শন প্রীতি, সত্যাদর্শ এবং ইউরোপীয় যুক্তিবাদে বিশ্বাস।

ড্রামন্ডের বাড়িতে নিয়মিত সাহিত্য, বিজ্ঞান ও দর্শন আলোচনার মজলিশ বসতো। 'D.D' নাম দিয়ে সমসাময়িক ইংরেজি পত্রিকায় তিনি কবিতা ও সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধ লিখতেন। তাঁর কবিতার একটি সংকলনও প্রকাশিত হয়েছিল। সাহিত্যচর্চা ছাড়াও ড্রামন্ড একজন কৃতি সাংবাদিক ছিলেন। তিনি একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন, নাম 'Weekly Examiner - A Journal Of Polotics, News & Literature.'

১৮৪৩ খ্রীস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ড্রামন্ডের মৃত্যু হয়। সার্কুলার রোডের গোরস্থানে ড্রামন্ডের সমাধির স্মৃতিফলকে আজও লেখা আছে - Beneath lie the mortal remains of David Drummond, a Native of Scotland and for many years a successful teacher of youth in this city. তরুণদের আদর্শ শিক্ষক - এই কথাকটিই তাঁর স্মৃতির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।

তথ্যসূত্র :
হেনরি ডিরোজিও : তাঁর জীবন ও সময়, সুবীর রায়চৌধুরী, ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট
হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও : এক অবিশ্বাস্য গল্পের নায়ক, সবাক, অবিশ্বাস্য ডট কম, ৬ই সেপ্টেম্বর ২০১৮
বাঙলায় উনবিংশ শতাব্দীর মানবতাবাদ ও নবজাগরণ, সুনীলকুমার বন্দোপাধ্যায়, পিরামিড প্রকাশনী
বিদ্রোহী ডিরোজিও, বিনয় ঘোষ, অয়ন
হিন্দু  কলেজ ও উনিশ শতকের বাংলার সমাজ, মনোতোষ চক্রবর্তী, সুবর্ণরেখা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ