এক সিংহের গল্প।। রানা চক্রবর্তী



কেউ বিপাকে পড়লেই তিনি ছিলেন উদারহস্ত।
আক্রান্ত মাইকেল মধুসূদন দত্তের পাশেও তিনি, আবার বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহেও তাই। দেউলিয়া খবরের কাগজকে বাঁচিয়েছেন, আবার অকাতরে দান করেছেন দুর্ভিক্ষেও।
বিধবা বিবাহ করলে হাজার টাকা আর্থিক পুরষ্কার ঘোষণা করেছিলেন তিনি।
মহাভারতের অনুবাদ করে জনস্বার্থে গ্রন্থ বিলিয়েছিলেন বিনামূল্যে।
শেষ জীবনে তিনিই কিনা ঋণজর্জর। নিঃসঙ্গ। তাঁর নামে রুজু হয়েছিল কুড়িটি মামলা। অভিযুক্ত হয়ে আদালত ছেড়েছিলেন মাথা নিচু করে।

তিনি কালীপ্রসন্ন সিংহ!
                           
সময়টা ঠিক একশো বাষট্টি বছরের বেশি পিছনে। বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর প্রথম পৃষ্ঠায় একটি বিয়ের খবর। যে সে বিয়ে নয়, জোড়াসাঁকোর এক রাজপরিবারের ছেলের বিয়ে।

পাত্রের বয়স মাত্র তেরো।
আর পাত্রী তখনও বড়দের কোলে পিঠেই ঘুরে বেড়ায়।

খবরটা ছিল এই রকম—

... "আগামী দিবসে মৃত বাবু নন্দলাল সিংহ মহাশয়ের পুত্র শ্রীমান বাবু কালীপ্রসন্ন সিংহের শুভ বিবাহ মিষ্টভাষী সদ্বিদ্বান শ্রীযুত রায় লোকনাথ বসু বাহাদূরের কন্যার সহিত নির্ব্বাহ হইবেক।...’’

এর পর যা কিছু লেখা, তা চলতি বাংলায় বললে এই রকম শোনায়—

‘‘এই শুভ কাজের জন্য কয়েক দিন ধরে সিংহবাবুদের বাড়িতে খুব নাচ-গান-জলসা হচ্ছে।
গত বুধবার রাত্রে দেশীয় বাবুদের এবং বৃহস্পতিবার সাহেব-বিবিদের নিয়ে এলাহি মজলিশ বসেছে।
সেখানে আমোদ-আহ্লাদ হয়েছে খুব। নন্দলালবাবুর হিসাবরক্ষক শ্রী হরপ্রসাদ ঘোষ চমৎকার ভাবে সমস্ত কাজ সামলাচ্ছেন। ব্রাহ্মণদের নেমন্তন্ন-চিঠি পাঠানো হয়েছে। সামাজিক বিদায়ের জন্য ঘড়া, থালা, বস্ত্র, শাঁখ, রুপোর বাসনকোসন সব বার করা হয়েছে। নন্দলালবাবু এই সময়ে যদি জীবিত থাকতেন, তা’হলে অকাতরে অর্থ্যব্যয় করতেন। পরমেশ্বরের কাছে আমরা প্রার্থনা করি তিনি কালীপ্রসন্নবাবুকে দীর্ঘায়ু দান করুন ও পরম সুখে রক্ষা করুন।’’

কিন্তু পরম সুখ, দীর্ঘায়ু কপালে থাকলে তো! বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই মারা গেলেন স্ত্রী।

দ্বিতীয় বার প্রিয়জনকে হারানোর আঘাত পেলেন কালীপ্রসন্ন।

প্রথম আঘাত পেয়েছিলেন বাবাকে হারিয়ে। তখন মাত্র ছয় বছর বয়স। বাবা নন্দলাল চলে যান বিশাল রাজসম্পত্তি রেখে।
                          
বাঙালি, বিশেষত কলকাতার বাঙালি তখন এক অদ্ভুত সময়ে দাঁড়িয়ে। এক দিকে বাবুরা পায়রা ওড়ানো, নিয়মিত গণিকাগৃহে যাতায়াত অথবা সেখানেই আবাস বানানো, বাড়িতে মদের ফোয়ারা ছোটানো, বাইজি-নৃত্যের আসর বসানোয় ব্যস্ত। অল্পবয়সির দল ‘দুষ্কর্ম-পঙ্কে’ পতিত। আর হিন্দু-সমাজের প্রতি পদক্ষেপ নির্ধারিত হয় টিকিধারীদের ‘বিধান’ অনুসারে।

আবার অন্য দিকে ফরাসি বিপ্লবের অভিঘাতে ময়দানে গিয়ে হিন্দু কলেজের একদল পড়ুয়া ব্রিটিশ ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে ওড়ালেন বিপ্লবের তেরঙা পতাকা! বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে বেশ কয়েক বছর হল ঈশ্বর গুপ্ত মারা গিয়েছেন। ‘আধুনিক’ বাংলা সাহিত্য অবশ্য হামাগুড়ি দিতে শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘হিন্দু থিয়েটার’।

সাহিত্য থেকে সমাজ, এমনই নানা ঘাত-প্রতিঘাতে হাঁসফাঁস করছে মহানগর কলকাতা। এমন এক সদ্য বোল শিখতে চাওয়া নগরেই জোড়াসাঁকোর বারাণসী ঘোষ স্ট্রিটের বিখ্যাত ও বিপুল ধনী সিংহ পরিবারে ১৮৪০-এর ফেব্রুয়ারিতে জন্ম নিলেন এক মহা-নাগরিক কালীপ্রসন্ন সিংহ। বাবা নন্দলাল সিংহ, যিনি সাতুসিংহ নামেই পরিচিত। মা ত্রৈলোক্যমোহিনী দাসী। কিন্তু ভরা সংসার করা নন্দলালের আর বেশি দিন হল কই? বছর ছয়েকের ছেলে, পরিবার, জমিদারি সব রেখে ১৮৪৬-এ কলেরায় মৃত্যু হল অত্যন্ত শৌখিন নন্দলালের।

কে ভার নেবে তার?

আদালতের হুকুমে ছ’বছরের কালীপ্রসন্নের অভিভাবকত্ব ও তাঁর বিপুল সম্পত্তির দেখভালের দায়িত্ব নিলেন পারিবারিক বন্ধু হরচন্দ্র ঘোষ। বিচারক হরচন্দ্র ঘোষ। নির্লোভ, সৎ। বিষয়আশয় দেখাশোনার পাশাপাশি কালীকে নিজের ছেলের মতো মানুষ করতে থাকলেন তিনি।

কিন্তু বাবার মৃত্যুর জেরে কালীপ্রসন্নের বাল্যশিক্ষায় যে বিশেষ বাধা উপস্থিত হল, এমনটা নয়। তবে স্কুলে মারামারি, ঠাট্টা-ইয়ার্কি আর হইহুল্লোড়ে এ ছেলের জুড়ি মেলা ভার। ক্লাসেও পড়াশোনা কম, সে সবেই মেতে থাকত ছেলেটি।

ইস্কুলে ভর্তিও করা হয়েছিল। কিন্তু যা দস্যি ছেলে!

একদিন ক্লাস চলছে। সবাই খুব মন দিয়ে স্যারের পড়ানো শুনছে। হঠাৎই একটি ছেলে ক্লাসরুমে তুমুল কান্নাকাটি শুরু করে দিল।

‘‘কী হয়েছে? কাঁদছ কেন?’’ জিজ্ঞাসা করলেন স্যার।

‘‘আমাকে কালীপ্রসন্ন মাথায় জোরে চাঁটি মেরেছে।’’ বলেই আবার কান্না।

‘‘সে কী! কালী, তুমি ওর মাথায় মেরেছ?’’

‘‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’’

‘‘আমার কোনও দোষ নেই স্যার।’’

‘‘দোষ নেই মানে? ওকে মারলে কেন?’’

‘‘স্যার আমি জাতে সিংহ। থাবা দিয়ে শিকার ধরা আমার জাতীয় স্বভাব। ছাড়ি কী করে বলুন?’’ গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন কালীপ্রসন্ন।

এমন ছেলেকে ইস্কুলের নিয়মে বাঁধে কার সাধ্যি? বাঁধা গেলও না শেষ পর্যন্ত। ষোলো বছর বয়েসেই ইস্কুল ছুট। আসলে ‘পাঠশালা যমালয় হতেও ভয়ানক’, এ কথা হুতোম কি তখনই বুঝেছিলেন?
                            
এ ভাবেই ক্লাস করতে করতে ১৮৫৭য় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে দিলেন হিন্দু কলেজের কিছু দিনের ছাত্র কালীপ্রসন্ন। আসলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পক্ষে এ ছেলেকে বেঁধে রাখা সম্ভব ছিল না। তার পড়াশোনার ধারাটা যে সে খাতে বয় না।

তা বলে পড়াশোনা ছাড়লেন না। বাড়িতে মাস্টারমশাই রেখে তাঁকে সংস্কৃত আর ইংরিজি শেখানো শুরু হল। ছোটবেলা থেকেই স্মৃতিধর। প্রখর বুদ্ধি। একবার যা পড়েন বা শোনেন, আর ভোলেন না। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ঠাকুমার কাছে শুনতেন কবিকঙ্কণ, কৃত্তিবাস বা কাশীরামের পয়ার। শোনামাত্রই  মুখস্ত।

বাড়ির সুশিক্ষার পরিবেশ ইচ্ছে মতো পড়াশোনার পালে হাওয়া জোগাল। টোলে পণ্ডিতের কাছে সংস্কৃত, উইলিয়াম কার্কপ্যাট্রিক সাহেবের কাছে ইংরেজি পড়া শুরু। দুই ভাষাতেই চোস্ত হয়ে উঠল ছেলেটি। সঙ্গত দিল বাড়িতে থাকা বিপুল বইপত্রের সম্ভারও। পাশাপাশি চলতে থাকল ঠাকুরমা আর মায়ের শিক্ষাও। বিশেষ করে বাংলা শিক্ষা।

বাড়িতে মায়ের কাছে সেই মুখস্ত বললেই পুরস্কার ছিল পয়ার পিছু একটি করে সন্দেশ। সেই সন্দেশের লোভে বাংলা পয়ার শিখতে শিখতেই বাংলা ভাষার প্রতি এমন মায়া জন্মে গেল যে এক সময়ে ঠিক করলেন, এই ভাষাকে আরও আধুনিক আরও সমকালের করতে হবে।

আর তাতেই একবার কোপে পড়লেন সাহিত্যসম্রাট স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্রের।

সে গল্পে আসছি একটু পরে।

প্রভূত সম্পত্তি, ততোধিক শিক্ষার অধিকারী হয়েও উনিশ শতকের মধ্যভাগের বাবুয়ানি বা ভেকধরা পাশ্চাত্য-অনুসরণে ভেসে গেলেন না কালীপ্রসন্ন। আর তাই মোটা চাদর, ধুতি আর চটিই হল তাঁর বাহ্যের আবরণ! এ ভাবেই কখন যেন কৈশোর থেকে ধীরে ধীরে তারুণ্যের জোয়ারে ভাসলেন কালীপ্রসন্ন।

আর এই বেড়ে ওঠার এক ফাঁকেই মাত্র বছর ১৪ বয়সে বিয়ের পিঁড়েয় বসলেন বাবু কালীপ্রসন্ন। পাত্রী ‘রঙ্গপুরের সদর আমিন’ বেণীমাধব বসুর কন্যা ভুবনমোহিনী দাসী। কিন্তু সে খেলাঘর টিকল না। বিয়ের কিছু দিন বাদেই ভুবনমোহিনীর মৃত্যু হল। পরে রাজা প্রসন্ননারায়ণ দেবের দৌহিত্রী শরৎকুমার দাসীর সঙ্গে ফের বিয়ে। কিন্তু এই দাম্পত্যের বীণা কোন সুরে বেজেছে, সে সম্পর্কে ইতিহাস এ যাবৎ তেমন কথা বলে না। তবে কালীপ্রসন্নের মৃত্যুর পরে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র বিজয়চন্দ্রকে দত্তক নেন শরৎকুমারী।
                              
বিদ্যা বুদ্ধি তো প্রবল ভাবে ছিলই। তার সঙ্গে ছিল যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। কাগজে-কলমে নয়, একেবারে সরাসরি। আর সেই প্রতিবাদও হত তাঁর চরিত্রের মতোই জোরালো।

একবার বাড়িতে ব্রত পুজো। পুজো শেষে ব্রাহ্মণদের গরু দান করা হল। এক ব্রাহ্মণ তাঁর দানের গরু নিয়ে আর ঘরে ফিরলেন না, রাস্তাতেই এক কশাইকে বিক্রি করে দিলেন। খবর কানে গেল কালীপ্রসন্নের। ব্রতর গরু কিনা কশাইকে বেচেছে...এত বড় ভণ্ড! রেগে আগুন কালীপ্রসন্ন। ডাক পড়ল সেই পণ্ডিতের। সকলের সামনে ব্রাহ্মণের টিকি কেটে শাস্তি দিলেন তাঁকে।

শোনা যায়, এর পর থেকেই নাকি তিনি এমন কোনও ভণ্ড ব্রাহ্মণের খোঁজ পেলেই তাকে তর্কে আহবান করতেন। সংস্কৃতে কোনও কঠিন বিষয় নিয়ে তর্ক।

শর্ত, পন্ডিত তর্কে হারলে তাঁর টিকি কেটে নেওয়া হবে! জিতলে মোটা অঙ্কের পুরস্কার। কিন্তু কালীপ্রসন্নের সঙ্গে তর্কে জেতা প্রায় অসম্ভব! ওই অল্প বয়সেই যেমন পাণ্ডিত্য, তেমনই বাগ্মিতা। বেশির ভাগ পণ্ডিতকেই তর্কে হারাতেন এবং তারপর কালীপ্রসন্ন তাঁর টিকিটি কেটে নিতেন। না, বিনামূল্যে নয়, রীতিমতো ভাল দক্ষিণা দিয়ে। তারপর সেই টিকি কত দাম দিয়ে কার কাছ থেকে কবে কেনা হল ছোট চিরকূটে লিখে আলমারিতে সাজিয়ে রাখতেন! সেই থেকে কালীপ্রসন্নের নামই হয়ে গেছিল ‘টিকি কাটা জমিদার’। এই ডাকে দূরদূরান্তের মানুষও তাঁকে একবারে চিনে ফেলতেন।

কিন্তু লোকমুখে গল্প প্রচারিত হল, কালীপ্রসন্ন নাকি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের ‘বশীভূত করিয়া তাঁহাদিগের টিকি ক্রয় করিতেন, পরে ঐগুলি কাটিয়া লইয়া আলমারিতে সাজাইয়া রাখিতেন’। এমনকি সেগুলি কত টাকায় কেনা, সেই তথ্য একটি ছোট্ট চিরকুটে লিখে তা সংশ্লিষ্ট কাটা টিকির সঙ্গে সাঁটানো হত!

কিন্তু এ সব গল্পই অত্যন্ত অতিরঞ্জিত। পরে এর প্রমাণ দেন ‘অর্ঘ্য’ পত্রিকার সম্পাদক অমূল্যচরণ সেন। মূল ঘটনাও তিনিই জানান।
                         
কিন্তু এই জমিদারই আবার প্রজার অধিকারের সপক্ষে কথা বলেন। জমিদার ডাকলেই প্রজাকে আসতে হবে, প্রজার বাড়ি থেকে ধান লুট, এ সবেরও চূড়ান্ত বিরোধিতা শোনা যায় তাঁর কাছ থেকে।

শুধু প্রজার ধান ও ধনরক্ষার সপক্ষেই নয়, প্রজার তথা দেশের মুখের ভাষার প্রতিও এমনই মমতা কালীপ্রসন্নের। আর তাই ‘বঙ্গভাষার অনুশীলনের’ জন্য তৈরি করেন একটি ‘ডিবেটিং ক্লাব’। পরে যা ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’ নামে পরিচিত হয়। এই সভা থেকেই প্রকাশিত হয় কালীপ্রসন্ন সম্পাদিত ‘বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা’। ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে এই সভা প্রবন্ধ প্রতিযোগিতারও আয়োজন করল। উনিশ শতকের মাঝামাঝি হওয়া এ সব প্রতিযোগিতার পুরস্কার মূল্য দু’-তিনশো টাকা! ওরিয়েন্টাল সেমিনারির চার জন ছাত্রকে তো ভাল বাংলা লেখার জন্য মেডেলই দেওয়া হল। এ সবের জন্য খরচের সবটাই অবশ্য আসে বাবু কালীপ্রসন্নের পকেট থেকে।

‘সমুদয় ব্যয়’ বহন করে অন্যের লেখা প্রকাশেও (‌যেমন, ‘নূতন পুস্তক’, হরিমোহন গুপ্তের ‘শকুন্তলা’ অনুবাদ ইত্যাদি) উদ্যোগী হন কালীপ্রসন্ন। এ ছাড়া ‘সর্বতত্ত্ব প্রকাশিকা’ প্রকাশ, ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’, দৈনিক খবরের কাগজ ‘পরিদর্শক’ সম্পাদনা এবং নানা ভাষার পত্রপত্রিকা প্রকাশে আর্থিক সাহায্য... রয়েছে সে সবও।
                           
একবার ছি ছি পড়ে গেল বাংলার সাহিত্য-পণ্ডিত মহলে। মাইকেল মধুসূদন নামের এক আধা বাঙালি আধা ফিরিঙ্গি বাংলা ভাষার সর্বনাশ করে ছাড়ছে! নাহলে অন্ত্যমিল ছাড়া আবার কাব্য হয়! অমিত্রাক্ষর ছন্দ আবার কোন দেশি? তাবড় পণ্ডিতরা একজোট হয়ে মধুদূদনকে আক্রমণ, পত্র-পত্রিকায় মাইকেলের বাপান্ত।

মাইকেল তখন সবে বিলেত থেকে ভাঙা মন নিয়ে ফিরেছেন। বাংলা কবিতাকে নতুন জন্ম দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তার মধ্যেই এ সব। রামগতি ন্যায়রত্নের মতো পণ্ডিতও ‘সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’-এ মাইকেলকে একহাত নিলেন। কবির মন আবার ভাঙে আর কী!

সেই সময় পাশে এসে দাঁড়ালেন কালীপ্রসন্ন। ভূয়সী প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন। সর্বত্র বলতে লাগলেন, ভবিষ্যতের বাংলা কবিতা এই ছন্দেই লেখা হবে। শুধু তাই নয়, প্রকাশ্য সভা করে সেই প্রথম কোনও বাঙালি কবিকে ঘটা করে সংবর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থাও করে ফেললেন। মেঘনাদ বধের রচয়িতাকে ওই সভায় ‘মহাকবি’ আখ্যা দিলেন কালীপ্রসন্ন। ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’র সমালোচনায় তাঁর ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় লিখলেন,

‘‘বাঙ্গালা সাহিত্যে এইপ্রকার কাব্য উদিত হইবে বোধ হয় স্বয়ং সরস্বতীও জানিতেন না। হায়! এখনও অনেকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহাশয়কে চিনিতে পারেন নাই।’’
                              
জগন্মোহন তর্কালঙ্কার ও মদনমোহন গোস্বামীর শুরু করা ‘পরিদর্শক’-এর সম্পাদনার দায়িত্ব নেওয়ার পরে কালীপ্রসন্ন যে তিনটি প্রতিজ্ঞা বাঙালি পাঠকের কাছে করলেন, তা সাংবাদিকতা এবং সংবাদ-গদ্যের জন্য অত্যন্ত জরুরি। প্রতিজ্ঞা তিনটি, ‘সত্যপথ হইতে বিচলিত’ না হওয়া, ‘কোন বিষয়ের অতি বর্ণনা না’ দেওয়া এবং ‘পক্ষপাতদোষে’র ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলার। বাংলা ভাষা ও সমাজের উন্নতির জন্যও এই তিনটি প্রতিজ্ঞা অত্যন্ত জরুরি। সেই প্রয়োজনীয়তা বুঝেই তাই হয়তো বিতর্ক হবে জেনেও ‘বিবিধার্থ সংগ্রহে’ মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’, দীনবন্ধুর ‘নীলদর্পণ’-এর সমালোচনা করলেন তিনি।

এমন দিলখোলা প্রশংসার প্রতিক্রিয়াও হল প্রবল। একটি প্রবন্ধে কালীপ্রসন্ন মাইকেলকে ভার্জিন মিলটনের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন বলে ওই সময়ের ‘ইন্ডিয়ান রিফর্মার’ কাগজে কালীপ্রসন্নকে যাচ্ছেতাই ভাষায় আক্রমণ করা হল। সে লেখার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, কিছু পেটোয়া চামচে মিস্টার দত্তকে ভার্জিন, মিল্টনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই অশিক্ষিত অপদার্থরা গ্রিক, লাতিন কিংবা ইংরেজি ভাষার কোনও সাহিত্যই না পড়ে নিজেদের বাংলা সাহিত্যের হনু ভাবতে শুরু করেছেন।

কালীপ্রসন্নও ছেড়ে কথা বলার লোক ন’ন। হিন্দু প্যাট্রিয়টে তিনি লিখলেন,

‘‘মাইকেল মধুসূদনের পক্ষ নিয়ে ঢাল তলোয়ার হাতে লড়াই করা আমাদের কাজ নয়। তবু বলতে বাধ্য হচ্ছি, যাঁরা লিখেছেন গ্রীক, লাতিন ইত্যাদি ভাষার সাহিত্য না পড়েই মাইকেলের কবিতার প্রশংসা করা হচ্ছে, হয় তাঁরা নিজেরাই সেইসব পড়েননি কিংবা ছোটবেলায় মায়ের কোলে বসে আমাদের দেশের অসামান্য সাহিত্যগুলি শোনেননি অথবা শুনলেও ভুলে গেছেন। তা না হলে বুঝতে পারতেন মাইকেল মধুসূদন দত্তর কাব্যপ্রতিভা কতখানি খাঁটি এবং দেশজ।"
                        
কালীপ্রসন্ন লিখিত 'হুতোম প্যাঁচার নকশা' পড়ে প্রচণ্ড রেগে গেলেন বঙ্কিমচন্দ্র। যে কালীপ্রসন্নর তিনি গুণমুগ্ধ, তারই কিনা এমন কীর্তি! ছি ছি! বঙ্কিমের লক্ষ্য, ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় নকশার বিরুদ্ধে তিনি লিখলেন,

‘‘লিখনের উদ্দেশ্য শিক্ষাদান, চিত্তসঞ্চালন। এই মহৎ উদ্দেশ্য হুতোমি ভাষায় কখনো সিদ্ধ হইতে পারে না। হুতোমি ভাষা দরিদ্র; ইহার তত শব্দধন নাই; ইহার তেমন বাঁধন নাই, হুতোমি ভাষা নিস্তেজ, হুতোমি ভাষা অসুন্দর এবং যেখানে অশ্লীল নয়, সেখানে পবিত্রতা শূন্য। হুতোমি ভাষায় কখনো গ্রন্থ প্রণীত হওয়া উচিত নহে।’’

তবে বাংলা গদ্যের ভাষাকে সাবালক করতে ও সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নিরিখে হুতোমি ভাষাকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। বঙ্কিমচন্দ্রের এমন আক্রমণের বিরুদ্ধে হুতোম কোনও পাল্টা আক্রমণ করেছিলেন কি না জানা যায় না। তবে বঙ্কিম নিজে বোধ হয় পরে সেই ক্রোধ মনে পুষে রাখনি। নয়তো কালীপ্রসন্ন যখন মারা যান,  অমন লিখতে যাবেন কেন! ‘কৃষ্ণচরিত’ বইয়ের বিজ্ঞাপনে বঙ্কিম লিখেছিলেন,

‘‘সর্ব্বাপেক্ষা আমার ঋণ মৃত মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহের নিকট গুরুতর। যেখানে মহাভারত হইতে উদ্ধৃত করিবার প্রয়োজন হইয়াছে, আমি তাঁহার অনুবাদ উদ্ধৃত করিয়াছি।"
                            
সাহিত্যে চলিত ভাষার যে চল প্রথম শুরু করেছিলেন টেকচাঁদ ঠাকুর তাঁর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বইতে, সেই আলালী ভাষাকেই আরও কথ্য আরও সমকালীন করে তুললেন কালীপ্রসন্ন। আসলে হুতোম বুঝেছিলেন, সমাজে যা অনাচার, বিকৃতি, ভূতের নাচন চলছে তার ওপর আঘাত হানতে হলে সংস্কৃত ঘেঁষা বাংলা নয়, প্রয়োজন কথ্য ভাষা।

তাই তিনটে ভাষার পণ্ডিত হুতোম ওই বাংলাকেই বাছলেন। ফলও ফলল হাতেনাতে।

প্রথম খণ্ড প্রকাশ হওয়া মাত্রই শহরের সব ফুলবাবুরা রে রে করে উঠলেন। হবে নাই বা কেন? কাউকে যে ছেড়ে কথা বলেননি তিনি। নিজেকেও না। বাবুদের নাম বদলে দিলেও তারা যে কারা, এক লাইন পড়লেই সকলের কাছে পরিষ্কার। সুতরাং লেগে গেল ধুন্ধুমার কাণ্ড।

নকশার প্রথম ভূমিকায় হুতোম লিখলেন,

‘‘সত্য বটে অনেকে নকশাখানিতে আপনারে আপনি দেখতে পেলেও পেতে পারেন, কিন্তু বাস্তবিক সেটি যে তিনি নন তা বলাই বাহুল্য, তবে কেবল এইমাত্র বলতে পারি যে আমি কারেও লক্ষ্য করি নাই অথচ সকলেরেই লক্ষ্য করিচি। এমনকী স্বয়ংও নকশার মধ্যে থাকিতে ভুলি নাই।’’

এমনকি যে ব্রাহ্মদের সঙ্গে কালীপ্রসন্নের ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল, সেই ধর্মাবলম্বীদেরও প্রশ্ন করতে ছাড়লেন না, ‘আজকাল ব্রাহ্মধর্মের মর্ম বোঝা ভার, বাড়িতে দুর্গোৎসবও হবে আবার ফি বুধবার সমাজে গিয়ে চক্ষু মুদ্রিত করে মড়াকান্না কাঁদতেও হবে।’ আসলে ধর্ম নিয়ে নয়, বরং এর ব্যবহারিক নানা কিছু নিয়েই আপত্তি কালীপ্রসন্নের।

আর দ্বিতীয় ভূমিকায় একেবারে বুক ফুলিয়ে লিখেই ফেললেন,

‘‘তবে বলতে পারেন ক্যানই বা কলকেতার কতিপয় বাবু হুতোমের লক্ষ্যান্তবর্ত্তী হলেন, কি দোষে বাগাম্বর বাবুরে প্যালানাথকে পদ্মলোচনকে মজলিসে আনা হলো, ক্যানই বা ছুঁচো শীল, প্যাঁচা মল্লিকের নাম কল্লে, কোন দোষে অঞ্জনারঞ্জন বাহদুর ও বর্ধমানের হুজুর আলী আর পাঁচটা রাজা রাজড়া থাকতে আসোরে এলেন?’’

নকশা প্রকাশ করে কলকাতার বাবুদের হাঁড়ি একেবারে মাঠের মাঝখানে ভেঙে দিলেন হুতোম। সটান ভীমরুলের চাকে ঢিল। আর যায় কোথায়!
                         
অনেক বাবু একজোট হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন হুতোমের ওপর। ‘আপনার মুখ আপুনি দেখ’ নামের বই লিখে হুতোমকে পাল্টা একহাত নিলেন ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়।

টেকচাঁদ ঠাকুরের ছেলে চুনীলাল মিত্রও অনেকদিন ধরে ক্ষেপে ছিলেন কালীপ্রসন্নর ওপর। এইবার সুযোগ পেয়ে তিনিও লিখলেন ‘কলিকাতার নুকোচুরি’। সেখানে সরাসরি হামলা চালালেন কালীপ্রসন্নর ওপর। তিনি লিখলেন,

‘‘হুতোম নিজে বজ্জাত হয়ে অন্যের খুঁত ধরছেন। হুতোম জীবনে যা করেছেন সবই খারাপ কাজ। ভালর মধ্যে শুধু ওই মহাভারত।’’

তবে মহাভারত অনুবাদ নিয়েও কি কম গঞ্জনা শুনতে হয়েছে তাঁকে! তাই নিয়ে আরেকটা মহাভারত লেখা হয়ে যায়।

আসছি সেই গল্পে।

জীবনে প্রথম নাটক লিখলেন তখন বয়স মাত্র চোদ্দো। নাটকের নাম ‘বাবু’। এই নাটকের জনপ্রিয়তা এমনই যে, সেটির সব কপি প্রকাশের মাত্র দু’বছরের মধ্যে শেষ হয়ে গেল। পরে ধীরে ধীরে ‘মালতী মাধব নাটক’ অনুবাদ, ‘সাবিত্রী সত্যবান’ মৌলিক নাটক রচনাও করেছেন তিনি। বুঝতে পেরেছিলেন বাংলায় নাট্যমঞ্চ দরকার। তাই ষোলো বছর বয়সে নিজের বাড়িতেই তৈরি করলেন বিদ্যোৎসাহিনী থিয়েটার। সেখানে রামনারায়ণ তর্করত্নের অনুবাদ করা ‘বেণীসংহার’ নাটক মঞ্চস্থ হল। নিজে অভিনয় করলেন। বিপুল প্রশংসা। কিন্তু কালীপ্রসন্ন বুঝলেন এই নাটকেও অনেক গলদ আছে। 

আবার কলম ধরলেন। কালীদাসের ‘বিক্রমোর্ব্বোশী’ নাটক অনুবাদ করলেন। ‘বিক্রমোর্ব্বশী’তে আনলেন অমিত্রাক্ষর ছন্দের খানিক আভাস! এর কিছু দিন বাদে ‘পদ্মাবতী’ নাটকে এই ছন্দ নিয়ে এগিয়ে গেলেন মাইকেল। তখন তাঁর বয়স মাত্র সতেরো। সে নাটকও মঞ্চস্থ হল। রাজা পুরূরবার চরিত্রে অভিনয় করলেন। এমন নাট্যপ্রেমের ছোঁয়া দেখা গেল অভিনয় রীতিতেও। তিনি পাশ্চাত্য ধাঁচে ‘আভিনায়িক পাঠ’-এর প্রচার করলেন। শুধু কালীপ্রসন্নের অভিনয় দেখার জন্যই কলকাতার সব সাহেব, বাবুদের এত ভিড় হল যে দাঁড়ানোর জায়গাটুকু না পেয়ে অনেকেই মন খারাপ করে ফিরে গেলেন। আর নাটক এমন সাফল্য পেল হল যে অনেকেই বিশ্বাস করল না এটি কোনও নাবালকের লেখা। 

এমনকী ইংলিশম্যান পত্রিকা মন্তব্য করে বসল, বিক্রমোর্ব্বোশীয় আসলে পণ্ডিত দীননাথ শর্মার অনুবাদ। কালীপ্রসন্ন নিজের নামে চালাচ্ছেন। প্রতিবাদ জানাল ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’। লিখল, ‘পণ্ডিত মহাশয় স্বয়ং সম্মুখে উপস্থিত থাকিয়া এই মিথ্যা নির্দ্দেশ অস্বীকার করিতেছেন।’

সেই অভিনয় প্রসঙ্গে ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ লিখল, ‘হিজ মিন ওয়াজ রাইট রয়্যাল, অ্যান্ড হিজ ভয়েস ট্রুলি ইম্পিরিয়াল।’

এর পর ‘সাবিত্রী সত্যবান’, ‘মালতীলতা’ পরপর দুটি নাটক লিখলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেই সব লেখা শুধু যত্নের অভাবে কিছুই রইল না।
                           
শুধু তাই নয়, এক বাদ্যযন্ত্রের আবিষ্কর্তাও ছিলেন তিনি। 
প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন হিন্দুস্থানী উচ্চাঙ্গসংগীতকে। সংগীত সম্পর্কে জ্ঞানও ছিল গভীর। সেই সময়ের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা থেকেই জানা যায়, কালীপ্রসন্ন কাগজ দিয়ে এক ধরনের কলাবতী বীণা তৈরি করেছিলেন, আর সেই বীণা সেই সময়কার সঙ্গীত মহলে বিশেষ ভাবে আদৃত হয়েছিল।
বাংলায় সঙ্গীতচর্চ্চার উন্নতির জন্য নিজের প্রাসাদোপম বাড়িতে সঙ্গীতসমাজ নামে একটি সভারও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। অজস্র গান লিখেছেন নিজে। আর নিজে যে সব নাটক লিখতেন সে সব নাটকের গানে সুরও বসাতেন নিজেই।

বন্ধুরা যখন ইংরেজি শিখে কোট প্যান্ট টাই পরে ঘুরছেন কালীপ্রসন্ন সেই বন্ধুদের থেকে অনেক বেশি ইংরেজিতে শিক্ষিত হয়েও বিদ্যাসাগরের মতো ধুতি, আলোয়ান পায়ে চটি। একেবারে কট্টর জাতীয়তাবাদী।

স্বভাবে ভাল সাহেবদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের অন্যায়কে ছেড়ে কথা বলেন না। ‘নীলদর্পণ’ কাণ্ডেই তার প্রমাণ মিলল।

সেও এক মস্ত কাহিনি।

আসলে কালীপ্রসন্নের ‘বাইরের জীবন’ এত বেশি বিস্তৃত যে, তাঁর অন্তর্জীবনের খোঁজ করার মতো অবকাশও হয়তো কারও ছিল না। সেই বিস্তৃত জীবন সাহিত্য, সমাজ, বিচারক সত্তা, পত্রিকা সম্পাদনা, নাট্য-সংস্কার, অনুবাদকর্ম, দানধ্যান, সভাসমিতি-সহ আরও নানা কিছুর ঠাস বুনোটে বাঁধা। কিন্তু এ সব কাজের অন্তরালেই রয়েছে স্বদেশ, স্বজাতির প্রতি সিংহবাবুর গভীর মমতা।

এই মমতা কখনও কখনও প্রতিবাদেও প্রকাশিত। তেমনই একটি ঘটনা।
                         
দীনবন্ধু মিত্রর ‘নীলদর্পণ’ প্রথম সংস্করণ শেষ। দ্বিতীয় সংস্করণ আর ছাপা হবে কি না তাই নিয়ে সংশয়। ছাপানোর টাকা নেই। খবর পেয়ে এগিয়ে এলেন কালীপ্রসন্ন। নিজের খরচে দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপিয়ে বিলি করা শুরু করলেন। শুধু তাই নয় ‘নীলদর্পণ’ ইংরেজিতে অনুবাদ করার জন্য যখন অভিযুক্ত হলেন লং সাহেব, সেখানেও এগিয়ে গেলেন কালীপ্রসন্ন। চুড়ান্ত শুনানির দিন আদালতে গেলেন। পকেটে ভর্তি টাকা। আদালত রায় দিল, জরিমানা দিতে হবে রেভারেন্ড লংকে। সঙ্গে সঙ্গে অর্থ দিয়ে লং সাহেবকে জামিনে মুক্ত করলেন কালীপ্রসন্ন। এমনকী ওই সময় স্বয়ং নাট্যকার দীনবন্ধুও গ্রেফতার হতে পারেন এমনও একটা খবর রটেছিল। তাই শুনে দীনবন্ধুকে আশ্বস্ত করে তিনি বলেছিলেন,

‘‘নিশ্চিন্ত থাকুন। অর্থের দ্বারা যদি আপনাকে বাঁচানো সম্ভব হয়, তা হলে আমি আমার সর্বস্ব দিয়েও চেষ্টা করব।’’

সেই আমলের অত্যন্ত বিতর্কিত ‘নীলদর্পণ’ নাটকের দ্বিতীয় সংস্করণটি প্রকাশ করে বিনামূল্যে তা জনসাধারণের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থাও করলেন কালীপ্রসন্ন। তবে এ কাজ যতটা স্বদেশের জন্য, ততটাই তাঁর নাট্যপ্রেমের জন্যও।

সেই নাট্যপ্রেম কেমন, তা বুঝতে গেলে দ্রুত ১৮৫৭-য় যাওয়া জরুরি। এই বছরটি ভারতবর্ষের ইতিহাসে সিপাহি বিদ্রোহের সূত্রপাতের সময় হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু পাশাপাশি বাংলা থিয়েটারের জগতেও এটি একটি ঐতিহাসিক বছর। কারণ, এ বছর পরপর তিনটি নাট্যশালা তৈরি হয়। একটি কলকাতার সিমলায় আশুতোষ দেবের বাড়িতে, একটি রামজয় বসাকের চড়কডাঙার বাড়িতে এবং অন্যটি বাবু কালীপ্রসন্নের বাড়িতে। 
                          
কালীপ্রসন্নের বাড়ির নাট্যশালা অর্থাৎ বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চের পথচলা শুরু ‘বেণীসংহার’ নাটকের অভিনয় দিয়ে। সেই অভিনয় দেখতে এলেন বিচারপতি আর্থার বুলার, ভারত সরকারের প্রধান সচিব সিসিল বিডন-সহ আরও অনেকে। সংবর্ধনা মিলল সর্বত্র।

এখানেই শেষ নয়।

‘নীলদর্পণ’ মামলার বিচারক ওয়েলস সাহেবকেও উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। এই ওয়েলস বিচার চলাকালীন কথায় কথায় বিচারকের আসন থেকেই বলে উঠতেন, ‘‘বাঙালিরা সবাই মিথ্যাবাদী।’’

ওয়েলসের এমন কথায় প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন কালীপ্রসন্ন। শুধু অপেক্ষায় ছিলেন মামলার কবে নিষ্পত্তি হয়। মামলা শেষ হওয়ার পরে পরেই সাহেবের হাতে বাঙালির অপমানের বদলা নিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সকলকে একজোট করে।

১৮৬১ সালের ২৬ অগস্ট। কালীপসন্ন তখন সবে একুশ। রাজা স্যার রাধাকান্তদেববাবুর বাড়িতে এক বিশাল সভা ডাকলেন। ইংরেজের বিরুদ্ধে সভা বলে অনেক বাবুই সেই সভায় আসতে সাহস পেলেন না, কিন্তু জমায়েত ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশিষ্টদের মধ্যে ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর,  নবাব আসগর আলি খান, রাজা স্যার রাধাকান্ত দেব, রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ-র মতো আরও অনেকে। আর জীবনে সেই প্রথম কোনও রাজনৈতিক সভায় ভাষণ দিলেন কালীপ্রসন্ন। তাঁর কথায় মোহিত হয়ে গেলেন সকলে। ওয়েলসের বিরুদ্ধে কুড়ি হাজার মানুষের স্বাক্ষর নেওয়া প্রতিবাদপত্র পাঠানো হল সেক্রেটারি অফ স্টেট স্যার চার্লস উডের কাছে।

উড বাঙালি জাতির প্রতি ওয়েলসের এমন অপমানের যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে চিঠির উত্তরে লিখলেন। যার কিছু অংশ বাংলা তর্জমা করলে এমন দাঁড়ায়—

‘‘যাঁরা আইনের উচ্চপদে রয়েছেন তাঁদের সব সময়ই অনেক বেশি অনুভূতিশীল এবং নিজের পদ ও দায়িত্বের প্রতি সচেতন হওয়া উচিত। পৃথিবীর সকল জাতির মধ্যেই কিছু অপরাধী থাকে, তাই বলে পুরো জাতটাই অপরাধী হয়ে যায় না। এই ভাবনা সেই জাতির পক্ষে অবমাননাকর।’’

জয় হল কালীপ্রসন্নর। জবাব গেল বাঙালি-অপমানের। আর এর পরে সেই ওয়েলস এমন ভাল মানুষ হয়ে গেলেন যে তাঁর সুনামও ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। মেয়াদ শেষে যখন তিনি নিজের দেশে ফিরে যাচ্ছেন, তখন একেবারে তিনি অন্য মানুষ। তাঁর বিদায়কালে তাঁকে যে সম্মাননা জানানো হল, সেই চিঠিতে সই করতে দ্বিধা করেননি কালীপ্রসন্ন।
                          
কিন্তু শুধু ইংরেজের বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সরব হওয়াই নয়, সেই ব্যবস্থার অঙ্গ হয়ে একে শোধরাতেও চাইলেন কালীপ্রসন্ন। ২৩ বছর বয়সে হলেন অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট ও ‘জাস্টিস অব পিস’। আর সেই আসনে বসেই একের পর এক দৃষ্টান্তমূলক রায় দেওয়া শুরু হল।

অভিযোগ এক: টেরিটি বাজার অপরিষ্কার করছেন বর্ধমানের মহারাজা মহতাপ চাঁদ। এই মহারাজা কালীপ্রসন্নের বিশেষ কাছের মানুষ। নিজের বইও উৎসর্গ করেছেন তাঁকে। কিন্তু কালীপ্রসন্ন রায় দিলেন, সব ময়লা সাফ না হওয়া পর্যন্ত ফি দিন ৫০ টাকা করে জরিমানা দেবেন মহারাজা।

অভিযোগ দুই: কলকাতার বাজারে কয়েক জন ব্যবসায়ী কম ওজনের বাটখারা ব্যবহার করছেন। লাভও হচ্ছে দেদার, কয়েক গুণ বেশি। মামলার শুনানি চলল। রায় হল, অভিযুক্ত আট জন দোকানদার প্রত্যেকে ২৫ টাকা করে জরিমানা দেবেন।

কিন্তু শুধু রায়দান নয়, নিজের রায়ে কোথাও ভুল হলে তা সংশোধন করে নিতেও এই যুবক বিচারপতির বিন্দুমাত্র সময় লাগত না। ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকা এ বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়। অভিযোগ উঠল, ডাক্তার বীটসনের ‘পকেটবহি’ চুরি করেছেন কেরানি মহেশচন্দ্র দাস। সব দিক বিচার করে মহেশচন্দ্রের কারাবাসের নির্দেশ দিলেন কালীপ্রসন্ন। কিন্তু কিছু দিন পরে সেই ‘বহি অন্যের নিকটে দৃষ্ট’ হয়। সঙ্গে সঙ্গে বিচারক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে মহেশচন্দ্রের মুক্তি চেয়ে চিঠি লিখলেন।

আসলে বিচারপতি হিসেবে দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন করতে চেয়েছেন কালীপ্রসন্ন। জমিদার হিসেবেও তা-ই।
                             
দাতাকর্ণ নামে লোকে চিনত তাঁকে। সমাজের কল্যাণে যেখানে যত অর্থ প্রয়োজন হয়েছে অকাতরে দান করেছেন কালীপ্রসন্ন। এর জন্য অবশ্য কম কথা শুনতে হয়নি। কেউ বলেছেন পয়সা ছড়িয়ে নাম কিনতে চাইছেন, কেউ বলেছেন রাজবংশের বখাটে ছোকরা। কান দেননি সে সব কথায়।

আসলে সাহিত্য হোক বা সমাজ সংস্কার, কালীপ্রসন্নের যে কোনও কাজে ‘জন’ই ছিল প্রধান লক্ষ্য। আর সেই জনের জন্য যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের প্রতি এই মানুষটির কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সে কৃতজ্ঞতা কেমন ধারার, সে প্রসঙ্গে দু’-চারটি ঘটনার কথা বলা যেতে পারে।

‘হিন্দু পেট্রিয়ট’-এর সম্পাদক হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর পত্রিকায় নীলকর সাহেব আর্চিবাল্ড হিল্‌সের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ আনলেন। সাহেবও মানহানির মামলা ঠুকে দিলেন। রায় হল, মামলার যাবতীয় ব্যয়ভার হরিশ্চন্দ্রকে দিতে হবে। কিন্তু তত দিনে হরিশ্চন্দ্রের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর পরিবারের লোকজন দেখলেন, বাড়ি বিক্রি ছাড়া উপায় নেই। বাঙালির জনকণ্ঠ যে মানুষটি শুনিয়েছেন, তাঁর পরিবারেরই পথে বসার উপক্রম হল। এগিয়ে এলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, কালীপ্রসন্ন-সহ আরও কয়েক জন। তৈরি হল ‘গৃহ রক্ষা তহবিল’। বাঁচল হরিশ্চন্দ্রের বাড়ি।

আসলে হরিশ্চন্দ্র সম্পর্কে বরাবরই ভীষণ শ্রদ্ধাশীল কালীপ্রসন্ন। তাই তাঁর মৃত্যুর পরে স্মৃতিরক্ষার জন্য ‘পঞ্চসহস্র মুদ্রা’ দান করেন এই জমিদার। কোনও স্মারক তৈরির জন্য বাঙালির কাছে আর্জি জানিয়ে পুস্তিকা লিখে প্রচার করা, হরিশ্চন্দ্রের ‘স্মৃতিমন্দির’ তৈরি করা হলে সুকিয়া বাগান স্ট্রিটে দু’বিঘা জমি দান করার মতো প্রতিশ্রুতি দিতেও দেখা গেল তাঁকে। কিন্তু সেই মন্দির আর দিনের আলো দেখেনি, বাঙালির আলস্যের জন্যই হয়তো।
                            
বিদ্যাসাগর মশাইকে মানতেন নিজের গুরু হিসেবে। তাই যখনই গুরুদেবের প্রয়োজন হয়েছে তখনই ছুটে গিয়েছেন তিনি। অনেক চেষ্টায় বিধবা বিবাহ আইন চালু করলেন বিদ্যাসাগর। কিন্তু বিধবা বিয়ে করার লোক কই? কালীপ্রসন্ন ঘোষণা করলেন, যে ব্যক্তি বিধবা বিবাহ করবেন তাঁকে তিনি এক হাজার টাকা পুরস্কার দেবেন।

আলস্যকে প্রশ্রয় দেওয়া সিংহ মহাশয়ের চরিত্রে ছিল না। তাই হয়তো তিনি হাত ধরেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। বিদ্যাসাগর তখন বিধবা বিবাহ প্রচলনের জন্য লড়ছেন। সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন বঙ্গসমাজ থেকে ধেয়ে আসতে শুরু করল বাছাবাছা বাক্যবাণ, চূড়ান্ত বিরোধিতা। কিন্তু সিংহ মহাশয়ের ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’ দাঁড়াল বিদ্যাসাগরের পাশেই। অত্যন্ত সক্রিয় ভাবে। ১৮৫৬-র ৭ ডিসেম্বর প্রথম বিধবা বিবাহ সংঘটনের সময়েও সহযোগিতা করলেন জোড়াসাঁকোর এই মানুষটি। এমনকি ঘোষণা করলেন বিধবা বিবাহ করলেই মিলবে এক হাজার টাকা! তবে সেই আমলের কিছু লোভী মানুষের টাকা পাওয়ার লোভ এই সৎ উদ্দেশ্যকে ভেস্তে দিল।

বিধবা বিবাহের সপক্ষে দাঁড়ানোর পাশাপাশি কৌলীন্যপ্রথা, বহু বিবাহের বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগর যে আন্দোলন গড়ে তুললেন, তাতেও সক্রিয় মদত জোগালেন কালীপ্রসন্ন। কিন্তু এ সবের আগে কৌলীন্যপ্রথার অভিশাপটি কেমন ছিল, তার ছোট্ট কিছু পরিসংখ্যান দেওয়া যেতে পারে। বিদ্যাসাগরের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী, শুধু মাত্র হুগলিতেই ৭৬টি গ্রামের ১৩৩ জন ‘কুলীনের’ স্ত্রীর সংখ্যা ২,১৫১ জন। পূর্ব বঙ্গের বিক্রমপুরে ৬৫২ জন কুলীনের স্ত্রীর সংখ্যা ৩,৫৮৮ জন! এ সবের বিরুদ্ধে কালীপ্রসন্ন তাঁর ‘বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা’য় প্রবন্ধ লিখলেন। পাশাপাশি, এই প্রথা আইন করে রদের জন্য ব্যবস্থাপক সভায় আর্জিপত্র পাঠানোতেও সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেল কালীপ্রসন্নকে!

সরব হলেন বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধেও। শাণিত ভাষায় তিনি সিদ্ধান্তে আসেন, এই প্রথা বা অভ্যেস আসলে ‘নানা অনিষ্টের মূল’। আর এই মৌল সমস্যার শিকড় কোনখানে সে প্রসঙ্গে তাঁর কটাক্ষ, ‘...বৈদিক মহাশয়েরা গর্ভেই বিবাহের সম্বন্ধ স্থির করেন।’ 
                           
কিন্তু এ তো গেল সমাজের অন্তর্লীন ঘাত-প্রতিঘাতের ছবি। ভারতীয় সমাজের ভিত্তি যা, অর্থাৎ কৃষি-ব্যবস্থা, সেটিরও উন্নতিতে বিশেষ মনোযোগ দিলেন জমিদারবাবু। উপলব্ধি করলেন কৃষি বিদ্যালয় তৈরি, কৃষি প্রদর্শনী আয়োজন করার। শুধু উপলব্ধিই নয়, সিসিল বিডন যে কৃষি প্রদর্শনীর আয়োজন করলেন, তাতেও বিশেষ সহযোগিতা করলেন এই জমিদার।

আসলে কালীপ্রসন্ন কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা— জনজীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আবশ্যিক উপকরণগুলি কী কী, তা অল্প বয়সেই উপলব্ধি করেছেন। আর তাই বিদ্যোৎসাহিনী পাঠশালা-সহ সাতটি অবৈতনিক স্কুল, চিৎপুরে দাতব্য চিকিৎসালয় তৈরি, দুর্ভিক্ষে নিজের ‘উত্তরীয় বস্ত্র’টি পর্যন্ত বিলিয়ে দেওয়া, সবেই অগ্রণী মানুষটি।

বর্তমান সময়ে দেশ জুড়ে জলসঙ্কট একটি চর্চার বিষয়। উনিশ শতকের মধ্যভাগে এই মহানগরেও বিশুদ্ধ পানীয় জলের তেমন কোনও ব্যবস্থা ছিল না। বিষয়টি দেখে ইংল্যান্ড থেকে ২,৯৮৫ টাকায় চারটি ‘ধারাযন্ত্র’ আনালেন কালীপ্রসন্ন। সেগুলি বসানো হল কলকাতার চার জায়গায়।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট কাগজের সম্পাদক মারা যাওয়ার পর টাকার অভাবে কাগজ উঠে যাওয়ার জোগাড়, এগিয়ে এলেন কালীপ্রসন্ন। কিনে নিলেন কাগজ। আবার বেঁচে উঠল হিন্দু প্যাট্রিয়ট।
                            
শিল্প-সংস্কৃতি-সমাজের কল্যাণে যখনই অর্থের প্রয়োজন হয়েছে অকাতরে দান করেছেন তিনি।

একবার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে  দুর্ভিক্ষ। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সভা ডাকলেন। উপস্থিত সকলকে বললেন, যাঁর যেটুকু সাধ্য দান করতে। যে যেমন সাহায্য করলেন। সে দিন প্রস্তুত হয়ে সভায় যাননি কালীপ্রসন্ন, কিন্তু তাই বলে কিছু না দিয়ে ফিরবেন? গায়ে জড়ানো ছিল বহুমূল্য আলোয়ান। সেটিকেই খুলে দেবেন্দ্রনাথের হাতে ধরিয়ে দিলেন তিনি। অথচ এই নির্দ্বিধায় দানই যে একদিন কর্ণের মতো তাঁরও অকাল মৃত্যু ডেকে আনবে কে জানত!

জনহিতে এমনই নানা বিতরণ আমৃত্যু করেছেন কালীপ্রসন্ন। কিন্তু এই বিতরণ-কাজের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তাঁর মহাভারতের বঙ্গানুবাদ খণ্ডে খণ্ডে জনতাকে বিলিয়ে দেওয়ার ঘটনাটি।

সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে এই মহা-অনুবাদ বিষয়ে দু’-চার কথা বলা আবশ্যিক। জীবনীকার মন্মথনাথ ঘোষের মতে, জনশ্রুতি যে, কালীপ্রসন্ন মহাভারতের কিছু অংশের বঙ্গানুবাদ করে তা অভিভাবক হরচন্দ্রের কাছে নিয়ে যান এবং গোটা মহাকাব্যটির অনুবাদ করার কথা বলেন। বিষয়টি শুনে হরচন্দ্র পণ্ডিতদের সহযোগিতা নেওয়ার কথা বলেন। কালীপ্রসন্ন বিদ্যাসাগরের কাছে গেলে তাঁর সক্রিয় পরামর্শে এবং সাত জন পণ্ডিতের সহযোগিতায় প্রায় আট বছর ধরে এই অনুবাদটি হয়। যাঁর কাছে হুতোমি ভাষা অশ্লীল ঠেকেছিল, সেই বঙ্কিমচন্দ্রও ‘ক্যালকাটা রিভিউ’-এ অভিনন্দন জানালেন। পাশাপাশি, ‘কৃষ্ণচরিত্র’র প্রথম ভাগের বিজ্ঞাপনে কালীপ্রসন্নের এই অনুবাদের প্রতি ‘গুরুতর’ ঋণ স্বীকারও করলেন বঙ্কিম।
                             
ঠিক করলেন সংস্কৃত মহাভারতকে বাংলায় অনুবাদ করতে হবে। বয়স তখন মাত্র আঠেরো। কিছু অংশ অনুবাদ করার পর বুঝতে পারলেন এই বিশাল কাজ তাঁর একার পক্ষে শেষ করা অসম্ভব। অতঃকিম? গেলেন পণ্ডিত হরচন্দ্র ঘোষের কাছে পরামর্শ নিতে। হরচন্দ্র বললেন, ‘‘এত বড় কাজ কারও একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। তুমি কয়েক জন সংস্কৃত পণ্ডিতের সাহায্য নাও।’’

এবার তা’হলে কার কাছে যাওয়া যায়। রওনা দিলেন গুরুদেব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছে। সটান বললেন, ‘‘আমার পক্ষে আর অনুবাদ সম্ভব হচ্ছে না, আপনি দায়িত্ব নিন।’’

বিদ্যাসাগর বললেন, ‘‘আমার সময় কই? প্রচুর কাজ মাথার ওপর।’’

‘‘তা হলে কি বন্ধ হয়ে যাবে আমার এই চেষ্টা?’’

‘‘এত ভাল চেষ্টা কখনওই বন্ধ হতে পারে না। আমি ব্যবস্থা করছি।’’

সাত জন পণ্ডিতকে কালীপ্রসন্নের সঙ্গে দিলেন বিদ্যাসাগর। তার পর কালীপ্রসন্নের তত্ত্বাবধানে তাঁর বাড়িতেই শুরু হল অনুবাদের কাজ।
                        
১৮৩৯ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজের একটি সমিতি গঠিত হয়, যার নাম ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’। ১৮৪৩-এর অগস্ট মাসে এই সভার নিজস্ব মাসিক পত্রিকা ‘তত্ত্ববোধিনী’ প্রথম প্রকাশিত হয়। শুরু থেকেই এই পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীতে ছিলেন বিদ্যাসাগর। ১৮৪৮-এর ফেব্রুয়ারি সংখ্যা থেকে বিদ্যাসাগরের নিজের করা মহাভারতের অনুবাদ ধারাবাহিক ভাবে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় বেরোতে থাকে। কিছু দিন পর মহাভারতের এই অনুবাদ প্যামফ্লেট আকারেও প্রকাশিত হয়। ১৮৫৮ সালে বিদ্যাসাগর যখন কালীপ্রসন্নের মহাভারত অনুবাদের কথা জানতে পারেন তখন তিনি নিজের অনুবাদের কাজ থেকে বিরত হন। পরে কালীপ্রসন্ন তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানান এই বলে যে, বিদ্যাসাগর মহাভারতের অনুবাদের কাজ বন্ধ না-করলে তাঁর পক্ষে মহাভারতের অনুবাদের কাজ চালানো সম্ভব হত না। লেখক অনুবাদের কাজে সাহায্যের জন্য সাত জন সংস্কৃত পণ্ডিত নিয়োগের কথা বলেছেন। এই সাত জন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ছাড়াও আরও অনেকের প্রতি কালীপ্রসন্ন কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন মহাভারতের ভূমিকায়। তিনি লিখেছিলেন, ‘ইহার অনুবাদ সময়ে অনেক কৃতবিদ্য মহোদয়গণের ভূয়িষ্ঠ সাহায্য গ্রহণ করিতে হইয়াছে।’ মহাভারত অনুবাদের সাহায্যের জন্য কালীপ্রসন্ন যাঁদের কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান, তাঁরা হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, পুরাণ-বিশেষজ্ঞ গঙ্গাধর তর্কবাগীশ, রাজা কমলকৃষ্ণ বাহাদুর, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকার সম্পাদক দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ, প্রেসিডেন্সি কলেজের বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক নবীনকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, ‘ভাস্কর’ পত্রিকার সম্পাদক ক্ষেত্রমোহন বিদ্যারত্ন এবং প্রুফরিডাররা।

অনুবাদক গোষ্ঠীর কয়েক জনের মৃত্যুর পর শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৮৬৬ সাল পর্যন্ত অনুবাদের কাজ চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন অভয়চরণ তর্কালঙ্কার, কৃষ্ণধন বিদ্যারত্ন, রামসেবক বিদ্যালংকার এবং হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন। কালীপ্রসন্ন মহাভারতের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেছিলেন এশিয়াটিক সোসাইটি ও শোভাবাজার রাজবা়ড়ি থেকে এবং আশুতোষ দেব, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর ও নিজের প্রপিতামহ শান্তিরাম সিংহের কাশীতে অবস্থিত বাড়ির ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে। কালীপ্রসন্ন কলকাতায় না-থাকলে বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রেসের কাজ এবং অনুবাদের তদারকি নিজে করতেন। ব্যাসকূট শ্লোক ও জটিল শ্লোকগুলির অনুবাদে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিলেন কলকাতা সংস্কৃত বিদ্যামন্দিরের শিক্ষক তারানাথ তর্কবাচস্পতি।
                             
প্রতিবারের মতো এ বারেও শুরু হল নিন্দুকদের বিদ্রুপ। কালীপ্রসন্ন টাকা দিয়ে পণ্ডিত কিনে মহাভারত অনুবাদ করিয়ে নিজেকে অমর করার ধান্দায় নেমেছেন।

উত্তরে তিনি শুধু লিখলেন,

‘‘আমি যে দুঃসাধ্য ও চিরজীবনসেব্য কঠিন ব্রতে কৃত সঙ্কল্প হইয়াছি, তাহা যে নির্বিঘ্নে শেষ করিতে পারিব, আমার এ প্রকার ভরসা নাই। মহাভারত অনুবাদ করিয়া যে লোকের নিকট যশস্বী হইব, এমত প্রত্যাশা করিয়াও এ বিষয়ে হস্তার্পণ করি নাই। যদি জগদীশ্বর প্রসাদে পৃথিবী মধ্যে কুত্রাপি বাঙ্গালা ভাষা প্রচলিত থাকে, আর কোন কালে এই অনুবাদিত পুস্তক কোন ব্যক্তির হস্তে পতিত হওয়ায় সে ইহার মর্ম্মানুধাবন করত হিন্দুকুলের কীর্তিস্তম্ভস্বরূপ ভারতের মহিমা অবগত হইতে সক্ষম হয়, তাহা হইলেই আমার সমস্ত পরিশ্রম সফল হইবে।"

টানা আট বছর ধরে উদয়-অস্ত পরিশ্রমের পর ১৮৬৬ সালে শেষ হল অনুবাদের কাজ। বইও তৈরি। এবার পাঠকদের কাছে পৌঁছানো বাকি। কত দাম ঠিক করা হল প্রতি খণ্ডের? না, মহাভারত বিক্রি করে ব্যবসা করার জন্য তো কালীপ্রসন্ন এই কাজ করেননি। তা হলে?

বইয়ের এক আশ্চর্য বিজ্ঞাপন প্রকাশের ইতিহাস পাওয়া যায় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়। কী লেখা সেই বিজ্ঞাপনে? লেখা ছিল—                                  

‘‘শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন সিংহ মহোদয় কর্ত্তৃক গদ্যে অনুবাদিত বাঙ্গালা মহাভারত

মহাভারতের আদীপর্ব্ব তত্ত্ববোধিনী সভার যন্ত্রে মুদ্রিত হইতেছে। অতি ত্বরায় মুদ্রিত হইয়া সাধারনে বিনামূল্যে বিতরিত হইবে। পুস্তক প্রস্তুত হইলেই পত্রলেখক মহাশয়েরদিগের নিকট প্রেরিত হইবে।

ভিন্ন প্রদেশীয় মহাত্মারা পুস্তক প্রেরণ জন্য ডাক স্ট্যাম্প প্রেরণ করিবেন না।

কারণ, প্রতিজ্ঞানুসারে ভিন্ন প্রদেশে পুস্তক প্রেরণের মাসুল গ্রহণ করা যাইবে না। প্রত্যেক জেলায় পুস্তক বন্টন জন্য এক এক জন এজেন্ট নিযুক্ত করা যাইবে, তাহা হইলে সর্ব্বপ্রদেশীয় মহাত্মারা বিনাব্যয়ে আনুপূর্ব্বিক সমুদায় খণ্ড সংগ্রহকরণে সক্ষম হইবেন।

—শ্রীরাধানাথ বিদ্যারত্ন, বিদ্যোৎসাহিনী সভার সম্পাদক’’

সেই সময়ে পুরো আড়াই লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এই মহাভারত বিতরণে।

উদ্দেশ্য একটাই, দেশের সাধারণ মানুষ ভারতের এই মহান মহাকাব্যকে জানুক, নিজের দেশের অসামান্য সাহিত্যকীর্তির সঙ্গে পরিচিত হোক। আর এই কাজ করতে গিয়েই একেবারে পথে বসে গেলেন তিনি।
                            
ঋণের দায়ে জর্জরিত। সাহায্যের জন্য কেউ নেই পাশে। যে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবকে বিশ্বাস করে তাঁদের এক সময়ে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন, তাঁরাও সরে পড়লেন। তাঁর ওড়িশার জমিদারি, কলকাতার বেঙ্গল ক্লাব, আরও যা যা সম্পত্তি, সব একে একে বিক্রি হয়ে গেল।

কার্যত কপর্দকশূন্য অবস্থায় ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও বন্ধুরাও মুখ ফেরালেন, ঠকালেনও। কিন্তু কালীপ্রসন্ন ঠকেও জনহিতের নেশা ছাড়তে পারলেন না। ফলে, যাঁরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, তাঁদের নৈতিক চরিত্রের বদল ঘটতে পারে, এই আশায় ফের তাঁদেরই বিশ্বাস করলেন। এই পরিস্থিতিতে ঋণজালে আটকে পড়লেন সিংহ জমিদার।

১৮৬৬ সালে তাঁর নামে মোট ২০টি মামলা রুজু হল। আর আদালতে উপস্থিত না থাকার জন্য সব ক’টাতেই একতরফা ডিক্রি হয়ে গেল।

একের পর এক সম্পত্তি আটক আর বিক্রি করে পাওনাদারদের দেনা মেটাতে থাকলেন হাইকোর্টের শেরিফ। তাতেও কুলোল না, সম্পত্তির ওপর রিসিভার বসল। পুরোপুরি বিপর্যস্ত জোড়াসাঁকোর রাজা! পাওনাদারদের দাবিতে শেষ পর্যন্ত ওয়ারেন্ট জারি হয়ে গেলে কালীপ্রসন্নের নামে।

যে কালীপ্রসন্ন একদিন রেভারেন্ড জেমস লংকে জরিমানা দিয়ে হাজতবাস থেকে বাঁচিয়েছিলেন, তাঁকেই শেষ পর্যন্ত ওয়ারেন্ট এড়াতে লুকিয়ে একা থাকতে হল বরানগরের গঙ্গার ধারের বাগান বড়িতে। ওই বাড়িতেই দীর্ঘ আট বছর ধরে কাজ হয়েছিল মহাভারত অনুবাদের। বড় সাধ করে বাড়ির নাম রেখেছিলেন সারস্বতাশ্রম। তবু শেষরক্ষা হল না। শেষ পর্যন্ত আদালতে আসতেই হল তাঁকে। দাঁড়াতে হল আসামির কাঠগড়ায়। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। বিচারপতি নেহাত দয়া করে তাঁকে কারাগারে না পাঠিয়ে মুক্তি দিলেন।

এই দয়াই যেন সহ্য হল না চিরকাল সিংহের মতো কেশর ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচা কালীপ্রসন্ন সিংহের। জীবনে প্রথম সে দিন মাথা হেঁট করে বেরিয়ে এসেছিলেন আদালত কক্ষ থেকে।
                             
এর পর কে-ই বা খোঁজ নিয়েছে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে শেষ যাচ্ছেন তিনি!

উপর্যুপরি নানা আঘাতে বিধ্বস্ত কালীপ্রসন্ন এ বার আঁকড়ে ধরলেন বেঁচে থাকার এক কঠিন অবলম্বনকে। নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন মদের নেশায়। কিন্তু তখনও জ্ঞানতৃষ্ণা তাঁকে ছেড়ে যায়নি। পরিকল্পনা করলেন এক ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার। ‘বঙ্গেশ বিজয়’ নামে সেই উপন্যাসের দুই ফর্মা জগন্মোহন তর্কালঙ্কার ভট্টাচার্যের ছাপাখানায় ছাপাও হয়। তবে উপন্যাসটি অসমাপ্ত।

ঠিক চার মাস কাটল এ ভাবেই।

১৮৭০ সাল। ২৪ জুলাই। বেলা ৩টে।

গঙ্গার ধারের বাসভবনে নিঃস্ব একাকী কালীপ্রসন্ন যখন পৃথিবীতে তাঁর জীবনের শেষ নিঃশ্বাসটি নিচ্ছেন, তখন তাঁর বয়স সবে তিরিশ ছুঁয়েছে!

কারণ, ১৮৭০-এর ২৪ জুলাই ডিসঅর্ডার অব লিভারে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৩০ বছর পাঁচ মাস বয়সে এই মহানগর থেকে বিদায় নেন কালীপ্রসন্ন। কালীপ্রসন্নের শেষ জীবনের মদ্যপানকে অনেকেই ‘নৈতিক অবনতি’ ও তাঁর মৃত্যুর কারণ হিসেবে দেখেন। কিন্তু তার পরেও কর্মকাণ্ডের জোরেই মদ্যপানের ‘দোষকেও’ অতিক্রম করে যান কালীপ্রসন্ন। রাজকৃষ্ণ রায় তাই লিখেছিলেন, 

"যদিও তোমাতে কিছু দোষ দেখা যায়,
এহেন মহান্ গুণে সে দোষ কি আর ধরে কেহ; দোষাকারে যেমতি সুধার
কলঙ্ক ঢাকিয়া করে গুণের প্রচার।"

— এই গুণ দিয়েই অশেষের উদ্দেশে যাত্রা কলকাতার মহা-নাগরিকের!
                              
(তথ্যসূত্র:
১- ‘বাংলার সমাজ ও সাহিত্যে কালীপ্রসন্ন সিংহ’: পরেশচন্দ্র দাস।
২- ‘মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ’: মন্মথনাথ ঘোষ।
৩- ‘সটীক হুতোম প্যাঁচার নকশা’: সম্পাদনা— অরুণ নাগ।
৪- ‘বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ’: বিনয় ঘোষ।
৫- ‘দি ইন্ডিয়ান স্টেজ’ (দ্বিতীয় খণ্ড): হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত।
৬- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০শে আগস্ট ২০১৬ সাল।
৭- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩রা আগস্ট ২০১৯ সাল।)
                              

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ