দেশভাগের জন্য দায়ী কে?।। রাণা হাজরা



১৯৩৩ সালে কেমব্রিজের ছাত্র রহমত আলি যখন পাকস্তান নাম প্রস্তাব করেন তখন তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি যে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে তার কল্পনা বাস্তবের দেশে রূপ নেবে। পৃথিবীর ইতিহাসে এ এক অভাবনীয় ঘটনা। পাঞ্জাব, কাশ্মীর, সিন্ধ আর বালুচিস্তানের স্তান নিয়ে তিনি পাকস্তান নামকরণ করেন। পরে ইংরেজি 'আই' অক্ষর যোগ করে পাকিস্তান নাম পবিত্র ভূমিতে রূপান্তরিত হয়। পাকিস্তান নামের কোথাও বাংলা নেই। পৃথক দেশের দাবি তোলার সময়েও মুসলিম লিগের কেউ বাংলাকে তাদের পবিত্র ভূমিতে যোগ করানোর কথা ভাবেনি। এই সময়ে গোল টেবিল বৈঠক হচ্ছে, যেখানে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ অখন্ড দেশে ইংরেজদের অধীনে থেকে স্বায়ত্তশাসনের জন্য দর কষাকষি করে যাচ্ছে। কেউ দুই নেশন দুই দেশের থিওরি আওড়াননি। এই দ্বেষবাণী প্রথম উঠে আসে হিন্দু মহাসভার নেতৃবৃন্দ ও সাভারকরের মুখে।  হিন্দু মহাসভার উনিশতম অধিবেশনে সাভারকর প্রথম দুই জাতি-দুই দেশ থিওরি তুলে ধরেন এবং জোরালো সওয়াল করেন।

এরমধ্যে আইনসভার নির্বাচনে মুসলিম লিগের বিপর্যয় ঘটে। মুসলিম গরিষ্ঠ অঞ্চলেও তারা ধরাশায়ী হয়। জিন্নাহ কোনকালে মুসলিম ধর্মাচরণে অভ্যস্ত ছিলেন না। তিনি ছিলেন আইনজীবী। দরকষাকষিতে পারদর্শী। অতএব হিন্দু মহাসভার সাভারকর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যেভাবে দেশভাগ চেয়েছিলেন, জিন্নাহ তাই লুফে নিলেন। ১৯৪০ সালের মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনে তিনি পৃথক দেশের দাবি করে বসলেন। যিনি প্রকৃতপক্ষে নাস্তিক ছিলেন, তিনিই ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা দেশের দাবি করে বসলেন। লালকৃষ্ণ আদবানি লাহোরে গিয়ে জিন্নাহকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করেন। প্রকৃতপক্ষে জিন্নাহ ক্ষমতালোভী ছিলেন। ধর্ম দিয়ে ঘৃণার চাষ করে তিনি ক্ষমতাভোগ করতে চেয়েছিলেন। ১৯৩০ সাল থেকে জিন্নাহ হিন্দু অধ্যুষিত ভারত রাষ্ট্রের মধ্যে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর জন্য আলাদা স্বায়ত্তশাসনের দাবি করেছিলেন। কিন্তু হিন্দু মহাসভার সাভারকরের দুই দেশের দাবি ওনাকে পৃথক রাষ্ট্রের দাবিতে উজ্জীবিত করে। তখনো তিনি বাংলার দিকে নজর ঘোরাননি। তিনি পরবর্তীকালে পাকিস্তানে অখন্ড বাংলা চেয়েছিলেন।  কলকাতা যদি বাংলার অন্তর্ভুক্ত না হয়, তবে যে সুজলা সুফলা বাংলাদেশ যে মরুভূমি, তিনি তা জানতেন। কিন্তু ভারতের মধ্যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অখন্ড বাংলায় হিন্দু মহাসভা কোনদিন ক্ষমতার অলিন্দে আসতে পারবেন না, তা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি জানতেন। অতএব তিনি ধর্মের ভিত্তিতে বঙ্গভঙ্গের দাবি তোলেন। মুসলিম সংখ্যাগুরু বাংলাকে পাকিস্তানের দিকে ঠেলে দিতে চাইছিলেন। কংগ্রেস বাংলা নিয়ে বেশি ভাবিত ছিলেন ন। অখন্ড বাংলা যে কংগ্রেসের নবতম শাসকদের পক্ষে বিপজ্জনক তারা তা জানতেন।

মহম্মদ আলি জিন্নাহ বাংলা ভাগ চাননি। ধর্মের ভিত্তিতে যে দেশ গড়ে উঠেছে, তিনি জানতেন যে এই বাঙালিরাই পাকিস্তানের পক্ষে বিপদস্বরূপ হয়ে উঠবে। মাঝে কয়েক হাজার কিলোমিটার ব্যবধানে থাকা দুটো অঞ্চল কখনো এক দেশ হয়ে থাকতে পারে না। কিন্তু তৎকালীন কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার নেতারা জানতেন যে ঐক্যবদ্ধ বাংলা শাসকদলের কাছে বিপদস্বরূপ। তাই পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ে কংগ্রেসিরা দর কষাকষি করলেও বাংলার কোন অঞ্চল নিয়ে কোন দর কষাকষিতে যাননি। বৌদ্ধ অধ্যুষিত চট্টগ্রাম পাহাড়িয়া অঞ্চল ভারতে থাকার কথা ছিল। হিন্দু অধ্যুষিত খুলনা ভারতে থাকার কথা থাকলেও তা নিয়ে কেউ আগ্রহ দেখায়নি। এমনকি সিলেট ভারতে থাকার আগ্রহ দেখালেও কংগ্রেসের কেউ গণভোটের আগে প্রচারে যায়নি।
ভবিষ্যতের শাষকেরা জানতেন বাঙালি অঞ্চল যত সঙ্কুচিত হবে তত তাদের পক্ষে শাসন চালানো সুবিধা হবে।

জিন্নাহ শুরুর দিকে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পক্ষে ছিলেন। তিনি কংগ্রেসে থেকে এর স্বপক্ষে প্রচার করতেন। কিন্তু কংগ্রেসের কট্টরবাদী হিন্দু নেতাদের দ্বারা কোনঠাসা হয়ে মুসলিম লিগের দিকে ঝুকে পড়তে বাধ্য হন। স্বাধীনতার সময়েও তিনি মুসলিমদের জন্য আলাদা দেশ চেয়েছিলেন, কিন্তু ইসলামিক রাষ্ট্রের পক্ষে ছিলেন না।
কট্টর হিন্দু নেতা আদবানি ঠিক এই কারণে জিন্নাহকে ধর্মনিরপেক্ষ বলেছেন।
স্বাধীনতার ঠিক আগে তিনি জাতির উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, "আপনারা মন্দিরে যেতে পারেন, আপনারা মসজিদে যেতে পারেন, আপনারা নিজেদের বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্মাচরণ করতে পারেন। নতুন দেশে ধর্ম রাষ্ট্রীয় বিষয় নয়।"
তিনি নিজেও যেভাবে জীবনযাপন করতেন, তাতে বর্তমান পাকিস্তানে তাকে ইসলাম অবমাননার দায়ে ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হত।

স্বাধীনতার পরেও জিন্নাহ স্বস্তি পাননি। পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে অস্তিত্ব হারিয়ে ভারতে মিশে যাবে বা বাংলা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে, এই ভয় পেয়ে বসেছিল। তাই ধর্ম ও ভাষা দিয়ে তিনি দেশকে কঠোর শাসনে বেঁধে রাখতে চেয়েছিলেন।
১৯৪৮ সালের একুশে মার্চ ঢাকার জনসভায় তিনি ঘোষণা করেন, "আপনারা এক ভাষা ছাড়া জোটবদ্ধ থাকতে পারবেন না। তাই উর্দু হবে পূর্ব ও পশ্চিম দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। বাংলা দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে থাকবে। যারা এর বিরোধিতা করছেন, তারা প্রাদেশিকতা দোষে আক্রান্ত।"
ইতিহাস সাক্ষী এক দেশ-এক ধর্ম-এক ভাষার থিওরি অনুসরণ করতে গিয়ে পশ্চিমা কালচারের জিন্নাহ পাকিস্তানকে শুধু পুনর্বার দ্বিখন্ডিত করেননি, আজ পশ্চিম পাকিস্তানেও মূল দেশের মধ্যে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশ আছে। যারা কেন্দ্রীয় শাসনকে অগ্রাহ্য করে।
কংগ্রেস সেখানে ভারতের কোন মূল রাষ্ট্রভাষা রাখেনি, কোন মূল ধর্মকে দেশের ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেননি। তাই স্বাধীনতার সত্তর বছর পরেও ভারতে বহু বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী সক্রিয় থাকলেও পাকিস্তানের মত সমস্যাসঙ্কুল, বিভাজিত রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়নি।

আজ যারা পুনরায় ইউরোপের অনুকরণে এক দেশে এক ধর্ম ও এক ভাষার দাবি তুলছেন, ভেবে দেখবেন বহু সংস্কৃতির ভারতীয় উপমহাদেশে তা কি বিভাজনের রাজনীতিকে প্রশ্র‍য় দিচ্ছে না? 
জিন্নাহ ধর্ম ও ভাষা দিয়ে দেশকে একতাবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন, যা পাকিস্তানকে বহুধাবিভক্ত করে। হিন্দু রাষ্ট্র ও হিন্দি ভাষার আগ্রাসন দিয়ে আপনারা কি এই দেশকে একতাবদ্ধ রাখতে পারবেন?
রবি ঠাকুরকে স্মরণ করুন। তিনি বিবিধের মাঝে মিলনের গান গেয়েছিলেন।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ