তৃতীয় ভুবন - মৃণাল সেন।। রানা চক্রবর্তী



বাংলা ছবিতে তৈরি হয়েছিল তিনটে ঘরানা৷ একটা সত্যজিৎ, আরেকটা ঋত্বিক ও তিন নম্বর মৃণাল সেন৷ এই তিন পরিচালকের ছবি তৈরির ঘরানার মধ্যে তফাৎ অনেকটাই৷ কেউ পর্দায় বাস্তবকে তুলে নিয়ে আসতেন, সাহিত্যের থেকে ধার করে, নন্দন তত্ত্বের ওপর ভর করে৷ যেখানে ছবি অনেকটাই ম্যাজিকাল৷ কেউ আবার ছবির পর্দায় গল্পের মাধ্যমে অনবরত সমালোচনা করেই চলতেই সমাজের৷ প্রথমটা যদি সত্যজিৎ রায় হন, তাহলে দ্বিতীয়টা অবশ্যই ঋত্বিক ঘটক৷ তবে এই দুই পরিচালকের থেকে অনেকটা দূরে থেকেই সিনেমাকে অন্যভাবে দেখেছেন পরিচালক মৃণাল সেন৷ কখনও কঠোর বাস্তব, তো কখনও মানুষের মনের থেকে স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নকে নিংড়ে নিয়ে এসে পর্দায় তৈরি করতেন এক অদ্ভুত ছবি৷ আর তাই হয়তো, সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকের পাশাপাশি সিনেমার পর্দার নিজের আলাদা ‘অটিয়োর’ তৈরি করেছিলেন মৃণাল সেন৷

'‘কলকাতা শহরে কত উনুন?’’ ছবির প্রধান চরিত্রের মনে এই প্রশ্ন উস্কে দিত মৃণাল সেনের ‘চালচিত্র’। মধ্যবিত্ত সংসারে রান্নার গ্যাসের যুগ নয় সেটা। উনুনের ধোঁয়া, লোডশেডিংয়ের অন্ধকার ঘেরা বারো-ঘর-এক-উঠোন আর পাঁজরের হাড় বার করা সত্তর-আশির কলকাতা সবচেয়ে বেশি যাঁর ছবিতে ধরা দিয়েছে, তিনি মৃণাল সেন।

চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, বাংলার চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে কলকাতার সবচেয়ে নিবিড় এবং স্থায়ী প্রণয়ী মৃণাল সেন। যে প্রেম এসেছিল তাঁর মধ্যবিত্ত শ্রেণিগত অবস্থান থেকেই। লং শট-এ একটু লো অ্যাঙ্গলে কে কে মহাজনের ক্যামেরায় শহরের গলিঘুঁজি, ছাদ দেখলেই চেনা যায় মৃণালের স্বাক্ষর। 

চলচ্চিত্রবিদ্যার অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতি বলছে, কী ভাবে উনি ফুটপাতে হাতে ‘ফ্রন্টিয়ার’ নিয়ে তর্ক করতে ভালবাসতেন। সেই ভালবাসাই তাঁকে কলকাতার গলি-উপগলি নিয়ে যত্নশীল করেছিল। সঞ্জয়ের মতে, ‘‘ষাটের দশকের গোড়াতেই ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবিতে চিনা চরিত্রটি যখন সিনেমার পোস্টারে এক অ-বাক নারীর দিকে তাকায়, বোঝা যায়, মৃণাল সেন কলকাতার এক অন্য রূপকল্প ভাবছেন। সেই রূপকল্পই আরও গভীর হয় সত্তরের দশকে।’’ কোরাস বা কলকাতা’৭১-এর যে কলকাতা, সেটা পরিচালকের নিজের ভাষায়, ‘ইনটেস্টিন্স অব দ্য সিটি’। শহরের অন্তঃপ্রণালী। ‘ভুবন সোম’, যেখানে শহর নেই, সেখানেও মৃণাল গ্রামকে পরীক্ষা করেন শহরের চোখ দিয়েই।

মৃণালের অন্যতম প্রিয় অভিনেতা ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ও পরিচালকের কলকাতা-প্রেমের ঘনিষ্ঠ সাক্ষী। তাঁর বক্তব্যে, ‘‘ছাত্রজীবন, আইপিটিএ-র সঙ্গে যোগ এবং পরে কিছুদিন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি — জীবনের বিভিন্ন স্তরে কলকাতাকে চষে খেয়েছেন মৃণালদা।’’ শহরের যে ছবিটা ওঁর মগজে রয়েছে, সেটা বুঝে নেওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ধৃতিমানের কথায়, ‘‘পদাতিক’-এর সময়ে ক্যামাক স্ট্রিটের একটি বহুতলে শুটিং হত। কাজ শেষে সেখানেই আমরা থাকতাম। যাতে যে কোনও সময়ে সকলের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়।’’ কলকাতা’৭১-এর জন্য ভবানীপুর, কালীঘাট আদিগঙ্গার ধার থেকে একেবারে ময়দান পর্যন্ত ক্যামেরা ধাওয়া করত অভিনেতা দেবরাজ রায়কে। এ দিন সে কথা মনে করে তিনি বলছিলেন, ‘‘প্রচুর দৌড় করিয়েছিলেন মৃণালদা!’’

সঞ্জয় মনে করিয়ে দেন, সত্যজিৎ বা ঋত্বিকের সঙ্গে মৃণালের প্রধান তফাৎই হল রোজকার জীবনের গল্প বলায়। মৃণাল প্রায়ই তাঁর প্রিয় চিত্রনাট্যকার, ইটালির জাভাতিনিকে উদ্ধৃত করে বলতেন, ‘টুডে টুডে অ্যান্ড টুডে’। সেই আজ-এর গল্পে কলকাতাই ছিল তাঁর নায়িকা। সঞ্জয়ের কথায় তাই, ‘‘মৃণাল চলে যাওয়াতে কলকাতার অধরোষ্ঠে কিছু চাপা কান্না থেকে যাবে।’’
                              
চওড়া ফ্রেমে আঁটা মোটা লেন্সের আড়ালে চকচকে দুটো চোখ, ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। তিনি মৃণাল সেন। বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই চলচ্চিত্রকার পাল্টে দিয়েছিলেন বাংলা সিনেমার ধারা। প্রতিনিয়ত নিয়ম ভেঙ্গে নতুন নিয়ম সৃষ্টিতে যাঁর ছিল অদম্য নেশা। সমাজ বাস্তবতাকে তিনি সব সময়ই গুরুত্ব দিয়েছেন। আর তাই তাঁর ছবিতে নকশাল আন্দোলন যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে শ্রেণীদ্বন্দ্ব, এসেছে দরিদ্র আদিবাসীদের কথা, এসেছে মানুষের গভীর সম্পর্কের কথাও। মৃণাল সেন মানেই এক প্রতিবাদী মুখ। যে মুখ তরুণের। তাই তারুণ্যের ভাষা তাঁর সৃষ্টিজুড়ে। তিনি সমাজমনস্কতায় বা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন এক অ্যাংরি ইমেজ। চলচ্চিত্রকে তিনি দিয়েছেন এক নতুন ভাষা। ক্যামেরাই ছিল তাঁর প্রতিবাদের অস্ত্র। 

মৃণাল সেনের একটা অদ্ভুত স্বভাব ছিল। খুব সিগারেট খেতেন। যখনই মুখে একটা সিগারেট ধরাতেন, যে সামনে আছে, তাঁর কাছে দেশলাই চাইতেন। তারপর সেটা নিজের পকেটে রেখে দিতেন। সেও লজ্জায় আর চাইতে পারত না। এই অভ্যাস প্রসঙ্গে অনেককেই বলেছিলেন, ‘যখন বাড়ি ফিরি, পকেটে গোটা দশ-বারো দেশলাই!’ 

এছাড়াও খুব শীতকাতুরে মানুষ ছিলেন তিনি। শীতকালে একদম স্নান করতে চাইতেন না। স্ত্রী শ্রীমতী গীতা সেন বলতেন, ‘তুমি যদি স্নান না করো, তোমাকে আমি খেতে দেব না।’ এই ঘটনা নিজে প্রত্যক্ষ করেছিলেন অভিনেতা শ্রী রঞ্জিত মল্লিক নিজে। একদিন তিনি মৃণাল সেনের বাড়িতে গিয়েছেন। শুনলেন গীতা সেন বলছেন, ‘শুনছো, তোমার স্নান হয়েছে?’ মৃণাল সেন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ক-ও-ও-বে...’। এই কবে মানে কিন্তু অনেকক্ষণ আগে নয়! আসলে মানুষটা ছিলেন খুব মজাদার। ‘ফুল অফ লাইফ’ যাকে বলে।
                             
মৃণাল সেনের স্মৃতিচারণে আধুনিক যুগের বাংলা গানের অন্যতম গায়ক ও অভিনেতা অঞ্জন দত্ত ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৮ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় জানিয়েছিলেন -

"প্রথমেই আমার নায়ক হওয়ার সব আশা জলাঞ্জলি দিয়ে দিলেন মৃণাল সেন। লম্বা চুল কেটে দিলেন। তার পর তেল মাখিয়ে, রোগা চেহারায় স্যান্ডো গেঞ্জি পরিয়ে দৌড় করালেন। দৌড়তে দৌড়তে মাঝে মাঝে পরিচালকের কথা শুনতে পারছি না। সে কথা বলতেই উনি রেগে বলে উঠলেন, ‘যা মনে হয়, সে রকম করো। ন্যাচারাল রিঅ্যাকশন।’

ছবির নাম ‘চালচিত্র’। একুশ বছরের উঠতি, উচ্ছৃঙ্খল, পুরোদস্তুর অরাজনৈতিক, তার্কিক, ডেঁপো এক ছেলের সঙ্গে পঞ্চান্ন বছর বয়সি পৃথিবীখ্যাত পরিচালকের বন্ধুত্বের শুরু। বন্ধু কথাটা ভুল নয়। অজস্র তর্ক, ভালবাসায় কেটেছে সেই সব দিন। ওঁর ছেলে কুনালও ওঁকে ‘বন্ধু’ বলে ডাকত। মৃণাল সেন আমার বন্ধু, শিক্ষক, পরিচালক, সহকর্মী, বাবার মতো অনেক কিছুই। এমনকি, বাবা যে স্বাধীনতা আমাকে দেননি, উনি সেটাও দিয়েছিলেন। ‘খারিজ’-এর পর ওঁকে ডেঁপোমি মেরে সার্ত্র, অস্তিত্ববাদ উল্লেখ করে চিঠি দিয়েছিলাম, ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যই সব। সামাজিক সমষ্টি নয়। উনি বলতেই পারতেন, এর পর রোল দেব না। উল্টে আমাকে হাতচিঠি পাঠালেন, ‘না, সমষ্টিই সব।’

মৃণাল সেন কোনও কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার ছিলেন না। কিন্তু মানুষের ভিড় ও মিছিল ওঁকে উদ্দীপ্ত করে এসেছে। মৃণালদাকে দেখেছি, তর্ককে প্রশ্রয় দিতেন। কিন্তু স্তাবকতাকে নয়। নন্দীগ্রাম নিয়ে প্রতিবাদ মিছিলের সময়ে উনি বললেন, ‘আমিও যাব।’ এসপ্ল্যানেড থেকে একটু নিয়ে যাওয়া হল। পরদিন ওঁকে ক্ষমতাসীন নেতাদের ফোন। সেই মিছিলেও গেলেন। লোকে বলতে শুরু করল, উনি বৃদ্ধ হয়েছেন। আমি নীরব ছিলাম। কারণ ‘মানুষের সঙ্গে আছি, সেটাই আমার জায়গা’ এই বার্তাই উনি বারংবার দিতে চেয়েছেন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক দিন হঠাৎ আমার ‘বং কানেকশন’ ছবি দেখতে হাজির। ওঁকে নেমন্তন্নও করিনি। কিন্তু উনি এসে জানালেন, ‘মৃণালদা বললেন, ভাল ছবি।’

মৃণালদা এই রকমই। এক দিকে পাজামা-পাঞ্জাবি পরা বাঙালিয়ানা, অন্য দিকে অকুণ্ঠ আন্তর্জাতিকতাবোধ। সংসারের ধরাবাঁধা নিয়ম না মেনে সকলের বন্ধু হয়ে ওঠেন। কখনও আমাদের প্রেম নিয়ে শুনতে চান, দুর্দশা টের পেলে কিছু জানতে না দিয়ে পকেটে সিগারেট, টাকা গুঁজে দেন। ‘টাকা কেন, মৃণালদা?’ উত্তর, ‘তুই পেতিস। ভুলে গিয়েছিস।’ ‘কান’ চলচ্চিত্র উৎসবে গেল ‘চালচিত্র’। দেখি, ব্রায়ান ডি পালমা, রবার্ট ডি নিরো থেকে সিডনি লুমেট সবাই ওঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু। তার আগে আমাকে পইপই করে শিখিয়ে দিয়েছিলেন, ‘ওখানে আমাকে মৃণাল বলবি। মৃণালদা একদম নয়!’ ... "
                          
১৯২৩ সালের ১৪ই মে, বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন মৃণাল সেন। মৃণাল সেন জন্মদিন সম্পর্কে তাঁর অটোবায়োগ্রাফিতে লিখেছিলেন, ‘I am one year younger than what I’ll be in next year’ ! দেশ বিভাগের সময় তাঁরা সপরিবারে কলকাতায় চলে আসেন। প্রথমে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। স্কটিশ চার্চ কলেজে যখন পড়তেন তখন থেকে নিয়মিত জাতীয় গ্রন্থাগারে যেতেন। নানাধরনের বইয়ের পাশাপাশি তাঁর চোখ খুঁজে বেড়াত চলচ্চিত্র বিষয়ক বইপত্র। একদিন হাতে এল বিখ্যাত রাশিয়ান শিল্প সমালোচক ভ্লামিদির নিলসেনের ‘সিনেমা অ্যাজ এ গ্রাফিক আর্ট’ বইটি। সেটা পড়েই মৃণাল সেন আজেনস্টাইনের সমাজ তত্ত্ব সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হলেন। চিন্তার জগতে তুমুল আলোড়ন শুরু হল। এই সময় ফরাসি পরিচালক জাঁ রেনোয়া কলকাতায় ছবি করতে এলেন। মৃণালবাবুর বেশ কয়েকজন বন্ধু রেনোয়ার কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রেনোয়ার কাজ দেখার জন্যে তিনি কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতেন। কারণ, সিনেমার প্রতি তাঁর কমিটমেন্ট ছিল অসাধারণ।

ছাত্রাবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখার সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু তিনি কখনও কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয়পদ গ্রহণ করেননি। ১৯৪৩ সালে তিনি আইপিটিএ-র সঙ্গে যুক্ত হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি সাংবাদিকতা,ওষুধ বিপণনকারী এবং চলচ্চিত্রের শব্দ কলাকুশলী হিসেবে কাজ করেন। তখনকার নামী অভিনেত্রী সুনন্দা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে প্রোডাকশন হাউস খুললেন। তিনি ছবি করবেন। পরিচালনা করবেন কে, সেই নিয়ে তিনি খোঁজখবর করছেন। এমন সময় খবর পেলেন কলকাতারই চলচ্চিত্র বোদ্ধা এবং একটি ছবির সহকারী পরিচালক মৃণাল সেন প্রযোজক খুঁজছেন। সুনন্দা দেবী তাঁকে প্রস্তাব দিলেন ছবির জন্য। মৃণালবাবুও রাজি হলেন। ১৯৫৫ সালে তাঁর প্রথম ছবি 'রাতভোর' মুক্তি পেল। যদিও ছবিটি ততটা সাফল্য পায়নি। ১৯৫৮ সালে মুক্তি পায় তাঁর দ্বিতীয় ছবি 'নীল আকাশের নীচে'। একপ্রকার আচমকাই প্রযোজক রূপে পেলেন সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। ছবির নায়ক ওয়াং লু-এর চরিত্রে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ছবির মাধ্যমে বাংলা সিনেমায় রাজনীতির প্রবেশ ঘটল। এই ছবিটি সরকার দুই মাসের জন্য বাজেয়াপ্ত করে রেখেছিল। এই ছবিই তাঁকে স্থানীয় চলচ্চিত্র মহলে পরিচিতি এনে দেয়। তাঁর তৃতীয় ছবি 'বাইশে শ্রাবণ' মুক্তি পায় ১৯৬০ সালে। এই ছবির দ্বারা তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি পান। ১৯৬৯ সালে তাঁর পরিচালিত বহুল আলোচিত ছবি 'ভুবন সোম' মুক্তি পায়। এই ছবিটি অনেকের মতে মৃণাল সেনের শ্রেষ্ঠ ছবি। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৩ সালের ভিতরে, কলকাতার অস্থির সামাজিক অবস্থার আলোকে তাঁর তিনটি ছবি (ইন্টারভিউ, কলকাতা ৭১, পদাতিক) মুক্তি পায়। এই ছবি তিনটি ‘কলকাতা ট্রিলজি’ নামে খ্যাত।

উল্লেখ্য, ১৯৮৩ সালে তাঁর পরিচালিত ‘খারিজ’ ছবিটি কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার পেয়েছিল। ১৯৮৬ সালে তিনি নির্মাণ করেন 'জেনেসিস'। এই ছবিটি হিন্দি, ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় মুক্তি পেয়েছিল। সবমিলিয়ে তিনি ২৭টি কাহিনীচিত্র, ১৪টি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি, ৪টি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। মৃণাল সেনের আত্মজীবনী বেরিয়েছে ২০০৪ সালের শেষদিকে। দিল্লির স্টেলার পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত ৩১০ পৃষ্ঠার এই বইটির নাম ‘অলওয়েজ বিয়িং বর্ন’।
১৯৮১ সালে তিনি পদ্মভূষণ পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল অবধি তিনি সংসদের সাম্মানিক সদস্যপদ লাভ করেন। ২০১৭ সালে হয়েছিলেন অস্কার অ্যাকাডেমির সদস্যও। সম্মান পেয়েছেন ফরাসি দেশেরও। ‘কমান্ডার অব আর্টস অ্যান্ড লেটার্স।’ সোভিয়েত রাশিয়া থেকে ‘নেহরু সোভিয়েত ল্যান্ড অ্যাওয়ার্ড’, রাশিয়ান ফেডারেশন থেকে ‘অর্ডার অব ফ্রেন্ডশিপ’। এ রকম কত দেশের কত সম্মান! একদা পশ্চিম জার্মানির প্রতিবাদী পরিচালক রাইনার্ড হফ আশির দশকের মাঝামাঝি বার্লিন থেকে কলকাতা আসেন দশ দিনের জন্য। মৃণালকে নিয়ে দীর্ঘ তথ্যচিত্র তৈরি করলেন—‘টেন ডেজ ইন ক্যালকাটা: আ পোর্ট্রেট অব মৃণাল সেন’। কাগজ পড়তেন নিয়মিত। স্ত্রী গীতা সেনের সঙ্গে ছিল তাঁর অসাধারণ এক দাম্পত্য জীবন। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে একাকীত্বে ডুবেছিলেন যেন। তবুও সমাজের খুঁটিনাটি বিষয়ের খবর রাখতেন। বই ও পত্র-পত্রিকা ছিল তাঁর আজন্ম সঙ্গী। ভালো লাগত বিরাট কোহলিকে। রাজনীতি থেকে খেলা সব কিছু গভীরভাবে পড়া চাই। বার্ধক্য যতই ছোবল বসাবার চেষ্টা করুক, তিনি যেন আড্ডার মাঝে ফুটন্ত তরুণ। তবে সবার সঙ্গে আড্ডা দিতেন না। পছন্দসই মানুষ পেলে বিছানায় শুয়েও জমে যেতেন গল্পে। বলতেন, জীবনটাই যেন নীললোহিতের মতো, সবসময় আটকে থাকে সাতাশে।
                            
পরাধীন ভারতে জন্মেছিলেন মৃণাল সেন, মাথার ওপর ছিল প্রায় দেড়শো বছরের ঔপনিবেশিকতার চাপ। জন্ম থেকে জীবনের প্রথম দিকটা কাটে ফরিদপুরের ছোট মফস্‌সল শহরে, যা আজ বাংলাদেশের অন্তর্গত। স্বাধীনতা অর্জনের পর বহু বছর ধরেই সিনেমায় আধুনিকতার নিরিখ কী, এক নাগাড়ে খুঁজে বেড়িয়েছেন তিনি। 

শেষ ছবি ‘আমার ভুবন’ (২০০২)। প্রথম ছবি করেছিলেন ১৯৫৫-য়, ‘রাতভোর’। ‘পথের পাঁচালী’-র তুমুল সাফল্যের পাশে ‘রাতভোর’-এর ব্যর্থতা তাঁকে দমিয়ে দিতে পারেনি এতটুকু। পরবর্তী ‘নীল আকাশের নীচে’ ছুঁয়ে তৃতীয় ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’ থেকেই খুঁজে নিয়েছেন নিজের জমি। ফিল্ম, এই আর্ট ফর্মটির প্রতি তীব্র আসক্তি বা ভালবাসা না থাকলে বোধহয় এমন ক্রমোন্নতি অসম্ভব।

সত্যজিৎ রায়ের মতো গোড়া থেকেই ধ্রুপদী সাহিত্য বা সাহিত্যিককে নিজের ফিল্মের আশ্রয় করে তোলেননি তিনি। বরং সত্যজিতের সৃজন-ভাবনার বিপরীত বিন্দু থেকেই তাঁর ছবি করা শুরু। সত্যজিৎও স্বীকার করেছেন সে কথা। ‘‘দে স্টার্টেড অ্যাট অ্যাবাউট দ্য সেম টাইম অ্যাজ আই ডিড, ঋত্বিক অ্যান্ড মৃণাল।’’ ‘‘দে ওয়্যার মেকিং ফিল্ম ভেরি ডিফারেন্ট ফ্রম মাইন, ভেরি ডিফারেন্ট, বাট ভেরি পাওয়ারফুল, আই থিংক।’’

মৃণাল সেন বিশ্বাস করতেন কোনও ছবি-করিয়ের ‘সবচেয়ে বড় সঙ্কট হল আদর্শগত’। তার মোকাবিলা করতে পরিচালক হিসেবে সব সময় তিনি দায়বদ্ধ থাকতেন ছবির মূল বিষয়বস্তুর প্রতি, ফিল্ম মাধ্যমটির প্রতি এবং যে সময়ে তিনি ছবি করছেন, সেই সময়ের প্রতি। ফলে ষাটের দশকের মাঝামাঝি বা শেষ থেকে সারা সত্তর দশকের উত্তাল কলকাতা কিংবা তার সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা অনবরত উঠে আসত তাঁর ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর পর প্রায় প্রতি ছবিতেই। ‘আকাশকুসুম’, ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘পদাতিক’, ‘কোরাস’-এর মতো সাদাকালো ছবিতে বাঙালি মধ্যবিত্তের অসার স্বপ্ন বা স্বপ্নভঙ্গের কাহিনি বুনে দিতেন তিনি। বাঙালি মধ্যবিত্তের দ্বন্দ্বে আকীর্ণ, রুক্ষ, স্ববিরোধী আর অসুন্দর জীবন যেমন ঠাঁই পেত তাঁর ছবিতে, তেমনই নকশাল আন্দোলন থেকে জরুরি অবস্থা অবধি বামপন্থী আন্দোলনের শক্তি ও দুর্বলতার ইতিহাসও ধরা পড়ত তাঁর এই সব ছবিতে। ধরা পড়ত অসম্ভব দারিদ্র আর ভয়ঙ্কর শোষণ। পুলিশ-প্রশাসন-সরকারের সশস্ত্র সন্ত্রাস। গণতন্ত্রের বকলমে রাষ্ট্র বা আইন-আদালতে শাসন নিয়ে প্রায়ই সপ্রশ্ন হয়ে উঠতেন তিনি, সেই সময়কার প্রায় প্রতিটি ছবিতেই। সে দিক থেকে দেখলে মৃণাল সেনকে রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকার বললে মোটেও বাড়িয়ে বলা হবে না।
                           
এই রাজনৈতিক সচেতনতার পিছনে ছিল তাঁর ফরিদপুরের জীবন। বাবা ছিলেন পেশায় উকিল, চরমপন্থী কংগ্রেসি, বিপিনচন্দ্র পালের ঘনিষ্ঠ। মৃণাল সেনের জন্ম যে বছর, সেই ১৯২৩-এর রায়ত সম্মেলনের বক্তৃতায় বাবা ১৯১৭-র বলশেভিক বিপ্লবের সশ্রদ্ধ উল্লেখ করেছিলেন। বড় হয়ে জানতে পেরে সে-কথা আজীবন স্মৃতিধার্য করে রেখেছিলেন মৃণাল সেন। বিপ্লবীদের ফাঁসির হুকুম হলে বাবা তাঁদের হয়ে কেস লড়তেন। এক বার গাঁধীজিকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে সারা দেশে হরতাল। বাবা আদালতে তো গেলেনই না, জেলাশাসক কৈফিয়ত চাইলে স্পষ্ট বলে দিলেন কারণটা। সে জন্যে শাস্তি পেতে হয়েছিল তাঁকে। এ সব দেখতে দেখতেই বড় হয়েছেন মৃণাল সেন।

দেখেছেন, সুভাষচন্দ্র বসু আর বিপিনচন্দ্র পালের কী রকম স্নেহধন্য ছিলেন তাঁর মা। ব্রিটিশ-বিরোধী জনসভায় উদ্বোধনী গান গাইতেন মা। এ সব অভিজ্ঞতার কথা বহু বার বলেছেন তিনি: ‘‘তখন দেখেছি কত অসংখ্য লোক আসতেন আমাদের বাড়িতে। আসতেন সে-সব লোক, যাঁরা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, যাঁদের পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে।... ফলে আমাদের বাড়িতে ক্ষণে ক্ষণে পুলিশের তল্লাশি চলতে লাগল। কী করে মানুষ পালিয়ে বেড়ায় এটা আমি খুব ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি। মানুষ ভয় পেয়ে পালায়, এক জন মানুষ অনেক মানুষের জন্যেই পালায়। ছোটবেলা থেকেই আমি পুলিশ চিনেছি।’’

নিজের নানান ছবিতে এই সব স্মৃতিকে পুনর্নির্মাণ করেছেন মৃণাল সেন। ধরাবাঁধা ছাঁচে আঁটা জীবনের গল্প বলতে চাননি বলেই বোধহয় কখনও ‘ট্র্যাডিশনালিস্ট’ হননি। নতুন কথা কিংবা নতুন বিষয় বিধৃত করার জন্যেই ফিল্মের ফর্ম বা টেকনিক নিয়ে অবিরত ভাঙচুর চালিয়ে গিয়েছেন। তাই কেতাবি কায়দায় ক্যামেরা চালানোটা কখনওই তাঁর ফিল্মের ধরন হয়ে ওঠেনি। অনেক সময় ক্যামেরার ফ্রেম স্লিপ করেছে। ফ্রেমলাইন ক্যামেরার মাঝখানে চলে এসেছে। পুলিশের লাঠি চালানো বা বিভিন্ন মারামারির শট তুলতে গিয়ে এটা ঘটেছে। পরে ওগুলোকে ও-ভাবেই রেখে দিয়েছেন। এ রকম উদাহরণ ছড়ানো আছে তাঁর ‘কলকাতা ৭১’, ‘পদাতিক’, ‘ইন্টারভিউ’-তে। এ ভাবেই তিনি চিত্রায়িত করতেন অসুন্দরকে। জীবনের মসৃণতার অভাব দেখানোর জন্যে সৃষ্টি করতেন টেকনিক্যাল জৌলুসের অভাব। খুব ভাল ভাবে মাধ্যমটাকে জানলে তবেই এটা করা সম্ভব।

ফর্মের এই ভাঙচুর নিয়ে মৃণাল সেনকে ঘিরে আলোচনা হয়েছে বিস্তর, তর্কাতর্কিও কম নয়। যেমন ‘ভুবন সোম’। ১৯৬৯-এ তৈরি এ শুধু মৃণাল সেনেরই প্রথম হিন্দি ছবি নয়, হিন্দি ছবির জগতেও প্রথম তরঙ্গ; আরও স্পষ্ট ভাবে বললে ‘নবতরঙ্গ’। ‘ভুবন সোম’ হিন্দি ছবির ভাবনার জগৎটাকে কিংবা বানানোর রীতিকে উল্টেপাল্টে দিয়েছিল একেবারে। বাণিজ্যিক সিনেমার লোকজন বরাবর বলে এসেছেন, ফিল্ম আদতে খুব ব্যয়বহুল মাধ্যম, মৃণাল সেনের কাছে সেটাই ছিল চ্যালেঞ্জ, কত কম খরচে, কত ভাল ছবি করা যায়। সেটাই করে দেখালেন ‘ভুবন সোম’-এ। মাত্র দেড় ঘণ্টার এই ছবিটি সরকারি ফিল্ম সংস্থা এফএফসি (আজকের এনএফডিসি)-র ইতিহাস বদলে দিয়েছিল। ছবির তুমুল জনপ্রিয়তা সাহস জুগিয়েছিল সংস্থাটিকে, পরে নতুন ধারার ছবিতে অর্থ বিনিয়োগের।
                          
আশি থেকে নব্বইয়ের গোড়া পর্যন্ত যে ধরনের ছবি তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন মৃণাল সেন, সেখানে মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবন যেন আরও বেআব্রু। আত্মরক্ষার আর কোনও অস্ত্র রইল না, প্রায় প্রতিটি ছবির চরিত্রদের তিনি চুল ধরে টেনে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন আয়নার সামনে। ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘আকালের সন্ধানে’, ‘খারিজ’, ‘খণ্ডহর’, ‘জেনেসিস’ বা ‘মহাপৃথিবী’ এ ধরনের ছবিতে আত্মসমালোচনা আর নিজেকে প্রশ্ন করা শুরু করলেন তিনি। কতটা বাস্তবনিষ্ঠ হতে পারছেন বা হওয়ার চেষ্টা করছেন শিল্পকর্মীরা, কিংবা বাস্তবের ধাপ বেয়ে চলতে চলতে কোনও ইচ্ছাপূরণের মোহে আটকে পড়ছেন না তো তাঁরা, এ সব প্রশ্নেরই যেন উত্তর পাওয়ার একটা দুর্মর চেষ্টা ছবিগুলিতে।

‘মহাপৃথিবী’-র পর নিয়মিত ছবি করা ছেড়ে দিয়েছিলেন। দীর্ঘ দশ বছরের ব্যবধানে যে-দু’টি ছবি করেছিলেন ‘অন্তরীণ’ আর ‘আমার ভুবন’, সে-দু’টি শিল্পমানের দিক থেকে গুরুত্বের। যখন নানা ভারতীয় ভাষায় অন্তত গোটা আটেক ছবি করেছেন, ওড়িয়া-য় ‘মাটির মনিষ’, তেলুগুতে ‘ওকা উরি কথা’ কিংবা হিন্দিতে ‘ভুবন সোম’, ‘এক আধুরি কহানি’, ‘মৃগয়া’, ‘খণ্ডহর’, ‘জেনেসিস’, ‘একদিন অচানক’, তখন অবিরত ভারতীয়তা বা আন্তর্জাতিকতার কথা বলে গিয়েছেন। বলেছেন, ‘‘আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেন যে, আপনি কেন এত বিভিন্ন ভাষায় ছবি করেন? আমি বলি, আমি দারিদ্র নিয়ে ছবি করি। আফ্রিকাতে গিয়ে সোয়াহিলি ভাষায় ছবি করতেও আমার কোনও অসুবিধে হবে না, যদি আমি ফিজিক্যাল পিকিউলিয়ারিটিগুলো ধরতে পারি, যেটা সব সময় সারফেস-এ থাকে।’’ 

টেলিফিল্ম, শর্টফিল্ম এবং ডকুমেন্টারি বাদ দিলে তাঁর পূর্ণদৈর্ঘ্যের ফিচার ফিল্মের সংখ্যা সাতাশ। বিদেশে, বিশেষ করে রাশিয়া ও ফ্রান্সে যেমন সম্মানিত, তেমনই রাজ্যসভার সাংসদ হয়েছেন, পেয়েছেন পদ্মভূষণ, অর্জন করেছেন ভারতীয় সিনেমার সর্বোচ্চ উপাধি ‘দাদাসাহেব ফালকে’।
                           
ঋত্বিক ঘটক - সত্যজিৎ রায় - মৃণাল সেন .. বলা চলে বাংলা চলচ্চিত্রের ব্রহ্মা - বিষ্ণু - মহেশ্বর। একই বৃত্তে কর্মরত ছিলেন তিনজন। ছিল আলোচনা ও সমালোচনা। ছিল বৈরিতা। তা সত্বেও ছিল বন্ধুত্ব।

মৃণাল সেন থেকে দুই বছরের বড় ছিলেন শ্রী সত্যজিৎ রায় (১৯২১ - ১৯৯২), আর ঋত্বিক ঘটক (১৯২৫ - ১৯৭৬) ছিলেন আড়াই বছরের ছোট। একজনকে সম্মান করতেন, অন্যজন ছিলেন বন্ধু। কিন্তু দুজনের সঙ্গেই ছিলো সম্পর্ক। চলচ্চিত্রের সূত্রে। দুজনের সঙ্গেই চলতো বাহাস। ছবি নিয়ে। ছবির ভাষা নিয়ে। তবে ঋত্বিক বন্ধু বলে ওর সঙ্গে ঝগড়াঝাটিও হতো। আরো হতো রাজনৈতিক আলাপ। পরিকল্পনা হতো কি করে তারা লুকিয়ে কাকদ্বীপে চলে যাবেন; তারপর সেখানে পুলিশের নজর এড়িয়ে, গেরিলা কায়দায় ১৬ মিলিমিটারে চলচ্চিত্র বানাবেন। এরপর তারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে সেই ছবি দেখাবেন। সত্যজিতের সঙ্গে অবশ্য সেসব আলাপ জমতো না। সত্যজিৎ এমনিতেই ছিলেন রাজনীতি থেকে দূরে থাকা মানুষ।

মৃণাল সেন (১৯২৩-২০১৮) দুজনের কাজেরই প্রশংসা করেছেন, সমালোচনাও করেছেন। রাজনীতি ও চলচ্চিত্রের অঙ্গীকারের প্রতি অবিচল ছিলেন বলেই ঋত্বিকের প্রতি পক্ষপাত যেন একটু বেশিই মৃণালের। অপর দিকে সত্যজিতের সেই অর্থে কোন অঙ্গীকার ছিলো না। ঘটকের মতো  সিনেমা ও বিপ্লবকে হাত ধরাধরি করে চলতে দেখেননি রায়। তিনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করার চাইতে নতুন নতুন কাহিনী বুনতেই বেশি ভালোবাসতেন। তারপরও কি রাজনীতির বাইরে থাকা যায়? ‘হীরক রাজার দেশে’ তো প্রচণ্ডভাবে রাজনৈতিক ছবি।

আবার ছবিতে যে অবধারিতভাবে রাজনীতি সরাসরি থাকতেই হবে বিষয়টি তেমনও নয়। সমকালীনতাকে ধারণ করলেও অনেক ছবি কালকে অতিক্রম করতে পারে। আর একারণেই ‘পথের পাঁচালী’কে যতোটা না, তার চেয়েও বেশি প্রশংসা মৃণাল করেছেন সত্যজিতের ‘অপরাজিত’ ছবিটির। দ্বিতীয় ছবি হলেও এটিকেই সত্যজিতের প্রথম দিককার শ্রেষ্ঠ ছবি বলে মনে করেন মৃণাল: 

‘আমার মনে হয় যে ছবিটি সব চাইতে জীবন্ত, সব চাইতে জটিল, সব চাইতে সমকালীন সত্যজিৎ রায়ের অন্যান্য ছবির তুলনায়, তা স্বাভাবিক কারণেই ‘অপরাজিত’। ছবিটি তৈরি হয় ১৯৫৬ সালে— সমকালীনতায় সমৃদ্ধ।’

মৃণাল সেনের ‘আকাশ কুসুম’ ছায়াছবি নিয়ে সত্যজিৎ রায় চাছাঁছোলা মন্তব্য করেন। যার জবাবে ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় চিঠি পাল্টা-চিঠিতে শুরু হয় দু’জনের জীবনব্যাপী এক দীর্ঘ দ্বৈরথ।

ফরাসি চিত্রনির্মাতা ফ্রাঁসোয়া ট্রুফোর দ্বারা প্রভাবিত মৃণাল সেন ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে ‘আকাশ কুসুম’ ছায়াছবিটি বানাতে শুরু করেন। অভিনয়ে ছিলেন সৌমিত্র চ্যাটার্জি ও অপর্ণা সেন। প্রকাশের পর এই ছবির ভাষাভঙ্গি নিয়ে চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের মাঝে সাড়া পড়ে যায়। তাঁর আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে এই ছবির সমালোচকদের একজন ছিলেন সত্যজিৎ রায়।

মৃণাল সেন সে’সময় আশীষ বর্মণের একটা গল্প নিয়ে ছবি বানাচ্ছিলেন। ‘আকাশ কুসুম’ নামের এই ছবির গল্পটা এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির যুবককে নিয়ে, যে যেনতেন উপায়ে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতো। মৃণাল চিত্রনাট্যে গল্পের ভেতর কিছু কিছু জায়গা বদলে দেন। ফলে গল্পের নায়ক অজয়ের চরিত্র হয়ে ওঠে স্বপ্নালু ও ভাবুক, যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধ বাস্তবতার ভেতরে বসেও আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখতো, যার প্রবল বিশ্বাস ছিল যে শুধু স্বপ্নের জোরেই সে একদিন বিরাট ধনী হতে পারবে। শেষ পর্যন্ত সে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়, এবং তার যা সহায়সম্পদ ছিল সেটাও খুইয়ে বসে।

কেন যেন অজয়ের চরিত্রটাকে চলচ্চিত্রের সমালোচকেরা ভালোভাবে নিতে পারলেন না। মৃণাল বেশ উদ্বিগ্নই হলেন। শেষতক ২৫ জুলাই একটা বিজ্ঞাপনেও একটি বাক্য জুড়ে দিলেন, “অজয় কোন ধোঁকাবাজ নয়, সে উচ্চাকাঙ্খী”। এর কিছুদিন আগে ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা ‘স্টেটসম্যান’-এ ছবিটার একটি সমালোচনা ছাপা হয়েছিল। তার প্রতিক্রিয়ায় সেই ২৫ জুলাইয়ে সম্পাদকের কাছে চিঠির পাতায় চিঠি লিখে পাঠালেন পাঠকেরা। প্রতিক্রিয়ার কারণ হলো স্টেটসম্যানের সমালোচক তার লেখায় বলেছিলেন যে এই ছায়াছবির সমাপ্তিটা ডন কিহোতের সমাপ্তির মতো – হাস্যরসে মেশানো করুণ। যে কারণে দর্শকেরা ছবি শেষ করে নায়কের পরিণতিতে সমব্যথী হবে। এর জবাবে গল্পকার আশীষ বর্মণ বলেছিলেন যে গল্পটা মোটেও এভাবে শেষ হয়নি। কারণ ওভাবে শেষ করলে তা শুধু ভুলই হতো না, দর্শকদের কাছেও সেটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হতো না। বর্মণের মতে, ‘সমসাময়িক’ সময়ের একটি গল্পে এমন শৈল্পিক ধোঁয়াশা রেখে দেয়া প্রায় অসম্ভব।       
                              
এই পর্যায়ে সত্যজিৎ ঘটনায় জড়িয়ে গেলেন। যদিও প্রতিক্রিয়া লেখার আগে সত্যজিৎ মৃণালকে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন যে তার সমালোচনার লক্ষ্য আশীষ, এবং তার লেখা পড়ে মৃণাল যেন আহত না হয়। কিন্তু তার লেখা প্রকাশ পেলে দেখা গেল যে তিনি পুরো ছবিটার ভিত্তিমূল নিয়েই প্রশ্ন করছেন। এই ছবির সমসাময়িকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন। যা পড়ে মৃণালও ভাবলেন জবাবটা তার দেয়া দরকার। সত্যজিৎ’র লেখার জবাবে একদিকে আশীষ লিখলেন যে, ‘কোন গল্পে মৌলিক মানবিক তাড়না, যেমন প্রেম, ঈর্ষা, ক্ষুধা, আশা কিংবা ভালো জীবনের আকাঙ্ক্ষার কথা বললেই তা সমসাময়িকতা হারায় না’। অন্যদিকে মৃণাল সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে উত্তর দিতে গিয়ে তুলে আনলেন চ্যাপলিনকে। আশীষ বর্মণ আর মৃণাল সেনের জবাবে বারবার সমসাময়িকতার বরাত দেয়াতে সত্যজিৎ বেশ ক্ষিপ্ত হলেন। এর পরের জবাব হলো আরো খাপখোলা তলোয়ারের মতো, কোনোরূপ চটুল রসিকতার আড়াল ছাড়াই, “এই ছবির নায়কের আচরণ আর তার পরিণতির কোন সমসাময়িকতার উপরে পুরো গল্পটা দাঁড়িয়ে আছে তা বোঝা আমার সাধ্যের বাইরে। ‘আকাশ কুসুম’-এর যদি কোন সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতা থেকে থাকে, তা শুধুই উপরে উপরে, কিছু ছড়ানো-ছিটানো শহুরে জীবনের বর্ণনা আর ফ্যাশনদুরস্ত বয়ানে। কিন্তু এই গল্পের থিমের সমসাময়িকতা কোথায়? সে ব্যাপারে ছবির নির্মাতাদের বক্তব্য কী?”

পাঠকদের চিঠি আসতে থাকলো। তার বেশিরভাগই সত্যজিৎ’র এমন রূঢ় লেখাকে ভালোভাবে নিলো না। কারো কারো কাছে মনে হলো সত্যজিৎ ‘গোঁড়া এবং অসহিষ্ণু’, কারো চোখে মনে হলো তার লেখায় ‘তলে তলে ছিদ্রান্বেষী মনোভাব সুস্পষ্ট’। এর মধ্যে মৃণালও আবার জবাব দিলেন, তবে তাঁর জবাব সচেতনভাবেই চ্যাপলিন সংক্রান্ত বিষয়ে সীমাবদ্ধ, আকাশ কুসুম নিয়ে তিনি কিছুই বললেন না।

এতসব চিঠি পড়ে রায়সাহেবের মেজাজ ঠাণ্ডা থাকার কথা না। এবার তিনি লিখলেন এক ঝাঁঝালো ব্ল্যাক হিউমার মেশানো সার-সংক্ষেপ, প্যারোডির ঢঙে এক গল্প লিখলেন, যার প্রত্যেক লাইনে জোর করে “সমসাময়িক” শব্দটা ঢুকিয়ে দিলেন। যেমন, নায়ক থাকে এক কুঁড়েঘরে, কিন্তু তার দেহের গড়ন সমসাময়িক সুনজর পেয়ে বেশ দশাসই। এই লেখাটা শেষ হলো তার বিখ্যাত সেই উক্তি দিয়ে, ‘A crow-film is a crow-film is a crow-film’।
                          
কথার লড়াই ততোদিনে মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে অনেকটাই ব্যক্তিগত যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। তাই কদর্যতায় রূপ নেয়ার আগে ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় উদ্যোগী হলো তর্ক-যুদ্ধ অবসানের। তাঁরা মৃণাল এবং আশীষের কাছে একটি শেষ জবাব দেয়ার অনুরোধ করলো। মৃণাল সত্যজিৎকে আক্রমণও করলেন না, তার ছায়াছবির হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনও করলেন না। তিনি সত্যজিৎ’র শেষ গল্পের জবাবে বললেন যে চাইলে হ্যামলেটকেও সংক্ষেপে রাজবাড়ির এক খুন আর ভূত-রহস্য-প্রেম-প্রতারণা-অজাচারের গল্প বলে চালিয়ে দেয়া যায়, যে গল্পের শেষে নায়িকা উন্মাদ হয়ে আত্মহত্যা করে, আর বেশ কয়েকটি খুন ঘটার পর নায়কও আত্মহত্যা করে।

কেন যে সত্যজিৎ অমন আক্রমণাত্মক লেখাটি লিখেছিলেন তা আজও রহস্য। আকাশ কুসুমের থিমের ব্যাপারে তার অ্যালার্জির কারণও বুঝতে বেজায় কষ্ট হয়। কারণ প্রায় কাছাকাছি থিমের একটি ছবি তিনি নিজেও এর সাত বছর আগে বানিয়েছিলেন। তার ‘পরশ পাথর’ ছায়াছবিতে এমনই এক গরীব কেরানি জাদুর পাথরের বদৌলতে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যায়। সে পাথর লোহাকে সোনায় পরিণত করতো, যার সুবাদে সেই কেরানির জীবনেও আমূল পরিবর্তন এসেছিল।

কারণ যাই হোক না কেন, আকাশ কুসুমকে ঘিরে ঘটে যাওয়া এই তর্ক-যুদ্ধে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল। সত্যজিৎ রায় প্রকাশ্যে মৃণাল সেনের সাথে বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন। ‘পথের পাঁচালী’র সময় থেকেই তিনি বাংলা সিনেমা জগতের অবিসংবাদিত নায়ক। সেই জগতে মৃণাল যে তাঁরই মতন প্রাসঙ্গিক আর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন এটা তিনি নির্ঘাত বুঝতে পেরেছিলেন।
                               
সে বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর দ্য স্টেটসম্যান আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আকাশ কুসুম’ ছায়াছবি নিয়ে তর্কের সমাপ্তি ঘোষণা করে জানায় যে এই বিষয়ের ওপর আর কোনো চিঠি তাঁরা ছাপাবে না। সেদিন সন্ধ্যায় ফিল্ম সোসাইটির একটা প্রদর্শনী ছিল। সেই মিলনায়তনে সত্যজিৎ আর মৃণালের দেখা হলো। সত্যজিৎ হাসতে হাসতেই বললেন, ‘কেমন হুট করে তর্কটা থামিয়ে দিলো! আপনি লেখা বন্ধ করলেন কেন? আমি তো আরো অনেকগুলো চিঠি লিখতে পারতাম!’

‘আমার তো আপনার মতো ভক্তকূলও নেই, লোকবলও নেই’, মৃণাল জবাব দিলেন, ‘তবে একাই আপনার সব চিঠির জবাব দিতে পারতাম!’

এই কথা-পাল্টা-কথাই এই দু’জনের পরবর্তী জীবনের প্রতীক হয়ে দাঁড়ালো। হাসি-ঠাট্টার সৌজন্যমূলক আবরণের আড়ালে তাঁরা পরষ্পর দূরে দূরেই থাকলেন। কেউ কাউকে চিনলেন না। সদা-সতর্ক, সদা-উদ্যত। ঘনিষ্ঠ বন্ধুমহলের আড্ডাতেও তারা একে অপরের কাজ নিয়ে কথা বলতে চাইতেন না।

কলকাতার সিনেমাবোদ্ধাদের অনেকে প্রায়ই বলেন যে সত্যজিৎ আর মৃণালের মধ্যে মিল শুধু দৈহিক উচ্চতায় আর গায়ের রঙে। সংবেদনশীল শিল্পী হিসেবে দু’জনেই চারপাশের ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা আর হালচালে প্রভাবিত হতেন। যদিও তাঁদের প্রকাশভঙ্গি আর শিল্প ছিল সম্পূর্ণ আলাদা, যেমন পুনশ্চ আর মহানগর। তাঁদের দীর্ঘ চলচ্চিত্র নির্মাতা জীবনে এমন অনেকবারই ঘটেছে। আধুনিক তারুণ্যের সমস্যা নিয়ে তাঁরা দু’জন বানিয়েছেন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ আর ‘ইন্টারভিউ’; ১৯৪৩ এর মন্বন্তর নিয়ে বানিয়েছেন ‘বাইশে শ্রাবণ’ আর ‘অশনি সঙ্কেত’; আর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিবাদ হিসেবে বানিয়েছেন ‘কোরাস’ আর ‘হীরক রাজার দেশে’।

আশির দশকে যেন নিজেরাই বোঝাপড়ার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান বদলে ফেললেন দু’জনেই। সঙ্গীতময়, সূক্ষ্ণ আর নিয়ন্ত্রিত সত্যজিৎ ক্রমশ হয়ে উঠলেন উচ্চকিত ও দৃঢ়ভাষী। নিজের দর্শনকে প্রকাশ করার জন্য তিনি তার ছবির ভাষাকেও আগাগোড়া বদলে দিলেন। অন্যদিকে মৃণাল, যিনি বরাবরই ছিলেন কসরতবাজ আর চড়াসুরের বক্তা, তিনি হয়ে উঠলেন অন্তর্মুখী আর শান্ত।
                             
বর্তমান প্রজন্মের বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে এককালে এই দু’জন অসম্ভব অন্যরকম শিল্পী পরষ্পরের খুব ভাল বন্ধু ছিলেন। মৃণাল সেনের চ্যাপলিনের ওপর লেখা বইয়ের প্রচ্ছদ করে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ। সত্যজিৎ’র লেক টেম্পল রোডের বাসায় মৃণালের নিত্য আসা-যাওয়া ছিল। সেখানে তাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিনেমা নিয়ে আলাপ করতেন। ‘অপরাজিত’ দেখে মৃণাল মুগ্ধ হয়েছিলেন, তাঁর কাছে এটাই সত্যজিৎ’র সেরা ছবি। কিন্তু কেন জানি ‘পরশ পাথর’ অতোটা পছন্দ করেননি, সত্যজিৎকে বলেওছিলেন সে’ কথা। ‘বাইশে শ্রাবণ’ দেখে সত্যজিৎ’র তেমন আহামরি কিছু মনে হয়নি। পরে অবশ্য তিনি এই মত পরিবর্তন করেছিলেন, এবং ১৯৬৫ সালের ২য় ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের জুরি থাকাকালীন সময়ে এই ছবিটার একটি বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন তার বন্ধুদের জন্য।

এমন চমৎকার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের পর ‘আকাশ কুসুম’ নিয়ে সত্যজিৎ’র লেখা চিঠিতে মৃণাল যারপরনাই আহত বোধ করেছিলেন। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেননি। আগের উষ্ণতা না থাকলেও মৃণাল বরাবরই সামাজিক সৌজন্য বজায় রেখেছিলেন। তাই তাঁর পরের ছবি ‘মাটির মণীষা’ দেখতে সত্যজিতকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ছবি দেখে সত্যজিৎ-ও বলেছিলেন যে তাঁর ভাল লেগেছে। প্রায় দশ বছর পর মৃণালের ‘ওকা উরি কাথা’ দেখেও তিনি একইভাবে প্রশংসা করেছিলেন।            

মৃণালও তাঁর ছবি ‘ভুবন সোম’-এর একটি দৃশ্যে বাংলার গৌরব নিয়ে বলার সময় পর্দায় সত্যজিৎ’র আলোকচিত্র দেখিয়েছিলেন। কিন্তু এই ছবিটা আবার সত্যজিৎ’র ভাল লাগেনি। তাঁর লিখিত বই “Our Films, Their Films”-এ সত্যজিৎ এই বিষয়ে লিখেছেন, “ভুবন সোম উৎরে গেছে কারণ মৃণাল এখনকার সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় কিছু কৌশল ব্যবহার করেছেন, যা এই ছবির ভাষার খচখচে জায়গাগুলোকে কিছুটা নরম করে দেয়। এসব কৌশলগুলো হলোঃ সুন্দরী নায়িকা, সুমধুর আবহসঙ্গীত, আর একটি সাধারণ, মন-ভালো-করে দেয়া চিত্রনাট্য ইত্যাদি। সাত শব্দে সারাংশ করলে দাঁড়ায়ঃ “Big Bad Bureaucrat Reformed by Rustic Belle”।
                           
সত্যজিৎ রায়ের বইটা প্রকাশ হবার পর কলকাতার একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা মৃণাল সেনের কাছে পাঠ প্রতিক্রিয়া লেখার অনুরোধ করে। প্রথমে কিছুটা টালবাহানার পর মৃণাল লিখতে রাজি হন। ভুবন সোম বিষয়ে সত্যজিতের সমালোচনা নিয়ে তিনি লিখেছেন, “সমালোচকেরা অনুকূল মন্তব্য করেছেন, দর্শক ছবিটা পছন্দ করেছেন, আর উভয়েই ছবিটাকে ব্যতিক্রমী মনে করেছেন। স্বভাবতই আমরা খুশি। যা হোক, অনেকে বলে এর সতেজ আমেজের কারণে ভুবন সোমকে সবাই গ্রহণ করেছে। এটুকুই যথেষ্ট।”

সত্যজিতের সাত শব্দের সারাংশ একটু পাল্টে মৃণাল তাঁর ছবিকে বললেন, “Big Bad Bureaucrat Chastised by a Charmer’s Cheek”। তাঁর এই লেখাটার শিরোনাম ছিল “His Book, My Comments”।

সত্যজিৎ’র জীবনের শেষ দশকে তাঁরা দুইজন বেশ কয়েকটি কমিটিতে একসাথে কাজ করেছেন। বিভিন্ন ফিল্ম সেমিনার ও অন্যান্য প্ল্যাটফর্মেও তাদের কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু তাঁদের এই শীতল ও আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের খুব বেশি উন্নতি হয়নি।

শেষদিকে আরো একবার সত্যজিৎ মৃণালের দিকে আক্রমণের তীর ছুঁড়েছিলেন। যদিও অনেকে বলেন তিনি এটা প্রকাশ্যে করতে চাননি। তাঁর পুরনো বন্ধু ও বিখ্যাত চিত্রসমালোচক চিদানন্দ দাসগুপ্তকে লেখা তাঁর এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন যে তথাকথিত ‘আর্ট ফিল্মের’ নির্মাতারা নিজ দেশে দর্শকদের সাথে মেলবন্ধনের চেয়ে বিদেশি ফেস্টিভ্যালে যাওয়ার ব্যাপারে বেশি উৎসাহী। ‘তাঁরা কেউই গল্প বলার কৌশল জানে না, মৃণালও জানে না’, এই ছিল তাঁর বক্তব্য।
                              
১৯৯১ সালের জুনে বন্ধুকে লেখা এই ব্যক্তিগত চিঠিটি অক্টোবর মাসে একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়ে যায় সত্যজিৎ’র অনুমতি ছাড়াই। ততোদিনে সত্যজিৎ খুবই অসুস্থ এবং বোঝা যাচ্ছিল যে তিনি মৃত্যুর দিন গুনছেন। মৃণাল স্বভাবতই এই আকস্মিক আঘাতে বিচলিত হয়েছিলেন। তবে তিনি তা প্রকাশ করেননি। অনেকের প্রণোদনা থাকার পরেও পত্রিকাকে একটি অসম্ভব স্থিতধী মন্তব্য জানিয়েছিলেন।

“আমি নন্দনতত্ত্ব আর গল্প বলার শৈল্পিক দিক নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের সাথে কোন তর্কে জড়াতে চাই না। তাঁর অসুস্থতায় ওষুধের পাশাপাশি মানসিক শান্তিও প্রয়োজন, এবং আমি তা কোনোভাবেই নষ্ট করতে চাই না।”

সত্যজিৎ রায়ের জবাব জানার আর কোন উপায় ছিল না। কারণ এই বিতর্কিত চিঠিটি প্রকাশের মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

সত্যজিৎ রায়ের অসুস্থতার পুরো সময়টায় সেন পরিবারের সবাই তাঁর পরিবারের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও সহযোগিতা বজায় রেখেছিলেন। তার মৃত্যুর খবর পেয়ে নার্সিং হোমে সবার আগে তারাই পৌঁছেছিলেন। শেষকৃত্য শেষ হওয়া পর্যন্ত মৃণাল সেনকে দেখাচ্ছিল উদ্ভ্রান্ত, শূন্য দৃষ্টিতে তিনি হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন। প্রায় দুই দশক আগে তিনি সত্যজিতকে তার একাকীত্ব নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন। সেই একই একাকীত্ব যেন তাকে গ্রাস করেছে। সেই ক্লান্ত গ্রীষ্মের এপ্রিলের বিকেলে সত্যজিৎ’র মরদেহের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। একটু পরেই এই দীর্ঘাঙ্গী সত্যজিৎ’র শেষ চিহ্নটিও চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। মৃণালের উপলব্ধি হলো যে এতদিন তাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উৎসাহে, উদ্যমে, ক্ষেপিয়ে সৃজন-উৎকর্ষের সুউচ্চ চূড়াটিতে তুলে দেয়া মানুষটি আর রইলো না।
                         
দুজনের মধ্যে এমন অম্ল সম্পর্ক যেমন ছিল, মুদ্রার উল্টো পিঠের মত, মধুর সম্পর্কও ছিল। সত্যজিতের Our Films, Their Films বইটির সমালোচনা লিখেছেন মৃণাল ‘সানডে’ সাপ্তাহিকে। আবার মৃণালের লেখা ‘চার্লি চ্যাপলিন’ বইটির প্রচ্ছদ করে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ। একটা সুস্থ তর্ক-বিতর্কের সম্পর্ক ছিল তাঁদের মধ্যে। মৃত্যুর আগে ও পরে তাই মৃণাল বরাবরই কাজের সমালোচনার পাশাপাশি শ্রদ্ধা দেখিয়ে এসেছেন সত্যজিতের প্রতি।

সত্যজিৎ শেষের কয়েকটি বছর খুব একটা আউটডোর শুটিং করেননি। অসুস্থ ছিলেন। তাই ইনডোরেই বেশিরভাগ শুট করেছেন। ১৯৮৯ সালে ইবসেনের কাহিনী নিয়ে ‘গণশত্রু’, ১৯৯০ সালে নিজের কাহিনী নিয়ে ‘শাখা প্রশাখা’ ও ১৯৯১ সালে নিজের লেখা গল্প থেকে ‘আগন্তুক’ এই তিনটি ছবিই ছিলো সত্যজিতের শেষ তিন ছবি। এসব ছবি তৈরির সময় স্টুডিওর বাইরে এম্বুলেন্স মজুদ থাকতো। কারণ এর আগে তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। পরপর দুটো অ্যাটাক। আমেরিকাতে বাইপাস সার্জারি হয়। সেই ধকল কিছুটা কাটিয়ে ওঠার পর ছবিগুলো নির্মাণ করেন। কাজ করার ইচ্ছা শক্তিই তাঁকে দিয়ে আরো তিনটি ছবি করিয়ে নেয়। তো ৯১ সালে মৃণাল এক ফাঁকে নিভৃতে সত্যজিৎকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘মাঝে মাঝে একা লাগে না?’ সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘ভয়ংকর একা লাগে। ভীষণভাবে একা লাগে।’

এই আলাপের এক বছর পর, ১৯৯২ সালে মারা যান সত্যজিৎ। মৃণাল তখন স্মরণ করছেন ১৯৮৩ সালের একটি ঘটনা। সে বছর প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয় সত্যজিতের। অ্যাটাকের দুঘন্টা আগে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ বলেছিলেন,

‘কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত আছি, মৃত্যু নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই।’

মৃণাল বলছেন,

‘অকপট, অদ্ভুত সাহসী একজন মানুষ!’

শ্রদ্ধার্ঘ্যে সত্যজিৎ সম্পর্কে মৃণাল বলছেন, 

‘... যা ঘটে থাকে মহৎ শিল্পীর দীর্ঘকালীন কর্মকাণ্ডের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে— প্রশস্তি এবং তারই পাশাপাশি কখনও সখনও কিছু প্রশ্ন, কিছু বা সংশয়, কিছু বিতর্ক। তারই মধ্যে সোজা দাঁড়িয়ে তিনি নিজের মতো করেই চলতে থাকলেন, চলতে চলতে আবার হঠাৎ, কিছু দিনের জন্য থেমে পড়লেন। শারীরিক কারণেই থামতে হল। আবার চললেন, বললেন, বুঝলেন কাজ, শুধু কাজই তাঁর শরীর ও মনকে তাজা রাখে, তাঁকে চালিয়ে নেয়। এভাবেই চলছিল, অসুস্থতাও বাড়ছিল, তারপর শেষের সেদিন এসে পড়ল অনিবার্যভাবে।’
                          
মহৎ শিল্পীর ক্ষেত্রে প্রশস্তির পাশাপাশি প্রশ্ন থাকা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় ঋত্বিক ঘটকের নাম। বিভূতিভূষণের উপন্যাস থেকে সত্যজিতের করা চলচ্চিত্রত্রয়ী নিয়ে প্রশ্ন ছিলো ঋত্বিকেরও। ঋত্বিক নিজেও একজন মহৎ শিল্পী। তিনি চেয়েছিলেন সত্যজিতের অপু বিভূতিভূষণের ছক মেনে গ্রামেই ফিরে যাক, কিন্তু সত্যজিতের অপু গ্রামে ফিরে যায়নি, কলকাতামুখী হয়েছে। মৃণাল এখানে ঋত্বিকের সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, 

‘ঋত্বিক সম্ভবত সত্যজিতের নাগরিক মননটুকু তেমনভাবে ধরতে পারেননি, পারলে বোধ হয় মানিকবাবুর ছবিতে অপুর বদলটা মেনে নিতে পারতেন।’

এই জায়গায় ঋত্বিকের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, মৃণাল যদি ঋত্বিকের শেকড়ে ফিরে যাওয়ার মননটা ধরতে পারতেন, তাহলে হয় তো ওপরের বাক্যগুলো ভিন্নভাবে বলতেন।

বয়সে মৃণালের ছোট হলেও বন্ধু ছিলেন ঋত্বিক। যথেষ্ট সম্মান করতেন মৃণাল, ভালোও বাসতেন। কারণ তিনি জানতেন গণমানুষের কাছে গণমানুষের শিল্পকে পৌঁছে দিতে ঋত্বিক ছিলেন ‘দুঃসাহসী’ ও সবচেয়ে ‘বেপরোয়া’। সিনেমাকে বিপ্লবের সঙ্গে জড়িয়ে চলতে শিখেছিলেন ঋত্বিক। মৃণালও। বলছেন,

‘ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি অচঞ্চল বিশ্বাস রেখে সে দিন থেকেই আমরা অন্তঃস্বারশূণ্য দেশজ সিনেমাকে তীব্রভাবে ঘৃণা করতে শিখেছিলাম, নতুন একটা ফ্রন্ট গড়ার জন্য মুখিয়ে উঠেছিলাম প্যারাডাইস কাফের ভাঙা চেয়ার-টেবিলে ঠাসা ঐ ছোট্ট ঘরে, যে ফ্রন্টে বিপ্লব আর সিনেমা হাত ধরাধরি করে চলবে। এই প্রাণচঞ্চল আসরগুলোয় যার গলা সবচেয়ে উঁচু পর্দায় বাঁধা ছিল সে হল ঋত্বিক। ঋত্বিক ছিল আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেপরোয়া। কোন কিছুকেই তোয়াক্কা করত না ঋত্বিক, আগু পিছু ভাবার মতো ধৈর্য ছিল না।’

তারা ঠিক করলেন স্টুডিয়োর অস্বচ্ছল কর্মী ও কলাকুশলীদের নিয়ে একটি সক্রিয় ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলবেন। কর্মীদের বাড়ি বাড়ি যাওয়া, তাদের সাথে কলা বলা ও বোঝানো, রাজনৈতিক এই অভিযানেও ঋত্বিক ছিলেন প্রথম কাতারে। গণআন্দোলনের জোয়ারে পশ্চিমবঙ্গ যখন ফুসছে, তখনও ঋত্বিক ও মৃণালরা কিছু করার জন্য টগবগ করে ফুটছেন। জনতার সংগ্রামের পাশাপাশি তখন কৃষক-মজদুর-মধ্যবিত্তের লড়াই থামাতে মরিয়া শাসকগোষ্ঠী। কাকদ্বীপ এলাকায় গুলি চালিয়েছে পুলিশ। মারা যায় কৃষকরমণী গর্ভবতী অহল্যা। মৃণাল ও ঋত্বিকদেরই আরেক সহযোদ্ধা সলিল চৌধুরী তখন রচনা করেছিলেন কালজয়ী কবিতা ‘শপথ’। শপথ ঠিকই নিয়েছিলেন তাঁরা। ঠিক করেছিলেন পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে তাঁরা কাকদ্বীপে যাবেন। সেখানে গিয়ে ষোল মিলিমিটারে নির্বাক ছবি তুলবেন। এরপর কলকাতায় ফিরে ছবি ধোলাই ও সম্পাদনা করে গ্রামে গ্রামে সেই ছবি দেখাবেন, লুকিয়ে লুকিয়ে।
                          
চিত্রনাট্য লিখলেন মৃণাল। সলিল নাম দিলেন ‘জমির লড়াই’। আর ঋত্বিক জোগাড় করলেন একটি ভাঙা ক্যামেরা। শেষ পর্যন্ত কাকদ্বীপে যাওয়া হয়নি ঠিকই। জোগাড় করা ক্যামেরাটি চালানো শিখে নিয়েছিলেন ঋত্বিক। জানতেন এই ক্যামেরাই হবে তাঁর হাতিয়ার। সিনেমা ও বিপ্লবের সহচর ঋত্বিকের সঙ্গে প্রচুর ঝগড়াও করেছেন মৃণাল। বলছেন,

‘ঝগড়া করেছি, মতান্তর ঘটেছে, মনান্তর ভয়ংকর চেহারা নিয়েছে এক এক সময়ে, আবার সময় আর ঘটনার মধ্য দিয়ে মিশে গিয়েছি আগের মতোই, এক সঙ্গে চলেছি।’  

ঋত্বিকের প্রথম ছবি ‘নাগরিক’ দেখে খুশি হতে পারেননি মৃণাল। কিন্তু দ্বিতীয় ছবি ‘অযান্ত্রিক’ ভীষণ ভালো লাগে তাঁর, প্রতিক্রিয়ায় বলেন,

‘একটি অসাধারণ ছবি এবং ভীষণ ভাল ও মৌলিক ছবি। সম্ভবত তাঁর ছোট্ট জীবনে তুলনারহিত। এ-ছবির কাহিনী একটি ভাঙা মোটরগাড়ি এবং এ-মোটরগাড়ির সঙ্গে এক রাগী ড্রাইভারের ভালবাসা-যন্ত্রণার কাহিনী। সবকিছু বলা হয়েছে ভারী সুন্দরভাবে, নিটোলভাবে। এই গাড়িটিতে বসে কিছু যাত্রী যখন নিজের নিজের কাহিনী বলছে ঋত্বিকের ক্যামেরা এদের কথা, এদের মুখ অবয়ব ছুঁয়ে ছুঁয়ে অন্য আর-একটি গল্প বলে দেয়, যে গল্পে আদিবাসীদের পালাপার্বনের কথা বলা হয়। এরা সবাই খুব শক্তিশালী কিন্তু এদের ভেতরে একটা সহজাত বেপরোয়া মনোভাব কাজ করে। হয়তো ঋত্বিক নিজের ভেতর নিজেই লড়াই করত। বেপরোয়া ভাবটা তাঁর চরিত্রের মধ্যেও ছিল, যে জন্য এ-ছবিটিতে সেটিও ফুটে উঠেছে। যাই হোক, দর্শককুল ছবিটির অকুণ্ঠ প্রশংসা করলেন, এমনকী কেউ কেউ বললেন—ছবিটি সত্যজিতের যে কোনও ছবির চাইতেও উচ্চমানের ছবি।’

মৃণালের ছবি নিয়ে ঋত্বিকের প্রতিক্রিয়ার কথাও আমরা জানতে পারি মৃণালেরই বয়ানে। ১৯৭৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর তিনি সকাল সকাল উপস্থিত হন মৃণালের বাড়ি। অসুস্থ ছিলেন ভীষণ। মৃণালের স্ত্রী গীতা ঋত্বিককে দেখে চমকে ওঠেন। একদম রোগা হয়ে গেছেন। গীতাকে ঋত্বিক বললেন, ‘আর মদ খাবো না’। একটু পর আবারো বললেন, ‘আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না’। গীতা বললেন, ‘মদ না ছাড়লে কী করে বাঁচবেন আপনি?’ উদাস দৃষ্টিতে ঋত্বিক পুনরাবৃত্তি করেছিলেন, ‘আমি আর মদ খাবো না’। এরপর হুট করেই বললেন, ‘গীতা, মৃণাল খুব ভালমানুষ। কিন্তু ওর ‘ভুবন সোম’, ফুঃ!’

ঋত্বিক এমনই ছিলেন। মৃণাল জানতেন তিনি ছিলেন মহৎ শিল্পী। সব সময়েই ‘নিজের ছবিতে মহৎ সত্যকে খুঁজে বার করতে সচেষ্ট’ থাকতেন তিনি। মৃণাল লিখছেন,

‘ঋত্বিক বলত, আমি সেই ভাষার কথা খুঁজি যে ভাষায় কথা কম, যে ভাষা জানায় বোঝায়, এবং এমন এক পরিবেশে পৌঁছে দেয় যা ‘আর্কিটাইপাল ইমেজ’ হিসেবে পরিচিত।’

এই প্রতিমা ঘুরেফিরে এসেছে ঋত্বিকের ছবিতে। নিজেও যে দ্রুত প্রতীমায় পরিণত হবেন, রক্তমাংসের মানুষ থাকবেন না,সেটা যেন আগেভাগেই বুঝতে পেরেছিলেন ঋত্বিক। সেজন্যই মৃণালের বাসায় গিয়ে সেদিন বলেছিলেন, তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না।

মৃণালের গৃহে মৃত্যুর কথা উচ্চারণের দেড় মাস পর, ১৯৭৬ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি মারা যান ঋত্বিক। অন্তিমশয়নে পাশেই ছিলেন মৃণাল। ঋত্বিক তাঁকে দেখতে পাননি। রাত এগারোটা পাঁচে সমাপ্তি ঘটে ঋত্বিক অধ্যায়ের। মৃণাল বলছেন,

‘বোধহয় মরে গিয়ে ঋত্বিক বেঁচে গেল। মৃত্যুর কয়েকবছর আগের সময়গুলো ছিল ভয়ংকর। অবাধ্য ঋত্বিক, হৃদয়হীন ঋত্বিক, শৃঙ্খলাহীন ঋত্বিক আবার সবার ওপরে সম্মাননীয় ঋত্বিক! এখনও সেভাবেই বেঁচে আছে।’

এভাবেই বেঁচে আছেন ঋত্বিক। ‘দামাল ঋত্বিক, বেপরোয়া ঋত্বিক, অসহিষ্ণু ঋত্বিক, বিশৃঙ্খল ঋত্বিক’ যদি মরে গিয়ে বেঁচে থাকবেন, তাহলে বলতে হয়, শান্ত সত্যজিৎ, পরিপাটি সত্যজিৎ, সহিষ্ণু সত্যজিৎ, উদ্যোমী সত্যজিৎও মরে গিয়ে বেঁচে আছেন, থাকবেন। আর মৃণালও বেঁচে থাকবেন— সাহসী মৃণাল, ক্ষুব্ধ মৃণাল, স্পষ্ট মৃণাল ও মহাত্মা মৃণাল হয়ে।
                            
(তথ্যসূত্র:
১- মৃণাল সেন, তৃতীয় ভুবন, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১১), কলকাতা।
২- মৃণাল সেন, আমি ও আমার সিনেমা, বাণীশিল্প (২০১৫), কলকাতা।
৩- মৃণাল সেন, অনেক মুখ অনেক মুহূর্ত, পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ ও থীমা (২০১৫), কলকাতা।
৪- মৃণাল সেন, মানিকবাবুর সঙ্গে তর্ক এখনও আমার শেষ হয়নি, ঋতুপর্ণ ঘোষ সম্পাদিত ‘আনন্দলোক’, ২ মে ১৯৯৮, কলকাতা।
৫- বর্তমান পত্রিকা, বৃহস্পতিবার, ৩রা জানুয়ারি ২০১৯ সাল।
৬- Mrinal Sen: Sixty Years in Search of Cinema, Dipankar Mukhopadhyay, HarperCollins India.
৭- অনেক মুখ অনেক মুহূর্ত, মৃণাল সেন, থীমা।
৮- আনন্দবাজার পত্রিকায়, ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৮ সালে মৃণাল সেনের স্মৃতিতে প্রকাশিত তিনটি প্রবন্ধ।
৯- Always Being Born: Recipient Of Dadasaheb Phalke Award Mrinal Sen A Memoir, Mrinal Sen, Stellar (২০১৬)।)
                              ©️রানা চক্রবর্তী©️

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ