অচেনা সুভাষচন্দ্র'।। ©️রানা চক্রবর্তী©️




মুর্শিদাবাদ জেলার সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসুর সম্পর্ক ছিল দীর্ঘদিনের। এক সময়ে মুর্শিদাবাদে সুভাষচন্দ্র বসু এসেছেন বেশ কয়েক বার। কৈশোরে তাঁর প্রথম আসা বন্ধু দঙ্গল নিয়ে, বেড়াতে। তবে, তার পরে গ্রাম বাংলার এই প্রান্তিক জেলায় তাঁর আনাগোনা আর ঢিলেঢালা পাজামা পরে সিরাজের সমাধিক্ষেত্র দেখার পর্যটক হয়ে নয়, রাজনীতির শিক্ষক, সংগ্রাহক, পর্যবেক্ষক কিংবা প্রচারক হিসেবে। তবে পূর্ণ বয়সে সুভাষের এ জেলায় পদার্পণ জেলবন্দি হিসেবে। হ্যাঁ, গ্রেফতারের পরে বহরমপুরের তদানীন্তন জেলেই ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। স্থানীয় পত্র-পত্রিকা, সরকারি গেজেট, পুরনো স্মৃতি হাতড়ে খোঁজ মিলছে, অন্তত বারো বার এ জেলায় এসেছেন সুভাষ। তাঁর প্রথম পা, ১৯১৩-১৪ সালে। তখন তিনি নিতান্তই বছর ষোলোর  স্কুল ছাত্র। এসেছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে সিরাজের সমাধিক্ষেত্র দেখতে। পরে সভা করতে এসেছেন, জেল খাটতেও এসেছেন। ১৯২৩ সালে সুভাষকে বন্দি করে ব্রিটিশ পুলিশ। পরের বছর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বহরমপুর জেলের সাত নম্বর ঘরে। এখন সেটি হয়েছে মানসিক হাসপাতাল। 'আলোকপাত’ নামে প্রবন্ধ সংকলন গ্রন্থে ‘মুর্শিদাবাদে নেতাজি’ শীর্ষক লেখা থেকেও জানা যাচ্ছে, সুভাষচন্দ্র বহরমপুরে এসেছিলেন ১৯১৩-১৪ সালের পরে ১৯২৩ সালে। তাঁকে সে বার রাজবন্দি হিসেবে বহরমপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।
                             
জেলের ভিতরে সরস্বতী পুজো করার জন্য সুভাষ জেদ ধরেন, জেল কর্তৃপক্ষ অবশেষে তা মেনে পুজোর ব্যবস্থা করেন। শোনা যায়, পুজো দেখতে যাওয়ার অছিলায় অনেকেই জেলের ভিতরে সুভাষের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ সুদে-আসলে মিটিয়েছিলেন। পুজো দেখার জন্য জেদ ধরে সে সময়ে বহরমপুরের নামী চিকিৎসক সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বছর বারোর মেয়ে ঊষাও। ডাক্তারবাবু আর কী করেন, মেয়েকে নিয়ে যান জেলখানায়। এই ঊষাই পরবর্তী কালে হন আইনজীবী তথা স্বাধীনতা সংগ্রাম, পরে সাংসদ শশাঙ্কশেখর সান্যালের স্ত্রী। শশাঙ্কশেখর ও উষাদেবীর লেখা অনুসারে অবশ্য সেটি সরস্বতী পুজো ছিল না, ছিল দুর্গাপুজো। শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ‘সমকালীন ভারতে সুভাষচন্দ্র’ গ্রন্থ এবং বহরমপুর জেল থেকে দাদা শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা সুভাষের চিঠি কিন্তু অন্য কথা বলে। লোকসংস্কৃতি গবেষক পুলকেন্দু সিংহ ‘মুর্শিদাবাদে সুভাষচন্দ্র’ গ্রন্থে লেখেন, ‘‘বহরমপুর জেল থেকে  সুভাষচন্দ্র ৮।১২।১৯২৪ তারিখে শরৎচন্দ্র বসুকে লিখেছেন, ‘গত বুধবার আমি এখানে এসে পৌঁছেছি।’ অর্থাৎ তিনি বহরমপুরে এসেছিলেন ৩।১২।১৯২৪ তারিখে। এখান থেকে তিনি যান ২৫।১।১৯২৫ তারিখে। তখন দুর্গাপুজোর সময় নয়। সময়টি ছিল সরস্বতী পুজোর।’’
                       
সুভাষচন্দ্র বহরমপুরে এলে হয় শশাঙ্কশেখর বা মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেস প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ব্রজভূষণ গুপ্তের বাড়িতে উঠতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের তহবিল সংগ্রহের জন্য বহরমরপুরে কৃষ্ণনাথ কলেজে এসে বক্তৃতাও করেছেন তিনি। তবে তাঁর এই জেলায় প্রথম আসা সম্ভবত ১৬-১৭ বয়সে, ছাত্রজীবনে, ১৯১৩-১৪ সাল নাগাদ। সুভাষের বাল্যবন্ধু, কৃষ্ণনগরের হেমন্ত সরকার লিখেছেন, ‘‘কৃষ্ণনগর থকে ট্রেনে আমরা পলাশি গেলাম।...যুদ্ধক্ষেত্রে ভ্রমণ করতে করতে আমি কবি নবীন সেনের ‘পলাশীর যুদ্ধ’ আবৃত্তি করলাম। সেই আবৃত্তি শুনে সূভাষচন্দ্র চোখের জল ফেললেন।’’ পলাশি ভ্রমণের পরে সুভাষকে নিয়ে কয়েক বন্ধু যান বহরমপুরে হেমন্তকুমারের আত্মীয়ের বাড়ি়। পরদিন লালবাগ গিয়ে নবাব সিরাজের সমাধিক্ষেত্র দেখতে যান সুভাষ। ভাগীরথী সান্নিধ্যে আবৃত্তি করেন, ‘‘এই গঙ্গায় ডুবিয়াছি হায় ভারতের দিবাকর হে/ উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার হে।’’

বহরমপুর ছাড়াও বেশ কয়েক বার নানা কর্মসূচিতে জঙ্গিপুর, রঘুনাথগঞ্জ, জিয়াগঞ্জ লালবাগ, বেলডাঙা, কান্দি, লালগোলা, গোকর্ণ, জেমো, পাঁচথুপি গিয়েছেন সুভাষ। রঘুনাথগঞ্জের সভা সেরে তিনি কলকাতায় জরুরি মিটিং-এ যাবেন। কিন্তু সুভাষ জঙ্গিপুর স্টেশনে পৌঁছতেই ট্রেন ছেড়ে দেয়। চলন্ত ট্রেনে উঠে চেন টেনে গাড়ি থামিয়ে সুভাষকে গাড়িতে তোলেন এক ছোকরা। সেই ছোকরাই পরে আরএসপি নেতা ত্রিদিব চৌধুরী।

বাঙালির ইতিহাস ভোলার বদনাম আছে। তবে বহরমপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের ইতিহাস কিন্তু আজও বেঁচে আছে। এখনও যথাবিহিত সরস্বতী পুজো হয়।
                              
পরে ১৯৩১ সালে ফের এসে গিয়েছিলেন কিশোরবেলার সেই সিরাজ-সমাধি দেখতে। সমাধি ক্ষেত্রে যাওয়ার পথে গঙ্গার ধারে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলেন সুভাষ। লোকসংস্কৃতি গবেষক পুলকেন্দু সিংহ তাঁর ‘মুর্শিদাবাদে সুভাষ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘‘সেই গঙ্গায় দাঁড়িয়ে সুভাষচন্দ্র বসু গেয়েছিলেন, ‘এই গঙ্গায় ডুবিয়াছে ভাই ভারতের দিবাকর হে-/ উদিবে সে রবি আমাদের খুনে রাঙিয়া পুনর্বার হে।’ সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল, তাঁর সঙ্গে যাঁরা ছিলেন তাঁরাই মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। ফেরার ট্রেনের সময় হয়ে আসছে। কিছুটা অনিচ্ছা নিয়েই সে বার ফিরেছিলেন তিনি।

জঙ্গিপুরে তিনি রাজনৈতিক সভা করতে ১৯২৭, ১৯৩৭ ও ১৯৩৯, তিন বার এসেছিলেন। বহরমপুরে ১৯৩১ সালে কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে এসে শহরের মাঝেই করেছিলেন সভা। নেতাদের একটি অংশের চক্রান্ত ব্যর্থ করে সেখানে তিনি বক্তৃতাও দেন। 

১৯৩৯ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন। জিয়াগঞ্জের কংগ্রেস প্রার্থী তাজ বাহাদুর দুগরের হয়ে তিনি নির্বাচনী প্রচারে এসে যা বক্তৃতা দিয়েছিলেন তা পরের প্রজন্ম মনে রেখেছিল। সে বার, রাজা সুরেন্দ্রনারয়ণ সিংহকে হারিয়ে তাজ বাহাদুর বিপুল ভোটে জয়ী হন। সে বার তাঁকে জিয়াগঞ্জ থেকে রুপোর তরবারি উপহার দেওয়া হয়েছিল। তথ্য বলছে— তা ঘুরিয়ে দেখে হা হা করে হেসে উঠেছিলেন সুভাষ।

১৯৩১ সালে ২রা জানুয়ারি বেলডাঙার সভায় যোগ দিতে গিয়েছিলেন তিনি। বেলডাঙা পুরাতন বাজারের হাজরা বাড়ির প্রাঙ্গণে তাঁর সভামঞ্চ হয়। তাঁর আগমন উপলক্ষে তাঁকে সম্মান জানাতে শহর জুড়ে ফুলের মেলা বসে গিয়েছিল। তৈরি হয় তোরণও। শেষ বার বীরভূম ছোঁয়া কান্দির গোকর্ণ আর বড়ঞার পাঁচথুপিতেও এসেছিলেন সুভাষচন্দ্র। শোনা যায়, রাজনীতির প্রচারের পাশাপাশি তহবিল সংগ্রহের প্রয়োজনে সে বার জেলার অনেকের কাছেই দরবার করেছিলেন তিনি।
                            
সালটা ১৯২৫। রানাঘাটের বেনেবাগানে কয়েক জন যুবক গড়ে তুলেছেন দেশবন্ধু ব্যায়ামাগার। টিনের ঘরে নিয়মিত শরীরচর্চা চলে। মুগুর দিয়ে চলত শরীর ‘ভাঙা’। ক্রমশই বাড়তে থাকে ছেলেদের সংখ্যা। বিষয়টি ভালভাবে নেয়নি তৎকালীন ইংরেজ সরকার। তাদের ধারণা ছিল, ওই ব্যায়ামাগার ‘সন্ত্রাসমূলক’ কাজের আখড়া। তাঁদের ব্যায়ামাগারে যে ইংরেজদের নজর পড়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি সেখানকার যুবকদের। বাধ্য হয়ে তাঁরা ব্যায়ামাগার সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেখান থেকে খানিকটা দুরে শহরের বিশ্বাসপাড়ায় সরিয়ে নিয়ে আসা হয় সেই ব্যায়ামাগারকে। নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করে ওই ক্লাব। নাম হয় ‘রানাঘাট স্পোর্টিং অ্যাসোসিয়েশন’। ১৯৩১ সালে ক্লাবের সম্পাদক নির্বাচিত হন অমিয়কুমার ঘোষ। তাঁর চেষ্টায় বর্তমান ক্লাব প্রাঙ্গণে উত্তর পশ্চিম কোণে ব্যায়ামাগার প্রতিষ্ঠিত হয়।

সেই ব্যায়ামাগারের দ্বারোদঘাটন করেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি সেই সময় কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র। খানিকটা দূরে গাড়ি থেকে নেমে তিনি হেঁটে ব্যায়ামাগারে পৌঁছন। যে রাস্তায় তিনি নেমেছিলেন, পরবর্তীতে সেই রাস্তার নাম এখন সুভাষ অ্যাভিনিউ। ব্যায়ামাগারের দ্বারোদঘাটন  করেন। যুবকদের নানা পরামর্শ দিয়ে যান।
                             
স্বাধীনতার দাবিতে তখন উত্তাল দেশ। বর্ধমানের রাজা তখন বিজয়চাঁদ মহতাব। তিনি প্রত্যক্ষ ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু দেশব্রতীদের জন্য তাঁর সাহায্যের হাত ছিল অবারিত। সেই সময় নানা কর্মসূচিতে বর্ধমানে এসেছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু থেকে শুরু করে জওহরলাল নেহরু— সকলেই। সুভাষচন্দ্র বসু বর্ধমান শহরে এসেছিলেন মোট চার বার। তার মধ্যে অন্তত দু’টির কথা বর্ধমানের বহু প্রবীণ নাগরিকের স্মৃতিতে আজও অম্লান। 

সালটা ১৯৩৮ বা ১৯৩৯। সুভাষচন্দ্রকে প্রথম দেখেন তখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র কালীপদ সিংহ। পরে তিনি বর্ধমান রাজ কলেজে বাংলার শিক্ষকতা করতেন। তাঁরা কয়েক জন ছাত্র, সে দিন বর্ধমানে ছিলেন। কালীপদবাবুর স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, সে দিন নেতাজি প্ল্যাটফর্মেই নামতেই তাঁরা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন নেতাজিকে। সেই সময়ে বর্ধমান তো বটেই, বাংলার অধিকাংশ ছাত্র ও যুবকের নয়নের মণি সুভাষচন্দ্র বসু। তাঁর বক্তৃতা শুনতে নানা প্রান্ত থেকে মানুষ হাজির হয়েছিলেন শহরে। কালীপদবাবু তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, ‘‘নেহরু এবং নেতাজি দু’জনের বক্তৃতার ধরনটা ছিল ভিন্ন গোত্রের। সুভাষ বক্তৃতা করতেন ধীরে ধীরে। মনের ভিতর থেকে কথাগুলোকে তুলে আনতেন যেন। কিন্তু নেহরু বক্তৃতা দিতেন ঝড়ের মতো।’’ কালীপদবাবুর স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, বর্ধমানের একটি জনসভায় নেতাজি বলেছিলেন, ‘‘ওই যে দেওয়াল রয়েছে, দেওয়াল একটা বড় শক্তি। একা আমরা ভাঙতে পারি না। কিন্তু আমরা সবাই যদি দেওয়ালটাকে চেপে ধরি তা হলে  দেওয়ালটা ঠিকই পড়ে যাবে। তেমনই ব্রিটিশ রাজশক্তি যতই শক্তিশালী হোক, আমরা সবাই যদি তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করি, নিশ্চয়ই এক দিন তাকে ভেঙে পড়তে হবে।’’ স্মৃতি হাতড়ে কালীবাবু বলেছেন, ‘‘নেহরু আবেগপ্রবণ ভাবে হাত নেড়ে নেড়ে উত্তেজনার মুখে দ্রুত কথা বলে যেতেন।  কিন্তু সুভাষ বলতেন স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে। যুক্তির পরে যুক্তি সাজিয়ে।’’ কালীপদবাবুর বক্তব্য থেকে জানা যায়, এই বর্ধমানের মাটিতে দাঁড়িয়ে একটি সভায় নেতাজি বলেছিলেন, ‘‘পরাধীনতা পাপ, পরাধীনতা স্বীকার করা মহাপাপ।’’ কিন্তু সেই সভা কোথায় এবং কবে হয়েছিল সে প্রসঙ্গে তাঁরা কিছু বলে যাননি।
                               
প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান ও নানা বইপত্র থেকে জানা যায় এর পরে সুভাষচন্দ্র বসু বর্ধমানে এসেছিলেন ১৯৪০ সাল নাগাদ। সম্ভবত সেটাই ছিল তাঁর শেষ বর্ধমানে আসা। সে বারে এসেছিলেন বেশ কিছু কাজ নিয়ে। এসে উঠেছিলেন ভামিনীরঞ্জন সেনের বাড়িতে।  ১৯৮৪ সালে ভামিনীরঞ্জন সেনের নাতি আইনজীবী দেবরঞ্জন সেনের একটি সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছিল নেতাজির সে বারের বর্ধমান আগমনের নানা প্রসঙ্গ। সেই সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, ১৯৪০ সালে সুভাষচন্দ্র যখন সেন বাড়িতে আসেন, তখন দেবরঞ্জনবাবু ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। তিনি পরে জানিয়েছিলেন, ‘‘বর্ধমানের মহারাজা স্যর বিজয়চাঁদের খুব সুন্দর সাজানো দু’ঘোড়ায় টানা সেই ঐতিহাসিক জুড়িতে চেপে কংগ্রেস নেতা সুভাষচন্দ্র বর্ধমান স্টেশন থেকে সোজা নামলেন আমাদের এই প্রকাণ্ড বাড়ির সামনে।’’ এই স্মৃতিকথা থেকে আরও জানা যায়, সেন বাড়ির গৃহকর্ত্রী, ভামিনীরঞ্জন সেনের স্ত্রী সরোজিনীদেবী সুভাষচন্দ্রের কাছে ছিলেন মাতৃসমা। নেতাজি বাড়িতে ঢুকে সবার প্রথমে তাঁর সঙ্গেই সাক্ষাৎ করেছিলেন। সুভাষচন্দ্রকে বুকে জড়িয়ে ধরে সরোজিনী দেবী প্রশ্ন করেন, ‘‘এত রোগা হয়ে গিয়েছিস কেন রে?’’ সুভাষচন্দ্র এই বাড়িতেই রাত কাটিয়ে ছিলেন। বৈঠক করেছিলেন কংগ্রেস কর্মীদের সঙ্গে। পুরসভার কমিশনারের সঙ্গেও দেখা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, সে বার তিনি বর্ধমানের কালীবাজারে পাইওনিয়ার ব্যাঙ্কের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন বলে জানা যায়। তবে এই ব্যাঙ্কটির এখন আর কোনও অস্তিত্ব নেই। 

সেই সময়ে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে একটি ঘটনার সূত্রে জড়িয়ে গিয়েছিলেন বর্ধমানের গোবিন্দচন্দ্র নাগ। পেশায় মিষ্ঠির ব্যবসায়ী গোবিন্দবাবুর সঙ্গে শৈলেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সুবোধ মুখোপাধ্যায়, বামাপতি ভট্টাচার্যের মতো শহরের বেশ কয়েক জন প্রভাবশালী লোকের চেনা জানা ছিল। সেই সুবাদেই তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় নেতা সুভাষচন্দ্র বসুর কাছে। গোবিন্দবাবু ১৯৪০ সালের ২৩ জানুয়ারি তাঁর প্রিয় নেতার জন্মদিনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘নেতাজি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ নামে একটি দোকানের। তার কিছু দিনের মধ্যেই নেতাজি স্বয়ং বর্ধমানে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। যাচ্ছিলেন বিসি রোড ধরে। তখন গোবিন্দবাবু এগিয়ে এসে নেতাজিকে তাঁর মিষ্টির দোকানে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। সুভাষচন্দ্র অনুরোধ রক্ষা করেন। এর পরেই বদলে গিয়েছিল গোবিন্দবাবু ওরফে ‘কালোদা’-র জীবন। প্রতি বছর নেতাজির জন্মদিনে দরিদ্র মানুষদের মধ্যে মিষ্টি বিলি শুরু করেন গোবিন্দবাবু। তার পরে কেটেছে অনেকটা সময়। সে দোকান এখন পাকা হয়েছে। আজও, ২৩শে জানুয়ারির সকালে দরিদ্র মানুষজনের মধ্যে লাড্ডু বিতরণ করেন  গোবিন্দবাবুর একমাত্র কন্যা রমাদেবীর পুত্র সৌমেন দাস।
                             
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে তখন। চল্লিশের শতকের শুরুতে জাতীয় রাজনীতিতে সে এক উথাল-পাথাল সময়। লালমাটি আর সবুজ শাল গাছে ঘেরা ঝাড়গ্রামের রাজপরিবার কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। একদিকে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর সত্যাগ্রহ। অন্য দিকে সুভাষচন্দ্রের স্বরাজের ডাক। দুই দেশনেতার মধ্যে মতবিরোধ। কংগ্রেসের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের দূরত্ব তখন স্পষ্ট। তখনও তিনি নেতাজি হননি। ব্রিটিশ সরকারের কড়া নজরদারি আর স্থানীয় বর্ধিষ্ণুদের নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় জঙ্গলমহলে স্বরাজ আন্দোলনের ঢেউ বড়ই নিস্তরঙ্গ।

বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্কে পূর্ববঙ্গ ও কলকাতা থেকে আসা দলে দলে লোকজন বসতি গড়ে তুলছেন অরণ্যমহলে। কুমুদকুমারী ইনস্টিটিউশনের তখন প্রধান শিক্ষক ছিলেন রাধাশ্যাম বসু। স্কটিশচার্চ কলেজে সুভাষচন্দ্রের সমসাময়িক সহপাঠী হিসেবে পরিচিত রাধাশ্যামবাবু হঠাৎ ক্লাসে-ক্লাসে একটি নোটিস পাঠালেন। শেষ বৈশাখের দগ্ধ দিনে সেই নোটিস পেয়ে কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্র ক্ষোভে ফুঁসতে থাকলেন। ক্ষোভ ছড়াল একাংশ অভিভাবক মহলেও। নোটিসের বয়ান, ‘যাহারা লালগড় মাঠে সভা শুনিতে যাইবে, সেই সকল ছাত্রদিগকে বিদ্যালয় হইতে বহিষ্কার করা হইবে।’ স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বিষয়টি জেনে ভীষণই ক্ষুব্ধ হলেন।

১২ই মে ১৯৪০ ঝাড়গ্রামের লালগড় মাঠে (এখনকার দুর্গা ময়দান) স্বরাজের আহ্বান-সভার আয়োজন করেছিলেন নাড়াজোলের কুমার দেবেন্দ্রলাল খান। আর রাধাশ্যাম বসু হেড মাস্টার হয়ে স্বরাজের বিরোধিতা করছেন জেনে বেজায় চটলেন সুভাষচন্দ্র! সুভাষচন্দ্র ঠিক করলেন, প্রকাশ্য সভায় বিষয়টি উত্থাপন করে রাধাশ্যামবাবুকে একহাত নেবেন। ঝাড়গ্রামের ওই সভাটিই ছিল অবিভক্ত মেদিনীপুরে সুভাষচন্দ্রের শেষ জনসভা। ১৯৪০ সালের ১২ই মে সুভাষচন্দ্রের ওই সভার বিস্তারিত সংবাদটি একদিন পরে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
                             
১৯৪০ সালের ১৪ই মে আনন্দবাজারে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের তীব্র মতবিরোধ সত্ত্বেও ওই দিন ঝাড়গ্রামে কংগ্রেস কর্মীরাই তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন কৃষক ও যুবকেরা। ঝাড়গ্রামে ব্যবসায়ী নলিনবিহারী মল্লিকের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করে একটি টালির বাড়িতে (এখন এটি বাছুরডোবা পেট্রল পাম্পের অফিস ঘর) বিশ্রাম নেন সুভাষচন্দ্র। দুপুরে নতুনডিহিতে কর্মী সম্মেলন করেন। তারপর বার-লাইব্রেরিতে (বর্তমান ঝাড়গ্রাম বার অ্যাসোসিয়েশনের আদি ভবন) আইজীবীদের সঙ্গে মিলিত হন। বিকেলে লালগড় মাঠে (দুর্গা ময়দান) জনসভায় বক্তব্য রাখেন। ওই সভার উদ্যোক্তা ছিলেন নাড়াজোল রাজ এস্টেটের কুমার দেবেন্দ্রলাল খান।

১৯৪০ সালের ১৪ই মে আনন্দবাজারে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, প্রকাশ্য জনসভায় প্রধান শিক্ষক রাধাশ্যাম বসুর সমালোচনা করে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, “দুঃখ ও লজ্জা হয় এই জন্য যে, এই রকম মানুষ এখনও আছে। তাঁহারা আবার ছেলেদের শিক্ষার ভার গ্রহণ করিয়াছেন। স্বরাজ হইলে প্রথমেই এই সকল শিক্ষকদের শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে, তারপর ছাত্রদের ব্যবস্থা হইবে।” শোনা যায়, পরে নিজের কৃতকর্মের জন্য ঘনিষ্ঠমহলে দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন রাধাশ্যামবাবু। ইংরেজ প্রশাসন ও স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের চাপে পড়ে প্রধানশিক্ষককে ওই কাজ করতে হয়েছিল প্রধানশিক্ষককে। তবে সুভাষচন্দ্রের কাছে আর দুঃখপ্রকাশ করার সুযোগ পাননি তিনি। অথচ সুভাষচন্দ্রের ঝাড়গ্রামে পদার্পণের দিনটি স্মরণীয় করে রাখার জন্য আজ পর্যন্ত প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এই অরণ্য শহরে সুভাষচন্দ্র জনসভা করেছিলেন, সেই তথ্য অনেকেরই অজানা। এখন যেটি দুর্গা ময়দান, বহু আগে সেটি লালগড় রাজাদের হেফাজতে থাকায় নাম ছিল লালগড়ের মাঠ। শোনা যায়, সুভাষচন্দ্রের সভার জন্য ঝাড়গ্রামে অন্য কোনও মাঠ পাওয়া যায়নি। সেই কারণে লালগড়ের মাঠে সভাটি হয়।
                            
ঝাড়গ্রাম শহরের যেখানে সুভাষচন্দ্র সভা করেছিলেন, সেই ঐতিহাসিক ‘লালগড়ের মাঠ’টির বর্তমান নাম দুর্গা ময়দান। আয়তন কমে মাঠের আর কোনও অস্তিত্ব নেই। শহরের প্রাচীনতম দুর্গা ময়দান সর্বজনীন দুর্গোত্সব কমিটির স্থায়ী দুর্গামন্দির তৈরি হয়েছে। ১৯৯৭ সালে সুভাষচন্দ্রের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বেসরকারি ভাবে দুর্গা ময়দান রক্ষা কমিটির উদ্যোগে মাঠের একপাশে একটি স্মারকস্তম্ভ তৈরি করা হয়। স্মারক স্তম্ভটির উদ্বোধন করেছিলেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বর্তমানে প্রয়াত সুবোধচন্দ্র হাঁসদা। কিন্তু ওই স্মৃতিস্তম্ভের ফলকটিতে ভুল তথ্য লেখা রয়েছে। ফলকে লেখা আছে, পরাধীন ভারতবর্ষে সুভাষচন্দ্রের শেষ জনসভাটি দুর্গা ময়দানে হয়েছিল।

সুভাষচন্দ্রের জনসভা নিয়ে গবেষণারত প্রবীণ সাংবাদিক তারাপদ কর জানিয়েছিলেন, ঝাড়গ্রামের সভাটি ভারতবর্ষে সুভাষচন্দ্রের শেষ জনসভা নয়। ১৯৪০ সালের মে মাসে আরও ৮টি সভা করেছিলেন সুভাষচন্দ্র। ১৯৪০ সালের ঢাকার করোনেশন পার্কের সভাটি সম্ভবত সুভাষচন্দ্রের শেষ জনসভা। এরপর ১৯৪০ সালের ২রা জুলাই দুপুরে ব্রিটিশ পুলিশ এলগিন রোডের বাড়ি থেকে সুভাষচন্দ্রকে ভারতরক্ষা আইনে গ্রেফতার করে প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে গিয়েছিল। তবে ১৯৪০ সালে ১২ই মে ঝাড়গ্রামের জনসভাটি অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় সুভাষচন্দ্রের শেষ জনসভা ছিল। তারাপদবাবুর আক্ষেপ, “প্রশাসনিক ভাবে আজ পর্যন্ত সুভাষচন্দ্রের ঝাড়গ্রামে আগমনের বিষয়টিকে কোনও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সিংহভাগ ঝাড়গ্রামবাসী সুভাষচন্দ্রের ওই জনসভার দিনটি সম্পর্কে জানেন না। এটা অত্যন্ত লজ্জার বিষয়।” তারাপদবাবুর নিরলস গবেষণা করেছেন সুভাষচন্দ্রের ঝাড়গ্রামের সভাটি নিয়ে।

সুভাষচন্দ্রের ওই সভার শ্রোতা বর্তমানে প্রয়াত অশীতিপর বৃদ্ধ সুধাকর মাহাতো বছর দু’য়েক আগে আনন্দবাজার পত্রিকায় এক স্মৃতিচারণায় লিখেছিলেন, ওই দিন বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ সভাস্থলে পৌঁছেছিলেন সুভাষচন্দ্র। পরণে ধুতি-পাঞ্জাবি। মাথায় গাঁধী টুপি। তিনি মাঠে পৌঁছতেই আতসবাজি পুড়িয়ে তাঁকে স্বাগত জানানো হয়। মহিলারা গেয়ে ওঠেন, ‘দেশ দেশ নন্দিত করি মন্দ্রিত তব ভেরী’। সব কথার মানে বোঝেননি সুধাকরবাবু। তবে সভায় যাওয়ার খবর চলে গিয়েছিল প্রধান শিক্ষকের কাছে। স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পরে অপমানে আর স্কুলের চৌকাঠ মাড়াননি সুধাকরবাবু। সুধাকরবাবুর লেখা থেকে জানা যায়, সভা শেষে সুভাষচন্দ্র ঝাড়গ্রাম স্টেশন থেকে রাতের ট্রেনে ফিরে গিয়েছিলেন। সেদিন তাঁকে দেখতে মানুষের ঢল নেমেছিল।”
                          
তাঁর ঘর ছিল গোটা পৃথিবীই। তবু নদিয়ার সঙ্গে তাঁর সখ্য সেই ছাত্রজীবন থেকে। সুভাষচন্দ্র থেকে নেতাজী হয়ে ওঠার প্রতিটি পর্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নদিয়ার জেলাসদর রাজার শহর কৃষ্ণনগর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জ। মাঠ-ঘাট থেকে গঙ্গা-জলঙ্গি নদী। পলাশির প্রান্তর থেকে অঞ্জনার তীর। চৈতন্যধাম নবদ্বীপ অথবা অদ্বৈত ভূমি শান্তিপুর হয়ে বাগআঁচড়া কিংবা মহেশগঞ্জ জুড়ে ছিল তার অবাধ বিচরণ। সময়টা ১৯১৩ থেকে ১৯৩৮। ওই সাড়ে তিন দশকে বারে বারে নদিয়ায় এসেছেন সুভাষচন্দ্র। স্বাধীনতার যুদ্ধে নিজেকে প্রস্তুত করার প্রাথমিক পর্বে সুভাষচন্দ্রের জীবনে নদিয়ার প্রভাব অকল্পনীয়।

সময়টা ১৯১৩ সালে মে মাস।

ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়ে  সুভাষচন্দ্র তাঁর বন্ধু হেমন্তকুমার সরকারের নিমন্ত্রণে কৃষ্ণনগর এসেছেন। সম্ভবত সেই প্রথম তাঁর কৃষ্ণনগর আসা। উঠেছেন বন্ধুর বাড়িতেই। ইতিহাসের নদিয়া এবং নবাবি মুর্শিদাবাদের প্রসিদ্ধ স্থানগুলি দেখতে প্রায়ই বেড়িয়ে পড়তেন সুভাষচন্দ্র। সঙ্গে হেমন্তকুমার ছাড়াও থাকতেন সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, যুগলকিশোর আঢ্য, গুরুদাস গুপ্ত প্রমুখ। নদিয়ার পলাশি কিংবা মুর্শিদাবাদের নবাবি আমলের বিভিন্ন ইতিহাসখ্যাত জায়গাগুলির প্রতি আশ্চর্য রকমের টান ছিল সুভাষচন্দ্রের।

একদিন নৌকা করে ফিরছেন মুর্শিদাবাদ থেকে। তখন বেশ রাত হয়েছে। বৈশাখি জ্যোৎস্নার রাত। বন্ধুরা সুভাষচন্দ্রকে গান গাইতে বললেন। গান সুভাষচন্দ্র নিজেও ভালই গাইতেন। চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া গঙ্গার বুকে সুভাষচন্দ্র ভরাট উদাত্ত কণ্ঠে গেয়ে উঠেছিলেন,

“দূরে হের চন্দ্র কিরণে উদ্ভাসিত গঙ্গা।
ধায় মত্ত হরষে সাগরে পদপদ পরশে।
কূলে কূলে করি পরিবেশন মঙ্গলময়ী বরষা, শ্যামধরণী সরসা।”

কান্তকবি রজনীকান্ত সেনের এ গান ছিল সুভাষচন্দ্রের বড় প্রিয়।
                             
অন্য এক দিন সদলবলে নবদ্বীপ এসেছেন সুভাষচন্দ্র। চৈতন্যদেবের স্মৃতি বিজড়িত নবদ্বীপ থেকে নৌকায় ফিরতি পথে স্রোতের উজানে আসতে হয়। জলঙ্গি দিয়ে নৌকা করে ফেরার সময় সকলের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে গুন টানলেন সুভাষচন্দ্র।

ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর হেমন্ত সরকার কৃষ্ণনগরে শ্রমজীবীদের জন্য নৈশ বিদ্যালয় স্থাপনে উদ্যোগী হন। মূলত বন্ধুকে এই কাজে সহায়তা করতেই সুদূর কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগরে আসতেন সুভাষচন্দ্র। নিয়ম করে ওই নৈশ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। সঙ্গে আসতেন শৈলেন ঘোষ। যিনি পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকায় বসে ভারতীয় বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার কাজ করবেন।  

কৃষ্ণনগরে সুভাষের নিয়মিত যাতায়াতের ফলে হেমন্ত সরকার ও তাঁর বন্ধুদের মধ্যে দারুণ উৎসাহের সৃষ্টি করল। কৃষ্ণনগরের অঞ্জনা নদী তখনও মরেনি। অঞ্জনার ধারে তাঁরা সমবেত হতেন। সেখানে সমকালীন  রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হত। থাকত ধর্মের আলোচনাও। কলকাতা থেকে সুভাষচন্দ্র এক এক বার এক এক জনকে নিয়ে যেতেন সেই আলোচনা সভায়। কখনও সুরেশচন্দ্র তো হেমচন্দ্র দত্তগুপ্ত, কখনও আবার হেমচন্দ্র সরকার। এই রকম সময়ে সুভাষচন্দ্র কৃষ্ণনগরের জলঙ্গি নদীতে সাঁতার শিখেছিলেন। এক দিন হেমন্ত সরকার সুভাষচন্দ্র কে কথায় কথায় জানান, তাঁর পৈত্রিক বাসস্থান বাগআঁচড়া গ্রামে আলিপুর বোমার মামলার আসামি নিরাপদ রায় থাকেন। তিনি তখন দশ বছর দ্বীপান্তর-দণ্ড ভোগ করে গ্রামে বাস করছেন। বাগআঁচড়া ছিল নিরাপদ রায়েরও পৈত্রিক বাসস্থান। সুভাষচন্দ্র চললেন, আলিপুর বোমা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত মানুষটিকে দেখতে। সেই বিপ্লবী সাধক সুভাষচন্দ্রের পরিচয় পেয়ে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করেছিলেন। সুভাষের মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, তিনি যেন বড় হয়ে দেশের কাজ করেন আর কখনও যেন গ্রামকে না ভুলে যান। 
                              
এক বার বড়দিনের ছুটিতে সন্ন্যাসী জীবনযাপন করার জন্য সুভাষচন্দ্র এবং তাঁর কয়েক জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু গেলেন শান্তিপুর। সেখানে গঙ্গার ধারে জনৈক ভরত পোদ্দারের খালি বাড়িতে শুরু করলেন সন্ন্যাস জীবনের যাবতীয় কৃচ্ছ্বতার অনুশীলন। ইন্দ্রদাস বাবাজী নামে এক তরুণ সন্ন্যাসী সেই সময়ে নদিয়ায় আসেন। সুভাষচন্দ্র এবং হেমন্ত সরকার তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। 

প্রথম জীবনে এই হেমন্ত সরকার ছিলেন সুভাষের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ১৯১২ সালে কটকে হেমন্তর সঙ্গে সুভাষের আলাপ হয়েছিল। সুভাষের সহপাঠী সমবয়সী হেমন্ত পরবর্তী কালে সহকর্মী ও সহযোদ্ধা ছিলেন নেতাজির। তৎকালীন বাংলা রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ জ্যোতিষ্ক হেমন্ত ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের ডান হাত এবং স্বরাজ্য দলের চিফ হুইপ। তিনি নদিয়া কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও বটে।

হেমন্ত সরকার তাঁর ‘সুভাষের সঙ্গে বারো বছর’ বইতে লিখছেন, “কিছু দিন পরেই সুভাষ এল কেষ্টনগরে আমার কাছে। আমাদের বাড়িতে প্রথমে তার স্থান হল না। তাই সুভাষকে নিয়ে নিকাড়ি পাড়ায় ডা: দামোদর চক্রবর্তীর এক বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। ওই বাড়িটা তখন ছিল একটা মেস বাড়ি। নানা রকম অনিয়মে সুভাষের শরীর তখন ভেঙে পড়েছিল। কৃষ্ণনগরে সে টাইফয়েডে আক্রান্ত হল। মেস থেকে আমাদের বাড়িতে এনে ওঠালাম।”

ওই বইয়ে হেমন্ত সরকার লিখেছেন যে কলকাতায় কলেজ স্ট্রিটের এক মেসে তিনি, সুভাষচন্দ্র এবং অন্য বন্ধুরা প্রায়ই যেতেন। সেখানেই তাঁরা বিপ্লবী বাঘাযতীনের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়ে ছিলেন। 

ইতিমধ্যে সুভাষচন্দ্র ক্রমশ ব্যস্ত হয়ে পড়তে থাকেন দেশব্যাপী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। স্বাভাবিক ভাবেই কমে যায় আগের মতো নদিয়ায় যাতায়াতের সুযোগ। তবু নদিয়ার প্রতি তাঁর ছিল আন্তরিক টান। সেটা বোঝা যায়, চরম ব্যস্ততার মুহূর্তেও যে কোনও কর্মসূচিতে তিনি নদিয়াতে আসবেনই।
                            
সেটা সম্ভবত ১৯২৯ সাল।

সুভাষচন্দ্র কৃষ্ণনগরে এক বিশেষ ছাত্র-যুব সভায় বক্তৃতা করেন। জায়গাটি ছিল ছুতোরপাড়া। সে সময়ে ওইখানেই ছিল কৃষ্ণনগর অ্যাথলেটিক ক্লাব এবং বিপ্লবী সংগঠন ‘রেড সার্ট ভলান্টিয়ার্স’দের কুচকাওয়াজের মাঠ। ছিল সাধনা লাইব্রেরির কিশোর বিভাগ। সুভাষচন্দ্রের সেই বিশেষ সভায় সকলের প্রবেশ অধিকার ছিল না। যাতে অবাঞ্ছিত লোক ঢুকে না পড়ে, তার জন্য সভামণ্ডপটি পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল রেড সার্ট ভলান্টিয়ার্সদের।    

সুভাষচন্দ্রকে ১৯৩০ সালের ২ নভেম্বর, কৃষ্ণনগর পুরসভার পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। প্রদান করা হয় মানপত্র। এর বছরখানেক পর সুভাষচন্দ্র ফের কৃষ্ণনগরে আসেন।

নদিয়াতে সুভাষচন্দ্র শেষবার আসেন ১৯৩৮ সালে। তখন তিনি সকলের 'নেতাজী'। নবদ্বীপের গঙ্গার পূর্বপাড়ে মহেশগঞ্জে বিমানে করে নামেন। মহেশগঞ্জের পালচৌধুরীদের মাঠে তাঁর বিমান নামলে একদল স্বেচ্ছাসেবক তাঁকে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানান। এঁরা ছিলেন নদিয়ার সুভাষ অনুগামী স্বেচ্ছাসেবক। এখান থেকে তিনি নবদ্বীপের প্রাণকেন্দ্র পোড়ামাতলায় এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা করেন। শহর নবদ্বীপ যেন ওই জনসভায় ভেঙে পড়েছিল। 

প্রকাশ্য রাজনৈতিক ভাবধারার এক নায়ক ছিলেন সুভাষচন্দ্র। আর কৃষ্ণনগর তথা নদিয়া ছিল সুভাষচন্দ্রের তারুণ্যের লীলাভূমি।
                       
মুর্শিদাবাদে ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের নানা নিদর্শন। ইতিহাস সমৃদ্ধ নবাবদের রাজত্বকাল বাদ দিলেও রয়েছে বহু ঐতিহাসিক ঘটনা আর নানা ব্যক্তিত্ব। মুর্শিদাবাদের লালগোলা তেমনই একটি জায়গা। লালগোলার রথবাজার পেরিয়ে এমএন একাডেমি স্কুলের আগে মনসা মন্দিরের বাঁ দিকে একটি হলুদ রঙের জীর্ণ মন্দিরের ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা আজ আমাদের অনেকেরই মনে নেই। ইতিহাস সচেতন মানুষ অবশ্য এই বাড়ির গুরুত্ব জানেন। লালগোলার মহারাজা যোগেন্দ্রনারায়ণ রায় তাঁর পৌত্র ধীরেন্দ্রনারায়ণ রায়ের জন্য এক জন গৃহশিক্ষকের খোঁজ করছিলেন। তলব করা হল তাঁকে। তিনি তখন মুর্শিদাবাদের অরঙ্গাবাদের নিমতিতায় একটি স্কুলের শিক্ষকতা করছেন।

যেখানে স্বয়ং রাজা তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন, না গিয়ে আর উপায় কী! সেই ডাকে সাড়ে দিয়ে চলে আসেন লালগোলা। কিছু দিন ধীরেন্দ্রনারায়ণ রায়কে পড়ানোর পরে রাজা তাঁকে লালগোলার এমএন একাডেমিতে শিক্ষকতার কাজে নিযুক্ত হতে বলেন। আর তখন থেকেই পাকাপাকি ভাবে তিনি থাকতে শুরু করেন এই বাড়িতে। সেই বিখ্যাত মানুষটি আর কেউ নন, যোগী বরদাচরণ মজুমদার।

বরদাচরণেবার ডাকে সাড়া দিয়ে কে না এসেছেন এই বাড়িতে! কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে তবলা শিল্পী ওস্তাদ আতা হোসেন, সঙ্গীত শিল্পী কাদের বক্সের পদধূলিতে ধন্য হয়েছিল লালগোলার এই বাড়ি। ঋষি অরবিন্দের সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মিক যোগ। চিঠিপত্রের আদান প্রদান চলত তাঁদের মধ্যে। কিন্তু কখনও সরাসরি দেখা করেননি তিনি। তবে এ বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল ঋষি অরবিন্দের ভাই বারীন ঘোষের।
                            
বাংলার আকাশে বাতাসে তখন ধ্বনিত হচ্ছে স্বাধীনতার জয়গান। দেশমাতৃকার সেবায় নিয়োজিত প্রাণ বাংলার যুবা-বৃদ্ধ অনেকেই। আর তাঁদের নেতৃত্বে রয়েছেন বাংলা তথা ভারতবর্ষের বীর সন্তান সুভাষচন্দ্র বসু। 

সুভাষচন্দ্রের কলেজ জীবনের বন্ধু ছিলেন দিলীপকুমার রায়। তিনি ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র। এছাড়া তিনি নিজেও একজন সুরসাধক ছিলেন। তিনিও বহু বার বরদাচরণের সঙ্গে দেখা করে গিয়েছেন এই বাড়িতে।

সেই সময় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক চরম সন্ধিক্ষণ। সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেসের সভাপতি পদত্যাগ করেছেন তখন। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে চালিত সমস্ত কংগ্রেস-শক্তি সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে। নতুন কর্মপন্থা নির্বাচনে সুভাষচন্দ্রের তখন ব্যস্ততার সীমা নেই।

সেই সময়ে এক দিন গ্রীষ্মের ছুটিতে লালগোলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মহাশয় কলকাতায় বেড়াতে আসেন। সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে তিনি অতিশয় আগ্রহী। সমস্ত জরুরি কাজ ফেলে সুভাষচন্দ্র সে দিন সকাল আটটার সময় বরদাবাবুর কাছে উপস্থিত হন। 

তারিখটা ছিল ১৯৩৯ সালের ১২ জুন। বাংলা ২৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৪৬ সাল।

আজ থেকে প্রায় আশি বছর আগের এক দিন। 

সুভাষচন্দ্রকে সঙ্গে করে বরদাচরণ একটি ঘরে প্রবেশ করেন। বরদাচরণ তখন কলকাতায় মোহিনীমোহন রোডের একটি বাড়িতে ছিলেন। ঘরে ঢুকে বরদাচরণ নির্দেশ দেন, তিনি ঘর না খোলা পর্যন্ত কেউ যেন দরজায় ধাক্কা না দেয়। টানা আড়াই ঘণ্টা ভেতরে চলে আলোচনা। আর আলোচনার পরে যখন তিনি বাইরে আসেন তখন দেখা যায় সুভাষচন্দ্রের চোখ মুখ লাল। যেন ঘোরের মধ্যে রয়েছেন।

সুভাষকে তাঁর গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। তিনি একটিও বাক্যালাপ না করে নিঃশব্দে গাড়িতে গিয়ে বসেন। গাড়িতে ওঠার আগে দেখা যায় তাঁর পদক্ষেপও যেন স্বাভাবিক নয়।

পরের দিন সন্ধ্যায় সুভাষচন্দ্র ফের দেখা করতে যান বরদাচরণের সঙ্গে। সেদিন প্রায় স‌োয়া দু’ঘন্টা কাটিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে। পরের দিন অবশ্য আসার কথা ছিল না সুভাষের। কী কারণে তিনি এসেছিলেন এবং এতক্ষণ সময় কাটিয়ে গিয়েছেন তা খোলসা করে কিছু বলেননি যোগী মহাশয়। ফলে বিস্তারিত কিছুই জানা যায় না।
                         
আশ্চর্যের ব্যাপার হল, পরের দিনও বিশেষ কাজে সুভাষচন্দ্রের কলকাতার বাইরে যাওয়ার কথা ছিল। উপস্থিত তাঁর কাছের লোকেরা বরদাচরণকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেছিলেন,

‘‘সব কিছু খুলে বলা সম্ভব নয়। অতীত জীবনটাই সুভাষবাবুর কাছে খুলে ধরেছিলাম। যে কথা তিনি ছাড়া আর কেউ জানেন না এমন কথাও তাঁর সামনে তুলে ধরেছিলাম।’’ 

বরদাচরণ ও সুভাষচন্দ্রের মধ্যে এমন কিছু কথাবার্তা হয়েছিল যা চিরকাল কেউ জানতে পারেন নি। সুভাষচন্দ্রের সে দিনের আসা নিয়ে জানতে চাইলে বরদাচরণ শুধুমাত্র বলেছিলেন,

‘‘আজ তাঁকে যোগের বিশেষ প্রক্রিয়া বলে দিলাম। ধ্যানে বসিয়েছিলাম, অনেকক্ষণ ধ্যানস্থ ছিলেন!’’

কী এমন বিশেষ আলোচনা হয়েছিল সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে, আমরা পুরোপুরি জানি না। সুভাষচন্দ্রের এই জন্মমাসে দাঁড়িয়ে আমাদের তা জানার বিশেষ আগ্রহ থাকলেও আজ তা জানার বিশেষ সুযোগ নেই। কিন্তু আমরা অনুমান করতে পারি যে, এমন কোনও কথা হয়েছিল যার জন্য সুভাষচন্দ্রের চোখ-মুখ সে দিন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছিল। স্বাধীনতার লড়াইয়ে নিজের জীবনের সবকিছু উৎসর্গ করে দেওয়া সুভাষ সে দিন হয়তো এমন একজন গুরুর খোঁজেই ছিলেন। তিনি পেয়েছিলেন কি এমন কিছু মন্ত্র যা তাঁকে পুরোপুরি বাকস্তব্ধ করে দিয়েছিল?

১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্রের দেখা হয়েছিল যোগী মহাশয়ের সাথে। আর তার পরেই ১৯৪১ সালের ২৬ জানুয়ারি সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধানের খবর ছড়িয়ে পড়েছিল বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।
                            
১৯৩৪ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত এমিলিয়েকে মোট ১৬২ খানা চিঠি লিখেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। রোম থেকে পাঠানো এক চিঠিতে যদিও তিনি দাবী করেছিলেন,

"চিঠিপত্র লেখায় আমি বেশ অনিয়মিত, তবে মানুষ হিসেবে আশা করি আমি খুব খারাপ নই।"

তবু এমিলিয়ের সাথে যোগাযোগ রক্ষায় তিনি যে নিরসল ছিলেন, তা চিঠির সংখ্যা দেখে বুঝে নিতে কারও অসুবিধা হওয়ার নয়।

স্বাধীনতা সংগ্রামী সুভাষচন্দ্র বড় রাজনীতিক হলেও ব্যক্তি সুভাষ কম বড় মানবিক নন। তার প্রমাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাঁর লেখা চিঠিপত্রের ছত্রে ছত্রে। কত জায়গা থেকেই না তিনি এমিলিয়েকে চিঠি লিখেছিলেন, কখনও জেলখানা থেকে, কখনও বা বন্দিগৃহ থেকে, কখনও আবার চূড়ান্ত রাজনৈতিক অগ্নিকুণ্ডের মধ্য থেকেই। এ সব চিঠিপত্র সুভাষচন্দ্রের মানবিক মুখ। কঠিন সময়েও কাছের মানুষদের কখনও তিনি বিস্মৃত হননি।

শুধু এমিলিয়েই নন, যাঁরাই সুভাষচন্দ্রের কাছে এসেছেন, তাঁরাই তাঁর আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছেন, তা সে কাছের মানুষই হোক বা দূরের।

কলকাতায় এলগিন রোডের বাড়িতে এ রকমই এক অপরিচিত যুবক সুনীল ঘোষ মৌলিকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সুভাষচন্দ্রের। মুর্শিদাবাদের পাঁচথুপির ছেলে সুনীল তখন কলকাতার স্কটিশচার্চ‌ কলেজের ছাত্র ছিলেন। ছাত্রাবস্থাতেই রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি হয়। উনিশ-কুড়ি বছর বয়সের মধ্যেই তিনি কংগ্রেস প্রাদেশিক কমিটির সদস্য হন। সেই সূত্রে তৈরি হয় শরৎ বসু-র সঙ্গে যোগাযোগ। তাঁরই অনুরোধে সুভাষচন্দ্র বসু মেদিনীপুরের কান্দি সাব-ডিভিশনের পাঁচথুপি গ্রামে এসেছিলেন।
                          
কংগ্রেসের দলীয় কাজে সে বার তিনি মুর্শিদাবাদে। এটা ১৯২৯ সালের কথা। কাজ হয়ে গেলে পাঁচথুপিতে সুনীল ঘোষ মৌলিকের বাড়ি যান। দূরের মানুষকে কাছের করে নিয়েছিলেন এক বিকেলেই। প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বেশী না হলেও উভয়েই শীঘ্রই পত্র-সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। সেখানেও সুভাষের মানবিক রূপ স্পষ্ট। যখনই সুনীলবাবু চিঠি দিয়েছেন, প্রত্যুত্তর দিয়েছেন সুভাষচন্দ্র। জানতে চেয়েছেন মুর্শিদাবাদের খবরাখবর। নিয়েছেন গ্রামের সংবাদ। দূরের বন্ধু বলে অবহেলা করেননি কখনও। এতটাই আন্তরিক।

এই সুনীল ঘোষ মৌলিক যখন বিবাহ করলেন, সুভাষচন্দ্র তাঁকে এক চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেখানে বৈবাহিক সম্পর্ক যে তাঁর কাছে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, তা জানলে অবাক হতে হয়। যদিও ব্যক্তি-জীবন, পারিবারিক জীবন তাঁর কাছে মূল্যহীন ঠেকে যদি না তা দেশকল্যাণে লাগে।

ব্যাজাস্টাইন থেকে ১৯৩৬-এর ১৭ই মার্চের সেই চিঠিতে সুনীল ঘোষের উদ্দেশ্যে সুভাষচন্দ্র বসু লিখেছিলেন,

"কুরহ্যাং,
ব্যাজাস্টাইন,অস্ট্রিয়া।

প্রীতিভাজেনেষু,

১৭/৩/৩৬

তোমার ২২শে জানুয়ারির চিঠি যথাসময়ে পেয়েছিলাম, কিন্তু নানা দেশে ঘুরছিলাম বলে সময় মত উত্তর দিতে পারি নাই। এখন এত বিলম্ব হয়ে গেছে যে ভাবছিলাম আর লিখে কি হবে। শেষে লেখাই স্থির করলাম।

এত দিনে তোমার শুভ বিবাহ হয়ে গেছে। এরূপ ঘটনা মানুষের জীবনে এক বারই হয় এবং এই ঘটনার উপর ভবিষ্যতের ভালোমন্দ অনেক কিছু নির্ভর করে। তাই আমি প্রার্থণা করি তোমার বিবাহিত জীবন সুখময় হউক এবং দেশের ও দশের হিতার্থে তোমাদের জীবন ব্যয়িত হোক। ব্যক্তিগত বা পরিবারগত সুখের মূল্য আমার কাছে মোটেই নাই যদি ব্যক্তি এবং পরিবারবর্গের জীবন দেশের কল্যাণে নিয়োজিত না হয়, তাই আমি বিশেষ করিয়া প্রার্থণা করি যেন তোমাদের জীবন দেশের ও দশের কল্যাণে ব্যয়িত হয়। তারমধ্যেই শ্রেষ্ঠ সুখ আনন্দের আস্বাদ নিশ্চয় পাবে।

তোমার সঙ্গে কবে আবার দেখা হবে জানি না— তাই খুব দূর থেকে এই শুভ ইচ্ছা তোমার কাছে পাঠাচ্ছি। আমার ভালোবাসা জানবে।

ইতি

শুভার্থী

শ্রীসুভাষচন্দ্র বসু।"
                           
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মরণীয় দিনগুলির মধ্যে ১৪ই এপ্রিল ১৯৪৪ এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। পঁচাত্তর বছর আগে এই দিনে আজাদ হিন্দ ফৌজের কর্নেল সৌকত মালিক ইম্ফল থেকে অল্প দূরে ময়রাং-এ ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। মিলিটারি ইতিহাসের বইতে দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মণিপুরের বিষেনপুর ময়রাং সেক্টরে প্রবল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল। এলাকার নিখতুখং গ্রামে হাড়গোড়ের পাহাড় জমে গিয়েছিল। ফলে নাকি ভূতের উপদ্রবও হয়েছিল। গ্রামবাসীরা শান্তিস্বস্ত্যয়ন করেছিলেন। এক ইংরেজ জেনারেল লিখে গিয়েছেন যে ঘোরতর যুদ্ধের মধ্যে তিনি হঠাৎ দেখেন গ্রামের এক কুটিরের দরজায় ভারী সুন্দর রাধাকৃষ্ণের ছবি আঁকা রয়েছে। জেনারেল সাহেবের মনে শান্তির প্রলেপ পড়েছিল।

ইম্ফল অভিযানের মিলিটারি নাম ছিল 'অপারেশন-ইউ'। ১৪ এপ্রিল ১৯৪৪ সালে, সৌকত মালিকের ইউনিট বাহাদুর গ্রুপের আজাদি সৈনিকরা আনন্দে আত্মহারা ছিলেন। তাঁদের যুদ্ধে সাথি জাপানের 'ফিফটিনথ আর্মি'র সেনারাও ছিলেন উৎফুল্ল। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে আর দু’চার দিনের মধ্যেই মণিপুরের ইম্ফল শহরের পতন হবে। তখন ইম্ফল শহর ছিল ইংরেজদের বড় ঘাঁটি। চার দিক থেকে অবরোধ করা হয়েছিল এই শহর, ব্রিটিশদের পালাবার কোনও পথ ছিল না।

কোহিমার দিক থেকে অবরোধ করেছিলেন শাহনওয়াজ খানের নেতৃত্বে 'সুভাষ ব্রিগেড'। বিষেনপুর ময়রাং সেক্টরে ছিল সৌকত মালিকের বাহাদুর গ্রুপ। প্যালেল-টামু পার্বত্য পথে পৌঁছে গিয়েছিলেন আইএনএ’র ফার্স্ট ডিভিশনের কমান্ডার মহম্মদ জমান কিয়ানি। সে দিক থেকে কর্নেল এনায়েত কিয়ানি গান্ধী ব্রিগেড নিয়ে মাঝে মাঝেই প্যালেল আক্রমণ করছিলেন। এক বার তিনি প্যালেল বিমানবন্দর দখলও করে ফেলেন।
                           
জাপানি সৈন্যবাহিনীর জেনারেল ফুজিয়ারা'র বক্তব্যে মায়ানমারের মেমিয়োতে এক মিলিটারি বৈঠকের কথা জানা যায়। বৈঠকে নেতাজি বলেছিলেন, ইম্ফল অবরুদ্ধ না করে অন্তত একটা দিক খুলে রাখা হোক, ইংরেজরা যাতে পলায়ন করতে পারে। কিন্তু জাপানি জেনারেল মুতাগুচির ইচ্ছা ছিল, সমগ্র ব্রিটিশ বাহিনী-সহ ইম্ফল তিনি দখল করবেন।

পরবর্তী কালে সকলে স্বীকার করেছেন, এই ভুল সিদ্ধান্তের জন্য ইম্ফল অভিযান ব্যর্থ হয়, এবং মিলিটারি ইতিহাসে তা ‘ইম্ফল ফিয়াস্কো’ নামে পরিচিত হয়।

বিষেনপুরে একটি ছোট পাহাড়ে আজও একটি ক্ষুদ্র পাথর বসানো আছে, তাতে খোদাই করা: ‘আইএনএ-র অজানা সৈনিকদের স্মরণে।’

সৌকত মালিক আদতে পঞ্জাবের বাহাওয়ালপুরের মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন এক বর্ণময় চরিত্র। তাঁর সম্পর্কে নানা কাহিনি প্রচলিত। তাঁর বক্তব্যে নেতাজি ও অন্যান্যদের নিয়ে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়।

ময়রাং দখলের পর সৌকত রেঙ্গুনে এলে নেতাজি একটি বড় সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন। সেখানে জাপানের ও বর্মার পদস্থ অফিসাররাও নিমন্ত্রিত ছিলেন। পানাহারের পরে সৌকত কিঞ্চিৎ মত্ত হয়ে পড়েন। মাঝে মাঝেই ‘নেতাজি’ বলে চেঁচিয়ে উঠছিলেন। এক বার তো এমন করলেন যে নেতাজি তাঁর দিকে ফিরে তাকালেন। তার পর অন্য দিকে ফিরে বা ম’র সঙ্গে আলাপ করতে লাগলেন। হবিব-উর রহমান এসে তাড়াতাড়ি সৌকতকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন।
                            
পর দিন খুব ভোরবেলায় সৌকত নেতাজির বাসগৃহে হাজির হলেন। এডিসি শামসের সিংহকে বলে নেতাজির সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। কোমর থেকে রিভলবার খুলে নেতাজির সামনে টেবিলে রাখলেন ও বললেন,

‘‘কাল আমি যা ব্যবহার করেছি তা আইএনএ অফিসারের উপযুক্ত নয়। আমি আর এ প্রাণ রাখব না। আত্মহত্যা করা মহাপাপ। কিন্তু আপনার হাতে শাস্তি পেলে আমি বেহেশত যাব।’’

নেতাজি শান্ত ভাবে চেয়ে বললেন, ‘‘সৌকত, তোমার কী প্রয়োজন জানো? একটু বিশ্রাম। তোমার ওপর দিয়ে অনেক ঝড় গিয়েছে, বিশ্রাম নাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।’’ 

এরপরে নেতাজি তাঁকে ব্যাঙ্ককে ছুটি কাটাতে পাঠিয়েছিলেন, খরচ করার জন্য কিছু অর্থও দিয়েছিলেন।

ইম্ফলের যুদ্ধে সৌকত মালিক বীরযোদ্ধা হিসেবে এক উজ্জ্বল নাম। তেমনই এক হাসিখুশি, মিশুকে মানুষ হিসেবে সহযোদ্ধাদের কাছে তিনি ছিলেন জনপ্রিয়। মণিপুর রণাঙ্গনে বীরত্বের জন্য নেতাজি সৌকত মালিককে ‘সর্দার-এ-জঙ্গ’ উপাধি প্রদান করেন।   
                           
যুদ্ধের সময় মনিপুরে থাকা আজাদ হিন্দ ফৌজের যোদ্ধাদের বক্তব্যে জানা যায়, নেতাজি যুদ্ধের মধ্যে সীমান্ত পার হয়ে চূড়াচাঁদপুরে প্রবেশ করেছিলেন। সেখানকার সাইকট গ্রামের রাজা অর্থাৎ জনজাতি প্রধান, যাঁর নাম ছিল 'কলবেল', তিনি সাক্ষাৎ করেছিলেন নেতাজির সাথে। ব্যবস্থা করেছিলেন নেতাজি ও তাঁর সাথে থাকা আজাদ হিন্দ ফৌজের বীর যোদ্ধাদের অতিথি সৎকারের। সম্প্রতি একটি বাংলা দৈনিকে তাঁর সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, চূড়াচাঁদপুরে আজাদি সৈনিকদের একটি ছাউনি ছিল। সেটা পরিদর্শন করতে নেতাজি এসেছিলেন। ওই স্থানে একটি পাহাড়ি এলাকায় একটি মস্ত ছাতিম গাছ আজও বর্তমান। সেই গাছের তলায় নেতাজি বসেছিলেন। ছাউনি থেকে বিশাল সেনার দল পাহাড়ের ঢালুতে বসেছিল। সে রাতে খুব চাঁদের আলো। রাজা কলবেল সৈনিকদের জন্য চায়ের ব্যবস্থা করেছিলেন, নেতাজিকে দিয়েছিলেন এক গ্লাস দুধ। নেতাজি বলেছিলেন,

‘‘আমার সৈনিকেরা যা খায়, আমিও শুধু তা-ই খেয়ে থাকি।’’

তবুও মাননীয় অতিথির প্রতি জনজাতি প্রথা মেনে তিনি সেই দুধ গ্রহণ করেছিলেন। নেতাজি বলেছিলেন, ‘‘তোমরা আমাদের সৈনিকদের খাদ্যসামগ্রী দিয়ে অনেক সাহায্য করেছ, দেশ স্বাধীন হলে আমরা সে কথা মনে রাখব।’’

এক টুকরো কাগজে কিছু লিখে নেতাজি, 'কলবেল' এর হাতে দিয়েছিলেন। ইংরেজরা ফিরে এসে এলাকা দখল করলে রাজা কলবেল একটি তোরঙ্গের মধ্যে সেই কাগজ রেখে মাটির তলায় লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, তোরঙ্গে জল ঢুকে সব কাগজপত্র নষ্ট হয়ে যায়। 

শাহনওয়াজ খান বলেছেন, নিষেধ না মেনে নেতাজি যুদ্ধের মধ্যে সীমান্তবর্তী অঞ্চল পরিদর্শন করতেন, মাঝে মাঝে ভারতে ঢুকেও পড়তেন।

নাগাল্যান্ডেও এ বিষয়ে জনশ্রুতি আছে। গবেষকের পক্ষে ক্রসচেকিং না করে তথ্য গ্রহণ করা সম্ভব নয়।

নেতাজি আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু পেছনে ফেলে গেছেন তার আন্তরিকতা, মানবিকতা আর দেশ কল্যাণের মহান আদর্শ। আজ হিংসা-দ্বেষ দীর্ণ সমাজে তাই তাঁর দৃষ্টান্ত বিশেষভাবে অনুসরণযোগ্য।
                             
(তথ্যসূত্র:
১- সুভাষের সঙ্গে বারো বছর, হেমন্তকুমার সরকার।
২- যোগীবর বরদাচরণ, অমরনাথ রায়, সদর প্রকাশনী (২০১৮)।
৩- আমাদের সুভাষচন্দ্র, পবিত্র সরকার, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ (২০১৫)।
৪- শ্রীসুভাষচন্দ্র বসু সমগ্র রচনাবলী (প্রথম থেকে দশম খন্ড), আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৫)।
৫- বিতর্কের বিন্যাসে সুভাষচন্দ্র, পিনাকী ভাদুড়ী, পুনশ্চ (২০১০)।
৬- মুর্শিদাবাদে সুভাষচন্দ্র, পুলকেন্দু সিংহ, শিল্পনগর প্রকাশনী (২০১২)।
৭- নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অপ্রকাশিত পত্রাবলি, আবুল আহসান চৌধুরী, শোভা প্রকাশ।
৮- দেশনায়ক সুভাষচন্দ্র, নিমাইসাধন বসু, আনন্দ পাবলিশার্স।
৯- সুভাষচন্দ্র, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ।
১০- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪শে জানুয়ারি ২০১৯ সালে প্রকাশিত দুটি প্রবন্ধ।
১১- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩শে জানুয়ারি ২০১৯ সাল।
১২- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ই এপ্রিল ২০১৯ সাল।
১৩- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬শে জানুয়ারি ২০১৮ সাল।
১৪- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪শে জানুয়ারি ২০১৮ সাল।
১৫- ২৩শে জানুয়ারি ২০১৯ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত তিনটি প্রবন্ধ।)
                           

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ