মূর্তি ভাঙ্গা : মতাদর্শের লড়াই?।। অনাবিল সেনগুপ্ত



ভারতে ব্রিটিশ শাসন বিরোধী পাঞ্জাবের বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন ভগৎ সিং, তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ। মৃত্যুর আগে তিনি তার সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন যেটি এখনো বিশেষভাবে সমাদৃত—  ‘ব্যক্তিকে সহজেই হত্যা করা যায়, কিন্তু আদর্শকে হত্যা করা যায় না। বড় বড় রাজ্য ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে কিন্তু আদর্শ টিকে থেকেছে ঠিকই’।
মৃত্যুর আগে কিউবার বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব চে গুয়েভারা বলিভিয়ার সৈন্যদ্যের উদ্দেশে বলেছিলেন “I know you have come to kill me. Shoot coward. You are only going to kill a man.”

ধ্বংস যখন ধ্বংসাত্মক :- 
বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি  ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তিগুলির মধ্যে অন্যতম। ২০০১ সালের মার্চ মাসে তালিবানদের হাতে ধ্বংস হয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে তৈরি প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরনো মধ্য আফগানিস্তানের বামিয়ান প্রদেশে ঐতিহাসিক বুদ্ধমূর্তি দুটি। ঐতিহাসিকদের মতে খ্রিস্টিয় ৩য় থেকে ১০ম শতক পর্যন্ত এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে প্রভাবিত যে বিশেষ ধরণের শিল্পকলা বিকাশ লাভ করেছিল, এগুলি সেই গান্ধার শিল্পেরই উৎকৃষ্ট নিদর্শন। ইউনেস্কো এই মূর্তিগুলিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু তালিবান নেতা মোল্লা মুহম্মদ ওমরের নির্দেশে ইসলামের দোহাই দিয়ে ২০০১ সালের মার্চ মাসে বড় মূর্তিদুটিকে পাহাড়ের গায়ে ডিনামাইট বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধ্বংস করা হয়।  গোটা বিশ্ব জুড়ে নিন্দার ঝড় উঠলো।  কিন্তু আঞ্চলিক সন্ত্রাসী কাজ কি আর হবে!
সম্বিৎ ফিরে পেতে দেরী হল না। স্রষ্টাকে সৃষ্টির ফল ভোগ করতে হবে কে জানতো? 
সেপ্টেম্বর ১১, ২০০১ এর হামলা (ইংরেজিতে 9/11 নামেও পরিচিত) সেপ্টেম্বর ১১, ২০০১ এর মঙ্গলবার সকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর আল কায়েদার (তালিবান সংরক্ষিত লাদেন বাহিনী) একইসাথে চারটি সমন্বিত সন্ত্রাসী হামলা। আক্রমনের ২,৯৯৭ জন নিহত এবং ৬,০০০ এর অধিক মানুষ আহত হয়, এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অধিক অবকাঠামো ও সম্পদ।
এইরকম উদাহরণ ইতিহাসে ইতিউতি ছড়িয়ে আছে।
বর্তমানে ত্রিপুরায় বিধানসভা নির্বাচনে জিতে বিজেপি সরকার গঠনের দাবীদার হয়ে উঠতেই, পূর্ববর্তী সরকারের আদর্শগত নেতা লেনিনের মর্ম্মর মূর্তিকে ভাঙ্গা হল! এই কান্ডে বহু বিজেপি নেতাদের আস্ফালন দেখাগেল।  রাজ্যের প্রধান সাংবিধানিক প্রধান রাজ্যপালও সংবিধানবিরোধী বক্তব্য রাখলেন এবং মনেকরিয়ে দিলেন তার পূর্ববর্তী রাজনৈতিক পরিচয়।
মনেকরিয়ে দিলেন পুড়নো ইতিহাস।  
বাবরি মসজিদ,  ভারতের উত্তর প্রদেশের, ফৈজাবাদ জেলার অযোধ্যা শহরের রামকোট হিলের উপর অবস্থিত একটি প্রাচীন মসজিদ। ১৯৯২ সালে একটি রাজনৈতিক সমাবেশের উদ্যোক্তারা, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুযায়ী মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় একটি রাজনৈতিক সমাবেশ শুরু করে যা ১৫০,০০০ জন সম্মিলিত একটি দাঙ্গার রূপ নেয় এবং মসজিদটি সম্পূর্ণরূপে ভূমিসাৎ করা হয়। ফলস্বরূপ ওই একই সালে ভারতের প্রধান শহরগুলোতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয় যা মুম্বাই ও দিল্লী শহরে ২০০০ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। মুসলিম রাজত্বের বহু বিখ্যাত ভাস্কর্য বা স্থাপত্যকে হিন্দুত্ববাদীরা চিহ্নিত করে এবং কাল্পনিক হিন্দু মন্দির ছিল বলে দাবী রাখছে!  দেশের ভিতরে ভয়ে ভক্তির বাতাবরণ তৈরিতে এরা ব্যস্ত। 
লড়াই ছড়াচ্ছে :-
ত্রিপুরায় লেনিন মূর্তির ভাঙ্গবার খরব ছড়িয়ে পড়তেই গোটা দেশজুড়ে বিজেপির মতাদর্শ বিরোধী দেশবরেণ্য বিভিন্ন নেতাদের মর্ম্মর মূর্তিকে ভাঙ্গার খবর। 
উত্তরপ্রদেশে ভীমরাও রামজি আম্বেদকর মূর্তি ভাঙ্গা হল; যিনি ভারতের সংবিধান রচয়িতার একজন।  আম্বেদকর সারাটা জীবন সামাজিক বৈষম্যতার (Social Discrimination), “চতুর্বর্ণ পদ্ধতি”-হিন্দু সমাজের চারটি বর্ণ এবং ভারতবর্ষের অস্পৃশ্য (Untouchables or Untouchables community) প্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছেন। ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির এক নেতার ফেইসবুকে দেওয়া হুমকির কয়েকঘণ্টার মধ্যে তামিলনাডুতে দ্রাবিড় ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আইকন, সমাজকর্মী 'পেরিয়ার' নামে পরিচিত ইভিআর রমাসামির মূর্তি ভাংচুর হয়েছে। সমাজকর্মী পেরিয়ার ভারতে ‌'আত্ম-সম্মান আন্দোলন' ও দ্রাবিড় ভাষাভাষীদের প্রথম সংগঠন দ্রাবিড়ার কাজাঘামের সূচনা করেন। হিন্দুত্ববাদীদের অন্যতম প্রধান আদর্শিক নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর একটি মূর্তি হাতুড়ি দিয়ে কিছুটা ভেঙ্গে তার ওপরে কালো কালি লাগিয়ে দিয়েছে কলকাতার কয়েকজন অতি-বামপন্থী ছাত্রছাত্রী। পুলিশ সেখান থেকে সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এই গ্রেপ্তার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আন্দোলনকারীরা প্রশাসনিক ব্যবস্থা শুধু তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হচ্ছে এবং শুধু এই রাজ্যেই!  এর মধ্যেই পশ্চিম বর্ধমানে মাইকেল মধুসূদন দত্তের মূর্তি ভাঙ্গার চেষ্টা করা হয়েছে! অনেকেই লিস্ট বলেছেন রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর থেকে নেতাজী কাউকে নাকি বাদ দেবে না এরা! 
তবে বিশ্লেষকদের মতে প্রশ্ন অন্য :-  মতাদর্শগত নেতাদের মূর্তি ভেঙ্গে দেওয়ার পেছনে কী তাহলে বামপন্থী আর হিন্দুত্ববাদী - এই দুই সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর রাজনৈতিক আদর্শের লড়াই-ই কাজ করেছে?
জবাব দিলেন  রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক বিমল শঙ্কর নন্দ  "এতদিন বৌদ্ধিক পর্যায়ে সংঘাতটা ছিল বামপন্থী আর জাতীয়তাবাদী, অর্থাৎ আপনি যাদের হিন্দুত্ববাদী বলছেন, তাঁদের মধ্যে। বামপন্থী বুদ্ধিজীবিরাই ইতিহাস ব্যাখ্যা করে এসেছে এতদিন। কিন্তু জাতীয়তাবাদীরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর তাদের মতাদর্শের সমর্থক বুদ্ধিজীবিরা ইতিহাস সমাজ নতুন করে ব্যাখ্যা করছেন এখন।"  "তাই এই সংঘাতটা ইন্টেলেকচুয়াল পর্যায়ে আছেই। তবে নতুন যেটা যোগ হয়েছে, তা হল ওই দুই মতাদর্শের লড়াই এখন তৃণমূল স্তরেও প্রকট হচ্ছে। এটা সম্ভবত তারই বহি:প্রকাশ।"
 মূর্তি না ভাস্কর্য লড়াই দুনিয়া জুড়ে :-
বাংলাদেশ দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয়েছিল দৃষ্টিনন্দন এক ভাস্কর্য। বাংলাদেশের আদালত প্রাঙ্গণে এই প্রথম কোনো ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছিল। ভাস্কর্যটির স্থাপত্যশৈলী নান্দনিকতার এক অনন্য নিদর্শন। রোমানদের কাছে এই ‘লেডি জাস্টিস’ ন্যায় বিচারের প্রতিকৃতি।  সুপ্রিম কোর্টের সামনে ‘গ্রিক দেবীর মূর্তি’ স্থাপন করা হয়েছে—এমন দাবি করে এর অপসারণের দাবি করে আসছিল হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মভিত্তিক নানা সংগঠন। ওদের বক্তব্য হল, ভাস্কর্য শিল্পের নামে ইসলামি সংস্কৃতির বিরোধিতা করা এবং অন্ধকার যুগের পৌত্তলিক সংস্কৃতি-কে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। ওই ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা হয়।  
এই প্রশ্ন তখনই উঠে মূর্তি না ভাস্কর্য?
ভাস্কর্য অর্থ : Sculpture (স্কালপচার)। যে আকৃতি বা ছবি খোদাই করে তৈরি করা হয় তা-ই ভাস্কর্য। যেমন বলা হয় ‘ভাস্কর্য বিদ্যা’ এর অর্থ, The art of carving বা খোদাই বিদ্যা। যিনি এ বিদ্যা অর্জন করেছেন তাকে বলা হয় ভাস্কর (Sculptor) অর্থাৎ যিনি খোদাই করে
আকৃতি বা ছবি নির্মাণ করেন। যেমন আছে অক্সফোর্ড অভিধানে- One who carves images or figures. অর্থাৎ যে ছবি অথবা আকৃতি খোদাই করে তৈরি করে। পক্ষান্তরে মূর্তি অর্থ ছায়া বা এমন আকৃতি-শরীর, যার ছায়া আছে। মূর্তি অর্থ দেহ, শরীর, আকৃতি চেহারা, রূপ। ভাস্কর অর্থ ধাতু প্রস্তর প্রভৃতি দ্বারা মূর্তি নির্মাণকারী। আর ভাস্কর্য অর্থ উক্ত ভাবে মূর্তি নির্মাণশিল্প। সংসদ বাংলা অভিধান ৪৬৮, ৫০৩ সুতরাং মূর্তি এবং ভাস্কর্য একই জিনিস; দুটির মাঝে শাব্দিক পার্থক্য ছাড়া কোনো পার্থক্য নেই। 
ইসলামে মূর্তি পূজা নিষিদ্ধ।  ইসলামে যে কোনো প্রাণীর প্রতিকৃতি নির্মাণ নিষিদ্ধ তাই ভাস্কর্য ও নিষিদ্ধ।   আবার  আমেরিকার বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনেস্বামী বিবেকানন্দ মূর্তি পূজার প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, "Hindus are not idol-worshiper. They are ideal-worshipers" অর্থাৎ হিন্দুরা মূর্তি পূজক নন, তাঁরা আদর্শের পূজারী। মূর্তি হলো একটি আদর্শের প্রতীক মাত্র। কিন্তু হিন্দুরা কখনই সেই মূর্তিকে ইশ্বর বলে না, সেই প্রতিমা ইশ্বরের প্রতীক মাত্র। কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলে! 
শাষকের মূর্তি স্থাপন :-
বিভিন্ন সময় বিপুল অর্থ ব্যয় করে অনেক বিতর্কিত কাজের জন্য গণমাধ্যমে খবর হয়েছেন ভারতের উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী। তবে এবার টাকার মালা পরে বা জুতা আনতে বিমান পাঠিয়ে নয়, তাঁর স্বপ্নের প্রকল্প বাস্তবে রূপ দিতে ৬৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করছেন একটি পার্ক। এটির নাম ভিম রাও আম্বেদকার পার্ক। উত্তর প্রদেশের নয়ডা এলাকায় ৩৩ হেক্টর জমির ওপর পার্কটি গড়ে তোলা হয়েছে। মায়াবতীর ব্রোঞ্জের মূর্তির পাশাপাশি এখানে দলিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে বি আর আম্বেদকার, জ্যোতিরাও ফুলে ও কাশীরামের ১৫টি মূর্তি শোভা পাবে। অন্যান্য মূর্তির পাশাপাশি ২০টি হাতির মূর্তিও স্থাপন করা হবে। সরকারী টাকায় এই অপচয়ের, জনস্বার্থ মামলায় কোর্ট বলে জনগণকেই দায়িত্ব নিতে জনপ্রতিনিধি করে নির্বাচিত করার দায়। 
গুজরাটের সর্দার সরোবরের ধারে ৩ হাজার কোটি টাকার সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের ১৮২ মিটার দীর্ঘ মুর্তি বসানোর কাজ চলছে। একে জাতীয় প্রকল্পের তকমা দিয়েছে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার। বিশ্বের দীর্ঘতম এই মুর্তি ভারতীয় সংহতি ও বিশালত্বের প্রতীক বলে দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু মেক ইন ইণ্ডিয়ার নামাবলী ধারণকারীর দেশের বদলে তা চিনে তৈরি করার কী দরকার ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। 
যাইহোক,  মূর্তি বা ভাস্কর্য স্থাপন  দুটোই অস্তিত্ব বজায় রাখবার বা স্মৃতিতে অস্তিত্ব রাখবার কৌশল করেছে শাষক শ্রেণী। 

ভেঙ্গেছে বহু মূর্তি বিদেশে :-
১) ২০১৬ সালে চীনে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মাও সেতুংয়ের  হেনান প্রদেশের একটি খোলা মাঠে ৩৭ মিটার উঁচু সোনালি রঙের বিশাল আকৃতির মূর্তিটি ভেঙে ফেলার অভিযোগ উঠেছে। সরকারের অনুমোদন না নিয়ে এ মূর্তিটি ওখানে স্থাপন করায় সেটিকে ভেঙে ফেলা হয়েছে বলে চীনা কমিউনিস্ট সরকারের মুখপত্র পিপলস ডেইলির এক খবরে বলা হয়েছে।
২)  ইউক্রেনে লেনিনের সহস্রাধিক মূর্তি ধ্বংস
বিলুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ছিল ইউক্রেন। আর সে কারণে ইউক্রেনের আনাচে-কানাচে কমিউনিস্ট নেতা ভ্লাদিমির লেনিনের মূর্তি ছিল অসংখ্য। সোভিয়েত যুগের সব চিহ্ন সরিয়ে ফেলার পাশাপাশি লেনিনের মূর্তিগুলোও সরিয়ে ফেলার উদ্যোগ নেয় ইউক্রেন সরকার। অনেকেই মূর্তি ও স্মৃতিচিহ্নগুলো ধ্বংসের সমালোচনা করেছেন। তারা বলছেন, এ ঘটনায় শুধু নাম কিংবা ভাস্কর্যই ধ্বংস হচ্ছে না, পাশাপাশি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সোভিয়েত যুগের ইতিহাসও। সোভিয়েত যুগের পরিসমাপ্তি ঘটার প্রায় দুই যুগ পরেও ইউক্রেনের বিভিন্ন স্থানে সগর্বে দাঁড়িয়ে ছিল লেনিনের অসংখ্য মূর্তি। তবে ইউক্রেনের বর্তমান সরকার কমিউনিস্ট যুগের এ স্মৃতিচিহ্ন রাখতে মোটেও আগ্রহী নয়। সম্প্রতি ইউক্রেনের শহর ও গ্রামে থাকা ১৩২০টির মধ্যে সবগুলো মূর্তিই সরিয়ে ফেলেছে ইউক্রেন সরকার। ২০১৫ সালের মে মাসে ইউক্রেন সরকার সোভিয়েত আমলের সব স্মৃতিচিহ্ন সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্তটি আইন হিসেবে পাস করার উদ্যোগ নেন প্রেসিডেন্ট পেট্রো পরোশেনকো।
৩) ২০১৫ সালে নিমরুদ শহরের ঐতিহাসিক নিদর্শন তিন হাজার বছরের পুরনো ইরাকের প্রাচীন নিমরুদ নগরী গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাকে যুদ্ধাপরাধ বলে মন্তব্য করেছে জাতিসংঘের সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা- ইউনেস্কো। ইরাকি কর্মকর্তারা বলছেন, ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা বুলডোজার দিয়ে শহরের তিন হাজার বছরের পুরনো প্রাচীর ও ভাস্কর্য মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। টাইগ্রিস নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই নিমরুদ ছিলো আসিরিয়ান সাম্রাজ্যের রাজধানী। ইসলামিক স্টেট বলছে, এই নিদর্শনগুলো ইসলামসম্মত নয় তাই এগুলোকে ধ্বংস করা প্রয়োজন। ইউনেস্কোর প্রধান ইরিনা বোকোভা বলেছেন ত্রয়োদশ শতাব্দীর এই প্রাচীর ও ভাস্কর্যগুলো ছিল প্রাচীন ইরাকি সমাজ ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন এবং সেগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করা যুদ্ধাপরাধেরই সামিল।
দেখাই যাচ্ছে উপরের ঘটনাদিরর উদাহরণ গুলি থেকে দেশ কাল সাংস্কৃতি পাত্র ভেদে মূর্তি বা ভাস্কর্য ভাঙ্গবার মধ্যে একটা পরিকল্পিত মতাদর্শ কাজ করেছে।  যা সমাজে হিংসার বাতাবরণ তৈরি করে।

বর্তমান সময়ে  ভারতে মতাদর্শের দ্বন্দ্ব :-
বিজেপি তো কংগ্রেস কে হারিয়ে অনেক রাজ্যেই ভোটে জিতেছে। কিন্তু তারপরে সেখানে জওহরলাল নেহরু বা ইন্দিরা গান্ধীদের মূর্তি ভাঙ্গার কোন সংবাদ পাওয়া যায় নি! তাহলে কেন কোথাও লেনিন বা কোথাও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর মতো যারা দুই মতাদর্শের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা - তাদের মূর্তি ভাঙ্গা হচ্ছে? স্বাধীনতার আগে থেকেই কংগ্রেস ছিল একটা মঞ্চ। সেখানে বামপন্থীরাও যেমন থেকেছেন, তেমনই দক্ষিণপন্থীরাও ছিলেন। তাই সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কংগ্রেসই বিজেপি-র প্রধান প্রতিপক্ষ হলেও তাদের সঙ্গে সেভাবে মতাদর্শের লড়াই হয়নি হিন্দুত্ববাদীদের।" "কিন্তু বামপন্থীদের সঙ্গে তাদের চরম মতাদর্শগত বৈরিতা। তাই কেরালায় যেটা অনেকদিন ধরেই আমরা দেখছি - দুই মতাদর্শের লড়াই - এবার সেটা কিছু কিছু দেখা যাচ্ছে ত্রিপুরার মতো জায়গাতেও। 
 এটা যে দুই মতাদর্শগত বিরোধের প্রকাশ, তা ঠিক। কিন্তু এর মধ্যে পরমত অসহিষ্ণুতা বেশি প্রকাশ পাচ্ছে - যেখানে অন্য মতের আদর্শিক নেতাদের মুখ দেখবোই না - এরকম একটা চিন্তা প্রকাশ পাচ্ছে। এটাই সবথেকে ভয়ের। এর থেকেই সামাজিক বৈরিতা সৃষ্টি। 
অনেকে বলছেন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরেও তো সেখানে লেনিন মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, সেখানে লেনিনকে দেখা হত রাষ্ট্রশক্তির প্রতীক হিসাবে। ত্রিপুরায় লেনিন তো রাষ্ট্রশক্তির প্রতীক ছিলেন না, সেখানে তিনি মতাদর্শের প্রতীক ছিলেন। মূর্তি ভাঙ্গা বা তাকে কেন্দ্র করে মতাদর্শগত সংঘাতের অসহিষ্ণুতার বহি:প্রকাশ কতটা ছড়িয়ে পড়বে, তা বলা কঠিন।
কিন্তু সর্বভারতীয় স্তরে বৌদ্ধিক পর্যায়ে দুই মতাদর্শের মধ্যে সেই সংঘাত চলতে থাকবে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
                   

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ