রাম কা নাম না বদনাম করো।। রাণা


"প্রথমে পিতার কাছে করে নিবেদন।
আদিকান্ড গান কৃত্তিবাস বিচক্ষণ।।"

ফুলিয়া নিবাসী কৃত্তিবাসের হাত ধরে বাংলায় রামায়ণ মহাকাব্য জনপ্রিয়তা লাভ করে। কৃত্তিবাস বাল্মিকী রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ করেননি। তাই কৃত্তিবাসী রামায়ণে বাংলার মাটির টান সুস্পষ্ট।

"রত্নাকর বলে, যত লয়ে যায় ধন।
মাতা পিতা পত্নী আমি খাই চারিজন।।
যেবা কিছু বেচি কিনি চারিজনে খায়।
আমার পাপের ভাগি চারিজনে হয়।।"

কৃত্তিবাস আদিকবি বাল্মিকীর কাহিনীটুকু নিয়েছেন। বাকিটুকু যা রচনা করেছেন তাতে বাংলার মাটির গন্ধ। দস্যু রত্নাকর থেকে বাল্মিকী উত্থানের কাহিনীতেও বাংলার "দুমুঠো খাবারের" চির উৎকণ্ঠা যোগ করে দিয়েছেন।
দূরদর্শন ও আকাশবাণী পূর্ববর্তী যুগে কৃত্তিবাসী রামায়ণ-ই ছিল বাংলার গৃহবধূ, বৃদ্ধা ও কন্যাদের সান্ধ্যিক বিনোদন। অস্ত্রের ঝনঝনানি থেকেও কৃত্তিবাস এই মহাকাব্যে সাংসারিক কূটকচালি ও বাংলার আবহমানকালের পারিবারিক দ্বন্দ্ব নিপুণভাবে মিশিয়েছেন।
কৃত্তিবাস এর সাথে বাংলার হিন্দুদের ভক্তিভাব মিশিয়ে বাংলার মহাকাব্য রচনা করেছেন। যে রামায়ণ উত্তর ভারতীয় রামায়ণের থেকে বহুযোজন দূরে।

"পিতার আজ্ঞায় রাম যাইবেক বন।
সঙ্গেতে যাবেন তাঁর জানকী লক্ষণ।।
সীতারে হরিয়া লবে লঙ্কার রাবণ।
সুগ্রীব সহিত রাম করিবে মিলন।।
বালিকে মারিয়া তারে দিবে রাজ্যভার।
সুগ্রীব করিয়া দিবে সীতার উদ্ধার।
দশ মুন্ড বিশ হাতে মারিয়া রাবণ।
অযোধ্যায় রাজা হইবেন নারায়ণ।।"

কৃত্তিবাসী রামায়ণে বারেবারে পারিবারিক ও বন্ধুত্বের আদর্শকে উর্দ্ধে তুলে ধরা হয়েছে। তাই রামের সহযোগী হয়েও বিভীষণ বাঙালির কাছে ঘৃণিত 'ঘরশত্রু বিভীষণ' হয়ে যায়।
এখানে রাম নিমিত্ত মাত্র। মূল আরাধনা করা হয়েছে নারায়ণকে। তাই বাংলায় নারায়ণের পূজো হয়, রামের হয় না। আবার নারায়ণ পূজো হয় মুসলিম সত্যপীরের সাথে মিশিয়ে, যা বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সত্যনারায়ণ পূজো বলে বিখ্যাত।

আজ যারা হিন্দুধর্মের বিধান প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন এবং যাকে সামনে রেখে এগোতে চাইছেন, চতু্ঃবর্ণ প্রথা অনুসরণ করলে ওনার উচিৎ ছিল গোদোহন করে তাদের ধার্মিক বিধিনিষেধ অনুসরণ করা। তিনি তা না করে উত্তর ভারতীয় কট্টর সংস্কৃতি দোহন করে বাংলার কৃষ্টিকে বিনষ্ট করতে চাইছেন। রামনবমীর নামে সমর্থকদের মাথায় জয় শ্রীরাম ফেট্টিও হিন্দিতে লেখা। এরা বাংলাকে ভালোবাসেন না। এরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলার জন্য গর্ববোধও করেন না। নিজেদের সংস্কৃতির প্রতি আবেগ থাকলে অস্ত্র নিয়ে রামনবমী পালনের আগে অন্তত কৃত্তিবাসী রামায়ণের আদিকাণ্ড পড়তেন।
বাংলায় ধর্মের মধ্যে কখনো অস্ত্রের ঝনঝনানি ছিল না। মঙ্গলকাব্যগুলো বাংলার সেই ঐতিহ্য বহন করে এসেছে। এখানে পূজো মানে অনেকটা উৎসবের মত। উত্তর ভারতীয়দের মতো বিধিনিষেধ নেই। এখানে দূর্গাপূজো মানে পারিবারিক, বারোয়ারি বা সর্বজনীন। তবে মহাকাব্যের চরিত্র রামকে নিয়ে যেভাবে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকে শোভাযাত্রা ও দাঙ্গাহাঙ্গামা হচ্ছে, তাতে বাঙালি হিন্দুদের নমনীয় ধার্মিকভাবকে ঘোরতর আঘাত করা হচ্ছে। এই সংস্কৃতি গুজরাট বা উত্তর ভারতীয় থেকে আগত।
ধর্মের নামে আজ আমাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে চাইছে। বাংলার ইতিহাসকে ভুলিয়ে দিতে চাইছে। আজ এরা ইতিহাস মানে বলে মারাঠা নেতৃত্বে হিন্দু জনজাগরণের কথা। কিন্তু মারাঠাদের বাংলার প্রতি অবদান কী?

"খোকা ঘুমলো, পাড়া জুড়লো।
বর্গী এল দেশে।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে?"

এখনো বাংলার শিশুকে মারাঠা বর্গীদের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়। মারাঠা বর্গীদের আতঙ্কের কথা তিনশ বছর পরেও বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যায়নি। আমরা কি বাংলা লুণ্ঠনকারী সেই মারাঠা দস্যুদের ইতিহাস পড়ব? আর যার নেতৃত্বে এই মারাঠা লুঠেরাদের দমন করা হয়, তিনি ছিলেন মুসলিম। নবাব আলিবর্দি খান ভাস্কর পন্ডিতকে দমন করে বাংলায় বর্গী হামলা বন্ধ করেন। বর্তমানের সাংস্কৃতিক লুঠেরারা তো আলিবর্দি খানের কথা বলেন না!

বাঙালিরা বরাবর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে রুখে দাঁড়িয়ে নিজ সংস্কৃতিকে রক্ষা করে এসেছে। আমাদের পূর্বপুরুষদের সেই ঐতিহ্য রক্ষার দায় আমাদের।
ধর্মের সাথে রাজনীতি মিশে গেলে তার পরিণতি কী হতে পারে, বাঙলিদের থেকে বড় ভুক্তভোগী আর কারা আছে? আমরা কি ভুলে যাব মুসলিম লিগ কর্তৃক ১৯৪৬ সালের দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং? আমরা কি ভুলে যাব নোয়াখালির দাঙ্গা? আমরা কি ভুলে যাব বাংলার হৃদয় চিরে কাঁটাতারের দাগ?
আমরা ভুলিনি বলেই পশ্চিমবঙ্গে ধর্মের কারবারিদের অপাংক্তেয় করে রেখেছিলাম। আমরা ভুলিনি বলেই পশ্চিমবঙ্গ ধর্মীয় সহিষ্ণুতায় গোটা দেশের কাছে উদাহরণ স্বরূপ। আজ আবার দিল্লীর শক্তির নজর বাংলার দিকে। এরা শুধুই ধর্মের নামে বাংলাকে অশান্ত করে আমাদের নবজাগরণকে দুর্বল করে দিতে চায়।
আমাদের শেষ শক্তি দিয়েও গোবলয়ের দালালদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতেই হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ