পর্ব- সামাজিক বিবর্তনীয় সারল্যাংশ..! || চার্বাকী


মানব সভ্যতার শুরুতে আমরা যদি ফিরে তাকাই শুরুতে মানুষ নগ্নতাকেই স্বাভাবিক হিসাবে গ্রহণ  করেছে। পেটের তাগিদ মানুষকে শিকার করতে শিখিয়েছে, শিখিয়েছে আগুন জ্বালাতে। শিকারের প্রয়োজন মানুষকে দলবদ্ধ করেছে তৈরী হয়েছে সমাজ।

প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে নিজেকে আর নিজের শরীরকে বাঁচাতে মানুষ প্রয়োজন অনুযায়ী শরীরকে ঢাকতে শিখেছে, সুচনা করেছে 'পোশাক'-এর। আফ্রিকার মানুষ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে রং দিয়ে ঢাকত, আবার একই সময় ফ্রান্সের মানুষ আভরণ হিসাবে কাজে লাগিয়েছে ভেড়া বা পশুর চামড়া। পোশাকের এই বৈষম্য তৈরি হয়েছে তাপমাত্রার কারণে। এই ধারাবাহিকতা আমরা এখনো বয়ে চলেছি; বর্ষাতে বর্ষাতি, গরমে সুতি আর শীতে পশমের পোশাক অর্থাৎ প্রয়োজন ও পরিবেশ অনুযায়ী পোশাকের রকমফের।

প্রাকৃতিক চাহিদার সাথে হাত ধরে এগিয়েছে সামাজিক চাহিদাও, মানুষ সব থেকে বুদ্ধিমান সামাজিক জীব, তাই তার মধ্যে অন্যান্য অনুভূতির চাহিদা যেমন প্রকৃতি প্রদত্ত, তেমনি লজ্জাও আমাদের আর পাঁচটা অনুভূতির মতই স্বাভাবিক। আর পোশাক আমাদের সাহায্য করে লজ্জানুভুতিকে ঢাকতে। অর্থাৎ একটু গুছিয়ে বললে- পোশাক হবে পরিবেশ প্রয়োজন অনুযায়ী, যা আমাদের শ্লীলতাকে বজায় রাখবে। যদিও শ্লীলতা আর অশ্লীলতার মধ্যে সীমারেখা নির্ধারণ করতে পারাটা খুব কঠিন, তবুও সহজ ভাষায়- যেটা নির্দ্বিধায় প্রকাশ করা যায় সেটাই শ্লীলতা, আর তা সবার জন্যে কল্যাণকর ও পরিবেশ উপযোগী।

তাহলে প্রশ্ন আসতেই পারে এক সময় নারীদের শরীরের যেকোন অংশ প্রকাশ্যে আসাটাকেও অশ্লীল মানা হত; বলা হতো- নারী হচ্ছে 'অসূর্যব্যমপাশ্যা', অর্থাৎ এক কথায় সূর্যালোক নারী সমাজের জন্যে নয়। কিন্তু আজ আমদের পোশাক সেই সময়ের পোশাকের ধারণার সাথে খাপ খায় না, কারন সেই সময়ের পোশাক এখনকার পরিবেশ, সময় ও প্রয়োজনের চাহিদাকে মেটায় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে- যখন কোন মহিলা শ্রমিক ইট ভাটায় তাঁর দুধের শিশুকে কোলে নিয়ে গরমে ইট বইছে তখন তার শাড়ি হাটুঁর উপর, শিশু স্তন পানরত হওয়ায় তার স্তন এর কিছু অংশ প্রকাশ্যে আসার কারনকে কি কোনভাবে অশ্লীলতা বলতে পারি? অন্য পরিস্থিতিতে সেটাই আবার অশ্লীল; কিন্তু কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের (প্রথাগত ভাবে মানা!) মানুষ আজো ঠিক করে নারী সমাজ কি পোশাক পড়বে, ইসলামী সমাজব্যবস্থায় তার একটা বড় প্রভাব দেখা যায়।

ধর্ম কি? যে ধারণ করে সেই হলো ধর্ম। ধর্ম হলো তাই যা মানুষের ন্যায় নিষ্ঠাকে ধরে রাখবে। যা মানুষকে বিপথগামী হতে দেবেনা। তাই ধর্ম কখনোই সন্ত্রাসের প্রশ্রয় দিতে পারে না। সেই দৃষ্টিকোণে যদি গ্রহণ করতে পারি তাহলে- হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইহুদিসহ বিভিন্ন জাতিগত বিশ্বাস, যেগুলোকে তারা ধর্ম বলে প্রচার করছে এগুলোকে আমরা এক একটা মতবাদ হিসেবে ধরতে পারি, আর কোনো মতবাদ কখনোই আমাদের ধর্ম হতে পারেনা। আমরা মানুষ, মানব ধর্মই কেবল আমাদের ধর্মের পরিচয়; কোন মতবাদকে পূর্ণাঙ্গ বা আংশিক আমরা মানতে পারি জীবনে চলার পথের সহযোগী হিসেবে অবশ্য যদি তা যুক্তিযুক্ত হয়, কিন্তু তা আমাদের ধর্ম হতে পারে না।

মন্ত্র আমাদের কে সাহায্য করতে পারে আমাদের ধর্মকে রোজের জীবনে মনে রাখতে, মন্ত্র মানে মনন। মন্ত্র কিন্তু অং বং চং না, মন্ত্র হচ্ছে অনুধ্যান অর্থাৎ যা আমরা মনের মধ্যে ধ্যান করি। সহজ কথায়- যা মনে রাখা উচিৎ। প্রাচীন গ্রন্থে প্রকৃতিজ অনেক বিষয়কে মন্ত্রের মাধ্যমে পূজনীয় করে গড়ে তোলা হয়েছে, তার মানে তাদের উপযোগিতা রোজকার জীবনে উপলব্ধ হোক; এর মানে যদি কেউ সেই উপযোগকেন্দ্রিক পার্বণ বা প্রার্থনাস্থল ভেবে, তার প্রতিষ্ঠাকে ধর্ম বানাতে চায়, তাহলে সেটি উগ্রতা আর পাগলামোর নামান্তর মাত্র, যা শোসনের হাতিয়ার হবে; যেমন- মন্ত্রে নদ-নদীর উল্লেখ পাওয়া যায় সেখানে নদীকে 'মা'-এর জায়গায় রাখা হয়েছে; আমরা যদি নদীকে আমাদের মননে রাখি, তাকে পরিষ্কার রাখি তাহলে- পরিবেশ দূষন, খাদ্যাভাব বা ব্যবসা-বাণিজ্যে অপ্রতুলতা থেকে বাঁচতে পারি, এটি মন্ত্রের যথার্থতা।

ইসলাম মতবাদালম্বিরা নারী পোশাক নিয়ে যে বিধিনিষেধ আরোপ করে তার ভিত্তি যে পোশাকের সংজ্ঞার সাথে চলেনা তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। কিভাবে? আরব ভূমিকেই মূলত ইসলামের উৎসভূমি মানা হয়। আরব মরুভূমির দেশ; বালিঝড়, দিনে প্রখর সূর্যালোক আর রাতে তীব্র ঠাণ্ডা, স্বভাবতই শরীরের বেশি অংশকে আবৃত করবে এমন পোশাক'ই পরিবেশ উপযোগী, যা ইসলাম ধর্মালম্বি পুরুষ নারী উভয়ের মধ্যেই লক্ষ্যণীয়। কিন্তু তা আমাদের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার উপযোগী না, এটা আজো আমরা উপলব্ধি করতে দেখিনি। কোন মতবাদকেই আমরা অন্ধভাবে যেমন গ্রহন করতে পারিনা, তেমনি কাউকে মেনে চলতে বাধ্য করতেও পারিনা।

সারা পৃথিবীর মধ্যে সৌদিআরব এমন একমাত্র দেশ যেখানে নারীদের গাড়ি চালানো সহ বহুক্ষেত্রিক  নিষেধাজ্ঞা সবথেকে বেশি। যদি তর্কের খাতিরে কোন মতবাদকে মানিও এবং তাকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নাম দিয়ে প্রচারিত করি, তাহলেও এটা স্মরণযোগ্য যে- সব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মেই বলা হয়েছে- যখনই ধর্মের মধ্যে গ্লানি আসবে তখনই তা সংস্কার করতে আসবে নতুন নবী বা অবতার বা দূত। কাজেই মতবাদ অর্থাৎ মানবসৃষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের নিয়মাদি কিন্তু সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিবর্তনশীল, কোন ধ্রুব সত্য নয়।

সব শেষে বলা যেতে পারে, আমরা যে মতবাদকে রোজের জীবনে মানছি তা অনেকটাই নির্ভর করে সেই দেশের শাসকদল কতটা রক্ষনশীল মানসিকতা নিয়ে চলে তার উপর; তাই নিজের সাথে সাথে আমাদের পরিসরের সমাজকেও যুক্ত করতে হবে মুক্তমনে যুক্তি দিয়ে একসাথে এক অখণ্ড সুস্থ মানসিকতার সমাজ গড়তে, একটি বৈষম্যহীন পৃথিবী গড়ার জন্য...!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ