ধর্ম মানুষকে হিন্দু, মুসলিম,খৃস্টান, আরো কতো কী বানায়, কেবল ‘মানুষ’ বানায় না।।গিয়াস_উদ্দিন


আদিম যুগে ধর্মের জন্ম হয়েছিলো প্রধানত অজ্ঞতা, ভয় ও আতঙ্ক থেকে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলতো, জঙ্গলবাসী বিষাক্ত সাপ ও পোকা-মাকড় এবং হিংস্র পশুর ভয়েও সদা ত্রস্ত থাকতো। এইসব বিপদ থেকে রক্ষা পেতে মানুষ নানা দেবদেবী ও অলৌকিক শক্তির কল্পনা করে তাঁদের সন্তুষ্ট করতে নানা আচার-অনুষ্ঠান করতো। এগুলোই পরবর্তীকালে ধর্মরূপে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা পায়। সেকালের ধর্মের কেন্দ্রে স্বভাবতই যেমন ঈশ্বরের ধারণা ছিলোনা, তেমনই ছিলোনা পরকালের ধারণা। হাজার হাজার বছর ধরে মানবসমাজে ধর্ম বলতে এরকমই ছিলো। অনেক কাল পরে ধর্মের সঙ্গে ঈশ্বর তথা স্রষ্টার ধারণা যুক্ত হয়। সেটা এমনি এমনি হয়নি। একদল মানুষ আর একদল মানুষকে ঠকাবার জন্যে, শাসন ও শোষণ করার জন্যে ধর্মকে হাতিয়ার করে নেয়। তখন থেকেই ধর্ম হয়ে ওঠে ঈশ্বরকেন্দ্রিক। এই নিবন্ধের আলোচনা এই ‘ঈশ্বরকেন্দ্রিক_ধর্ম’ [Religion] নিয়েই।

ধর্ম, ধর্মীয় মৌলবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি পরস্পরের পরিপূরক। ধর্ম থেকে উৎপত্তি ধর্মীয় মৌলবাদের এবং ধর্মীয় মৌলবাদ থেকে উৎপত্তি ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির। এটাই সঠিক সমীকরণ। কিন্তু এই সমীকরণটি ভুল বলে নিরবচ্ছিন্ন প্রচার করা হয় অথবা এই সমীকরণটি গোপন করার অপচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। ধর্ম ভালো, আর ধর্মীয় মৌলবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদীরা মন্দ কিংবা ধর্ম শান্তি, সম্প্রীতি অহিংসার কথা বলে, ধর্মীয় মৌলবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদীরা অশান্তি, হিংসা ও বিভেদের কথা বলে– এই তত্ত্বটা একেবারেই ভুল, অবৈজ্ঞানিক ও অবাস্তব। যাঁরা এই তত্ত্ব প্রচার করেন তাঁদের একটি অতিশয় ক্ষুদ্র অংশ হয়তো সত্যিই শান্তি ও সম্প্রীতি চায়, কিন্তু বৃহৎ অংশটা সচেতনভাবে মানুষকে প্রতারিত করার জন্যে এই মিথ্যেটা নানা অপযুক্তির ধুম্রজাল বুনে নিরবচ্ছিন্ন প্রচার করে। 

ধর্মীয় মৌলবাদের জন্মই ধর্মের গর্ভে এবং যাঁরা ধর্মীয় মৌলবাদের প্রচার ও প্রয়োগ করে তাঁরাই ধর্মীয় মৌলবাদী। যাঁরা ধর্ম থেকে ধর্মীয় মৌলবাদ ও ধর্মীয়

মৌলবাদীদের বিচ্ছিন্ন করার ডাক দেয় তাঁরা মিথ্যে মোহ সৃষ্টি করে মাত্র। কেউ সজ্ঞানে করে কেউ অজ্ঞতায় করে। অনেক মনীষীই ধর্মের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন। কার্ল মার্কস ধর্মকে আফিম বলেছেন, ব্রাট্রার্ন্ড রাসেল বলেছেন- ‘সব ধর্মই ক্ষতিকর ও অসত্য’; কবি সুধিন্দ্রনাথ ধর্ম সম্পর্কে বলেছেন- ‘আরণ্যক নির্বোধের ভ্রান্ত দুঃস্বপ্ন’। বিখ্যাত ব্যক্তিদের ধর্ম সম্পর্কে এই উক্তিগুলি নিশ্চয়ই সত্য ও যথার্থ, তবু যেন ঠিক যথার্থ মনে হয়, এই বাখ্যায় মন ভরে না, মন্তব্যগুলো খুব নিরীহ মনে হয়। বরং বাংলাদেশের তরুণ কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র মন্তব্যটি অনেক বেশী স্পষ্ট, বলিষ্ঠ ও যথার্থ মনে হয়। তিনি বলেছেন- ‘ধর্ম হলো হেমলক বিষ’। হ্যাঁ, চারিদিকে তাকালে, খুব ভালোভাবে নিরীক্ষণ করলে মনে হয় ধর্মের চেয়ে ভয়ঙ্কর নেশা, ধর্মের চেয়ে ভয়ঙ্কর বিষ, ধর্মের চেয়ে ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর, ধর্মের চেয়ে ভয়ঙ্কর মিথ্যে আর কিছু নেই। ধর্ম তো হেমলক বিষই, তারচেয়েও মারাত্মক কোনো বিষ থাকলে ধর্ম হলো তাই’ই।

ধর্ম কেবল মিথ্যাই নয়, প্রতারণার আর প্রবঞ্চনার আর এক নাম ধর্ম। ধর্ম কতো অনায়াসে ও কতো অবলীলায় যে মানুষকে ধোঁকা দেয়, ঠকায়, বোকা বানায় যা আমাদের তাজ্জব করে দেয়! ধর্ম মানুষকে হিন্দু বানায়, মুসলমান বানায়, খৃস্টান বানায়, ইহুদি বানায়, আরো কতো কী বানায়, কেবল ‘মানুষ’ বানায়না। ধর্ম মানুষকে শুধু ভাগ আর ভাগের ভাগই করেনা, মানুষকে স্বার্থপর করে, লোভী করে, আত্মকেন্দ্রিক করে, সঙ্কীর্ণ করে, নীচ করে, হীন করে, বিদ্বেষী করে, হিংস্র করে, জঙ্গি করে, নিষ্ঠুর করে, বর্বর করে, অমানবিক করে, হৃদয়হীন করে, বিবেকহীন করে, যুক্তিহীন করে, নির্বোধ করে, অন্ধ করে; ধর্ম মানুষকে উগ্র করে, গোঁড়া করে, ধর্ম আবার হাজার হাজার মানুষকে ঘাতকও করে। আরো যা কিছু কুৎসিৎ আছে মানবসমাজে ধর্ম মানুষকে সেসবই করে। ধর্ম কেবল মানুষকে সত্যিকারের মানুষ, নির্ভেজাল মানুষ করেনা। আমরা একথা ভুলতে পারিনা যে- লাদেন, মোল্লা ওমর, আল-জাওয়াহিরি, আবুবকর আল-বাগদাদী[আইএসের খলিফা], আবুবকর সেকাও[বোকো হারামের নেতা], আল-মাওদুদী, গোলাম আজম, দেলওয়ার হোসাইন সাঈদী প্রমুখ মুজাহিদরা ইসলামের সৃষ্টি; দামোদর বিনায়ক সাভারকার[বীর সাভারকার], নাথুরাম গডসে, প্রবীণ তোগাড়িয়া, প্রমুখ হিন্দু মৌলবাদীরা হিন্দু ধর্মের সৃষ্টি; এবং যাঁরা সক্রেটিস ও ব্রুনোকে হত্যা করেছিলো তাঁরা খৃস্টান ধর্মের সৃষ্টি। হ্যাঁ একথা ঠিক যে ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষদের মধ্যেও ভালো মানুষ আছে যাঁরা সৎ, সুন্দর, উদার, দয়াবান, সহনশীল, ধৈর্যশীল, ক্ষমাশীল ও মননশীল। তাঁদের সংখ্যা খুবই কম এবং তাঁদের মধ্যে বিদ্যমান এসব সদগুণে ধর্মের কোনো ভূমিকা নেই, কৃতিত্ব নেই। তাঁদের মধ্যে এই যে ভালো গুণাবলী রয়েছে সেটা এজন্যে যে তাঁরা ধর্মের প্রভাব কাটাতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁরা ধর্মের প্রভাব কাটাতে পেরেছেন বলে মানুষ হিসেবে তাঁদের অনেকটাই উত্তরণ সম্ভব হয়েছে। ধর্মবিশ্বাসী ভালো মানুষগুলো ধর্মের যাবতীয় ক্ষতিকর উপাদানগুলো ধারণ না করে বর্জন করেছেন বলে তাঁরা ভালো মানুষ হতে পেরেছেন।

এখন প্রশ্ন হলো ধর্মের উপাদানগুলো কেনো অহিতকর ও ক্ষতিকর। এটা বুঝতে হলে তার উৎস-মূলে যেতে হবে। মানুষের যে প্রথম সমাজব্যবস্থাটা ছিলো সেটা আদিম সাম্যবাদী সমাজ নামে ইতিহাসখ্যাত। তখন মানুষের মধ্যে শ্রেণি ছিলোনা, শোষণ ছিলোনা, রাষ্ট্রও ছিলোনা, এবং অবশ্যই তখন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মও ছিলোনা। হাজার হাজার বছর মানুষ ধর্ম বা ঈশ্বর ছাড়াই বেঁচেছিলো, কখনোই তাঁদের ঈশ্বরের প্রয়োজনও পড়েনি। মানব সমাজ যখন বিভক্ত হলো দুটো শ্রেণিতে, একদিকে দাস ও আর একদিকে দাস-মালিক, সে সময় আবির্ভাব হলো রাষ্ট্রের। সে সময়ের কিছু আগে পরে উদ্ভব হয় ধর্মেরও। শুরু হলো যেমন মানুষের উপর মানুষের শোষণ, প্রায় তার সাথে সাথে দেখা দিলো শোষিত শ্রেণিকে দমন-পীড়নের প্রয়োজনও। দমন-পীড়নের জন্যে রাষ্ট্রের প্রয়োজন হলো, ফলে  আবির্ভাব হলো রাষ্ট্রেরও। তখন থেকেই ধর্মকে হাতিয়ার করাও শুরু হয়। ধর্ম হয়ে ওঠে ক্রীতদাসদের শোষণ করার হাতিয়ার, এবং তাঁদের দমন করার হাতিয়ারও। শাসন-শোষণ এবং দমন-পীড়নকে ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিগ্রাহ্য করে তোলার জন্যে জোর কদমে শুরু হয় মিথ্যে প্রচারনা ও প্রতারণা ঈশ্বরের নামে। তোমরা দাস হয়ে জন্মেছো, কষ্ট ভোগ করছো, এ সবই ঈশ্বরের বিধিলিপি, তোমাদের পূর্বজন্মের পাপের ফল। যাঁরা দাস-মালিক তাঁরা তাঁদের পূর্বজন্মের সুকর্মের সুফল ভোগ করছে, ওদের প্রতি ক্ষোভ করোনা, হিংসা করোনা। ঈশ্বরের বিধান মেনে শান্ত থাকো, ঈশ্বরকে স্মরণ করো, মরণের পর স্বর্গ পাবে এবং পরের জন্মে সুখ পাবে। তথাকথিত ঈশ্বরের এই বাণীগুলো এখনো প্রচার করা হয়, মানুষ বিশ্বাসও করে। এই বাণীগুলোই প্রমাণ করে যে, ধর্ম এসেছে মানব কল্যাণের জন্যে নয়, এসেছে শোষক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করার জন্যেই। আসলে ধর্ম ঈশ্বর প্রেরিত কোনো আলোর দর্শন নয়, শোষক শ্রেণি ও শাসক শ্রেণিই ঈশ্বরের স্রষ্টা এবং ওই শোষক শ্রেণিই ঈশ্বরকে সৃষ্টি করে তথাকথিত অমরলোকের গল্প বানিয়ে সেখান থেকে ঈশ্বরকে মর্তে [মানবসমাজে] স্থাপন করেছে তাঁদের নিজেদের স্বার্থ পূরণ ও চরিতার্থ করতে, লোকের চোখে ধূলো দিতে, তাইতো তাঁরা বলে ঈশ্বর নিরাকার, অদৃশ্য। ঈশ্বর ও ঈশ্বরের ধর্ম যে তাঁদেরই সৃষ্টি তা আরও স্পষ্ট বোঝা যায় যখন দেখা যায় যে, সমাজব্যবস্থার বিকাশ, পরিবর্তন ও রূপান্তরের সাথে সাথে কতো সুন্দরভাবে ও কতো সামঞ্জস্যপূর্ণরূপে ঈশ্বরের বাণীগুলো তথা ধর্মের বিধানগুলোও পাল্টে পাল্টে যায়।

দাস সমাজে ঈশ্বরের বিধান ছিলো– দাসকে পশুর মতো কেনাবেচা ও হত্যা করা বৈধ, তাতে দোষ নেই, পাপ নেই। সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ঈশ্বরের বিধান পাল্টে যায়। ঈশ্বরের নামে এক শ্রেণির যাজক বললো– দাসকে হত্যা করা শুধু পাপই নয়, মানুষকে দাস করে রাখাও পাপ, দাসদের মুক্তি দিতে হবে। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ঈশ্বরের বিধান আবার বদলে গেলো। এই সমাজে একদল যাজক ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে বললো– মানুষকে শুধু ক্রীতদাসত্ব থেকেই নয়, মুক্তি দিতে হবে ভূমিদাসত্ব থেকেও। দাস-মালিকদের পরাস্ত করে রাষ্ট্র ক্ষমতা যখন কেড়ে নিয়েছে সামন্ত শ্রেণি তখন তাঁদের দখলে থাকা বিশাল ভূ-সম্পত্তি চাষ করার জন্যে প্রচুর লোক দরকার। কিন্তু মানুষ তো দাস-মালিকের হাতে বন্দি। রাষ্ট্র তখন মানুষকে ক্রীতদাস করে রাখা ও হত্যা করা নিষিদ্ধ করলো। তখন ঈশ্বরও তাঁর বিধানে পরিবর্তন নিয়ে এলো। মালিকদের কাছ থেকে ক্রীতদাসগণ মুক্তি পেয়ে দলে দলে সামন্তপ্রভুর কাছে কাজের জন্যে নাম লেখাতে শুরু করলো। সামন্ত প্রভুরা আইন তৈরী করলো যে কেউ ভূ-স্বামীদের অনুমতি ছাড়া অন্য কারো অধীনে কাজে যেতে পারবেনা। নতুন সমাজব্যবস্থায় ক্রীতদাসরা ভূমিদাসে পরিণত হলো। তারপর একসময় বুর্জোয়া শ্রেণি রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নিলো সামন্ত শ্রেণির কাছ থেকে। তাঁদের শিল্পের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্যে অনেক শ্রমিক দরকার, কিন্তু পাবে কোথায়, সবাই তো ভূমিদাস হয়ে বন্দি হয়ে আছে সামন্ত শ্রেণির কাছে। বুর্জোয়া রাষ্ট্র সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রের আইন পরিবর্তন করে মানুষকে ভূমি থেকে মানে ভূমিদাসত্ব মুক্ত করে দিলো তাঁদের স্বার্থে। মুক্ত মানুষ এবার মজুরীর বিনিময়ে মজুরের খাতায় নাম লেখালো বুর্জোয়া শ্রেণির অধীনে। মার্কসের ভাষায় ভূমিদাসরা মজুরিদাসে পরিণত হলো। বুর্জোয়া রাষ্ট্রের তৈরী করা নতুন নতুন আইনের সাথে সাথে পাল্টে যেতে থাকলো তখন ঈশ্বরের বাণী ও বিধানও। সমাজবিকাশ ও বিবর্তনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এই ভাবেই যেমন যেমন শাসক ও শোষক শ্রেণির রঙ ও রূপ তথা শ্রেণি চরিত্র পাল্টায়, তেমনি ঈশ্বরের বিধানগুলোও কী চমৎকারভাবে পাল্টে পাল্টে যায়। রাষ্ট্রের আইনের ক্রমাগত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরের বিধানগুলির এই ক্রমাগত ও ধারাবাহিক পরিবর্তনগুলি প্রমাণ করে যে পৃথিবীতে যতো ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ আছে সবই মনুষ্য সৃষ্টি। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, ধর্মের জন্ম মিথ্যার পাঁকে; ধর্মের জন্ম হয়েছে মানুষকে ঠকাবার জন্য, ধোঁকা দেবার জন্যে; ধর্মের জন্ম মানুষকে স্বর্গের লোভ দেখিয়ে বা নরকের ভয় দেখিয়ে লোভী, কাপুরুষ, ভীতু ও পুতুল বানাবার জন্যে। সেজন্যেই মানবসমাজে ধর্মের চেয়ে মন্দ কিছু আর নেই। ধর্ম কোনো কালে বা কোনো যুগে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ও সমাজ বিকাশের পথে সহায়তা করেইনি, বরং প্রতিপদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।

মানবসমাজের উন্নতি ও বিকাশের জন্যে তাই ধর্মের স্বরূপ উন্মোচন করা, ধর্ম যা তাঁকে মানুষের সামনে ঠিক সেভাবেই উপস্থাপন করা একান্তই আবশ্যক। ধর্মীয় মৌলবাদের শিকড় যেহেতু ধর্মের গর্ভেই রয়েছে তাই ধর্মীয় মৌলবাদকে ধর্ম থেকে পৃথক করে আলাদা করে তার বিরুদ্ধে লড়াই করা শুধু অর্থহীনই নয়, এধরনের লড়াই এক প্রকার নগ্ন প্রতারণাও। যাঁরা ধর্মের বন্দনা করেন অথচ ধর্মীয় মৌলবাদীদের সমালোচনা করেন তাঁরা ভণ্ড ও প্রতারক শ্রেণিভুক্ত জীব বৈ অন্যকিছু  নয়। এই শ্রেণিভুক্ত মুখোশধারী বুদ্ধিজীবীগণ ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাতকেই শক্তিশালী করেন। তাই ধর্ম, ধর্মীয় মৌলবাদ আর এই ভণ্ড ও প্রতারক বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ব্যতীত মানবসমাজের কল্যাণ ও বিকাশে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব নয়। ধর্ম, ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় মৌলবাদের ধারক ও বাহকরা হলেন যাজক সম্প্রদায়। ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম তাই প্রকৃত অর্থে যাজকতন্ত্রের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম।

মুসলিম সমাজের যাজকগণ সাধারণভাবে মোল্লা নামে পরিচিত। মাওলানা, মুফতি, ইমাম প্রভৃতি ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানী ব্যক্তিরা মোল্লা সমাজের অন্তর্ভুক্ত। এরা যে তত্ত্ব অনুসরণ করেন সেটাই মোল্লাতন্ত্র। সেই তত্ত্ব হলো সারা পৃথিবীতে– কী রাষ্ট্রীয় জীবনে কী সমাজ জীবনে– ইসলামি তথা শরিয়তি শাসন কঠোরভাবে বাস্তবায়িত করা। বলাবাহুল্য যে- ইসলামি যাজকতন্ত্র তথা মোল্লাতন্ত্র অন্যান্য যাজকতন্ত্র থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী। এটা শুধু এদেশেই নয়, সমগ্র বিশ্বের ক্ষেত্রেই এটা সত্যি। এরফলে অবশ্য সবথেকে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুসলিম সমাজই, তাঁরাই পড়ে রয়েছে সবচেয়ে বেশি পশ্চাদে। তার প্রধান কারণ, মোল্লাতন্ত্রই তো মুসলিম সমাজের কল্যাণ ও বিকাশের পথকে রুদ্ধ করে রেখেছে। এই পশ্চাদপদতা দূর করতে তাই সবচেয়ে জরুরী কাজ হলো মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। বলাবাহুল্য যে এই সংগ্রামটা সবচেয়ে কঠিন সংগ্রামগুলির একটি। ইসলাম ধর্ম এবং এই ধর্মের প্রবর্তক মুহাম্মদের সামান্যতম সমালোচনা সহ্য করার মতো ন্যূনতম সহনশীলতা এবং গণতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধ আজো সারা বিশ্বে মুসলিম সমাজ অর্জন করতে পারেনি। সামান্য সমালোচনাতেও মুসলিম সমাজ অসম্ভবব উত্তেজিত ও অস্থির হয়ে ওঠে। এমনকি হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর রকমের হিংস্রও। এটা মানব সমাজের পক্ষে যতোটা ভীতিকর, তারচেয়েও বেশী লজ্জাকরও। মুসলিম সমাজের কোনো যুক্তিবাদী মানুষ যদি সেরূপ সমালোচনা সামান্য মাত্রাতেও করে তবে তো পরিস্থিতিকে আরো ভয়ঙ্কর করে তোলে মোল্লা সমাজ। কোরানের পুনঃ পুনঃ শাস্তির হুমকির কথা– সীমা লঙ্ঘনকারীদের আল্লাহ ক্ষমা করেনা, তাঁদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি– বারবার ধর্মীয় নেতারা উচ্চারণ করেন, কথায় কথায় স্মরণ করিয়ে দেন। মুসলিম সমাজের যাঁরা বলেন শরিয়তি আইনগুলো অন্ধভাবে অনুসরণ না করতে, বলেন যে যুক্তি ও বাস্তবতার নিরিখে যেগুলো অনাবশ্যকীয় ও হানিকর সেগুলো বর্জন করতে, তাঁদের সীমালঙ্ঘনকারী ও মুর্তাদ তকমা দিয়ে মোল্লা-মুফতি সমাজ তাঁদের প্রতি হিংস্র হয়ে ওঠে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া জারি করে। সেই ফতোয়া কার্যকর করার জন্যে মুসলিম সমাজের একদল ধর্মান্ধ ও হিংস্র মানুষ উন্মত্ত হয়ে ওঠে। জাত উগ্র ও হিংস্র ফতোয়াবাজ সেই মোল্লা সমাজের হাতেই মুসলিম সমাজ আজো কুক্ষিগত হয়ে রয়েছে। ফলতঃ প্রায় চোদ্দশ বছরের পুরানো ও জরাজীর্ণ সেই শরিয়তি আইনকানুন, শরিয়তি মূল্যবোধ ও আদর্শ এবং শরিয়তি শিক্ষা-সংস্কৃতিতেই মুসলিম সমাজ এখনো আবর্তিত হচ্ছে এবং ক্রমাগত পশ্চাদগামী হচ্ছে। মুসলিম সমাজের তাই উন্নতি ও অগ্রগতির প্রধান শর্তই হচ্ছে শরিয়তের ফাঁস থেকে এই সমাজটাকে মুক্ত করা এবং একটি গণতান্ত্রিক ও বিজ্ঞান-মনস্ক আধুনিক সমাজ গড়ে তোলা। যেসব মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকগণ শরিয়তের প্রশংসা করেন কিংবা শরিয়ত প্রসঙ্গে নীরব থেকে মুসলিম সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন তাঁরাও ভণ্ড ও প্রতারক। এরা মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামটাকে আরো জটিল ও কঠিন করে তোলেন।

সংগ্রামটা যতোই জটিল ও কঠিন হোক আমাদের কিন্তু লড়তেই হবে, কেননা এর কোনো সহজ, সরল ও মসৃণ বিকল্প নেই। শুধু জটিল ও কঠিনই নয়, এটা একটা দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামও বটে। সংগ্রাম করতে হবে যেমন এই সময়ের মোল্লাতন্ত্রের ফতোয়ার বিরুদ্ধে এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে , একই সঙ্গে সংগ্রাম চালাতে হবে তেমনি মোল্লাতন্ত্রের উৎস-মুখটা বন্ধ করার লক্ষ্যেও। মাদ্রসাগুলি, বিশেষ করে খারিজি মাদ্রাসা ও সিনিয়র মাদ্রাসা, হলো মোল্লাতন্ত্রের একটি উল্লেখযোগ্য ও অন্যতম প্রধান উৎসমুখ। এই মাদ্রাসাগুলি মোল্লাতন্ত্রকে তার প্রধান নেতৃত্বকারী অস্ত্র মাওলানা, ইমাম ও মুফতি সরবরাহ করে। মাদ্রাসা সম্পর্কে মুসলমান সমাজের মোহমুক্তি অনেকটাই ঘটছে ঠিকই, কিন্তু এখনও অসংখ্য মাদ্রাসা চলছে। এই মাদ্রাসাগুলি চলছে প্রধানতঃ মুসলিম সমাজের অর্থেই, যদিও সৌদি আরব ও অন্যান্য ইসলামি রাষ্ট্র থেকে মাদ্রাসার জন্যে প্রচুর অর্থ সাহায্য আসে। মাদ্রাসা সম্পর্কে মোহমুক্তির এই মন্থর গতিকে আমাদের কর্তব্য হলো দ্রুতগতিতে পরিণত করা এবং মুসলিম সমাজকে মাদ্রাসা-ব্যাধি থেকে মুক্ত করা। মুসলিম সমাজের দ্রুত উন্নতি ও অগ্রগতির জন্যে আবশ্যক হলো আধুনিক শিক্ষা। যেমন যেমন শিক্ষার্থীর অভাবে মাদ্রাসাগুলি দুর্বল হবে ঠিক সেভাবেই মোল্লাতন্ত্রও দুর্বল হবে এবং মুসলিম সমাজের কল্যাণের রুদ্ধ মুখ খুলে ধীরে ধীরে যাবে। তাই শুধু আধুনিক শিক্ষার আবশক্যতার কথা

বললেই হবেনা, এর পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষা ও মাদ্রাসাকে বর্জন করার কথাটাও স্পষ্ট করে বলার সাহস অর্জন করতে হবে। আবার আধুনিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠাগুলির আঙিনাতেও ধর্মীয় মৌলবাদ তথা মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার ক্ষেত্র তৈরী করা সম্ভব এবং তা করা আমাদের কর্তব্যও বটে। কারণ আমাদের প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা যাঁরা ভবিষ্যতে সমাজে নেতৃত্ব করবে তাঁরা যাতে মোল্লাতন্ত্রের শিকার না হয় সে বিষয়েও আমাদের সতর্ক থাকা ও যত্নবান হওয়া একান্তই আবশ্যক।

কিন্তু আমাদের সরকার এবং শিক্ষাবিদগণ এ বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন ও নির্বিকার। বরং এমনই শিক্ষাক্রম রচনা করা হয় বা রচনা করানো হয় যার উপরে থাকে ধর্মের ব্যাপক প্রভাব। ফলে পুঁথিগত শিক্ষার শেষে দেখা যায় অধিকাংশ উচ্চশিক্ষিত মানুষের বিশ্বাস অটুট থাকে তাঁদের ধর্মগ্রন্থগুলির প্রতি। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে কোরান, পুরাণ, বেদ, বাইবেল ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থগুলি ঐশীগ্রন্থ এবং মহাপবিত্র গ্রন্থ। তাঁদের দশটি আঙ্গুলে দশ রকমের পাথরযুক্ত আংটি, কোমরে-বাহুতে-গলায় মাদুলি বা তক্তি এবং কব্জিতে বিপদতারিণী লাল ধাগা দেখা যায়। তাঁরা নিজ নিজ ধর্মীয় উপাসনালয়ে গিয়ে ব্যক্তিগত ও পরিবার-পরিজনের সুখ-সমৃদ্ধি কামনায় স্বার্থপরের মতো আল্লাহ-ভগবানের পদতলে মাথা নত করেন। সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালনে তাঁদের প্রতি কোনো আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়না, এমনকি তাঁদের একাংশকেও ধর্মীয় মৌলবাদীরূপে আত্মপ্রকাশ করতেও দেখা যায়। তাই শুধু গতানুগতিক ও পুঁথিগত আধুনিক শিক্ষাদানই নয়, আমাদের প্রিয় শিক্ষার্থীদের এমনভাবে পাঠদান করা উচিত যাতে তাঁদের মানসিক গঠন সংকীর্ণ, অনুদার, আত্মকেন্দ্রিক এবং সমাজবিমুখ না হয়ে ওঠে। বরং যাতে তাঁরা সংস্কারী হয়; কুসংস্কারমুক্ত, বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী এবং উদার চিত্তের প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে ওঠে সে লক্ষ্যে শ্রেণিকক্ষে তাঁদের পাঠদান করতে হবে। এরূপ পাঠদান করা নিশ্চয় সহজ কাজ নয়। বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ, বাইরের পরিবেশ এবং সমগ্র পরিবেশই এরূপ পাঠদানের পক্ষে প্রতিকূল। পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তকও এরূপ পাঠদানের অনুকূল ও সহায়ক নয়। সামগ্রিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি এবং সমাজের মানসিক গঠন এমনই যে, এরূপ পাঠদান কেবল সুকঠিনই নয়, ঝুঁকিপূর্ণও বটে। তথাপি এ কথাটাও ঠিক যে, এ কাজটি সম্পাদন করা কিন্তু অসম্ভব নয়। এরূপ পাঠদানের জন্যে পাঠ্যপুস্তক থেকে প্রত্যক্ষ সাহায্য পাওয়া যাবেনা, কারণ প্রচলিত পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচীতে প্রচুর সীমাবদ্ধতা ও ঘাটতি রয়েছে। সামগ্রিক প্রতিকূলতা এবং পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচীর সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ইচ্ছা থাকলে শ্রেণিকক্ষে পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত বিষয়ে পাঠদানের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংস্কারমুক্ত, যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলার জন্যে প্রয়োজনীয় শিক্ষাদান করা সম্ভব। বাড়ির পরিবেশ থেকে শিক্ষার্থীরা ঈশ্বর, ঈশ্বরের দূত, ধর্ম, ধর্মগুরু ও ধর্মগ্রন্থের প্রতি তৈরী হওয়া অন্ধবিশ্বাস, অন্ধানুগত্য ও অগাধ শ্রদ্ধা নিয়েই বিদ্যালয়ে যায়। কিন্তু অল্পবয়স হেতু তাঁদের মস্তিষ্কে সেই অন্ধবিশ্বাস, অন্ধানুগত্য ও অগাধ শ্রদ্ধাগুলি যথেষ্ট দৃঢ়ভাবে দানা বাঁধতে পারেনা। মস্তিষ্কে সেগুলি থাকে খুব আলগা অবস্থায়। একটু একটু করে বিজ্ঞান, বাস্তব অভিজ্ঞতা ও যুক্তির আঘাত দিলে সেই নেতিবাচক ও অবৈজ্ঞানিক অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের আবর্জনাগুলি তাঁদের  মস্তিষ্ক থেকে ধীরেধীরে বের করে দেওয়া সম্ভব। গায়ের পোশাকে যেমন ধূলোবালির আস্তরণ প্রথম পর্যায়ে ভীষণ আলগাভাবে লেপ্টে থাকে, শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কেও ঠিক তেমনি অন্ধবিশ্বাস, অন্ধানুগত্য ও শ্রদ্ধার ধূলোবালির ময়লাগুলো আলগাভাবেই অবস্থান করে। পোশাকের ওপর থেকে হালকা টোকা মেরে ধূলো ঝেড়ে ফেলার মতোই ওদের মস্তিষ্ক থেকেও ঐ ময়লাগুলো বিজ্ঞান ও যুক্তির হালকা হালকা টোকায় উড়িয়ে ফেলা সম্ভব। তারজন্যে প্রয়োজন হলো পাঠ্যপুস্তকের পাঠ্যবিষয়ের  শিক্ষাগুলো আলোচনা করার পাশাপাশি সেই বিষয়গুলিতে ধর্মগ্রন্থগুলিতে ঈশ্বরের নামে কী বলা হয়েছে, সেগুলিও তুলে ধরা। পাশাপাশি দুটো শিক্ষা তুলে ধরলে তাঁরা সহজেই বুঝতে পারবে যে এতদিন তাঁরা যা জেনে এসেছে তা কতো ভুল।

কল্পনাপ্রসূত কোনো চিন্তাভাবনা থেকে এ কথা বলছিনা। একজন শিক্ষক হিসেবে আমার যে উপলব্ধি হয়েছে সে কথাই আমি এখানে তুলে ধরবার চেষ্টা করছি মাত্র। এটা আমার উপলব্ধিই শুধু নয়, এটা আমার সুদীর্ঘ শিক্ষক জীবনের পরিক্ষালব্ধ ও অভিজ্ঞতালব্ধ এক প্রকার অর্জিত জ্ঞানও বটে। এ অর্জন আমার জীবনের অন্যতম সেরা অর্জনও বটে। আমি যা বিশ্বাস করি, তা অকপটে লিখি, এ লেখায় জীবনের ঝুঁকি রয়েছে জেনেও লিখি, জীবনকে বাজি রেখেই লিখি। লিখি মানবসমাজের কল্যানের জন্যে, বিশেষতঃ মুসলিম সমাজের কল্যাণের জন্যেই লিখি। আর তাই তো শরিয়তের সমালোচনা করি, শরিয়ত বর্জন করার আহ্বান জানাই, কারণ শরিয়তি আইনকানুন, ধ্যানধারণা ও সংস্কৃতিই সবচেয়ে বড়ো বাধা সৃষ্টি করে মুসলিম সমাজের উন্নতি ও অগ্রগতির পথে। এসব লেখার কারণে মোল্লাতন্ত্রের রোষানলে পড়েছি। ধর্ম মানুষকে উগ্র করে, উন্মত্ত করে, হিংস্র করে, ভয়ঙ্কর আরো কত কী করে তা প্রথমেই বলেছি। যা বলেছি তা স্বচক্ষে দেখেছি ও প্রত্যক্ষ করেছি সেই দিনগুলোতে [২০০৫ সাল] যখন আমাকে মোরতাদ ঘোষণা করা হয় এবং আমার মুণ্ডচ্ছেদকারীকে পাঁচ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেবার ঘোষণা দেওয়া হয়। দেখেছি মোল্লা সমাজ ও ধর্মান্ধ মানুষগুলো কীভাবে ও কতটা হিংস্র ও বর্বর হয়ে ওঠে। কিন্তু সে সময় এও লক্ষ্য করেছি যে, ঐ উন্মাদতুল্য বর্বর লোকগুলোর দলে আমার কোনো ছাত্র যোগ দেয়নি। বহুলোক ছিলো যাঁরা আমার মাথা কেটে নেওয়াকে সমর্থন না করলেও আমার প্রতি ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিলো এবং আমাকে সমাজচ্যুত করার ফতোয়াকে সমর্থন করেছিলো।

আমি লক্ষ্য করেছি, আমার কোনো ছাত্র গিয়াসুদ্দিনের মুণ্ডু চাই ধ্বনি তোলে তাঁদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলায়নি। বরং আমার অনেক প্রাক্তন ছাত্র আমাকে গোপনে জানিয়েছে যে তাঁরা আমার লেখা সমর্থন করে। সেই ঝড়ের দিনগুলোতে যখন ‘আমি মুসলমানদের এক নম্বর শত্রু’– এরূপ আওয়াজে আকাশে বাতাস মুখরিত ও তীব্র আন্দোলিত, সেই সময়েও আমি শ্রেণীকক্ষে মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের চোখেমুখে বিন্দুমাত্র অশ্রদ্ধার ছাপ দেখিনি। বরং দেখেছি মোল্লাদের ফতোয়ায় আমার জন্যে তাঁদের মুখমণ্ডলে উদ্বেগের চিহ্ন। আমি ওদের জিজ্ঞাসা করেছি, তোরা কোন পক্ষে? যাঁরা আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছে তাঁদের পক্ষে? ওরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে সমস্বরে জবাব দিয়েছে, স্যার, না আমরা আপনার বিরুদ্ধে নই, আমরা আপনাকে শ্রদ্ধা করি। যে মুসলিম ছাত্রটি দু’বছর আগেও ধর্মগ্রন্থের উপর আমার মন্তব্য ও আলোচনা শুনে পীড়িত বোধ করতো, সে ছাত্রটিও নীরব থাকেনি, সেও অন্যদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছে। এযে আমার কত বড় প্রাপ্তি, এবং এ প্রাপ্তির মহানন্দে যে কত সুখ তা প্রকাশ করা সাধ্যাতীত ব্যাপার।

পরিশেষে বলতে চাই যে মোল্লাতন্ত্রের রিক্রুটিং সেন্টার হলো খারিজি মাদ্রাসা ও সিনিয়র মাদ্রাসাগুলি। সিনিয়র মাদ্রাসাগুলি সরকার অনুমোদিত ও সরকারি ব্যয়ে পরিচালিত। এই মাদ্রাসাগুলিই তৈরী করে মোল্লাতন্ত্রের ধারক-বাহক তথা ইমাম ও মুফতিদের। আমরাও [ যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষক-অধ্যাপক] যাঁরা সমাজের সংস্কার চাই, সমাজের দেহ থেকে মধ্যযুগীয় যাবতীয় ঘূণ ধরা, মরচে পড়া ধ্যানধারণা ও সংস্কার-কুসংস্কার দূর করে আধুনিক ও সভ্য সমাজ নির্মাণ করতে চাই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি থেকে সমাজ সংস্কার ও পরিবর্তনের সংগ্রামের জন্যে সৈনিক তৈরী করতে পারি। পারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে, শ্রেণিকক্ষগুলিকে আমাদের সংগ্রামের রিক্রুটিং সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করতে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ