ক্যাম্পা কোলা যেভাবে হারিয়ে গেল || পিনাকী ঘোষ

 


ঋজু কাল ফরিদাবাদ-এ এক বন্ধুর বাড়ি ছিল।  কলকাতায় ফিরে আমায় জিজ্ঞেস করলো, তোমাদের ছোটবেলায় ক্যাম্পা কোলা ছিল না? বললাম, হ্যাঁ, খুব চলতো, অনেক খেয়েছি; ৭০ আর ৮০র দশকে। ঋজু বলল, ক্যাম্পা কোলা দিল্লিতে আবার তৈরী হচ্ছে। ও দিল্লিতে কাল ক্যাম্পা কোলা খেয়েছে। 

ক্যাম্পা কোলার ইতিহাস জানতে চাইলো ঋজু। বললাম, ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধী সরকার একরকম জোর করে কোকা কোলা-কে ভারত থেকে তাড়িয়ে দিল। কোকা কোলা ভারত থেকে বিতাড়িত হয়ে, ভারত থেকে বিতাড়িত হওয়ার ক্ষতি পূরণ করতে পাকিস্তানের বাজারে জোর দিল। কোকা কোলাকে তাড়ানোর ফলে ভারতের কোলার মার্কেট হয়ে গেল একদম ফাঁকা।  ভারত সরকার সেটা ভরার জন্য স্বদেশী কোলা বলে প্রচার করে 'ডবল সেভেন' নামে সরকারি কোলা বাজারে আনলো। প্রস্তুত করতো সরকারি সংস্থা সেন্ট্রাল ফুড টেকনোলজি রিসার্চ ইনস্টিটিউট। ডবল সেভেন (৭৭) নাম রাখার কারণ ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধী সরকার কোকা কোলাকে ভারত থেকে তাড়িয়েছিলো, যেটা সরকার মনে করত স্বদেশী জিনিস তৈরির লক্ষ্যে একটা বড় ধাপ। ওদিকে কোকা কোলার বটলিং করতো পিওর ড্রিঙ্কস নাম একটি সংস্থা। কোলার কনসেনট্রেট সাপ্লাই করতো কোকা কোলা কোম্পানি, পিওর ড্রিকংস সেই কনসেনট্রেট-এ জল ও কার্বন-ডাইঅক্সাইড গ্যাস মিশিয়ে বোতলে ভরত তাদের বটলিং ইউনিটগুলিতে। কোকা কোলা ভারত ছাড়ার কারণে পিওর ড্রিকংস এর কারখানাগুলোতে কাজ স্তব্ধ হয়ে গেলো ১৯৭৭ সালে। ভারত সরকার পিওর ড্রিঙ্কস কে অফার দিয়েছিলো তাদের বটলিং প্লান্টগুলিতে স্বদেশী ড্রিংক ডবল সেভেন তৈরী করতে। পিওর ড্রিঙ্কস-এর কাছে এটা ঝুঁকিমুক্ত ভালো বিকল্প ছিল, যাতে তাদের কারখানাগুলোতে আবার কাজ শুরু হতো, কর্মীরাও বসে থাকতো না  কিন্তু পিওর ড্রিঙ্কস-এর মালিক সতওয়ানত সিং-এর মাথায় আরো বড় একটা প্ল্যান ঘুরছিল। তিনি সরকারি প্রস্তাব না নিয়ে তাঁর নিজের কোলা ব্র্যান্ড ক্যাম্পা কোলা লঞ্চ করলেন। তিনি কোকা কোলার কনসেনট্রেট নকল করে কোকা কোলার স্বাদ ক্যাম্পা কোলাতে আনতে পেরেছিলেন। ক্যাম্পা কোলার ১৯৭৮এর লোগো এবং লাল রং ছিল একদম কোকা কোলার অনুকরণে। তার পরে ছোটদের জন্য ছাড়লেন অরেঞ্জ ড্রিংক ক্যাম্পা। ক্যাম্পা কোলা ভারতের বাজারে বিশাল জনপ্রিয়তা পেলো, যা সরকারি ডবল সেভেন পেলো না। 

ওদিকে ক্যাম্পা কোলার সঙ্গে জোর টক্কর দিতে পার্লে ড্রিঙ্কস ১৯৭৭ এ বাজারে ছাড়লো তাদের নতুন কোলা ব্র্যান্ড থামস আপ। এর অনেক আগে ১৯৫০ এর দশকে পার্লে একবার তাদের কোলা ছাড়ার চেষ্টা করেছিল; যার নাম দিয়েছিলো গ্লুকো কোলা, ১৯৫০র দশকে তাদের জনপ্রিয় বিস্কুট লেবেল পার্লে গ্লুকো (এখন নাম পার্লে জি) বিস্কুট-এর নাম টেনে। কিন্তু সেই সময়ে কোকা কোলা পার্লের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছিল যে গ্লুকো কোলা আসলে কোকা কোলা নামের অনুকরণ। সেই মামলায় ভয় পেয়ে পার্লে গ্লুকো কোলা বন্ধ করে দিয়েছিলো। কিন্তু ১৯৫২তে গ্লুকো কোলার বদলে পার্লে বাজারে ছেড়েছিলো তাদের অরেঞ্জ ড্রিংক গোল্ড স্পট। ১৯৭৭ এ কোকা কোলা চলে যাওয়ার পর পার্লে আরও কড়া স্বাদের থামস আপ বাজারে আনলো, আর বিজ্ঞাপনের স্লোগান দিলো 'হ্যাপি ডেস আর হিয়ার এগেন।' ভারতের গরম আবহাওয়ার কারণে ঠান্ডা লেবুর শরবতের জনপ্রিয়তার মাথায় রেখে লিম্বু কা  পানি কথা থেকে লিমকা নাম দিয়ে পার্লে বাজারে আনে তাদের লেবু ড্রিংক।

১৯৮০-র দশক জুড়ে থামস আপ কড়া স্বাদের জন্য ক্যাম্পা কোলার জনপ্রিয়তা ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। ১৯৯২ তে পেপসি ভারতে আসার পর ক্যাম্পা কোলা আরও হারিয়ে যেতে লাগলো। তারপর কোকা কোলা ১৯৯৩ তে নরসিংহ রাও সরকারের উদারনীতির জন্য ভারতে আবার আসার পর পার্লের থেকে তাদের থামস আপ, গোল্ড স্পট, লিমকা, মাজা, সিটরা লেবেলগুলি কিনে নেয়। ৬ কোটি ডলারে নিজের লেবেলগুলিকে বিক্রি করে দেন পার্লের রমেশ চৌহান। কোকা কোলা - পার্লের চুক্তির পর চোখের জল ধরে রাখতে না পেরে শিশুর মতো কেঁদেছিলেন রমেশ চৌহান। 

অবশ্য, তাঁর পানীয় জলের ব্র্যান্ড বিসলেরি-কে কোকা কোলার কাছে বিক্রি করেননি চৌহান। আজ অবধি কোকা কোলার পানীয় জলের ব্র্যান্ড কিনলে বা পেপসির  একুয়াফিনা রমেশ চৌহানের বিসলেরিকে হারাতে পারেনি। 

কোকা কোলা আমেরিকার প্রধান কোকা কোলা ভারতের প্রধানকে মতামত দেন কোকা কোলার পাশাপাশি থামস আপ বাঁচিয়ে রাখার দরকার নেই, কোকা কোলার ফান্টার পাশাপাশি গোল্ড স্পট দরকার নেই, স্প্রাইট-এর পাশাপাশি লিমকা ও সিটরা বাঁচিয়ে রাখার দরকার নেই।  অতএব এই লেবেলগুলিকে মেরে দেওয়া হোক। পার্লের মালিক রমেশ চৌহান অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন তাঁর লেবেলগুলিকে যেন কোকা কোলা বন্ধ না করে দেয়, কারণ ভারতীয়রা এগুলিকে ভালোবাসে। কিন্তু গোল্ড স্পটকে প্রথম দিনেই নির্দয়ভাবে মেরে দেওয়া হলো। থামস আপ কে চেপে দেওয়া হলো।  কোকা কোলা কিছুতেই পেপসির সঙ্গে ভারতে পেরে উঠছিলো না, কারণ পেপসি ভারতে আগে এসেছিলো। শেষমেশ অনেক দেরিতে কোকা কোলার মাথায় ঢোকে যে থামস আপ তাদের বাঁচাতে পারে। তাই থামস আপকে 'টেস্ট তা থান্ডার' স্লোগান দিয়ে বড়োদের ঝাঁঝালো কোলা, আর পেপসি বাচ্চাদের  মিষ্টি কোলা, এইভাবে প্রচার করা শুরু করে থামস আপকে আবার ফিরিয়ে আনে কোকা কোলা। এর পর ওয়ার্ন্ড কাপ স্পনসর করা, ইত্যাদি আরো কারণে কোকা কোলা ভারতে পেপসিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়. আর এই প্রচন্ড প্রতিযোগিতার মধ্যে হারিয়ে যায় ক্যাম্পা কোলা। তাদের কারখানা ও অফিস ২০০০-২০০১-এ বন্ধ হয়ে যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

X

Never Miss an Update!

Join my newsletter to get the latest posts from littlemag.in directly to your inbox.