বিদ্যাসাগর ও বিধবা বিবাহ || বলাই চরণ মণ্ডল

 

বিদ্যাসাগর ছিলেন বাস্তবধর্মী। তিনি জানতেন, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসঙ্গত হওয়া সত্ত্বেও যদি আইনসিদ্ধ না হয়, তাহলে বিধবাবিবাহ প্রচলিত হবে না। বিধবাবিবাহের ফলে জাত সন্তানরা যাতে পিতার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হতে পারে তারজন্য বিধবাবিবাহকে আইনানুগ করতে হবে। তাই বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহকে শাস্ত্রীয় যুক্তিতে প্রমাণ করে ক্ষান্ত হলেন না। তিনি বিধবাবিবাহের পক্ষে আইন পাশের ব্যাপারে ভারত-সরকারের নিকট আবেদনপত্র পাঠাবার জন্য স্বাক্ষর সংগ্রহের কর্মসুচীও গ্রহণ করেন। এই প্রসঙ্গে বিনয় ঘােষ মন্তব্য করেন--“আজকাল আমরা কোনাে আন্দোলনের পক্ষে বা বিপক্ষে এই স্বাক্ষর সংগ্রহ করাকে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের একটি বড় কৌশল বলে মনে করি। আজ থেকে একশ বছর আগে বিদ্যাসাগর সীমাবদ্ধ গণ্ডিতে হলেও এই গণতান্ত্রিক রীতিতেই তাঁর বিধবাবিবাহ আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন।” ৩৩ ১৮৫৫ সালের ৪ অক্টোবর বিদ্যাসাগর ৯৮৬ জন লােকের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি আবেদনপত্র ভারত-সরকারের কাছে প্রেরণ করেন। আবেদনপত্রে H.C.Banerjee নামে একজন লােকের স্বাক্ষর কাটা আছে। ৩৪ আবেদনপত্রে জয়কৃষ্ণ মুখােপাধ্যায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বারকানাথ মিত্র, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, প্যারীচরণ সরকার, কালীকৃষ্ণ মিত্র, মহারাজা দুর্গাচরণ লাহা, রাজা প্রতাপচন্দ্র, রাজা ঈশ্বরচন্দ্র প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ স্বাক্ষর করেন। সকলের শেষে স্বাক্ষর করেন বিদ্যাসাগর।

আবেদনপত্রে স্বাক্ষরকারীগণ উল্লেখ করেন যে, বহুদিনের প্রচলিত প্রথানুসারে হিন্দুদের মধ্যে বিধবাদের বিবাহ নিষিদ্ধ। এই নিষ্ঠুর ও অস্বাভাবিক প্রথা নীতিবিরুদ্ধ এবং সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর। হিন্দুদের মধ্যে বাল্যবিবাহের প্রচলন থাকায় অনেক বালিকা কথা বলতে ও হাঁটতে শেখার পূর্বেই বিধবা হয়। এই প্রথা শাস্ত্রসঙ্গত অথবা হিন্দু আইনের অনুমােদিত নয়। আবেদনকারীগণ ও অন্যান্য অনেক হিন্দু বিধবাবিবাহকে বিবেকবুদ্ধি-বিরােধী মনে করেন না। মহারানী ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আদালতে হিন্দু আইনানুসারে বিধবাবিবাহ অসিদ্ধ এবং বিধবাবিবাহ-জাত সন্তান অবৈধ বলে পরিগণিত হবে। যে সকল হিন্দু বিধবাবিবাহকে বিবেকবুদ্ধিবিরােধী বলে মনে করেন না এবং যাঁরা সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বাধা উপেক্ষা করে বিধবাবিবাহ করতে ইচ্ছুক, হিন্দু আইনের উপরােক্ত ব্যাখ্যা তাদের ক্ষেত্রে এরূপ বিবাহে বাধা সৃষ্টি করছে। শাস্ত্রের বিপরীত ব্যাখ্যার জন্য যে গুরুতর সামাজিক ক্ষতি সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে রক্ষা পাবার উদ্দেশ্যে সমস্ত আইনসম্মত বাধা দূর করা ব্যবস্থাপক সভার কর্তব্য। বহুসংখ্যক ধার্মিক ও নিষ্ঠাবান হিন্দুর অভিপ্রায় হল বিধবাবিবাহের বিধিসম্মত বাধা অপসারণ করা। শাস্ত্রবিরুদ্ধ বলে মনে করে এবং সমাজের মঙ্গলের কথা বিবেচনা করে যারা বিধবাবিবাহ-বিরােধী, বিধবাবিবাহের আইনসঙ্গত বাধা অপসারিত হলে তাঁদের কোনাে ক্ষতি হবে না। বিধবাবিবাহ মানুষের স্বভাববিরুদ্ধ নয়। পৃথিবীর অন্য কোনাে দেশে বা অন্য কোনাে জাতির মধ্যে আইন বা প্রথা অনুসারে বিধবাবিবাহ নিষিদ্ধ নয়। সবশেষে স্বাক্ষরকারীগণ বলেন—

“That your Petitioners, therefore humbly pray that your Honourable Council will take into early consideration the propriety of passing a law (as annexed) to remove all legal obstacles to the mariage of Hindoo widows, and to declare the issue of all such marriages to be legitimate."৩৫

বিদ্যাসাগর আবেদনপত্রের সাথে একটি চিঠিও লেখেন— 
“To 
W. Morgan Esq. 
Clerk to the Honourable Legislative Council of India 
Sir,
On behalf of the Petitioners I have the honour to forward the Petition of certain Hindoo Inhabitants of the Province of Bengal which I beg to request you will do me the favour to lay before the Honourable Council at their next meeting.
I have the honour to be your most obedient servant 
Eshwar Chandra Sharma."
Calcutta 
Sanskrit College 
The 4th October 1855

বিধবাবিবাহের সমর্থনে বাংলা ও বাংলার বাইরে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আরও অনেক পৃথক আবেদনপত্র ভারত-সরকারের নিকট প্রেরিত হয়। বাংলার কৃষ্ণনগর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল, বারাসত ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল, কলকাতা ও তার সন্নিহিত অঞ্চল, মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া, বর্ধমান, শান্তিপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা, চট্টগ্রাম প্রভৃতি স্থান থেকে বিধবাবিবাহের পক্ষে আবেদনপত্রগুলি পাঠানাে হয়। কলকাতা মিশনারী সম্মিলনের সদস্যবৃন্দ এবং মেদিনীপুর থেকে রাজনারায়ণ বসু সহ অন্যান্য অধিবাসীগণও বিধবাবিবাহের সমর্থনে আবেদন করেন। বর্ধমানের প্রভাবশালী মহারাজা মহাতবচাঁদ বিধবাবিবাহকে সমর্থন করলে বিদ্যাসাগর জে. পি. গ্র্যান্টকে এক চিঠিতে লেখেন—“It is really a matter for congratulation that the first man of Bengal is going to take up the cause.” বাংলার বাইরে পুনার অধিবাসীগণ, সেকেন্দ্রারাবাদের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ ও ভিঞচূরের মারাঠাপ্রধান বিধবাবিবাহের সমর্থনে পৃথক পৃথক আবেদনপত্র পাঠান।

বিধবাবিবাহের বিপক্ষেও বহু আবেদনপত্র ভারত-সরকারের কাছে প্রেরিত হয়েছিল। বিধবাবিবাহের বিরােধিতা করে শােভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত দেব ৩৬,৭৬৩ জন লােকের স্বাক্ষরসম্বলিত একটি আবেদনপত্র ভারত-সরকারের কাছে পাঠিয়েছিলেন। এছাড়াও বাংলার নদীয়া, ত্রিবেণী, ভাটপাড়া, বাঁশবেড়িয়া, কলকাতা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে বিধবাবিবাহের বিপক্ষে বহু প্রতিবাদপত্র পাঠানাে হয়েছিল। ত্রিপুরা, বােম্বাইয়ের অন্তর্গত সাতারা জেলা, পুনা প্রভৃতি ভারতের বিভিন্ন স্থানের অধিবাসীগণও বিধবাবিবাহের বিপক্ষে আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন। বিধবাবিবাহ-বিরােধীদের বক্তব্য ছিল যে, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রনিষিদ্ধ ও প্রচলিত প্রথাবিরুদ্ধ। বিধবাবিবাহ প্রচলিত হলে সামাজিক ও ধর্মীয় অমঙ্গল হবে। বিধবাবিবাহের ফলে সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে বিরােধ দেখা দিবে। ভয়াবহ পারিবারিক বিপর্যয় ঘটবে, বংশলােপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে এবং আর্থিক দিক থেকে হিন্দুরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

দেখা যায়, সমর্থনের আবেদনপত্র অপেক্ষা বিরােধী আবেদনপত্রের সংখ্যা ছিল বেশী এবং পক্ষের স্বাক্ষরকারীগণ অপেক্ষা বিপক্ষের স্বাক্ষরকারীগণের সংখ্যাও ছিল বেশি। বিহারীলাল সরকার লেখেন-- “এই আইনের বিরুদ্ধে ৫০/৬০ সহস্র ব্যক্তির স্বাক্ষরিত ৪০ খানির উপরও আবেদনপত্র পেশ হইয়াছিল। ইহার পক্ষে হইয়াছিল, ৫ সহস্র লােকের স্বাক্ষরিত ২৫ খানি আবেদনপত্র।”৩৭ ১৮৫৬ সালের ১২ জুলাই জে.পি. গ্র্যান্ট ব্যবস্থাপক সভায় জানান- "I believe there are upwards of 40 petitions against the Bill signed by from 50,000 to 60,000 persons; in favour of the Bill there are upwards of 25 petitions, signed by more than 5000 persons.”

বাংলায় বিধবাবিবাহ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল। কিন্তু শীঘ্রই আন্দোলন বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং সমাজে প্রবল আলােড়নের সৃষ্টি হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এই আন্দোলন একটি সর্বভারতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। বিনয় ঘােষ মন্তব্য করেন—“ঊনিশ শতকের সমাজসংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনই প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলন বলে মনে হয়।”৩৮

১৮৫৫ সালের ১৭ নভেম্বর ব্যবস্থাপক সভার অন্যতম সদস্য জে.পি.গ্র্যান্ট প্রস্তাবিত বিধবাবিবাহ বিষয়ক আইনের খসড়া ব্যবস্থাপক সভায় (Legislative Council) পেশ করেন। প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়—যদি হিন্দু বিধবা অথবা মৃত ব্যক্তির বাগদত্তা স্ত্রী পুনর্নির্বাহ করেন, তাহলে তা বে-আইনী বলে বিবেচিত হবে না এবং বিবাহজাত সন্তান অবৈধ হবে না। দ্বিতীয়বার বিবাহ করলে উত্তরাধিকার সুত্রে মৃত স্বামীর বিষয়-সম্পত্তিতে অধিকার অথবা খােরপােশ সূত্রে অন্য কোনাে দাবী বাতিল হয়ে যাবে এবং প্রথম স্বামীর পক্ষ থেকে বিধবা স্ত্রী মৃত বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু পুনর্বিবাহে অন্য সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি অথবা নিজ উপার্জিত বিষয়-সম্পত্তিতে বিধবার অধিকার বজায় থাকবে।

১৮৫৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারী রসিককৃষ্ণ মল্লিক, প্যারীচাঁদ মিত্র, কিশােরীচাদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার প্রমুখ ইয়ং বেঙ্গল দলের নেতৃবৃন্দ প্রস্তাবিত আইনের সংশােধনের জন্য প্রায় ৩৭৫ জন ব্যক্তির স্বাক্ষরিত একটি আবেদনপত্র ভারত-সরকারের নিকট পাঠিয়েছিলেন। আবেদনপত্রে তারা বলেন যে, একটি নির্দিষ্ট বিধি অনুসারে বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হওয়া দরকার। অন্যথায় বিভিন্ন ব্যক্তি তাদের ইচ্ছানুযায়ী বিবাহ করবে এবং সেক্ষেত্রে বৈধ বিধবাবিবাহের বিচারে আদালতে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। ... it may be apprehended that such marriages will often be disputed in a court of justice.” তাই ইয়ং বেঙ্গল দলের নেতৃবৃন্দ প্রস্তাব করেছিলেন যে, স্বামী ও স্ত্রী দু’টি অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করে বিবাহ করবে, বিবাহের ছয় মাসের মধ্যে এই অঙ্গীকারপত্রগুলিকে রেজেষ্ট্রি করতে হবে, তাদের বিবাহিত জীবনে অঙ্গীকারপত্র বলবৎ থাকবে এবং স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই অঙ্গীকারপত্রের শর্ত মেনে চলতে বাধ্য থাকবে।

১৮৫৬ সালের ৯ জানুয়ারী প্রস্তাবিত আইনের পাণ্ডুলিপিটি পুনরায় ব্যবস্থাপক সভায় উপস্থাপিত হয়। পাণ্ডুলিপিটি পর্যালােচনা করে রিপাের্ট দিবার জন্য একটি সিলেক্ট কমিটির ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়। ১৮৫৬ সালের ৩১ মে সিলেক্ট কমিটি প্রস্তাবিত আইনের পক্ষে রিপাের্ট পেশ করে। ১৮৫৬ সালের ১৯ জুলাই ব্যবস্থাপক সভায় তৃতীয়বার খসড়াটি পঠিত হয়। অতঃপর ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই বিধবাবিবাহ আইন পাশ হয়- Act XV of 1856, being an Act to remove all legal obstacles to the marriage of Hindu Widows. আইনটিতে বলা হয়--প্রচলিত প্রথা ও হিন্দু আইনের ব্যাখ্যায় বিধবা স্ত্রী ও মৃত ব্যক্তির বাগদত্তা কন্যার পুনর্বিবাহ নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও এরূপ কোনাে বিবাহ অসিদ্ধ হবে না এবং এরূপ বিবাহজাত সন্তান অবৈধ হবে না। "No marriage contracted between Hindoos shall be invalid and the issue of such marriage shall be illegitimate by the reason of the woman having been previously married or betrothed to another person, who was dead at the time of such marriage. Any custom or any interpretation of Hindoo law to the contrary notwithstanding.” বিধবা বিবাহ-প্রবর্তক আইন বিদ্যাসাগরের অবিনশ্বর কীর্তি।

বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহকে শাস্ত্রসঙ্গত বলে প্রমাণ করলেন। তারই প্রচেষ্টায় বিধবাবিবাহ আইনসম্মত হল। কিন্তু তখনও বিধবাবিবাহ-বিরােধীরা মনে করেছিলেন যে, বিধবাবিবাহ বাস্তবে কার্যকরী হবে না। তাই কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বিদ্রুপ করে একটি কবিতা লিখলেন--
“হিন্দু বিধবার বিয়া আছে অপ্রচার। 
বহুকাল হতে যার নাহি ব্যবহার।।
সে বিষয়ে ক্ষতাক্ষত না করি বিশেষ। 
করিলেন একেবারে নিয়ম নির্দেশ।। 
শত শত প্রজা তায় ব্যথা পায় প্রাণে। 
তাদের আর্দশ নাহি শুনিলেন কানে।। 
গ্রান্ট করি গ্রান্টের সকল অভিলাষ। 
কালবিল কাল বিল করিলেন পাস।।
...
কোলে কাকে ছেলে ঝােলে যে সকল রাঁড়ী। 
তাহারা সধবা হয়ে পরে শাঁখা শাড়ী।। 
এ বড় হাসির কথা শুনে লাগে ডর। 
কেমন কেমন করে মনের ভিতর।।
...
সাহস কোথায় বল প্রতিজ্ঞা কোথায়। 
কিছুই না হতে পারে মুখের কথায়।। 
মিছামিছি অনুষ্ঠানে মিছে কাল হরা।
মুখে বলা বলা নয় কাজে করা করা।। 
সকলেই তুড়ি মারে বুঝে নাক কেউ। 
সীমা ছেড়ে নাহি খেলে সাগরের ঢেউ।। 
সাগর যদ্যপি করে সীমার লঙ্ঘন। 
তবে বুঝি হতে পারে বিবাহ-ঘটন।। 
নচেৎ না দেখি কোন সম্ভাবনা আর। 
অকারণে হই হই উপহাস সার।।
কেহ কিছু নাহি করে আপনার ঘরে। 
যাবে যাবে যায় শক্র থাক্‌ পরে পরে।। 
তখন এরূপ কবে হ'লে ব্যতিক্রম। 
‘ফাটায় পড়েছে কলা গােবিন্দায় নম।।
...
কিন্তু বিদ্যাসাগর কার্যত বিধবাবিবাহ-সংঘটনে অগ্রণী হন। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের বিদ্রুপকে উপেক্ষা করে এই কাজে মনপ্রাণ সঁপে দেন। তিনি মুখে যে কথা বলতেন, তা তিনি কাজে পরিণত করে প্রমাণ করতেন। এ ব্যাপারে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা ছিল, ছিল সাহসিকতা। তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

৭ ডিসেম্বর, ১৮৫৬ (২৩ অগ্রহায়ণ, ১২৬৩)। বাংলা তথা ভারতের বিধবাবিবাহের ইতিহাসে দিনটি বিশেষ উল্লেখযােগ্য। এই দিন বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় ও তার কতিপয় শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুর সহযােগিতায় প্রথম বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। পাত্র চব্বিশ পরগণা জেলার অন্তর্গত খাটুয়া গ্রামের রামধন তর্কবাগীশের পুত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। পাত্রী বর্ধমান জেলার অন্তর্গত পলাশডাঙ্গা গ্রামের ব্রহ্মানন্দ মুখােপাধ্যায়ের দশ বছরের বিধবা কন্যা কালীমতী দেবী। শ্রীশচন্দ্র ছিলেন সংস্কৃত কলেজের কৃতী ছাত্র। ১৮৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যশ্রেণির অধ্যাপক ছিলেন। পরে তিনি মুর্শিদাবাদের জজ পণ্ডিত হন। বিদ্যাসাগরের বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১২ নং সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। বিবাহবাসরে কলকাতা শহরের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। কৌতুহলবশতঃ বিবাহ দেখবার জন্য বাড়ীর সামনে অসংখ্য মানুষও ভিড় করেন। ভিড় সামলানাে ও শান্তিরক্ষার জন্য পুলিশ পাহারার বন্দোবস্ত ছিল। আমন্ত্রিত ও সমাগত ব্যক্তিদের জন্য আহারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই বিবাহে প্রায় দশ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। সমস্ত খরচ বহন করেছিলেন বিদ্যাসাগর।

রাজা রামমােহন রায়ের পুত্র রমাপ্রসাদ রায় বিদ্যাসাগরের বন্ধু ছিলেন। বিদ্যাসাগর নিজে রমাপ্রসাদ রায়কে নিমন্ত্রণ করতে যান। রমাপ্রসাদ রায় বিবাহ-অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন বলে বিদ্যাসাগরকে কথা দেন। কিন্তু বিবাহের আগে তিনি বিদ্যাসাগরকে বলেন, “আমি তাে ভেতরে ভেতরে আছিই। বিয়েতে নাই বা গেলাম।” রাগে বিদ্যাসাগর দেওয়ালে টাঙানাে রামমােহনের ছবি দেখিয়ে বলেন, “ওটা ফেলে দাও। ওটা ফেলে দাও।” তৎকালীন পত্রপত্রিকাগুলিতে বিবাহ-অনুষ্ঠানের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল।

তথ্যসূত্র--
৩৩. বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ - বিনয় ঘােষ
৩৪. করুণাসাগর বিদ্যাসাগর - ইন্দ্রমিত্র
৩৫. বিদ্যাসাগর - চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় 
৩৬. করুণাসাগর বিদ্যাসাগর - ইন্দ্রমিত্র 
৩৭. বিদ্যাসাগর- বিহারীলাল সরকার
৩৮. বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ - বিনয় ঘােষ
লেখকের 'বিদ্যাসাগর মানবতার মূর্ত প্রতীক' পুস্তক-এর নির্বাচিত অংশ (৭২-৭৮ পৃষ্ঠা)। 
প্রকাশক- পাওয়ার পাবলিশার্স।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ