বিশে ডাকাত-ইতিহাস বিকৃতি?।। পরাশর ভট্টাচার্য


জন্ম তারিখ ইতিহাসে লেখা নেই, ইতিহাস শুধু তার উপস্থিতির সাক্ষ্য দেয়, আর তার মহান প্রস্থান ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করতে বাধ্য হয় । ঔপনিবেশিক যুগের উচ্ছিষ্টভোজী বর্ণহিন্দু ভদ্রজনেদের বহু আগে  যারা মাতৃভূমির জন্য প্রাণ দিয়েছেন, তিনি তাদেরই একজন।  ইতিহাসে তাদের ছোট করে দেখানোর কোনো কসুর বাকি রাখেনি ভদ্রজনেরা, তারা অসভ্য তারা ডাকাত, তবু তারাই ভারতের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। 
১৮০০ শতকের নীল বিদ্রোহে প্রথম নেতৃত্ব দেন বিশ্বনাথ সর্দার, তিনিই নীল বিদ্রোহের প্রথম শহীদ। ইংরেজ ঐতিহাসিকরা তাকে বিশে ডাকাত বলে বর্ণনা করেছেন। মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায়ের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি বিশ্বনাথ সর্দার বাংলার হিন্দু মুসলমান কৃষককে একত্রিত করে নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রথম সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
বিশ্বনাথ ধনীদের সম্পদ লুণ্ঠন করে গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন, ফুলে(ফুলিয়া) নবলার জঙ্গলে ছিল তাঁর ঘাঁটি। কখনো রণপায়ে কখনো চুর্নির জলে নৌকা ভাসিয়ে সদলে চলে যেতেন দূরদূরান্তরের গ্রামে, ধনী অত্যাচারী জমিদাররাই ছিল তাঁর লক্ষ্য।
এইসময় নীলকর সাহেবরা বাংলার চাষিকে বলপূর্বক নীল চাষ করতে বাধ্য করছিল, নীল চাষ করতে অস্বীকার করলে তাদের চাবুক মেরে, ঘর জ্বালিয়ে নির্যাতন করা হোত, কৃষক রমণীকে কুঠিতে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ ও কৃষকদের হত্যা ছিলো নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা । 
শান্তিপুরের কৃষক ও তাঁতীরা বিশ্বনাথ সর্দারের কাছে সাহায্যের আবেদন জানালেন, তিনি গরীবের বন্ধু, অত্যাচারী জমিদারকে শায়েস্তা করেন, শোষকের ধণ কেড়ে শোষিতকে বিলিয়ে দেন, এই অন্যায়ের প্রতিবাদ তিনিই করতে পারবেন। বিশ্বনাথ তাদের জিজ্ঞাসা করলেন তোরা কে কে লাঠি ধরতে পারবি ?  গরীব চাষী আর তাঁতীরা বললে, আমরা যে কোনোদিন মারদাঙ্গা করিনি সর্দার,  আমরা কি পারবো ?  বিশ্বনাথ বললেন পারবিনে তো আমি কি করবো ?  যা মাগ ছেলেপুলে নিয়ে ঘরে যা,  নীল কুঠীর পেয়াদা কখন এসে ধরে নিয়ে যাবে তার জন্য অপেক্ষা কর। সমবেত পল্লী গ্রামস্থ প্রজারা কাতর কন্ঠে বললে এমন কথা বলবেন না সর্দার, আপনি ছাড়া আমাদের আর কে ভরসা দেবে। বিশ্বনাথ হেসে বললেন আর আমি যে লাঠির জোরে ভরসা রাখি রে, পারবিনা ওই লাঙল ধরা কড়া হাতে লাঠি ধরতে ? সমবেত চাষীদের মধ্য থেকে আওয়াজ উঠলো, আপনি সাথে থাকলে খুব পারবো সর্দার । বিশ্বনাথ তার বিশ্বস্ত অনুচর কাশিনাথ কে ডেকে বললেন, কাশি চূর্ণীর তীরে বন কেটে আখড়া বানা, এদের লাঠি আর সড়কী চালাতে শেখা।      
নীলকর ফ্রেডির অত্যাচারে নিষ্পেষিত শান্তিপুরের চাষি ও তাঁতিরা বিশ্বনাথ সর্দারের নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, বিশ্বনাথ ফ্রেডির কুঠি আক্রমণ করবার আগে তাকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করেন, এটাই ছিল তার রীতি। ১৮০৮ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর ফ্রেডি ও লেডিয়ার্ড বন্দুক নিয়ে সারারাত জেগে থাকেন, নদীয়ার জেলা শাসক ইলিয়ট কে খবর পাঠিয়ে দুজন গোরা সেপাই ও জনা চল্লিশেক দেশীয় লাঠিয়াল বহাল রাখেন, কিন্তু শেষ রাতে অল্প বৃষ্টিতে আবহাওয়া ঠাণ্ডা হতে লঠিয়ালরা ঘুমিয়ে পড়ে, ফ্রেডি, লেডিয়ার্ডও তন্দ্রাচ্ছন্ন, পাঁচিল ডিঙিয়ে কুঠিতে ঢোকেন বিশ্বনাথ সঙ্গে বিশ্বস্ত অনুচর  বৈদ্যনাথ ও কাশিনাথ। ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়লো ঝাড়বাতি, হঠাৎ আক্রমণে তন্দ্রাচ্ছন্ন সায়েবেরাও জেগে উঠে গুলি চালাতে লাগলেন, বিশ্বনাথের ছোঁড়া লাঠি কবজিতে লাগতেই বন্দুক হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল, দুজন নীলকরই বন্দী হলেন, লাঠিয়াল আর গোরা বন্দুকবাজরা দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারলোনা।হাজার হাজার গ্রামবাসী কুঠিতে ঢুকে ভাঙচুর চালাল, কেড়ে নেওয়া হোল বন্দুক, সড়কি। গ্রামবাসীরা ফ্রেডিকে হত্যা করতে বললেও বিশ্বনাথ তাকে ছেড়ে দিলেন, কারণ তিনি নিরস্ত্র বন্দীকে হত্যা করেননা। এরপর খালিবোয়ালিয়া, নিশ্চিন্তপুর, বাঁশবেড়িয়া একের পর এক নীলকুঠী আক্রমণ করে নীলকরদের মনে ত্রাসের সৃষ্টি করলেন বিশ্বনাথ,  তার ভয়ে নীলকররা নিজেদের সম্পুর্ন গুটিয়ে নিয়েছিল। 
বামুন কায়েত জমিদারেরা ছিলেন নীলকরদের বন্ধু, তারাও চাষীদের উপর কম অত্যাচার করতো না, বিশ্বনাথের লাঠি তাদের কোমর ভেঙে দিলো, আজ আড়ংঘাটা তো কাল চকবেড়িয়া, রাতারাতি রনপায়ে চড়ে সদলবলে পৌছে যেতেন বিশ্বনাথ, জমিদারের সমস্ত লুন্ঠন করলেও জমিদার বাড়ির মহিলাদের গায়ের গয়না নিতেন না ।  ভীত নারীরা গায়ের গয়না খুলে দিতে উদ্যত  হলে হাতজোড় করে বলতেন, তোমার সিন্দুকের গয়না দাও মা জননী, ওই গলার হার খুলোনা।লুণ্ঠিত ধন বিশ্বনাথ বিলিয়ে দিতেন দরিদ্র মানুষের মধ্যে, নারীর সম্মানরক্ষা তিনি তার পবিত্র কর্তব্য মনে করতেন। তার গতি, আক্রমণ ও পরবর্তী অতর্কিতে আক্রমণের দূরত্ব শত্রুকে দিশেহারা করে দিলো, তাদের বিশাল বাহিনী নিয়েও তারা কিছুতেই বিশ্বনাথকে ধরতে পারেনা। 
এদেশে অনেক কিছুর অভাব থাকলেও বিশ্বাসঘাতকের অভাব কোনো কালেই ছিলো না। তাদেরই একজনের সহায়তায় একদিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবেরা বিশ্বনাথের হদিস পেয়ে গেলো।
ইলিয়ট ও ব্ল্যাক ওয়ারের বিশাল পুলিশ বাহিনী যখন তাকে ঘিরে ধরে, তখন বিশ্বনাথ তার সঙ্গে থাকা কৃষকদের আগে ঘেরাও মুক্ত করেন, অবশেষে  সবার নিরাপদ নিষ্ক্রমণ সুনিশ্চিত করে তিনি ও বৈদ্যনাথ আত্মসমর্পণ  করেন। সেইসময় সেখানে অগণিত মানুষ উপস্থিত হয়ে শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে। ইংরেজরা এর আগে দেখেছে এদেশের নবাবের লাশ উলঙ্গ করে হাতির পিঠে চড়িয়ে বাজারে ঘোরালে এদেশের মানুষ দাড়িয়ে তামাশা দেখে, আজ তার উল্টো ছবি দেখে ব্রিটিশ প্রমাদ গুনলো।
ইংরেজরা তাঁকে ফাঁসী দেয়, ও মানুষকে সন্ত্রস্ত করতে, যাতে আর কেউ বিশ্বনাথ সর্দারের মতো বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিতে সাহস না পায়, তার মৃতদেহ একটি খাঁচায় পুরে কৃষ্ণনগরের কাছে আসননগরে একটি গাছে ঝুলিয়ে রাখে, বিশ্বনাথের মা তার অবশিষ্ট কংকালটি জলে ভাসিয়ে দেবার অনুরোধ করলেও সুসভ্য ইংরেজ জাতি তাতে কর্ণপাত  করেনি। 
বিশ্বনাথ সর্দার এদেশের মাটিতে মিশে গেছেন, বিছন হয়ে আছেন বঞ্চিত নিপীড়িত শোষিত মানুষের সংগ্রামে। বাংলার মাটি, বাংলার জল আজও তার পুন্য প্রবাহ বহন করে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ