রবীন্দ্র বিরোধিতার স্বরূপঃ পাকিস্তান পর্ব ।। কুলদা রায়


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত  শিলাইদহ কুঠিবাড়ি 

১.

পাকিস্তানের জন্মমৃত্যুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ জড়িত। পাকিস্তান শুধু একটা রাষ্ট্র নয়-একটা পন্থাও বটে। এই পাকিস্তানপন্থা মানুষের সম্প্রীতির জায়গাটি ভেঙে দিতে চেয়েছে-চেয়েছে সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি চাগিয়ে তুলতে। উদ্দেশ্য বাঙালি নামক একটা বিকাশমান জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে শেষ করে ফেলা। একটি নিরঙ্কুশ উপনিবেশ কায়েম করার লক্ষ্যে জাতি হিসাবে বাঙালিকে পঙ?গু করে দেওয়া।

খুব কঠিন কথা। কিন্তু সরল সত্যি। তারা পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই এই পন্থাটিকে হাজির করে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভেতর দিয়ে। তারা ধর্মকেই রাষ্ট্র গঠনের ও জাতীয়তা নির্ধারণের একমাত্র নীতি হিসাবে গ্রহণ করে। এই নীতির মধ্যেই পাকিস্তানের জন্ম ১৯৪৭ সালে। মৃত্যু ১৯৭১ সালে। এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে পাকিস্তানের ভূতটির আছর দেখা দিচ্ছে।

১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে মুসলিম লীগ ভারতের মুসিলম প্রধান অঞ্চলগুলোতে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠনের দাবী উত্থাপন করেছিল। বলা হয়েছিল , এই রাষ্ট্রসমূহের অন্তর্ভূক্ত ইউনিটগুলো হবে স্বায়ত্বশায়িত এবং সার্বভৌম। কিন্তু ১৯৪৬ সালে দিল্লীতে অন্য এক প্রস্তাবে, ভারতের উত্তর-পূর্বে বাংলা ও আসাম, উত্তর-পশ্চিমে পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান, প্রভৃতি ব্যাপক মুসলমান জনঅধ্যূষিত অঞ্চলগুলুসহ একটি মাত্র সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বস্তুত এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়েই প্রণীত হয়েছিল পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের স্থায়ী উপনিবেশ পরিণত করার গোপন ও সুপরিকল্পিত সনদ। তারা বলে, যেহেতু মুসলমান আন্দোলেনর ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাই একটি ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানকে গড়ে তোলাই হবে যুক্তিসঙ্গত। অথচ মুসলিম লীগ এবং এর নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রকৃতপক্ষে কেউ-ই ধর্মানুরাগী ছিলেন না। কিংবা ইসলামের কোনোরূপ উৎকর্ষ সাধনও তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। তারা তাঁদের শোষণ কৌশলকে কার্যকর করার লক্ষ্যে ইসলাম ধর্মের একটি রাজনৈতিক সংস্করণ বের করে ফেলে। ধর্মকে যখন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করা হয় তখন তারা ফ্যাটসীবাদে পরিণত হয়।

পাকিস্তানের সূচনাতেই সাম্প্রদায়িক উস্কানি মূখ্য ভূমিকা নিয়েছিল। ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবীতে মুসলিম লীগ যে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেয়, মূলত তা ছিল এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নামান্তর। ১৯৪৭ সালের পরেও এই দাঙ্গা স্থায়ী হয়েছিল। ফলে এই ভেদরাজনীতির বাইরে অবস্থান করেও অসংখ্য মানুষ বাস্তুচ্যূত হয়-- দেশচ্যূত হয়।

পাকিস্তান সৃষ্টির বছর খানের মধ্যেই প্রথম আক্রান্ত হয় বাংলা ভাষা। শুরু হয় ভাষা সাম্প্রদায়িকতা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে বুকের রক্ত দিয়ে বাঙালিরা সে আক্রমণ প্রতিরোধ করে। এই ভাষা আন্দোলনের মধ্য থেকেই বাঙালী আত্মপরিচয় ফিরে পায়। তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ঘটে। বুঝতে পারে দ্বিজাতিতত্বের অসারতা এবং কপট রাজনীতির হিংস্রতা। বাঙালি তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানপন্থার নাগপাশ থেকে মুক্তির দাবীতে সোচ্চার হতে শুরু করে। এই মুক্তির আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ সহায় হয়ে উঠেন।

পর্যায়ক্রমে পাকিপন্থা শাসকগোষ্ঠী বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিবিরোধী বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা পূর্ববাংলায় একটি বুদ্ধিবৃত্তিক মৌলবাদি গ্রুপও তৈরি করে ফেলে। তাদের সহায়তায় কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা হরফ পরিবর্তন, বাংলা ভাষার ইসলামী রূপদান এবং বাংলা ভাষা সংস্কার প্রভৃতি জঘণ্য কাজ শুরু করে। আক্রান্ত হন রবীন্দ্রনাথ। কালক্রমে ১৯৭১ সালে পাকিপন্থা বাঙালীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হত্যা করে ৩০ লাখ মানুষ। ধর্ষিতা হয় ৩ লাখ নারী। দেশত্যাগের শিকার হয় এক কোটি বাঙালি। এর মধ্যে দিয়েই বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি ভুমিষ্ট হয়। রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি হয়ে ওঠে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত।

রবীন্দ্রনাথ যে বাঙালী জাতিসত্তার সঙ্গে এত প্রখরভাবে প্রবলভাবে প্রাণবন্ত হয়ে সঙ্গী হবেন-সেটা পাকিপন্থা গোড়া থেকেই বুঝতে পেরেছিল। বুঝতে পেরেছিল বলেই পাকিস্তানের জন্মর পরপরই রবীন্দ্রবিরোধিতার বীজটি রোপণ করে।

২.

পাকিস্তান শাসনামলে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। এর পরিকল্পনা হয়েছিল পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই। ১৯৪১সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ ও পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি গঠিত হয়।

একাত্তরের পাকবাহিনীর সহযোগী সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন একাত্তরের স্মৃতি গ্রন্থে লিখেছেন--

আমাদের লক্ষ্য ছিল, বাংলা ভাষায় মুসলিম কালচারের পরিচয় থাকে এমন সাহিত্য সৃষ্টিতে লেখকদের উদ্বুদ্ধ করা। একই সময় পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি গঠিত হয়। সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইনকে চেয়্যারম্যান নির্বাচন করা হয়। সে সময় এই সংগঠনের পক্ষ থেকে আবুল মনসুর আহমদ, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ লেখেন, যে পাকিস্তানের স্বপ্ন তারা দেখছেন-সেখানে যে বাংলা ভাষা চালু থাকবে , সে ভাষার চরিত্র হবে হিন্দুত্ব বর্জিত।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়ে গেল। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ সাহেব ঘোষণা দিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা নয়-একমাত্র উর্দু। যারা এর বিরোধিতা করবে তারা পাকিস্তানরে শত্রু।

সে সময় পূর্ববঙ্গে মাত্র ১.৫২% মুসলমান অধিবাসী ছিলেন বিদেশাগত। এরা ছিলেন ধনী এবং বাস করতেন শহরে। ছিলেন উর্দুভাষী। অধিকাংশ উর্দুভাষীরা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী। আর ৯৮% মুসলমান বাস করতেন গ্রামে। এরা কথা বলতেন বাংলা ভাষায়। জীবিকার জন্য নির্ভর করতেন জমির উপর। জোলা, দরজি, ঘরামি, কশাই ইত্যাদি পেশায়ও নিয়োজিত ছিলেন অনেকে। যথারীতি উর্দুভাষী গ্রামবাসী গরীব চাষাভূষো মুসলমানদের আতরাফ বা নিম্নশ্রেণীর বলেই গণ্য করতেন।

ভাষাতাত্ত্বিক গ্রিয়ারসন আলোচনায় মন্তব্য করেন যে, গ্রামের নিম্নশ্রেণীর হিন্দু এবং মুসলমানদের ভাষায় আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য থাকলেও ভাষাগত কোনো পার্থক্য ছিল না, অল্প কিছু ধর্মীয় শব্দ ছাড়া।

এসব সত্ত্বেও তারা মনে করছেন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যদি নাও হয় তাহলেও অন্তত: সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলমান তর্কাতীতভাবে দুটি আলাদা জাতি? একথা স্বীকার্য যে হিন্দুমুসলিম সংস্কৃতির মধ্যে মিল আছে, কিন্তু অমিলও কম নেই? যেখানে সেই অমিল অর্থাৎ মুসলিম সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য, তার বিকাশের মধ্যেই রয়েছে "তমদ্দুনী আজাদীবাকালচারেল অটনমী'? বোঝা যায় পাকিস্তানে, মূলত পূর্ব পাকিস্তানে তাঁরা ইসলামী বা মুসলিম সংস্কৃতি চর্চার ওপর গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন?১৯৪৯ সালে মাহে নও পত্রিকায় আবুল কালাম শামসুদ্দীনের কণ্ঠে এঁদের সকলের কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শোনা যায়,'বিজাতীয়ভাবধারা, বিজাতীয় উপমা রূপক শব্দ কোন কিছুই আর নতুন পোষাক পরে পাকিস্তান সাহিত্যে চালু হতে পারবে না?' (মাহে-নও, ১৩৫৬)।

প্রফেসর হাবিব রহমান লিখেছেন, এঁরা প্রচুর আরবি-ফারসি উপাদান আমদানি করে বাংলা ভাষাকে একটা স্বাতন্ত্র্যবাদি বৈশিষ্ট্য দিতে চান। কেবল তাই নয়, কেউ কেউ আবার আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করেন। গোলাম মোস্তফা, ফররুখ আহমদ, রওশন ইয়াজদানী, তালিম হোসেন, মোফাখখারুল ইসলাম ,মীজানুর রহমান, শাহেদ আলী প্রমুখের রচনায় এই মুসলমানী বাংলা লেখার মানসিকতা অভ্রান্তভাবে প্রকাশ পেয়েছিল।

১৯৫১ সালে সৈয়দ আলী আহসান (জন্ম ১৯২) মাহে নও তৃতীয় বর্ষ, পঞ্চম সংখ্যা (আগস্ট ১৯৫১) পত্রিকায় "পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা সাহিত্যের ধারা' প্রবন্ধে লেখেন-

"প্রাক্তন সম্পূর্ণ বাংলার সাহিত্যের ভাণ্ডার কখনও নি:শেষিত হবে না। সেগুলোর উপর উভয় বাংলারই পূর্ণ অধিকার আছে, কিন্তু এই অধিকার থাকার অর্থ এই নয় যে, এই সাহিত্যের ট্রেডিশনও আমরা গ্রহণ করবো। নতুন রাষ্ট্রের স্থিতির প্রয়োজনে আমরা আমাদের সাহিত্যে নতুন জীবন ও ভাবধারার প্রকাশ খুঁজবো। সে সঙ্গে একথা সত্য যে, আমাদের সাংস্কুতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার এবং হয়তো বা জাতীয় সংহতির জন্য যদি প্রয়োজন হয়, আমরা রবীন্দ্রনাথকেও অস্বীকার করতে প্রস্তুত রয়েছি। সাহিত্যের চাইতে রাষ্ট্রীয় সংহতির প্রয়োজন আমাদের বেশি।?পূর্ব বাংলার সাহিত্যক্ষেত্রে আমাদের উত্তরাধিকার হলো ইসলামের প্রবহমান ঐতিহ্য, অগণিত অমার্জিত পুঁথি সাহিত্য, অজস্র গ্রাম্যগাথা, বাউল ও অসংস্কৃত অঙ্গের পল্লীগান।'

এই উপলদ্ধি থেকে তাঁর সম্পাদিত দুখণ্ড গল্প সংগ্রহে (ঢাকা, ১৯৫২) তিনি কোনো অমুসলমান লেখকের লেখা প্রকাশ করেননি।

কিন্তু এই ১৯৫২ সালেই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠানের বঙালি চেতনায় সমৃদ্ধ উৎসবের দেশে পরিণত হয়। এই অনুষ্ঠানে উৎসবে রবীন্দ্রসঙ্গীত, রবীন্দ্রসাহিত্য মানুষের অবলম্বন হযে দাড়ায়। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি নতুন করে জেগে ওঠে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে।

মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাত বছরের মধ্যে যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসিলম সরকারের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। তিন শতাধিক আসনের মধ্যে তারা পায় মাত্র নটি আসন। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সালের সময়কালের মধ্যে মাত্র এক বছরের গণতন্ত্র একবার মাত্র উঁকি দিয়ে যায়। আর কখনো পাকিস্তানে ১৪ বছরের মধ্যে আসেনি।

পাকিস্তানে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র প্রবর্তনের নানা চেষ্টার পর ১৯৫৮ সালে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে এবং শুরু হয় আইয়ুব খানের শক্ত শাসন। সব রকম গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হয়, রাজনৈতিক দল ও কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং ব্যাপক গ্রেপ্তারির মাধ্যমে কারাগার ভরে ওঠে রাজবন্দীদের দ্বারা।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছিল অস্বীকৃত এবং সভা-সমাবেশের ওপর জারি ছিল নিষেধাজ্ঞা। ঘোর অন্ধকার ওই সময়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলো ছত্রখান অবস্থায়, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ তো দূরের কথা, দেশের মানুষের একত্র হওয়ার মতো কোনো অবলম্বনও তখন নেই। আইয়ূব খান ময়মনসিংহের এক বটতলার উকাল মোনায়েম খানকে গভর্ণর নিযুক্ত করেন। এই মোনায়েম খানই আইয়ুব খানের জল্লাদ হিসাবে আবির্ভূত হয়।

তখন ১৯৫৯ সালের গোড়ার দিকে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের উদ্যোগে করাচিতে এক লেখক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সেখানে আইয়ুব খান পরিস্কারভাবে ঘোষণা দেন, পাকিস্তানী ভাবদর্শের প্রতি লেখকদের আনুগত্য থাকতে হবে। পাকিস্তানের ভিতর অসাম্প্রদায়িকতা, বাঙালিত্ব, রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদিকে তিনি পঞ্চমবাহিনীর ঘটনা বলে প্রকাশ করেন। এটাকে কঠোর হাতে দমন করার নীতি ঘোষণা করেন। তার একাজে সমর্থন জানায় সাম্প্রদায়িক দক্ষিণপন্থী এবং বাঙালিত্বে হিন্দুত্ব আবিষ্কারকারী মহলসমূহ, বিশেষ করে বাঙালি-বিদ্বেষী ও জাতিবৈরের পরাক্রান্ত ক্রিমিনাল অবাঙালিরা।

এ সময়ই সৈয়দ আলী আহসান করাচি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে বাংলা একাডেমীর পরিচালকের দায়িত্ব নেন ১৯৬০ সালে। তিনি রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের উদ্যোগ গ্রহণের বিরোধিতা করেন। বাংলা একাডেমীতে প্রফেসর আনিসুজ্জামানকে সাফ সাফ বলে দিলেন, সরকারী সিদ্ধান্তের বাইরে তিনি কিছু করবেন না। সরকারী সিদ্ধান্তটা ছিল পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোনো আয়োজন হবে না।

এই পরিস্থিতিতে চির নূতনের ডাক দিয়ে এল পঁচিশে বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথের শততম জন্মবার্ষিকী। বাঙালির এই মহৎ কবিকে স্মরণ করার জন্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক উদ্যোগ যে বাঙালি জাতিসত্তার পরিপ্রকাশক হয়ে উঠবে, তা শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পেরেছিল। বাঙালিকে গড়াপেটা করে দ্বিজাতিতত্ত্ব-ভিত্তিক মুসলিম জাতি তৈরির যে প্রয়াস চলছিল, তা বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে রবীন্দ্রনাথ নামের কবির দ্বারা, যাঁর জন্ম আজি হতে শতবর্ষ আগে। এই উপলব্ধি থেকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ পালনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করল, আজাদ পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে লেখা হলো: "রবীন্দ্রনাথের দোহাই পাড়িয়া অখণ্ড বাংলার আড়ালে আমাদের তামদ্দুনিক জীবনে বিভেদ ডাকিয়া আনার সুযোগ দেওয়া চলিবে না। একদল লোক পশ্চিম বাংলার সাহিত্যের অন্ধ-অনুসারী ও ভক্ত। তাদের রবীন্দ্র-ভক্তি বিপদের কারণ হইতে পারে এবং বাইরের যারা পাকিস্তানকে দ্বিধাহীন মনে গ্রহণ করেন নাই, তারা এই সুযোগে তামদ্দুনিক খেলায় নামিতে পারে।'

একাত্তরের ঘাতক জামাতে ইসলামীর অধ্যাপক গোলাম আজম ও তদনুসারীদের সভা আয়োজিত হয় ২৪ বৈশাখ। সভার সিদ্ধান্তে বলা হয়, "পাকিস্তানিদের ইসলামভিত্তিক জাতীয়তা ও রাষ্ট্রে অখণ্ড ভারতীয় রামরাজ্যের স্বপ্নদ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথকে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় কবি হিসাবে চালু করবার জন্য একশ্রেণীর তথাকথিত সংস্কৃতিসেবী প্রদেশব্যাপী যে সাংস্কৃতিক অপচেষ্টা চালাইয়া যাইতেছে, এই সভা তাহাদের নিন্দা করিতেছে।'

গোটা বৈশাখ মাস জুড়েই দৈনিক আজাদ পত্রিকা রবীন্দ্রনাথকে মুসলিম-বিদ্বেষী, হিন্দু ভাবধারার বাহক এবং পাকিস্তানের সংস্কৃতিক্ষেত্র অগ্রহণীয় বলে প্রচার করতে থাকে। স্বয়ং দৈনিক আজাদের সম্পাদক মোলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ স্বনামের রবীন্দ্রবিরোধী লেখা প্রকাশ করলেন।

সে সময় পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ প্রচার করছে, রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ পালনের জন্য ঢাকার ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশন দুহাতে পয়সা ছড়াচ্ছে।

১৯৬১ সালের ৭ মে সন্ধ্যায় ঢাকা জেলা পরিষদ হলে ফজলুল হক সেলবর্সীর সভাপতিত্বে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় সরকারী উদ্যোগে। আলোচকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জামাতে ইসলামীর গোলাম আজম, মঈনুদ্দিন, দেওয়ান আব্দুল হামিদ, মওলানা মহীউদ্দিন, হাফেজ হাবিবুর রহমান, আব্দুল মান্নান তালিব প্রমুখ। সেখানে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে প্রচুর বিষোদ?গার হয়েছিল। সভায় বলা হয়েছিল, রবীন্দ্র-সাহিত্য হিন্দু ও ভারতীয় সাহিত্যের সঙ্গে অভিন্ন বলে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোনো আয়োজনের রাজনৈতিক তাৎপর্য হল-পাকিস্তানরে জাতীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রকে বানচাল করে অখণ্ড ভারতীয় রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহায়তা করা। এই সভাতেই সর্বপ্রথম রবীন্দ্রনাথের নাম না করে পূর্ব পাকিস্তানের সকল বিশ্ববিদ্যালয়, একাডেমি ও বেতারকেন্দ্রকে "বিজাতীয় সঙ্গীত-সাহিত্যের অভিশাপমুক্ত' করার আহ্বান জানানো হয়।

মজার কাণ্ড হল, সে সময় সৈয়দ আলী আহসান রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করলেও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি ব্যক্তিগতভাবে একটি কবিতা লিখে ফেলেন। তার ওস্তাদ প্রফেসর সাজ্জাদ হোসাইনও রবীন্দ্র-সাহিত্যের প্রশংসা করে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সৈয়দ আলী আহসান এটা করেছিলেন ভবিষ্যতের ডিগবাজি দেওয়ার সুযোগ করে রাখার জন্য। তিনি চিরকালই খানেওয়ালা। তিনি জানতেন পাকিস্তানী এই চক্রান্ত পরাজিত হবে। আর সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন যা পাওয়ার সব পাকিস্তানে থাকতেই পেয়ে গিয়েছিলেন। নতুন করে তার পাওয়ার কিছু ছিল না। তাই তিনি পাকিস্তানী কলাবোরেটর হিসাবে দালাল আইনে আটক হয়ে জেলখানায় থেকে একটি আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছিলেন, রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষের সময় তাকে ব্যবহার করা হয়েছিল। (১৯৬৭ সালে বেনজির আহমদ, আশরাফ সিদ্দিকী ও সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন রবীন্দ্রবিরোধিতায় সবচেয়ে বড় ভূমিকাটি রাখেন। )

এই বুদ্ধিবৃত্তিক মৌলবাদিদের রবীন্দ্র-বিরোধিতার কারণটি একান্তভাবে রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত সুযোগ লাভের প্রত্যাশা? সরকার চাইছিল 'হিন্দু' কবি রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করতে আর 'মুসলমান' কবি ইকবালকে প্রতিষ্ঠা দিতে। রবীন্দ্রনাথের শূন্যস্থানে ইকবালকে ছাড়া আর কাউকে তো বসানো যায় না? তাছাড়া ইকবাল উর্দূ ও ফারসি ভাষার কবি। বাংলার চেয়ে এ দুটি ভাষার সঙ্গে মুসলমান 'জাতি'র সত্তার যোগ অধিক। অবশ্য বাংলা ভাষার 'মুসলমান' কবি নজরুল ইসলাম আছেন। তবে তাঁকে গ্রহণ করা যায় কাটা- ছেঁড়া করে। সরকারের এই মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটেছিল রবীন্দ্র-বিরোধীদের বক্তব্যে। তা না হলে অন্তত কবি গোলাম মোস্তফা ও সৈয়দ আলী আহসান যে রবীন্দ্র-প্রতিভাকে চিনতেন না তা তো নয়? ১৯৫৪ সালে ক্ষমতাসীন মুসলিমলীগের পরাজয় ঘটে যুক্তফ্রন্টের কাছে। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী অচিরেই এই যুক্তফ্রন্ট সরকারকে হঁটিয়ে ইস্কান্দার মির্জার নেতৃত্বে সামরিক শাসকগোষ্ঠী ক্ষমা দখল করে।

পাকিস্তানে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র প্রবর্তনের নানা চেষ্টার পর ১৯৫৮ সালে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে এবং শুরু হয় আইয়ুব খানের শক্ত শাসন। সব রকম গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হয়, রাজনৈতিক দল ও কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং ব্যাপক গ্রেপ্তারির মাধ্যমে কারাগার ভরে ওঠে রাজবন্দীদের দ্বারা।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছিল অস্বীকৃত এবং সভা-সমাবেশের ওপর জারি ছিল নিষেধাজ্ঞা। ঘোর অন্ধকার ওই সময়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলো ছত্রখান অবস্থায়, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ তো দূরের কথা, দেশের মানুষের একত্র হওয়ার মতো কোনো অবলম্বনও তখন নেই।

১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষকী দমনের ফরমান জারী করে আয়ুব শাহী। সারাদেশে আইয়ূব শাহীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর সফল আয়োজন হল। ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল অফিসে তরুণ কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন আরচার ব্লাড, সুধার ভূমিকায় অভিনয় করেছিল ব্লাডকন্যা দ্বাদশবর্ষীয়া শিরিন। ঢাকা ও ময়মনসিংহে সফল মঞ্চায়নের পর তাঁরা যখন আরও কয়েকটি স্থানে নাটক মঞ্চায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন গভর্নর মোনায়েম খানের দপ্তর থেকে নাটক বন্ধ করার কথা বলা হয় এবং ডাকঘর মঞ্চায়ন বন্ধ হয়ে যায়।

এই ছিল পাকিস্তানি বাস্তবতা, অবাস্তবের বাস্তবতা, যার সঙ্গে পরবর্তী কালের ল্যাটিন আমেরিকান লৌহমানবদের শাসনের মিল পাওয়া যেতে পারে, যে অ্যাবসার্ড শাসন বোঝাতে ম্যাজিক রিয়ালিজমের আশ্রয় নিতে হয়েছিল ঔপন্যাসিক গার্সিয়া মার্কেজকে। পাকিস্তানেও দেখা গেছে আইয়ুবের বশংবদ গভর্নর মোনায়েম খান ম্যাজিক রিয়ালিজমের ধারাতেই বুঝি অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাইকে রুষ্ট কণ্ঠে বলেন, "আপনারা রবীন্দ্রসংগীত লিখতে পারেন না। তার যে চাই পাকিস্তানি ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ রবীন্দ্রসংগীত!'

তখন ঢাকায় আয়ুবশাহী ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবর্ষ সফল পালনে "ক্রুদ্ধ' পাকিস্তানি সমরনায়কপ্রধান ১৯৬২-তে সাহসী ছাত্রদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে ওদের চমকে দিল। দমননীতির স্টিমরোলার নেমে এলো। নির্বাচনের খায়েশ হলো সমরতন্ত্রীদের। "মৌলিক গণতন্ত্র' বলে অদ্ভুত এক বিধান সৃষ্টি করল নিজেদের সুবিধার কথা মনে রেখে।

১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধের সময় ভারত থেকে বই আমদানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বাংলাভাষা ও সাহিত্যের বিরাট অংশ থেকে পূর্ব-বাংলার বাঙালিদের বঞ্চিত রাখবার সরকারি অভিপ্রায় এতে কাজ করেছিল। ভারতীয় সম্পদ বর্জনের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ-বর্জন নিয়ে সংকট আরও ঘনীভূত হয়। তখন সরকার বুলবুল ললিত কলা একাডেমীর কর্মকাণ্ডকে সঙ্কুচিত করে দিল। রেডিওতে রবীন্দ্রসঙ্গীত নাই হয়ে যেতে থাকল।

সাতষট্টিতে জুন মাসে ঢাকায় নবাব বাড়ির শাহাবুদ্দিন, পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী হিসাবে ফতোয়া দিলেন- রবীন্দ্র সঙ্গীত হিন্দু সঙ্গীত, ইসলামের পবিত্রভূমি পাকিস্তানে তা চলবে না। তেইশে জুন সরকারীভাবে এই ঘোষণাটি জারি করা হল। পঁচিশ জুন ঢাকার উনিশ জন বুদ্ধিজীবি এই ফতোয়া বা ঘোষণার নিন্দা ও প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দিলেন। উত্তরে চল্লিশ জন তমুদ্দুনপন্থী নামীদামী মানুষ রবীন্দ্র বর্জনকে স্বাগত জানান। কবি সৈয়দ আলী আহসান তাদের অন্যতম।

তারা বিবৃতিতে বলেন, রবীন্দ্রনাথকে তারা বাংলাভাষী পাকিস্তানীদের সংস্কৃতির অবিচ্ছদ্য অঙ্গ নয়। রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এবং রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করলে পাকিস্তানী সংস্কৃতির মূল নীতিটাকেই বিরোধিতা করা হয়।

রবীন্দ্রবর্জনের পক্ষে বিবৃতিদাতা ৪০ জন বুদ্ধিজীবিদের হলেন-

১. মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, ২. বিচারপতি আবদুল মওদুদ,৩. আবুল মনসুর আহমদ,৪. আবুল কালাম শামসুদ্দিন, ৫.অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খাঁ, ৬. মজিবর রহমান খাঁ, ৭. মোহাম্মদ মোদাব্বের, ৮. কবি আহসান হাবীব ১৩. বেনজীর আহমদ, ১৪. কবি মইনুদ্দিন, ১৫. অধ্যক্ষ শেখ শরফুদ্দিন, ১৬. আ.কা.ম. আদমউদ্দিন, ১৭.তালিম হোসেন, ১৮. শাহেদ আলী, ১৯. আ.ন.ম. বজলুর রশীদ, ২০. মোহাম্মদ মাহফুজুল্লাহ, ২১. সানাউল্লাহ নূরী, ২২. কবি আবদুস সাত্তার, ২৩. কাজী আবুল কাশেম (শিল্পী), ২৪. মুফাখখারুল ইসলাম, ২৫. শামসুল হক, ২৬. ওসমান গণি, ২৭. মফিজ উদ্দিন আহমদ, ২৮. আনিসুল হক চৌধুরী, ২৯. মোস্তফা কামাল, ৩০. অধ্যাপক মোহাম্মদ মতিউর রহমান, ৩১. জহুরুল হক, ৩২. ফারুক আহমদ, ৩৩. শরফুদ্দীন আহমদ, ৩৪. বেগম হোসনে আরা, ৩৫. মাফরুহা চৌধুরী, ৩৬. মোহাম্মদ নাসির আলী, ৩৭. এম. নূরুল ইসলাম, ৩৮. কবি জাহানারা আরজু, ৩৯. কাজী আবদুল ওয়াদুদ, ৪০. আখতার উল-আলম।

এই চল্লিশজনকে বলা হত চল্লিশ চোর। এই উপাধি দিয়েছিলেন কবি আব্দুল গণি হাজারী। অনেক সইদাতা উত্তরকালে অনেক মূল্যে কলঙ্কমোচনের প্রয়াস পেয়েছেন, অনেকে বাংলার স্বাধীনতার পক্ষে মূল্যবান কাজ করেছেন। কিন্তু সঙ্গতভাবেই 'চল্লিশ চোর'-এর অধিকাংশ মুক্তিযুদ্ধে অনতিপ্রচ্ছন্ন রাজাকার ভূমিকা পালন করেছেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন।

এবার জানা যাক- এই চল্লিশ চোরের বিবৃতির প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন তাদের নাম- ১. ড: কুদরত-ই-খুদা, ২. ড: কাজী মোতাহার হোসেন, ৩. বেগম সুফিয়া কামাল, ৪. জয়নুল আবেদীন, ৫. এম.এ. বারি, ৬. অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল হাই, ৭. অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ৮.ড: খান সারওয়ার মুরশিদ, ৯. সিকান্দার আবু জাফর, ১০. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ১১. ড: আহমদ শরীফ, ১২. ড: নীলিমা ইব্রাহীম, ১৩. কবি শামসুর রাহমান, ১৪. হাসান হাফিজুর রহমান, ১৫. ফজল শাহাবুদ্দিন, ১৬. ড: আনিসুজ্জামন, ১৭. রফিকুল ইসলাম, ১৮. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান প্রমুখ। (মোট ১৯ জন)। এঁদের মধ্যে কয়েকজনকে একাত্তরে হত্যা করা হয়। (এই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম প্রণেতা ছিলেন সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন। ) কয়েকজনকে বিএনপি জামাত আমলে মুরতাদ ঘোষণা করা হয় এবং কবি শামসুর রাহমানকে হত্যার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। ফজল শাহাবদ্দিন পরবর্তীকালে সৈয়দ আলী আহসানের চেলা হয়েছেন। বাকীরা প্রগতিশীলতার পক্ষে সরব ছিলেন-আছেন।

১৯৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তানের তথ্য ও বেতার মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন জাতীয় পরিষদে ঘোষণা করেন যে, ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসকচক্রের তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন আহমদ পার্লামেন্টের এক অধিবেশনে মন্তব্য করে বসল: "রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির কেউ নন।' পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক মর্যাদার পরিপন্থী এমন সকল রবীন্দ্র সঙ্গীত ভবিষ্যতে পাকিস্তান বেতারে প্রচার করা হবে না। এবং অন্যান্য সঙ্গীতেরও প্রচার হ্রাস করা হবে।

খাজা শাহাবুদ্দিনের এই মন্তব্যে সারাদেশ ক্ষেপে উঠল। ঢাকায় তিনদিন ব্যাপী রবীন্দ্র অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে আইয়ুব খানের গভর্নর মোনায়েম খান কয়েক ট্রাক গুণ্ডা পাঠিয়ে অনুষ্ঠান বানচাল করার চেষ্টা করেন। অনুষ্ঠান শেষে শিল্পীরা চলে যাওয়ার পরে অনুষ্ঠানস্থলটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাত্রিতে ঢাকা শহরে পাক বাহিনী অপারেশন সার্চ লাইটের মাধ্যমে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালায়। আক্রমণ করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে। হত্যা করা অসংখ্য ছাত্রকে- হত্যা করা হয় শিক্ষকদের। এ সময় রবীন্দ্র বিরোধিতাকারী ড: সাজ্জাদ সাজ্জাদ হোসাইন ছিলেন রাজশাহী বিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তার সঙ্গে ছিলেন ১.হামিদুল হক চৌধুরী : মালিক অবজারভার গ্রুপ অব পাবলিকেশন্স ২.মাহমুদ আলী : ৪.বিচারপতি নুরুল ইসলাম : বাংলাদেশের সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি, ৫. ড: কাজি দীন মুহাম্মদ : অধ্যাপক বাংলাবিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালী শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবি সাংবাদিকদের হত্যা করার কাজে সহায়তা করে।

আর সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন একাত্তরে ঘাতক টিক্কাখানের আমন্ত্রণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দায়িত্ব নেন। তিনি রাও ফরমান আলীর সঙ্গে সেই পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা সংস্কার কমিটি গঠন করেন এবং ১৯৪০ সালের করা সেই পূর্ব বাংলা রেনেসাঁ সোসাইটির প্রকল্পটির নতুন ভাষ্য তৈরি করেন। এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীল নকশা প্রনয়নে রাওফরমান আলীকে সহযোগিতা করেন। পাকিস্তান বাহিনী পরাজিত হলে-তিনি গণ ধোলাইয়ের সম্মুখিন হন। পরে জেল থেকে বেরিয়ে বিদেশ চলে যান। গোলাম আযমের সঙ্গে বাংলাদেশ বিরোধি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন। তিনি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বাংলা ভাষা, সাহিত্য সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ, রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা করে গেলেন। তার এইসব অপকথার সমষ্টি হল---একাত্তরের স্মৃতি।

অসাধারণ ধুরন্ধর সৈয়দ আলি আহসান একাত্তরের পশ্চিমবঙ্গে চলে যান এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শব্দ সৈনিক হিসবাবে কাজ করতে থাকেন। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে একখানা পুস্তকও রচনা করেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদ বাগান। এবং গোপনে পাকিস্তানপন্থী বুদ্ধজীবীদের সংগঠিত করতে থাকেন। একই সঙ্গে তিনি পাকিস্তানপন্থী চাইনিজ বিপ্লবীদেরও পোষক হিসাবে কাজ করেন। তিনি সকল সামরিক সরকারের হয়ে কাজ করেন। হন জিয়া'র মন্ত্রী। এরশাদের সভাকবি। জামাতের বুদ্ধিজীবী।

রবীন্দ্রবিরোধীদের অধিকাংশই রাজাকার হিসাবে দায়িত্ব পালন করে পাকিপন্থার সেবা করে গেছেন। কেউই প্রগতিশীল ধারার সঙ্গে থাকেন নি। গণমানুষের আন্দোলন, সংগ্রামে কারো অংশগ্রহণই কোনোকালে ছিল না। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, পাকিপন্থার সেবা করার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্র থেকে লুটপাটের ফয়দা লোটা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ