চায়ের লাল রঙটি কি আদিবাসীদের রক্ত?।। বিপ্লব দাস



সর্দার বুলে কাম কাম
বাবু বুলে ধইরে আন
আর সাহিব বুলে লিব পিঠের চাম
রে যদুরাম
ফাঁকি দিয়া পঠাইলি আসাম... 

পরিযায়ী শ্রমিক। ধোঁয়াশায় ভরা সংজ্ঞা, বহুচর্চিত ও বহু ব্যবহৃত শব্দ। তবে শুধুমাত্র আজ নয়, তারা হেঁটে আসছে বহু বছর ধরে। তাদের গানের কথা ইচ্ছে মত বসিয়ে নেওয়া যায়। একই গানের মধ্যেকার চরিত্ররা পালটে পালটে যেতে থাকে। বাবা-মেয়ে, প্রেমিক-প্রেমিকা, মা-মেয়ে, ভাই-বোন। 

১৭৭০ থেকে ১৭৯০ সাল। অজগরের শিকার গেলার মত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত মোগল শাসন থেকে বৃটিশ শাসনে যাচ্ছে। পুরুলিয়ার জঙ্গল তখনো অবধি মোটামুটি অক্ষুন্ন। আদিবাসী গ্রামের জ্ঞানী বৃদ্ধরা জঙ্গলে কুড়িয়ে পাওয়া ১৩৯ রকমের খাদ্যের নাম অবলীলাক্রমে বলে দিতে পারেন। পুরুলিয়া সুদীর্ঘ পর্ণমোচী, মাঝারি উচ্চতার চিরহরিৎ আর নিচু গুল্মের আচ্ছাদনে ঢাকা। আকাশ থেকে মাটি প্রায় দেখাই যায় না। এই সবুজের ভিতরে লুকিয়ে হাজারো রকমের শাকাহারি এবং মাংশাসী স্তন্যপায়ী, সরীসৃ্প কীটের দল। জলবায়ুতে নিয়মিত বর্ষা এবং আর্দ্র বাতাস। আদর্শ বাস্তুতন্ত্র, পৃথিবী যেমনটি চেয়েছে আর কী। 

এরপরই কর্নওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের অর্থনীতি নির্ভর করছিল কৃষি উৎপাদনের ওপরে। রাজারা বিলুপ্ত হয়ে গেল, সাথে সাথে রাজার-প্রজার ন্যুনতম নৈতিক বন্ধনটুকু রাখার দায়ও রইলনা। এল জমিনদার, যে মরিয়াভাবে বৃটিশ কোম্পানিকে খাজনা দিতে বাধ্য। আরও বেশি জমিকে চাষযোগ্য করে তোলার একটা ভয়ঙ্কর এবং অবধারিত প্রয়াস সমগ্র ছোটনাগপুর মালভুমি ধরেই জেঁকে বসেছিল। নতুন নতুন পুকুর আর ইঁদারা খোঁড়া হল। কিন্তু প্রায় সব কটার উদ্দেশ্য চাষে জল দেওয়া। পুরুলিয়ার জলস্তর নামতে শুরু করল। এটাই পরবর্তী একশো বছরের ইতিহাস। 

এক পয়সার পোঁটিমাছ
আর গায়াগুনার ত্যাল গো
মিনির বাপে মাঙে যদি
আরই দিব ঝোল গো।

এরপর একদিন এল রেলগাড়ি। রেলের বগি, স্লিপার তৈরির জন্য প্রয়োজন হাজার হাজার শালকাঠ। কে দেবে? 
কেন, জঙ্গলমহল! এর আগে বাড়ির আসবাব থেকে জাহাজ সব তো জঙ্গলমহলই সরবরাহ করে এসেছে।  

এক ঢিলে দুই পাখি। জঙ্গল কেটে কাঠের আশু প্রয়োজন মেটাও আর ভবিষ্যতের খাজনা মেটাবার পাক্কা বন্দোবস্ত তৈরি করো। এই করতে করতে একদিন পুরুলিয়া বদলে যায়। জঙ্গলহীন পাথুরে জমি ঠিক যেন ছাতাহীন মাথা। বৃষ্টির তোড়ে সব মাটিটুকুই ধুয়ে যায়। বেরিয়ে আসে কাঁকর ও নুড়ি। সবাই নাম দেয় ‘তড়া’ জমি। তখন পুরুলিয়া জুড়ে শুধু তড়া জমির সিনেম্যাটিক ল্যাণ্ডস্কেপ্প। তবে নিয়মিত বর্ষা তখনও হচ্ছে।

এল ১৮৮১ সাল। কলকাতা-নাগপুর রেল চালু হয়েছে। যে জ্ঞানী বৃদ্ধরা ১৩৯ রকমের খাদ্যের নাম বলে দিতে পারতেন তাদের নাতিপুতিরা ততদিনে বৃ্দ্ধ হয়ে গেছে। তারা জন্মাবধি সেসব খাদ্য দেখতে পায়নি। কী শেখাবে সন্তানদের? তাদের মধ্যে যারা চাষ শিখেছিল, একফসলি চাষে যেভাবে হোক দিন গুজরান করে নিত। বাকিদের জীবন?  
মধুর সৌহার্দ্যপূর্ণ জীবনে ভীষণ প্রতিযোগিতা নেমে এল। ঠিক এসময়েই হঠাৎ বৃষ্টিও এল কমে। 
ওদিকে সিলেট আর আসামে চা চাষের শুরুওয়াদ হয়েছে। এটা বৃটিশদের নতুন অর্থকরী ব্যবসা। ডুয়ার্সের জঙ্গল কেটে চা চাষে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন। নজর পড়ল ছোটনাগপুর মালভুমি আর জঙ্গলমহলে। 

চল মিনি আসাম যাবো
দেশে বড় দুখ রে
আসাম দেশে রে মিনি চা বাগান ভরিয়া. .. 

জঙ্গল নির্ভর বাস্তুতন্ত্রে দুর্ভিক্ষ অনামী শব্দ। দু-এক বছর অনাবৃষ্টিতে জঙ্গলের সেরকম কিছু এসে যেত না। কিন্তু কৃষিকাজে বাধ্য হওয়া ‘তড়া জমি আর বছর বছর অনিয়মিত বৃষ্টিপাত’ এর পুরুলিয়া তখন ১৮৬৬, ১৮৭৪, ১৮৯২, ১৮৯৭, ১৯০৩, ১৯০৪-০৫, ১৯০৬-০৭ সালে পরপর দুর্ভিক্ষ দেখল। মাত্র এক-দেড়শো বছর আগের স্বাধীন স্বাভাবিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত মানুষগুলি সামান্যতম বলপ্রয়োগ ছাড়াই হয়ে গেল পরাধীন পরিযায়ী শ্রমিক। তাদের নতুন নাম ‘কুলি’। শেকড়হীন।
জঙ্গল নির্মুল হওয়ার সাথে সাথে অবলুপ্ত হল জঙ্গল নির্ভর ভেষজ  চিকিৎসাজ্ঞান। পরবর্তী প্রজন্মের আদিবাসী চিকিৎসকদের বেশিরভাগ  ডাইনি তাড়ানোর কাজে নেমে পড়ল। গ্রামে গ্রামে মহিলাদের জীবনে অনিশ্চয়তা নেমে এল। এজন্যই সেনসাস বলছে, পুরুলিয়ার পুরুষের চেয়ে মহিলারা বেশি পরিযায়ী হয়েছিল। 
যাদের ফিরে আসার কোনো উপায় ছিল না। পরিযায়ী সূত্র মেনেই তারা অত্যাচারের ফসিলচিত্র।

কুড়ল মারা যেমন তেমন
পাতা তুলা কাম গো
হায় যদুরাম
ফাঁকি দিয়া পঠাইলি আসাম।

জঙ্গল থেকে পিলপিল করে মানুষ বেরিয়ে আসতে লাগল। যেভাবে আগুন দিলে মৌচাক থেকে মৌমাছি বেরোয়। পুরুলিয়া শহর হল ছোটনাগপুর কুলি সাপ্লায়ের অন্যতম ‘ডিপো’। বাঁকুড়া শহর ততদিনে তৈরি হয়েছে। কুলি সরবরাহের এখানে একটি নতুন পাড়া তৈরি হয়ে গেল, ডিপোগোড়া। তৈরি হল আড়কাঠি, দালাল, মহাজন শ্রেণি। কোনো আড়কাঠিই কথা রাখে না। বছরে কোন কোন সময়ে, কোথা থেকে, কীভাবে কুলির দলকে শহরের ট্রেনে চাপানো যাবে ফন্দিফিকিরে তারা মগ্ন থাকত। সেসময়ের বহু অভিজাত মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল কুলি সাপ্লাই। 

আমাদের চায়ের লাল রঙটি আসলে কী? 
আদিবাসীদের অস্থিমজ্জার রস?

courtesy:  Environment and Migration, Purulia, West Bengal-
Nirmal Kumar Mahato
Photo courtesy: Indiatoday.in
গান : প্রচলিত ( চল মিনি আসাম যাব)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ