অন্তর্জলি যাত্রা - কলিকাতার মৃত্যু বিনোদন।। রাণা



"আয়রে আয় নগরবাসী, দেখবি যদি আয়।
জগৎ জিনিয়া চূড়া যম জিনিতে যায়।।
যম জিনিতে যায় রে চূড়া, যম জিনিতে যায়।
জপ-তপ কর, কিন্তু মরিতে জানিলে হয়।।"

কলিকাতার বাবু চূড়ামণি দত্ত অন্তর্জলি যাত্রায় বের হয়েছেন। মৃত্যুশয্যায় থেকেও আয়োজক তিনি নিজেই। রূপোর চতুর্দোলায় ফুলবাবু সেজে তিনি চললেন মরণ যাত্রায়। তার সামনে পিছনে অসংখ্য মানুষ ঢাক-ঢোল-খোল-করতাল নিয়ে। তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী সদ্য প্রয়াত রাজা নবকৃষ্ণ দেবের বাড়ির সামনে আসতেই ঢাকে আরো জোরে বোল উঠল, 'চূড়া যায় যম জিনিতে।'
রাজা নবকৃষ্ণ দেব ঘুমন্ত অবস্থায় দেহ রাখেন। তারিখ ১৭৯৭ সাল, ২২ নভেম্বর। সেকালে গঙ্গার কোলে মৃত্যু না হলে তা ছিল অপমৃত্যু। তাই চিরশত্রু চূড়ামণি দত্ত নবকৃষ্ণ দেবের উপরে এইভাবে প্রতিশোধ নেন। তিনি নিজের অন্তর্জলি যাত্রার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেকালে অন্তর্জলি যাত্রা ছিল রথে চড়ে স্বর্গে যাওয়া।

আবার যেমন সেকালে হিন্দু কূলপতি ও ধনীশ্রেষ্ঠ রাধাকান্ত দেব নিজের মৃত্যুর আয়োজন করেন বৃন্দাবনে। আশ্রমে থাকা অবস্থায় মৃত্যুর দিনে তিনি ভৃত্যের হাতে দুধ পান করেন। দুধ পান করে ভৃত্যকে নির্দেশ দেন পুরোহিতকে ডেকে পাঠাতে এবং নির্দিষ্ট জায়গায় শুইয়ে দিতে। তিনি শায়িত অবস্থায় পুরোহিতকে নির্দেশ দেন তার মৃত্যু আয়োজন ও পারলৌকিক ক্রিয়া কিভাবে সম্পূর্ণ হবে। এরপর আশ্রম আঙ্গিনায় তৈরি তুলসী বাগানে নিজের শয্যায় মালাজপ করতে করতে তৎকালীন গোড়া হিন্দু রাধাকান্ত দেব মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতে থাকেন। এর দু-ঘন্টা পরে তিনি মারা যান। এই খবর কলকাতায় পৌছালে কলকাতার ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন হলে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়।

রাধাকান্ত দেব কিছুটা ব্যতিক্রম এখানে। তিনি গঙ্গা ছেড়ে বৃন্দাবনে নিজের মৃত্যুর স্থান নির্বাচন করেন। তৎকালীন কলিকাতা শহরে অন্তর্জলি যাত্রা জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও শাস্ত্রে এই নিয়ে তেমন কোন সুস্পষ্ট বিধান ছিল না। অন্তর্জলি যাত্রা ছিল মৃত্যুকে আরো একটু বিভীষিকাময় ও পীড়াদায়ী করে তোলা। অন্তর্জলি যাত্রায় বের হয়ে সুস্থ হয়ে আর বাড়ি ফেরার উপায় ছিল না। তাই সবার ঐকান্তিক চেষ্টা থাকত কত দ্রুত মৃত্যুপথযাত্রীকে খাদের নিচে ফেলে দেওয়া যায়। গঙ্গানদীর জল আরো বেশি বেশি খাইয়ে, নাকে-বুকে মুখে গঙ্গামাটি ঘষে, খোল-করতাল সহ কীর্তনীয়াদের অনবরত চিৎকার,  সাথে সামান্য আচ্ছাদনযুক্ত অপরিসর ঘরে ঠান্ডা হাওয়ায় রুগীকে রেখে মৃত্যুর ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা হত। ফেরার উপায় ছিল না। কুলীন ব্রাহ্মণ ও ধনীদের মধ্যে এই প্রথা জনপ্রিয় ছিল। গরীবদের মধ্যে এই প্রথার চল ছিল না। যাদের তৎকালীন জীবন ছিল মৃত্যুপুরীতে থাকা তারা আর মৃত্যুচিন্তা নিয়ে কিভাবে ভাবতে পারে। এক একজন ধনী সেই সময়ে ৩-৬ লক্ষ টাকা খরচ করতেন, যা বর্তমান মূল্যে শতকোটি ছুতে পারে। যা ছিল ধনী ও গোড়া হিন্দু বাঙালির মৃত্যু মোচ্ছব। বরং হুতুম প্যাচার স্রষ্টা কালীপ্রসন্ন সিংহের আকস্মিক মৃত্যু তাকে এই প্রথা থেকে অব্যহতি দান করে।

যে ঠাকুরবাড়িকে বাঙালির নবজাগরণের আতুড়ঘর ধরা হয়, তারাও এই প্রথা থেকে মুক্ত ছিলেন না। দ্বারকানাথ ঠাকুরের মৃত্যু যেমন ইংল্যান্ডে হয়। তাই মৃত্যু পূর্ববর্তী কোন মোচ্ছব কলকাতায় হয়নি। কিন্তু মৃত্যুর পরে কলিকাতা নগরে ঠাকুরবাড়িতে মহাধুমধামের সহিত পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। হিন্দু ধর্মের রিফর্মার হিসেবে আবির্ভূত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই প্রথা থেকে বিযূক্ত ছিলেন না। নিজের ঠাকুমার অন্তর্জলিযাত্রায় তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং রাত্রিযাপন করেন। 

দেবেন্দ্রনাথের ঠাকুমা অলকাসুন্দরী দেবী খোলার চালায় তিনরাত জীবিত ছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ লিখেছেন, 
"ঠাকুমার মৃত্যুর পূর্বদিন রাত্রিতে আমি ওই চালার নিকটবর্তী নিমতলার ঘাটে একখানা চাঁচের উপরে বসিয়া আছি। ওইদিন পূর্ণিমার রাত্রি, চন্দ্রোদয় হইয়াছে, নিকটে শ্মশান। তখন ঠাকুমার নিকট নাম সঙ্কীর্তন হইতেছিল - 'এমন দিন কি হবে, হরিনাম বলিয়া প্রাণ যাবে;' বায়ুর সঙ্গে তাহা অল্প অল্প আমার কানে আসিতেছিল।"
ঠাকুরবাড়ি থেকেই জানা যায় অনিচ্ছুক হইলেও জোর করে অন্তর্জলিযাত্রায় পাঠানো হত।
দিদিমার অন্তর্জলিযাত্রা নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন,
"১৭৫৭ সালে দিদিমার যখন মৃত্যুকাল উপস্থিত তখন আমার পিতা এলাহাবাদ অঞ্চলে পর্যটন করিতে গিয়েছিলেন।  বৈদ্য আসিয়া কহিল, 'রোগীকে আর গৃহে রাখা হইবে না। অতএব সকলে আমার পিতামহীকে গঙ্গাতীরে লইয়া যাইবার জন্য বাড়ির বাহিরে আনিল।...গঙ্গায় যাইতে তাঁহার মত নাই  তিনি বলিলেন যদি দ্বারকানাথ বাড়িতে হাজির থাকিত, তবে তোরা কখনোই আমাকে লইয়া যাইতে পারিতেস নে।' কিন্তু লোকে তাহা শুনিল না। তাহাকে লইয়া গঙ্গাতীরে চলিল। তখন তিনি কহিলেন, 'তোরা যেমন আমার কথা না শুনে আমাকে গঙ্গায় নিয়ে গেলি, তেমনি আমি তোদের সকলকে খুব কষ্ট দিব। আমি শীঘ্র মরিব না।"

যেসময় শ্রাদ্ধের ন্যুনতম নিয়ম ভঙ্গ করলে গৃহচ্যুত হতে হত, সেই সময়েও এই কলিকাতা শহরে এমন অনেক মানুষ ছিলেন যারা এই শ্রাদ্ধ প্রথাকেই নস্যাৎ করে গেছেন। যেমন হাইকোর্টের জজ ও পন্ডিত দ্বারকানাথ মিত্র পিতার মৃত্যুর পর বলেছিলেন, "আমার যখন কিছুতেই বিশ্বাস নাই, আত্মা, ভগবান, পরকাল কিছুতেই বিশ্বাস নাই, তখন আমি লোক দেখানো কেনই বা পিতৃশ্রাদ্ধ করিতে যাই।"
কলিকাতা হোক বা কলকাতা, এই শহরে বরাবর এই দুটো মেরু থাকবে।


(গ্রন্থঋণঃ কলকাতার বাবু ও তাদের মৃত্যুবৃত্তান্ত। লেখক- সিদ্ধার্থ বসু)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ