সিংহলে বঙ্গ রক্তের সন্ধানে।। বিপ্লব দাস



এ আরেক বাঙ্গালির গল্প যাকে তার বাবা আদ্দেক মাথা মুড়ে জাহাজে তুলে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। যাকে নিয়ে হাজারো মিথ জড়িয়ে আছে। আড়াই হাজার বছরের মিথগুলি ছেঁটেছুটে কঙ্কাল বের করা শুধুমাত্র কষ্টকর নয়, দুঃসাধ্য। 

আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছররেও আগে। বুদ্ধ তখনও জন্মাননি। বঙ্গের এক রাজা কলিঙ্গের রাজকন্যা মায়াবতীকে বিয়ে করেন। তাদের মেয়ে সুপ্পা স্বাধীন জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে হঠাৎই রাজ্য থেকে বেরিয়ে একটি যাযাবরের দলে ভিড়ে মগধের পথে অগ্রসর হয়। যেতে যেতে ‘লাল’ বা ‘লাড়’ নামক জঙ্গলে কোনও এক সিংহের আক্রমনের সামনে পড়ে দলটি। সিংহ সুপ্পাকে অপহরণ করে গুহাতে বন্দী করে এবং দীর্ঘদিনের সহবাসের পর সিংহবাহু ও সিহসীবলী নামের এক পুত্র, এক কন্যা সন্তান হয়। এর বহুবছর পর একদিন কিশোর সিংহবাহু মায়ের মুখে অতীত শুনে জঙ্গল কেটে মা ও বোনকে নিয়ে বে্রিয়ে আসে। ঘুরতে ঘুরতে এক অঞ্চলে উপস্থিত হয় যেখানের স্থানীয় গোষ্ঠীপতি সুপ্পার খুড়তুতো ভাই। যুবতী সুপ্পা নিজের সঙ্কট কাটাতে তাকে বিয়ে করে ফেলেন। ওদিকে তখন পরিবার হারিয়ে সিংহ খেপে লাল। সিংহের অত্যাচারে আশেপাশের সকলে  ভীত সন্ত্রস্ত। রাজ্যে ত্রাহি ত্রাহি রব। নিরুপায় বঙ্গরাজা সিংহের মাথার দাম ঘোষণা করলেন। ইনাম শুনে সিংহবাহু এগিয়ে এলেন। নিজের পিতাকে হত্যা করে বঙ্গরাজার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। কিন্তু সিংহবাহু রাজধানীতে পৌঁছানোর আগেই রাজার মৃত্যু ঘটে। সব জানতে পেরে মন্ত্রীরা তাকেই রাজা বানিয়ে ফেলেন। 

এখানেই মধুরেণ সমাপয়েৎ হতে পারত।

কিন্তু সিংহবাহু মোটেও রাজ্যলোভী ছিলেননা। কিছুদিনের মধ্যেই মায়ের নতুন স্বামীকে রাজ্যপাট ছেড়ে দিয়ে নিজের জন্মস্থান ‘লাল’ বা ‘লাড়’এর দিকে চলে যান। সেখানে তিনি নতুন রাজ্য স্থাপন করেন ‘সিংহপুর’ বা ‘শিপুর’। বিয়ে করেন নিজের বোন সিহসীবলিকে। তাদের মোট বত্রিশটি সন্তান হয় যাদের প্রতিটিই যমজ। বিজয়সিংহ হল জ্যেষ্ঠ।

গল্প বাঁক নেওয়াতেই আসল মজা।

রাজা সিংহবাহু তার যুবক পুত্র বিজয়সিংহের চুড়ান্ত বেলেল্লাপনা এবং অসভ্যতা সহ্য করতে না পেরে অবশেষে জরুরি সভা তলব করলেন। রাজ্যের জ্ঞানীবৃদ্ধদের পরামর্শে অর্ধমস্তক মুণ্ডন করে রাজপুত্রকে তাম্রলিপ্ত বন্দরে একটি জাহাজে তুলে ‘তডিপার’ করে দেওয়া হল। সাথে দেওয়া হল বিজয়ের পেয়ারের সমস্ত বন্ধুবান্ধব, কিছু সৈন্য সামন্ত, অমাত্য, চাকর বাকর, খাদ্যদ্রব্য। তমলুক থেকে ভাসতে ভাসতে তারা একসময় এক অচেনা অনামী বড়সড় দ্বীপে এসে পৌঁছায়। সেখানে তখন প্রাচীন এক মানবগোষ্ঠী যক্ষদের বাস। তটবর্তী এলাকায় কিছুদিন থাকতে থাকতে বিজয়সিংহের দেখা হয় কুবেনী নামের এক মেয়ের সাথে। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বিজয়সিংহ খুব সহজেই কুবেনীর সাথে সম্পর্ক্যে লিপ্ত হলেন। 

সাধে বলে! স্বভাব যায় না মলে।

কুবেনী ছিল যক্ষদের এক গোষ্ঠীপতির কন্যা। কুবেনীর সহায়তায় বিজয়সিংহ খুব সহজেই যক্ষদের এলাকা ছাড়া করল। স্থাপন করল নিজের রাজ্য তাম্বপানি। রাজকর্মচারিদের অমত সত্বেও ঘোষণা করল- কুবেনী হল তাম্বপানির রানী। তাদের দুই সন্তান হল। বঙ্গের মানুষেরা দ্বীপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। এদিকে জাহাজে নারীসংখ্যা কম আসায় এত এত পুরুষের প্রতিনিয়ত নারীসঙ্গের সমস্যা তৈরি হল। তাই সকলে মিলে ঠিক করল কাছেই মাদুরাই রাজ্যের রাজাকে বিপুল সামুদ্রিক রত্নের উপহার সমেত খবর পাঠানো হবে। তাই করা হল। উপহার দেখে মাদুরাই রাজা রাজি হয়ে অসংখ্য নারী পাঠালেন। আর বিজয়ের জন্য নিজের রাজকন্যাকে। রানী রূপে আর্যনারী এসে যাওয়ায় সকলের পরামর্শে অনার্য কুবেনী সন্তানসহ বিতাড়িত হল। কিন্তু ট্র্যাজেডি এটাই যে, কুবেনীকে যক্ষরা মেনে নিল না। হত্যা করল বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে। ওদিকে দ্বীপের প্রতিটি কোনায় নিজের আধিপত্য পৌঁছে গেলেও যৌবন অতিক্রান্ত বিজয়সিংহ আর সন্তানলাভ করতে পারলেন না। 

নাকি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিলেন কুবেনীকে? আমরা সত্যিটা কোনোওদিন জানতে পারব না।

সিংহ বংশের নাম অনুসারী এই রাজ্যের নাম হয়ে গেল ‘সিংহল’। পরে দ্বীপটিকেও ঐ নামে সকলে চিনে যাবে।
বহুবছর পর বৃ্দ্ধ বিজয়সিংহ একদিন খবর পাঠালেন বঙ্গে, নিজের যমজ ভাইকে। রাজ্য সামলানোর উত্তরাধিকার পাঠাও। সেই খবর পৌঁছতে কয়েকমাস। ততদিনে বিজয়সিংহ মারা গেলেন। শেষ অবধি অনেকদিন পর বঙ্গ থেকে বিজয়ের ছোটো ভাইপো গিয়ে সিংহলের হাল ধরে। মাঝখানে বার সাতেক আক্রান্ত হলেও সিংহলে এদেরই বংশধরেরা ১৮৯টি জেনারেশন  এবং দুহাজার বছর ধরে ঘুরেফিরে অধিপতি হয়ে থাকে, যতদিন না পর্তুগীজ এবং ওলন্দাজরা দ্বীপে এসে পৌঁছায়। 

বঙ্গের তখনকার মুখের ভাষা সংযুক্ত বিযুক্ত বিবর্তিত হতে হতে এখন নিউ এডিশন বাংলায় এসে পৌঁছেছে। সিংহলের নামও একসময় পালটে গেছে, ‘শ্রীলঙ্কা’। আজকের শ্রীলঙ্কার পঁচাত্তর ভাগ মানুষ বঙ্গ এবং তামিল রক্তের মিশ্রণে সিংহলী। মিথের ‘যক্ষ’রা যাদের গোষ্ঠীর আসল নাম ‘ভেড্ডা’, তারা এখন হাজারে দুজন মাত্র।

কী? সনৎ জয়সূর্য বা অর্জুন রনতুঙ্গাকে আত্মীয় বলে মনে হচ্ছে কি? 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

X

Never Miss an Update!

Join my newsletter to get the latest posts from littlemag.in directly to your inbox.