চাটগাঁইয়া বাঙালি ও ফরাসি বিপ্লব।। বিপ্লব দাস


ঠিক আড়াইশো বছর আগে, ১৭৭০ সাল। এরকমই কোনো পয়লা বৈশাখের সন্ধ্যে হয়তো। এক বাঙালি কিশোর জাহাজের ছোটো কুঠুরিতে কয়েকটি শুয়োরের সাথে গাদাগাদি করে শুয়ে আছে। শুয়ে আছে আর ভাবছে তার পাড়ার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া অপরিসর জলধারাটির কথা, তারা বলত নদী, গামছা দিয়ে মাছ ধরত চানের সময়। তার ঠাকুমা, চোখে কিছুই দেখেনা, সন্ধ্যে বেলা কূপির আলোয় ব্যর্থ সেলায়ের চেষ্টা করে। তার বোন আছে, মুখ আবছা মনে পড়ে, হয়তো কেউ তুলে নিয়ে গেছে এতদিনে, সেও পড়ে আছে কোনো কুঠুরিতে, পায়ে নুপুর। তবে জাহাজে কিশোরটির কোনো বাঁধন নেই। খোলামেলা। কাজও অল্প। কতদিন হয়ে গেল বাড়ি যায়নি সে। এক বছর না দু বছর? কদিন আগেও ছিল একটা অদ্ভুত দেশে, নাম কি যেন, দাঁত খুলে যায়, ‘মাদাগাস্কার’। এখন তারা ছুটে চলেছে সাহেবদের নিজের দেশে। তার একটা বাহারি নাম দিয়েছে সাহেবারা ‘নিগার’।

এখনও অবধি বাঙালি কিশোরটি এক ব্রিটিশ মালিকের কেনা। মাদাগাস্কারে এরকম অনেক মানুষ কিনে নিয়েছে তার মালিক। জাহাজ ভর্তি মানুষ যাচ্ছে। যেমন করে রামপুরের হাটে গরু কেনে আলম মিঁয়া। হাঁটিয়ে নিয়ে যায় চাঁটগা অবধি। 

যদিও এরপরেই কিশোর হাতবদল হয়ে যাবে, হাত পাল্টাতে পাল্টাতে অবশেষে পড়বে ফ্রান্সের রাজা পঞ্চদশ লুই-এর হাতে। আপাতত লুই-এর উপপত্নী মাদাম দুবারির সারাদিনের ফাই-ফরমাশ খাটার জন্য নতুন কিছু দাসের প্রয়োজন। যদিও আমরা সবাই জানি, ইতিহাসের বাঁক বোঝা দায়।

সে আজীবন একজন সাধারণ দাস থেকে যাবেনা। তার পারদর্শীতায় মুগ্ধ হয়ে মাদাম দুবারি তাকে লেখাপড়া শেখাবেন। নিগার কিশোরটি কোন ফাঁকতালে একে একে পড়ে ফেলবে রুশোর সব প্রবন্ধগুলি। পড়তে পড়তে মনে পড়বে তার দেশের জমিদারের ঘরে আগুন দেওয়ার কথা, লাল প্যান্ট-জুতো পরা ঘোড়ায় চাপা নতুন রাজার নীল চোখ। কী করছে তার মা, তার নিরূপায় বাবা, যে বন্দরে সাফাইয়ের কাজ করতে পাঠিয়েছিল তাকে। 

পড়তে পড়তে জানতে জানতে কিশোর হয়ে উঠবে যুবক। নতুন নামও পাবে মাদামের কাছে ‘জামর’। লুই বেনেডিট জামর। রাজপ্রাসাদের লাইব্রেরি থেকে বই চুরি করে পড়তে পড়তে সে একদিন জেনে ফেলবে চট্টগ্রামে তার অতীত থাকলেও সে আসলে জন্ম জন্মান্তরের দাস। হাজার খানেক বছর আগে আরবের ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রামে ব্যবসা করতে এসে তাদের সাহারা মরুভুমি থেকে এনেছিল। তাই চট্টগ্রামের এক গ্রামে থাকলেও, এক ভাষাতে কথা বললেও তার গায়ের রঙ, মাথার চুল, দাঁতের গঠন হরি, রামময়, আমিনাদের মত ছিল না। 

ওদিকে ফরাসী বিপ্লব শুরু হয়েছে, রাজপ্রাসাদের ঘেরাটোপে থেকেই গোপনে জ্যাকোবিন বিপ্লবীদের সাথে হাত মিলিয়েছেন যুবক জামর। হাজার বছরের দাসত্বের জমাট রক্ত প্রতিশোধ চাইছে তখন। কিছুদিনের মধ্যেই জ্যাকোবিন দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যে পরিণত হলেন। তবে নিজেকে বেশিদিন লুকোতে পারলেন না। রাজপরিবারের কাছে ধরা পড়ে গেলেন। ফলত রাজপরিবারের সংস্পর্শ ত্যাগ করে পুরোদস্তুর বিপ্লবী জীবনযাপন। 

নিয়ম মেনে বিপ্লব একদিন শেষ হল। একে একে রাজপরিবারের সবার ফাঁসি হচ্ছে। জামর তখন জ্যাকোবিনদের ‘গণ নিরাপত্তা সমিতি’র নেতা। মাদাম দুবারির অপরাধের তালিকা তৈরি করতে জামরকে বিপ্লবীদের আদালতে সাক্ষীরূপে ডাকা হল। এই প্রথম কোথাও জামর আত্মপরিচয় দিতে বাধ্য হলেন। বাঙালি জামরের সাক্ষীর ওপর ভর করে দুবারির ফাঁসি হল। বিপ্লবীরা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে এতটাই কঠোর যে অভিজাত গৃহে লালিত হওয়ার অপরাধে জামরকেও অপরাধী সাব্যস্ত করা হল। মাত্র কয়েকমাসের কারাবাস কাটিয়ে বন্ধুদের সহায়তায় জামর হঠাৎ একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। 

এদিকে ফরাসি বিপ্লব পরবর্তী অস্থির সময়গুলিতে নেপোলিয়ন ফ্রান্সে্র হাল ধরলেন। ওদিকে জামরের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। বা বলা যায় কেউ খোঁজ রাখল না। নেপোলিয়নও একসময় তাঁর সব যুদ্ধগুলি শেষ করে হেলেনা দ্বীপে নির্বাসনে চলে গেলেন। সেইন নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেল। 

বাইশ বছর পর জামরকে পাওয়া গেল প্যারিস শহরের এক ঝুপড়ি বাড়িতে। বস্তির পাঠশালাতে বাচ্চাদের পড়ান তিনি। প্রতিবেশীরা বলে তার নাকি অল্প মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে। অকারণে বাচ্চাদের মারধোর করে ফেলেন। এভাবেই একদিন ফট করে মারা গেলেন পাঠশালার রগচটা শিক্ষকটি। যথারীতি তাঁর শেষকৃ্ত্যে হাজির হলনা কেউ। শুধু তার ঝুপড়ি বাড়ির দখল নিতে গিয়ে দেখা গেল ময়লা দুর্গন্ধময় বিছানার একপাশে টাঙ্গানো আছে রোবসপীয়রের একটি ছবি। মাথার ওপরে রুশোর ‘দ্য স্যোসাল কন্ট্রাক্ট’।  

জামর জানতেন তাঁকে নিয়ে ভাববেনা কেউ কোনোদিন। শুধু জানতেন না, তাঁর মৃত্যুর দেড়শো বছর পর এক জনপ্রিয় ইউরোপীয় কমিক্স গোয়েন্দা সিরিজে আবার ভেসে উঠবে তার নাম। রঙিন কমিকস ছবিতে দরজার বাইরে আটকে থাকবে নকল গিলেটিনের ব্লেড। 
photo courtesy: google.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ