জীবন পথিক জীবনানন্দ।। রানা চক্রবর্তী


খড়্গপুর কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। রেলশহরে তাঁর জীবন মাত্র পাঁচ মাস ১২ দিনের। কেমন ছিল রেলশহরে কবির জীবন? ১৯৫০ সাল। বছর তিনেক আগেই বাংলাদেশের বরিশালের ব্রজমোহন কলেজের শিক্ষকতা ছেড়ে ফিরে এসেছেন কলকাতায়। চাকরি খুঁজছেন। ভাই অশোকানন্দ দিল্লির এক মিলিটারি ট্রেনিং কলেজে চাকরির সুযোগ করে দেন। তবে বাংলা ছাড়তে নারাজ কবি। সেই সময়েই খড়্গপুর কলেজে ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপক নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। ঢাকার মানিকগঞ্জ কলেজ থেকে খড়্গপুরে আসা হিমাংশুভূষণ সরকারের নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষক ১৯৪৮ সালের ২৯শে অগস্ট কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। ইংরেজির একমাত্র অধ্যাপক সরোজকুমার ভট্টাচার্যের পক্ষে বিভাগ চালানো কঠিন হয়ে পড়ছিল। কবি খ্যাতির জন্য অধ্যক্ষ হিমাংশুভূষণের চেষ্টায় নিয়োগপত্র পেলেন। ১৯৫০ সালের ৪ঠা অগস্ট নিয়োগপত্রের প্রাপ্তি স্বীকার করে অধ্যক্ষকে চিঠি দেন কবি।

কলকাতা থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে খড়্গপুর। কিন্তু বাংলায় থাকার সুযোগ তো মিলছে! কয়েকদিনের মধ্যে চলে আসেন খড়্গপুরে। পরিবেশ, থাকা খাওয়ার সুবিধা ইত্যাদি বিষয় সরেজমিন দেখে গিয়েছিলেন। অধ্যক্ষ সহকর্মীদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কবির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। কারখানা, রেলের বিভিন্ন কার্যালয়, লাল মাটির রাস্তার ধারে থাকা গাছ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কবি। কলকাতায় ফিরেই কাজে যোগদানের সম্মতিপত্র পাঠিয়ে দেন কলেজে। ১৯৫০ সালের ২৫শে অগস্ট। চিঠিতে অধ্যক্ষকে কলেজ হস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেন। লিখেছিলেন, নিয়োগপত্র অনুযায়ী ১লা সেপ্টেম্বর থেকেই কলেজে যোগ দেবেন। হস্টেলে পৌঁছে যাবেন ৩১শে অগস্ট।
                           
তখনও কলেজের নিজস্ব ভবন হয়নি। সিলভার জুবিলি হাইস্কুলে সকাল ও সন্ধ্যায় ক্লাস হত। স্কুলের ছাত্রাবাসের একটি ঘরেই জীবনানন্দের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল। ২ সেপ্টেম্বর থেকে ক্লাস নেওয়া শুরু করেন কবি। জীবনযাপন উদাসীন এবং অনাড়ম্বর। হস্টেলের ঘরে সামান্য একটি খাট, বিছানা। কিছু বই, আর কালির দোয়াত। কোনও শিক্ষক ছাত্রাবাসে থাকতেন না। ছাত্রাবাস দেখভালের দায়িত্ব ছিল কলেজের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক পুলিনবিহারী পালের। তাঁর সঙ্গে সহজ-সরল সম্পর্ক ছিল কবির।

জীবনানন্দের খড়্গপুর বাস নিয়ে একসময় লিখেছিলেন শহরের বাসিন্দা কবি কামরুজ্জামান। তিনি লিখেছেন, ‘‘খড়্গপুর কলেজে কবি ইংরেজি গল্প, প্রবন্ধ, একাঙ্ক নাটক এমনকী শেষের কয়েকদিন কবিতা পড়ানো শুরু করেছিলেন। বাণিজ্য বিভাগের ছাত্রদের কাছে ইংরেজি সাহিত্যের আকর্ষণ কতদূর হবে তা তো সকলের জানা। তবে কলাবিভাগের ছাত্ররাও যে খুব একটা আকৃষ্ট হতেন তার প্রমাণও নেই। যদিও তিনি ঠিক সময়েই ক্লাসে যেতেন।’’ ক্লাস করানোর সময়টুকু ছাড়া হস্টেলের ঘরে থাকতেন। দরজা বন্ধ করে লিখতেন ও পড়তেন। বেশিরভাগ সময় উদাস, নয়তো চিন্তাশীল। কেউ দেখা করতে এসে দরজায় কড়া নাড়লেও তিনি আত্মনিমগ্ন। দরজা খুলতেন না। খড়্গপুর বাসের সময় কবি কোনও কবিতা লিখেছিলেন কিনা জানা যায়নি। কামরুজ্জামানও জানিয়েছেন, “কবি সেই সময়ে নিশ্চয় কবিতা লিখেছেন। তবে কোন কবিতা তা জানা যায়নি। কারণ তিনি তো ওই ঘরে বসে থাকতেন, দরজা খুলতেন না। একমাত্র পুলিনবিহারী পাল ডাকলে দরজা খুলতেন। কিন্তু যে কোনও কথার জবাব হ্যাঁ বা না, এই দুই শব্দে সীমাবদ্ধ থাকত। এমনকী পুলিনবাবু নিজের লেখা প্রবন্ধ, গল্প নিয়ে গিয়ে কবিকে শোনালে ভাল বলে চুপ করে যেতেন বলে শুনেছি।”
                           
বাংলায় থাকবেন বলে দিল্লি যাননি। আবার কলকাতা থেকে দূরে স্ত্রী-ছেলের জন্য উতলা হতেন। শনিবার হলে বা ছুটির দিন পেলেই কলকাতায় পালিয়ে যেতেন। পরে খড়্গপুরে পাকাপাকি থাকারও ইচ্ছে হয়েছিল কবির। স্ত্রী লাবণ্যপ্রভার খড়্গপুরের মালঞ্চর একটি স্কুলে চাকরির সুযোগ হয়। খড়্গপুরে বাড়িও দেখতে শুরু করেছিলেন। মালঞ্চয় বাড়ি ভাড়া নিয়েও ফেলেন। কিন্তু কলকাতায় গিয়ে দেখেন, প্রবল শীতে স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ। স্ত্রীকে এমন অবস্থায় রেখে ফিরে আসতে পারেননি কলেজে। কয়েকদিন পর কলেজ খুলতে সমস্যার কথা জানিয়ে ৫ই ডিসেম্বর অধ্যক্ষকে চিঠি দেন। চিঠিতে দ্রুত কলেজে যোগদান করার কথা বলে ভাড়া নেওয়া বাড়িটি কাউকে দিয়ে দিতে বলেন। অবশ্য দিন কয়েকের মধ্যেই জীবনানন্দ নিজেই জ্বরে আক্রান্ত হন। ভুগলেন বেশ কয়েকদিন। ১৯৫১ সালের ১৩ই জানুয়ারি চাকরি হারানোর আশঙ্কায় হিমাংশুভূষণকে ফের চিঠি দিলেন। শেষমেশ ওই বছরের ২২শে জানুয়ারি দীর্ঘ ছুটি কাটিয়ে কলেজে যোগ দিলেন কবি।

কিন্তু খড়্গপুরে আবার জ্বরে আক্রান্ত হলেন কবি। ১৪ই ফেব্রুয়ারি কোনও ক্রমে ক্লাস নিয়েই কলকাতায় চলে গেলেন। গিয়ে দেখলেন স্ত্রীর অসুস্থতা বেড়েছে। চিকিৎসক জানালেন, সুস্থ হতে মাস তিনেক সময় লাগবে। স্ত্রীর এমন পরিস্থিতিতে আবার ছুটির আবেদন করলেন। সেই আবেদনে পাঠক্রম প্রায় শেষ করে দিয়েছেন বলে জানালেন। সেই সঙ্গে ইংরেজি বিভাগের পদটি যাতে রাখা হয় তার অনুরোধ করলেন। এর পরেও কলেজ কর্তৃপক্ষ না মানলে ইস্তফা দেওয়া ছাড়া তাঁর আর কোনও রাস্তা থাকবে না বলেও জানিয়ে দিলেন। ১৯৫১ সালের ১১ই মার্চ লেখা ওই চিঠিতে তিনি যে দিল্লির চাকরি ছাড়ার মতো কতটা ত্যাগ স্বীকার করে এই কলেজে যোগ দিয়েছিলেন সে কথাও স্মরণ করিয়ে দেন। জীবনানন্দের দীর্ঘ ছুটি সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনার জন্য কলেজ পরিচালন সমিতির সভা ডাকা হয়। কিন্তু কলেজের আর্থিক সঙ্কটের কথা ভেবে শেষমেশ বিলুপ্ত করা হয় ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় পদটি। ফুরিয়ে যায় কবির সঙ্গে খড়্গপুরের সব লেনদেন। কবি ব্যক্তিগত ভাবে পুলিনবিহারী পালের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সম্পর্ক ক্রমেই ফিকে হয়ে যাচ্ছিল।
                           
শেষমেশ কবির সঙ্গে খড়্গপুরের যোগসূত্র হয়ে যায় তাঁর পাঁচটি চিঠি। অবশ্য চিঠিগুলোও হারিয়ে যেতে বসেছিল। কলেজে ১৯৭০ সালে করণিক পদে যোগ দেওয়া উজ্জ্বলকুমার রক্ষিত সেসব সযত্নে রেখেছেন। অসুস্থ উজ্জ্বলকুমার সংবাদমাধ্যমে বলেছিলেন, “আমি হিমাংশুভূষণ সরকারের থেকেই জীবনানন্দ সম্পর্কে অনেকখানি জেনেছিলাম। হিমাংশুবাবু চিঠিগুলো কলেজের অফিসঘরে রেখেছিলেন। ১৯৭৫ সাল নাগাদ কলেজে চুরি হয়। চোরেরা চিঠিগুলি কলেজের বাইরে ফেলে দিয়েছিল। আমি দেখতে পেয়ে চিঠিগুলো কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে নিজের কাছে রেখেছি। পরে লাবণ্য দাশের স্কুলে চাকরির নিয়োগপত্রও সংগ্রহ করেছি।”

জীবনানন্দের স্মৃতি পুনরুজ্জীবনে ১৯৯৮ সালে উদ্যোগী হন শহরের কয়েকজন লেখক-কবি। তাঁরা গড়ে তোলেন জীবনানন্দ শতবর্ষ কমিটি। কমিটির উদ্যোগেই খড়্গপুর কলেজের নিজস্ব ভবনে বসানো হয় কবির আবক্ষ মূর্তি। কমিটি এখন সক্রিয় নয়।
                             
কেউ বলেছেন, তিনি অন্তর্মুখী, আত্মসমাহিত। কেউ বলেছেন, তিনি নির্জনতম। কেউ বলেছেন তিনি সংসার-পলাতক। আবার কেউ গলার পর্দা আরও একটু চড়িয়ে বলেছেন তিনি অমিশুক, অসামাজিক। বাংলা সাহিত্যের পাঠকেরাও কবি জীবনানন্দের ব্যক্তিরূপ এ ভাবেই কল্পনা করতে অভ্যস্ত হয়েছে। হয়। কিন্তু এ পরিচয় জীবনানন্দের সত্যিকারের পরিচয় নয়। যাঁরা তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গ ভাবে মিশেছেন, তাঁরা দেখেছেন, তিনি সহজ, সরল, মিশুক, গল্পপ্রিয়, পরিহাস-পটু এক সামাজিক মানুষ। হাসাতে পারতেন, নিজে হাসতেও পারতেন। এবং যে সে হাসি নয়। একেবারে লোককে চমকে দেবার মত হাসি। পরিচিত মহলে তার হাসি বিখ্যাত ছিল। তাঁর হাসিকে কেউ বলেছেন, ‘উৎকট হাসি’, কেউ বলেছেন ‘অট্টহাসি’, কেউ বলেছেন ‘মেজাজি হাসি’ ইত্যাদি। হাসির সময় জীবনানন্দ স্থান কাল ভুলে যেতেন। এই হাসির মধ্যেই ধরা পড়ত তাঁর সহজ সরল অন্তঃকরণ।

বড়িষা কলেজে এক সহকর্মীর কাছে তিনি এক বার বলেছিলেন, ‘বুদ্ধদেব বসু, নির্জন কবি নির্জন কবি বলে আমার সম্পর্কে একটা লিজেন্ড খাড়া করেছেন যেটা আমার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ঠিক নয়।’ বোন সুচরিতা দাশ ‘কাছের জীবনানন্দ’ তেও লিখেছেন, কবিকে ঘিরে জনশ্রুতি কতটা ভুল। জীবনানন্দের পথচলা ও আড্ডার সঙ্গী সুবোধ রায় লিখেছেন, জীবনানন্দ কতটা আড্ডাপ্রিয় ও পরিহাসপ্রিয় ছিলেন তার কথা। সুবোধ রায়ের স্মৃতি কথা থেকে জানা যায়, কবি গল্প করতে এতটাই ভালবাসতেন যে  তাঁর বাড়িতে সন্ধেয় গল্প করতে গেলে অনেকদিনই রাত্রি একটা-দেড়টা হয়ে যেত। 

জীবনানন্দের জীবনের (১৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ থেকে ২২শে অক্টোবর ১৯৫৪) শেষ চাকরি হাওড়া গার্লস  কলেজে। এই কলেজেই প্রথম জীবনানন্দ পেয়েছিলেন অধ্যাপনার কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ। জীবনানন্দকে এই কলেজে ছাত্রী, শিক্ষক সবাই ভালবেসেছিল। তিনিও কলেজকে ভালবেসেছিলেন। পরিবেশ নিজের মনের মত হলে তিনি নিজেকে মেলে ধরতেন। হাওড়া গার্লস কলেজেও তার অন্যথা হয়নি। এই কলেজে জীবনানন্দের সহকর্মী ছিলেন অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। অসিতবাবু জীবনানন্দকে বর্ণনা করেছেন ‘হাস্য-পরিহাসের অংশভাগী’ ও ‘বন্ধুবৎসল’ বলে। এই কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ কেশবচন্দ্র চক্রবর্তী জীবনানন্দকে বলেছেন ‘একজন সঙ্গলোভী সামাজিক মানুষ।’ তিনি লিখেছেন, ‘জীবনানন্দের যে বিচিত্র মনোরম পরিচয় আমরা পাইয়াছি, স্মৃতির ভাণ্ডারে তাহার মূল্য  অপরিমেয়।’
                            
জীবনানন্দ সম্পর্কে গড়ে ওঠা জনশ্রুতি নিয়ে স্ত্রী লাবণ্য দাশ এক বার কবিতা সিংহের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে  উষ্মাও প্রকাশ করেছিলেন। আসলে বাড়িতে যে মানুষটিকে সর্বক্ষণ দেখেছেন, তিনি যে একেবারেই আলাদা।  বিয়ের পরে স্ত্রী যাতে ঠিকমত পড়শোনা করতে পারে  তার জন্য যত্নশীল, বোন-ভাইয়ের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ, প্রিয় মানুষদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতে আগ্রহী, নীতির প্রশ্নে আপসে যেতে নারাজ এবং যথেষ্ট ব্যক্তিত্বেরও অধিকারী। এই মানুষটিকে তিনি ওই সব জনশ্রুতির সঙ্গে মেলাবেন কী ভাবে! তাঁর কাছে বাইরের ওই সব কথা অনেকটাই ‘বানিয়ে তোলা’।

বোন সুচরিতা দাশ লিখেছেন, ‘জীবনানন্দ বাড়িতে এত মজার মজার কথা বলতেন যে সবাই হেসে কুটিপাটি হত। সে সময় দাদাটিকে দেখলে কে বলবে, ইনিই এত গুরুগম্ভীর কবিতা লেখেন!’ মজার মজার কথা বলে অন্যকে হাসানোর স্বভাব জীবনানন্দের ছেলেবেলা থেকেই ছিল। এই স্বভাব সম্ভবত তিনি পেয়েছিলেন মাতুল বংশ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে। জীবনানন্দের দাদামশাই চন্দ্রনাথ দাশ ছিলেন রসিক মানুষ। তিনি অনেক হাসির গানও লিখেছিলেন। ভাই অশোকানন্দ লিখেছেন, ‘পার্কে, রাস্তায় কোথাও  হিউমারের গন্ধ পেলেই জীবনানন্দ দাঁড়িয়ে যেতেন। তারপর আড়ালে গিয়ে সঙ্গী বন্ধুর কাছে, অথবা বাড়িতে এসে নিকটজনেদের কাছে তা রসিয়ে পরিবেশন করতেন।’ 
                            
জীবনানন্দের রঙ্গ রসিকতার নানা গল্প তাঁর কাছের মানুষেরা লিখে গিয়েছেন। সত্যি জীবনানন্দের হদিশ পেতে গেলে সেই সব গল্পে একটু কান পাততে হবে। কয়েকটা উদ্ধার করা যাক।

অশোকানন্দ আর তিনি তখন কলকাতার অক্সফোর্ড মিশন হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেন। তিনি বিএ, আর অশোকানন্দ আইএসসি। এক দিন সকালবেলা বাইরে থেকে দৌড়ে ঘরে ঢুকে ভাইকে একজন ধনী, নামজাদা অধ্যাপকের নাম করে বললেন, ‘শিগগির আয়। দেখে যা হোস্টেলের সামনে দিয়ে কেমন সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন!’ নামজাদা, ধনী অধ্যাপক মশাই সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন শুনে অশোকানন্দ একটু অবাকই হলেন। দাদার সঙ্গে তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে দেখেন, মলিন শার্ট পরে এক জন ভদ্রলোক সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন, যাঁর সঙ্গে অধ্যাপক মশাইয়ের চেহারার অনেক সাদৃশ্য।

অশোকানন্দের লেখা থেকে দাদার কৌতুকপ্রিয়তার আর একটি গল্প। সেই সময় তিনি দিল্লিতে অশোকানন্দের কাছে আছেন। ভাইয়ের বাড়িতে অনেক বন্ধু, আত্মীয়স্বজনের সমাগম হয়েছে। এক দিন সকালবেলা অশোকানন্দ নিজের ঘর থেকে দাদাকে শুধোলেন, ‘তোমার বাথরুম খালি আছে কি?’ জীবনানন্দ জবাব দিলেন, ‘দিল্লির মসনদ কি কখনও খালি হয়?’

হাওড়া গার্লস কলেজে অধ্যাপনাকালীন তাঁর রস-রসিকতার অনেক কথা জানা যায়। যেমন, এক দিন এক অধ্যাপকের বাড়িতে গিয়েছেন সবার সঙ্গে। অধ্যাপক বন্ধুটি ছিলেন স্পষ্টবাদী এবং স্পষ্ট কথাটা বলতেন বেশ কড়া ভাবে। সবার জন্য চা-জলখাবার এল। জীবনানন্দ চায়ে কয়েক বার চুমুক দিয়ে বললেন, ‘চা-টা যদি আপনার কথার মত কড়া হত, তা হলেও উপভোগ্য হত।’

জীবনানন্দের অন্তরঙ্গ বন্ধু সুবোধ রায় লিখেছেন, ‘রাস্তায় কোনও মোটা পুরুষ অথবা মহিলা দেখলে তিনি তাদের নিয়ে আড়ালে এসে নির্দোষ মস্করা করতেন। তাঁর আর একটি মস্করার বিষয় ছিল তাঁর মাথায় গজিয়ে ওঠা টাকটা নিয়ে।’
                          
জীবনানন্দের পরিচিত মূর্তির সঙ্গে এ সব মিলবে না। যেমন মিলবে না, সংসারে শান্তি আনার জন্য তাঁর ভাড়াটেকে উৎখাত করার তৎপরতা। আর্থিক দুরবস্থা ঘোচাতে নিজের ফ্ল্যাটের একটা ঘরে এক মাঝবয়সী মহিলাকে ভাড়াটে হিসাবে বসিয়েছিলেন। কিন্তু অচিরেই প্রকাশ পেল মহিলার স্বরূপ। মহিলার ঘরে অন্যধরনের লোকের সমাগম হতে লাগল। কবির মানসিক অশান্তি শুরু হল। তিনি উঠেপড়ে লাগলেন  মহিলাকে উৎখাত করতে। সাহায্যের জন্য অনেক হোমরাচোমরা ব্যক্তিরও শরণাপন্ন হলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হল না। আইনি পথে সুবিধা করতে পারবেন না ভেবে, এক সময় গুন্ডা দিয়েও মহিলাকে উৎখাত করার কথা তিনি ভেবেছিলেন। এরপরেও কি জীবনানন্দকে ‘সংসার-পলাতক’ বলা যাবে? অনেকের মতে বাড়ির এই দুশ্চিন্তাতেই ১৯৫৪ সালের সেই অভিশপ্ত ১৪ই অক্টোবর ট্রামলাইন দিয়ে হাঁটার সময় তিনি অমন অন্যমনস্ক ছিলেন।

তাঁর জীবনকালে জীবনানন্দের প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা দুশোর একটু বেশি, অথচ মৃত্যুর ষাট বছরে তোরঙ্গ থেকে উদ্ধার হয়েছে অসংখ্য অসূর্যম্পশ্যা কবিতা! পাতার পর পাতা থেকে সেই হস্তাক্ষর, সেই কণ্ঠস্বর, সেই শৈলী, সেই মানুষ আর তাঁর নির্জনতা ঝরে পড়ছে। তাঁর প্রিয় ইয়েটস-এর ভাষায় এও এক ‘সেকেন্ড কামিং’, ধর্ম বা ঈশ্বরে বিশ্বাসহীন জীবনানন্দের এক অভিনব ‘সম্ভবামি’। তবে এও সত্যি যে, কবির মরণোত্তর জীবনই ঢের বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ১৯৫৪-য় ২২শে অক্টোবর তাঁর অকাল প্রয়াণের পর। ১৯৪৮-এর মে-জুন মাসে রচিত তাঁর দুই উপন্যাস ‘মাল্যবান’ ও ‘সুতীর্থ’ প্রকাশনার আলো দেখল তাঁর মৃত্যুর পর। লেখার দু’বছরের মধ্যে এর একটি প্রকাশ পেলেও পেতে পারত, পায়নি। সেটা ১৯৫০-এ ‘পূর্বাশা’ সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে লেখা একটা চিঠিতে ধরা পড়েছে। কবি লিখছেন—

‘‘বেশি ঠেকে পড়েছি, সে জন্য বিরক্ত করতে হল আপনাকে। এখুনি চার-পাঁচশো টাকার দরকার; দয়া করে ব্যবস্থা করুন।

এই সঙ্গে পাঁচটি কবিতা পাঠাচ্ছি, পরে প্রবন্ধ ইত্যাদি (এখন কিছু লেখা নেই) পাঠাব। আমার একটি উপন্যাস (আমার নিজের নামে নয়— ছদ্মনামে) পূর্বাশায় ছাপতে পারেন; দরকার বোধ করলে পাঠিয়ে দিতে পারি, আমার জীবনস্মৃতি আশ্বিন কিংবা কার্তিক থেকে পূর্বাশা’য় মাসে মাসে লিখব। সবই ভবিষ্যতে, কিন্তু টাকা এক্ষুনি চাই— আমাদের মতো দু-চারজন বিপদগ্রস্ত সাহিত্যিকের এ রকম দাবি গ্রাহ্য করবার মতো বিচার বিবেচনা অনেক দিন থেকে আপনারা দেখিয়ে আসছেন— সে জন্য গভীর ধন্যবাদ।’’

চিঠির ‘সবই ভবিষ্যতে’ কথাটা ব্যঞ্জনাময়। কত কি‌ছুই যে লেখার পরিকল্পনা মাথায়, অথচ লেখা হয়ে গেছে এমন অজস্র কিছু সম্পর্কে কী নির্ভার (নাকি গুরুভার?) উদাসীনতা! তাঁর পাণ্ডুলিপির ছবি দেখলেই স্পষ্ট হয় ওঁর ওই অপরূপ মরমি পঙ্‌ক্তি সব কত সচেতন কাটাকুটি পেরিয়ে, প্রায় সীতার মতো অগ্নিপরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে কবিতায় এসেছে; — তা হলে এত কিছুর পরও তারা কেন, কী ভাবে কুমারী, অন্তরালবর্তিনী রইল?

সঞ্জয় ভট্টাচার্য লিখেছেন: ‘‘আমার মনে হয় জীবনানন্দ ঠিক ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা যাননি। যদিও এই কথাটাই সর্বত্র বলা হয়ে থাকে, তথাপি আমার ধারণা তিনি আত্মহত্যা করেছেন।’’
                            
এই সঞ্জয় ভট্টাচার্যের মতামত উল্লেখ করে জীবনানন্দের ছাত্র অরবিন্দ গুহ কবির স্মৃতিচারণায় লিখেছেন: ‘‘জীবনানন্দের মুখে শুনে তাঁর পারিবারিক ঘটনাই সঞ্জয় ভট্টাচার্য জেনেছেন, সে সব ঘটনা খুব সুখের নয়। স্ত্রীর সঙ্গে প্রতিদিন জীবনানন্দের একটা দ্বন্দ্বের কথা সঞ্জয় ভট্টাচার্য অকপটে ব্যক্ত করেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে এও জানিয়েছেন যে জীবনানন্দ তার থেকে মুক্তি খুঁজছিলেন।’’

কবির গণনাতীত ভক্তের মধ্যে যাঁরা পারিবারিক এই ছবির আঁচ পাননি তাঁরাও ‘মহাপৃথিবী’ সঙ্কলনের ‘ফুটপাথে’ কবিতার এই সূচনা স্তবকের দ্বারা আক্রান্ত না হয়ে পারেননি। কবি যেখানে তাঁর নিলয়যাত্রাকে প্রায় নিটোল অনুমানে এনেছেন:

‘‘ট্রামের লাইনের পথ ধরে হাঁটি: এখন গভীর রাত/কবেকার কোন্ সে জীবন যেন টিটকারি দিয়ে যায়/‘তুমি যেন রড ভাঙা ট্রাম এক— ডিপো নাই, মজুরির প্রয়োজন নাই/কখন এমন হয়ে হায়!/ আকাশে নক্ষত্রে পিছে অন্ধকারে/কবেকার কোন্ সে জীবন ডুবে যায়।’’

ট্রাম বা ট্রামলাইনও যে এক সময় রূপকালঙ্কার হয়ে ওঁর গদ্যকেও ভর করেছিল তাও ভক্তরা লক্ষ করছিলেন এমন সব বর্ণনায়:

‘‘শচী… প্রকাশের বিছানার কাছে এসে দাঁড়াল; এই শীতের ভেতরেও প্রকাশের কপাল ঘামিয়ে উঠেছে— আঁচল দিয়ে আস্তে আস্তে স্বামীর কপাল মুছে ফেলে শচী দরজা জানালাগুলো সব খুলে দিল। বড় রাস্তাটার দিকের জানালাটার পাশে এসে রাতের কলকাতার দিকে একবার তাকাল সে— ট্রামলাইনগুলো খালি পড়ে আছে— রাস্তার সেই বিরাট হাঙরদের এখন ঘুমোবার সময়।’’ (গ্রাম ও শহরের গল্প)

এই যে ভক্তদের কথা বলছি, এঁদের একজন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। যিনি উঠতি যৌবনে পুরনো বইয়ের দোকান থেকে চার আনায় এক কপি ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কিনে বোধ করেছিলেন কে যেন দু-চোখে ঘুসি মারল! লিখছেন—

‘‘আমি পাগলের মতন জীবনানন্দ দাশের ভক্ত হয়ে গেলাম। ভক্ত কিংবা ক্রীতদাসও বলা যেতে পারে।’’

এই ভক্ত কিংবা ক্রীতদাস কবির শেষ যাত্রার নাতিদীর্ঘ মিছিলে ছিলেন। লিখেছেন, ‘‘শবানুগমনে খুব বেশি লোক হয়নি। আমাদের অল্পবয়সি কাঁধ বেশ শক্ত, আমরা কয়েকজন কাঁধ দিয়েছিলাম পাল্লা করে। জীবনে একবারই মাত্র সেই কবির শরীর স্পর্শ করেছি, তখন নিস্পন্দ।’’

সেই শবযাত্রায় সাক্ষী অরবিন্দ গুহ নজর করেছিলেন যে, ‘‘শ্মশানের পথে পড়ল সেই জায়গাটা, যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, ট্রামলাইনের সেই জায়গা জুড়ে সবুজ ঘাস— আশ্চর্য, শানবাঁধা কলকাতায় জীবনানন্দের জীবনের চরম দুর্ঘটনা এমন জায়গাতেই ঘটল যেখানে ঘাস, ঘাস— যে ঘাসের প্রতি তাঁর ভালবাসা প্রগাঢ়, প্রবল।

আর মৃত্যু হল যখন, কোন তারিখ? রাত্রি ১১টা ৩৫মি। ৫ কার্তিক।’’
                         
এই কার্তিকের রাত্রির সংযোগটাও আশ্চর্য করেছিল অরবিন্দকে, যাঁর মামাবাড়ি ছিল বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলের কাছে। যে-ব্রজমোহন স্কুলের ছাত্র ছিলেন জীবনানন্দ; পরে ব্রজমোহন কলেজের অধ্যাপকও, অরবিন্দ লিখছেন:

‘‘লক্ষ্মীপুজোর নেমন্তন্ন থাকত মামাবাড়িতে। নেমন্তন্ন সেরে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যেত। কোজাগরি পূর্ণিমার রাত। একাধিকবার দেখেছি, স্কুলের মস্ত মাঠ জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে, মন্তাজ মিঞার আস্তাবলের কয়েকটি ঘোড়া জ্যোৎস্নার মাঠে ঘাস খাচ্ছে। বহু কাল পরে জীবনানন্দের ‘ঘো়ড়া’ নামক একটি বিখ্যাত কবিতায় পড়েছি— ‘মহিনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে/প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন— এখনও ঘাসের লোভে চরে/পৃথিবীর কিমাকার ডাইনোসর ’পরে।…‘ঘোড়া’ কবিতাটি পড়ে আমি অনেক দিন ভেবেছি— জীবনানন্দ কি কোনও দিন ওই জ্যোৎস্নার মাঠে স্বচক্ষে মন্তাজ মিঞার আস্তাবলের ঘোড়াদের ঘাস খেতে দেখেছেন?’’

অরবিন্দ ভাবেননি, তবে ভাবতেও পারতেন, শেষ আশ্বিনের ওই ভয়ানক সন্ধ্যার অপঘাতও কি জীবনানন্দ মনশ্চক্ষে দেখেছিলেন কখনও? কিংবা আধোঅচেতন অনুরাগে অনুভব করেছিলেন, যেমনটি লিখে গেছেন ‘ফুটপাথে’ কবিতার দ্বিতীয় স্তবকে…

‘‘কোন্ দিকে যেতে হবে? নিস্তব্ধ শহর কিছু জানে নাকো/ সে শুধু বিছায়ে আছে/ বিশ্বাসীর বিধাতার মতো।/ কোলে তার মুখ রাখি— বিশ্বাস করিতে চাই, তবু মনে হয়/ শহরের পথ ছেড়ে কোনও দিকে হেঁটে যদি চলে যেত আমার হৃদয়’’…।

সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে তো লিখেইছিলেন , আরও অনেককেই মৌখিক ভাবে জানিয়েছিলেন জীবনানন্দ যে তিনি আত্মজীবনীতে হাত দিতে চান। তাঁর শরীর-স্বাস্থ্য আরেকটু স্বাচ্ছন্দ্যকর হলেই।

সেটা আর হয়নি। এক, শরীর ঠিক জুতে এল না। আর দুই, হঠাৎ করে এক সন্ধ্যায় বালিগঞ্জগামী ট্রামটা এসে পড়ল গায়ের ওপর।

অথচ ১৯৩০ থেকে ১৯৩৫ তিনি নিয়মিত ‘লিটারারি নোটস’ নামে দিনলিপি লিখে গেছেন। লিখেছেন ইংরেজিতে এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পাশাপাশি গল্পের প্লটলাইন ধরে রাখতে। মাঝে মাঝে বাংলাও মিশে গেছে ক্রমশ ডায়েরি হয়ে ওঠা খাতাগুলোয়।
                           
জীবনানন্দের ইংরেজিতে ডায়েরি লেখা নিয়ে যাঁরা কিছুটা চমকিত সেগুলো প্রকাশ্যে আসায় আরওই চমৎকৃত হয়েছিলেন আরেকটি তথ্যে। কবি ১৯১৬-য় কবিতা লেখা শুরু করেন ইংরেজিতে!

ডায়েরির ইংরেজির স্টাইলটাকে বলা যায় টেলিগ্রাফিক। গল্পের ভাবনার বাইরে যে দিনের অভিজ্ঞতা পাওয়া যায় তা বড়ই মর্মান্তিক, পড়তে পড়তে মনে ভেঙে যায়। কর্মহীন জীবনের দৈনন্দিন বিড়ম্বনার ধারাবিবরণী। সদ্য বিবাহিত জীবনে সুখের অভাবেরও ইঙ্গিত এসে পড়ছে থেকে থেকে। মনে হচ্ছে এ বিবাহ না হলেই ভাল ছিল। পথে-ঘাটে কোনও মেয়েকে দেখে মনে পড়ে যাচ্ছে কোনও গ্রাম্য কিশোরীর মুখ এবং উন্মনা হচ্ছেন।

কবির কষ্টের ইঙ্গিত দিতে তিনটে ছোট্ট এন্ট্রির উল্লেখ করব। ২৭. ৭. ৩১-এর পাতায় লিখছেন: দুপুরটা কাটল চাকরির আবেদন লিখে লিখে ডাকে পাঠাতে, খেলা দেখে যে একটু আরাম স্বস্তি পাব তা আর কপালে নেই: জীবন থেকে বহু কিছুই উবে গেছে।

তার পর লিখছেন: ঢ্যাঁড়শই বাঁচিয়ে রেখেছে আমাকে। একই সঙ্গে মাধুর্য ও পরিহাস।

লিখছেন: বেজায় গরম, ঘুমনো গেল না। একবারটি চায়ের দোকান হয়ে আসতে হবে, তবে তিন পয়সার বেশি খরচের মুরোদ নেই। অভাবে থেঁতলে দিচ্ছে, ভাবছি খবরের কাগজ রাখা বন্ধ করে দেব।

এছাড়া ‘পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকুরী’ পঙ্‌ক্তিটির রচয়িতা ৯.৮.৩১-এর রোজনামচায় তিক্ততা ঝরিয়ে লিখছেন: চাকরি নেই, লোকে প্রশ্ন করছে, ‘বসে আছ?’:

‘‘…on ‘বসে থাকা’— বেকার কখনও বসে থাকে না: they stand and run, throb and palpitate; it is only the well-placed who have the external charm of the easychair or cushions, sofas and bed for themselves.’’

শেষ বয়সে কবি যে-আত্মজীবনীর কথা ভাবছিলেন তাতে কি দিনলিপির এত শোকশোচনার পূর্ণ বয়ান থাকত? আমরা জানি না, অনুমানও করতে পারি না, তবু একটা আকাঙ্ক্ষা থেকে যায়, এত রক্তক্ষরণ যে-হৃদয়ের, তিনিই তো লিখে রেখে গিয়েছিলেন, ‘তার স্থির প্রেমিকের নিকট’ নামের কবিতায়—

‘‘বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই— আমি বলি না তা/কারও লাভ আছে— সকলেরই— হয়তা বা ঢের/ভাদ্রের জ্বলন্ত রৌদ্রে তবু আমি দূরতর সমুদ্রের জলে/পেয়েছি ধবল শব্দ— বাতাসতাড়িত পাখিদের।’’

কবির যে দুটি বিখ্যাত বই দিয়ে বাঙালি পাঠকের সাধারণত পরিচয় ঘটে ওঁর সঙ্গে সেই ‘বনলতা সেন’ বা ‘রূপসী বাংলা’ পড়ে তাদের ধারণায় আনাও কঠিন কবির ব্যক্তিজীবনের ওঠাপড়া। অথচ নিয়তি এমন যে, এক সময় ওঁর জীবনের সঙ্গেই মিলিয়ে মিলিয়ে পড়ার প্রয়োজন হয় ওঁর কবিতা। শুধু কাব্যোপভোগের জন্যই নয়, এক আধ্যাত্মিক আরাম ও দার্শনিক সুকৃতি অর্জনের জন্য। শুধু ওঁর কবিতা পড়ে এক আশ্চর্য জীবনানন্দকে জানা হয়; আর ওঁর জীবন ও কবিতা পাশাপাশি ও মিলিয়ে পড়লে এক পরমাশ্চর্য জীবনানন্দকে আবিষ্কার করে ফেলা যায়। আর এখানে তুলনাটা খুব সহজেই এসে পড়ে ওঁর প্রিয় কবি জন কিটস্-এর।
                        
প্রকৃতি, নির্জনতা, মৃত্যু ও অন্ধকারের প্রতি দু’জনেরই স্বভাবটান। কিন্তু নক্ষত্র, আকাশ, সমুদ্র, নাবিক ও অভিযান যে ভাবে বেঁধেছে দুই কবির দুই সেরা কবিতাকে তা কলেজের প্রথম বর্ষে আবিষ্কার করে যে-হিল্লোল জেগেছিল ভেতরে সে-রোমাঞ্চ আজও ছেড়ে যায়নি অর্ধশতাব্দী পরেও।

কিটসের কবিতা ‘‘On First Looking into Chapman’s Homer’’ একটি চতুর্দশপদী, জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ দ্বাদশ পদে ধরা। প্রথমে কিটসের প্রথম চার লাইন:

‘‘Much have I travel’d in the realms of gold,/ And many goodly states and kingdoms seen;/Round many western islands have I been/Which bards in fealty to Apollo hold.’’

এর পর জীবনানন্দের প্রথম চার পঙ্‌ক্তি:

‘‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,/সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে/অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে/সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;’’

এর পর জীবনানন্দের শেষ ক’টি পঙ্‌ক্তি:

‘‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,/ মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতি দূর সমুদ্রের পর/হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা/সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর/ তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’/ পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।’’

এ বার কিটসের সেই শেষ কটা অবিস্মরণীয় লাইন:

‘‘Then felt I like some watcher of the skies/When a new planet swims into his ken;/ Or like stout Cortez when with eagle eyes/ He star’d at the Pacific— and all his men/ look’d at each other with a wild surmise— /Silent, upon a peak in Darien.’’

আত্মজীবনী লেখা না হলেও নিজের বাবা ও মা’কে নিয়ে সুন্দর একটা প্রবন্ধ রেখে গেছেন জীবনানন্দ, যার শিরোনামাটিও সরল— ‘আমার মা বাবা’।

শুরুটাও সরল— ‘‘আমার মা শ্রীযুক্তা কুসুমকুমারী দাশ ১৩… সালে ২১শে পৌষ বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাঝে মাঝে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার কথা লিখে রাখতেন মনে পড়ে। তার পরে কলেজে উঠেও তাঁকে কোনো কোনো সময় তাঁর নিজ জীবন ও নানা বিষয় সম্পর্কে ধারণা ভাবনা লিখে রাখতে দেখেছি। সে সব লেখা কোথায় তিনি রেখে দিয়েছিলেন— কিংবা নিজেই ছিঁড়ে ফেলেছেন কিনা কিছুই জানি না। তাঁর কয়েকটি অপ্রকাশিত কবিতা ছাড়া অন্য কোনো লেখা আমাদের কারো কাছে নেই। এখন সে সব কবিতাও খুঁজে পাচ্ছি না।’’
                        
এই মায়ের ওপর নির্ভরতার একটা মিষ্টি ছবি আছে ছাত্রাবস্থায় হার্ডিঞ্জ হস্টেলে থেকে ওঁকে লেখা জীবনানন্দের একটি চিঠিতে। লিখছেন:

‘‘Golden Treasuryটা পাঠাইতে লিখিয়াছিলাম, পাঠাইয়া দিও। আমার Hostel ও Law College-এর টাকা এখনও আসিতেছে না কেন? তা ছাড়া বইর জন্য ৫০ টাকা পাঠাইতে হইবে।… Paradise Regained আমাদের পাঠ্য। আগে কিনি নাই। আজকাল তো পাওয়া যাইতেছে না। জিতেন মুখার্জ্জীর বইটা থাকিতে পারে। ভুবন যদি তাহার নিকট হইতে সেই বইটা এবং Scott-এর নভেলের তিনটা (Kenilworth, Old Morality, Talisman) লইয়া আসে তাহা হইলে ভাল হয়।’’

বাবা সম্পর্কে জীবনানন্দের বিচারটা এমন ছিল:

‘‘একমাত্র জ্ঞানযোগই যে বাবার অন্নিষ্ট ছিল সে কথা সত্য নয়; কিন্তু মধ্যবয়স পেরিয়েও অনেক দিন পর্যন্ত সাহিত্য শিল্প বিজ্ঞান এমনকি গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চ্চায় তাঁকে প্রগাঢ় হয়ে থাকতে দেখেছি মানুষের জীবন ও চরাচর সম্বন্ধে যত দূর সম্ভব একটা বিশুদ্ধ ধারণায় পৌঁছবার জন্যে, নিজের হিসেবে পৌঁছতে পেরেছিলেন তিনি। উচ্ছ্বাস দেখিনি কখনো তাঁর, কিন্তু জীবনে অন্তঃশীল আনন্দ স্বভাবতই ছিল— সব সময়ই প্রায়। কিন্তু গদ্য লেখা ছাড়া বাবা সাহিত্য সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেননি, কিন্তু পাঠ করেছিলেন অনেক, আলোচনার প্রসারে ও গাঢ়তায় আমাদের ভাবতে শিখিয়েছিলেন— দৃষ্টি তিনিই খুলে দিয়েছিলেন।’’

নাতিদীর্ঘ এই রচনা থেকে জীবনানন্দের চিন্তা ও চলনের উৎসমুখ শনাক্ত করা অসুবিধের না। এই প্রবন্ধ এবং ‘লেখার কথা’, ‘কেন লিখি’, ‘কবিতা সম্পর্কে’ শীর্ষক রচনাত্রয়ী এবং ওঁর চিঠিপত্র, দিনলিপি ও কবিতার বইগুলো মিলিয়ে পড়লে কবির একটা আত্মজীবনী পড়া হয়ে ওঠে।

বোন সুচরিতা দাশের বিবরণে জানা যাচ্ছে কী ‘ভীষণতম হিংস্র দুর্দিন’ ঘনিয়ে আসায় সাধের বরিশাল ছাড়তে হয়েছিল কবিকে। কিন্তু তাতেও তাঁর ‘এষণাশক্তি, ভাবনাপ্রতিভা, mother wit’ (কথাগুলো কবির থেকেই নেওয়া) বিস্রস্ত হয়নি এতটুকু।

সুচরিতা লিখছেন: ‘‘বাইরে থেকে যাঁরা তাঁকে দেখেছেন তাঁরা তাঁকে গম্ভীর নির্জন, স্বপ্নালোকবাসী বলেছেন, বলেছেন সর্বক্ষণ একটা অদৃশ্য বেষ্টনী তৈরি করে তাঁর নিজের চারিদিকে তিনি সবার থেকে আলাদা হয়ে থাকতেন। …

যে মানুষ অত গুরুগম্ভীর কবিতা লিখতেন, তিনি যে অমন চারিদিক উচ্চকিত করে প্রকম্পিত হাসি হাসতে পারতেন, বা অন্যকেও হাসিয়ে হাসিয়ে ক্লান্ত করে দিতে পারতেন, তা যেন না দেখলে বিশ্বাস করাই যায় না।’’
                         
সামগ্রিক কর্মজীবনে পাঁচটিরও বেশি কলেজে কাজ করেছেন জীবনানন্দ। এ যেন এক বিপন্ন বিস্ময়, যা তাঁকে স্থিত হতে দেয়নি। যার সূত্রপাত সিটি কলেজে কাজ যাওয়ার পরপরই। কলকাতায় থাকতে এক দিকে তিনি সমসাময়িক বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে-র চেয়ে বয়সে বড়। কিন্তু তখনও তাঁর কবিতা পত্র-পত্রিকা থেকে ফেরত আসে, নতুন কবিতা সংকলনে তাঁর নাম ছাপা হয় না। অন্য দিকে ব্যক্তিগত, আর্থিক জীবনেও অনিশ্চয়তা। ভাল না লাগায় ১৯২৯ সালে বাগেরহাট কলেজের চাকরি ছেড়ে দেন। সেখা‌ন থেকে দিল্লি। ১৯৩০ সালের মে মাস পর্যন্ত তিনি দিল্লিতে ছিলেন। তার পর বিয়ে করতে বরিশালে এসে আর দিল্লি যাননি। অমিতানন্দের কথায়, ‘‘বিয়ের কয়েক মাস আগে চাকরিটা ছেড়ে দিলেন হঠাৎ। তখন থেকেই তাঁর দাম্পত্য জীবনে সঙ্কট শুরু হয়। যা আর কখনও মেটেনি। জেঠিমা সুন্দরী ছিলেন, শিক্ষিতা ছিলেন, গানও ভাল গাইতেন। কিন্তু তিনি সেই এক্সপোজ়ারটা পাননি। দাম্পত্য জীবনে খামতি থাকার জন্য ছেলে-মেয়েকে খুব প্রশ্রয় দিতেন। ক্ষতিটা হয়তো পুষিয়ে দিতে চাইতেন।’’ অসুখী দাম্পত্য ফুটে উঠেছে তাঁর লেখা একাধিক উপন্যাসেও। অমিতানন্দের খুঁজে পাওয়া একটি ডায়রিতেও দেখা গেল সেই অস্থির জীবনের ছায়া। সেখানে লিখছেন এক জায়গায়, ‘বাড়িতে থাকতে রোজি সন্ধ্যার পর ভাবতাম একটু অন্ধকারে থাকা যাক—জ্যোৎস্না বা লম্ফের আলোতে—কিন্তু একটা না একটা কারণে রোজি আলো জ্বালতে হত—তারপর মেসে চলে গেলাম সেখানে roommateদের জন্য আলোর ব্যবস্থা না হলে চলত না—’ আবার আরেক জায়গায়, ‘চিরদিন দুঃখ ভোগ করে যাওয়াটাই তো জীবনের উদ্দেশ্য নয়...’
                         
ব্যক্তিগত জীবনে ত্রস্ত ছিলেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু কোথাও তাঁর একটা স্থির বিশ্বাসের ভরকেন্দ্রও ছিল! হয়তো সে বিশ্বাসে শাণিত তরবারির স্পর্ধা ছিল না। কিন্তু সে বিশ্বাস ছিল ফসলসম্ভবা মাটির মতো নরম অথচ ঋজু। না হলে তাঁর বিরুদ্ধে যখন লাগাতার ধূসর, পলায়নকারী মানসিকতা, দুর্বোধ্য, বিশেষণগুলি (নেতিবাচক অর্থেই) ক্রমাগত ব্যবহার করা হচ্ছে, তখন কেন বলবেন, ‘‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’ আমার কবিতার প্রধান আবহাওয়া নয়...’ অথবা ‘ক্যাম্পে’ কবিতার অশ্লীলতার অভিযোগ নিয়ে কেন লিখবেন, ‘যদি কোনো একমাত্র স্থির নিষ্কম্প সুর এ কবিতাটিতে থেকে থাকে তা জীবনের— মানুষের-কীট-ফড়িঙের সবার জীবনেরই নিঃসহায়তার সুর।’ কর্মজীবন টালমাটাল হওয়া সত্ত্বেও কেন তিনি নির্দ্বিধায় বলবেন, ‘যে জিনিস যাদের যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে সবই অসাড়তার নামান্তর নয় কি?’ এই উচ্চারণের জন্য তো স্পর্ধা লাগে, সাহসও। যেমন ভাবে বিশ্বাস লাগে এই সারসত্যটুকু বলতে, ‘সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি।’ এই নিষ্কম্প বিশ্বাস তাঁর কলকাতার উপরেও ছিল। এমনিতে ছাত্রজীবন থেকে কর্মজীবন, ১৯৩৫ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ার আগে এবং আবার কলকাতায় ফেরা পর্যন্ত, এ শহরে তাঁর আবাস-মানচিত্রে ছিল কখনও মেস, কখনও অশোকানন্দের বাড়ি, কখনও ল্যান্সডাউনের ভাড়াবাড়ি। কর্মজীবনে টালমাটাল মুহূর্তে অন্য জায়গায় চাকরির সুযোগ হচ্ছিল, কিন্তু তবু তিনি যাচ্ছিলেন না বলে জানিয়েছিলেন অমিতানন্দ। তাঁর কথায়, ‘‘অসমে, পঞ্জাবে ও অন্যত্র চাকরি হলেও কলকাতা ছেড়ে যেতে রাজি ছিলেন না!’’ দেশভাগের পরে কলকাতায় এসে বন্ধু সঞ্জয় ভট্টাচার্যের চেষ্টায় ‘স্বরাজ’ নামে একটি নতুন দৈনিক পত্রিকার রবিবাসরীয় সাহিত্য বিভাগটি সম্পাদনার কাজ পেয়েছিলেন। ‘স্বরাজ’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে ১৯৫০ সাল নাগাদ কিছু দিন খড়্গপুর কলেজে কাজ করছিলেন। সেখান থেকে শহরে ফিরে কখনও বড়িশা কলেজ, ডায়মন্ড হারবারের ফকিরচাঁদ কলেজ, হাওড়া গার্লস কলেজে কাজ করেছেন। আর শহর ছেড়ে যাননি! এ শহরও তখন তাঁকে আস্তে আস্তে চিনছে। তত দিনে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘বনলতা সেন’, ‘মহাপৃথিবী’, ‘সাতটি তারার তিমির’, ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রকাশিত হয়েছে (যদিও সব মিলিয়ে অপ্রকাশিত রয়ে গিয়েছে তখনও দেড় হাজারেরও বেশি কবিতা, উপন্যাস, গল্প)। স্বীকৃতি পাচ্ছেন তিনি, জুটেছে পুরস্কারও। তারও আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রশংসায় আপ্লুত হয়েছেন তিনি, আর বুদ্ধদেব বসুর মতো যাঁরা ভাষাবিন্যাসে অচলায়তন ভাঙার সমর্থক, তাঁদের কাছে তিনি তো তখন রীতিমতো আবিষ্কার! তাই শহরের সমস্ত সাহিত্য আলোচনায়, কবিতাপাঠে তিনি আমন্ত্রিত।
                           
কিন্তু তার পর সে দিন! ১৯৫৪ সালের ১৪ই অক্টোবর। আগের দিনই রেডিয়োয় ‘মহাজিজ্ঞাসা’ কবিতাটি পাঠ করেছিলেন। তা নিয়ে সে দিন সকালে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনাও করেছিলেন। তার পর প্রতি দিনের মতো ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ি থেকে বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই হাঁটা যে তাঁর অভ্যেস। ও পার বাংলায় বাল্যকালের সেই স্টিমারের জেটি। কিছুটা দূরে ঝাউয়ের সারি। লিচু, অজস্র ফুল-ফল সমারোহে বিশাল কম্পাউন্ড নিয়ে ব্রাউন সাহেবের কুঠি। সে সব পার হয়ে ব্রাহ্ম সমাজ সার্কিট হাউসের গির্জা, তা ছাড়িয়ে গেলে শ্মশানভূমি, লাশকাটা ঘর। সে সব পথ হাঁটতে হাঁটতে আকাশে মেঘ দেখে বালক জীবনানন্দ ভাইকে বলতেন, তিনি একটা মনপবনের নৌকা তৈরি করবেন। সে দিনও কি জীবনানন্দ আকাশে মেঘ দেখে মনপবনের নৌকার কথা ভাবছিলেন? না হলে কেন ট্রামের অবিরাম ঘণ্টা বাজানোর আওয়াজ, ট্রাম চালকের চিৎকার শুনতে পাবেন না তিনি! ট্রামের ধাক্কায় গুরুতর জখম জীবনানন্দকে রাস্তা থেকে তুলে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন অপরিচিতেরা। সেখানেই আট দিনের লড়াই।

মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ উক্তি ছিল, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপির রং সারাটা আকাশ জুড়ে’।

‘‘সেই ট্রামটি এখন আর নেই! এক সময়ে আগুন লেগেছিল। তাতেই পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল ট্রামটি। তবে কবির স্মৃতির উদ্দেশ্যে বনলতা নামে একটা হেরিটেজ ট্রাম চালু হয়েছে,’’ পরে সংবাদমাধ্যম কে জানিয়েছিলেন পরিবহণ দফতরের প্রাক্তন পদস্থ কর্তা। তিনি আরও জানিয়েছিলেন, বহুল আলোচিত ওই ‘নকড ডাউন’-এর কোনও তথ্য এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর!

নেমেসিস? হবে হয়তো। না হলে কবির ‘ঘাতক’ ট্রাম নিজেই আগুনে কেন ভস্মীভূত হবে!

শহরের প্রাণঘাতী ট্রামলাইনে তাঁর পথ হাঁটা থেমেছিল, আবহমানের শব্দস্রোত থামেনি!

‘সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী’, কিন্তু হয়তো সেই আবহমানের খোঁজে বেরিয়েই জীবনানন্দ আর ফেরেননি! বাংলা কবিতার নির্জন চরাচর ধরে জীবনানন্দ হেঁটে গিয়েছেন দূরে, দূরতম দ্বীপে, একাকী, নিঃসঙ্গ অবস্থায়। তাঁর গা থেকে খসে খসে পড়েছে বাংলা কবিতার অবিশ্বাস্য সব লাইন, অসম্ভব সব শব্দ। তার পর সে সব শব্দ মিশে গিয়েছে আলপথে,

মাঠের ধারে, ধানসিড়ি নদীর কিনারে। আর তিনি ছড়িয়ে পড়েছেন এ বাংলায়, দুই বাংলার বিস্তীর্ণ চরাচরে— মাটির ভিতর মাটি হয়ে, ফসলের ভিতর ফসল হয়ে, পাখির ভিতর পাখি হয়ে...
                              
জীবনানন্দের যাবতীয় রচনার সাক্ষ্যে একটা ভয় কিন্তু থেকে যায়। তা হল আত্মজীবনীটা লিখে ফেললেও নিজের witty, কৌতুকপ্রিয় সত্তাটাকে সেখানে মেলে ধরতেন কিনা। এখানেও তুলনাটা এসে পড়ে অন্য নির্জন কবি কিটসের। যাঁর চরিতের জীবনোচ্ছল ছবিগুলোর জন্য নির্ভর করতে হয় সমসাময়িক ও জীবনীকারদের বৃত্তান্তে। আমাদের সৌভাগ্য জীবনানন্দের এরকম একজন ছিলেন অরবিন্দ গুহ, যিনি অগ্নিমিত্র নামে চমৎকার রসরচয়িতা হয়েছিলেন পরে। তাঁর বর্ণিত জীবনানন্দের কতিপয় রসিক ছবির একটি দিয়ে শেষ করব।—

‘‘সিনেমায় গান লেখার ব্যাপারে একদা জীবনানন্দ কিঞ্চিৎ আগ্রহী হয়েছেন, তিনি আমাকে এক দিন জিজ্ঞেস করলেন— সিনেমায় গান লিখলে নাকি অনেক টাকা পাওয়া যায়? তুমি কিছু জানো এ বিষয়ে? আমি জানি না এমন কোনো বিষয় জগতে নেই, আমি সর্বজ্ঞ— আমার নিজের মতে। সর্বজ্ঞের গলায় বললাম— হ্যাঁ, আমিও শুনেছি সিনেমায় গান লিখলে অনেক টাকা পাওয়া যায়। তিনি বললেন— আমি লিখতে পারি না? বললাম— নিশ্চয়ই পারেন। —আমাকে কী করতে হবে? —বাংলা সিনেমার পরিচালক হিসেবে প্রেমেন্দ্র মিত্রের খুব নামডাক, প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন? জীবনানন্দ বললেন— খুব ভালো, বললাম— তা হলে আর কী কথা? তাঁকে বলুন। উনি অনায়াসে একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। দিন কয়েক বাদে আবার রাসবিহারী এভিনিউতে দেখা। জিজ্ঞেস করলাম— প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে দেখা করেছিলেন? জীবনানন্দ বললেন— না, এ বার করে ফেলব। ইতিমধ্যে ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভাবনাচিন্তা করেছি— সর্বজ্ঞের অনেক দায়। আবার রাসবিহারী এভিনিউতে দেখা। বললাম— প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে…। জীবনানন্দ বললেন— না, এখনও ঠিক হয়নি, কিন্ত এ বারে আর দেরি করব না। বললাম— থাক, এ ব্যাপারে প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে দেখা করার দরকার নেই। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন? জীবনানন্দ বললেন— খুব ভালো। আমি তুড়ি মেরে বললাম— তা হলে আর কথা নেই। ওঁকে বলুন সিনেমার ডিরেক্টর হিসেবে প্রেমেন্দ্র মিত্রের চেয়ে ওঁর দাপট অনেক বেশি। তা ছাড়াও একটা কথা আছে। জীবনানন্দ আগ্রহী হলেন— কী কথা?বললাম— প্রেমেন্দ্র মিত্র নিজেই সিনেমার গান লেখেন, কিন্তু শৈলজানন্দ নিজে সিনেমার গান লেখেন না। এই অবস্থায়… আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে জীবনানন্দ বললেন— বুঝেছি, আর বলতে হবে না। আমি শিগগিরই শৈলজাকে বলব। — ঠিক আছে।

দশ-বারো দিন বাদে আবার রাসবিহারী এভিনিউতে এক দিন। নির্ঘাত শৈলজানন্দের সঙ্গে কথা বলেছেন? জীবনানন্দ বললেন— না, তোমার সঙ্গে কথা আছে।

বলে আমাকে নিয়ে গেলেন ফুটপাথের এক পাশে। সেখানে সাবধানে গোপন কথা বললে আর কারও শোনার আশঙ্কা কম। বললেন— শৈলজার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলিনি কেন জান? বললাম— না। কেন? খুব হতাশভাবে বললেন— যদি শৈলজা আমার জন্য কোথাও একটা ব্যবস্থা করে দেয় তা হলেও আমি কেমন করে লিখব, ‘রাধে-এ-এ-এ ঝাঁপ দিলি তুই মরণ যমুনায়’। এখনো আমার মনে গেঁথে আছে চোখমুখের সকৌতুক ভঙ্গির সঙ্গে জীবননান্দের গলায়— রাধে-এ-এ-এ… বলা বাহুল্য হলেও বলা দরকার, ইহজন্মে সিনেমার গান লেখার সৌভাগ্য জীবনানন্দের হয়নি,’’

মৃত্যুশয্যায় এই জীবনানন্দকে দেখে অরবিন্দর মনে হয়েছিল যেন নীচের ঠোঁট কামড়ে দুরন্ত হাস্যস্রোতকে ঠোঁটের ওপারে বন্দি করে রেখেছেন। হয়তো খানিক আগেই সেই নিজস্ব হাসি হেসেছেন। নাকি একটু পরেই হেসে উঠবেন প্রচণ্ড শব্দে?
                              
(তথ্যসূত্র:
১- অনন্য জীবনানন্দ: জীবনান্দ দাশের সাহিত্যিক জীবনী, ক্লিন্টন বি সিলি, প্রথমা প্রকাশন (২০১৮)।
২- আমার জীবনানন্দ আবিষ্কার ও অন্যান্য, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিভাস (২০১৫)।
৩- জীবনানন্দ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, দে’জ পাবলিশিং (১৯৮৯)।
৪- জীবনানন্দ দাশ: বিকাশ প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং (২০০৭)।
৫- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪শে জানুয়ারি ২০১৫ সাল।
৬- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ই সেপ্টেম্বর ২০১৮ সাল।
৭- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩শে জানুয়ারি ২০১৬ সাল।
৮- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সাল।
৯- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ই ফেব্রুয়ারি ২০২০ সাল।)
                            

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ