হারিয়ে যাওয়া হীরা ।। রানা চক্রবর্তী



সময়টা তখন রেনেসাঁস, ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে ব্রিটিশ-ভারতের অধিভুক্ত অবিভক্ত বাংলায় বিস্ময়কর উত্থান ঘটেছিল বাঙালির নবজাগরণের। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে শুরু করে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ, বেগম রোকেয়া, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, কাজী নজরুল ইসলাম পর্যন্ত প্রাতঃস্মরণীয় প্রায় সব বাঙালি মনীষীই২ বাংলার এই নবজাগরণ আন্দোলনের অংশ ছিলেন। বর্তমান বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান ভূখ- নিয়ে গঠিত তখনকার ব্রিটিশ-শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশের তথা বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসের বিস্মৃতপ্রায় কিন্তু অবিস্মরণীয় এক অধ্যায়ের রচয়িতা ছিলেন বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলার বকজুরি গ্রামের সমত্মান হীরালাল সেন (১৮৬৬-১৯১৭)। গবেষণায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে হীরালাল সেন শুধু অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশেরই নন, সমগ্র এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা অঞ্চলেরও প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রকার।

অথচ কোনো পাঁজি, কোনো চলচ্চিত্র ক্যালেন্ডার, কোনো সরকারি সিলমোহর, কোনো পাঠ্যপুস্তক এমনকি কোনো ফিল্ম অধ্যাপকের লেকচার নোটেও তিনি নেই, থাকেন না।

ইতিহাসের পাতা জুড়ে থাকা সব আখর কি বর্ণে বর্ণে সত্যি? এক জনের কৃতিত্বে অন্য জন কি ভাগীদার হয়নি? ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসের গোড়াতেই গন্ডগোল। এ দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের জনক কে? হীরালাল সেন না কি দাদাসাহেব ফালকে? প্রভাব প্রতিপত্তি এবং তৎকালীন বম্বে মিডিয়ার আধিপত্যের জোরে নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় জনের নামেই বেশি ভোট পড়বে। কিন্তু ইতিহাসের পাতার ভাঁজে তো অনেক নামই হারিয়ে যায়। চলচ্চিত্র উৎসাহী ছাড়া ক’জনই বা হীরালাল সেনের নাম জানেন!

তখনকার মতো চলচ্চিত্র এখনো উপমহাদেশ জুড়ে বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হয়েই আছে। পৃথিবীর এ-অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র এবং কাহিনিভিত্তিক পূর্ণ ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয় (বছরে তিন সহস্রাধিক)। এই উপমহাদেশেরই চলচ্চিত্রের জনক, চলচ্চিত্রের মূল এবং মৌলিক শেকড় হলেন হীরালাল সেন। দুর্ভাগ্য, ঐতিহাসিক ভুল, হীনমন্যতা, সংকীর্ণতা আর ভূরাজনৈতিক কূটনীতি’র শিকার হয়ে কালের গর্ভে আজো বিস্মৃত, অবহেলিত, আচ্ছন্ন ও সমাহিত হয়ে আছেন আমাদের চলচ্চিত্রের সেই মহানায়ক হীরালাল সেন।

অথচ হীরালালকে বাদ দেওয়া মানে ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসের সূত্রপাতে খুঁত থেকে যাওয়া। বিশ্বাস-অবিশ্বাস তো চিরকালই ধাওয়া করে এসেছে তাঁকে। ভারতীয় সিনেমার পথিকৃৎ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে বছরের পর বছর গড়িয়ে গিয়েছে।

চলচ্চিত্র-মহীরুহ হীরালাল সেনই এই ভূখণ্ডে চলচ্চিত্র সংস্কৃতির জন্মদাতা, কারণ তিনি বঙ্গদেশের এবং অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা, তাঁরই হাত ধরে এদেশে চলচ্চিত্র সাধারণ্যে পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়েছে। তাঁর নির্মিত উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রের নাম The Dancing Scene from the Flower of Persia (১৮৯৮)। তিনি উপমহাদেশের এবং সারা পৃথিবীর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র – Alibaba (১৯০৩) এবং প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র – Grand Patriotic Film (১৯০৫)-এর নির্মাতা।৪ হীরালাল সেন পৃথিবীর সেই প্রথম চলচ্চিত্রকার, যিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের কারণে রাজরোষে নিপতিত হয়েছিলেন এবং যাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র – The Visit Film (১৯১২) বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসে প্রথম রাজনৈতিক কারণে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল।

নিরীক্ষা এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালিয়ে পৃথিবীতে হীরালাল সেনই প্রথম বৈদ্যুতিক পদ্ধতিতে প্রক্ষিপ্ত ছবির আয়তন বৃদ্ধির কৌশল আবিষ্কার করেন এবং বিশ্বচলচ্চিত্র সংস্কৃতির প্রসারে অবদান রাখেন। প্রায়োগিক নিরীক্ষার মাধ্যমে চলচ্চিত্র প্রদর্শনব্যবস্থারও তিনি যুগান্তকারী উন্নয়ন ঘটান। নিজস্ব উদ্ভাবন এবং লাগসই দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শনের মাধ্যমে সমগ্র উপমহাদেশে চলচ্চিত্রকে জনপ্রিয় শিল্পমাধ্যম হিসেবে পরিচিত করে তোলেন তিনি। তিনি ছিলেন চলচ্চিত্র শিক্ষক ও গবেষক। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে তারকাপ্রথার উদ্ভব ঘটে।

১৮৬৮ (মতভেদে ৬৬) সালের ২ আগস্ট (১৯ শ্রাবণ ১২৭৫ বঙ্গাব্দ) শ্রাবণ পূর্ণিমার দিন, অখণ্ড ভারতবর্ষের ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ মহকুমার বগজুরি গ্রামে হীরালাল সেনের জন্ম। বাবা– চন্দ্রমোহন, মা– বিধুমুখী। ঠাকুর্দা –গোকুলকৃষ্ণ সেন মুনশি। দাদু – শ্যামচাঁদ। দিদিমা – ব্রহ্মময়ী। ছোটোপিসি রূপলতার সঙ্গে বিয়ে হয় ঈশ্বরচন্দ্র সেনের আর তাঁদের সন্তানই হলেন আচার্য, লেখক ও সাহিত্যিক ড. দীনেশচন্দ্র সেন। দীনেশচন্দ্রের লেখা ঘরের কথা ও যুগ সাহিত্য–ই হল হীরালালের ছোটোবেলা সম্পর্কে আকর গ্রন্থ। দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন,

“বগজুরীর মাতুলালয় ছিল অতি প্রকাণ্ড, খুব বড় কোন রাজবাড়ীর মত। বাড়ীটি ৩০/৪০ বিঘা জমি লইয়া তন্মধ্যে প্রায় ৪/৫ বিঘা শুধু ফুলবাগানই ছিল।” (পৃ. ৮৪, প্রকাশক –জিজ্ঞাসা, দ্বিতীয় মুদ্রণ –জৈষ্ঠ্য ১৩৬৯, বানান অবিকৃত)।

২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত চিকিৎসক ও সমাজকর্মী বাসুদেব মণ্ডল গিয়েছিলেন হীরলালের জন্মভিটেতে। তাঁর বয়ান অনুযায়ী,

“বাড়িটি খুবই নীচু জমির ওপর ছিল কেননা মূল রাস্তা থেকে নেমে বাঁধের মতো পথ ধরে পায়ে হেঁটে যেতে হয় সেখানে। দুধারে নীচু জমি। ইতস্তত কিছু হতদরিদ্র মানুষের বসতি দুপাশেই। পাটকাটি, হোগলা পাতা চ্যাঁচাড়ির ঘরবাড়ি। মূল ফটক যেখানে ছিল, সেখানে এখন কিছুই নেই। সরকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় করেছে সেখানে। সেটা চালুও আছে  আর জমির পরিমাণ খুব বেশি হলে ১০ বিঘা মতো হবে। বাড়িটি যেখানে ছিল সেখানে একটু উঁচু চাতাল মতো আছে কিন্তু কোনো ইঁট কাঠের চিহ্ন নেই। ওই রাস্তার বাম দিকে গাছপালার আড়ালে জঙ্গলাকীর্ণ একটি মন্দির আছে। ব্যাস!”

প্রথমে কেউ বিশ্বাসই করেনি যে, ফোটোগ্রাফিতে প্রথাগত তালিম না থাকা সত্ত্বেও এক সদ্য যুবক বিদেশিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছবি তুলতে পারে!

ওই সময়ে বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড কোম্পানির একটি ফোটোগ্রাফি প্রতিযোগিতা হত। সেখানে হীরালালের তোলা ছবি প্রথম স্থান অধিকার করে। চিত্রগ্রাহকের নাম দেখে সাহেবরা বিশ্বাস করতে পারেনি এক জন নেটিভ এমন ছবি তুলতে পারে। তাই হীরালালকে ওই ছবিটি ফের তুলে প্রমাণ দিতে হয়েছিল। তথ্য বলছে, ১৮৮৭-১৮৯৮ সালের মধ্যে ফোটোগ্রাফি চর্চায় শ্রেষ্ঠত্বের জন্য হীরালাল সাত বার স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। ভাই মতিলাল এবং দেবকীলালকে নিয়ে ঢাকা মানিকগঞ্জের আদিবাড়িতে স্টুডিয়ো খুলেছিলেন। সে যুগের বিচারে এই উদ্যোগ অবশ্যই চমকপ্রদ। হীরালাল তখন দেশের এক নম্বর স্টিল ফোটোগ্রাফার।

কিন্তু ফরমায়েশি ছবি তোলা আর কত দিন? অন্য স্বপ্ন ডানা মেলতে শুরু করেছে। ফোটোগ্রাফি থেকে বায়োস্কোপের নেশায় মাতলেন হীরালাল। তত দিনে ঢাকা থেকে কলকাতায় চলে এসেছেন। স্টিল ফোটোগ্রাফির ব্যবসা ভুলে বায়োস্কোপ শিক্ষায় মাতলেন। তবে কাজটা সহজ ছিল না। বায়োস্কোপে তখন সাহেবদের একচেটিয়া আধিপত্য। খুঁটিনাটি জানার জন্য হীরালালকে ঘুরতে হয়েছে নানান দরজায়। তখন স্টার থিয়েটারে 'স্টিফেন্স সাহেব' বলে এক জন বায়োস্কোপ দেখাতেন। থিয়েটারের ফাঁকেই তা দেখানো হত। সেই প্রথম চলমান ছবি চাক্ষুষ করলেন হীরালাল। কেমন যেন ঘোর লেগে গেল! এত দিন যে ছবি তুলেছেন, সেই সব সৃষ্টি মিথ্যে মনে হতে লাগল। স্টিফেন্স সাহেবকেই ধরলেন বায়োস্কোপ তৈরি শিখিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সাহেব মোটেই আমল দিলেন না। একবগ্গা হীরালালকে এ সব দমিয়ে রাখতে পারেনি। যেমন ভাবে নিজের চেষ্টায় ফোটোগ্রাফি শিখেছিলেন, তেমন ভাবেই সিনেম্যাটোগ্রাফিও শিখে নিলেন।

হীরালালের রয়্যাল বায়োস্কোপ (১৮৯৮) তৈরির ঠিক দু’বছর আগে ১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই সংবাদপত্রে একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়।

‘দ্য মার্ভেল অব দ্য সেঞ্চুরি, দ্য ওয়ান্ডার অব দ্য ওয়ার্ল্ড, লিভিং ফোটোগ্রাফিক পিকচার্স ইন লাইফ সাইজড রিপ্রোডাকশন বাই মেসার্স লুমিয়ের ব্রাদার্স সিনেমাটোগ্রাফ...’— ওটি ছিল লুমিয়ের ব্রাদার্সের চলমান চিত্রের প্রদর্শনী।

এ ভাবেই সিনেমার সঙ্গে ভারতবাসীর প্রথম পরিচয়। তার এক বছর আগেই বিশ্ববাসী জেনেছে লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের চলমান চিত্র আবিষ্কারের কাহিনি। বিনোদনের ঢেউ এসে লাগল বঙ্গদেশেও।

আই.এস.সি-র ছাত্র হীরালালের লেখাপড়ায় মোটেই ঝোঁক ছিল না। এক দিন একটি পত্রিকায় সিনেম্যাটোগ্রাফ মেশিনের বিজ্ঞাপন দেখলেন। ব্যস, মা বিধুমুখী দেবীর কাছ আবদার জুড়লেন কিনে দেওয়ার জন্য। মায়ের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে যন্ত্রের অর্ডার দিয়ে দিলেন! কিন্তু যন্ত্র পেলেই তো হল না, ছবি দেখানোর জন্য প্রয়োজন ইলেকট্রিকের। ১৮৯৭ সালে কলকাতার ইডেন গার্ডেন এবং হাওড়া স্টেশনেই এক মাত্র ইলেকট্রিসিটির ব্যবস্থা ছিল। তখন ইলেকট্রিক আর্কল্যাম্প বা লাইম লাইটের সাহায্যে সিনেমা দেখানো হত। সেই ব্যবস্থা করা চাট্টিখানি কথা নয়। লাইম লাইটের জন্য অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন গ্যাসের প্রয়োজন ছিল। রবারের ব্যাগে গ্যাসের জোগানের ব্যবস্থা করলেন। এক দিন আচমকাই সেই রবারের গ্যাসের ব্যাগটি গেল ফেটে। বিপাকে পড়ে হীরালাল হাজির হলেন সেন্ট জ়েভিয়ার্স কলেজের ফাদার লাফোঁর কাছে। ওই ব্যাপারে লাফোঁর জ্ঞান ছিল। ওই সময়ে তিনি চলমান চিত্র দেখিয়ে ছাত্রদের পড়াতেন। উৎসাহী যুবকটিকে তিনি অনেক পরামর্শও দেন। নানা রকম জোগাড়যন্ত্র করে হীরালাল নেমে পড়লেন মাঠে। শুরু হল ‘রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি’র (১৮৯৮) যাত্রা। সঙ্গী দুই ভাই মতিলাল এবং দেবকীলাল আর ভাগ্নে কুমারশঙ্কর গুপ্ত। যদিও দেবকীলাল অল্প দিনই সেখানে যুক্ত ছিলেন।

যে সময়টায় হীরালাল বায়োস্কোপের কারবার শুরু করলেন, তখন কলকাতার একেবারে অন্য রূপ। সাহিত্য-সংস্কৃতি সব দিকেই শিখরে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার রাজধানী। রাস্তায় ট্রাম চলছে। পাশ দিয়ে হেঁকে যাচ্ছে জুড়িগাড়ি। ফিটন গাড়ি করে নাটক দেখতে আসছেন বাবু-বিবিরা। শহরের নানা দৃশ্য ক্যাপচার করতে লাগলেন হীরালাল। বাইরে গিয়েও ছবি তুলে আনতেন। দর্শক হাঁ করে গিলতে লাগলেন সেই সব চিত্র। নানা জায়গা থেকে ডাক পেতে লাগল রয়্যাল বায়োস্কোপ। বিভিন্ন রাজ পরিবার, এস্টেটে গিয়ে বায়োস্কোপ দেখাতে হত তাঁকে। বাড়তে লাগল পরিচিতি। আসতে লাগল অর্থ। কিন্তু হীরালাল ক্রমশ বুঝতে পারলেন, গতে বাঁধা ছবি দেখানোয় ক্রিয়েটিভিটি নেই। যদিও তিনি তত দিনে আলো, সম্পাদনা নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা শুরু করে দিয়েছেন। সিনেমার জন্য যে একটা গল্পের প্রয়োজন, তা বুঝতে পেরেছিলেন হীরালাল।

এই সময়েই থিয়েটারের অমরেন্দ্র দত্তের সঙ্গে যোগাযোগ হয় হীরালালের। অমর দত্ত তাঁর হাতে ব্ল্যাঙ্ক চেক ধরিয়ে দেন। তখন থিয়েটারের উঠতি নক্ষত্র অমর। গিরীশ ঘোষ থাকা সত্ত্বেও তাঁর প্রতিপত্তি কোনও অংশে কম নয়। ১৮৯৬ সালে তিনি শুরু করলেন ক্লাসিক থিয়েটার। থিয়েটার জগতের যা কিছু ঐতিহ্য, সব ভেঙে নতুন আইডিয়ার জোয়ার নিয়ে এলেন। বদলে দিলেন মঞ্চ সজ্জার পুরনো স্টাইল। বাংলা থিয়েটারে মঞ্চের উপরে ঘোড়া নামিয়ে দিয়েছিলেন অমর দত্ত! তিনি এবং হীরালাল দুই প্রতিভা এক হয়ে বায়োস্কোপ এবং থিয়েটার দুই ক্ষেত্রেই নিয়ে এলেন বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

ওই সময়ে ক্লাসিকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘সীতারাম’ জনপ্রিয় হয়েছিল। সেই নাটকের কিছু অংশ তুললেন হীরালাল। তার পরে ‘আলিবাবা’ নাটকের অংশও তুললেন তিনি। জানা যায়, ১৮৯৮ সালের ৪ এপ্রিল ক্লাসিকে প্রথম বায়োস্কোপ দেখান হীরালাল। এ ভাবে অনেক নাটকই ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন। ১৯০২-০৩ সালে বিদেশ থেকে আরও উন্নত ক্যামেরা ও যন্ত্রপাতি আনালেন। এ বার তুললেন প্রথম পূর্ণাঙ্গ নাটক ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’। ১৯০৪ সালের ২৩ জানুয়ারি ক্লাসিকে তা দেখানো হল। সিনেমার ইতিহাসে একটা অধ্যায় তৈরি হল সে দিন।

চলচ্চিত্র এবং ফটোগ্রাফির অনেক কিছুতেই হীরালাল ভারতে ও বঙ্গদেশে প্রথম। সেগুলির একটি তালিকা তৈরি করলে বিষয়টি নিম্নরূপ হয়।

১ম– ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের নাটক নিয়ে ছায়াছবি আলিবাবা মুক্তি পায় ২৩ জানুয়ারি ১৯০৩ সালে। প্রায় দু-ঘণ্টার ছবি। যদিও সিকোয়েলের মতো করে আলাদা আলাদা স্ক্রিনিং করা শুরু হয়েছিল ১৯০০ সালে। উল্লেখ থাকুক দ্য গ্রেট ট্রেন রবারি রিলিজ করে ১৯০৩ সালে এবং বিশ্বের প্রথম কাহিনিচিত্র হিসেবে খ্যাত। কলকাতার ক্লাসিক থিয়েটারে এটির প্রথম অভিনয় হয়েছিল ১৮৯৭ সালে। ভ্রমর হীরালালের প্রথম ছবি হলেও সেটির সন তারিখের নথি না-পাওয়ায় অনুল্লেখিত রইল।
২য় –প্রথম বিজ্ঞাপন চিত্র (১৯০৩) (ভারতে, সম্ভবত বিশ্বে)।
৩য় –প্রথম রাজনৈতিক তথ্যচিত্র (১৯০৫) (ভারতে, সম্ভবত বিশ্বে)।
৪র্থ – প্রথম রাষ্ট্র কর্তৃক নিষিদ্ধ তথ্যচিত্র (১৯০৫) (ভারতে, সম্ভবত বিশ্বে)।
৫ম – প্রথম সবাক চলচ্চিত্র প্রক্ষেপণ প্রচেষ্টা (১৯০৫ , টাউন হল)।
৬ষ্ঠ– প্রথম তথ্যচিত্র (১৯০৫) (ভারতে, সম্ভবত বিশ্বে)।
৭ম- প্রথম রঙিন চলচ্চিত্রের স্রষ্টা (সেলুলয়েডে রঙ লাগিয়ে ১৯০০ সালে)।
৮ম- প্রথম বাঙালি চলচ্চিত্র প্রদর্শক (রয়্যাল বায়োস্কোপ কম্পানি, ১৮৯৮)।
৯ম- প্রথম বাঙালি ল্যাব টেকনিশায়ান (১৯০০)।
১০ম- প্রথম বাঙালি ফিল্ম ডেভেলপার (১৯০০)।
১১তম - প্রথম ভারতীয় স্বর্ণপদক জয়ী স্থিরচিত্রগ্রাহক (১৮৯৮)।
১২তম- প্রথম স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র প্রদর্শক (ভারত শিল্প প্রদর্শনী, ১৯০০ সাল, রয়াল বায়োস্কোপ কম্পানি)।

হীরালাল যা-ই করেছেন, পাশে পেয়েছেন তাঁর পরিবারকে। বিত্তশালী পরিবারের সন্তান হওয়ার সুবাদে টাকাপয়সা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি। বাবা চন্দ্রমোহন সেন ছিলেন ঢাকা শহরের নামজাদা উকিল। মা বিধুমখী পুত্রের ইচ্ছেয় সব সময়ে সায় দিয়েছেন। যখনই হীরালাল কিছু চেয়েছেন তাঁরা হাজির করেছেন সামনে। আর এক জন হীরালালের সব ইচ্ছেতেই মদত দিতেন। তিনি পিতামহ গোকুলকৃষ্ণ।

যদিও সিনেমার এই আদিপুরুষ সম্পর্কে খুব কম তথ্যই পাওয়া যায়। তাঁর উত্তরসূরিরা এতটাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে যে, তেমন তথ্যও মেলে না।

ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথিকৃৎকে নিয়ে সিনেমা তৈরির পরিকল্পনা ছিল পরিচালক শেখর দাসের। তাঁকে নিয়ে অনেক গবেষণাও করেছেন। গিয়েছিলেন বাংলাদেশেও। তাঁর বক্তব্যে,

‘‘বগজুরি গ্রামে হীরালালদের বিশাল জমি, বাড়ি, দালান, নাটমন্দিরের বর্ণনা পাওয়া যায়। যদিও আমি গিয়ে তার খুব বেশি অবশিষ্ট দেখিনি। কিন্তু ওই সময়ে মুন্সিদের বিশাল দাপট ছিল। চন্দ্রমোহন বাড়িতে বাইজি নাচ বসাতেন। বাইজিদের পায়ে ছুড়ে দেওয়া হত আবির। পায়ে পায়ে উড়ত সেই ফাগ। কিশোর হীরালাল আড়াল থেকে সে সব দেখতেন। হয়তো তাঁর স্বপ্নের উপরে এই সব ঘটনার প্রচ্ছন্ন ছাপ ছিল।’’

নামকরা পণ্ডিত এবং সাহিত্যিক দীনেশচন্দ্র সেন ছিলেন হীরালালের পিসতুতো দাদা। তাঁর লেখাতেই পাওয়া যায়, ছোটবেলায় কেমন ভাবে কাগজ কেটে পুতুল-নকশা তৈরি করতেন তাঁরা। লণ্ঠনের আলোয় ছায়াবাজির খেলায় মাততেন। এই সব করতে করতেই হীরালালের মাথায় ফোটোগ্রাফির ভূত চাপে। ঢাকা থেকে কলকাতায় চলে আসার ফলে তাঁর স্বপ্নও বাস্তবের কাছাকাছি আসে। চন্দ্রমোহন তাঁর পরিবার নিয়ে এসে ওঠেন কলকাতার ভবানীপুরে। সেখান থেকে পরে তাঁরা মসজিদ বাড়ি স্ট্রিটে উঠে যান। সেখানেই হীরালালের সিনেমার হাতেখড়ি।

তত দিনে হেমাঙ্গিনী দেবীর সঙ্গে হীরালালের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সিনেমা-পাগল হীরালালের সব পাগলামির শরিক হেমাঙ্গিনী। বাবা-মা, স্ত্রী সকলের আশকারা না পেলে তিনি হয়তো এ ভাবে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছতে পারতেন না। তিন মেয়ে এবং এক ছেলের পিতা হীরালাল না ছিলেন সংসারী, না ছিলেন বিষয়ী। দ্বিতীয়টির জন্য ভবিষ্যতে তাঁকে অনেক পস্তাতেও হয়। কিন্তু কিছু মানুষ তো থাকেন, যাঁদের বিষয়-আশয়ের গণ্ডির মধ্যে আটকানো যায় না। সোনার চামচ মুখে নিয়ে যে ব্যক্তির জন্ম, তাঁর শেষ জীবন কেটেছিল চূড়ান্ত দারিদ্র্যে। এমনকি বিক্রি করে দিতে হয় প্রাণের চেয়ে প্রিয় ক্যামেরাও। সৃষ্টির নেশায় মত্ত হীরালালের সংসারটা বেঁধে রেখেছিলেন হেমাঙ্গিনী। কিন্তু যে স্বামীর জন্য হেমাঙ্গিনীর এত কিছু, আঘাত পেয়েছিলেন তাঁর কাছ থেকেও। তবু শেষ দিনে অসুস্থ, নিঃস্ব হীরালালকে তিনিই আগলে রেখেছিলেন।

বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারের কারণে হীরালালের চেনাজানার পরিধি ছোট ছিল না। সমাজের উঁচু তলাতেও তাঁর মেলামেশা ছিল। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর বন্ধু ছিলেন। চলচ্চিত্রকারের শেষ দিনেও পাশে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। অমর দত্তের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব অত্যন্ত গাঢ় ছিল। কিন্তু শেষের দিকে সেখানেও ফাটল ধরে। সৃষ্টিশীল সিদ্ধান্তে অমিল না কি ক্লাসিকের নায়িকা কুসুমকুমারীকে নিয়ে তাঁদের দ্বন্দ্ব, তা অবশ্য স্পষ্ট জানা যায়নি।

সমস্যা হল, বিখ্যাত হওয়ার চেয়ে সেই জায়গাটা ধরে রাখা বেশি শক্ত। হীরালালের প্রতিভায় কোনও খাদ ছিল না। কিন্তু তাঁর চরিত্রে নানা রকম দোষ দেখা দিতে থাকে। তাঁর পিসতুতো দাদা দীনেশচন্দ্র সেন নিজের লেখায়, হীরালাল ‘বখে গিয়েছিল’ বলে উল্লেখ করেছেন। মদ্যপান তো শুরু করেছিলেনই, তার উপরে অভিনেত্রী কুসুমকুমারীর সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বলেও শোনা যায়। ক্লাসিকের প্রধান অভিনেত্রী তখন কুসুমকুমারী। ‘আলিবাবা...’র মর্জিনা। যদিও কুসুমকুমারীর সঙ্গে অমর দত্তেরও সম্পর্ক ছিল। থিয়েটারের দৃশ্য ক্যাপচার করার সময়ে দিন-রাত ক্লাসিকেই পড়ে থাকতেন হীরালাল।

এর মধ্যেই আবার একটা মারাত্মক ভুল করে বসলেন। ‘আলিবাবা...’র লাভের শেয়ার লিখে দিলেন কুসুমকুমারীর নামে। কাজ, থিয়েটার, কুসুমকুমারী, মদ্যপান— এ সবে যত নিমজ্জিত হতে থাকলেন, সংসারের সঙ্গে দূরত্ব ততই বাড়তে লাগল। হেমাঙ্গিনী রাশ টানার চেষ্টা করলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। এর মধ্যে ছিল হীরালালের বেহিসেবি খরচ। প্রভূত অর্থ উপার্জন করা সত্ত্বেও আর্থিক কষ্টের মধ্যে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। ছোট ছোট ভুলই হীরালালকে এগিয়ে দিচ্ছিল মস্ত এক খাদের কিনারে।

যেমন ভাবে প্রথম সিনেমা তৈরিতে হীরালাল পথ দেখিয়েছিলেন, তেমন ভাবেই প্রথম রাজনৈতিক তথ্যচিত্রও তিনিই তুলেছিলেন। তখন রাজনৈতিক দিক থেকেও বড়সড় পরিবর্তন আসছে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন প্রসঙ্গে টাউন হলে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক সভা, রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে শোভাযাত্রা এবং তাঁর বক্তৃতা-সহ একাধিক রাজনৈতিক ঘটনার সাক্ষী ছিল হীরালালের ক্যামেরা। রাজনৈতিক তথ্যচিত্র দেখানোর জন্য তাঁকে সমস্যায়ও পড়তে হয়েছিল। 

বিজ্ঞাপনের ছবি তোলার ক্ষেত্রেও তাঁকে পথিকৃৎ বলা যেতে পারে। সি.কে সেনের ‘জবাকুসুম কেশতৈল’, বটকৃষ্ণ পালের ‘এডওয়ার্ডস এন্টিম্যালেরিয়া স্পেসিফিক’, ডব্লিউ মেজর অ্যান্ড কোম্পানির ‘সার্সাপেরিয়া’র বিজ্ঞাপন করেন। বলা হয়, বিদেশ থেকে ক্যামেরা আনানোর জন্য বটকৃষ্ণ পালের কাছে গিয়ে অনুরোধ করেন হীরালাল। সটান গিয়ে বলেন, বিদেশ থেকে ক্যামেরা আনিয়ে দিলে তিনি এডওয়ার্ডস টনিকের বিজ্ঞাপন চিত্র তুলে দেবেন এবং সেটি বিভিন্ন জায়গায় দেখাবেন। সন্দেহ নেই তখনকার দিনে এই ভাবনায় অভিনবত্ব ছিল। জবাকুসুম কোম্পানির মালিকের কাছেও তিনি নিজে থেকেই গিয়েছিলেন। ওই বিজ্ঞাপনে কুসুমকুমারীকে নিয়েছিলেন হীরালাল। বিজ্ঞাপনে অভিনেত্রীদের ব্যবহার করার চল যে শুধু এখনকার নয়, হীরালালের এই পদক্ষেপই তাঁর প্রমাণ। তবে তিনি মোট ক’টি ছবি, ক’টি তথ্যচিত্র তুলেছিলেন, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য পাওয়া যায় না।

চলচ্চিত্র-গবেষক সৈকত আসগর, প্রভাত মুখোপাধ্যায়, কালীশ মুখোপাধ্যায়, সজল চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের গবেষণামূলক কাজের তথ্য-উপাত্ত থেকে এ পর্যন্ত হীরালাল সেন-নির্মিত বিজ্ঞাপনচিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য, পূর্ণদৈর্ঘ্য, রাজনৈতিক চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র সব মিলিয়ে মোট পঞ্চান্নটি চলচ্চিত্রের নাম উদ্ধার করা গেছে। তবে সম্প্রতি চলচ্চিত্র-গবেষক অনুপম হায়াৎ উলেস্নখ করেছেন – হীরালাল সেন ১৮৯৮ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের প্রায় একশ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।

এখনো পর্যন্ত পাওয়া তথ্যসূত্রের হিসাবে হীরালাল সেনের চলচ্চিত্রপঞ্জি নিম্নরূপ:

● কাহিনীচিত্র:- ১) ভ্রমর; ২) আলিবাবা; ৩) হরিরাজ; ৪) দোল লীলা; ৫) সরলা; ৬) বুদ্ধ; ৭) সীতারাম।
( ১৯০০-১৯০১ সময়সীমায় তোলা এই ছবিগুলির দৈর্ঘ্য ১০০ থেকে ১৫০ ফিট পর্যন্ত)।

৮) দুটি প্রাণ; ৯) মৃণালিনী; ১০) সোনার স্বপন; ১১) মনের মতন; ১২) মজা; ১৩) বধু;
(১৯০২- ১৯০৫ সময়সীমায় তোলা এই ছবিগুলির দৈর্ঘ্য ২০০ থেকে ৩০০ ফিট পর্যন্ত - বিদেশ থেকে ক্যামেরা এনে নতুন ক্যামেরায় তোলা)।

১৪) চাবুক; ১৫) গুপ্তকথা; ১৬) ফটিকজল; ১৭) দলিতা ফনিনী (১৯০৩-১৯০৫ সময়সীমায় তোলা ছায়াছবি )।

● সংবাদচিত্র:- ১৮) করোনেশন দরবার -দিল্লি (১৯০৩); ১৯) করোনেশন দরবার -কলকাতা ( ১৯০৩); ২০) গ্র্যান্ড প্যাট্রিওটিক ফিল্ম (১৯০৫); ২১) সুরেন্দ্রনাথের শোভাযাত্রা (১৯০৫); ২২) দিল্লি কলকাতার দরবার চিত্র (১ম) (১৯১১-১২); ২৩) দিল্লি কলকাতার দরবার চিত্র (২য়) (১৯১১-১২); ২৪) দিল্লি কলকাতার দরবার চিত্র (৩য়) (১৯১১-১২); ২৫) দিল্লি কলকাতার দরবার চিত্র (৪র্থ) (১৯১১-১২); ২৬) দিল্লি কলকাতার দরবার চিত্র (৫ম) (১৯১১-১২); ২৭) দিল্লি কলকাতার দরবার চিত্র (৬ষ্ঠ) (১৯১১-১২)।

● তথ্যচিত্র:- ২৮) পথের ছবি; ২৯) গঙ্গার ঘাটের ছবি; ৩০) প্যাথে নৃত্য দৃশ্য; ৩১) প্যাথে ছবি (গুচ্ছ) (১৯০০ সালে তোলা); ৩২) চিৎপুর রোডে চলমান দৃশ্য; (১৯০০- ১৯০১ সময়সীমায় তোলা ছায়াছবি); ৩৩) বগজুরি গ্রামের বিবাহোৎসব; ৩৪) বগজুরি গ্রামের স্নানার্থী তথ্যচিত্র (১৯০২- ১৯০৩ সময়সীমায় তোলা ছায়াছবি); ৩৫) রাজেন্দ্র মল্লিকের বাড়ির বিবাহোৎসব; ৩৬) দুলিচাঁদ মল্লিকের বাড়ির বিবাহোৎসব; ৩৭) শিবচরণ লাহার বাড়ির বিবাহোৎসব; ৩৮) রাজেন্দ্র মল্লিকের বাড়ির বিভিন্ন উৎসব; ৩৯) শিবচরণ লাহার বাড়ির বিভিন্ন উৎসব (১৯০২-১৯০৫ সময়সীমায় তোলা ছায়াছবি)।

● প্রচারচিত্র:- ৪০) এডওয়ার্ড অ্যান্টি ম্যালেরিয়া স্পেসিফিক কম্পানির পেটেন্ট ওষুধ; ৪১) জবাকুসুম তেল (সি কে সেন-এর আগরপাড়া বাগানবাড়িতে গৃহীত); ৪২) সার্সাপেরিলা (ডব্লিউ মেজর কম্পানির তৈরি, সি কে সেনের বাগানবাড়িতে গৃহীত) ১৯০৩ সালে তৈরি।

এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যমতে তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে কাহিনিচিত্র বাইশটি (মঞ্চনাটকের খন্ড, কাহিনিভিত্তিক স্বল্প ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র), রাজনৈতিক চলচ্চিত্র ও সংবাদচিত্র ষোলোটি (সংবাদভিত্তিক চলচ্চিত্র, প্রামাণ্য চলচ্চিত্র), তথ্যচিত্র চৌদ্দটি এবং বিজ্ঞাপন চলচ্চিত্র তিনটি। তিনি কথাসাহিত্য থেকে গল্প নিয়ে যেমন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, তেমনি গ্রামবাংলা ও শহরের চিত্রও ধারণ করেছেন ক্যামেরায়। পর্যবেক্ষণে দেখা যাবে – বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসের তিনটি যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত ও মাইলফলক স্থাপন করেছিলেন হীরালাল সেন।

১৯০৩ সালে হীরালাল সেন নির্মাণ করেছিলেন বিশ্বের প্রথম পূর্ণদের্ঘ্য চলচ্চিত্র – আলিবাবা। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানির প্রযোজনায় নির্মিত হয় চলচ্চিত্রটি। এটি বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল। তিনি পৃথিবীর প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র – Grand Patriotic Film (১৯০৫) নির্মাণ করেন। তিনি প্রথম সংবাদভিত্তিক তথ্যচিত্র – The Visit Film (১৯১২) নির্মাণ করেন। এই চলচ্চিত্রই ইতিহাসে প্রথম চলচ্চিত্র, যা রাজনৈতিক কারণে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। বিশ্বচলচ্চিত্র ইতিহাসে অনুলিস্নখিত এ-তিনটি বিষয় তাই গুরুত্বসহ আলোচনার বিশেষ দাবি রাখে।

গবেষণায় জানা গেছে, ১৯০৩ সালে নির্মিত আলিবাবা (মুক্তির তারিখ: ২৩শে জানুয়ারি ১৯০৩) চলচ্চিত্রই সারা পৃথিবীর মধ্যে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্র। কারণ চলচ্চিত্রকার এডউইন এস পোর্টার-নির্মিত গ্রেট ট্রেন রোবারি (মুক্তির তারিখ: ১লা ডিসেম্বর ১৯০৩) পৃথিবীর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্র হিসেবে কথিত হলেও, তার দৈর্ঘ্য মাত্র বারো মিনিট দশ সেকেন্ড।

ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ-রচিত আলিবাবা (১৯০৩) নাটকটি প্রথমে ক্লাসিক থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়েছিল। হীরালাল সেন এই নাটকেরই চলচ্চিত্ররূপ দিয়েছিলেন। অপরপক্ষে The Great Train Robbery (১৯০৩) চলচ্চিত্রটিও Edwin S. Porter আমেরিকান নাট্যকার Scott Marble (১৮৪৭-১৯১৯) কর্তৃক ১৮৯৬ সালে রচিত The Great Train Robbery শীর্ষক মঞ্চনাটক দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মাণ করেছিলেন। তাই বলার সময় এসেছে, বাংলার আলিবাবা (১৯০৩) চলচ্চিত্রই সারা পৃথিবীর মধ্যে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্র, আমেরিকার The Great Train Robbery (1903) নয়।

২৪শে মার্চ ১৯১৭ সাল, শনিবার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের বাংলা নির্বাক কাহিনিচিত্রটি ময়দানের নতুন তাঁবুতে সন্ধ্যে ৬-১৫ ও রাত ৯-৩০-এর দুটি শো-এ দেখানো হয়।

হীরালাল সেনের হাত ধরেই বাংলা ছবিতে গল্প বলা শুরু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গল্প-অবলম্বনে তিনি নির্মাণ করেছিলেন ভ্যাগাবন্ড (১৯০৯) নামক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র (আসগর, ৬২)। তিনি সাতটি নাটকের খন্ড-দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন, এসবে অভিনয় করেন নেপা বোস, অমর দত্ত, গিরীশচন্দ্র ঘোষ, কুসুমকুমারী দেবী প্রমুখ। কলকাতায় ১৯০১ সালের ৯ ফেব্রম্নয়ারি এগুলোর প্রদর্শনী হয়। কলকাতার ক্ল্যাসিক থিয়েটারে ১৯০৩ সালের ৬ই জুন দেখানো হয় হীরালাল-নির্মিত নৃত্যমুখর আলিবাবা ও মনের মতন শিরোনামের দুটি ছবি। আগেকার ছবিগুলোতে ক্যামেরা এক স্থানে বসিয়ে চিত্রগ্রহণ করা হতো। কিন্তু নৃত্যমুখর আলিবাবা ও মনের মতন এই দুটি ছবিতে ক্যামেরার স্থান পরিবর্তন করে চলচ্চিত্রায়ণের নিরীক্ষা করেন হীরালাল। এভাবে কলকাতায় তরুণদের মধ্যে নতুন এই শিল্পমাধ্যমটি জনপ্রিয় হয়ে উঠল। তাঁর একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা চলচ্চিত্রকে স্থানীয় রূপ দিলো, জনপ্রিয় করল এবং সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি অর্জনে সহায়ক হলো। সবচেয়ে বড় কথা, বহু সমসাময়িক শিল্পীকে তিনি অনুপ্রাণিত করলেন, কাজ শেখালেন। চলচ্চিত্রের শিক্ষার্থী হীরালাল সেন হয়ে উঠলেন উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র-নির্মাতা ও চলচ্চিত্র-শিক্ষক। হীরালাল সেনের কাছে হাতেকলমে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শনের কাজ শিখেছিলেন ইম্পিরিয়াল বায়োস্কোপের প্রতিষ্ঠাতা অনিল চট্টোপাধ্যায় ও নলিনী চট্টেপাধ্যায়; অরোরা ফিল্ম করপোরেশনের অনাদি বোস, দেবী ঘোষ ও চারুঘোষ; কালী ফিল্মস স্টুডিওর প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায়, এনকে চ্যাটার্জি,  প্রমথনাথ গাঙ্গুলি, নারায়ণ বসাক, সত্যচরণ বসাক, সুরেশ রায়, শচীন রায়, উপেন মৈত্র, জীতেন মৈত্র এবং তাঁর নিজের ভাগ্নে কুমার গুপ্ত এবং আরো অনেকে।

সম্রাট পঞ্চম জর্জের সস্ত্রীক ভারত আগমন উপলক্ষে ১৯১১-১৯১২ সালে সরকারি আমন্ত্রণক্রমে হীরালাল সেন তৈরি করেন The Visit Film (1912), যা সারাবিশ্বের প্রথম সংবাদচিত্র, আবার সরকারি বিধিনিষেধে যার প্রদর্শনী নিষিদ্ধও হয়েছিল (সজল, পৃ ২৪৭)। অমৃতবাজার পত্রিকার বিজ্ঞাপনানুযায়ী ৫ জানুয়ারি ১৯১২ তারিখে মিনার্ভা থিয়েটারে মুক্তি পায় হীরালাল সেনের এই বায়োস্কোপ The Visit Film। এর ছিল মোট সাতটি খন্ড। ক্যান্সার রোগাক্রান্ত হীরালাল সেন ভগ্নস্বাস্থ্য, জনবল সংকট এবং তীব্র অর্থাভাব সত্ত্বেও সম্রাট দম্পতির ভারত পরিভ্রমণের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সব অনুষ্ঠান চিত্রায়িত করেছিলেন Visit Film-এ। নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে নিজের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত রসায়নাগারে এই ছবির পরিস্ফুটন এবং সম্পাদনার কাজও তিনি সম্পন্ন করেছিলেন তাৎক্ষণিকভাবে। এ প্রসঙ্গে ওঁর জামাতা অবনীপ্রসাদ, যিনি প্রিনসেপ ঘাটে ছবির শুটিংও দেখেছিলেন, তিনি বলেন, ‘কাজে উনি সর্বদাই ছিলেন সময়ের আগে, ভালো দামি ঘড়ির চেয়েও নিয়ন্ত্রিত এবং দানবীয়ভাবে কর্মশীল।’
 
হীরালালের দেখাদেখি তখন আরও অনেকে বায়োস্কোপের ব্যবসায় আসছেন। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ছিলেন জামশেদজী ফ্রামজী ম্যাডান। ভারতীয় সিনেমায় ম্যাডান একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই পারসি ভদ্রলোকের যেমন ছিল অর্থ, তেমনই ব্যবসায়ী বুদ্ধি। তিনি বিদেশ থেকে ছবি আনিয়ে দেখাতেন। সিনেমা দেখানোর ব্যবসা যে কালক্রমে বাড়বে, তা বুঝেছিলেন ম্যাডান। তথ্য বলছে, কলকাতার প্রথম চিত্রগৃহ ‘এলফিনস্টোন বায়োস্কোপ’ (১৯০১)। এটাই নাকি পরবর্তী কালের ‘চ্যাপলিন’। তখন গড়ের মাঠে তাঁবু খাটিয়ে বায়োস্কোপ দেখানোর চল ছিল। রয়্যাল বায়োস্কোপও সে ভাবেই দেখাত। হীরালালের তোলা ছবি ম্যাডানের তাঁবুতে দেখানো হয়েছে, এমনও ঘটেছে। কিন্তু ম্যাডান আর রয়্যালের বন্ধুত্ব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। তার ফলে আদপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল রয়্যাল। 

ম্যাডান তো প্রতিদ্বন্দ্বী, কিন্তু সংঘাত বেঁধেছিল আপন সম্পর্কেই। হীরালাল প্রথম ধাক্কা খান ভাগ্নে কুমারশঙ্কর গুপ্তর কাছ থেকে। কুমারশঙ্কর অনেক দিন ধরেই আলাদা হয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। ১৯০৩ সাল নাগাদ তিনি অন্য এক ব্যক্তির সঙ্গে পার্টনারশিপে ‘লন্ডন বায়োস্কোপ’ খুললেন। যদিও সেখানে বেশি দিন থাকতে পারেননি। তবে হীরালাল সবচেয়ে বেশি আস্থা রাখতেন যাঁর উপরে, সেই মতিলালের আলাদা হয়ে যাওয়ায় রয়্যালের জয়যাত্রা থমকে যায়।

শুরু থেকেই ঠিক ছিল ক্যামেরা-যন্ত্রপাতির মালিকানা হীরালালের আর সিনেমার স্টক মতিলালের। দুই ভাই যে দিন আলাদা হয়ে গেলেন, সে দিন হীরালালের নিজের সৃষ্টির উপরে আর কোনও দাবি রইল না। এই ভাঙনের জন্য অনেকে মতিলালকে দোষ দেন। কিন্তু হীরালালের চরিত্রের পতনও এর জন্য কম দায়ী নয়। খরচপত্রের হিসেব রাখতেন মতিলাল। কিন্তু দাদার উল্টোপাল্টা খরচ সামলাতে বেগ পেতে হত তাঁকে। দুই ভাইয়ের তিক্ততা চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছয় যখন কুসুমকুমারী ‘আলিবাবা...’র জন্য নিজের লভ্যাংশ দাবি করেন। কুসুমকুমারীর প্রেমে অন্ধ হয়ে, মতিলালকে না জানিয়েই হীরালাল এই কাজ করেছিলেন। পরে কুসুমকুমারী মামলাও করেন। যদিও তাতে তিনি জিততে পারেননি।

মতিলালের ছেলে বলরাম সেনের বয়ানে পাওয়া যায়— প্রত্যক্ষদর্শী জগদীশ সেন বলেছেন, একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে দাদার কাছে কৈফিয়ত দাবি করলে মতিলালকে সকলের সামনে চড় মারেন হীরালাল। ১৯১৩ সালে আলাদা হয়ে যান দুই ভাই। ওখানেই শেষ হয়ে যায় চলচ্চিত্র ইতিহাসের একটি অধ্যায়। হীরালালের তোলা সব ছবির মালিক ছিলেন মতিলাল। পরে দুই ভাই আলাদা করে ব্যবসা করার চেষ্টা করলেও সুবিধে হয়নি। মতিলালের কাছে ছিল না হীরালালের সৃজনশীলতা। আর হীরালালের ছিল না ব্যবসায়িক বুদ্ধি।

শেখর দাস যোগাযোগ করেছিলেন মতিলালের নাতি দেবু সেনের সঙ্গে। ‘‘হীরালালের আত্মীয়দের পাওয়া না গেলেও মতিলালের উত্তরাধিকারীরা রয়েছেন। কলকাতার জামির লেনে তাঁদের বড় বাড়িও রয়েছে। দুই ভাইয়ের ভাগাভাগির সময়ে বলা হয়েছিল, সব টাকা মতিলাল নিয়েছিলেন। অবশ্য ওঁর নাতি তা অস্বীকার করেন।’’

রয়্যাল বায়োস্কোপ ভেঙে যাওয়ার শোক নিতে পারেননি হীরালাল। তত দিনে তাঁর শরীর ভেঙেছে। ভেঙেছে মনও। কুসুমকুমারীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে তিনি ফিরে এসেছেন তাঁর চিরসুহৃদ হেমাঙ্গিনীর কাছে। বরাবরের মতো আবার হেমাঙ্গিনী স্বামীর পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। কারণ তত দিনে হীরালালকে ধরে নিয়েছে রাজব্যাধি— ক্যানসার।

অভাবের তাড়নায় তখন পরপর বাড়ি বদলেছেন হীরালাল। জুটি বেঁধেছেন অন্যত্র। কিন্তু কোথাও সুবিধে করতে পারেননি। বন্ধুবৎসল হীরালালের বড় দুর্বলতা ছিল যে, তিনি চট করে অন্যকে বিশ্বাস করতেন। রাম দত্ত নামে এক জনের সঙ্গে সিনেমা হল চালানোর ব্যবসা শুরু করলেন। রাম দত্ত মোটেও সুবিধের লোক ছিলেন না। কিছু দিনের মধ্যেই হীরালালের ব্যবসায়িক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে রাম দত্ত গোটা ব্যবসা নিজের নামে করে নেন।

এ দিকে স্ত্রী হেমাঙ্গিনী নিজের গয়না, বাড়ির আসবাব বিক্রি করে স্বামীর চিকিৎসার খরচ জোগাড় করেছেন। দু’হাতে রোজগার করেছিলেন হীরালাল। কিন্তু রাখতে পারেননি কিছুই। শেষ জীবনে দারিদ্র্যের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা হেমাঙ্গিনীর পক্ষে সহজ ছিল না। তিনি নিজে সচ্ছল পরিবারের সন্তান ছিলেন। বিয়ে হয়েছিল ধনী পরিবারে। সেখান থেকে চূড়ান্ত অভাবের মধ্যে সংসার টানতে হয় হেমাঙ্গিনীকে।

হীরালাল তখনও স্বপ্ন দেখছেন, সুস্থ হয়ে ফের সকলকে তাক লাগিয়ে দেবেন! হরিতকী বাগানের বাড়ি বিক্রি করে চলে এলেন ব্ল্যাকি স্কোয়ারে। এর মধ্যে মারা গেলেন তাঁর বড় মেয়ে। ক্রমশ বুঝতে পারছিলেন, নতুন করে শুরু করা বোধহয় তাঁর আর হবে না। নিদারুণ শোক ও অর্থকষ্টে কেটেছে তাঁর জীবনের শেষ চারটে বছর। অভাবের তাড়নায় নিজের দু’টি ক্যামেরা নিয়ে এক দিন গেলেন আংটি মল্লিকের কাছে। তখনকার দিনে আংটি মল্লিক নামজাদা ধনী। আসল নাম পান্না মল্লিক। এই ব্যক্তি হীরালালের সুহৃদ ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, হীরালালের মতো ব্যক্তিত্ব ক্যামেরা বন্ধক রেখে টাকা চাইতে এসেছেন। পান্না মল্লিক টাকা দিতে রাজি, কিন্তু ক্যামেরা রাখতে চান না! চিকিৎসার জন্য টাকা চাইলেও হীরালাল বুঝতে পারছিলেন, তাঁর সময় আসন্ন। তাই জোর করে ক্যামেরা দিয়ে আসেন। এটা ভেবেই তিনি আশ্বস্ত ছিলেন যে, তাঁর ক্যামেরা এমন এক জনের কাছে থাকছে, যে তার মূল্য বুঝবে, যত্ন করবে।

ঈশ্বরের কী নির্মম পরিহাস! স্রষ্টার সঙ্গে তাঁর সৃষ্টিও গেল। ১৯১৭ সালের ২৯ অক্টোবর মারা গেলেন হীরালাল। সে বছরই মতিলালের রায় বাগান স্ট্রিটের বাড়িতে আগুন লাগে। সেখানে ছিল হীরালালের তোলা সব ছবির স্টক। সমস্ত ভস্মীভূত হয়ে যায়।
 
ইংরেজি ২৯শে অক্টোবর ১৯১৭ সাল, বাংলা ৮ই কার্ত্তিক ১৩২৪ বঙ্গাব্দ। আজ থেকে প্রায় ১০২ বছর আগে মৃত্যু ঘটে হীরালালের। মৃত্যুকালে তাঁর ছোটোবেলার বন্ধু কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত উপস্থিত ছিলেন। মৃত্যু ঘটে ১৮ নং, ব্ল্যাকি স্কোয়ারের বাড়িতে এবং এখানেই শ্রাদ্ধাদি সম্পন্ন হয়েছিল। স্টার থিয়েটার ছাড়িয়ে হেদুয়ার দিকে যেতে ডানহাতে পড়ে নেতাজী নামাঙ্কিত একটি বিখ্যাত তেলেভাজার দোকান। পাশ গলি দিয়ে এগোলে পড়বে হরি ঘোষ স্ট্রিট। সেখানে ননীলাল ঘোষের মিষ্টির দোকানের পাশের গলি দিয়ে গেলে যে পার্কটি আছে সেটিই সাবেক ব্ল্যাকি স্কোয়ার (অধুনা সাধক রামপ্রসাদ উদ্যান)।

মৃত্যু হয়েছিল ক্যান্সারে। কিন্তু সে তো চিকিৎসাবিদ্যার পরিভাষা। ডেথ সার্টিফিকেটে যা ছিল না সেটা জানা দরকার বইকি। মৃত্যুর চার বছর আগে (১৯১৩) পরিবারের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়। হরিতকী বাগান লেনের বাড়ি ছেড়ে দু-ভাই গেলেন দু-জায়গায় । দু-ভাইয়ের ঝগড়া যে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কত বড়ো সর্বনাশ করেছিল তা হীরালাল-পড়ুয়া ও গবেষক মাত্রই ওয়াকিবহাল আছেন। হীরালাল উঠে আসেন ১৮ নং ব্ল্যাকি স্কোয়ারের এই বাড়িতে। ভাই মতিলাল উঠে যান রায়বাগানের ভাড়াবাড়িতে, যার নীচ তলার গুদাম ঘরে থাকত রয়াল বায়োস্কোপ কম্পানি( হীরালাল সেন প্রতিষ্ঠিত ভারতের প্রথম সিনেমা কম্পানি) ও প্যাথে কম্পানির চলচ্চিত্র সরঞ্জাম অর্থাৎ ওই গুদামেই ছিল হীরালালের সারা জীবনের যাবতীয় ফিল্ম ও ফোটোগ্রাফ, বলা ভালো, বাংলা-তথা ভারতীয় চলচ্চিত্র ইতিহাসের প্রামাণ্য নথি বা দলিলসমূহ (প্রিন্ট রিল স্টিল নেগেটিভ ইত্যাদি)। পুরোটাই সহজদাহ্য পদার্থে ভরা ঘর। ১৯১৭ সালের ২৪ অক্টোবর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার সময় হীরালালের প্রাণাধিক প্রিয় ভাইঝি অমিয়বালাকে (মতিলালের বড়ো মেয়ে) চারদিক থেকে আগুন ঘিরে ধরে, অগ্নিদগ্ধ হয়ে নবমীর রাতে চলে যান তাঁর ভাইঝি। নীচের গুদামে তখনও জ্বলছে হীরালালের সারাজীবনের কাজ অথবা বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস। এর ঠিক চারদিন বাদে চলে যান ভারতীয় তথা বঙ্গীয় চলচ্চিত্রের প্রথম পুরুষ হীরালাল সেন।

ভাগাভাগির পরে দাদার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখেননি মতিলাল। মৃত্যুর সময়েও যাননি। কিন্তু ভাগ্যের খেলা... যখন আগুন লাগে, তখন মতিলালের বড় মেয়ে অমিয়বালা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আগুনের গ্রাস থেকে তিনি বেরোতে পারেননি। এর পরে মতিলালও ভেঙে পড়েন। ব্যবসার সব দায়িত্ব তুলে দেন ছেলেদের হাতে। স্বামীর মৃত্যুর পরে হেমাঙ্গিনী চলে যান শ্বশুর চন্দ্রমোহনের কাছে ডালিমতলা লেনে। তখনও বেঁচে হীরালালের বাবা-মা।

চলচ্চিত্রে বম্বে ইন্ডাস্ট্রির দাপট চিরকালই। যে কারণে দাদাসাহেব ফালকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনক হওয়ার স্বীকৃতি লাভ করেছেন। ভারতীয় সিনেমার আদিপুরুষ হিসেবে হীরালাল সেনের অবিস্মরণীয় অবদানের কথা এখানেই কেউ সে ভাবে মনে রাখেনি! বাংলাদেশ বা এখানে কিছু গবেষণা অবশ্য হয়েছে। পরিচালক অরুণ রায় তাঁকে নিয়ে ছবি তৈরি করেছেন। অনেক আলোচনার পরে হীরালালের মৃত্যুর শতবর্ষে তাঁর নামে পুরস্কার চালু করা হয় ইন্ডাস্ট্রিতে। কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর নামে মঞ্চ হয়। প্রয়োজনের তুলনায় হয়তো সামান্যই। কিন্তু যেটুকু হয়েছে তাই বা কম কী!

আলোচনাসভায় হীরালালের অবদান নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলেছে। অনেকের মতে, যেহেতু তিনি থিয়েটারের দৃশ্য ক্যাপচার করেছিলেন, তাই তাঁকে প্রথম সিনেমার জনকের স্বীকৃতি দেওয়া যায় না। কিন্তু তিনি যে সময়ে দাঁড়িয়ে কাজটি করেছিলেন, তা অস্বীকার করা যাবে কী করে? শুধু ছবি তোলা নয়, এডিটিং, লাইটিং সব কিছুতেই তিনি পথ প্রদর্শক। হীরালালের যখন শেষ অবস্থা, তখন শুরু করেছেন দাদাসাহেব ফালকে। তাঁর প্রথম ছবি ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’ মুক্তি পায় ১৯১৩-এর ৩ মে। তার প্রায় দশ বছর আগে হীরালালের ‘আলিবাবা...’

বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আদুর গোপালকৃষ্ণণ এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন, ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথিকৃতের স্বীকৃতি যদি কাউকে দিতে হয় তো তিনি হীরালাল সেন। প্রথম সিনেমা তিনিই করেছেন। আরও অনেকে সমর্থন করেছেন তাঁকে।

স্বীকৃতি পেলেন হীরালাল। কিন্তু মাঝে যে কেটে গিয়েছে প্রায় একশো বছরের বেশি!


 

(তথ্যসূত্র:
১- ঘরের কথা ও যুগ সাহিত্য, ড. দীনেশচন্দ্র সেন, জিজ্ঞাসা (জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৯)।
২- বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের ইতিহাস, কালীশ মুখোপাধ্যায়, পত্র ভারতী।
৩- সোনার দাগ, গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ, যোগমায়া প্রকাশনী (২০১০)।
৪- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ই জুন ২০১৯ সাল।
৫- ২৩শে অক্টোবর ২০১৭ সালে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় শ্রী আলেকজান্ডার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিত প্রবন্ধ। মূল লেখার লিংক:
https://www.bongodorshon.com/home/story_detail/hiralal-sen-the-pioneer-of-bengali-cinema
৬- প্রথম বাঙালি চলচ্চিত্রকার: হীরালাল সেন ও অন্যান্য, অনুপম হায়াৎ, বঙ্গজ প্রকাশন (২০১৪)।
৭- ব্রাত্যজনের বায়োস্কোপ: ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের অনালোচিত মানুষ হীরালাল সেন এর জীবনবৃত্তান্ত, জয়ন্ত কুমার ঘোষ, দে’জ পাবলিশিং (২০০৮)।)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ