‘আহমেদিয়া’- এক অসম্ভব নির্যাতিত গোষ্ঠির করুণ উপাখ্যান।। আজিজুল শাহজি...!


প্রথম পর্ব

পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ সবচেয়ে বেশি হয়েছে দুই ভাবে; এক গায়ের রং ইত্যাদির কারণে অথবা ধর্মের ভিত্তিতে। যতদুর জেনেছি তাতে ধর্মের কারণে মানুষের অধিকার লুন্ঠন বা অত্যাচারের সংখ্যা অনেক বেশি। আগে উইঘুর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের ইয়েজেদিদের নিয়ে লিখেছিলাম, আজ লিখতে যাচ্ছি আহমেদিয়াদের উপরে। আহমেদিয়ারা পৃথিবীর অনেক অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকলেও এই লেখাটি মূলতঃ এদের মূল ভুখন্ড পাকিস্থানের উপরে। সম্পর্কিত পাকিস্তানি কাগজ এবং একটি পুরোনো বই, লিওনার্ড বাইন্ডার এর রিলিজিওন এন্ড পলিটিক্স ইন পাকিস্তান (১৯৬১)কে ভিত্তি করে লেখা, কিছু সম্পর্কিত তথ্য নিয়েছি অন্তর্জালের অন্য সূত্র থেকে যা নিচেও দিয়েছি। তথ্য পারস্পরিক অন্য সূত্র ধরে মিলিয়ে নেওয়া। সংযোজন করার কাজ পাঠক করলে কৃতজ্ঞ চিত্তে করবো তবে যেমন বলেছি, তথ্যসূত্র দেবেন, মিলিয়ে তবেই করবো।
একদম হালের ইমরান খানের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এবং একজন অতীব মেধাবী আতিফ মিয়া কে অপসারণ করা হয়। সুযোগ্য মানুষ ছিলেন পাকিস্তানের বেহাল অর্থনীতির উন্নতি করতে। কেন সরিয়ে দেওয়া হলো? কারন, লোকটি আহমেদিয়া গোষ্ঠীর একজন মানুষ। 

সম্পর্কিত তথ্যসূত্র, একদম পাকিস্থানের নিজস্ব পত্রিকার, এই যে: https://www.dawn.com/news/1431495

প্রসঙ্গত বলে রাখি,পাকিস্তানের মূলনিবাসী এবং পরবর্তীতে পুরোপুরি প্রবাসী, পাকিস্থানের একমাত্র নোবেল জয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আব্দুস সালাম একই ভাবে লাঞ্চিত এবং নির্যাতিত হয়েছিলেন। তাঁর কবর পর্যন্ত অটুট থাকেনি কারন তিনি ছিলেন আহমেদিয়া। পুরো পাকিস্তানে এই গোষ্ঠীর মানুষের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। আমরা যাঁরা এই ভারতের অসহিষ্ণুতা নিয়ে বড় ব্যথিত তাদের জন্য বলে রাখি, সকল অমুসলিম সম্প্রদায়ের মতো এই মানুষগুলো ও অত্যন্ত ব্রাত্য যাদের ধর্ম পালন তো দূরের কথা চাকরি বা অন্য যাবতীয় নাগরিক সুবিধা প্রায় পায়না। প্রায় বললাম কারন এরা নিজেদের এই পরিচয় দেয়না সামাজিক কোনো জায়গায়।

আহমেদিয়া কারা? 
এই ভাবধারা মূলত ইসলামের একটি শাখা (যদিও অনেকেই ওটা মনে করে না) হিসেবে উঠে আসে ১৮৮৯ এ পাঞ্জাব মানে ভারতীয় ভাগের পাঞ্জাবের কাদিয়ানএ।মির্জা গুলাম আহমেদ এর শুরু করে প্রথম এক দশক এই গোষ্ঠীর কোনো নামকরন ছিলনা, পরবর্তীতে ৪নভেম্বর ১৯০০’তে মির্জা একটি সনদ প্রকাশ করে এই নামকরনের কথা ঘোষনা করে। নিজেকে ধর্ম সংস্কারক বলে দাবি করে এই ব্যক্তিটি মুলত যা করেছিল তাহলো নিজেকে পরবর্তী প্রচারক এবং ইমাম মেহেদীর রূপ বলেছিল। অন্য ধর্মের অবতারবাদ স্বীকৃত হলেও ইসলামের ক্ষেত্রে ওটা মেনে নেওয়া হয়না কারন নবী মোহাম্মদের পর আর কোনো নবী আসবেনা এই নির্দেশের বাইরে যাওয়া মানে ইসলামের সুন্নি মতবাদের সাথে সংঘাত। মনে রাখবেন, ইসলামের ক্ষেত্রে কোরান বা নবীর দেখানো পথ বা সুন্নাহ কে একটি শব্দেও পরিবর্তন বা অস্বীকার করার উপায় নেই। আর এই অনড় মনোভাবের ভাবধারার কারণেই শিয়া ইত্যাদি গোষ্ঠীর সাথে এই সংঘর্ষ। এই লোকটি মানে মির্জা গুলাম আহমেদের সমসাময়িক ভক্তবৃন্দ তাকে এই রূপেই মেনে নিয়েছিল এবং তাদেরকে ওই জেলার নামে কাদিয়ান এর অন্তর্গত কাদিয়ানী বা আহমেদিয়া বলে পরিচয় দেওয়া হয়। আহমেদিয়ারা কিন্তু মূল গোষ্ঠী মানে সুন্নি অন্তর্ভুক্তই ছিল। তাঁরাও ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ মানে ঈমান, নামায, রোজা, হজ্জ্ব, যাকাত কে ধরেই চলে। যাইহোক, তাতে অসুবিধে হয়নি, ঝামেলা হয়েছে তাদের এই মনোভাব যে নবীর পরের কোনো নবী আসার ধারণা বা বিশ্বাসের কারণে। বিরোধ আরো যা নিয়ে তা হলো এই আহমেদিয়ারা যীশুর পুনরুত্থান এবং সেই সময়ে তাঁর ভারতে আগমন এবং এই উপমহাদেশেই প্রয়াণ ইত্যাদি প্রচার করে যা মূলধারার ইসলাম মান্যতা দেয়না। এছাড়াও এই উপমহাদেশের হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্মের নানান অবতারের স্বীকৃতি বা তাঁদের পুনরায় আবির্ভাবের যে বিশ্বাস সেই সব ধর্মের মানুষদের আছে তার স্বীকৃতি দিয়ে। এক অর্থে এই সকল অবতারের রূপ মির্জা নিজেই এই ধরনের ঘোষণা থেকেই এই বিবাদের শুরু, যদিও তাতে বিতর্ক আছে।

মির্জা গুলাম আহমেদের মৃত্যুর পরে এই আহমেদিয়া গোষ্ঠী দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি আহমেদিয়া মুসলিম কমিটি আর অপরটি লাহোর আহমেদিয়া আন্দোলন বা মুভমেন্ট এই নামে। পরেরটি মানে লাহোর গোষ্ঠী আবার প্রচলিত পথে নবী মোহাম্মদের শেষ নবী হওয়ার ধারণাকে স্বীকার করে। একই সাথে এই আন্দোলন ধর্মীয় সংস্কারের একটি কারন বলে প্রচার করে। অন্যদিকে আহমেদিয়া মুসলিম গোষ্ঠী এখনো মির্জা’কে এই ওহী প্রাপ্ত পরবর্তী মানুষ বলে ধরে চলে।

আহমেদিয়াদের উদ্ভবের সূত্র: 
আহমেদিয়া এই ধারা যে ইমাম মেহেদির কথা বলছে তার উল্লেখ কিন্তু ইসলামে আছে। বলা হয় বিধর্মী বা কাফেরদের পরাজিত আর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জয় আনার জন্য ইমাম মেহেদি নেতৃত্ব দেবে। একই সাথে কোরানে উল্লিখিত নবী এবং রসূল বলতে পুরোপুরি নির্দেশ করেছে মোহাম্মদ কে। সেক্ষেত্রে কোরান বিশেষজ্ঞ অধিকাংশ উলেমা এটি সেই সর্বশেষ নবীর নির্দেশ বলেই মনে করে। আবার একই সাথে উপলব্ধি বা ওহীর বিষয়ে কোনো নির্দেশ কোরান দেয়না ফলে এটি যে কারোর ক্ষেত্রে হবেই না তার কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব হয় না। এই জায়গাটি ধরেই সুফী সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি অন্য ভাবধারা শুরু হয়। মোঘল আমলে ইসলামের বেশ অনেক আধ্যাত্বিক মানুষের সম্বন্ধে জানা যায় যাঁরা নবীর মাধ্যমে অলৌকিক ভাবে ওহী বা ঈশ্বরের নির্দেশ পাওয়ার শক্তি রাখে বলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আজকের ইসলামের প্রচুর ধর্মগুরুর অবস্থান এই একই ভাবেই কিন্তু!

১৮৫৭ সিপাই বিদ্রোহের পরবর্তী পর্যায়ে হতাশ এবং বিভ্রান্ত মুসলমান সম্প্রদায় বুঝে ফেলে যে মোঘল সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে না। এই অবস্থায় রক্ষণশীল মতামতের সাথে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য সংস্কার বা নতুন কে মেনে নিতে বেশ কিছু মানুষ কাজ করেন। হিন্দুদের মধ্যে দয়ানন্দ সরস্বতী বা ব্রাহ্ম সমাজ  যেমন ছিলেন তেমন পুরো ধর্মীয় আঙ্গিকে না হলেও ইংরেজি শিক্ষা বা পাশ্চাত্ব ভাবধারাকে মুসলমান সমাজে গ্রহণ করার জন্য স্যার সাঈদ আহমেদ খান কাজ করেন। এই পরিবর্তনের নতুন বাতাবরণের মধ্যেই মির্জা গুলাম আহমেদ তাঁর এই ভাবধারা নিয়ে অন্য আঙ্গিক তৈরী করলেন।

মির্জা গুলাম আহমেদ আর তাঁর শিষ্যরা ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে এই ভাবধারা নিয়ে কাজ শুরু করে এক পর্যায়ে একটি ধর্মীয় রূপে উঠে আসে।নিজেকে ধর্ম সংস্কারক এবং পরবর্তীতে মেহেদির এক রূপ বলে দাবি করা এই লোকটি ১৮৮৯-এ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে তৈরী করে তৎকালীন সংযুক্ত পাঞ্জাবে (ইউনাইটেড প্রভিন্স) আহমেদিয়া মুসলিম জামাত। সেই সময়ের পাঞ্জাব এবং সিন্ধুতে ভালো রকম সাড়া জাগিয়ে তোলেন এবং তাঁর প্রচুর ভক্ত বা এই মতাদর্শী এই পথে আসে। গুলাম মির্জার বিশেষত্ব ছিল লোকটি এই উপমহাদেশের হিন্দু বৌদ্ধ ইত্যাদি ধর্মের সকল অবতারকে ইসলামের সেই নবী পাঠানোর বার্তার হিসেবে এদের ও একই ভাবে গণ্য করেছিল ফলে আরো বেশি আপত্তি উঠেছিল ওয়াহাবি বা মূল ধারার ইসলামের অনুসারী উলেমাদের কাছ থেকে। অন্যদিকে এই অঞ্চলের মানুষগুলোর কাছে তাঁর প্রচার করা ইসলাম অনেক বেশি আকর্ষণীয় আর কাছের মনে হয়েছিল। একপর্যায়ে যেমন বলেছি এই কাদিয়ানী মানে আহমেদিয়ারা বিভক্ত হয়ে যায় দুটি গোষ্ঠীতে। লাহোর আর কাদিয়ান গোষ্ঠীর মধ্যে এই লাহোরী গোষ্ঠীর ইতিমধ্যেই পশ্চিম আফ্রিকায় পাঁচ লক্ষ এই গোষ্ঠীর মানুষ যুক্ত আছে যাঁর প্রধান মির্জা তাহির আহমেদ। এছাড়া লন্ডনে সদর অফিস আর ১৭টি দেশে ২০০ টি শাখা নিয়ে এরা অবস্থান করছে। 

ভারতে নানান জায়গায় এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও আছে এদের বিভিন্ন মসজিদ। ইন্টারনেট ধরে খুঁজলে নিজেরাই পেয়ে যাবেন, আমার উদ্দেশ্য এদের অবস্থান ধরে দেখানো না তাই অঞ্চল ভিত্তিক কোনো তথ্য দিচ্ছি না বিধিবদ্ধ কারণেই। একই ভাবে বাংলাদেশেও এদের অবস্থান নিয়ে কোনো আলাদা কিছু বলছি না।এমনিতেই এই গোষ্ঠী অতীব নির্যাতিত তাই এদের আরো তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। তবে একটা বেশ দৃষ্টি আকর্ষনীয় তথ্য দিচ্ছি, মূল ধারা মানে আহমেদিয়া মুসলিম কমিউনিটি কিন্তু আজ অনেক বড় তার অন্য শাখা লাহোরি গোষ্ঠির থেকে।সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠী এখনো পাকিস্তানেই বসবাস করলেও প্রসার হচ্ছে আফ্রিকার দেশগুলোতে যেমন ঘানা বা সিয়ারালিওন ইত্যাদিতে। এদের ধর্মান্তরের মানে মূল ধারার ইসলামের অনুসারী থেকে এইদিকে আসার গতি ও বেশ আগ্রহের কারন। নির্দিষ্ট কারণে ওটা নিয়ে বিস্তারিত বলছি না তবে সংঘর্ষের একটি কারণ যে এই বিষয় তা মনে হচ্ছে। সম্পর্কিত একটি ছবি দিলাম, এদের অবস্থানের বৈশ্বিক একটি মানচিত্রের ছবি দিলাম, তাতে বিষয়টা অনেকটাই হয়তো পরিস্কার হবে।

এই আহমেদিয়া নাম কিন্তু ওই ১৮৮৯ এ আসেনি। এটি আরো এক দশক পরে অর্থাৎ ১৯০০ সালে আসে। প্রতিষ্ঠাতা গুলাম আহমেদের মতে এটি মোটেই তাঁর নামের অনুসরণে না, এটি নবী মোহাম্মদের আরো একটি নাম আহমেদের অনুসরণে। আর আহমেদ হলো ‘অধিক প্রশংসিত’, আল্লাহর বান্দার মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি প্রশংসার যোগ্য এবং আল্লাহর সর্বাধিক প্রশংসাকারী। এই পরের নামের ভিত্তিতেই এই নামকরন।

শুরুর দুর্বিসহ দিনের আর বিশ্বে এদের উপর নির্যাতনের একটি সামগ্রিক ছবি: 
আহমেদিয়াদের এই নবী মহম্মদের পরের নবী ধারণার কারণে এদের বিরোধীদের কর্মতৎপরতা একইভাবে চলেছে এদের উৎপত্তির পরের থেকেই। শুরুর সংঘর্ষ অতীব সামান্য ছিল, হংকং-এ একজন আহমেদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষের মুসলিম সাধারণ সুন্নি সম্প্রদায়ের কবর স্থানে কবর দেওয়াকে কেন্দ্র করে হলেও এর কোনো প্রভাব উপমহাদেশে দেখা যায়নি। ইতিহাসের নিরিখে বিংশ শতকের তিনের দশকের থেকে স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত খুব একটা সম্প্রদায় ভিত্তিক এই অশান্তি দেখা যায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত এদের ব্রিটিশ সরকারের পক্ষেই অবস্থান দেখা যায়।উল্টো মূল ধারার ইসলামী গোষ্ঠির থেকে এরা পাকিস্থান করার জন্য অনেক বেশি এক হয়ে কাজ করেছিল। স্বাভাবিক ভাবেই দেশ বিভাগের পরেই এদের প্রায় অধিকাংশ চলে যায় পাকিস্তানে। আজকের বাংলাদেশ এবং পাকিস্থানে এদের একটি অংশ থাকলেও বেশিরভাগ আছে পাকিস্থানে। অবিভক্ত এই ভারতের সেই সময়ের সীমান্তে মানে আফ্গানিস্থানেও এদের উপস্থিতির ইতিহাস জানা যায় তবে তা অতীব সামান্য।

বিশ্বে যেখানেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ আছে ওখানেই একটা সংঘাত হয়েছে এদের উপস্থিতির কারণে তবে সরকারী মদত দু একটি দেশ না দেওয়ায় পাকিস্থান ছাড়া বাকি দেশে সেভাবে এরা সামগ্রিক নির্যাতিত হয়নি। সঙ্গত কারণে বিশ্বের বাকি জায়গার উপর ছুঁয়ে গিয়ে মূল ভুখন্ড পাকিস্থানে এদের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করবো। প্রথম পর্বে তাত্ত্বিক পরিচয় আর বিশ্বের অবস্থান নিয়ে আর পরেরটি একদম এই পাকিস্থানে এদের অবর্ণনীয় অবস্থার উপরে থাকবে।

সরকারিভাবে বিংশ শতকের বিশের দশকে আফগানিস্থানে দুজন আহমেদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষের উপর মৃত্যুদন্ড আর পরবর্তীতে মানে হালের তালিবানি কাজের ফলে ঐদিকে এদের দেখাই দুস্কর তাই ঠিক কত মানুষ অত্যাচারিত তার সঠিক ছবি দেওয়া কঠিন।

ভারতের ক্ষেত্রে বিষয়টি অন্যরকম, মূলতঃ সরকারী কোনো নিষেধাজ্ঞা তো নেই উল্টো কেরালা এবং তামিলনাডু কোর্টে এদের ইসলাম অনুসারী বলে রায় দেওয়ায় তাদের আইনি কবচ অনেকটাই সুরক্ষিত।যদিও মূলধারার ইসলামী দলগুলো বেশ কয়েকবার বিচ্ছিন্ন ভাবে আক্রমন করে তামিলনাডু এবং পাঞ্জাবে কয়েকজনকে হত্যা করেছে। আঞ্চলিক দাঙ্গাও হয়েছে হায়দ্রাবাদ এবং পাঞ্জাবে তবে তার সামগ্রিক ফলাফল সেভাবে সমাজকে বা তাঁদের ক্ষতিগ্রস্থ করেনি। 
বাংলাদেশে একদম হালের সময়ে আইসিস এর শাখা হিসেবে উঠে আসা সন্ত্রাসবাদী দলের হামলা হলেও সার্বিক কোনো অত্যাচারের খবর পাওয়া যায় না।

ইন্দোনেশিয়াতে সামাজিক ভাবে এদের বিচ্ছিন্ন করা নিয়ে দ্বিধাভক্ত মানুষ এখনো সেভাবে এদের উপর অত্যাচার শুরু না করলেও এদের অনেকটাই ব্রাত্য করে রাখা হয়েছে। একই অবস্থা মালেশিয়াতে তবে সরকারী ভাবে অত্যাচারের প্রকোপ নেই। সৌদি আরব সরকারী ভাবে আহমেদিয়াদের নিষিদ্ধ করেছে এবং হজ্বের অনুমতি দেয়না তবে ওটা নির্ধারন করার ক্ষেত্রে কোনো উপায় নেই যতক্ষণ নির্দিষ্ট দেশের যেমন পাকিস্থানের মতো অমুসলিম ঘোষণা না করছে। 

ইউরোপে প্রবাসী আহমেদিয়াদের উপর যে কটি আক্রমন হয়েছে তার কারন অবশ্য উগ্রপন্থায় বিশ্বাসী মূল ধারার মুসলিম ব্যক্তিরা তবে কোনো রাষ্ট্রীয় শক্তির হস্তক্ষেপ না হওয়ায় মোটের উপর ওই জায়গাগুলোতে এরা অনেকটাই সুরক্ষিত। একটি সম্পর্কিত উইকি সূত্র দিলাম, তাতে এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে পারবেন https://en.wikipedia.org/wiki/Persecution_of_Ahmadis

পাকিস্থানে অবস্থিত এই মূল জনগোষ্ঠিকে ইতিহাসের নিরিখে দেখলে নিজেই বুঝবেন ১৯০০ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত এদের উপর এই ধরনের অত্যাচার কিন্তু হয়নি।ওটা শুরু পাকিস্থান তৈরির পরের সময় থেকেই। কালের কি পরিহাস, এই গোষ্ঠী সার্বিক ভাবে পাকিস্তান গঠনের আন্দোলনে সামিল হয়েছিল অথচ পাকিস্তান হওয়ার পরেই এদের ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে।

প্রথম পর্বের তথ্যসূত্র:
১. আহমেদিয়া সম্প্রদায়ের নিজস্ব বাংলা ওয়েব সাইটের একটি https://www.ahmadiyyabangla.org/
২. নিজস্ব সাইট আহমেদিয়াদের https://www.alislam.org
৩. যে বইটি মূল বিষয়ের উপর জানতে সাহায্য করেছে ওটা পড়তে হলে ডাউনলোড করুন এই সূত্র ধরে : https://ia800504.us.archive.org/16/items/religionpolitics00bind/religionpolitics00bind.pdf
৪. দেশভিত্তিক এদের অবস্থান সমন্ধে জানতে দেখুন https://en.wikipedia.org/wiki/Ahmadiyya_by_country
৫. সার্বিক জানতে দেখতে পারেন https://www.dw.com/en/who-are-the-ahmadiyya-muslim-jamaat/a-49500230
৬. ইউটিউব এর একটি প্রতিবেদন দেখতে পারেন https://www.youtube.com/watch?v=8rujDytbEbQ

দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব

পাকিস্থানভিত্তিক এই গোষ্ঠিকে ইতিহাসের নিরিখে দেখলে নিজেই বুঝবেন ১৯০০ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত এদের উপর এই ধরনের অত্যাচার কিন্তু হয়নি। ওটা শুরু পাকিস্থান তৈরির পরের সময় থেকেই। কালের কি পরিহাস,এই গোষ্ঠী সার্বিক ভাবে পাকিস্তান গঠনের আন্দোলনে সামিল হয়েছিল অথচ পাকিস্তান হওয়ার পরেই এদের ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে।

দেশভাগের পরে রাবেয়া বলে একটি জায়গায় নতুন করে সংস্থার দফতর খুলে আহমেদিয়ারা নিজেদের কাজ শুরু করে। এরপরের থেকেই এদের বিরোধ হয় মূলধারার গোড়া আহরার সম্প্রদায়ের সাথে। মজার কথা হলো আহরার আবার তৎকালীন সরকারের কাছে মোটেই প্রিয় ছিলনা কারন ওরা পাকিস্তান গঠনের বিরোধী ছিল আর জিন্নাহ’কে তাঁর ইসলাম বিরোধী কর্ম কাণ্ডের জন্য 'কাফের এ আজম’ বলে ডাকতো। এই আহরার গোষ্ঠী ধীরে ধীরে এই আহমেদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করে। এদের কাছে এই মতবাদের প্রচারক মির্জা গুলাম আহমেদ আর তৎকালীন বিদেশ মন্ত্রী জাফরুল্লাহ ছিল প্রধান শত্রু। এর মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই জীবিত জাফরুল্লাহ ছিল মূল লক্ষ্য। তাঁরা নানান সমাবেশ এবং জলসা আয়োজন করে এই আহমেদিয়াদের প্রকাশ্যে অমুসলিম ঘোষণা করে। এই কাজ আরো জোরে শুরু হয় যখন জিন্নাহর মৃত্যুর পরে আহমেদিয়ারা মূলধারার সুন্নি ইমামের পরিচালিত জানাজাতে সামিল হলোনা। একইভাবে ওই সময়ে এক সামরিক বাহিনীর তরুণ অফিসার আহমেদিয়া বলে নৃশংস ভাবে খুন হয়ে গেল। সবমিলিয়ে এক হিংসার বাতাবরণ তৈরী হয়ে উঠলো। এই সময়ে পুলিশ প্রশাসন নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকায় আরো ছড়িয়ে পড়তে লাগলো হিংসা। ক্রমশ আহমেদিয়াদের প্রতিষ্ঠিত নানান স্কুল কলেজ বা নিজস্ব পাঠাগার বা বই হয়ে উঠলো আক্রমনের লক্ষ্য। এইসময়ে মানে ১৯৫২’তে আলোচ্য জাফরুল্লাহ আহমেদিয়া সম্প্রদায়ের একটি সমাবেশে যোগ দেন করাচির জাহাঙ্গীর পার্কে। সরকারের তরফে জাফরুল্লাহকে এতে যোগ না দিতে বলা হয়েছিল তবে তিনি তা মান্য করেননি। তাঁর এই সমাবেশে বলার সময়েই আহরার, জামাত-ই-ইসলামী, জামায়াত-এ-উলেমা-এ-পাকিস্তান এবং আহলে-হাদিস একসাথে আহমেদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করার দাবি করে।একই সাথে সরকারি সকল পদের থেকে আহমেদিয়াদের অপসারণের দাবি ও জোরালো হয়ে ওঠে।

সর্বপ্রথম দাঙ্গার সূচনা:

জাফরুল্লাহ’কে অপসারণ দিয়ে আন্দোলন শুরু হলেও একপর্যায়ে তৈরী হয় এই তীব্র বিরোধিতা করা দলগুলির একটি সম্মিলিত মঞ্চ মজলিশ-ই-আমল।তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন এদের সাথে বৈঠকে বসলে এরা তিনটি দাবি করে। প্রথম দুটি হলো জাফরুল্লাহ’কে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া, সকল আহমেদিয়াকে উল্লেখযোগ্য সরকারি পদ থেকে অপসারন আর তৃতীয়টি হলো আহমেদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করা। প্রথম দুটি মেনে নিলেও তিন নম্বর না মানার কারণে শুরু হয় এই দাঙ্গা। এর কারণে এক সার্বিক অচলাবস্থার তৈরী হয়। বিপর্যয় এড়াতে পাঞ্জাবে মার্শাল ল মানে সামরিক আইন বলবৎ করে এবং এক অর্থে ডান্ডা দিয়ে ঠান্ডা করে এই লোকগুলোকে। এই দাঙ্গার মূল লোকটি হলো সেই জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মৌলানা মৌদুদী। সেই সময়ের হিসেবে আনুমানিক ৩০০ লোক প্রাণ হারায় আর অজস্র মানুষ আহত হয়। এই সামরিক আইন বলবৎ ছিল ৭০দিনের জন্য। এই দাঙ্গার জন্য দায়ী করে সেই সময়ের সামরিক আইনের কর্তারা ১৯৫৩ সালের মে মাসের ৭তারিখে মৃত্যুদন্ড দেয় মৌলানা আব্দুস সাত্তার নিয়াজি এবং ১১ তারিখে মৌলানা মৌদুদী’কে। না, এই দন্ড বাস্তবায়িত হয়নি। সত্যি বলতে সেই সময়ের বিষবৃক্ষ তার ফল ধরাতে শুরু করেছিল। ধর্মের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ আর একই সাথে সামরিক শাসনের সুতিকাগার ছিল এই কাজ। ১৯৫৮’তে পুরোপুরি ক্ষমতা দখল এই সময়ের থেকেই শুরু।প্রসঙ্গত বলা যায়, ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকারের নিয়োগ করা কমিশনের বিচারপতি মুনির যে রিপোর্ট দিয়েছিলেন তার নির্যাস হলো দেশের এই উলেমা বা তাদের ফতোয়া ধরে চললে পুরো দেশের নাগরিকদের অমুসলিম বলে গণ্য করতে হয়। একটি বাক্যই সব বলে দেয় না কি? 

ষাটের দশকে আয়ুবের সময়েই কিঞ্চিৎ আস্কারা পেয়ে শক্তি সঞ্চয় করে এই গোষ্ঠীগুলো। তারা সফল হয় একটি সাংবিধানিক সংশোধনী জুড়ে দিতে যাতে কোনো আইন আর করার জায়গা দেওয়া হবেনা যা কোরানের নির্দেশের পরিপন্থী বা নবীর শিক্ষার বিপরীত বা অন্যকিছু বলে। সোজাসুজি বলা যায়, আয়ুব এদের ব্যবহার করে তবে নিয়ন্ত্রণের রশি নিজের হাতেই রেখে দিয়ে। ভুট্টোর বোতলের দৈত্যের বাইরে আনার কাজ বা এক সর্বাত্বক ঘৃণার আবাদ তৈরী দ্বিজাতি তত্ত্বের মুখে থাপ্পড় পড়ে পূর্বপাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম নাগরিকদের বাংলাদেশ গঠনের পরে। সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা খর্ব করে ধূর্ত ভুট্টো সত্যিকারের অর্থে বেসামরিক এক নাগরিক হিসেবে এই প্রথম পাকিস্থানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে। নিজেকে বাম এবং অন্যদিকে ডানপন্থী ধর্মীয় পক্ষের একমাত্র নেতা হিসেবে তুলে ধরতে একের পর এক মিথ্যাচার করে চলে এই লোকটি। বামপন্থীদের আত্মস্থ এবং ক্ষমতাহীন করে আরো উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠে। এশিয়ার মুসলমানদের নেতৃত্বদানের বাসনায় খেলে ধর্মীয় তাস। একটি তৈরী করা দাঙ্গার সুত্রে ১৯৭৪ সালে আহমেদিয়াদের সবচেয়ে বড় সর্বনাশ আনুষ্ঠানিকভাবে করতে পার্লামেন্টে পাস্ করে এদের অমুসলিম হয়ে যাওয়ার ফরমান। একইভাবে এদের হত্যা বা এদের ধর্মের স্থানে বা অন্য জায়গাতে আগুন দিয়ে বা অন্য কিছু করে মূলধারার ধর্মীয় নেতারাও নিজেদের জনপ্রিয়তা আবার জাগিয়ে তোলে।

হাস্যকর হলো এই লোকটির পাশে সেইসময়েও ছিল ওই দেশের বামপন্থী নেতা আর তাদের দলগুলো। এই অধ্যাদেশে বলা হয় আহেমদিয়ারা অমুসলিম এবং সংবিধানকে সংশোধন করে মহম্মদ কে শেষ নবী মান্য করে এমন লোকই মুসলিম এই বিধান জারি করে।ইতিহাস বিচার করলে দেখবেন, সেই সময়ে এমন বিশাল কোনো জনবিক্ষোভ হয়নি যার জেরে ওটা করতেই হবে ভাবা যায়। ক্রমশ পাকিস্তানের সামাজিক নানান কর্মক্ষেত্রে এমনকি সামরিক বিভাগেও এই উচ্চপদ বঞ্চিত হতে শুরু করে এই মানুষগুলো।আজকেও সামরিক বাহিনীতে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রবেশ নিষিদ্ধ না হলেও ওটা ওই পর্যন্ত, অর্থাৎ আহমেদিয়া কেউ থাকলেও তার পদোন্নতি বা কোনো সামরিক পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। সাধারন প্রবেশ এবং আনুষ্ঠানিক অবসর এই পর্যন্ত।


আশির দশকে পাকিস্থানকে পুরো মধ্যযুগীয় শরীয়তের আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে সামরিক প্রধান জিয়া উল হক লোকগুলোর অবস্থা আরো দুঃসহ করে দেয়।১৯৮৪ সালে আহমেদিয়াদের নিজেদের মুসলমান বলার উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। পরবর্তীতে ইসলাম বহির্ভুত কারবার বন্ধ করতে সকল আহমেদিয়াদের নিজেদের মুসলিম বলার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তারা সাধারণের মসজিদে নামাজ পড়ার অধিকার হারায়, এমনকি অন্য সাধারণ মসজিদের মতো এদের মসজিদে আজান দেওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। এমনকি তাদের এই উপাসনার জায়গাকে মসজিদ বলার ও অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। এছাড়া এদের কোনো সাধারণ সমাবেশে ইসলামী পদ্ধতিতে সম্ভাষণ, জনসমাবেশে কোরানের থেকে উদ্ধৃতি, প্রচার বা নিজেদের মতে ধর্মান্তর, কোনো সম্পর্কিত বই বা লেখা ছাপানো ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর কোনো একটির অমান্য করলেই তিন বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। এছাড়া সরকারি কোনো পরিচয়পত্র পাসপোর্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্র ইত্যাদিতে আহমেদিয়াদের অমুসলিম এবং এই মির্জা গোলাম আহমেদ'কে একজন প্রতারক বলে ঘোষণা করার কাজ বাধ্যতামূলক করা হয়। একইসাথে মূলধারার মুসলিম সম্প্রদায়ের ঘৃণার লক্ষ্য করে তোলার জন্য প্রত্যেকটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানে মাদ্রাসা ইত্যাদিতে এদের উপর অবমাননাকর কথা এবং ঘৃণার উস্কানিমূলক লেখা পাঠ করানোর কাজ শুরু করা হয়।
এই ঘৃণার আবাদের ফলাফল দেখা যায় ২০০৫ এর একটি সমীক্ষা থেকে। সমাজের নানান স্তরের এই সমীক্ষা থেকে জানা যায় স্রেফ অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত না, উচ্চশিক্ষিত মানুষদের কাছেও এই আহমেদিয়ারা সবথেকে ঘৃণিত একটি গোষ্ঠী হয়ে উঠেছে। স্কুল কলেজের শিক্ষকরা সহ ছাত্র/ছাত্রীদের অত্যাচার বা ঘৃণার প্রতিনিয়ত শিকার এই মানুষগুলো।খুন থেকে সামাজিক বয়কট চলছে সমাজের নানান স্তরে বিশেষত পাকিস্তানের পাঞ্জাবে এর প্রকোপ অতীব বেশি।

একদম প্রতিনিয়ত হত্যা আর ঘৃণার এক বাতাবরণের মধ্যে দশক ধরে কিছু ক্লেদাক্ত ঘটনা:

১৯৯৩ এ আহমেদিয়াদের তথাকথিত শারিয়া আইনের ভিত্তিতে খোদ সরকারি আদালত এদের একইভাবে সলমন রুশদির মতো একই শ্রেণীতে ফেলে।
এপ্রিল ১৯৯৫ সালে পেশোয়ারে দুজন আহমেদিয়াকে প্রকাশ্য রাস্তায় পাথর ছুঁড়ে মারার কাজ হয়, এতে একজন মারা যায় আর অন্যজন মারাত্বক আহত হয়।এতেই শেষ হয়নি, এদের টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় প্রকাশ্য রাস্তায়। পুলিশ দর্শক হয়ে দেখে সাধারণ মানুষের সাথে।
২০০০ সালে সন্ত্রাসবাদীরা গুলি করে মারে পাঁচজন উপাসনারত এই সম্প্রদায়ের মানুষকে আর আহত হয় অনেক মানুষ। এরপরেই ২০০৫ সালে মোটর সাইকেলে এসে গুলি করে আটজন একই সম্প্রদায়ের মানুষকে মেরে ফেলে আর ১৮ জনকে আহত করে এই উগ্রপন্থীদল। এরপরে এই বছরেই সব আহমেদিয়া সম্প্রদায়ের ছাত্রদের বহিস্কার করা হয় পাকিস্তানের পাঞ্জাবের ফয়সালাবাদ মেডিকেল কলেজ থেকে। এই কলেজের প্রধান ডক্টর আসগার আলী ১৫জন ছাত্রী আর আটজন ছাত্র কে নিজে হাতে বহিস্কার করে কলেজ থেকে এবং হোস্টেল থেকে। এই ঘৃণা এমন পর্যায়ে যায় যে ২০০৮ এ পাকিস্তানের এক জনপ্রিয় দূরদর্শন অনুষ্ঠান জিও টিভির 'আলিম অনলাইন'-এ এক সঞ্চালক আমির লিয়াকত হোসেন সরাসরি আহমেদিয়াদের কাফির বলে ঘোষণা করে। এতেই শেষ না, এই বিশ্বাসের পালন করা লোকেদের বধযোগ্য মানে ওয়াজিব-উল-কতল করার মতো ঘোষণাও করা হয়।অনুষ্ঠান সম্প্রচারের পরেই আহমেদিয়া সম্প্রদায়ের দুজন মুখ্য ব্যক্তিকে খুন করা হয়। ভাবুন কি দেশ এটি!
এই ঘৃণার এক নারকীয় ঘটনার উল্লেখ করা যায় ২৮শে মে, ২০১০ সালে, তেহরিক-এ-তালিবান গোষ্ঠীর সন্ত্রাবাদীরা লাহোরের দুটো আহমেদিয়া মসজিদে ঢুকে ৯৫ জনকে গুলি করে আর আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ করে মেরে ফেলে। একইসাথে একশোর উপর মানুষকে মারাত্মক আহত করে।

ভাবতেই পারেন, তথ্য অনুযায়ী তো হাজারে হাজারে নিধন নেই, আসলে নিধন হয় একটি গোষ্ঠির সার্বিক সর্বনাশের কাজের কারণে। এই অবস্থা আজকে কি সাংঘাতিক রূপ ধারণ করেছে তার একটা পরিচয় দিতে পাকিস্থানের সাম্প্রতিক আরো একটি তথ্য তুলে ধরছি। একটি রিপোর্ট বলছে হাজার দশেক আহমেদিয়া তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট নবায়নের সময় এই নতুন নিয়মে নিজেদের অমুসলিম বলার পরেই এদের মধ্যে হাজার ছয়েক দেশ ছেড়েছেন।পাঠক, প্রকৃত মৃত্যুভূমি কি বুঝলেন? কে সহি তার হিসাব করতেই চলে ঘৃণার আবাদ, এই উদাহরণ আমাদের জন্য শিক্ষনীয় হওয়ার একটি রূপ। মনে রাখবেন, ধর্মের ভিত্তিতে কোনো দেশের বুনিয়াদ হওয়া কাম্য না আর ধর্মের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ হওয়ার ফলাফল অতীব ভয়ঙ্কর। ইউরোপ এর থেকে শিক্ষা নিয়েছে, আমাদেরও নেওয়ার সময় এসেছে। এরজন্য কোনো মেকি নিরপেক্ষতার ভন্ডামি না, সাদা কে সাদা কালো কে কালো বলার মানসিকতা গড়ে তোলার প্রয়োজন। এরজন্য দরকার- একদম পাঠ্যপুস্তক থেকে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা কে ধর্মের প্রভাব থেকে দূরে রাখা।মানুষকে প্রশ্ন করার সুযোগ করে দেওয়া, তাহলেই নিরবে ঘটে যাবে অনেক বড় পরিবর্তন। আমি আশাবাদী ইন্টারনেট এর প্রভাব সর্বস্তরে ছড়িয়ে যাবে, নব প্রজন্ম নিয়ে আসবে নতুন এক ভোর। আমরা তাঁর পূর্বসুরী তাই এর ভিত্তি গড়ে দেওয়ার কাজ আমাদেরই। 

তথ্যসূত্র:
১. কি ভাবে ব্রাত্য করে রাখা হয়েছে এবং হয় এদের,জানুন এইখানে https://www.dawn.com/news/813291 
২. হালের সরকারী মদতে ঐতিহাসিক আহমেদিয়া উপাসনালয়ের বিনাশের খবর https://www.dawn.com/news/1409714
৩. মৃত্যুর থেকেও যন্ত্রনার জ্বালা আহমেদিয়া হওয়া,দেখুন এইখানে https://www.dawn.com/news/1017550/ahmadis-face-discrimination-even-in-death
৪. অত্যাচারের দিনলিপি https://www.dawn.com/news/669566/ahmadis-the-lightning-rod-that-attracts-the-most-hatred
৫. একদম হালফিলের দিনলিপি এই অত্যাচারিত সম্প্রদায়ের https://herald.dawn.com/news/1398500

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ