বাংলার রবিনহুড ডাকাতদের আখ্যান || রানা চক্রবর্তী

● ছবিতে- ডাকাতির শাস্তি। ১৮৮০ সালে বর্তমান ভারত-মায়ানমার সীমান্তে দুইজন ডাকাতকে ক্রুশবিদ্ধ করে শাস্তি প্রদান করার ছবি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দেবার জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসন এই ধরনের নৃশংস শাস্তির ব্যবস্থা করত। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যেত যে সরকার বা জমিদার দ্বারা অত্যাচারিত হয়েই সাধারণ মানুষ ডাকাতে পরিণত হত। স্থানীয় মানুষেরা তাঁদের সাহায্য করতেন বা সহযোগিতা করতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এদের বিচার হত নামমাত্র বা হতই না। ছবিটি তুলেছিলেন উইলোঘুবি ওয়ালেস হুপার।
ছবি সৌজন্যে- প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি আর্ট মিউজিয়াম, নিউ জার্সি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

● ডাকাতের আবার ভালো-মন্দ কি?! ডাকাত তো ডাকাতই হয়। কিন্তু স্বাধীনতার বহু আগে বাংলায় এমন কিছু মানুষের নাম পাওয়া যায়, যারা ডাকাতির মতন ভয়ঙ্কর পেশার সাথে জড়িত থাকলেও, সাধারণ মানুষের কাছে তাঁরা ছিলেন "ভালো ডাকাত"। অন্যভাবে বলতে গেলে, তাঁদের রবিনহুড বলে মনে করত সাধারণ মানুষেরা। আদতে রবিনহুড তো নিজেও ডাকাত ছিলেন। এরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে ধনী ব্যক্তি জমিদার, জোতদার, কোম্পানি থেকে লুন্ঠিত অর্থ বিলিয়ে দিতেন। ধরা পড়লে শাস্তি ছিল ভয়ানক। প্রাণদণ্ড তো নিশ্চিত। বাংলার রঘু ডাকাত, বিশ্বনাথ সর্দার, ভবানী পাঠক তো কিংবদন্তি। এরা ছাড়াও আরও অনেকে ছিলেন যাদের নাম আজও লেখা আছে ইতিহাসের পাতায়।

নৈহাটি থানার দারোগা রঘু ডাকাতের কাছ থেকে হঠাৎ চিঠি পেলেন। রঘু লিখেছে, সে নিজেই দারোগার কাছে আসবে। দারোগা তো হতভম্ব! সরকার তখন হন্যে হয়ে রঘুকে খুঁজছে, তাকে ধরার জন্য গুচ্ছ টাকার পুরস্কারও ঘোষণা করেছে। দারোগা থানার চার পাশে অনেক সেপাই মোতায়েন করলেন। এক দিন সেপাইরা দেখে, দূর থেকে এক লম্বা-চওড়া মানুষ থানার দিকে এগিয়ে আসছে। সে খানিক কাছে এলে দেখা গেল, নেহাতই এক নিরীহ জেলে। দু’খানা বিরাট মাছ তার মাথায়। বলল, সুখচরের জমিদার নাতির মুখেভাত উপলক্ষে মাছগুলো দারোগাকে উপহার পাঠিয়েছেন। দারোগা খুশ। লোকটাকে বকশিশও দিলেন। কিছু দিন পর ফের রঘু ডাকাতের চিঠি। লিখেছে, সে দারোগার সঙ্গে দেখা করে এসেছে। দারোগাবাবু মাছ কেমন খেলেন?

দারোগাকে এই যে চিমটি কাটা, এটা আসলে এক প্রতিবাদী রঘুকেই চিনিয়ে দেয়। রঘু সব সময় ছিল সাধারণ মানুষের পক্ষে, আর অত্যাচারী জমিদার বা প্রশাসনের বিপক্ষে। যে গুণটি রঘুকে সবচেয়ে বিখ্যাত করেছিল, তাকে ‘বাংলার রবিনহুড’ তকমা দিয়েছিল, তা হল তার দয়া। ব্রতপার্বণে সে গাঁয়ের মানুষকে দানধ্যান করত। নীলকরের অত্যাচারে ঘর পুড়ে যাওয়া মানুষদের টাকা দিয়ে সাহায্য করত। কোন ব্রাহ্মণের মেয়ের বিয়ে পণের টাকা জোগাড়ের অভাবে আটকে গেছে, বরযাত্রী ফিরে যাচ্ছে, রঘু তাদের মাঝপথ থেকে ফিরিয়ে এনেছে। মেয়ের বাবার হাতে পণের টাকা গুঁজে দিয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছে সে তখন ভগবান। তাই রঘু ডাকাতের চালচলনের হদিশ পেত না পুলিশ। লোকে তার ঠিকানা জানলেও, বলত না, ধরিয়ে দিত না।

বাংলার গ্রামে গ্রামে তখন কোম্পানি সেরা ধানের জমিগুলো বেছে নিয়ে দাগ দিচ্ছে। নীল চাষ হবে। প্রথমে ‘পাঁচকাঠিয়া’, পরে তা বেড়ে দাঁড়াল দশ কাঠায়। আর হুকুম-না-মানা চাষিদের ঘরে লাগল আগুন। পাইক দিয়ে তাদের কাছারিতে তুলে নিয়ে গিয়ে চলল বেদম মারধর। শোনা যায়, নীলকুঠির পাইকদের হাতে মার খেয়েই মারা যান রঘু ডাকাতের বাবা। তখনও সে ডাকাত হয়নি। তবে, লাঠিখেলায় অপ্রতিরোধ্য। বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে রঘুনাথ আচার্য হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। থানায় আগুন দিয়ে, নীলকুঠি পুড়িয়ে লুঠপাট চালায়। ছেলে-ছোকরাদের ডেকে বলে, লাঠি ধর। নীলকরের অত্যাচার সইবি না। ওরা মারলে তোরাও মারবি। রঘু শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েনি। গ্রামের মানুষরাই ঢাল হয়ে তার চার পাশে দাঁড়িয়েছিল।

নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রথম রুখে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু বিশ্বনাথ ডাকাত। তাকে বিখ্যাত করেছে নদিয়ার স্যামুয়েল ফেডির নীলকুঠি লুঠের গল্প। কৃষ্ণনগর অঞ্চলে নীলকর ফেডি ও তার দলবলের অত্যাচার সীমা ছাড়িয়েছিল। বিশাল বাহিনী নিয়ে এক রাতে বিশে ডাকাত সেই কুঠি আক্রমণ করল। তুমুল সংঘর্ষে মারা গেল ফেডির অনেক অনুচর। ফেডির স্ত্রী মাথায় কালো হাঁড়ি চাপিয়ে পুকুরে ডুব দিয়ে রক্ষা পেল। আর ফেডিকে ডাকাতরা নিয়ে এল নিজেদের আস্তানায়। সবাই বলল, ফেডির রক্ত চাই। কিন্তু ফেডি প্রাণভিক্ষা করতে, বিশ্বনাথ তাকে ছেড়ে দেয়। অকৃতজ্ঞ ফেডি কিন্তু তার পরই ধরিয়ে দিল বিশ্বনাথকে। অল্প দিন পরেই বিশ্বনাথ জেল পালিয়ে ফেডির কুঠি আক্রমণ করে। ফেডি আহত হল। কিন্তু এ বারও তাকে প্রাণে মারল না বিশ্বনাথ। শেষ পর্যন্ত কোম্পানির ফৌজের হাতে বিশ্বনাথ ধরা পড়ে, নীলকরদের দোসর এক জমিদারের বাড়ি লুঠতে গিয়ে। মর্মান্তিক পরিণতি হয়েছিল তার। প্রকাশ্যে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়।

সাধারণ ঠগি, ঠ্যাঙাড়েদের চেয়ে বাংলার এই ডাকাতরা আলাদা। নিরীহ মানুষ নয়, এদের টার্গেট ছিল অত্যাচারী, সাহেবভজা জমিদার। আড়াল থেকে সর্বস্ব লুঠ করত না এরা। একেবারে চিঠি দিয়ে, দিনক্ষণ জানিয়ে, তৈরি হওয়ার সময় দিয়ে, বাঘের মতো আসত। নৃশংস ছিল, খুনজখমে হাত কাঁপত না এতটুকু। কিন্তু শিশু আর মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়াকে অধর্ম মনে করত অনেক ডাকাত সর্দারই। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘ইন্দিরা’তে তার প্রমাণ মেলে।

ইন্দিরা বিয়ের পর প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। পথের মধ্যে ডাকাত পড়ল। পালকি-সমেত ইন্দিরাকে উঠিয়ে নিয়ে চলল তারা। রাত এক প্রহরে এক নিবিড় বনের ভেতর পালকি নামানো হল। ইন্দিরার গয়নাগাঁটি, দামি কাপড় লুঠের পর তারা পালকির রুপোও খুলে নিল। কিন্তু ইন্দিরাকে স্পর্শমাত্র করল না। বরং ঘন জঙ্গলে, গভীর রাতে তারা তাকে পশুর মুখে ফেলে যায় দেখে ইন্দিরা যখন ভয়ে তাদের সঙ্গে যেতে চেয়েছিল, তখন দলের সর্দার তাকে বলে, ‘বাছা, অমন রাঙ্গা মেয়ে আমরা কোথায় লইয়া যাইব?’ আবার এক যুবা দস্যু যখন অতি উৎসাহে বলছে, ‘আমি ইহাকে লইয়া ফাটকে যাই, সেও ভাল, তবু ইহাকে ছাড়িতে পারি না’, তখন দলের সর্দার তাকে লাঠি দেখিয়ে বলে ওঠে, ‘এই লাঠির বাড়িতে এইখানেই তোর মাথা ভাঙ্গিয়া রাখিয়া যাইব। ও সকল পাপ কি আমাদের সয়?’

শিবে ডাকাতের গল্পে দেখি, সিপাহি যুদ্ধের সময়, মুর্শিদাবাদের এক মুসাফিরখানায় কাজ করত বছর বারোর ছেলে, বাচ্চু। কাজে একটু ভুল হলেই জুটত বেধড়ক মার। তার পাওনা টাকা তো সে পেতই না, এমনকী কেউ তাকে বকশিশ দিলে, সেটাও কেড়ে নিত মালিক। সেই মুসাফিরখানাতেই আসত এক বাঙালি ঘোড়সওয়ার, শিবদাস। সে বাচ্চুকে খেতে দিত, অনেকটা করে টাকা দিত। বাচ্চুও তার দুঃখের কথা মন খুলে বলত শিবদাসকে। তার পর এক দিন বাচ্চুর চাকরি গেল। ছ’মাস কাজ করার টাকা পেল না, বরং যা-তা গালাগাল দিয়ে, পিটিয়ে, মালিক তাকে বের করে দিল। এই বার ওই ঘোড়সওয়ার স্বমূর্তি ধরল। সে শিবে ডাকাত, জানতে পেরে মালিকের তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। শিবে ডাকাত মালিকের জোচ্চুরির জরিমানা হিসেবে শ’খানেক টাকা আদায় করে, বাচ্চুর হাতে তুলে দিল।

মনোহর ছিল দুর্দান্ত ডাকাত। এখন দক্ষিণ কলকাতার যে পথের নাম মনোহরপুকুর, আজ থেকে দুশো বছর আগে সেখানে ছিল ঘন জঙ্গল, খাল, বিল, জলা হোগলার বন। সেখানেই তার আস্তানা। এক বার গভীর রাত্রে সেই পথে ফেরার সময় মনোহর ও তার সঙ্গীদের নজরে পড়ে, খালের পাড়ে কাদা-জলে মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে দুটি দেহ, এক স্ত্রীলোক এবং বছর পাঁচ-ছয়ের একটি ছেলে। মেয়েটি বাঘের থাবায় গুরুতর আহত। দস্যুরা তাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসে মনোহরের বাড়ি।

ডাকাতদের সেবা সত্ত্বেও মেয়েটিকে বাঁচানো গেল না। এ বার ছেলেটির কী হবে? কার ছেলে, কোথায় থাকে, কিছুই জানা নেই। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের গল্পে দেখা যায়, মনোহরের বুড়ি পিসি মনোহরকে উপদেশ দিচ্ছেন, ছেলেটির গলা টিপে তাকে বাদার জঙ্গলে ফেলে দেওয়া হোক। উত্তরে মনোহর গর্জে উঠে বলছে, ‘তুই মাইয়া মানুষ হইয়া এমন কথা বলিস্। ডাকাত বটি কিন্তু এ হাতে কোনদিন মাইয়া মানুষ আর ছোট ছোট ছাইল্যা মাইয়া মারি নাই। পিসি তুই কি পুতনা রাক্ষসী!’ সেই ছেলেকে মনোহর ডাকাত নিজের কাছে রেখে মানুষ করে। গ্রামের পাদরির কাছে নিয়ে যায় লেখাপড়া শেখাতে।

সে এক অদ্ভুত সময় ছিল। তখন জমিদাররাও ডাকাত হত। দিনের বেলা জমিদারি সামলে রাতের আঁধারে ছিপ নৌকোয় অন্যের জমিদারি লুঠতে বের হত তারা। শান্তিপুরের কুখ্যাত ডাকাত দেবী ঘোষ ও নবীন ঘোষও জমিদার ছিল। এক বার দুই ভাই প্রকাণ্ড বজরা চেপে চলেছে কোনও এক জমিদার বাড়ি লুঠতে। তারা ‘দীর্ঘকায়, বলিষ্ঠ এবং ঘোর কৃষ্ণবর্ণ কুৎসিত পুরুষ। মাথায় সেকালের রীতি অনুযায়ী ছিল একরাশ ঝাঁকড়া চুল, গলায় সোনার মাদুলি, দুই বাহুতে সোনার বাজু, হাতে সোনার বালা।’

বজরা তখন কামারডেঙ্গির কাছে। ছাদের ওপর থেকে দেবী ঘোষের চোখে পড়ল, ষোলো-সতেরো বছরের একটি মেয়ে ঘাটে বসে কাঁদছে। বজরা থেকে নেমে সে মেয়েটির কাছে গেল। মেয়েটি দেবী ঘোষের পায়ে লুটিয়ে পড়ে বলে, ‘বাবা, আমাকে আপনি রক্ষা করুন।’ তার নাম সুলোচনা। মা-বাপ নেই। মামার কাছে মানুষ। মামা তার সঙ্গে আশি বছরের এক বুড়ো কুলীনের বিয়ে ঠিক করেছেন। এ দিকে সুলোচনার মন বাঁধা পড়ে আছে বলরাম মুখুজ্জের ছোট ছেলে কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে। সে কথা জানতে পেরে তার মামা সেই রাতেই সুলোচনার সঙ্গে সেই কুলীনের বিয়ের বন্দোবস্ত করেছেন। বেচারি সুলোচনা তাই পালিয়ে এসেছে। গঙ্গায় ডুবে মরতে।

সেই দিন শেষ রাতে নহবত বাজল দেবী ঘোষ, নবীন ঘোষের বাড়িতে। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত লিখছেন, ‘সানাইয়ের সুরে সমস্ত বাড়ি ও পল্লী হইল উৎসব-মুখর। লোকজনের হৈ-হৈ রব। ভূরিভোজনে সকলে তৃপ্ত হইয়া গেল।’ দুই ভাই দাঁড়িয়ে থেকে সুলোচনার সঙ্গে বিয়ে দিলেন কৃষ্ণচন্দ্রের। লোকে জানল, দেবী ঘোষের মেয়ের বিয়ে।

বিয়ের পরের দিন। বরকনের বিদায়ের সময় দেবী ঘোষ সুলোচনাকে বুকে টেনে বলল, ‘জানিস আমি কে?’ সুলোচনা জানল, তার নতুন বাবা আর কাকা আসলে ডাকাত। শান্তিপুরের ত্রাস। শুনে সুলোচনা বলল, ‘কে বলে আপনারা ডাকাত, আপনারা দেবতা! দেবতার কাছে কি জাত-বিচার আছে, বাবা?’ এ ঘটনার পরেই নাকি দু’ভাই ডাকাতি একেবারে ছেড়ে দেয়।

ভবানী পাঠক বিখ্যাত ‘দস্যু’। তাঁর ভয়ে বরেন্দ্রভূমি কম্পমান। কিন্তু জঙ্গলে একা, অসহায় প্রফুল্লকে তিনি মা বলে ডেকেছিলেন। অনুচরদের কাছে তাঁর কড়া নির্দেশ ছিল, তারা যেন প্রফুল্লর কোনও অনিষ্ট না করে, আর কাউকে করতেও না দেয়। ইজারাদারে রঞ্জনপুর গ্রাম লুঠলে, ভবানী পাঠকের দল সেই ইজারাদারের কাছারি লুঠে, গ্রামের লোকের ধনসম্পত্তি গ্রামের লোকের হাতেই দিয়ে আসার তোড়জোড় করেন। নিজের দস্যুবৃত্তির সমর্থনে প্রফুল্লকে বলেন, ‘আমি দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন করি।’ তাঁর বয়ানে কাছারির অত্যাচারী কর্মচারীদের প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘দেবী চৌধুরাণী’ উপন্যাসে লিখছেন, ‘সিংহাসন হইতে শালগ্রাম ফেলিয়া দেয়, শিশুর পা ধরিয়া আছাড় মারে, যুবকের বুকে বাঁশ দিয়া দলে, বৃদ্ধের চোখের ভিতর পিঁপড়ে, নাভিতে পতঙ্গ পূরিয়া বাঁধিয়া রাখে। যুবতীকে কাছারিতে লইয়া গিয়া সর্ব্বসমক্ষে উলঙ্গ করে, মারে, স্তন কাটিয়া ফেলে, স্ত্রীজাতির যে শেষ অপমান, চরম বিপদ্, সর্ব্বসমক্ষেই তাহা প্রাপ্ত করায়।’ ভবানী ঠাকুরের কথায়, ‘এই দুরাত্মাদিগের আমিই দণ্ড দিই। অনাথা দুর্ব্বলকে রক্ষা করি।’

এখানে তিনি নিছক ডাকাত সর্দার নন, বরং সমাজের রক্ষাকর্তা এক অসামান্য পুরুষ। এমনই এক মানুষ, যিনি রংপুর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কোম্পানির শাসনকে থমকে দেওয়ার স্পর্ধা দেখাতে পারেন। ইংরেজ শাসনের গোড়ায়, যখন আমজনতার চোখে বিদেশি শাসনের কুৎসিত রূপটা ততটা বিকট ভাবে ধরা পড়েনি, সে সময় হয়তো ভবানী পাঠক, রঘু, বিশে ডাকাতদের প্রয়োজন ছিল। তারা একেবারে নিখুঁত ভাবে দেখিয়ে দিয়েছিল, কাদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে হবে, কারা দেশের আসল শত্রু।

মাথায় ঝাঁকড়া চুল, গলায় সোনার মাদুলি, দুই বাহুতে সোনার বাজু, হাতে সোনার বালা, পেশা ডাকাতি – এসব বিবরণ শুনে মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে রবিনহুডের কথাই বলা হচ্ছে। না, যার কথা বলা হচ্ছে তিনি পুরোদস্তর বাঙালি। রঘু, রঘু ডাকাত। তাঁকে বলা হয় বাংলার রবিনহুড। সেটা বলার অবশ্য যথার্থ কারণও আছে। কারণ, তিনি ছিলেন গরীবের বন্ধু।

সেই সময়টা আজ থেকে দেড়শ-দু’শো বছর সময় আগের কথা। ভারতবর্ষে তখন ব্রিটিশ শাসন। বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার নৈহাটি। নীল করদের অত্যাচারে জর্জরিতদের টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করতো এই রঘু।

রঘুর দুয়ার থেকে অর্থকষ্টে থাকা মানুষ সাহায্য চেয়ে ফিরে এসেছে এমনটা কখনো শোনা যায়নি। অর্থাভাবে কোনো দরিদ্র মেয়ের বিয়ে আটকে যাচ্ছে, সেখানে বাবার পকেটে কিছু টাকা গুজে দিতেন রঘু। কারো ঘর পুড়ে গেছে, সেখানেও সবার আগে হাজির রঘু। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চোখে তাই তিনি ছিলেন পরম শ্রদ্ধার পাত্র।

রঘু ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের জন্য হুমকির কারণ। একজন বাঙালি ডাকাতের এতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠা তাঁদের জন্য অপমানজনক ছিল। তাই তো, পুলিশের কাছে তিনি ছিলেন ‘মোস্ট ওয়ানন্টেড ক্রিমিনাল’। তাকে ধরিয়ে দিলে বড় অংকের অর্থ পুরস্কার দেওয়া হবে – এমন ঘোষণাও এসেছিল। সাধারণ মানুষ সেই ফাঁদে পা দেয়নি। তাই, রঘুর হদিশ পেত না পুলিশ। স্থানীয় লোকেরা তাঁর ঠিকানা জানলেও, বলত না, পুলিশে ধরিয়ে দেবার তো প্রশ্নই আসে না।

রঘু’র ডাকাতি লাইনে আসার পেছনে একটা গল্প শোনা যায়। কথিত আছে, নীলকুঠির পাইক-পেয়াদাদের হাতে মার খেয়েই মারা যান রঘু’র বাবা। রঘুর তখন কেবল কৈশোর পেরিয়েছেন। তখন বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি।ভাল লাঠিখেলা জানতেন। সেটাই হয়ে যায় অস্ত্র। থানায় থানায় গিয়ে আগুন লাগিয়ে দেন, নীলকুঠিতে লুটপাট চালান। স্থানীয় তরুণদের তাঁর দলে ভেড়ানোর জন্য উৎসাহিত করতে থাকেন। স্থানীয়রাও দেখলো, এতদিনে একজন এসেছেন যারা তাদের নিজেদেরই লোক, কথাও বলছেন তাঁদের হয়ে। তার ওপর লুটপাটের সব অর্থও বিলিয়ে দিচ্ছে। তাই, জনগণের সমর্থন আর আশীর্বাদ ছিল রঘুর সাথে। সাধারণ মানুষই ছিল তাঁর প্রেরণা, ছিল তাঁর ঢাল। পুলিশ তাই কখনো রঘুকে ছুঁয়েও দেখতে পারেনি।

ইতিহাসে এই রঘু ডাকাতের ঠাঁই হয়নি। গুটিকয়েক লেখকদের লেখায় তিনি বেঁচে আছেন। তাঁকে ঘিরে হাজারো গল্প প্রচলিত। কোনোটা সত্যি, কোনোটা মিথ! বলা হয়, ডাকাত রঘুই বাঘহাটি জঙ্গলে স্থাপিত কালিবাড়ী মন্দিরে নরবলি দেওয়ার প্রথা বন্ধ করেন। সেই মন্দিরে কালিপূজার সময় এখনো তাঁকে স্মরণ করা হয়। নামই পাল্টে রাখা হয়ে রঘু ডাকাত কালি মন্দির।

বিশ্বনাথ সর্দার ছিলেন বাংলার নীল বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান নেতা। ইংরেজ ঐতিহাসিকরা তাকে 'বিশে ডাকাত' নামে আখ্যায়িত করেছেন। মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় তাকে মানবদরদী ও কৃষকবীর বলেছেন। তার দানশীলতা ও বীরোচিত চরিত্রের জন্যে 'বাবু' আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। দরিদ্র ও নীলকর দ্বারা শোষিত জনসাধারণের জন্যে রাজনৈতিক ডাকাতির পথ অবলম্বন করেছিলেন। অনেকের কাছে তিনি নীল বিদ্রোহের প্রথম শহীদ হিসেবে গণ্য হন।
১৮০০ শতকের নীল বিদ্রোহের সাংগঠনিক রূপ দেন বিশ্বনাথ সর্দার। স্যামুয়েল ফেডি নামক অত্যাচারী নীলকরের বিরুদ্ধে গ্রামীন হিন্দু-মুসলমান কৃষকদের একত্র করে বৃহৎ আন্দোলনের আকার দেন। শান্তিপুর এলাকার তাঁত শ্রমিক ও নীলচাষীদের ওপর অত্যাচারে প্রতিশোধ নিতে বিশ্বনাথ শান্তিপুর কুঠি আক্রমন করে লুঠ করেন, ক্রমান্বয়ে চিত্রশালী নীলকুঠি ও নদীয়া ইন্ডিগো কনসার্নের নীলকর স্যামুয়েল ফেডির কুঠি ধ্বংস করার পর নীলকর গোষ্ঠী আতংকিত হয়ে ওঠে। তার একের পর এক সুসংগঠিত আক্রমনে ধুলিস্বাৎ হয়ে যায় খালিবোয়ালিয়া, নিশ্চিন্তপুর, বাঁশবেড়িয়া নীলকুঠি।
নীলকর স্যামুয়েল ফেডির কুঠি তিনি আক্রমন করেন ১৮০৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাত্রে। গ্রামবাসীরা ফেডিকে বন্দী করে হত্যা করতে বদ্ধপরিকর হলেও বিশ্বনাথের দয়ায় সে রক্ষা পায় এবং প্রতিজ্ঞা করে নীলচাষ বন্ধ করে দেবে। যদিও মুক্তি পেয়ে জেলাশাসক ইলিয়টকে এ সংবাদ জানিয়ে দেয় ফেডি। এর কয়েকদিন পরে ইংরেজ সেনাপতি ব্ল্যাক ওয়ার ও ইলিয়টের পুলিশ বিশ্বনাথকে ঘেরাও করলে সাথীদের প্রান রক্ষার্থে মহানুভব বিশ্বনাথ সংঘর্ষ এড়িয়ে যান ও আত্মসমর্পণ করেন।

বিশ্বনাথ ধরা পড়ার পর বিচারের প্রহসন শেষ করতে ব্রিটিশ সরকার খুব দেরি করেনি। তার হত্যা ও হত্যা পরবর্তী কর্মকান্ড ছিল ব্রিটিশ সরকারের বর্বরতার অন্যতম নিদর্শন। তাকে ফাঁসি দেওয়ার পর মৃতদেহটি লোহার খাঁচায় পুরে নদীয়ার কৃষ্ণনগরের নিকটবর্তী আসাননগরের একটি গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয় ও চিল শকুন দিয়ে খাওয়ানো হয়েছিল। শাসকরা চেয়েছিল বিদ্রোহীর এই বীভৎস পরিনতি দেখে কৃষকেরা শংকিত হোক। বিশ্বনাথ সর্দারের মা পুত্রের কংকালটি জলে ভাসিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন, তাতে কর্তৃপক্ষ কর্নপাত করেনি।
বিশ্বনাথের জীবনীকার বিমলেন্দু কয়াল তাকে শেরউড বনের রবিনহুডের সাথে তুলনা করেছেন। বামপন্থী ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় বলেছেন "যাহারা একক শক্তিতে বিদেশী নীলকর দস্যুদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পতাকা উড্ডীন করিয়াছিলেন তাহাদের মধ্যে বিশ্বনাথ সর্দার প্রথম ও শ্রেষ্ঠ স্থানের অধিকারী"। যদিও অনেক ঐতিহাসিক বিশ্বনাথ ও তার সহচর বৈদ্যনাথ কে 'বিশে বদে' ডাকাত নাম দিয়ে হেয় করেছেন, এতদসত্ত্বেও নীল বিদ্রোহের ইতিহাসে ও কৃষক আন্দোলনে তাদের অবদান অপরিসীম। শিশুসাহিত্যিক ধীরেন্দ্রলাল ধর তার 'নীলকর এলো দেশে' উপন্যাসে শহীদ বিশ্বনাথ সর্দারের কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন। শিশুসাহিত্যিক খগেন্দ্রনাথ মিত্র লিখেছেন বিশ্বনাথ ছিলেন বাগদি, তিনি নিজের প্রতাপে বাবু উপাধি ধারণ করেছিলেন।

(তথ্যসূত্র:
১- ডাকাত অমনিবাস। শ্রী খগেন্দ্রনাথ মিত্র। কলকাতা: ভারতী সাহিত্য প্রকাশনী। পৃষ্ঠা ৮ - ২৯।
২- নীলকর এলো দেশে। ধীরেন্দ্রলাল ধর। কলকাতা: দেজ পাবলিশিং।
৩- নদীয়া জেলা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনা সমিতি (১৯৭৩)। স্বাধীনতা সংগ্রামে নদীয়া। নদীয়া জেলা পরিষদ।
৪-  ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম। সুপ্রকাশ রায়। কলকাতা: ডি এন বি এ ব্রাদার্স। পৃষ্ঠা ২১১, ২১২।
৫- আনন্দবাজার পত্রিকা। ৩০শে অক্টোবর ২০১৬ সাল।)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ