"শ্রদ্ধা" ও "সম্মান" || চৈতালি ভট্টাচার্য

বাংলা ভাষায় "শ্রদ্ধা" আর "সম্মান" শব্দ দুটোর ভিন্ন মানে আছে । সব ভাষাতে সব অনুভূতি প্রকাশের জন্য শব্দ নাও থাকতে পারে । যেমন ইংরাজী ভাষায় এই দুটো শব্দের জন্য একটাই প্রতিশব্দ আছে - "Respect" । "প্রেম" এবং "ভালবাসা" শব্দ দুটোর জন্যও যেমন ইংরাজীতে আলাদা শব্দ নেই । হিন্দি বা উর্দু ভাষায় এই শব্দ গুলোর জন্য হয়ত আরও ভাল প্রতিশব্দ পাওয়া যাবে । "প্রেম", "ভালবাসা" শব্দ গুলো অনেক বেশি জটিল । বাংলা ভাষায় এই শব্দ গুলোকে কনটেক্সট দেখে বুঝতে হয় । "শ্রদ্ধা", "সম্মান" শব্দ গুলো ততটা জটিল নয় । মানুষের চিন্তাভাবনার জটিলতার জন্য অনেকাংশে দায়ী ভাষার ভিন্নতা আর শব্দ গুলোর অস্পটতা । ভাষার সমস্যা নিয়ে আমি আগে লিখেছি । তাই এবিষয় এখন আর বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না । এই মুহূর্তে আমার বক্তব্য শুধু বাংলা ভাষার দুটো শব্দকে নিয়ে - "শ্রদ্ধা" এবং "সম্মান" ।

"শ্রদ্ধা" এমন একটা অনুভূতি যা একজন মানুষের মনে তৈরি হয় অন্য একজন মানুষের প্রতি ভালোলাগা থেকে । দৈনন্দিন জীবনে সাধারণত আমরা যেসব মানুষকে খুব পছন্দ করি, তাদের প্রতি আমাদের মনে একটা "শ্রদ্ধাবোধ" তৈরি হয় । আমরা যেসব মানুষদের গুণের প্রতি আকৃষ্ট হই, তাদের প্রতি আমাদের মনে একটা শ্রদ্ধা জন্মায় । আর যাদের মধ্যে আমরা দোষ দেখতে পাই, তাদের জন্য আমাদের মনে অশ্রদ্ধা তৈরি হয় । অন্যদিকে "সম্মান" মূলত শ্রদ্ধারই বহিঃপ্রকাশ, যা আমাদের ব্যাবহারে প্রকাশ পায় । সাধারণত, আমরা যদি কাউকে মন থেকে শ্রদ্ধা করি, তার প্রতি আমরা আমাদের ব্যবহারে সম্মান দেখাই । এই আচরণ আমরা সবসময় যে জেনে-বুঝে করি তা নয় । এরকম আমরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই করি ।

কিন্তু তার মানে এই নয় যে, যেসব মানুষকে আমরা সম্মান দেখাই আমাদের ব্যাবহারে, তাদের সবাইকে আমরা মন থেকে শ্রদ্ধা করি । আমরা অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক মূল্যবোধ বা ভয় থেকেও সম্মান দেখাই । একজন স্কুলের ছাত্র যদি তার শিক্ষকদেরকে সম্মান দেখায়, তার মানে এটা নয় যে সে তার সব শিক্ষকদের মন থেকে শ্রদ্ধা করে । কিন্তু সে কোন একটা সামাজিক মূল্যবোধ থেকে অথবা ভয় থেকে তার শিক্ষকদেরকে সম্মান দেখায় । আমরা চাইলে একজনকে সম্মান দেখাতে পারি, কিন্তু আমরা চাইলে জোর করে কারোর জন্য আমাদের মনে শ্রদ্ধা তৈরি করতে পারি না । শ্রদ্ধা ভালোলাগা থেকেই আসে ।

এই প্রসঙ্গে একটা কথা বোঝা কিন্তু খুব দরকার । এই "সম্মান" শব্দটার সামাজিক গুরুত্ব কিন্তু অপরিসীম । একটা সমাজ প্রকৃত সুসভ্য সমাজে তখনই পরিণত হতে পারে, যখন মানুষ একে অপরকে সম্মান দিতে শিখবে । আমি যদি কারোর কোন কাজ বা কোন বক্তব্য অথবা কোন মতামত পছন্দ না করি, সেটার বিরোধিতা করতে চাই, সেই বিরোধিতাটাও যেন সম্মান দিয়েই করি । তবেই আমরা প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত এবং সুসভ্য সমাজ গড়ে তুলতে পারব ।

এবারে আসা যাক আমাদের জীবনে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গুলোর প্রসঙ্গে । একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে "শ্রদ্ধা" আর "সম্মান" এই দূটোই খুব গুরুত্বপূর্ণ । ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বলতে এক্ষেত্রে
কোন কাছের বন্ধু, প্রেমিক / প্রেমিকা অথবা জীবনসঙ্গী । এধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে "শ্রদ্ধা" আর "সম্মান" না থাকলে কখনও একটা ভাল বা উন্নতমানের সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে না। এই প্রসঙ্গে এটা মনে রাখা দরকার যে, শ্রদ্ধা আসে একজন মানুষকে ভালোলাগার অনুভূতি থেকে । বন্ধুত্ব বা প্রেম সবসময় কিন্তু ভালোলাগা থেকে গড়ে ওঠে না । সেক্ষেত্রে শ্রদ্ধাবোধ নাও তৈরি হতে পারে । সেই কারণেই দুজন আদর্শবাদী / চিন্তাশীল মানুষের মধ্যে সম্পর্ক এভাবে না গড়ে ওঠাই বাঞ্ছনীয় । আদর্শের কারণে বা চিন্তাচেতনার মিলের কারণে দুজন চিন্তাশীল মানুষের মধ্যে সম্পর্ক বা ঘনিষ্ঠতা তৈরি হতে পারে । সেই ধরনের সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ এবং সম্মান দুটোই থাকা টা স্বাভাবিক । আবার মতাদর্শগত বিরোধ বা চিন্তার মতানৈক্যের কারণে সেরকম দুজন মানুষের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে পারে । দূরত্ব তৈরির কারণ যাই হোক না কেন, দুজন প্রগতিশীল চিন্তার মানুষের কাছে এটাই কাম্য যে, তাদের কাছে আসা এবং দূরে যাওয়া দুটোই সম্মানের সাথে হবে ।

সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ভাবতে গেলেও দেখা যাবে যে, একটা গঠনমূলক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, যেটা সবথেকে বেশি প্রয়োজনীয় সেটা হল "পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ" এবং তার সঙ্গে "সম্মান" । আমি একথা বলছি না যে একটা সম্পর্কে মনের অন্যান্য অনুভূতি গুলো খুব কম প্রয়োজনীয় । "প্রেম", "ভালবাসা", "পারস্পরিক বোঝাপড়া" এইসব কিছুরই প্রয়োজন হয় একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে । আবার সব ধরনের অনুভূতি থাকার পরও অনেক সম্পর্কে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয় শুধুমাত্র কাছের মানুষটাকে সময় না দিতে পারার কারণে । তাই একটা সম্পর্কের ক্ষেত্রে যত্নশীল হতে চাইলে এই দিক গুলোও মাথায় রাখতে হবে । কিন্তু দুজন প্রগতিশীল চিন্তার মানুষের সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ থাকা টা কাম্য । কারণ এধরনের মানুষরাই সমাজের কাছে দৃষ্টান্ত হতে পারেন ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ