শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় মৌলবাদের কালো ছায়া ঘনীভূত... || অনাবিল সেনগুপ্ত


 "অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই;
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।"

অসংলগ্নতার বহর:-
'বিমানের আবিষ্কারক রাইট ভ্রাতৃদ্বয়, এটি ঐতিহাসিক ভুল'। বিজেপি সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী সত্যপাল সিং দাবি করেছেন, 'বিমানের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় হিন্দু পুরাণ রামায়ণে'। ‘আর যদি বর্তমান যুগের কথা ধরা হয়, তাহলে বিমানের আবিষ্কারক হলেন শিবাকর বাবুজি তালপাঢ়ে!’
'রাইট ভাইয়েদের আট বছর আগেই বিমান আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন শিবাকর বাবুজি তালপাঢ়ে' ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রদের একটি পুরষ্কার বিতরণী সভায় এক ভাষণে এ কথা বলেন সিং।
খোঁজ পড়ে গেছে কে এই তালপাঢ়ে, যিনি বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসে সম্পূর্ণ 'অজানা'ই রয়ে গেছেন! খুঁজে পাওয়া যায়নি এখনও। বিভিন্ন  বিজ্ঞান সম্মেলনেও চললো এই গুলগল্প!                                                  
       এতো গেল বিমানের প্রসঙ্গ। ভারতের চিকিৎসা বিজ্ঞানের ঐতিহ্য যে কত মহান আর সুপ্রাচীন, তা বোঝতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালেই বলেছিলেন, প্রাচীন ভারতেও 'কসমেটিক সার্জারি'র প্রচলন ছিল। উদাহরণ হিসাবে মোদি তুলে ধরেছিলেন হিন্দুদের দেবতা গণেশের কথা। ‘আমরা ভগবান গণেশের পুজো করি। সেই সময়ে নিশ্চই এমন একজন প্লাস্টিক সার্জেন ছিলেন যিনি একটি হাতি মাথা একজন মানুষের শরীরে লাগিয়েছিলেন। তখন থেকেই প্লাস্টিক সার্জারির প্রচল হয়’- মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালের চিকিৎসকদের সামনে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, ভগবান শিব একটি হস্তিশাবকের মাথা একটি শিশুর দেহে জুড়ে দিয়ে ভগবান গণেশকে সৃষ্টি করেছিলেন।
                    চিকিৎসা বিজ্ঞানের ঘটনা থেকে আবারও ইঞ্জিনিয়ারিং এ ফেরত যাওয়া যাক। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপাণী একটি ইঞ্জিনিয়ারিং গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে হিন্দুদের ভগবান রামের ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যার উদাহরণ দিয়েছিলেন। হিন্দু পুরাণ রামায়ণে উল্লেখিত আছে, নিজের অপহৃত স্ত্রী সীতাকে শ্রীলঙ্কার দৈত্যরাজ রাবণের হাত থেকে যখন উদ্ধার করে আনতে গিয়েছিলেন, তখন লংকায় পৌঁছানোর জন্য তিনি সমুদ্রের ওপরে একটি সেতু নির্মাণ করেছিলেন। পক প্রণালী নামে পরিচিত ভারত মহাসাগরের যে সরু ও অগভীর অংশটি ভারতের দক্ষিণতম প্রান্ত আর শ্রীলঙ্কার মধ্যে আছে, তারই ওপরে ওই সেতু তৈরি হয়েছিল বলে অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী এখনও বিশ্বাস করেন। পক প্রণালীর ওই অংশে কিছু পাথরের অবশেষ এখনও দেখা যায়। সেটিকেই সবাই রামের তৈরি সেতুর ভগ্নাবশেষ বলে মনে করে থাকেন। ‘চিন্তা করে দেখুন সেই কোন যুগে ভারত আর শ্রীলঙ্কার মধ্যে সেতু বানিয়েছিলেন ভগবান রামচন্দ্র! তার কাছে কী উন্নত মানের প্রকৌশলীরা ছিলেন সেযুগে। এখনও সেই সেতুর ভগ্নাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়’- বলেছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী।

ইঞ্জিনিয়ারিং আর চিকিৎসা বিজ্ঞান হলো, কিন্তু গরু কি না এসে পারে এই বিজ্ঞানমনস্কতার মধ্যে?

বি জে পি শাসিত রাজস্থানের শিক্ষা মন্ত্রী বাসুদেব দেবনানী জানুয়ারী মাসে বলেছিলেন, ‘গরুর বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব কতটা তা বুঝতে হবে। পৃথিবীতে গরুই একমাত্র প্রাণী, যারা অক্সিজেন প্রশ্বাস নেয়, আবার নিঃশ্বাস ছাড়ার সময়েও অক্সিজেনই ফিরিয়ে দেয় প্রকৃতিতে।’

বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা নিত্যনতুন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব দিচ্ছেন, তো বিচারপতিরাই বা বাদ যান কেন আর প্রজনন বিজ্ঞানই বা পিছিয়ে থাকবে কেন!
ময়ূরকে কেন জাতীয় পাখি হিসাবে ঘোষণা করা হবে না, কারণ  ময়ূর হচ্ছে একমাত্র ব্রহ্মচারী প্রাণী!  রাজস্থান হাইকোর্টের বিচারপতি মহেশ শর্মা সাংবাদিকদের ব্যাখ্যা করেছিলেন ময়ূরের প্রজনন প্রক্রিয়া সম্বন্ধে। একটি ময়ূরী গর্ভবতী হয় কীভাবে তাহলে? বিচারপতির যুক্তি, ময়ূর যখন তার চোখের জল ফেলে, ময়ূরী সেই অশ্রু পান করেই নাকি গর্ভবতী হয়ে পড়ে। সেজন্যই ময়ূরের ব্রহ্মচর্য কখনও ক্ষুন্ন হয় না, সে আজীবন কৌমার্য রক্ষা করতে সক্ষম হয়। এরকম এক ব্রহ্মচারী পাখিরই জাতীয় পাখির মর্যাদা পাওয়া উচিত ভারতে। বর্তমানে ভারতের জাতীয় প্রাণী বাঘ। তার বদলে গরুকে জাতীয় পশুর মর্যাদা দেয়ার পক্ষেও সওয়াল করেছিলেন ওই বিচারপতি। এই সবই তিনি অবশ্য আদালতের বাইরে, নিজের কর্মজীবনের শেষ দিনে, সাংবাদিকদের সামনে বলেছিলেন।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছিলেন ময়ূরের চোখের জল খেয়ে ফেলে ময়ূরী গর্ভবতী হয়ে পড়ার এই কল্পকাহিনী অনেক পুরনো। বহুদিন ধরেই এটা চলে আসছে। অন্য সব প্রাণীর মতোই শারীরিক মিলনের মাধ্যমেই যে 'ব্রহ্মচারী' ময়ূর কোনও ময়ূরীকে গর্ভবতী করে, সেটাই বিজ্ঞান।
ভারতে বিজেপিশাসিত অসমের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা ক্যানসারকে 'পাপের ফল' বলে মন্তব্য করায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। সম্প্রতি
শিক্ষকদের নিয়োগপত্র প্রদান অনুষ্ঠানে হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলেন, ‘এই যে অনেকের ক্যানসার হয়, কারো তরুণ সন্তান দুর্ঘটনায় অকালে মারা যায় এসবই হল পাপের ফল। এই জন্মে বা পূর্বজন্মে করা পাপের জন্যই এসব ঘটনা ঘটে। নিজে পাপ না করে থাকলেও বাবা-মা অথবা পরিবারের অন্য কেউ পাপ করলেও তার ফল সন্তানকে ভুগতে হতে পারে!’ অসম সরকার পরিচালিত ক্যানসার হাসপাতালের সুপার বি বি বোর ঠাকুর স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই বলে মন্তব্য করেছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা অবশ্য তার সাফাইতে বলেছেন, ‘কর্মফল হিন্দুধর্মের সনাতন বিশ্বাস। তা থেকে বাঁচা যায় না! আমি কোনও নতুন কথা বলিনি। বলেছি, আমাদের সব কষ্টই কর্মফল। আগের জন্মের কর্মফল এ জন্মে ভোগ করতে হয়, এটাই হিন্দু বিশ্বাস। সেই সুপ্রাচীন দর্শনকেই তুলে ধরেছি মাত্র।’ হিমন্ত বলেন, ‘হিন্দু দর্শনের মূলেই রয়েছে কার্মিক দর্শন। আমি তা বদলে ফেলতে পারব না। হিন্দু হিসেবে সেই মতবাদই আমি মেনে চলব।’
আসামে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা তুলে দিতে এটাই যথেষ্ট!
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হিন্দুত্ববাদী বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা ভারতের ইতিহাস এবং হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ যে কত মহান ও বিজ্ঞান। আর বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, পশু বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং- সব কিছুতেই প্রাচীন ভারত যে বাকি পৃথিবীর থেকে অনেক এগিয়ে ছিল, সেটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করে চলেছেন নানাভাবে।
 কিন্তু এই হিন্দুত্ববাদী বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ সুচতুরভাবে এড়িয়ে যায় বৈদিক সাহিত্যে ছ'টি শ্রেণীর নাস্তিকদের যথা - ১. মাধ্যমিক, ২. যোগাচার, ৩. সৌত্রান্তিক, ৪. বৈভাষিক, ৫. চার্বাক ও ৬. দিগম্বর।
সাংখ্য দর্শন,  মীমাংসা দর্শন, স্বভাববাদ, বৌদ্ধ মতবাদ এর কথা, কারণ তখন এরা সামাজিক এবং ধর্মীয় অন্ধত্বকে প্রশ্নবাণে জ্বরিত করে। সমাজের কুসংস্কার উপর প্রশ্ন উঠায়।
গণিতজ্ঞ আর্যভট্ট, বরাহমিহির, গুপ্তযুগের একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী ধন্বন্তরি, চরকের মেডিসিন বিষয়ক ‘চরক সংহিতা’, শল্যবিদ সুশ্রুত রচিত ‘সুশ্রুত সংহিতা’  থেকে রামমোহন বিদ্যাসাগর। যারা এই বিজ্ঞান তথা তৎকালীন যুক্তিবাদী চিন্তা ধারায় আমূল পরিবর্তন এবং উচ্চতায় নিয়ে যায়। এরাই সমাজের ধর্মীয় অভ্রান্ততা প্রশ্নচিহ্ন তোলে এবং সমাজে যুক্তির পথ দেখায়।  পৃথিবীতে নাস্তিক্যবাদের উপস্থাপন এবং প্রসারিত হয় এই ভারতেই।  যার ফলে বহু অত্যাচার  এবং অজ্ঞতার অন্তরালে রাখাবার চেষ্টা এখনো চালিয়ে যাচ্ছে ওইসব ধর্মীয় সংগঠন বা তল্পিতল্পাবাহকরা।
এর ফলে বিজ্ঞানের বা ইতিহাসে কতটা ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, তা এখনই বলা কঠিন, কারণ ওই সব মতামত বৈজ্ঞানিক মহলে মোটেই মান্যতা পাচ্ছে না, তবে সামাজিক মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে হাসির খোরাক হচ্ছে।  কিন্তু তলে তলে শাষকের আসনকে কাজে লাগিয়ে চলছে শিক্ষাব্যবস্থাকে অন্ধত্বের আস্তাকুরে পর্যবসিত করার প্রয়াস।
   
   "রাজা জানেন মগজ ধোলাই মন্ত্র,
খিদে পেটেও হাসছে প্রজা এটাই প্রজাতন্ত্র"

যতই কথার খোরাক থাকুক, ওই বক্তব্যই স্কুল থেকে কলেজের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তি চলছে যাকে শিক্ষার গৈরিকীকরণ(কুসংস্কার আর ধর্মীয় অন্ধত্বের বোঝা) বলছে সমালোচকরা | ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে বিদেশী প্রভাব মুক্ত করে (হাস্যকর) দেশীয়(গৈরিকীকরণ) ইতিহাস লেখায় মন দিয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আর এস এস | শিক্ষায় ‘রামরাজত্ব’ আনার লক্ষ্যে স্কুলের পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ পড়তে চলেছেন নিউটন, গ্যালিলিও, পিথাগোরাস বা বাবর, আকবর, হুমায়ুন |
বিজেপি শাসিত রাজ্য রাজস্থান থেকে এই লক্ষ্যে কাজ শুরু করল আর এস এস | নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আসার পর থেকেই শিক্ষা ব্যবস্থায় হিন্দুত্বের প্রভাব বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছিল তারা | রাজস্থানের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষামন্ত্রী এবং আর এস এস সদস্য বাসুদেব দেবনানী জানিয়েছেন, এখন থেকে ইতিহাস বইতে কেবলমাত্র জায়গা পাবেন নেতাজী, ভগত সিং, মাস্টারদা সূর্য সেন, রানা প্রতাপ, শিবাজী এঁদের মতো দেশীয় চরিত্র | আর বাদ পড়বেন বিদেশীরা | মন্ত্রীর বক্তব্য – ‘আমাদের সন্তানরা কেন আকবর দ্য গ্রেট পড়বে? কেন মহারানা প্রতাপ দ্য গ্রেট পড়বে না? আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা চিরকাল বিদেশী শাসক, গণিতজ্ঞ ও বিজ্ঞানীদের অবদান পড়ে আসছে | আমি শিক্ষা দপ্তরের দায়িত্ব নেওয়ার পরই সব পাঠ্যপুস্তক থেকে বিদেশীদের অবদান বাদ দিয়ে নতুন করে ইতিহাস লেখার উদ্যোগ নিয়েছি |’
আর এস এস-এর এই পদক্ষেপ নিয়ে বিতর্কের তুমুল ঝড় উঠেছে দেশ জুড়ে | অন্যান্য কোনো রাজ্য এখনো এই জাতীয় কিছু না করলেও আশঙ্কার মেঘ ঘন হয়ে আসছে ক্রমশ | যদি শুধু বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতেই এ ব্যবস্থা চালু হয়ে যায়, তবে ভারতবর্ষের অর্ধেকের বেশি স্কুল পড়ুয়াই শিখবে এক নতুন ইতিহাস |
দেরি না করে রাজস্থানের পথ অনুসরণ করছে মহারাষ্ট্র।  রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ইতিহাস বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির জন্য নির্ধারিত পুস্তকতালিকায় এমন একটি বইকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল, যাতে হলদিঘাটের যুদ্ধে মহারানা প্রতাপকে বিজয়ী এবং সম্রাট আকবরকে পরাজিত দেখানো হয়েছিল। এ বার মুঘল সাম্রাজ্যের কথা সম্পূর্ণ মুছে দিতে চলেছে মহারাষ্ট্র শিক্ষা পর্ষদ।
মুম্বই মিররের একটি রিপোর্টে জানা গিয়েছে পর্ষদের অন্তর্ভুক্ত স্কুলের সপ্তম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির বইয়ের সিলেবাসে মুঘল সাম্রাজ্যের কথাই মুছে দিতে চলেছে পর্ষদ। উল্লেখ থাকবে না কোনো মুঘল স্থাপত্যেরও। তার বদলে মরাঠা সম্রাট শিবাজিকে আরও বেশি করে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হবে।
বাজপেয়ীজীর সময়ে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মুরলী মনোহর যোশী যা শুরু (বৈদিক জ্যোতিষ শাস্ত্র (যা অন্ধ কুসংস্কার)কে বিজ্ঞান রূপে সিলেবাসে পা০ড়ানোর চেষ্টা বিফলে যায় যুক্তিবাদীদের চ্যালেঞ্জ এর সামনে) করেছিলেন, মোদীজীর সময়ে মন্ত্রকে এসেই স্মৃতি ইরানিও সেই পথে এগোচ্ছেন। মন্ত্রীর গদিতে বসেই স্মৃতি রামলাল, সুরেশ সোনি, কৃষ্ণগোপালদের মতো আর এস এস-র প্রথম সারির নেতাদের সঙ্গে বসেছেন, সঙ্ঘের শিক্ষা সংক্রান্ত সংগঠনগুলির সঙ্গে বৈঠক হয়েছে এবং তারা নির্দিষ্ট নির্দেশিকাও দিয়ে দিয়েছে মন্ত্রীকে। আর এস এস নেতারা স্কুল পাঠ্যবইয়ে যে ইতিহাস পড়ানো হয় তা ‘সংশোধন’ করে নিতে বলেছেন। হিন্দু সংস্কৃতি এবং হিন্দু রাষ্ট্রনায়কদের গৌরবগাঁথা বেশি বেশি করে পড়ানোর পরামর্শও দিয়েছেন সঙ্ঘ নেতারা। ইতোমধ্যেই ভারতীয় ইতিহাস গবেষণা পরিষদের মাথায় বসানো হয়েছে ওয়াই সুদর্শন রাওকে যিনি মহাকাব্য এবং ইতিহাসকে একই জিনিস বলে মনে করেন।
কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপেই হয়তো খানিকটা ঠাহর করা যায়, বি জে পি সরকার কোন হাওয়ার সওয়ারি। শুরুতেই এই সরকার ভারতীয় শিক্ষা নীতি উদ্যোগ (বি এস এন এ) তৈরির অনুমোদন দিয়েছে। যেখানে জায়গা করে দেওয়া হয়েছে সঙ্ঘের শাখা সংগঠন, শিক্ষা সংস্কৃতি উত্থান ন্যাসের লোকজনকে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ‘ভারতীয়করণ’ করতে এরা ইতিহাস ‘সংশোধনের’ পরামর্শ দিয়েছেন। এর মাথায় বসানো হয়েছে দীনানাথ বাটরার মতো বিতর্কিত লোককে। সেই বাটরা যাঁর একের পর বইতে মহাকাব্য ও পৌরাণিক উদাহরণগুলিকে বাস্তব বলে প্রচার করা হয়েছে। শিক্ষাবিদ ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে মোদীর সময়কালে গুজরাটের স্কুলে সেই সব বই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ এই শিক্ষাবিদের পরামর্শেই মধ্য প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান স্কুল পাঠক্রম থেকে জীবন শৈলী শিক্ষাকে বাইরে রাখায় উদ্যোগী হয়েছেন।
একইভাবে গত কয়েক মাসে ভারতীয় ইতিহাস বদল ও শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠনের জন্য বেশ কিছু প্রচেষ্টা হয়েছে, যেখানে এদেশের প্রধান সমস্যা হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে সংখ্যালঘুদের। মুসলিম, খ্রীষ্টান ও পার্সী সকলকেই বহিরাগত হিসেবে দেখানো হচ্ছে। আর স্বাধীনতা সংগ্রামকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। বি জে পি-র আগের বারের শাসনকালেও এই একইভাবে এই সবই ধীরে ধীরে করা হয়েছিল জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় গৌরবের নামে। মুরলী মনোহর যোশীর সেই লাগামছাড়া গৈরিকীকরণের পথেই এগোচ্ছেন স্মৃতি ইরানিও। সমালোচনা আন্দোলন প্রতিরোধ ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে বিস্তর,  কিন্তু বাঘের পিঠে সাওয়ারকে রুখছে না! পূর্বসূরি এন সি ই আর টি-র বইয়ে বদল থেকে শুরু করে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজ, এন সি ই আর টি এবং ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব হিস্টোরিক্যাল রিসার্চের স্বীকৃত শিক্ষা সংস্থায় বি জে পি, আর এস এস-র লোক ঢুকিয়েছিলেন। স্মৃতিও এসেই ক্লাস এইট, নাইন, টেনের পাঠক্রমে বেদ, উপনিষদসহ প্রাচীন হিন্দু গ্রন্থ ঢোকানোর তোড়জোর শুরু করেছেন। কেউ হয়তো বলতেই পারেন প্রাচীন গ্রন্থ পড়ানোর মধ্যে তো আর সাম্প্রদায়িকতা নেই। কিন্তু কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে তা পড়ানো হচ্ছে, জ্ঞানচর্চার জন্য যুক্তিবাদী চিন্তায় বস্তুনিষ্ঠ ভাবে নাকি জাতীয়তাবাদের বিকৃত ধারণা তৈরি জন্য প্রশ্ন সেখানেই।
২০০০সালের ১৯শে জানুয়ারি গুজরাট শিক্ষা দপ্তর একটা সরকারী নির্দেশে সমস্ত স্কুলে আর এস এ—এর মাসিক পত্রিকা ‘সাধনা’ রাখা বাধ্যতামূলক করে। ঠিক যেমনভাবে দীনানাথ বাটরা মতো লেখকের লেখা উগ্র জাতীয়তাবাদী, উদ্ভট চিন্তার বইগুলি সেরাজ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে পড়ানো বাধ্যতামূলক করা হয়। এমনকি গান্ধী-হত্যাকেও বৈধতা দেওয়া হচ্ছে গুজরাটের ইতিহাস বইয়ে।

এটাকে শিক্ষার গৈরিকীকরণ বলুন, বা শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণ অথবা শিক্ষার রাজনীতিকরণ যে নামেই উল্লেখ করুন মূল সত্যটা হলো যে কোনো ভাবে কচি মনেই ধর্মীয় মৌলবাদের গবেষণাগার গড়ে তোলো, নিরীহ মনে একটা উগ্র চিন্তা গেঁথে দাও। যা থেকে তৈরি হবে অর্ধ সত্য জানা, অর্ধ শিক্ষিত এক উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী প্রজন্ম তৈরি করা। এই বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে দেশ।
ধর্মীয় মৌলবাদী সংঘ পরিবারের কাছে গৈরিকীকরণ হলো সেই দরকারকেই পূরণ করার একটি অন্যতম মাধ্যম। তাই বিজ্ঞান কংগ্রেস থেকে ইতিহাস সংসদ, গৈরিকীকরণের সুনামী আছড়ে পড়ছে বারবার। তবে গৈরিকীকরণের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্রটি অবশ্যই শিক্ষাক্ষেত্র। হিটলার একসময় বলেছিলেন “Let me control the school text books, 3rd reich will rule for the next 20 years without any internal threat.” ঠিক এই কারণেই শিক্ষাক্ষেত্রটি সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র গৈরিকীকরণের। এই গৈরিকীকরণ আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় এক মধ্যযুগীয় উল্লাসের মধ্যে। যার থেকে ফুটে বেরোয় সামন্ততান্ত্রিকতা। আর ঐ মধ্যযুগীয় উল্লাসের পেছেনেই থাকে শিক্ষার বেসরকারিকরণের চাল। কারণ শিক্ষায় ধর্মীয় মৌলবাদ  মানেই রাষ্ট্রের সাথে কর্পোরেট এর  চুক্তি। আর বেসরকারিকরণ ছাড়া বহুজাতিক কর্পোরেট গুলির মুনাফা বৃদ্ধির রাস্তা বন্ধ। তাই শিক্ষার বেসরকারিকরণ চলে গৈরিকীকরণের সাথে হাতে হাত ধরে।
গোটা দেশে ছড়াতে :-
বেনারস ইউনিভার্সিটি ২০১৫ সালেই  ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্রছাত্রীদের বেদ, পুরাণ, বৈদিক শাস্ত্র, ধর্মানুরাগ শেখানোর দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সিলেবাসে ঢুকিয়েছে। সেই বেনারস ইউনিভার্সিটির ডিরেক্টরকে সিলেবাস কমিটির মাথায় রেখে এই সদ্য ঘোষণা করা হল,  এবার থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর গোটা দেশের ছাত্রছাত্রীদের পড়তে হবে বেদ-পুরাণ। অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকলিক্যাল এডুকেশন(এআইসিটিই)-র নতুন নির্দেশিকায় একথা উল্লেখ করা হয়েছে। গত ২৪শে জানুয়ারি'১৮ ওই নির্দেশিকা প্রকাশিত হয়েছে।
শুধু বেদ, পুরাণ, তর্কশাস্ত্রই নয়, এবার থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্রদের জানতে হবে সংবিধানও। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই এই পাঠ চালু হবে বলে জানা গিয়েছে। বাধ্যতামূলকভাবেই পড়ানো হবে এইসব বিষয়গুলি। মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর জানিয়েছেন, ক্যারিকুলাম আপডেট ছাত্রছাত্রীদের অধিকার। তাই এইসব বিষয়ের মধ্যে ভারতীয় সংস্কৃতির ছোঁয়া থাকবে বলে জানা গিয়েছে। অর্থাৎ, পড়ানো হবে ভারতীয় দর্শন, যোগা, ভাষাবিদ্যা ইত্যাদি। এর ফলে ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞান বাড়বে বলছে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রক। ভারতের ৩০০০-এরও বেশি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রত্যেক বছর ৭ লক্ষ ইঞ্জিনিয়ার পাশ করে। তবে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে দেখা যায় মাত্র অর্ধেক চাকরি পাচ্ছে। এআইসিটিই-র ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, বেদ, পুরাণ ছাড়াও সিলেবাসে ‌যোগ হচ্ছে পরিবেশবিদ্যা, সংবিধান, ভারতীয় দর্শন, ভাষাবিদ্যার মতো বিষয়।
ইতিমধ্যে খড়গপুর আই আই টি-তে স্থাপত্যবিদ্যার পাঠ্যক্রমে বাস্তুশাস্ত্র অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই ধরনের চিন্তাভাবনা বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের আরও পিছিয়ে দেবে বলেই মনে করছে অ্যাসোসিয়েশন অব স্টেট ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড টেকনিকাল অফিসার্স (অ্যাসেটো) ওয়েস্ট বেঙ্গল-এর নেতৃবৃন্দ। সংগঠনের বক্তব্য, বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তি, ন্যায্যতা প্রমাণ, মুক্তচিন্তা ও আধুনিকতার ওপরে নামিয়ে আনা হচ্ছে পরিকল্পিত আক্রমণ। বিজ্ঞান ও অন্ধ বিশ্বাসের মধ্যে বিভাজন মুছে ফেলে দেশকে পুরোপুরি হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর ছক চলছে। ইঞ্জিনিয়াররা বলছেন, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে অন্ধ বিশ্বাসের বিষয়গুলিকেও ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে আগামী দিনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছাত্রছাত্রীদের অগ্রগতি ও গবেষণায় ক্ষতি হবে।
মনেরাখা দরকার যেসব ছাত্রছাত্রী পড়বে সবাই প্রথাগত শিক্ষায় ১০+২ পাস করে, প্রফেশনাল কোর্সভিত্তিক (নির্দিষ্ট জীবিকাভিত্তিক) পড়াশোনা করেতে এসেছে! তাই খুবই বিপদজনক অভ্যাস তৈরি চেষ্টা হচ্ছে। এইসব প্রফেশনাল কোর্সে ওইসব অবৈজ্ঞানিকী বা মনোনিবেশ অন্যত্র নিয়ে গেলে, ভুলচর্চার অভ্যাস তৈরি করালে সমাজের সরাসরি ক্ষতিকারক বা বিপদজনক। কারণ নাগরিক সমাজের সমস্ত রকম পরিকাঠামো উন্নয়নে এরা সরাসরি যুক্ত। তাই জ্ঞান এখানে একমাত্র পেশাগত হওয়াই আবশ্যিক।  যেমন একজন চিকিৎসকের অজ্ঞানতায় বা ভুল চিকিৎসায়য় একজন রুগির মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তেমনি একজন ইঞ্জিনিয়ার এর অজ্ঞানতায় সরাসরি প্রাণনাশ অনেক গুণ বেশী হতে পারে। মনেপরে কলকাতার বড়বাজারের উড়ালপুল নির্মাণকাজ সময়ে ভেঙ্গে যাওয়ার ঘটনা, কারণ অনেক হতে পারে কিন্তু ভবিষৎকালে এটাই হবে নাতো!
 বর্তমানে ভারতের উৎপাদিত খাদ্যাপণ্য উন্নত দেশে রপ্তানি করা দায় (ভেজাল) মানদণ্ডে আটকে যায় বারবার ! এরপরে এই শিক্ষা ব্যবস্থা চললে দেশের ইঞ্জিনিয়ারদেরও উন্নত দেশগুলো বয়কট করবে ভেজাল ইঞ্জিনিয়ার তকমা দিয়ে।  যে কর্মসংস্থানের কথা বলা হচ্ছে, তাতে মগজধোলাইকৃত কিছু সস্তা শ্রমিক পওয়া যাবে!

সুস্থ মূল্যবোধ এবং যুক্তিবাদী বৈজ্ঞানিক শিক্ষার প্রসারে রাজ্যসরকার গুলো এগিয়ে আসবে আশাকরি।  ভারতের সংবিধানে শিক্ষাকে কেন্দ্র রাজ্য যৌথভাবে দেখাবার দায়িত্ব দিয়েছে। সেই অধিকার থেকে রাজ্যসরকার এই ধর্মীয় মৌলবাদী অবৈজ্ঞানিক কুসংস্কারগ্রস্থ শিক্ষার গৈরিকীকরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।  শিক্ষায় স্থানীয় সংস্কৃতি ভাষা মূল্যবোধের অপরিসীম স্থান,  একে বাদ দিয়ে শিক্ষার পরিপূর্ণতা সম্ভব নয়। আর আমাদের ভারতীয় সংবিধানের ৪নং অনুচ্ছেদের 51/h "বৈজ্ঞানিক মানুসিকতার বিস্তার, মনুষ্যত্ব এবং সমাজে সত্যের খোঁজ"কে দেশের প্রত্যেকটি মানুষের সাংবিধানিক আবশ্যিক পালনীয় দায়িত্ব বা কর্তব্য দিয়েছে। তাই প্রত্যেক দেশবাসীর দায়িত্ব, এই অবৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গর্জে উঠে আমাদের দেশের সংবিধানকেই সন্মান জানানোর, ধর্মনিরপেক্ষতার মৌলিক অধিকারকে সুরক্ষিত রাখবার । "শিক্ষা আনে চেতনা", চেতনাই পারে শাষকের মুখোশ খুলে দিতে।  কবি সাহিত্যিক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর নিচের কবিতাটি  শেষকরি;
''বরং দ্বিমত হও,আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে।
বরং বুদ্ধির নখে শান দাও,প্রতিবাদ করো।
অন্তত আর যাই করো, সমস্ত কথায়
অনায়াসে সম্মতি দিও না।
কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়,
তারা আর কিছুই করে না,
তারা আত্নবিনাশের পথ পরিস্কার করে।''
                                       
                                    ।।সমাপ্ত।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ