বাচ্চাদের মোবাইল আসক্তি থেকে কিভাবে দূরে সরিয়ে রাখবেন ।। সর্নালী মন্ডল


মোবাইলের প্রতি বাচ্চাদের অতিমাত্রায় আসক্তি হয়ে যাচ্ছে, মোবাইলটা কিছুতেই রাখতে চাইছে না, বাচ্চারা অতিরিক্ত মাত্রায় মোবাইল ব্যবহার করছে, তার ফলে পড়াশোনা থেকে শুরু করে অন্যান্য জিনিস থেকে সে বিরত হয়ে যাচ্ছে।

তাহলে প্রথমে আমরা দেখে নিই এই আসক্তি মানে কি?


এই আসক্তি মানে হল যেখান থেকে আমরা কিছুতেই বের হতে পারছি না, কোনোকিছুর প্রতি বেশি আসক্তি এবং যেটা ক্ষতির কারণ।


মোবাইল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইলেকট্রনিক ডিভাইস, এটা আমরা সকলেই জানি। এটার অপকারিতার থেকে উপকারিতা বেশি। যেমন আমরা মোবাইলের সাহায্যে সারাবিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি, ইন্টারনেট থেকে অনেক কিছু জিনিস শিখতে পারছি, জানতে পারছি। ইন্টারনেটের সাহায্যে সারা বিশ্বের সঙ্গে কাজকর্ম করা যাচ্ছে। এর পাশাপাশি যখন আমরা মোবাইল মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করছি, প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রয়োজনীয় কাজকর্মে লিপ্ত হচ্ছে বাচ্চারা। তখন দেখা যাচ্ছে যে সেটা অপব্যবহারের পর্যায়ে যাচ্ছে।


বাচ্চারা এটা করার পিছনে কিছু কারণ আছে। সে জায়গা থেকে বাবা-মা-রা কি করে বাচ্চাদের অতি সহজে মোবাইল আসক্তি থেকে বের করে আনবে এটা একটা মূল বিষয়।


WHO-র রিপোর্ট অনুযায়ী ২ বছরের বা তার কম বয়সী বাচ্চাদের মোবাইল দেওয়াই উচিত নয়। আমরা কিন্তু তাদের মোবাইলটা ধরিয়ে দিয়েছি। এটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরবর্তীক্ষেত্রে আসক্তিতে পরিণত হতে পারে। যেমন মা বা বাবা কোনো একটা কাজ করছে বা কোনো একটা বিষয়ে ব্যস্ত আছে, সে তখন বাচ্চাকে মোবাইলটা ধরিয়ে দিচ্ছে গেম খেলার জন্য বা ভিডিয়ো দেখার জন্য। কারণ বাবা বা মা নিজের জন্য একটা ফ্রি টাইম পেতে চাইছে, সেই ফ্রি টাইম পাওয়ার জন্য বাচ্চাটিকে মোবাইল ধরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তারা এটা  ভাবছেন না যে এই মোবাইলটা যে বাচ্চাটির হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে এটা আগামীদিন বাচ্চাটির ক্ষতি হতে পারে। কারণ এইভাবে নিতে নিতে বাচ্চাটি অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। মোবাইলটি তখন তার নিত্যদিনের চাহিদায় পরিণত হবে, একটা অভ্যাস হয়ে যাবে মোবাইল ব্যবহার করার। এবং এইভাবে তার মোবাইলের প্রতি আসক্তি হয়ে যাবে।


প্রথমে সে বায়না করবে একঘন্টার জন্য, এরপর দু ঘন্টা তারপর তিনঘন্টা। এভাবে ক্রমশ বাড়তে থাকবে তার চাহিদা। তখন সেই অবস্থা থেকে তার মোবাইলের প্রতি আসক্তি জন্মাবে।


এই অবস্থাটা বাবা-মাকে বুঝতে হবে। অনেকসময় দেখা যায় বাবা বা মা-রা নিজেরাই ফেসবুক স্ক্রল করে বা ইউটিউবে ভিডিয়ো দেখে দিন কাটাচ্ছে। বাচ্চারা এটা প্রতিনিয়ত দেখছে। এবং তার কাছে একটা বার্তা যাচ্ছে যে বাবা বা মা মোবাইলে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা ইউটিউব দেখেই বেশিরভাগ সময় কাটায়, তাহলে আমারও একটা মোবাইল চাই। আমিও এগুলো করবো।


পরোক্ষে আমরাই বাচ্চাদের মোবাইল ব্যবহার করা শেখাচ্ছি। এই বিষয়গুলোর জন্য আমাদের নিজেদের মধ্যেও মোবাইল ব্যবহার করার সময় বেঁধে দিতে হবে। আমরা যদি নিজেরা মোবাইল ব্যবহার করার সময়সীমা বেঁধে দিই, তবে বাচ্চাদের বললে তারা শুনবে।


বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় বাচ্চাদের খাওয়ানোর সময় যখন বাচ্চারা খেতে চায় না তখন বাবা-মা-রা মোবাইলে গেম খেলতে দিয়ে বা কোনো একটা কার্টুন বা অন্য কোনো ভিডিয়ো চালিয়ে দিয়ে খাওয়াচ্ছে। এতেও বাচ্চার মোবাইলের প্রতি আসক্তি তৈরি হচ্ছে। খাওয়ানোর সময় প্রথম দিন শিশুটিকে মোবাইল দেওয়া হল, দ্বিতীয় দিনও তাকে মোবাইল দেওয়া হল, তৃতীয় দিন কিন্তু তখন শিশুটির ইচ্ছা হবে মোবাইল নেওয়ার। বায়না ধরবে মোবাইল দিলে তবেই খাবো। এবং এভাবেই সে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে মোবাইলের প্রতি।


এ অবস্থা থেকে শিশুটিকে বের করে আনার জন্য বাবা-মাকে প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকা বন্ধ করার মধ্য দিয়ে। প্রথমে আগে বাবা-মাকে পরিবর্তিত হতে হবে। আগে তাদের মোবাইলের প্রতি আসক্তি কমাতে হবে। তারা যদি নিজেরা পরিবর্তিত না হয়, তবে বাচ্চারও পরিবর্তন আসবে না। বাচ্চারা যদি দেখে বাবা-মা নিজেরাই মোবাইলের প্রতি আসক্ত, তবে বাচ্চারা কেন বাবা-মা-র কথা শুনবে। তাই ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনতে হবে।


খাওয়ার সময় মোবাইল দেওয়া চলবে না।


আগে যেমন বাচ্চারা মাঠে যেতে পারতো, খেলতে যেতে পারতো, এখন তা ক্রমশ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বাচ্চারা মাঠে যাচ্ছে না, বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে পারছে না। নতুন বন্ধু তৈরি হচ্ছে না। স্কুল থেকে ফিরে টিউশন তারপর আঁকার ক্লাস বা আবার পড়তে বসা। ফলে একটা সময়ের পর বাচ্চাদের মন ভালো লাগছে না। তখন তারা মোবাইলে গেম খেলা বা কম্পিউটারে গেম খেলার প্রতি মনোনিবেশ করছে। বর্তমানে বাচ্চাদের মধ্যে একটা বিষয় সৃষ্টি হচ্ছে তা হল বোরিং। যখন সে বোর ফিল করছে, তখন মোবাইলকে সে বন্ধু হিসেবে বা বোরিংনেস কাটানোর উপায় হিসেবে বেছে নিচ্ছে।


এক্ষেত্রে বাবা-মার উচিত বাচ্চাকে যেন খুব বেশি মানসিক চাপ না দেয়। এবং বিশেষ করে নিজের বাচ্চার জন্য সময় দেওয়া, কোয়ালিটি সময় দেওয়া, তাদের সঙ্গে খেলা- এটা প্রত্যেক বাবা-মার করা উচিত। বাচ্চার সঙ্গে কোয়ালিটি সময় কাটানো দরকার। বাচ্চাকে নিয়ে মাঠে যাওয়া বা খেলতে নিয়ে যাওয়া উচিত। এর মাধ্যমে বাচ্চার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটবে। বোরিং কাটবে।


তবে তারা যেন শুধুমাত্র এটাই চাহিদা না করেন যে বাচ্চাকে খেলতে নিয়ে যাচ্ছে মানে তাকে বড় ফুটবলার বা ক্রিকেটার হতে হবে। এই চাহিদা যেন তারা না করেন। এই চাহিদার ফলে বাচ্চার মনে একটা চাপ সৃষ্টি হবে, তারা স্বতস্ফূর্তভাবে খেলতে পারবে না। মাঠে খেলতে যাওয়াটা মনের, শরীরের বিকাশের জন্য জরুরি।


খাওয়ার সময় মোবাইল ব্যবহার করা ঠিক নয়। এমনকি পাশে নিয়েও খেতে বসা ঠিক নয়। কোনোরকম ইলেকট্রনিক গেজেট যেন সেখানে না থাকে। এরজন্য বাবা-মা খাওয়ার ঘরে নোটিশ ঝুলিয়ে দিতে পারে যে খাওয়ার সময় মোবাইল ব্যবহার বা ইলেকট্রনিক গেজেট ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এবং তারা যেন নিজেরাও তা না আনে।


যদি এরকম দেখা যায় যে আপনার জীবন সঙ্গী বা সঙ্গিনী খাওয়ার সময় মোবাইল ঘাঁটছে বাচ্চাটির সামনে, তখন আপনাদের নিজেকে নিজেরাই বারণ করুন। খাওয়ার সময় মোবাইল ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে বর্জন করুন।
এর ফলে বাচ্চাটির প্রতি কিন্তু একটা প্রভাব পড়বে। এবং সে বুঝতে পারবে যে খাওয়ার সময় মোবাইল ব্যবহার বন্ধ।


এটাও একটি বিষয় যে আজকের মতো ডিজিটাল যুগে বাচ্চাকে মোবাইল ফোন থেকে সম্পূর্ণ দূরে রাখা, মোবাইল সম্পর্কে অজ্ঞ রাখা এটাও কিন্তু চলবে না। কারণ বর্তমানে ডিজিটাল পড়াশোনা, মোবাইল ব্যবহার করে পড়াশোনা এসব হচ্ছে, সেক্ষেত্রে বাচ্চাটি মানসিকভাবে পিছিয়ে পড়বে। তাই মোবাইল ফোন তাকে অবশ্যই ব্যবহার করতে দিতে হবে। তবে সেই মোবাইল ব্যবহার একটা নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বেঁধে দিতে হবে। এবং আপনিও বাচ্চার মোবাইল ব্যবহারের দিকে লক্ষ্য রাখবেন। এক্ষেত্রে মোবাইলে প্যারেন্টিং কন্ট্রোল চালু করে রাখতে পারেন যেখানে বাচ্চাটি মোবাইলের কোন কোন অ্যাপস ব্যবহার করতে পারবে তা আপনি ঠিক করে দেবেন। মোবাইলের কাজকর্ম কি কি এ সম্পর্কে বাচ্চাকে বোঝানো দরকার।
এবং আপনি বাচ্চার সামনে যতটা সময় থাকবেন চেষ্টা করবেন আপনার মোবাইল ব্যবহার নিদিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বেঁধে রাখার। এবং তাকে আপনিও বলুন যে আমি কিন্তু আজ থেকে এতটুকু সময়ের মধ্যে মোবাইল ব্যবহার করছি এবং তুমিও এতটুকু সময় মোবাইল ব্যবহার করবে। এর থেকে বেশি সময় ধরে মোবাইল ব্যবহার করবে না। এর মধ্যে দিয়ে আপনি তাকে বোঝাতে পারবেন যে মোবাইল নির্দিষ্ট সময় ব্যবহার করতে হয়।


মনে রাখতে হবে আপনার থেকেই কিন্তু আপনার বাচ্চা শিখবে। 


মোবাইলটি যখন আপনি আপনার বাচ্চার হাতে দিচ্ছেন তা যেন গঠনমূলক কাজে বা ক্রিয়েটিভ কাজে ব্যবহৃত হয় সেটা নজর রাখবেন। আপনি তাকে একটা বুদ্ধিদীপ্ত খেলা বা নতুন কিছু শেখার বিষয় যেমন অরিগ্যামি বা গাছ লাগানোর ভিডিয়ো ইত্যাদি যখন দেবেন, তখন এসবের মধ্যে দিয়ে তার মনের বিকাশ ঘটবে।


কিছু গেম আছে যা অতিরিক্ত চাহিদার সৃষ্টি করে বা মনের মধ্যে নেগেটিভিটির সৃষ্টি করে, সেসব বিষয় থেকে আপনার বাচ্চাকে দূরে রাখবেন।
এবং চেষ্টা করুন মোবাইলের পরিবর্তে বই পড়ার মানসিকতা বাচ্চার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার। মোবাইলে কার্টুন দেখার পরিবর্তে কমিকস বা কোনো ছবি সম্বলিত বই পড়া বা ছবি আঁকা বা নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক বা দাবা খেলা বা কোনো কিছু অন্য খেলা শেখানো যেমন ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস এসমস্ত শরীর বৃত্তীয় গঠনমূলক বিষয়ে বাচ্চাকে লিপ্ত রাখুন।


এসমস্ত পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে আপনি বাচ্চাকে মোবাইলের আসক্তি থেকে দূরে রাখতে পারবেন।


- লেখক কাউন্সেলিং (counsellor) পেশায় যুক্ত। পড়াশোনায় অমনোযোগী বাচ্চাদের, ডিপ্রেসড মানুষদের কাউন্সেলিং করান।


Image Source: POPSUGAR Photography / Emily Faulstich
Product Credit: Left: Everlane sweatshirt, Gap sweatpants / Right: Marigot PJ shirt

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ