সোশ্যাল ডিস্টান্সিং বনাম শারীরিক ডিস্টান্সিং ।। সুমিত্রা পদ্মনাভন



সোশ্যাল অর্থাৎ সামাজিক দূরত্ব।

ইংরেজীতে দুটো শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে – সোশ্যাল ডিস্টান্সিং আর ফিজ়িকাল ডিস্টান্সিং। একই অর্থে। কিন্তু বাংলায়, এই দেশে সামাজিক দূরত্ব কথাটা যেন কেমন কেমন লাগছে। শারীরিক দূরত্ব রাখলেই তো যথেষ্ট। সামাজিক ভাবে আমরা কিন্তু আরও কাছাকাছি এসেছি, বা আসতে চাইছি। এবারের রবীন্দ্র-জয়ন্তী দেখে শুনেই মনে হচ্ছে এই সোশ্যাল মিডিয়া র কল্যাণে আমরা  যেন এবারে আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে পঁচিশে বৈশাখ কে উপভোগ করলাম। বেহালার পাঁচ বছরের ছোট্ট নাতাশা র গান একেবারে সামনে থেকে শুনলাম।  হাওড়া র ক্লাস ফাইভের সৃঞ্জয় যে এত ভাল আবৃত্তি করে, হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গায়, আর গড়িয়া র সেই বিদ্যাপীঠে পড়া মেয়েটি, যে কোথাও না শিখে এরকম অসাধারণ নাচে, সেটা কি চোখের সামনে দেখতে পেতাম!

সোশ্যাল মিডিয়া কাকে বলে? হোয়াটসাপ ফেসবুক ইত্যাদি। এগুলো কি মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখে? মোটেই না। এই লকডাউন বা ঘরবন্দীর সময় এই মিডিয়াগুলো আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে বলা যায়। এর খারাপ দিক বা গুজব ছড়ানোর কথাটা আরেকটা দিক – এটা আমার আলোচ্য নয়। কিন্তু খবর নেওয়া? আমার আত্মীয় বন্ধুদের খবর নেওয়া, অসুস্থ, একাকী বৃদ্ধ বৃদ্ধা দের বাড়িতে খাবার বা ওষুধ পৌঁছে দেওয়া – এগুলো আমরা করতে পারতাম না এইসব মাধ্যম ছাড়া। কত পুরনো পড়শি বা বন্ধুদের খবর পাচ্ছি আমরা নিয়মিত।

বারবার এই সামাজিক দূরত্ব রাখার কথাটা শুনতে ভাল লাগছে না। কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থেকে যাচ্ছে হয়ত। এই ছোয়াঁচে রোগের সঙ্ক্রমণ থেকে বাঁচতে পরস্পরের থেকে একটা বিশেষ দূরত্ব রাখার কথা বলছেন বিজ্ঞানী ও ডাক্তাররা। এক মিটার কি পারলে দু মিটার দূরত্বে থাকা, যখন বাইরে যাব। ভীড় না করা, কোন কিছু ছুঁলে হাত ধোয়া ও কিছু কিনলে সেগুলো ধুয়ে নেওয়া বাড়িতে এসে। আর ততক্ষণ নিজের হাত দিয়ে নাক, মুখ, চোখ, গাল বা চুল না ছোঁয়া, এই হচ্ছে নির্দেশ। ভেবে দেখলে এটা কিন্তু এমনিতেই কিছুটা করা উচিত। অনেক সর্দি কাশি ফ্লু ঠিক এইভাবেই ছড়ায়। আমরা রিকশাচালক বা দোকানীর থেকে দুরত্ব রাখছি মনে করে, আর পাড়ার মাসিমার সঙ্গে দেখা হলে এগিয়ে গিয়ে মুখের মাস্ক নামিয়ে গল্প করছি, ওনার হাতের জিনিস হয়ত ছুঁয়েও দেখছি। এগুলো আমাদের মজ্জায় আছে। কিন্তু না, নিয়মগুলো নির্লজ্জের মতই মানতে হবে  এখন। এটা ঠিক যে ঘরে আমরা পরিবারের মানুষের কাছাকাছি থাকছি, কারণ ধরে নিচ্ছি আমরা একই পরিবারে আছি, আর ঘরটা আর ঘরের জিনিসপত্র যথেষ্ট পরিস্কার বা নতুন ভাষায় বললে, স্যানিটাইজ় করা। ঠিক কথা। আর যারা খুব ঘন বসতি অঞ্চলে থাকেন, একই ঘরে হয়ত আট দশজন ঘুমোন, তারা? তারাও নিজের অঞ্চলের বাইরে যাবেননা। একজনও যদি পাড়ার বাইরে বেরোন, বা মোড়ের চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে যান, তাদেরও দরকার পুলিশের ধমকি, লাঠির ভয়, যথেষ্ট কারণ না দেখাতে না পারলে।  তারাও যখন ঘরে ঢুকবেন, সেই একই নিয়ম – হাত ধোয়া, কাপড় ছেড়ে কেচে দেওয়া ইত্যাদি; তার নিজের ও বাড়ির বাকিদের নিরাপত্তার জন্য।  

এবার মনে করি সেই ভদ্রলোকের কথা। যিনি কর্মসূত্রে নিজের জেলার বাইরে ছিলেন, আটকে পড়েছিলেন বাড়ির বাইরে, আমাদের দেশের আরো কয়েক লক্ষ(বিখ্যাত লেখিকা-সাংবাদিকের মতে এই সংখ্যাটা ৪৬ কোটি)পরিযায়ী শ্রমিকের মত। তার বেঁচে থাকার সমস্ত রসদ ফুরিয়ে যাওয়ার পর তিনি হাঁটতে শুরু করলেন। একশো তিরিশ কিলোমিটার হেঁটে পাঁচদিন পর পৌঁছলেন তার শ্বশুর বাড়ির গ্রামে। কাটোয়ার কাছে এই গ্রামে ছিলেন তার তিরিশ না পেরনো স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান। প্রথমে গ্রামের লোক ভিড় করে তাকে গ্রামে ঢুকতে বাধা দেয়, অপমানিত যুবক চঞ্চল মাঝি রাত্রে বাইরে রাস্তায় কাটান। পরের দিন হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে জানা যায় চঞ্চল বাবু সম্পূর্ণ সুস্থ। তারপরও গ্রামের লোক তাকে নিজের বাড়িতে ঢুকতে বারণ করলে ক্লান্ত, অপমানিত চঞ্চল আত্মহননের পথ বেছে নেন।

কি বোকা লোক বলুন! এই তুচ্ছ কারণে কেউ আত্মহত্যা করে...

আন্দাজ করতে পারি, দীর্ঘদিন ঠিকমত না খাওয়া, পাঁচদিন অতটা পথচলার শ্রম, ঘুমের অভাব – এইসমস্ত মিলে তার মস্তিষ্কের সহ্যক্ষমতাকে একেবারে তলানিতে নিয়ে গেছিল। তার সঙ্গে আরেকটা বড় কারণ আশাভঙ্গ। ও নিশ্চয়ই আশা করেছিল ওকে ফিরে পেয়ে চিন্তিত বাড়ির লোক খুশি হয়ে ওকে স্বাগত জানাবে, বাচ্চারা ছুটে আসবে। জানিনা বাচ্চাদের জন্যে ও ছোটখাট কিছু এনেছিল কিনা।... ও চেষ্টা করেছিল বেঁচে থাকার। দুদিন বাইরে কাটিয়ে, ডাক্তার দেখিয়ে ...

তার পরেও পাড়ার মাতব্বরেরা মনে করেছে ওকে ওর নিজের বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়াই সমীচিন। আচ্ছা কোথাও কি জায়গা হলনা ওর? কোনও বারান্দায়, উঠোনে, গাছের তলায়, কোন দোকান ঘরে? যেখানে ও দুরত্ব বজায় রেখে দুটো কথা বলতে পারবে, খেতে পারবে, বাচ্চাদেরকে দেখতে পারবে, বলতে পারবে ওর দীর্ঘ পদযাত্রার রোমাঞ্চকর কাহিনী আর ঘুমোতে পারবে? ও তো বীর! ও তো সুস্থ, অক্ষত শরীরে ফিরে এসেছে ওর পরিবারের কাছে! ওর একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়ে! না হয় সপ্তাহখানেক এরকম বনবাসে থেকে আবার ও ডাক্তার দেখিয়ে কোভিড পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিন্ত করতে পারত প্রতিবেশীদের।

এই যদি হয় একজন সুস্থ মানুষের প্রতি ব্যবহার, তাহলে সত্যি কেউ করোনা আক্রান্ত হয়ে সেরে উঠলে কী হবে? ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর মত? এটাকেই আমি বলব ‘সামাজিক’ দূরত্ব। মানবিক, সামাজিক বোধ যখন কাজ করেনা, তখন কেন করছি, কী করছি এসব মনে হয়না। ভূতের ভয়ের মত একটা আতঙ্ক, একটা অযৌক্তিক ভয় চালিত করে। আমরা তো রাস্তার কুকুর বেড়ালকেও ভালবাসি, খেতে দিই। ভালবাসতে হলে তো গায়ে হাত দেওয়ার দরকার হয়না। একটা পরিবারের মাথা, দুই শিশুসন্তানের পিতা – সুস্থ মানুষ, তাকেও আমরা মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারি! এটাই সোশ্যাল ডিস্টান্সিং! মানবিক ও সামাজিক দূরত্ব। শারীরিক দূরত্ব ডাক্তারদের কথা অনুযায়ী মেনে চলেও শ্রদ্ধা, ভালবাসা জানানো যায়, ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া যায় জায়গা মত। ও তো অপরাধ করেনি কোনো, ও অসুস্থ নয়, তবু এত ঘৃণা? আমি বলছি ও অসুস্থ হলেও ঘৃণা করার কোন কারণ থাকত না। অসুখ যে কারুরই হতে পারে। নিয়মগুলো মানলেই তো হল।

এটাকে কী বলবেন? কোভিডে মৃত্যু? আরো শুনলাম চেন্নাই তে এক মৃত ডাক্তারের সৎকারে বাধা – আম্বুলেন্স চালককে পেটানো হল এমন, সে আহত হয়ে পালিয়ে গেল। এক বন্ধু ডাক্তার গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলেন মৃত ডাক্তারের শব অন্য কোনো গোরস্থানে! তার পরেও পিছু ছাড়েনি ক্ষুব্ধ জনতা! এগুলোই অন্ধ, অযৌক্তিক সামাজিক বয়কট।

বিশেষ করে আমাদের দেশে সামাজিক বয়কটের ইতিহাস সুপ্রাচীন। ছায়া মাড়ানো বারণ, এক কুয়ো থেকে যে কেউ জল খেতে পারবেনা। ছুঁয়ে দিলে গঙ্গাস্নান করতে হয় – ইত্যাদি সবই নোংরার প্রতি ঘৃণা, রোগের ভয় ইত্যাদি থেকে শুরু হয়ে আধা জানা অযৌক্তিক আতঙ্ক ও দূরে সরিয়ে রাখাতে প্রতিষ্ঠিত হয়। হয়ে এসেছে।

জাতিগতভাবে ঘৃণা ছড়িয়ে যাওয়ার মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর অন্যায় বাসা বাঁধে। যখন দেখি হাসপাতালে মৃত মানুষ কোন বেড এ শায়িত, তখন খারাপ লাগে ঠিকই, কিন্তু হাসপাতাল বা ডাক্তারদের ওপরে রেগে হিংস্র হয়ে ওঠার কোনো যুক্তি খুঁজে পাইনা। আরে একজন মৃত মানুষ তো হাঁচতে বা কাশতে পারবেন না। তার সর্ব শরীর যদি ব্যাগের মধ্যে শক্ত করে বাঁধাছাঁদা থাকে, সে কার কী ক্ষতি করতে পারে? সম্প্রতি মুম্বইয়ের এক হাসপাতালে এরকম এক দৃশ্যের ছবি দেখলাম। সেখানে অজস্র বডি-ব্যাগে বাঁধা মৃতদেহ, অন্যান্য রোগীদের মধ্যে মধ্যে পড়ে আছে। হয়ত গাড়ি বা লোক আসতে দেরি হচ্ছে – কতক্ষণ পড়ে ছিল তাও জানা নেই। বড় জোর বলা যায় করপোরেশনের লোক পেরে উঠছেনা। শুধু শুধু বেড আটকে আছে, এই পর্যন্ত।

 সাধারণ জনতার এই আতঙ্ক থেকে পিপিই পরা কর্মচারীদেরও এই অদ্ভূত ভয় আরও জটিলতার সৃষ্টি করে। একটি মেয়ে লিখছে – ‘আমার মা কি অচ্ছুত?’ হাসপাতালের কর্মীরা হাত লাগাতে দেরি বা অস্বীকার করায় কোভিড পজিটিভ মা কে মেয়ে নিজের হাতে এম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে স্ট্রেচারে তুলতে বাধ্য হয়।

এরকম হাজারো উদাহরণ ছড়িয়ে আছে গত দু মাসের দৈনিক সংবাদপত্রে।

নাহ, আমাদের আরও সোচ্চার হতে হবে। হাত ধোয়া, দূরত্ব রাখার ব্যাপারটা আরো ভাল করে বুঝতে ও বোঝাতে হবে। তার সঙ্গে আসুন মনে করিয়ে দিই সবাইকে – ব্যাপারটা শারীরিক দূরত্ব, সামাজিক বা মানসিক দূরত্ব নয়। স্বাস্থ্যের খাতিরে এমনিতেই অনেক সময়ে এটা আমরা করে থাকি, বা করা উচিত। উদাহরণ চাই? সদ্যোজাত শিশুকে দেখতে গেলে সাবান দিয়ে হাত না ধুয়ে, পরিষ্কার জামা কাপড় না পরে, শিশুকে কোলে নেওয়ার কথা ভাবিনা। হাসপাতালে রোগী দেখতে গেলে রোগীর বিছানায় বসিনা, ঘরে বেশি লোকে ভীড় করিনা। এর সঙ্গে ঘৃণার কোন যোগ নেই। 

আসুন কোভিডের ক্ষেত্রে  'সামাজিক ' দূরত্ব কথাটা প্রথমেই তুলে দিই। এইসব নাটকীয় ঘটনা দেখলেই প্রতিবাদ করি, মানুষকে বোঝাই। একটু ব্যালেন্স রেখে চলার চেষ্টা করি এই একুশ শতকে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ