ধূমকেতুর নাম নজরুল ।। রানা চক্রবর্তী



তখন ব্রিটিশ শাসন চলছে পুরো ভারতে। স্বাধীন ভারতে স্বাধীনতার দাবি জোরালো হচ্ছে ধীরে ধীরে। লেখক-বুদ্ধিজীবীরা লিখে যাচ্ছেন ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে, জোরালো দাবি জানাচ্ছেন ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শাসকদের নির্যাতন, নিপীড়ন। নিষিদ্ধ হচ্ছে বিভিন্ন লেখকের বইপত্র, প্রবন্ধ-নিবন্ধ। অনেকের মতো দেশদ্রোহীতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় নজরুলের বই। বাজেয়াপ্ত করা হয় তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতা ও প্রবন্ধের বই। শুধু তা-ই নয়, তাঁর সংবাদ সংগ্রহের জন্য পেছনে লাগিয়ে দেওয়া হয় গোয়েন্দা।

একদিনের ঘটনা, নজরুল গেছেন কবি সুফিয়া কামালের বাড়িতে। বসেছে গানের আসর। সেখানে একজন গোয়েন্দাও ছিলেন। তাঁকে উদ্দেশ করে নজরুল কবিতা আওড়ালেন, ‘তুমি টিকটিকি, জানি ঠিকঠিকিই।’ ব্যঙ্গ কবিতা শুনে গোয়েন্দাটি রাগ করে উঠে যেতেই কিশোরী সুফিয়া কামাল অবাক হয়ে বললেন, ‘দাদু তুমি একে চিনলে কী করে?’ ‘গায়ের গন্ধে। বড়কুটুম যে।’ নজরুলের উত্তর।
                       
সময়টা ১৯২২ সাল। কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা অফিসে সকাল সকাল আড্ডা জমেছে। অনেকের সঙ্গে সে দিন সেখানে উপস্থিত কমরেড মুজাফফর আহমেদ। হঠাৎ দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে একসঙ্গে অনেক জুতার শব্দ শুনে আড্ডা ভাঙল। মুজাফফর আহমেদের কথায়, “পুলিশ এসেছে ‘ধূমকেতু’র অফিসে তল্লাসী ও কাজী নজরুলের নামে গ্রেফতারের পরওয়ানা নিয়ে। … নজরুল তখন কলকাতায় নেই গিয়েছে সমস্তিপুরে, পুলিশ আমাদের গভার্মেন্ট অর্ডার দেখালো যে, ২৬শে সেপ্টেম্বর (১৯২২) তারিখের ‘ধূমকেতু’তে প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ (কাজী নজরুলের লেখা) শীর্ষক কবিতা ও ‘বিদ্রোহীর কৈফিয়ৎ’ (অধ্যাপক শ্রী সাতকড়ি মিত্রের ছোট বোনের লেখা) শীর্ষক একটি ছোট লেখা বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে।”

‘বসন্ত'র একটি কপিতে নিজের নামটি লিখে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘তাকে বোলো, আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে আমার সমগ্র অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বোলো, কবিতা লেখা যেন কোনো কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে, কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জাগাবার কবিও তো চাই।’’ সে সময় সরকারবিরোধী ব্যঙ্গধর্মী কবিতা-রচনার অপরাধে অভিযুক্ত সেই রাজবন্দি ব‌ইটি পেয়েই বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন এবং সেই প্রস‌ঙ্গে তিনি লিখেছিলেন - ‘‘এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নাটক আমাকে উৎসর্গ করেন। তাঁর এই আশীর্বাদ মালা পেয়ে আমি জেলের সর্বজ্বালা, যন্ত্রণা ক্লেশ ভুলে যাই।’’ হয়তো কবিগুরুর কাছে কবি স্বীকৃতি পাওয়ার প্রেরণাতেই সেই আলিপুর জেলে তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা, ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’। সেই কবিতায় তিনি লিখেছিলেন - ‘‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে/মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে/আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।’’

নতুন করে বলবার অপেক্ষা রাখে না সেই সৃষ্টি সুখের উল্লাসে যিনি মেতেছিলেন তিনি ছিলেন কবি নজরুল ইসলাম। ইংরেজি ১৯২২ সাল ১২ই অগস্ট দিনটিতে ‘ধূমকেতু’ নাম নিয়ে কলকাতার ৩২ নম্বর কলেজ স্কোয়ার থেকে প্রকাশিত হল একটি অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা। পৃষ্ঠা সংখ্যা আট। প্রতি সংখ্যার নগদ মূল্য এক আনা এবং বার্ষিক পাঁচ টাকা। সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের অচলায়তনকে ভেঙেচুরে নতুন যুগচেতনায় দেশবাসীদের উদ্বুদ্ধ করার পবিত্র সংকল্প নিয়ে ধূমকেতুর সারথিরূপে মূর্ত বিদ্রোহ নজরুল আর্বিভূত হলেন। ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যায় তিনি লিখেছিলেন - ‘দেশের যারা শত্রু, দেশের যা কিছু মিথ্যা, ভন্ডামি, মেকি তা সব দূর করতে ‘ধূমকেতু’ হবে আগুনের সম্মার্জনী।

হিন্দু মুসলমানের মিলনের অন্তরায় বা ফাঁকি কোনখানে তা দেখিয়ে দিয়ে এর গলদ দূর করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য। রবীন্দ্রনাথ‌ও সম্পাদক নজরুলের ‘ধুমকেতু’কে আশীর্বাদ জানিয়ে স্ফুলিঙ্গের ১৭তম কবিতায় লিখেছিলেন - ‘‘আয় চলে, আয় রে ধুমকেতু/ আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু/ দুর্দিনের ঐ দুর্গশিরে/ উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন’’। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের ব্যর্থতায় ঝিমিয়ে পড়া ও নৈরাশ্যপীড়িত বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য ধূমকেতু যে দুরূহ ও দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার।

১৩২৯ সালের ১৭ই কার্তিক তারিখের ধূমকেতুর সম্পাদকীয় প্রবন্ধ   নিশান বরদার পতাকাবাহীতে  তিনি লিখেছিলেন - ‘ওঠো ওগো আমার নির্জীব ঘুমন্ত পতাকাবাহী বীর সৈনিক দল। ওঠো, তোমাদের ডাক পড়েছে, রণ-দুন্দুভি রণ-ভেরী বেজে উঠেছে। তোমার বিজয় নিশান তুলে ধরো। উড়িয়ে দাও উঁচু করে, তুলে দাও যাতে সে নিশান আকাশ ভেদ করে উঠে। পুড়িয়ে ফেল এ প্রাসাদের উপর যে নিশান বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে তোমাদের উপর প্রভুত্ব ঘোষণা করছে‌। ... বল আমরা সিংহশাবক, আমরা খুন দেখে ভয় করি না।’ ধূমকেতুর পুচ্ছ তাড়নায় অস্থির হয়ে অত্যাচারী ব্রিটিশ সরকার নজরুলের কণ্ঠরোধ করার ফিকির খুঁজতে লাগল। নজরুল কিন্তু ভয়হীন চিত্তে অগ্নিগর্ভ প্রবন্ধ, কবিতা, হাস্য- কৌতুক প্রভৃতির মধ্য দিয়ে এক দিকে শাসক শ্রেণীর অত্যাচার, অবিচার ও শোষণ এবং অপর দিকে হিন্দু-মুসলমান সমাজের জড়তা, দুর্নীতি ও ভন্ডামির বিরুদ্ধে তাঁর শক্তিশালী লেখনী চালিয়ে যান। ‘ধূমকেতু’তে প্রকাশিত অনেক রচনার জন্যই নজরুলকে রাজদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা যেত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পূজা সংখ্যায় প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’র জন্য তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহমূলক মোকদ্দমা আনা হয়। ১৯২২ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর দ্বাদশ সংখ্যা  ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ শীর্ষক কবিতায় তিনি লিখেছিলেন - ‘‘আর কত কাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?/ স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি-চাঁড়াল/ দেব শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি/ ভূ-ভারত আজ কসাইখানা—আসবি কখন সর্বনাশী?’’ এর পর ইংরেজ সরকার আর হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেনি।                                       
১৯২২ সালের ৮ই নভেম্বর সকাল বেলা ৭ নম্বর প্রতাপ চাটুজ্যে লেনের  ‘ধূমকেতু’র অফিসে এক দল পুলিশ হানা দিয়ে নজরুলের খোঁজ করে। তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি দন্ডবিধি আইনের ১২৪ (ক) এবং ১৫৩ (ক) ধারা মতে রাজদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছিল। কিন্তু নজরুলকে না পেয়ে  অফিসে তল্লাশি চালিয়ে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ (বারোশো সংখ্যা) ও লীলা মিত্রের কবিতা ‘বিদ্রোহীর কৈফিয়ৎ’ (পনেরোশো সংখ্যা) বাজেয়াপ্ত করে। এর পর পুলিশ ধূমকেতুর প্রকাশক ও মুদ্রাকর আফজালুল হককে গ্রেফতার করেন। কিছু দিন পর ১৯২২ সালের ২৩শে নভেম্বর কুমিল্লা থেকে কবিকে আটক করে  পরদিন কলকাতায় নিয়ে আসা হয় ও প্রেসিডেন্সি জেলে রাখা হয় এবং ওই দিনে ‘যুগবাণী’ গ্রন্থটিকেও বাজেয়াপ্ত করা হয়।

১৯২২ সালের ২৫শে নভেম্বর কোমরে দড়ি ও হাতে হাতকড়া পরিয়ে কবিকে চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইন হোর এজলাসে হাজির করা হলে, ২৯শে নভেম্বর শুনানির দিন ধার্য করা হয়। নজরুলের পক্ষ সমর্থন করে সলিল মুখোপাধ‍্যায়-সহ বেশ কয়েক জন আইনজীবি এগিয়ে আসেন। ১৯২৩ সালের ৭ই জানুয়ারি রবিবার দুপুরে প্রেসিডেন্সি জেলে বসে আত্মপক্ষ সমর্থনে রচনা করেন, ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’। ৮ই জানুয়ারি তা কোর্টে পেশ করা হয়।  তিনি লিখেছিলেন - ‘আমার ওপর অভিযোগ আমি রাজ বিদ্রোহী, তাই আমি আজ রাজ কারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত। ... আমি কবি, আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। তা রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পার, ধর্মের আলোকে, ন্যায়ের দুয়ারে তা নিরপরাধ, নিষ্কলুষ, অম্লান, অনির্বাণ, সত্য ও সুন্দর। ... সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এ বার ভগবানের হাতে অগ্নি মশাল হয়ে অন্যায়-অত্যাচার দগ্ধ করবে।’ আদালতে কবির সেই জবানবন্দী সাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্য নজির হয়ে থাকলেও তাঁকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

প্রেসিডেন্সি জেলে বিচারাধীন বন্দি হিসাবে কিছু দিন থাকার পর, ১৬ই জানুয়ারি ১৯২৩ সালে, নজরুলের এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ হল। পরদিন, ১৭ই জানুয়ারি সাজাপ্রাপ্ত বন্দি হিসাবে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। এরপর হুগলি জেল হয়ে নজরুলকে বহরমপুর জেলে আনা হল ওই বছরের ১৮ই জুন।

হুগলি জেলে নজরুল প্রথমে বিশেষ শ্রেণীর কয়েদির মর্যাদা পাননি, যদিও রাজনৈতিক বন্দি হিসাবে তা তাঁর প্রাপ্য ছিল। হুগলি জেলে নজরুলের ৩৯ দিনের অনশন আলোড়ন তুলেছিল সারা বাংলায়। এই অনশনের পর নজরুলকে বিশেষ শ্রেণির কয়েদি হিসাবে গন্য করার নির্দেশ আসে। কিন্তু সে নির্দেশ কার্যকর করা হয়নি।

সে দিক দিয়ে বহরমপুর জেল ছিল অনেকটাই অন্যরকম। এখানে তিনি বিশেষ শ্রেণীর  কয়েদি হিসাবেই আসেন। যদিও নজরুল এখানেও সাধারণ কয়েদিদের মতোই পোশাক পরতেন। এই জেলের পরিবেশ নজরুলকে খুশি করেছিল। জেলে থাকাকালীন মুজফফর আহমদকে গোপনে লেখা একটা চিঠিতে রয়েছে, বহরমপুর জেলে তাঁর ভাল থাকার কথা। সে সময় বহরমপুর জেলের সুপার ছিলেন বসন্ত ভৌমিক। বসন্তবাবু ছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রফুল্লকুমার সরকারের  ভগ্নিপতি। নজরুলের লেখাপত্রের খোঁজ তিনি ভালই জানতেন। নজরুলের প্রতি তাঁর মনে যথেষ্ট সহানুভূতি ছিল। তিনি নজরুলকে একটা হারমোনিয়াম জোগাড় করে দিলেন। আর কবিকে কে পায়? চলল গান। জেলের ভিতরের বন্দিরা শুধু নয়, বাইরেও লোকেরা দাঁড়িয়ে নজরুলের গান শুনতে লাগল। হুগলি জেল থেকে নজরুলকে আনার কারণ ছিল, সেখানে বন্দিদের উপর নজরুলের ক্রমবর্ধমান প্রভাব।  বহরমপুরে এসে বাড়ল বই কমল না।

এ দিকে গানের সঙ্গে কবিতা লেখাও চলছে। তাঁর সব লেখাই গোপনে চলে যাচ্ছে বাইরে। ‘প্রবাসী’ সম্পাদক নজরুলের ছোট বড় যে কোনও কবিতার জন্য দশ টাকা দিয়ে তাঁকে উৎসাহিত করতে লাগলেন। উল্লেখ্য, সে সময় একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কেউই কবিতার জন্য টাকা পেতেন না। এরই মধ্যে আর্য পাবলিশিং হাউস থেকে ওই ১৩২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বের হল নজরুলের ‘দোলনচাঁপা’ কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থের ১৯টি কবিতা জেলে বসেই নজরুল লেখেন। এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটা বহরমপুর জেলে বসে লেখা। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় ওয়ার্ডারদের সাহায্যে কবিতাগুলো বাইরে  আনেন। ‘দোলনচাঁপা’র প্রুফ দেখা, ভূমিকা লেখার (‘দুটি কথা’ শিরোনামে) কাজও করেন পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়।
                                
বহরমপুর জেলে বসে নজরুলের সবচেয়ে বড় সাহিত্য কীর্তি সহবন্দী পূর্ণ দাসের অনুরোধে একটি নাটক লেখা। পূর্ণ দাস বাইরে গিয়ে একটি চারণদল গঠন করবেন, সেই চারণ দলের অভিনয়ের উদ্দেশ্যে তিনি নজরুলকে একটা নাটক লিখে দেবার অনুরোধ  করেন। এই নাটক লেখার কথা নজরুল বলেন মুজফফর আহমদকে, চিঠিতে। অন্যান্য রচনার মত এ রচনাও জেলের বাইরে পাচার হয়। কিন্তু তার পর এর আর হদিশ মেলে না। নাটক হারিয়ে গেলেও এই নাটকের একখানা গান কিন্তু রক্ষা পায়। সে গান এখন বিখ্যাত। ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছে জুয়া।’

তবে বহরমপুর জেলের জীবন একেবারে নিষ্কন্টক ছিল না। প্রিজন অ্যাক্ট ভাঙার অপরাধে নজরুলের বিরুদ্ধে এখানেই আবার একটা মামলা হল। ওই বছরেরই ১০ই ডিসেম্বর তাঁকে হাজির করা হল বহরমপুরের সাব ডিভিসনাল ম্যাজিস্ট্রেট এন কে সেনের আদালতে। এ দিন বহরমপুর কবির পাশে দাঁড়িয়ে অনন্য নজির স্থাপন করল। ব্রজভূষন গুপ্তের নেতৃত্বে শহরের হিন্দু মুসলমান উকিলেরা কবির হয়ে লড়াই  করলেন। পুলিশের অনুরোধে ১৪ই ডিসেম্বর পরবর্তী মোকদ্দমার দিন পড়ল। কিন্তু সে মোকদ্দমা ১০ তারিখের কথা মনে করেই হোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক সরকার আর চালিয়ে নিয়ে যেতে চাইল না। ১৫ই ডিসেম্বর মুক্তি পেলেন নজরুল। নজরুল মেয়াদ শেষ হবার আগে মুক্তি পেয়েছিলেন, এমন ভাববার কিন্তু কোনও কারণ নেই। মুজফফর আহমদ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, জেল আইন অনুসারে সে সময় মাসে  তিন দিন করে রেমিশন পাওয়া যেত। সেই হিসাবে দশ মাসে তিনি  ত্রিশ দিন রেমিশন পেয়ে ঠিক সময়েই জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন। মুক্তির দিন কৃষ্ণনাথ কলেজের ছেলেরা মিছিল করে নজরুলকে নিয়ে গেলেন সায়েন্স মেসে। পরে নজরুল এসে উঠলেন নলিনাক্ষ সান্যালের বাড়িতে। এখানে সেসময় কয়েকটা দিন তিনি থেকেও গেলেন। নজরুলের জনপ্রিয়তা  তখন তুঙ্গে। যে ক’দিন তিনি এখানে ছিলেন বহরমপুরের যুব সম্প্রদায় নজরুলের গান দিয়ে শহর মুখর করে তুলেছিল।

নজরুলের কারাজীবনে পূর্ণ দাস, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রমুখ যাঁরা তাঁর সহবন্দি ছিলেন বহরমপুর জেলে, সকলের কাছেই জেলজীবন নজরুলের গানের স্পর্শে, প্রাণের উচ্ছলতায় অন্যরকম হয়ে উঠেছিল। আর বহরমপুরের মানুষ কবির  কারাবাস কালে তাঁর পাশে থাকতে পেরে, কারাবসানে তাঁকে সম্বর্ধিত করতে পেরে হয়েছিল ধন্য। সেদিনের সেই ঘটনা সেই মফস্বল শহরে আজও, প্রায় শতবর্ষ পরেও কিন্তু রয়ে গেছে এক টুকরো গর্বের ইতিহাস হয়ে।
                         
১৯২২ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত কাজী নজরুল ইসলামের পাঁচটি বই বাজেয়াপ্ত করা হয়। বাজেয়াপ্ত না হলেও দেশদ্রোহীতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় তাঁর আরও কিছু বই।

নজরুলের প্রথম যে বইটি নিষিদ্ধ হয় তার নাম ‘যুগবাণী’। ১৯২২ সালে ফৌজদারি বিধির '৯৯এ' ধারানুসারে বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। তৎকালীন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ‘যুগবাণী’কে একটি ভয়ংকর বই হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়, লেখক বইটির মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রচার করছেন। ‘ক্রীতদাস মানসিকতার’ ভারতীয় জনগণকে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে শাসনভার দখলের মন্ত্রণা জোগাচ্ছেন। ‘নবযুগ’ পত্রিকায় লেখা কাজী নজরুল ইসলামের কয়েকটি নিবন্ধনের সংকলন ‘যুগবাণী’।

এর ঠিক দুই বছর পর ১৯২৪ সালে নজরুলের দুটি কবিতার বই পরপর নিষিদ্ধ হয়। প্রথমে ‘বিষের বাঁশি’; তৎকালীন বেঙ্গল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত পাবলিক ইন্সট্রাকশন বিভাগকে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করেন, ‘লেখক বিষের বাঁশির মাধ্যমে তার বিপ্লবী অনুভূতির প্রকাশ করেছেন এবং তরুণদের বিদ্রোহ করতে এবং আইন অমান্য করতে প্ররোচনা দিচ্ছেন…।’ অপরাধ তদন্ত বিভাগের স্পেশাল ব্রাঞ্চকে প্রকাশনাটির দিকে দৃষ্টি দিতে সুপারিশ করেন তিনি। দত্তগুপ্তের সুপারিশ বিফলে যায়নি। ১৯২৪ সালের ২২শে অক্টোবরের গেজেট ঘোষণায় ‘বিষের বাঁশি’ নিষিদ্ধ হয়।

‘বিষের বাঁশি’র প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদটি ছিল অপূর্ব। একটি কিশোর হাঁটু মুড়ে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে। তাঁকে জড়িয়ে আছে বিশাল এক বিষধর সাপ। কিন্তু কিশোরের চোখেমুখে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। আর তার বাঁশির সুরে জেগে উঠছে নতুন দিনের সূর্য। এরপর ‘ভাঙার গান’ বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয় ১৯২৪ সালের ১১ই নভেম্বর।

নিষিদ্ধ ঘোষণা করেও বই দুটির প্রচার বন্ধ করা যায়নি। কবিতার বই দুটি সংগ্রহে যুবকদের আগ্রহের অন্ত ছিল না। ‘বিষের বাঁশি’ ও ‘ভাঙার গানে’র সুরে তরুণেরা তখন মাতোয়ারা।

‘প্রবাসী’র মতো অভিজাত পত্রিকা বিষের বাঁশির প্রশংসা করে লিখেছিল, “কবিতাগুলি যেন আগ্নেয়গিরি, প্লাবন ও ঝড়ে প্রচণ্ড রুদ্ররূপ ধরিয়া বিদ্রোহী কবির মর্মজ্বালা প্রকটিত করিয়াছে। জাতির এই দুর্দিনে মুমূর্ষু নিপীড়িত দেশবাসীকে মুত্যুঞ্জয়ী নবীন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করিবে।”

এরপর সরকারি রোষের কোপে পড়ে কাব্যগ্রন্থ ‘প্রলয় শিখা’। কবির মনোজগতে তখন তোলপাড় চলছে। প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র বুলবুল মারা গেছে। বিদ্রোহ-বিপ্লবের পুরোধা কবি কেঁদে কেঁদে আকুল। চোখে জল কিন্তু বুকে আগুন। সেই আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ল ‘প্রলয় শিখা’র প্রতিটি শব্দে। বিদ্যুৎ গতিতে ‘প্রলয় শিখা’ ছুটলো পুরো বাংলায়। পুলিশ গোয়েন্দাদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। তড়িৎ গোপন বার্তা চালাচালি হতে লাগেলো। তৎকালীন পাবলিক প্রসিকিউটর রায়বাহাদুর তারকনাথ সাধু ‘প্রলয় শিখা’ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে তৎকালীন কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি কমিশনারকে জানান বইটি ভারতীয় পেনাল কোডের '১৫৩এ' ও '১২৪এ' ধারা ভঙ্গ করেছে। তাই বইটিকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ ঘোষণার পরামর্শ দেন তিনি। এর ভিত্তিতে সেই সময়কার পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট বইটকে অবিলম্বে বাজেয়াপ্ত করার জন্য ১৯৩০ সালের ১৫ই সেপ্টম্বর মুখ্য সচিবকে জরুরি চিঠি দেন। ‘প্রলয় শিখা’ আনুষ্ঠানিকভাবে বাজেয়াপ্ত হয় ১৯৩১ সালে।

‘প্রলয় শিখা’র রেশ কাটতে না কাটতে বাজেয়াপ্তের খড়্গ নেমে আসে চন্দ্রবিন্দুর ওপর। এটি মূলত ব্যঙ্গ বিদ্রূপের কবিতার বই। তৎকালীন সময়ের সমাজ ও রাজনীতির প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, শ্লেষপূর্ণ হাস্যরস ফুটে উঠেছে এর প্রতি ছত্রে। এর দুটি কবিতা …

“মসজিদ পানে ছুটিলেন মিঞা মন্দির পানে হিন্দু,
আকাশে উঠিলো চির জিজ্ঞাসা করুণ চন্দ্রবিন্দু।’’

“কাফ্রি চেহারা ইংরিজি দাঁত,
টাই বাঁধে পিছে কাছাতে
ভীষণ বম্বু চাষ করে ওরা অস্ত্র আইন বাঁচাতে।”

চন্দ্রবিন্দু নিষিদ্ধ হয় ‘প্রলয় শিখা’ নিষিদ্ধ হওয়ার এক মাস পর ১৪ই অক্টোবর ১৯৩১ সালে। নজরুলের অন্যান্য নিষিদ্ধ বইয়ের মতো এটিও ভারতীয় দণ্ডবিধির '৯৯এ' ধারা অনুসারে বাজেয়াপ্ত করা হয়।
উল্লিখিত পাঁচটি গ্রন্থ ছাড়াও ‘অগ্নিবীণা’, ‘ফণিমনসা’, ‘সঞ্চিতা’, ‘সর্বহারা’, ‘‍রুদ্রমঙ্গল’ প্রভৃতি বই ব্রিটিশ সরকারের কোপানলে পড়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত এগুলো বাজেয়াপ্ত হয়নি।
                              
বাংলা কবিতা আধুনিক হয়েছে যে সব কবির মাধ্যমে বলা বাহুল্য কাজী নজরুল ইসলাম তাঁদের মধ্যে অন্যতম। কবিতার আধুনিকতা সময়ের দিক থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আর ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্রপ্রভাবমুক্তি প্রয়াসী। সত্য-শিব-সুন্দরের পূজারি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন জগৎ ও জীবনের প্রতি চরমভাবে আস্থাশীল। আধুনিক কবিরা এহেন রবীন্দ্রদর্শনকে অতিক্রম করতে চাইলেন। কাজটি বড় সহজ ছিল না। কিন্তু রবীন্দ্রপ্রভাবিত কাব্যজগতে তাঁরা নিজ নিজ স্বতন্ত্র কবিসত্তা গড়ে তুললেন। সকলেরই লক্ষ্য জগতের ছেঁড়াখোঁড়া বাস্তবকে কবিতায় তুলে ধরা। সেদিক থেকে নজরুল সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্রোহ ঘোষণা করেই বাংলা কাব্যে তাঁর স্বতন্ত্র কবিবৈশিষ্ট্য গড়ে তুললেন।

বর্ধমানের চুরুলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন নজরুল।  ফকির আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী জাহেদা খাতুনের পর পর চার পুত্রের মৃত্যুর পরে নজরুলের যখন জন্ম হল, তাঁর নাম রাখা হল ‘দুখু মিঞা’। মাত্র আট বছর বয়সেই বাবাকে হারান। স্কুলে পড়াকালীনই তিনি গল্প ও কবিতা লিখতে শুরু করেন। স্কুলের পড়া শেষ না করেই কাজী নজরুল ইসলাম (২৫/০৫/১৮৯৯ - ২৯/৮/১৯৭৬) ৪৯ নম্বর বাঙালি রেজিমেণ্টে সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়ে মেসোপটেমিয়ায় যান (১৯১৭)।  সেখানে বাঙালি পল্টনের মুসলমান সেনাদের তদারকির কাজে এক জন পাঞ্জাবি মৌলবী যুক্ত ছিলেন। তাঁর মুখে হাফিজের কবিতা শুনেই মুগ্ধ নজরুল মৌলবী সাহেবের কাছে ফারসি শিখতে থাকেন। সৈনিক কবির প্রথম উল্লেখযোগ্য কবিতা হাফিজের অনুসরণেই - ‘‘নাই বা পেল নাগাল, শুধু সৌরভেরই আশে/ অবুঝ সবুজ দূর্বা যেমন যুঁইকুঁড়িটির পাশে/ বসেই আছে— তেমনি বিভোর থাক্ রে প্রিয়ার আশায়,/ তার অলকের একটু সুবাস পশবে তোরও নাসায়।’’

কবি দেশে ফিরলেন দু’বছর পরে অর্থাৎ ১৯১৯ সালে। ক্রমে সওগাত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, প্রবাসী ইত্যাদিতে কবিতা লিখে কলকাতার সাহিত্যমহলে তিনি সুপরিচিত হলেন। ১৯২২ সালে ‘বিজলী’ পত্রিকায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে তিনি আলোড়ন ফেলে দিলেন। মুজফ্ফর আহমেদের সঙ্গে যৌথ ভাবে সম্পাদনা করলেন ‘নবযুগ’ পত্রিকা। তার পরে প্রকাশ করলেন ‘ধূমকেতু’ (১৯২২) পত্রিকা। এখানেই তাঁর ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি প্রকাশ হলে প্রবল প্রতিবাদী সত্তার অজুহাতে তাঁকে কারারুদ্ধ করে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। ইতিমধ্যে তাঁর ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যটিও (১৯২২) প্রকাশিত হয়েছে।

সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েও নজরুল তাঁর সৃষ্টির কাজে অনড় থাকলেন। হুগলি জেলে বন্দিদের উপর অকথ্য অত্যাচার শুরু হলে অন্য বন্দিদের সঙ্গে নজরুলও অনশন শুরু করেন। রবীন্দ্রদর্শন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাইলেও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কিন্তু নজরুলকে বুকে টেনে নিয়েছেন। আবার রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর অন্তরের আকর্ষণ অনুভব করা যায় তাঁর অগ্নিবীণা কাব্যের নামকরণটি দেখে। কারণ রবিঠাকুরের একটি গানই এর প্রেরণা - ‘অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন করে’। প্রাণের আবেগে ভরা তরুণ কবি নজরুলকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বসন্ত (১৯২৩) নাটকটি  উৎসর্গ করেছিলেন। অথচ নজরুল ছিলেন কল্লোলীয় কবি। যাঁদের মূল লক্ষ্যই ছিল রবীন্দ্র সাহিত্যের বিরোধিতা। কিন্তু তা বলে রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর কোন বিরোধিতা কোন কালেই ছিলনা। একটা ঘটনায় সেটার প্রমাণ পাওয়া যায়।
                                ©️রানা©️
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ উপন্যাস থেকে ছবি বানিয়েছিলেন নরেশচন্দ্র মিত্র। ‘দেবদত্ত ফিল্ম’-এর প্রযোজনায় তা মুক্তি পায় ১৯৩৮-এর ৩০শে জুলাই। ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন কাজি নজরুল ইসলাম। তাতে বাধা কম আসেনি।

ছবি মুক্তির আগে বিজ্ঞাপন দেওয়া হল, তা দেখে বিশ্বভারতী মিউজ়িক বোর্ড আপত্তি তুললেন। তাঁদের বক্তব্য, কাজী নজরুল ইসলাম কি রবীন্দ্র-গানের মর্যাদা রাখতে পারবেন? কেন এ কাজ করার আগে তাঁদের অনুমতি নেওয়া হল না? মুশকিলে পড়লেন নির্মাতারা,  কারণ ছবির কাজ তখন সম্পূর্ণ। শুধু মুক্তির অপেক্ষা। এখন তা আটকে গেলে ভীষণ সমস্যা। বিশ্বভারতীর পর্যবেক্ষকেরা ছবিতে সংযোজিত রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলি শুনে তা ত্রুটিমুক্ত নয় বলে রায় দিলেন। পরিচালক ভেবেছিলেন, স্বয়ং নজরুল যেখানে সঙ্গীত পরিচালক, সেখানে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই কোনও আপত্তি করবেন না।  তাই আর অনুমতি নেওয়ার কথা ভাবেননি। এখন?

‘গোরা’ ছবির প্রিন্ট আর একটা ছোট প্রজেক্টর সঙ্গে করে, গাড়ি নিয়ে নজরুল সোজা রবীন্দ্রনাথের কাছে শান্তিনিকেতনে হাজির হয়েছিলেন। নজরুলকে দেখে তো কবি মহাখুশি। নজরুল ছবি সংক্রান্ত সমস্যার কথা খুলে বললেন কবিকে। বাঁধন সেনগুপ্ত ‘রবীন্দ্রনাথের চোখে নজরুল’ রচনায় লিখেছেন, সব শুনে কবি রীতিমতো বিস্মিত ও অসন্তুষ্ট হয়ে নজরুলকে বলেছিলেন, ‘‘কী কাণ্ড বলতো? তুমি শিখিয়েছ আমার গান আর ওরা কোন আক্কেলে তার দোষ ধরেন? তোমার চেয়েও আমার গান কি তারা বেশী বুঝবে!  আমার গানের মর্যাদা ওরা বেশী দিতে পারবে?’’ কবির মন্তব্য শুনে নজরুল আশ্বস্ত হলেন। বললেন, তবু কবির লিখিত অনুমতি দরকার, নইলে ছবি মুক্তি পাবে না। তিনি ছবির প্রিন্ট ও প্রজেক্টর নিয়ে এসেছেন, রবীন্দ্রনাথ ছবি দেখে যা লেখার লিখে দিন।  শুনে কবি বলেছিলেন, ‘‘ছবি দেখাতে চাও সকলকেই দেখাও, সবাই আনন্দ পাবে। আপাতত দাও কিসে সই করতে হবে।’’ আর কিসের বাধা!

‘গোরা’ মুক্তি পেল কলকাতার ‘চিত্রা’ (পরে ‘মিত্রা’) প্রেক্ষাগৃহে।  ছবিতে অভিনয় করলেন জীবন গঙ্গোপাধ্যায়, রাণীবালা, প্রতিমা দাশগুপ্তা, রমলা দেবী, রাজলক্ষ্মী দেবী, মোহন ঘোষাল, নরেশ মিত্র, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, রবি রায়, ললিত মিত্র, মনোরমা দেবী, বীণা, ইলা দাস, সুহাসিনী দেবী, বিনয় মুখোপাধ্যায় ও আরও অনেকে।

ছবিতে মোট পাঁচটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করেছিলেন নজরুল। ‘সখী প্রতিদিন হায়’, ‘ওহে সুন্দর মম গৃহে আজি পরমোৎসব রাতি’, ‘রোদনভরা এ বসন্ত’, ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ এবং আংশিক ভাবে ‘মাতৃমন্দির পুণ্য অঙ্গন’। গানগুলি গেয়েছিলেন রাণীবালা ও প্রতিমা দাশগুপ্ত। এ ছাড়া সমবেত কণ্ঠে ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’ ও বিভিন্ন সংস্কৃত স্তোত্র। ছবির একটি রোম্যান্টিক দৃশ্যে নিজের লেখা একটি গানও ব্যবহার করেছিলেন নজরুল। দৃশ্যটিতে তখন সবে ভোর হচ্ছে। নদীর বুকে চলন্ত স্টিমারের কেবিনে ঘুমিয়ে ‘ললিতা’(প্রতিমা দাশগুপ্তা)। বাইরে ডেকে চেয়ারে আধো ঘুমন্ত ‘বিনয়’ (মোহন ঘোষাল)। হঠাৎ ললিতার ঘুম ভেঙে যেতে তিনি এসে দাঁড়ালেন জানালায়। বাইরে এসে একটি চাদর টেনে দিলেন বিনয়ের গায়ে। নজরুল-রচিত গানটি ভেসে এল নেপথ্যে। রোম্যান্টিক আবহ তৈরি হল ভোরের পরিবেশে।

ঢিমে ত্রিতালে রাগাশ্রয়ী এই গানটি তৈরি করেছিলেন নজরুল।  গেয়েছিলেন সেই সময়ের এক প্রতিষ্ঠিত কণ্ঠশিল্পী ভক্তিময় দাশগুপ্ত।  গানের কথাগুলো ছিল: ‘ঊষা এলো চুপি চুপি রাঙিয়া সলাজ অনুরাগে/ চাহে ভীরু নববধূ সম তরুণ অরুণ বুঝি জাগে।। শুকতারা যেন তার জলভরা আঁখি/ আনন্দে বেদনায় কাঁদে থাকি’ থাকি’/ সেবার লাগিয়া হাত দুটি/ মালার সম পড়ে লুটি/ কাহার পরশ-রস মাগে।।’
                                
নজরুলের কবিতায় বিদ্রোহের সুর বেজে ওঠার কারণ হিসেবে সুকুমার সেন একটি যুক্তি দিয়েছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও প্রাচ্যভূমির দুর্দশা দূর হয়নি। মেসোপটেমিয়ায় গিয়ে স্বাধীনতাকামী মুসলিম রাষ্ট্র তুর্কির উদ্যম নজরুল দেখেছিলেন, সেটাই তাঁর কবিতায় ‘বিদ্রোহ-উল্লাসের সুর’ এনেছিল।

ব্যক্তিগত জীবনও বড় যন্ত্রণাময় ছিল কবির। ১৯২৪ সালে তাঁর বিয়ে হয় প্রমীলা সেনগুপ্তের সঙ্গে। সস্ত্রীক হুগলিতেই বাস করতে থাকলেন। তখন থেকেই সক্রিয় ভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনেও জড়িয়ে পড়া। গঠিত হয় স্বরাজপার্টি তথা তাঁদের মুখপত্র ‘লাঙল’ পত্রিকা। তাঁর বিখ্যাত সাম্যবাদী কবিতার প্রকাশ তো এখানেই হয়েছিল। ইতিমধ্যে দুই পুত্রসন্তানের অকালমৃত্যু কবিকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে। অধ্যাত্ম-আশ্রয়ে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলেন। আবার ১৯৪০ সালে স্ত্রী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন। ১৯৪২ সালে কবি নিজেও দুরারোগ্য পিক্সরোগে আক্রান্ত হলেন। যাতে ক্রমশ তাঁর মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা চলে যায়, তিনি সৃষ্টির দুনিয়া থেকে নির্বাসিত হন।

কাজেই আমরা বুঝতেই পারছি ৭৭ বছরের জীবন হলেও সৃষ্টির জন্য তিনি পেয়েছেন মাত্র ২২-২৩ বছর। কিন্তু এরই মধ্যে তাঁর সৃষ্টি সম্ভারের প্রাচুর্য দেখলে অবাক হতে হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল ‘অগ্নিবীণা’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘ভাঙ্গার গান’, ‘ফণিমনসা’, ‘পূবের হাওয়া’, ‘চিত্তনামা’, ‘সর্বহারা’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’, ‘ঝিঙ্গেফুল’, ‘সন্ধ্যা’ ইত্যাদি। কাব্যগ্রন্থের নামকরণের মধ্যেও প্রচলিত ধ্যানধারণার প্রতি অনাস্থা লক্ষিত হয়। তিনি হাফিজের অনুবাদও করেছিলেন - ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’ নামে। ‘রিক্তের বেদন’, ‘শিউলিমালা’ ইত্যাদি তাঁর গল্পগ্রন্থ। ‘বাঁধন-হারা’, ‘মৃত্যুক্ষুধা’, ‘কুহেলিকা’ তাঁর উপন্যাস। এ ছাড়া ‘ঝিলিমিলি’ ও ‘আলেয়া’ নামে দু’টি নাটকও রয়েছে। ‘দুর্দিনের যাত্রী’ ও ‘রুদ্রমঙ্গল’ নামে দু’টি প্রবন্ধের বইও আছে তাঁর।

তাঁর ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘ভাঙ্গার গান’ কাব্যের কবিতাগুলিতে বিদ্রোহী সত্তার সম্যক প্রকাশ মেলে যা তৎকালীন পরাধীন ভারতবর্ষে গভীর দেশপ্রীতিও জাগ্রত করেছিল। যেমন ‘‘কারার ঐ লৌহকপাট/ ভেঙে ফেল কররে লোপাট/ রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণ বেদী’’ (ভাঙ্গার গান)। সমাজের নানা বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। তবে তাঁর এই সাম্যবাদ মার্ক্স-এঙ্গেলস প্রবর্তিত সাম্যবাদ নয়। তিনি মূলত ধনী-নির্ধন, নারী-পুরুষ ইত্যাদি বৈষম্যের পাশাপাশি জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে বলেছেন। কোনও রকম ধর্মীয় গণ্ডীতে নিজের কবিসত্তাকে বাঁধতে চাননি। তাই ‘রক্তাম্বর-ধারিণী মা’,  ‘আগমনী’ যেমন আছে তেমনি ‘কোরবাণী’ ও ‘মোহর্ রম্’ও  আছে তাঁর লেখায়।
                                
বিদ্রোহই শুধু তাঁর কবিতার কেন্দ্র জুড়ে অবস্থান করেনি, প্রেমও তাঁর লেখায় ধরা পড়েছে। ছায়ানট বা দোলনচাঁপা কাব্যের বিষয় প্রেম ও প্রকৃতি। দোলনচাঁপা কাব্যের অভিশাপ কবিতায় প্রিয়তমাকে উদ্দেশ্য করে কবি বলছেন, ‘‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে,/ অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে/ বুঝবে সেদিন বুঝবে।’’ আবার ছায়ানট কাব্যের বিজয়িনী, পলাতকা, চিরশিশু, বিদায়বেলা, দূরের বন্ধু ইত্যাদি কবিতায় প্রেমের সঙ্গে প্রকৃতিকে মিলিয়েছেন।

গান বাদ দিয়ে নজরুলের স্মৃতিতর্পণ সম্পূর্ণ হতে পারে না। সমসময়ে তাঁর গানগুলি অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।  এটা একটা বিস্ময় যে, এত কম সময়ে তিনি প্রায় চার হাজার গান রচনা করেন। গ্রামাফোন রেকর্ড কোম্পানির চাহিদাতেও তাঁর এই বিপুল সংখ্যক গান রচনা। তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে সৃষ্ট বলে অনেক গানই পরবর্তীতে আর সংরক্ষিত হয়নি ঠিক মতো। তবে তিনি কিছু গানের সংকলন করে গিয়েছেন ‘গানের মালা’, ‘গুল বাগিচা’, ‘গীতি শতদল’, ‘বুলবুল’ ইত্যাদি গ্রন্থে। সুর তথা বিষয় বৈচিত্র্যে তাঁর গানগুলি বাংলা সঙ্গীত জগতের সম্পদ। বর্তমানে নজরুলগীতির তেমন আর জনপ্রিয়তা নেই বলে অনেককেই আক্ষেপ করতে শোনা যায়। অথচ তাঁর শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলীর পাশাপাশি ইসলামি সঙ্গীত, মুর্শেদী গানে মুগ্ধ হতে হয়। আজকের দিনে বেশি করে গীত হোক তাঁর সম্প্রীতি ও নারীজাগরণের গানগুলি।  তা হলেই হবে আমাদের চেতনায় বিরাজিত কবি-সঙ্গীতজ্ঞ-সঙ্গীতস্রষ্টা এবং প্রকৃত দেশপ্রেমিকের  প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।
                           
(তথ্যসূত্র:
১- নিষিদ্ধ নজরুল, শিশির কর, আনন্দ পাবলিশার্স (১৯৮৩)।
২- কারাবাসে নজরুল, শান্তনু ঠাকুর, গণকন্ঠ (২০০০)।
৩- রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল সম্পর্ক, রতনতনু ঘোষ, একুশে বাংলা প্রকাশন (২০১৫)।
৪- নজরুলের সাংবাদিকতা, আবু হেনা আবদুল আউয়াল, নজরুল ইন্সটিটিউট।
৫- কাজী নজরুল ইসলাম- স্মৃতিকথা , মুজফ্ফর আহমেদ।
৬- বিদ্রোহী রণক্লান্ত: নজরুল-জীবনী, গোলাম মুরশিদ, প্রথমা প্রকাশন।)
                         ©️রানা চক্রবর্তী©️

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ