প্রতাপাদিত্য : বীরত্বের ফাঁপানো বেলুন?।। শিবাশীষ বসু



অষ্টাদশ শতকের কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর তাঁর প্রখ্যাত 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যে রাজা প্রতাপাদিত্যের গুণকীর্তন করে লিখে গিয়েছিলেন,
"যশোর নগর ধাম
প্রতাপ আদিত্য নাম
মহারাজা বঙ্গজ কায়স্থ।
নাহি মানে পাতশায়
কেহ নাহি আঁটে তাঁয়
ভয়ে যত নৃপতি দারস্থ॥"

ঐতিহাসিক প্রভাসচন্দ্র সেনের মতে, "খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতকের প্রথম পাদের ঘটনা অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় পাদে জনশ্রুতিতে কিরূপ বিকৃতি প্রাপ্ত হয়েছিল, কবি ভারতচন্দ্রের বিবরণ তাহার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।"

ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার স্পষ্টভাবে লিখে গেছেন, "অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে তাঁহার শক্তি, বীরত্ব ও দেশভক্তির যে উচ্ছ্বসিত বর্ণনা দেখিতে পাওয়া যায়, তাহার অধিকাংশেরই কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই।" প্রভাসবাবু ও রমেশবাবুর বিবৃতি পড়লে রীতিমত শক লাগারই কথা কারণ বাল্যকাল থেকেই আমরা ইতিহাসে, গল্পে, নাটকে (এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য বনফুলের সুবিখ্যাত 'প্রতাপাদিত্য' নাটকখানি) বাংলার বারো-ভূঁইয়ার অন্যতম প্রতাপের বীরত্বের যে আড়ম্বরপূর্ণ বর্ণনা পড়েছি এবং শুনেছি তাতে এই বিবৃতি এক বালতি ঠান্ডা জল ঢেলে দেওয়ার মতো। বরং একটু ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাক, ব্যাপারখানা ঠিক কি।

১৮০১ খ্রীস্টাব্দে লিখিত রামরাম বসুর 'রাজা প্রতাপাদিত্য' এবং ১৮৫৬ খ্রীস্টাব্দে হরিশ্চন্দ্র তর্কালঙ্কার রচিত 'রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র' প্রভৃতি গ্রন্থের দ্বারা প্রতাপাদিত্যের কাহিনী প্রচারিত হয়। কিন্তু তাতে সত্য, মিথ্যা ও মিথ এমনভাবে মিশে গিয়েছে যে প্রকৃত ইতিহাস উদ্ধার করা কঠিন। যতদূর জানা যায় তা হল, প্রথম কুলীন দশরথ গুহের বংশে প্রতাপাদিত্যের জন্ম। তাঁর প্রপিতামহ রামচন্দ্র গুহ সপ্তগ্রামে গিয়ে কানুনগো দপ্তরে নিযুক্ত হন। তাঁর তিন পুত্র - ভবানন্দ, গুণানন্দ ও শিবানন্দও ফারসি ভাষায় দক্ষ হয়ে কানুনগো দপ্তরেরই কর্মচারী হন। ভবানন্দের পুত্র শ্রীহরি এবং গুণানন্দের পুত্র জানকীবল্লভ গৌড়ের নবাব দায়ুদ খাঁর বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন। তাঁরা বঙ্গোপসাগরের নিকট সুন্দরবন অঞ্চলে এক বিস্তীর্ণ এলাকার জায়গীর প্রাপ্ত হন এবং বনজঙ্গল কেটে বসতি স্থাপন করেন। শ্রীহরি বিক্রমাদিত্য এবং জানকী বসন্তরায় নাম নেন এবং ত‍াঁর জমিদারির সীমা ছিল যশোহর, খুলনা ও বাখরগঞ্জ জেলার অধিকাংশ অঞ্চল। ১৫৭৫ খ্রীস্টাব্দে দায়ুদের মৃত্যুর পর বিক্রমাদিত্য ও বসন্তরায় মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি তোডরমল্লের সঙ্গে সাক্ষ‍াৎ করে বাদশাহের নিকট হতে যশোহর রাজ্য জমিদারীরূপে লাভ করেন। বিক্রমাদিত্যের পুত্র হলেন প্রতাপাদিত্য। তিনিও ফারসি ভাষায় সুদক্ষ হন এবং অ‍াগ্র‍ায় গমন করে বাদশাহের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর পর তিনিই জমিদারী সনদ লাভ করেন। যমুনা ও ইছামতী নদীর সংযোগস্থলে ধূমঘাটে তাঁর রাজধানী ছিল। সংক্ষেপে এই হল প্রতাপাদিত্যের বারো-ভূঁইয়ার অন্যতম হয়ে ওঠার কাহিনী।

সেই সময়ে ইসলাম খাঁ ছিলেন সুবে-বাংলার মুঘল প্রতিনিধি সুবাদার। সেই সময়ে রাজমহল ও বাঁকুড়া হতে ত্রিপুরা ও চট্টগ্রামের সীমা পর্যন্ত বঙ্গদেশের বিস্তীর্ণ ভূভাগ ছোটবড় বিভিন্ন রাজার অধীনে ছিল যাঁরা মুখে মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করলেও সুযোগ পেলেই তাদের বিরুদ্ধাচারণ করতেন। মুসা খাঁ ছিলেন এঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী এবং নেতাস্বরূপ। ইসলাম খাঁ প্রথমেই মুসাকে দমন করব‍ার জন্য ব্যাপক আয়োজন করলেন। প্রতাপাদিত্য মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করে কনিষ্ঠ পুত্র সংগ্রামাদিত্যকে উপঢৌকন সহ ইসলাম খাঁর দরবারে পাঠালেন। স্থির হল তিনি সৈন্যসামন্ত নিয়ে ইসলাম খাঁর অভিযানে সহায়তা করবেন। ইসলাম খাঁ এক বৃহৎ সৈন্যদল ও বহুসংখ্যক রণতরী নিয়ে অভিযান আরম্ভ করলেন এবং একে একে বাঁকুড়ার হাম্বীর, ভুষণার সত্রাজিৎ, ভুলুয়ার অনন্তমানিক্য, ঢাকার মুসা খান, মৈমনসিংহের উসমান ইত্যাদি সকলকে পর‍াজিত করে মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করালেন। ১৬১১ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে বঙ্গদেশ মোটামুটিভাবে মুঘলদের অধিলারভুক্ত হল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল প্রতাপাদিত্য নিজ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ইসলাম খাঁকে বিন্দুমাত্র সাহায্য করলেন না। ক্রুদ্ধ ইসলাম খাঁ এবার প্রতাপাদিত্যকে দমন করবার জন্য অগ্রসর হলেন। "অন্যান্য জমিদারদের পরিণাম দেখিয়া প্রতাপাদিত্য ভীত হইলেন এবং ৮০টি রণতরী সহ পুত্র সংগ্রামাদিত্যকে ক্ষমা প্রার্থনার করিবার জন্য 
ইসলাম খানের নিকট পাঠাইলেন।" কিন্তু তাতে চিঁড়ে ভিজলো না। মুঘল নৌবাহিনী পদ্মা, ইছামতী ও জলঙ্গী নদী দিয়ে ১৬১১ খ্রীস্টাব্দেের মধ্য ডিসেম্বরে বনগাঁর দক্ষিণে সালকা নামক স্থানে উপস্থিত হল। এখানে প্রতাপাদিত্যের জেষ্ঠ্য পুত্র উদয়াদিত্য বহুসংখ্যক সৈন্য, রণহস্তি ও রণতরী নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। মুঘল সেনাপতি মির্জা নাথন ইছামতীর দুই তীর হতে গোলাবর্ষন করে যশোর নৌবাহিনীর পার্শ্বদেশ ভেদ করলে, উদয়াদিত্য সালকার দুর্গ ত্যাগ করে পলায়ন করলেন। অধিকাংশ রণতরী ও গোলাবারুদ মুঘলদের হস্তগত হল।

ইতিমধ্যে মুঘল বাহিনী বাকলার অল্পবয়স্ক রাজা প্রতাপাদিত্যের জামাতা রামচন্দ্র রায়কে সাতদিন প্রবল যুদ্ধের পর পরাজিত করল। প্রতাপাদিত্য রাজধানীর পাঁচমাইল উত্তরে কাগরঘাটায় একটি শক্তিশালী ঘাঁটি নির্মাণ করে প্রস্তুত রইলেন। কিন্তু  মুঘলবাহিনী অপূর্ব কৌশলে এই দুর্গটিও দখল করে নিলে প্রতাপাদিত্য আত্মসমর্পণ করলেন। ইসলাম খাঁ প্রতাপাদিত্যের রাজ্য দখল করলেন। শোনা যায়, প্রতাপাদিত্যকে বন্দী করে ঢাকায় একটি লোহার খাঁচায় বন্ধ করে রাখা হয় এবং পরে বন্দী অবস্থায় দিল্লী পাঠানো হয়, কিন্তু পথিমধ্যে বারানসীতে তাঁহার মৃত্যু হয়।

রমেশ মজুমদারের মতে, প্রতাপাদিত্য যথেষ্ট শক্তি ও প্রতিপত্তিশালী ছিলেন - এবং শেষ অবস্থ‍ায় মুঘলদের সহিত বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন, এ কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে তাঁকে যেরূপ বীর, স্বাধীনতাপ্রিয় ও দেশভক্তরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে, সমকালীন ইতিহাস তা সমর্থন করে না।

তথ্যসূত্র : 
বাঙলার ইতিহাস, প্রভাসচন্দ্র সেন, কথাশিল্প প্রকাশ
বাংলাদেশের ইতিহাস দ্বিতীয় খণ্ড, রমেশচন্দ্র মজুমদার, জেনারেল প্রিন্টার্স এ্যান্ড পাবলিশার্স

Post a Comment

0 Comments