সতীদাহ প্রথা ও সতীদাহ প্রথা বন্ধের নেপথ্যে।।রানা চক্রবর্তী


(ছবিতে - মুঘল যুগের চিত্রকর মোহাম্মদ রেজা'র মুঘল অঙ্কনশৈলীতে অঙ্কিত সতীদাহের একটি তৈলচিত্রের ফটোগ্রাফিক প্রিন্ট। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একজন হিন্দু রানী সতী হচ্ছেন, মুঘল সম্রাট আকবরের অনিচ্ছায় কিন্তু রানীর সম্মতিতে সম্রাটের বাধ্য হয়ে দেওয়া অনুমতিতে। ছবিতে সামনে ডানদিকে ঘোড়ার পিঠে চেপে মুঘল সম্রাটের পক্ষ থেকে সতী হওয়ার অনুষ্ঠানে উপস্থিত রয়েছেন আকবরের তৃতীয় পুত্র শাহাজাদা দানিয়াল।
ছবিটি খুব সম্ভবতঃ ষোল শতকের শেষের দিকে অঙ্কন করা হয়েছিল।
ছবি সৌজন্যে- ব্রিটিশ লাইব্রেরী, ইউনাইটেড কিংডোম।)
                                 ©️রানা চক্রবর্তী©️
সময়টা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ। ঝোপজঙ্গলে ভরা গঙ্গার পাড় থেকে মাঝেমধ্যেই ভেসে আসত ঢাক, ঢোল, কাঁসর, ঘণ্টার আওয়াজ! যাঁদের কানে সেই শব্দ পৌঁছত তাঁরা বুঝতে পারতেন কী ঘটছে। গগনভেদী সেই আওয়াজই বলে দিত, কোনও কিশোরী বধূর সহমরণের কাহিনি। দুশো বছরের বেশি পুরনো সেই স্মৃতি, আজও জেগে রয়েছে কলকাতার গা ঘেঁষা প্রাচীন জনপদ বরাহনগরে। এখনও সেখানে রয়েছে ‘সতীদাহ’ ঘাট। এলাকার ইতিহাস বহন করে যা আজও গল্প শোনায় সহমরণের। আজও গঙ্গার পাড় ধরে হাঁটলেই রায় মথুরানাথ চৌধুরী স্ট্রিটে চোখে পড়ে ছোট্ট পরিসরে থাকা সতীদাহ ঘাটের।

এই এলাকার পুরনো বাসিন্দা তথা সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় আনন্দবাজার পত্রিকায় সাম্প্রতিক এক লেখায় জানিয়েছিলেন, এক সময়ে বিত্তজীবী মানুষ ও বেনে সম্প্রদায়ের বাস ছিল বরাহনগরে। সঙ্গে গঙ্গার পাড় ঘেঁষে ছিল জমিদারদের বাগানবাড়ি। টাকির মুন্সি জমিদারদের পূর্বপুরুষ ছিলেন রায় মথুরানাথ চৌধুরী। তাঁদেরই বিরাট বাড়ি, বাগান ছিল এই বরাহনগরে। এ ছাড়াও আরও অনেকের বাগান ছিল এই এলাকায়। এখন যেটি রায় মথুরানাথ চৌধুরী স্ট্রিট, সেটি ছিল গা ছমছমে পথ। যে জায়গাটিকে সতীদাহ ঘাট বলা হচ্ছে, তার অদূরেই রয়েছে কাশীপুর মহাশ্মশান। সঞ্জীববাবু বলেন, ‘‘কাশীপুর শ্মশানে অবশ্য কখনও সতীদাহ হয়নি। কিন্তু বরাহনগরের এই গঙ্গার ঘাটে সে কালের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্রাহ্মণেরা বিধবাদের পুড়িয়ে মারার একটা ব্যবস্থা করেছিল।’’

লেখক স্বপন বসুর ‘সতী’ নামক বইতেও উল্লেখ রয়েছে বরাহনগরের গঙ্গার পাড়ের সেই সব ঘটনার। তিনি লিখেছেন, ‘কামারহাটির কৃষ্ণদেব মুখোপাধ্যায় মারা গিয়েছেন, খবর পেয়েই পাল্কি চেপে বরাহনগরের গঙ্গার ঘাটে হাজির হয়েছিলেন এক বৃদ্ধা। বয়সের ভারে ঠিক মতো চলতে না পারা ওই বৃদ্ধা ছিলেন কৃষ্ণদেববাবুর স্ত্রী। স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে বরাহনগরের ঘাটে তিনি এসেছিলেন সতী হতে। বৃদ্ধার ইচ্ছানুসারে স্বামীর চিতার পাশেই শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁকেও।’ এই লেখা থেকে বোঝা যায়, বরাহনগরের ওই ঘাটে যে শুধু কিশোরী বধূদেরই সতী করা হত তা নয়, অনেক বৃদ্ধা স্ত্রী-ও সতী হতেন।

ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায় জানিয়েছিলেন, প্রাচীন প্রথা সতীদাহের উল্লেখ পাওয়া যায় বেদে। তবে সে সময়ে সেটা খুব বড় আকারে ছিল না। ব্রাহ্মণ, রাজপুত, জমিদারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত রাজস্থানে রাজপুতদের প্রধান প্রথা ছিল এই সতীদাহ। তাতে অবশ্য সমাজের নিম্ন শ্রেণির লোকেরা অংশ নিতেন না। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও হত না। তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে আচমকাই অন্যান্য প্রদেশকে পিছনে ফেলে বাংলাদেশে সতীদাহ বেড়ে গেল। রজতকান্তবাবুর মতে, ‘‘এর মূল কারণ ছিল, নিম্ন শ্রেণির মানুষেরাও সমাজের উঁচু স্থানে বসতে চাইলেন। তাঁদের মধ্যেও সতীদাহ প্রথার চল হতেই সমস্যা প্রকট হল। যার ফলে বাংলাদেশে বেশি সতীদাহ হতে থাকল। নিম্ন বঙ্গে বিশেষত কলকাতা থেকে হুগলি জেলার মধ্যে এর চল ছিল বেশি।’’ সহমত পোষণ করে সঞ্জীববাবুও বলেন, ‘‘চন্দননগর, শ্রীরামপুর, চুঁচুড়া, হুগলিতেও এই প্রথার চল ছিল।’’

রবীন্দ্রভারতীর ইতিহাসের শিক্ষক ও পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদের সম্পাদক আশিসকুমার দাসের মতে, ‘‘সতীদাহের ইতিহাস ঘাঁটলে বরাহনগর ও বাঁকুড়ায় সতীঘাটের উল্লেখ পাওয়া যায়। আরও দেখা যায়, হুগলি, বর্ধমান, নদীয়া, ২৪ পরগনা ও কলকাতার শহরতলির মেয়েরাই সব থেকে বেশি সতী হতেন। তার মধ্যেই রয়েছে কলকাতা লাগোয়া বরাহনগরও।’’
                            ©️রানা চক্রবর্তী©️
অতীতের ইতিহাসের পাতা থেকে সমাচার দর্পণ পত্রিকায় প্রকাশিত সহমরণের কিছু খবর এবং একটি পরিসংখ্যানের দিকে নজর দেওয়া যাক। ইউরোপীয়দের আঁকা সহমরণের বহু পেইন্টিং আছে; প্রথম পেইন্টিং পাওয়া যায় ডাচ প্রোটেস্টান্ট বণিক Jan Huyghen van Linschoten (১৫৬৩–১৬১১)-এর ১৫৯৬ সালে প্রকাশিত Itinerario: Voyage ofte Schipvaert van Jan Huygen van Linschoten naer Dost ofte portugaels Indien বইতে।

সমাচার দর্পণে প্রকাশিত সহমরণ বিষয়ক খবর:

২৭ মার্চ ১৮১৯ ।। ১৫ চৈত্র ১২২৫
সহমরণ। শহর কলিকাতার এক ব্রাহ্মণ মরিয়াছেন অল্পবয়স্কা তাহার স্ত্রী সহগমন করিয়াছে আমরা শুনিয়াছি যে দুই দিনপর্য্যন্ত আপন মৃত স্বামীকে রাখিয়া তৃতীয় দিন সহগমন করিয়াছে এত বিলম্বে সহগমন করিতে পূর্ব্বে শুনি নাই। তাহার কারণ এই স্ত্রীর বয়স বিবেচনা করাতে এত কাল বিলম্ব হইল। কথক বৎসর হইল শ্রীশ্রীযুত নানাদেশীয় মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতেরদের নিকটে হিন্দুশাস্ত্রানুসারে সহগমন বিষয়ে যথার্থ ব্যবস্থা লইয়া আজ্ঞা দিয়াছেন যে ষোড়শবর্ষন্যূন বয়স্কা কিম্বা গর্ভবতী কিম্বা যাহার অতিশিশু বালক থাকে সে স্ত্রী সহগমন করিতে পাইবেক না।
এবং হিন্দুশাস্ত্রে ইহাও কহে যে সহমরণাদিরুপ কর্ম্মে নির্ব্বাণ মুক্তি হইতে পারে না কিন্তু সুখ ভোগমাত্র হয়। অতএব হিন্দুশাস্ত্রের মতে নির্ব্বাণসাধন কর্ম্মেরি প্রশংসা করিয়াছেন।
অধিক সহমরণ বাঙ্গালা দেশে হয় পশ্চিম দেশে তাহার চতুর্থাংশও হয় না এবং বাঙ্গালার মধ্যে ও কলিকাতার কোট আপীলের অধীন জিলাতে অধিক হয় আরো হিন্দুস্থানে যত সহমরণ হয় তাহার সাত অংশের একাংশ কেবল জিলা হুগলিতে হয়।

৭ এপ্রিল ১৮২১ ।। ২৬ চৈত্র ১২২৭
সহমরণ।–গত মহাবারুণী যোগে উড়িষ্যা প্রদেশের অনেক লোক গঙ্গাস্নানে আসিয়াছিল তাহার মধ্যে মো বাঁশবাড়িয়া গ্রামে এক ব্যক্তি আপন স্ত্রী প্রভৃতি পরিজন সমেত রহিয়াছিল দৈবাৎ শনিবারে গঙ্গাস্নান করিয়া সেই রাত্রিতে তাহার পীড়া হইয়া প্রাণ ত্যাগ হইল। পরদিন রবিবার তাহার স্ত্রী সহমরণে যাইতে নিশ্চয় করিয়া ঐ মোকামে গঙ্গাতীরে চারিদিকে চারি হস্ত প্রমাণে এক কুণ্ড কাটাইল ও ঐ কুণ্ড কাষ্ঠ ও চন্দন কাষ্ঠ ও ধুনা ও আর ২ সুগন্ধি মসালাতে পূর্ণ করিয়া তাহাতে অগ্নি সংযোগ করিল। পরে ঐ কুণ্ডের অগ্নি অত্যন্ত প্রজ্বলিত হইল দেখিয়া আপন মৃত স্বামির শরীর ঐ প্রজ্বলৎ কুণ্ডে ণিক্ষেপ করিল। অনন্তর ঐ স্ত্রী গঙ্গাস্নান করিয়া ও সূর্য্যার্ঘ্য দিয়া এক হাঁড়ী ঘৃত কক্ষদেশে করিয়া ঐ অগ্নিকুণ্ডে ঝম্প দিয়া পড়িল এবং তক্ষণাৎ ভস্মসাৎ হইল তাহার আত্মীয় লোকেরা হরিধ্বনি করিতে লাগিল।
এতাদৃশ সহমরণ ব্যবহার এতদ্দেশে নাই তৎপ্রযুক্ত বিশেষ করিয়া লিখা গেল।

২৩ মার্চ ১৮২২ ।। ১১ চৈত্র ১২২৮
সহমরণ।–কলিকাতার অন্তঃপাতি কোঠের সাহেবেরা সহমরণ বিষয়ক এই রিপোর্ট শ্রীশ্রীযুত বড় সাহেবের নিকটে পাঠাইয়াছিলেন।
সন ১৮১৫ সাল ১৮১৬ সাল ১৮১৭ সাল সন
কলিকাতার অন্তঃপাতি ২৫৩ ২৮৯ ৪৪১
ঢাকা ৩১ ২৪ ৫২
মুরশেদাবাদ ১১ ২২ ৪২
পাটনা ২০ ২৯ ৩৯
বানারস ৪৮ ৬৫ ১০৩
বরেলী ১৭ ১৩ ১৯
 ৩৮০ ৪৪২ ৬৯৬

১৫ নভেম্বর ১৮২৩ ।। ৯ অগ্রহায়ণ ১২৩০
সহমরণ ।।– মোং কোন নগর গ্রামের কমলাকান্ত চট্টোপাধ্যায় নামে এক ব্যক্তি কুলীন ব্রাহ্মণ সর্ব্ব সুদ্ধা বত্রিশ বিবাহ করিয়াছিলেন তাহার মধ্যে তাহার জীবদবস্থাতে দশ স্ত্রী লোকান্তরগতা হইয়াছিল বাইশ স্ত্রী বর্ত্তমানা ছিল। তাহারদের মধ্যে কেবল দুই স্ত্রী তাহার নিজ বাটীতে ছিল আর সকলে স্বস্ব পিত্রালয়ে ছিল। ২১ কার্ত্তিক বুধবার ঐ চট্টোপাধ্যায় পরলোক প্রাপ্ত হইলে তাহার সকল শ্বশুর বাটীতে অতি ত্বরায় তাহার মৃত্যু সম্বাদ পাঠান গেল তাহাতে কলিকাতার এক স্ত্রী ও বাঁসবাড়ীয়ার এক স্ত্রী নিকটস্থা দুই স্ত্রী এই চারিজন সহমরণোদ্যতা হইল। পরে সেখানকার দারোগা এই বিষয় সদর রিপোর্ট করিয়া সদর হইতে হুকুম আনাইতে দুই দিবস গত হইল পরে ২৩ কার্ত্তিক শুক্রবার তৃতীয় দিবসের মধ্যাহ্নকালে হুকুম আইলে ঐ চারি জন পতিব্রতা সহমরণ করিয়াছে। এই স্ত্রীরদের বয়ঃক্রম ত্রিশ বৎসর অবধি পঞ্চাশ বৎসর পর্য্যন্ত হইবেক।

২৭ এপ্রিল ১৮২২ ।। ১৬ বৈশাখ ১২২৯
সহগমন।।–ওলাওঠা রোগে অনেক বাঙ্গালি মরিয়াছে তাহার মধ্যে ঐ [গয়া] মোকামে এক ব্রাহ্মণ মরিলে তাহার স্ত্রী সহগমনে উদ্যতা হইল তাহাতে গয়ার জজ শ্রীযুত মেং কিরিষ্টফর স্মিথ সাহেব গিয়া তাহাকে অনেক নিষেধ করিলেন তাহাতে সে ব্রাহ্মণী আপন অঙ্গুলী অগ্নিতে দগ্ধ করিয়া পরীক্ষা দেখাইল তাহা দেখিয়া জজ সাহেব আজ্ঞা দিলেন যে তোমার যে ইচ্ছা তাহা করহ। পরে সে স্ত্রী সহগমন করিল।

১৩ নভেম্বর ১৮২৪ ।। ২৯ কার্ত্তিক ১২৩১
সহগমন।–লখিপুরনিবাসি আনন্দচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়নামক এক জন প্রধান লোক রোগবিশেষে আপন আয়ুঃশেষ জানিয়া কালীঘাটে আগমনপূর্ব্বক সুরধুনী তীরে তিন দিবস বাস করিয়া সাময়িক বিহিত ক্রিয়ায় কালক্ষেপণানন্তর ১৭ কার্ত্তিক সোমবার রাত্রিকালে প্রাণ ত্যাগ করিয়াছেন। এঁহার বয়ঃক্রম ৬৭ বৎসর হইয়াছিল তাঁহার স্ধ্বী স্ত্রী স্বামির মরণে মৃত্যু শ্রেয়ো জানিয়া তৎসহগামিনী হইয়াছেন। সং কৌং

২৭ আগষ্ট ১৮২৪ ।। ১৩ ভাদ্র ১২৩২
সহগমন।।–সিমল্যানিবাসি ফকিরচন্দ্র বসু ১ ভাদ্র সোমবার ওলাওঠারোগে পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইয়াছেন। ইহার বয়ঃক্রম প্রায় ৩৬ বৎসর হইয়াছিলো তাঁহার সাধ্বী স্ত্রী শ্যামবাজারনিবাসি শ্রীমদনমোহন সেনের কন্যা তাঁহার বয়ঃক্রম ন্যূনাতিরেক ২২ বৎসর হইবেক এবং সন্তান হয় নাই। ঐ পতিব্রতা স্ত্রী রাজাজ্ঞানুরোধে দুই দিবস অপেক্ষা করিয়া বুধবার প্রাতে সুরের বাজারের নিকট সুরধুনী তীরে স্বামিশবসহ জ্বলচ্চিতারোহণপূর্ব্বক ইহলোক পরিত্যাগ পুরঃসর পরলোক গমন করিয়াছে।
                               ©️রানা চক্রবর্তী©️
গুপ্ত সাম্রাজ্যের (খৃষ্টাব্দ ৪০০) পূর্ব হতেই এ প্রথার প্রচলন সম্পর্কে ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায়। গ্রিক দিগ্বিজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডারের সাথে ভারতে এসেছিলেন ক্যাসান্ড্রিয়ার ঐতিহাসিক এরিস্টোবুলুস। তিনি টাক্সিলা (তক্ষশীলা) শহরে সতীদাহ প্রথার ঘটনা তার লেখনিতে সংরক্ষণ করেছিলেন। গ্রিক জেনারেল ইউমেনেস এর এক ভারতীয় সৈন্যের মৃত্যুতে তার দুই স্ত্রীই স্বত:প্রণোদিত হয়ে সহমরণে যায়; এ ঘটনা ঘটে খৃষ্ট পূর্বাব্দ ৩১৬ সালে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, গুপ্ত সাম্রাজ্যের  আগে থেকেই ভারতবর্ষে সতীদাহ প্রথার প্রচলন ছিল। প্রাচীন সতীদাহ প্রথার উদাহারণ পাওয়া যায় অন্তর্লিখিত স্মারক পাথরগুলিতে। এ পর্যন্ত সবচেয়ে প্রাচীন স্মারক পাথর পাওয়া যায় মধ্যপ্রদেশে, কিন্তু সব থেকে বড়ো আকারের সংগ্রহ পাওয়া যায় রাজস্থানে। এই স্মারক পাথরগুলিকে সতী স্মারক পাথর বলা হত যেগুলি পুজো করার বস্তু ছিল [Shakuntala Rao Shastri, Women in the Sacred Laws – The later law books (1960)]। ডাইয়োডরাস সিকুলাস (Diodorus Siculus) নামক গ্রিক ঐতিহাসিকের খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের পাঞ্জাব বিষয়ক লেখায়ও সতীদাহ প্রথার বিবরণ পাওয়া যায় [Doniger, Wendy (2009). The Hindus: An Alternative History. Penguin Books. p. 611]।
মূলতঃ স্বত:প্রণোদিত হয়েই পতির মৃত্যুতে স্ত্রী অগ্নিতে আত্মাহুতি দিত। পৌরাণিক কাহিনীতে এ আত্মাহুতি অতিমাত্রায় শোকের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই দেখা হত। মহাভারত অনুসারে পাণ্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রী সহমরণে যান কারণ মাদ্রী মনে করেছিলেন পান্ডুর মৃত্যুর জন্য তিনি দায়ী যেহেতু পান্ডুকে যৌনসহবাসে মৃত্যুদন্ডের অভিশাপ দেওয়া হয়েছিল। রাজপুতানায় "জহর ব্রত" প্রচলিত যাতে কোন শহর দখল হবার পূর্বেই পুরনারীরা আত্মসম্মান রক্ষার্থে আগুনে ঝাঁপ (বা জহর বা বিষ) দিয়ে স্বেছায় মৃত্যুবরণ করতেন, যা সতীদাহের অনুরূপ। কিন্তু কালক্রমে বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে হিন্দু স্ত্রীকে সহমরণএ বাধ্য করা হত। বিশেষ করে কোন ধনী লোকের মৃত্যুর সম্পত্তি অধিকার করার লোভে তার আত্মীয়রা তার সদ্যবিধবা স্ত্রীকে ধরে বেঁধে, ঢাক-ঢোলের শব্দ দ্বারা তার কান্নার আওয়াজকে চাপা দিয়ে তার স্বামীর সাথে চিতায় শুইয়ে পুড়িয়ে মারতো।

১৮২৯ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর বৃটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীতে সতিদাহ প্রথাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল ঘোষণা করা হয়। এসময় বেঙ্গলের গভর্ণর ছিলেন লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক। অবশ্য এ আইনী কার্যক্রম গৃহীত হয় মূলতঃ রাজা রামমোহন রায়ের সামাজিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেই। এই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে মামলা করা হয়। প্রিভি কাউন্সিল ১৮৩২ সালে বেঙ্গলের গভর্ণর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের ১৮২৯ এর আদেশ বহাল রাখেন। খুব অল্পসময়ের মধ্যে ভারতের অন্যান্য কোম্পানী অঞ্চলেও সতীদাহ প্রথাকে বাতিল ঘোষণা করা হয়।

পাশ্চাত্যের গবেষকদের অনেকের মাঝে দ্বন্দ্ব থাকলেও ভারতীয় বেদ ভাষ্যকারগণদের মতে বেদে সতীদাহের উল্লেখ নেই। বরং স্বামীর মৃত্যুর পর পুনর্বিবাহের ব্যাপারেই তাঁরা মত দিয়েছেন। এ বিষয়ে অথর্ববেদের দুটি মন্ত্র প্রণিধানযোগ্য:

অথর্ববেদ ১৮.৩.১
"ইয়ং নারী পতি লোকং বৃণানা নিপদ্যত উপত্ব্য মর্ন্ত্য প্রেতম্। ধর্মং পুরাণমনু পালয়ন্তী তস্ম্যৈ প্রজাং দ্রবিণং চেহ ধেহি।।"

অর্থঃ হে মনুষ্য! এই স্ত্রী পুনর্বিবাহের আকাঙ্খা করিয়া মৃত পতির পরে তোমার নিকট আসিয়াছে। সে সনাতন ধর্মকে পালন করিয়া যাতে সন্তানাদি এবং সুখভোগ করতে পারে।

অথর্ববেদ ১৮.৩.২ (এই মন্ত্রটি ঋগবেদ ১০.১৮.৮ এ ও আছে)
"উদীষর্ব নার্ষ্যভি জীবলোকং গতাসুমেতমুপশেষ এহি। হস্তাগ্রাভস্য দিধিষোস্তবেদং পত্যুর্জনিত্বমভি সংবভূব।।"

অর্থঃ হে নারী! মৃত পতির শোকে অচল হয়ে লাভ কি?বাস্তব জীবনে ফিরে এস। পুনরায় তোমার পাণিগ্রহনকারী পতির সাথে তোমার আবার পত্নীত্ব তৈরী হবে।
                           ©️রানা চক্রবর্তী©️
ধর্মের বাণী সবসময় ফানি হয় না, কোনো- কোনো সময় নিষ্ঠুরও হয়। অধিকাংশ ধার্মিকরা যে তাদের ধর্মগ্রন্থ না পড়েই অন্ধভাবে বিশ্বাস করে সেটা তেমন অস্বাভাবিক নয়। কারণ কেউ ধর্মগ্রন্থ বুঝে পড়লে তার নাস্তিকতা ঠেকায় কার সাধ্যি।
হিন্দুরা সম্প্রদায়গণ যেসব গ্রন্থকে তাদের পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ বলে সম্মান প্রদর্শন করে,  ঈশ্বরের বাণী বলে পুজোর সময় শ্লোক আওড়ায়, সেইসব গ্রন্থেই এ বর্বর প্রথার উল্লেখ রয়েছে। রেফারেন্স হিসাবে কয়েকটি সোর্স উল্লেখ করা যেতে পারে:

(১) অথর্ববেদ : “আমরা মৃতের বধু হওয়ার জন্য জীবিত নারীকে নীত হতে দেখেছি।” (১৮/৩/১,৩)।

(২)পরাশর সংহিতা : “মানুষের শরীরে সাড়ে তিন কোটি লোম থাকে, যে নারী মৃত্যুতেও তার স্বামীকে অনুগমন করে, সে স্বামীর সঙ্গে ৩৩ বৎসরই স্বর্গবাস করে।” (৪:২৮)

(৩) দক্ষ সংহিতা : “যে সতী নারী স্বামীর মৃত্যুর পর অগ্নিতে প্রবেশ করে সে স্বর্গে পূজা পায়”। (৪:১৮-১৯)।

(৪) দক্ষ সংহিতা : “যে নারী স্বামীর চিতায় আত্মোৎসর্গ করে সে তার পিতৃকুল, স্বামীকুল উভয়কেই পবিত্র করে।” (৫:১৬০)। যেমন করে সাপুড়ে সাপকে তার গর্ত থেকে টেনে বার করে তেমনভাবে সতী তার স্বামীকে নরক থেকে আকর্ষণ করে এবং সুখে থাকে।

(৫) ব্রহ্মপুরাণ : “যদি স্বামীর প্রবাসে মৃত্যু হয়ে থাকে তবে স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর পাদুকা বুকে ধরে অগ্নিপ্রবেশ করা।”

(৬) মহাভারতের মৌষল পর্বে, কৃষ্ণের মৃত্যুর পর তাঁর চার স্ত্রী রুক্ষিণী, রোহিণী, ভদ্রা এবং মদিরা তাঁর চিতায় সহমৃতা হয়েছিলেন। এমন কি বসুদেবের আট পত্নীও তাঁর মৃত্যুর পরে সহমরণে গিয়েছিলেন।
পাণ্ডু দেহত্যাগ করলে তার দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রী তাঁর চিতায় সহমৃতা হয়েছিলেন।

(৭) ব্যাসস্মৃতি বলছে, চিতায় বিধবা নারী তার স্বামীর মৃতদেহে আলিঙ্গন করবেন অথবা তার মস্তকমুণ্ডন করবেন। (২:৫৫)।

(৮) ষষ্ঠশতকের বরাহমিহির তার বৃহৎসংহিতায় বলেন, “অহো নারীর প্রেম কি সুদৃঢ়, তারা স্বামীর দেহক্রোড়ে নিয়ে অগ্নিতে প্রবেশ করে।” (৭৪:২৩)।

(৯) রামায়ণেও আমরা দেখি, রাবণের কাছে বন্দি থাকাকালে সীতার “সতীত্ব” ঠিক ছিল কী-না সেটা জানার জন্য অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। সেটা ভগবান রামও অনুমোদন করে দেন! অথচ,রামের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অধিকার কারও ছিল না!

সতীদাহ প্রথা ছিল হিন্দু ধর্মান্ধতার এক নিষ্ঠুর পৈশাচিক প্রথা। ধর্মের দোহাই দিয়ে মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতার আগুনে স্ত্রীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো। ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তনের পর ওয়ারেন হেস্টিংস কয়েকজন ব্রাহ্মণের সাহায্যে হিন্দু আইন সংকলন করেছিলেন তাতে সতীদাহ প্রথার মাহাত্ম্য বর্ণনা করে বলা হয়েছে, "পতির চিতায় পুড়ে মরলে সতী সাধ্বী মানুষের গায়ে যত লোম, ততো বছর অর্থাৎ সাড়ে তিন কোটি বছর পতি সহ সুখে স্বর্গে বাস করবে। তার পতির পিতৃমাতৃ উভয় কূলের তিন পুরুষ পাপ মুক্ত হবে। সহমরণের মত পত্নীর আর কোন মহৎ কর্তব্য নেই। এ জন্মে এটি অবহেলা করলে পর জন্মে তার পশু জন্ম হবে।" ১৮২২ সালে ২০ মার্চ সংখ্যা সামাচার দর্পণে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতবর্ষে সতীদাহের ঘটনা ১৮১৫ সালে ৩৮০, ১৮১৬ সালে ৪৪২, ১৮১৭ সালে ৬৯৬টি, এসব সতীদের বেশিভাগেরি বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর এবং তার কমও অনেকের ছিল। ১৮১৫ থেকে ১৮২৮ সালের মধ্যে কেবল মাত্র অবিভক্ত বাংলায় ৮,১৩৪টি সতীদাহের ঘটনা ঘটে। উল্লেখযোগ্য অমানবিক ঘটনা ঘটে ১৮১৮-১৮২০ সালের মধ্য যারা সতী হয়েছিল। এদের মধ্য তিনজনের বয়স ছিল মাত্র ৮ বছর। বাকি ৪৩ জনের বয়স ছিল নয় বছর থেকে ষোল বছরের মধ্যে। রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে সতীদাহ প্রথার বিলোপ সাধনের জন্য আন্দোলন শুরু হয় এবং ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর লর্ড ব্যান্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ আইন প্রণয়ন করেন এবং এর বিরুদ্ধে দন্ডাদেশ জারি করেন। এর বিরুদ্ধে প্রাচীনপন্থী গোঁড়া হিন্দু সমাজ প্রতিবাদ করেন। হেস্টিংস তাদের প্রত্যাখ্যান করেন। তারা পরবর্তীতে বিলেতের প্রিভি কাউন্সিলে আপিল করেন। রাজা রামমোহন রায় বিভিন্ন যুক্তিতর্কের সাহায্যে সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন। এর ফলে চরমপন্থি হিন্দুদের আপিল বরখাস্ত হয় এবং চিরদিনের জন্য সতীদাহ প্রথা বন্ধ হয়।
                           ©️রানা চক্রবর্তী©️
সমস্ত প্রথা রীতিনীতি ও যুগ বিশেষের আইন-কানুনের পিছনে থাকে ঐতিহাসিক ঘটনাবলী। ইতিহাস বাদ দিয়ে তার বিচার করলে অবিচার করা হয় তাই সতীদাহ প্রথার বিষয়ে বলতে গেলে পূর্বাপর কিছু অবস্থা না বললে তা বোঝা কঠিন হবে বলেই সেই সময়ের অবস্থার অবতারনা করতে হচ্ছে। ভারতের ইতিহাস আধুনিক কালের মত লিপিবদ্ধ করা নেই। ভারতের ও হিন্দু ধর্মের ইতিহাস জানতে হলে সেই সময়ের ধর্ম ও সাহিত্য গ্রন্থ কিছু স্থাপনা ও প্রত্নতাত্মিক নিদর্শনের উপরে নির্ভর করতে হয়।
ভারতের সনাতন ধর্ম পরবর্তিতে যা হিন্দু ধর্ম নামে প্রচারিত ও প্রচলিত হচ্ছে সেই দ্রাবিড়দের সময় হতে। তখনকার দ্রাবিড়রা ছিল মাতৃ পুজারক। কিন্তু তারা তা মূর্তি পূজার মাধ্যমে করত কিনা তার কোন নিদর্শন পাওয়া যায় নি। পরবর্তিতে আর্যরা পিতৃ পুজা শুরু করে। অর্থাৎ দ্রাবিড়িরা ঈশ্বরকে দেখত মাতৃ শক্তি রূপে আর্যরা দেখা শুরু করে পিতৃ শক্তি ও মাতৃ শক্তি উভয় রূপে।

প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে সতীদাহ প্রথা নামে কোন শব্দের উপস্থিতি পাওয়া যায় না, তবে সহমরন শব্দ ও তার প্রয়োগ দেখা যায়। আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন সতীদাহ ও সহমরন এক শব্দ বা প্রতিশব্দও নয়।
                         ©️রানা চক্রবর্তী©️
১৩০০ শতাব্দীতে অশিক্ষত আলাউদ্দিন খিলজী (সম্রাট জালাল উদ্দিন খিলজীর মৃত ভাইয়ের ছেলে) ছিলেন ভারতের সম্রাট। তিনি সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য আরব থেকে কিছু ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ আনয়ন করেন। সেই সময়ে অমুসলিম প্রজাদের জন্য ২টি কর আইনের জন্ম হয়

১) নজর-এ –এ মরেচা
২) নজর-এ-বেওয়া।

১) নজর-এ –এ মরেচা: অমুসলিম প্রজাদের ছেলে বা মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার পারমিশানের নেওয়ার জন্য কর।

২) নজর-এ-বেওয়া:  অমুসলিম প্রজাদের কোন নারী নিঃসন্তান অবস্থায় বিধবা হইলে তাহাকে স্বামী বা পিতার গৃহে রাখিবার জন্য বার্ষিক কর।

এই দুই করের জন্য নির্দিষ্ট কোন অর্থের পরিমাপ ছিল না, সেই সময়ের পরগনার দেওয়ান বা কাজী যাহা ধার্য করিতেন প্রজারা তাহাই দিতে বাধ্য থাকিত। যাহারা সেই অর্থ দিতে অসমর্থ হইত, তাহাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হতো বা সেই কন্যা বা বধুকে বাজেয়াপ্ত করে হাউলিতে চালান করা হতো। এই সকল নারীকে যে সুরক্ষিত বাড়ীতে রাখা হতো তাহার নাম “হাউলি “বা “হাভেলী”।

এই হাভেলীতে থাকা অবস্থায় সেই নারীদের যে বাচ্চা হতো সেই বাচ্চাদের নাম হতো “ নজরতরপের বাচ্চা”। সেই বাচ্চা ছেলে হলে তাকে ধর্ম শিক্ষা ও অস্ত্র শিক্ষা দিয়ে সেনাবাহীনিতে নিয়োগ দেওয়া হতো। আর মেয়ে বাচ্চা হলে তাদেরকে নর্তকী হিসাবে প্রস্তুত করা হতো।

নজরে বেওয়া সম্বন্ধে আবার ভিন্ন কাহিনীও জনশ্রুতি হিসাবে কিংবদন্তি আছে যে, কুমারী ও বিধবাদের সন্তান সম্ভবা বা সন্তান প্রসব হলেই কেবল তাদেরকে এই কর প্রদান করতে হতো। আর না দিতে পারলেই সেই মা ও বাচ্চা সহ হাউলীতে পাঠানো হতো। পরিশেষে সেই বাচ্চা ছেলে হলে সৈনিক মেয়ে হলে নর্তকী হিসাবে ভবিতব্য নির্ধারন হতো।

এছাড়াও দীনেশ চন্দ্র সেন তার “বৃহৎ বঙ্গ পুর্বোক্ত” নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “যে কোন রমনী ভাল নাচিতে ও গাহিতে পারিতেন তাহলে তার রক্ষে ছিল না। ময়মনসিংহ জেলার মুসলমান নবাবের নিযুক্ত এক শ্রেনীর লোক ছিল, যাদের উপাধি ছিল “সিন্ধুকী”। হিন্দু ঘরের রূপবতী ও গুনবতী রমনীদের ঠিকানা নবাব সরকারে জানিয়ে দেওয়াই তাদের কাজ ছিল। এর বিনিময়ে তারা বিস্তর জায়গীর পাইতেন”।
“আবার কোন কোন সময় নবাবের লোকেরা বা সেই জায়গীরের লোকেরা বিভিন্ন যায়গায় ঘুরা ফিরা করতেন। তারা হিন্দুদের প্রাপ্ত বয়স্কা সুন্দরী কুমারী পাইলেন বল পুর্বক ধরিয়া লইয়া যাইত”।
যাইহোক, সেই সময়ে বিভিন্ন অত্যাচার ও অনাচারের হাত থেকে বাচার জন্য “গৌরীদান” প্রথা চালু হয়। অর্থাৎ ঋতুমতি হওয়ার পুর্বেই বিয়ে দেওয়া প্রথাই গৌরীদান প্রথা। অথচ এই ভারতে স্বয়ংবর বিবাহের প্রথা চালু ছিল। মেয়ে আমন্ত্রিতদের মধ্য থেকে নিজের পছন্দ মত ছেলেকে বিয়ে করার পদ্ধতিই “স্বয়ংবর” প্রথা। কালের প্রভাবে স্বয়ংবর বিবাহ প্রথার ভারতে শুরু হয় গৌরীদান প্রথার বিবাহ পদ্ধতি।
অর্থাৎ কুমারি মাতা হওয়া ও নবাবের লোলুপ দৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য শুরু হয়েছিল গৌরীদান প্রথা। আর বিধবা মাতা ও সুন্দরী বিধবাদের প্রতি মুসলিম জায়গীর ও নবাবের কুদৃষ্টি / “নজরে বেওয়ার” হাত থেকে বাঁচার জন্য হিন্দু সমাজপতিরা সতীদাহ প্রথার প্রবর্তন করেছিলেন বলেই জানা যায়।
                                ©️রানা চক্রবর্তী©️
এটা সত্য যে, ব্রাহ্মণদের মতো অনেক সাধারন মানুষের নিকটও এই সতীদাহ প্রথা একটি অবশ্যপালনীয় ধর্মিয় অনুষ্ঠানে পরিনত হয়েছিল। আর তাই একদল যখন স্বামীহীন গৃহবধুকে সাদা শাড়ী পড়িয়ে, চুল কেটে, আতপ চাল খাইয়ে অনাকর্ষনীয় করে তুলতে তৎপর ছিল, অপর দিকে অন্যদল তখনো তার প্রিয় আত্মীয়টিকে মৃত্যুর করুন মুখে ঠেলে দিতে অনুতকন্ঠিত হতো। এই বিষয়ে ক্ষিতিশ চন্দ্র মৌলিক বলেন – "জনস্বার্থ বিরোধী বা অপ্রয়োজনীয় প্রথা যদি কেহ জনসমাজের উপর চাপিয়ে দেন, তবে সে প্রথা অল্প দিনেই লোপ পায়। ব্রাহ্মণরা যে সকল বন্ধনী দিয়া সমাজকে বাধিয়া ফেলিলেন, তাহা আপদকালের জন্য বিধান – তাহা সর্বকালের জন্য নয়। জ্বর হইলে রুগীর ভাত খাওয়া বন্ধ হয়, পায়ে ঘা হইলে পঙ্খীরাজ ঘোড়াকেও দৌড়াইতে দেওয়া হয় না। তাহা কোন মতেই সর্বকালের জন্য নয়।" অথচ শুধু সময়ের প্রয়োজনেই এই অমানবিক প্রথা প্রায় ৫০০ বছর হিন্দু সমাজে প্রচলিত ছিল। পরবর্তি ইতিহাস সকলেরই জানা।

প্রাচীনকালে বিভিন্ন পরিব্রাজকদের ভ্রমন বৃত্তান্তে সতীদাহের উল্লেখ আমরা পাই। অলবিরুনির ভ্রমন বৃত্তান্ত পড়ে আমরা জানতে পারি যে তিনি গঙ্গানদীর পারে শ্মশান গুলোতে নিয়মিত সতীদাহ হতে দেখেছেন।

"মোহাচ্ছন্ন মন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছে। পুরোহিত গন ভীষন ব্যাস্ত। শয্যা প্রস্তুত। কাঠের গুড়ির উপর শুয়ে আছে স্বামী। কাঠের গুড়ির মাঝে চন্দন কাঠও আছে। চন্দন কাঠ, ধুপ এর গন্ধ, ধোয়া, কাছা দেয়া ধুতি পরা খালি গায়ের মন্ত্রকের মুখের মন্ত্র, ব্যাস্ত সমস্ত চিতায় আগুন দেয়ার মানুষজনের উল্লাসিত পদক্ষেপ, চিতাকে ঘিয়ে দাঁড়ানো বড় সড় একটা ভিড়ের সার্কেল, নদী পারের শ্মশান ঘাটকে আলাদা পরিবেশ এনে দিয়েছে। সুষমাকে কয়েকজন ধরে নিয়ে আসছে। স্বামীর পাশেই যে শয্যা আজ তাঁর। ঘোরের মধ্যে থাকা অনিচ্ছুক সুষমা চলৎশক্তিহীন অবস্থায় এগিয়ে যাচ্ছে শয্যার দিকে। এটিই তাঁর স্বামীর সাথে জাগতিক শেষ শয্যা। জোড় করে শুইয়ে দিয়ে দড়ি দিয়ে হাত পা বাঁধা হয়েছে তাঁর। এরপর শুকনো কাঠে আগুন।
হরি হরি বোল, হরি বোল- দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো। সুষমার চিৎকার বাঁচাও বাঁচাও। মায়ের কান্না শুনে সুষমার পাঁচ বছরের মেয়ে চিৎকার করছে। কেউ সুষমাকে বাঁচাতে এলো না। কেন বাঁচাবে ? এটিই তো নিয়ম। হাত পায়ের দড়ি কিছুক্ষণের মধ্যে পুড়ে যায়। অগ্নি দগ্ধ শরীর নিয়ে সুষমা লাফ দিয়ে নামে চিতা থেকে। দৌড়ে পালাচ্ছে। বেশী দূর যেতে পারেনা সুষমা। এত বড় বিদ্রোহ, এত বড় অনাচার ? মন্ত্র পড়া বাদ দিয়ে একজন পুরোহিত সুষমার দিকে ছুড়ে মারে পাথর। মাথায় আঘাত পেয়ে সুষমা পরে যায় মাটিতে। আগত ধর্মীয় রীতি রক্ষায় সংকল্পবদ্ধ মানুষ পিটিয়ে অচেতন করে সুষমা। পিটিয়ে মেরে ফেলা যাবেনা, তাতে যে সহমরণ হবে না।
অচেতন সুষমাকে হাত পা ধরে তুলে নিয়ে এসে চিতায় নিক্ষেপ করা হলো। সতী মা কি জয় ধ্বনিতে আকাশ প্রকম্পিত। বংশ সম্প্রদায় এবং পরিবারের গর্ব হয়ে থাকে সে ‘সহমরণের একজন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে। নেপালের সুষমা তোমার অনিচ্ছায় তুমি পরিবারের অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত হয়ে রইলে।"
                                 ©️রানা চক্রবর্তী©️
১৮১৮—১৯, রামমোহন রায় দুটি বই লিখে প্রকাশ করেন:

ক) সহমরণ বিষয়।। প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ এবং
খ) সহমরণ বিষয়ে ।। প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ।

দশ বছর পরে, ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক (লর্ড: ১৮২৮–৩৫) বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে সতীদাহ নিষিদ্ধ করেন। এর আগে রামমোহন একটি আবেদন করছিলেন; সেই আবেদনে সাড়া দিয়েই সতীদাহ নিষিদ্ধ করা হয়; ফলে পরবর্তীকালের ইতিহাস সমাজসংস্কারে রামমোহনের কৃতিত্ব হিসাবেই হাজির করে এটিকে।

কিন্তু ঘটনা এমন সরল ছিলো না; সতীদাহ আগে থেকেই নিষিদ্ধ ছিলো এবং তারও আগে নিষিদ্ধ হয়েছিল। সতীদাহ প্রথাকে ভারতবর্ষে ইসলামের আগমনের সাথে মিলিয়ে ফেলা অসৎ উদ্দেশ্য ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মনে করেন কেউ কেউ। অমানবিক সতীদাহ প্রথা নির্মূলীকরণে মুসলিমদের আইনানুগ কোনো অবদান ছিল কি না, সেটাও একটু খতিয়ে দেখা দরকার। আমরা একবার চোখ বুলিয়ে নিতে পারি :

১. সতীদাহ প্রথা বন্ধের প্রথম সরকারি প্রচেষ্টা মুসলিমরা করেছিলেন। মুহাম্মদ বিন তুঘলক সর্বপ্রথম এই প্রথা বন্ধের চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। [L. C. Nand, Women in Delhi Sultanate, Vohra Publishers and Distributors Allahabad 1989] দিল্লীর সুলতানি রাজত্বকালে সতীদাহ প্রথার জন্য যাতে বিধবাকে বাধ্য না করা হয় তাই সতীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সতীদাহ প্রথা সম্পাদন করার রীতি ছিল।

২. মুঘল সম্রাটদের মধ্যে যারা সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন,তাদের মধ্যে হুমায়ুন স্থানীয় হিন্দুদের প্রতিবাদের মুখে পড়েছিলেন। [Central Sati Act – An analysis by Maja Daruwala is an advocate practising in the Delhi High Court. Courtsy: The Lawyers January 1988.]

৩. অনেক সময় মুঘল প্রশাসন থেকে বিধবা মহিলাদের পেনশন বা উপহার দেয়া হত সতীদাহ না করার জন্য। সম্রাট আকবর (১৫৪২-১৬০৫) সতীদাহ আটকানোর জন্য সরকারীভাবে আদেশ জারি করেন যে, কোন নারী, প্রধান পুলিশ কর্মকর্তার সুনির্দিষ্ট অনুমতি ছাড়া সতীদাহ প্রথা পালন করতে পারবেন না। এছাড়াও এই প্রথা রদের জন্য তিনি পুলিশ কর্মকর্তাদের অধিকার দেন যা তারা যতদিন সম্ভব ততদিন সতীর দাহের সিদ্ধান্তে বিলম্ব করতে পারেন। বিধবাদেরকে উত্তরবেতন, উপহার, পুনর্বাসন ইতাদি সাহায্য দিয়েও এই প্রথা না পালনে উৎসাহিত করা হত।

৪. শিশুদের এই প্রথা থেকে রক্ষা করা হয়েছিল। সম্রাট শাহজাহানের সময় নিয়ম ছিল কোনো অবস্থাতেই যেসব মহিলাদের সন্তান আছে তাদের দাহ হতে দেওয়া হবে না। [XVII. "Economic and Social Developments under the Mughals" from Muslim Civilization in India by S. M. Ikram edited by Ainslie T. Embree New York: Columbia University Press, 1964.] ফরাসি বণিক এবং ভ্রমণকারী তাভেরনিয়ের লেখা থেকে জানা যায় যে, অন্যান্য ক্ষেত্রে, গভর্নররা তড়িঘড়ি সতীদাহের অনুমতি দিতেন না, কিন্তু ঘুষ দিয়ে করান যেত।

৫. সব থেকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয় সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়। ১৬৬৩ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি রুল জারি করেন, যে কোনো পরিস্থিতিতে মুঘল কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত দেশের কোথাও সতীদাহ ঘটতে সরকারি অনুমতি দেয়া হবে না। ইউরোপীয় পর্যটকদের বর্ণনা অনুযায়ী সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলের শেষের দিকে সতীদাহ প্রথা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, শুধু রাজাদের স্ত্রী'রা ব্যতীত। [XVII. "Economic and Social Developments under the Mughals" from Muslim Civilization in India by S. M. Ikram edited by Ainslie T. Embree New York: Columbia University Press, 1964.]
                        ©️রানা চক্রবর্তী©️
প্রকৃতপক্ষে, রাজা রামমোহন রায় তাঁর এক বৌদিকে জোরপূর্বক সতী বানানোর ঘটনা দেখে ১৮১২ সালের দিকে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন শুরু করেন। তার আগ পর্যন্ত হিন্দুসমাজ সংস্কারকদের মধ্য থেকে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে প্রথম আওয়াজ তুলেছিলে বর্ধমান নিবাসী রূপেন্দ্র নাথ বন্দোপাধ্যায়, যিনি হটি বিদ্যালঙ্কারের বাবা ছিলেন । রামমোহনের জন্মের ৭০ বছর আগে তিনি বেশ কয়েকটি সতীদাহ আটকেছিলেন। অন্যের ঘরে যখন আগুন লাগছিল তখন সবাই চোখ বুজে ছিল ধর্মের ভয়ে, যখন নিজের ঘরেই সেই আগুনের আঁচটা লাগল কিছু একটা করতে হবে ভাব মনকে গ্রাস করে নিল। ফলে রাজা রামমোহন রায়ের সাথে সাথে আপামর হিন্দুসমাজ কোনোভাবেই এই প্রথা নির্মূলের কৃতিত্ব দাবি করতে পারে না, এককভাবে তো নয়ই।

১৮১৩ সালের ২০শে এপ্রিল সতীদাহ নিষিদ্ধ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। একই সাথে সহমরণকে আইনীভাবে রিকগনাইজ করে। নিষেধাজ্ঞায় বলা হয়, ১৬ বছরের নিচে বিধবা হলে, গর্ভবতী অবস্থায় হলে বা দুগ্ধপোষ্য শিশুর মা বিধবা–এনারা সহমরণে যেতে পারবে না; এবং নেশাদ্রব্য সেবন বা জোরারোপের মাধ্যমে স্বামীর চিতায় বিধবাকে পোড়ানো যাবে না; সহমরণের একমাত্র বৈধ উপায় বিধবার উইল; বিধবার ইচ্ছা ভিন্ন কোন উপায় নাই আর। বিধবার ‘উইল’ জিনিসটা এইখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ; ইংরেজ তথা ইউরোপীয় অনুমান ছিলো সহমরণ হয় না আসলে, ওইটা সতীদাহ। অর্থাৎ বিধবা স্বেচ্ছায় চিতায় ওঠে না, বা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো বাঁচা; বিধবার উপর থেকে বাইরের—পরিবারের, ধর্মবেত্তাদের, সমাজের চাপ সরানো গেলে বিধবারা মৃত স্বামীর চিতায় পুড়তে উঠবে না; এই কারণেই ইংরেজ-এর কাছে এটি সহমরণ না, সতীদাহ (বার্নিং উইডো বা সতী/Suttee)। সহমরণের সময়ে উলুধ্বনির মাধ্যমে জীবন্ত পুড়তে থাকা বিধবার আর্তচিৎকার গোপন করা হয় বলে ভাবতো ইংরেজরা। বা বিধবাকে দড়ি দিয়ে বেধে দেওয়া হতো যাতে আগুনের যন্ত্রণায় উঠে দৌঁড় দিতে না পারে, কেউ মুক্ত হয় গেলে যাতে ঠেকাতে পারে সেজন্য চারপাশে লাঠি নিয়ে লোক খাড়াইয়া থাকতো। পরবর্তীকালের বাঙালি ঐতিহাসিকরাও এই ধারনা থেকেই ইতিহাস লিখছেন; সহমরণ হিসাবে না হয়ে সতীদাহ হিসাবেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারলো এই কারণে।
কিন্ত বিধবার উইল বিষয়ক এই ধারনা পুরাই ভুল প্রমাণিত হয় পরে। বাস্তবে দেখা গেলো ১৮১৩ সালের পরে সহমরণের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হইয়া উঠলো; দ্য হিন্দুজ: অ্যান অল্টারনেটিভ হিস্টি বইতে ওয়েন্ডি ডনিজার জানাইছেন, ১৮১৫ – ১৮১৮ তিনবছরে সহমরণের সংখ্যা ৮৩৯, আগের তিনবছরে এই সংখ্যা ছিলো ৩৭৮; দ্বিগুণেরও বেশি। সেসময়ে প্রকাশিত সমাচার দর্পণের পরিসংখ্যানের সাথে যদিও পুরো মেলে না ডনিজারের হিসাব; অবশ্য দুইটা পরিসংখ্যানের সময়কালে একটু ভিন্নতা আছে।
১৮১৮ সাল থেকে প্রকাশিত হওয়া সংবাদপত্রে স্বেচ্ছায় মৃত স্বামীর চিতায় আরোহণের মাধ্যমে হিন্দু বিধবাদের সহমরণের খবর পাওয়া যায় প্রচুর; এসব খবরে ম্যাজিস্ট্রেট বা দারোগার বিধবাকে বোঝানো, বাচ্চাদের কথা ভাবতে বলা ইত্যাদির মাধ্যমে বিধবাদের নিরস্ত করার চেষ্টার কথা জানা যায়; ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি পেতে দুইদিন লাগলে সেই দুইদিন দাহ না করে ঘরে রাখা এবং পরে বিধবার সহমরণ—এমন খবরও পাওয়া যায়।
১৮১৩ সালের নিষেধাজ্ঞায় আরো একটা ধারা ছিলো: হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত/ব্রাহ্মণ যেইখানে সহমরণ বারণ বলে মত দেবেন, সেখানেও সহমরণ হতে পারবে না। রামমোহন এই ধারায় বলা হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত/ব্রাহ্মণের মত দেবার কাজটিই করছেন আসলে।

ইংরেজের জন্য সহমরণ বোঝা খুব সোজা ছিলো না; ইউরোপ জুড়ে ডাইনী নিধন তখনো খুবই টাটকা স্মৃতি; হিন্দু বিধবাদের তাঁরা ইউরোপের ‘ডাইনী’ হিসাবেই বুঝতো সম্ভবতঃ। সে কারণেই মনে হয় সহমরণ তাদের কাছে ‘উইডো বার্নিং’ বা পোড়াইয়া মারা বা ‘সতীদাহ’; স্বেচ্ছায় চিতায় যাওয়া আসলে কেবলি নেশাদ্রব্যের সাময়িক হিতাহিত জ্ঞানশূন্যতা। ইংরেজের কাছে চড়ক পূজার ব্যাখ্যাও মনে হয় এমনই ছিলো। হিন্দু বিধবাদের বাঁচানো ইংরেজের বিশেষ এজেন্ডা হওয়া নেটিভের জীবনের প্রতি ইংরেজের মায়া হিসাবে দেখা মুশকিল; কেননা, আগে পরে নীল চাষ বা দুর্ভিক্ষে নেটিভরা মারা যাওয়ায় ইংরেজরা বিশেষ তাড়িত হয় নি। ইউরোপের মধ্যযুগে ইংরেজরা যে আর নেই সেইটা প্রমাণ করার সহজ উপায় হিন্দু বিধবাদের বাঁচানো; নিজের প্রতি ইংরেজের নৈতিক সন্দেহ দূর করার সোজা রাস্তা এইটাই।
                           ©️রানা চক্রবর্তী©️
এদিকে রামমোহন বেশ ইন্টারেস্টিং আলোচনা করেন সহমরণ নিয়ে; তাঁর আলোচনায় সহমরণের কতগুলি কারণ পাওয়া যায়। তিনি একে সহমরণই বলছেন, সতীদাহ না। হিন্দু বিধবা স্বেচ্ছায় স্বামীর চিতায় যাচ্ছে, তাঁর মতে হিন্দু ধর্মের মাননীয় শাস্ত্রগুলি সহমরণের বিপক্ষে; হিন্দু বিধবাদের বরং ব্রহ্মচর্যে বাকি জীবন কাটাতে হবে। যুক্তি দিচ্ছেন তিনি যে, সহমরণ লোভের কাজ, ব্রহ্মচর্য ত্যাগের; স্বর্গে স্বামীর সঙ্গ পাবার লোভে বিধবা সহমরণে যাচ্ছে; এবং এটি আত্মহত্যা; শাস্ত্রে আত্মহত্যা পাপ।
রামমোহনের আরেকটা অকাট্য যুক্তি হলো—সহমরণে নির্বাণ লাভ হয় না নারীর; নির্বাণ কী? এইটা বৌদ্ধধর্মের নির্বাণ না ঠিক; এইটা হলো ‘যোনী’ থেকে মুক্তি লাভ। স্বামীর চিতায় মরলে স্বর্গে স্বামীসুখ পাবে ঠিক, কিন্তু তাতে করে পরজন্মে আবার নারীজন্মই হবে; কেননা সহমরণে নির্বাণ তথা ‘যোনী’ থেকে মুক্তির কোন বিধান নাই শাস্ত্রে। ‘যোনী’ থেকে মুক্তির জন্য নারীকে কঠিন ব্রহ্মচর্যে বিধবাজীবন পার করতে হবে। অর্থাৎ রামমোহন অভিশপ্ত নারীজন্ম থেকে মুক্তির জন্য নারীকে সহমরণে যাইতে মানা করছেন। হাউ ইন্টারেস্টিং!

১৯৩২ (আশ্বিন ১৩৩৯) সালে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা, প্রথম খণ্ড’ প্রকাশিত হয়। এই বইতে প্রধানতঃ মার্শম্যানের সম্পাদনায় শ্রীরামপুরের মিশনারি থেকে ১৮১৮ সালে প্রকাশিত ‘সমাচার দর্পণ (১৮১৮—১৮৩০)’ থেকে শিক্ষা, সমাজ, ধর্ম, সাহিত্য বিষয়ের সংবাদগুলি সংকলন করেন সম্পাদক। ‘সমাচার দর্পণ’-এ সহমরণ নিয়ে বেশ কিছু খবর প্রকাশিত হয়। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, মার্শম্যান সম্পাদক হলেও পত্রিকার খবর লেখালেখির কাজ করতেন হিন্দু পণ্ডিতরা। শুরুতে বলা কয়েকটা বিষয়ের ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে হিন্দু পণ্ডিতদের এই ভূমিকা থেকে। যেমন, সহমরণ বিষয়ের খবরগুলি প্রায় সবই বিধবাদের স্বেচ্ছায় স্বামীর চিতায় যাওয়ার বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে। ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের নিরস্ত করার নানাবিধ চেষ্টার পরেও বিধবারা স্বামীর চিতায় যাচ্ছেন খবরগুলিতে। কোন জোরাজুরি বা নেশাদ্রব্য খাওয়ানো হচ্ছে না। মৃত ব্রাহ্মণের ৩২ বউয়ের মধ্যে চারজন একসাথে অভিন্ন স্বামীর চিতায় মরছেন—এমন খবরও আছে।
সমাচার দর্পণে প্রকাশিত সহমরণের খবরগুলি সহমরণকে উৎসাহিত করতো; ধর্ম ও নারীর জয়গানের ভাব আছে এগুলিতে। অনুমান করি, খবরগুলি ছিলো ১৮১৩ সালের সহমরণ বিষয়ক আইনের প্রতিক্রিয়া; সে হিসাবে বলা যায়, হিন্দু বিধবারাই ইংরেজবিরোধী আন্দোলনের প্রথম দিককার শহিদ। সহমরণের খবরগুলিতে সম্ভবতঃ ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদ বিকশিত হবার কিছু লক্ষণও পাওয়া যাবে; অর্থাৎ সহমরণই শুরুর দিককার জাতীয়তাবাদী তৎপরতা! এর বাইরে সহমরণের পক্ষে-বিপক্ষে দুয়েকটা চিঠিও প্রকাশিত হইছিলো। পক্ষের একটি চিঠিতে রামমোহনকে অহিন্দু হিসাবে ইঙ্গিত করা হচ্ছে; রামমোহন বৈষ্ণব কুলোদ্ভূত বলে তাঁর মতামত হিন্দুদের বেলায় অপ্রযোজ্য বলে দাবি করা হচ্ছে। একদিকে সম্পাদক মার্শম্যান, অন্যদিকে হিন্দু পণ্ডিত—এইভাবে সহমরণের বিপক্ষ-পক্ষে ভাগাভাগি ছিলো সম্ভবতঃ। খবরগুলির আরেকটা লক্ষণীয় দিক ছিলো; সহমরণের সবগুলিই মোটামুটি ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণীদের খবর। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সহমরণের কোন খবর প্রকাশিত হয় নি।

১৮২৯ সালে ‘সতীদাহ’ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার পরে রামমোহন ও রবীন্দ্রনাথের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর সহ কোলকাতার চার বিশিষ্ট নাগরিক উইলিয়াম বেন্টিংক-এর সাথে দেখা করার খবরও প্রকাশিত হইছিলো। নিষেধাজ্ঞার পরে ইংল্যন্ডে আপীল করার জন্য সভা করার খবর পাওয়া যাচ্ছে সমাচার দর্পণে। আরো জানা যায়, আপীল করার পরামর্শও লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক-এর; তিনি পত্রিকা মারফত জানান যে, এ বিষয়ে কেউ আপীল করলে তিনি সানন্দে ইংল্যান্ডে পৌঁছেদেবেন সেটি।
                               ©️রানা চক্রবর্তী©️
নারীর ওপর নিপীড়ন চিরকালই হয়েছে ধর্মের নামে। প্রকৃতপক্ষে পুরুষের স্বার্থে। পৌনে ২০০ বছর আগে রামমোহন রায় আরও লিখেছিলেন:

"বিবাহের সময় স্ত্রীকে অর্দ্ধাঙ্গিনী বলিয়া স্বীকার করেন কিন্তু তাহাদের সহিত পশুর অধিক ব্যবহার করেন। স্বামীর গৃহে প্রায় সকলের পত্নী দাস্যবৃত্তি করে অর্থাৎ অতি প্রাতে কি শীতকালে কি বর্ষাতে স্থান মার্জ্জন, ভোজনাদি পাত্র মার্জ্জন, গৃহ লেপনাদি তাবৎ কর্ম্ম করিয়া থাকে এবং বৃহৎ পরিবারের সূপকারের কর্ম্ম বিনা বেতনে দিবসে ও রাত্রিতে করে।...এ সকলই স্ত্রীলোকেরা ধর্ম্মভয়ে সহ্য করে, আর সকলের ভোজন হইলে ব্যঞ্জনাদি উদর পূরণের অযোগ্য যৎকিঞ্চিৎ অবশিষ্ট থাকে তাহা সন্তোষপূর্ব্বক আহার করিয়া কাল যাপন করে। ...যাহার স্বামী দুই তিন স্ত্রীকে লইয়া গার্হস্থ্য করে তাহারা দিবারাত্রি মনস্তাপ ও কলহের ভাজন হয়। কখনো স্বামী এক স্ত্রীর পক্ষ হইয়া অন্য স্ত্রীকে সর্ব্বদা তাড়ন করে, আবার কেহ কেহ সামান্য ত্রুটি পাইলে বা বিনা কারণে সন্দেহবশতঃ স্ত্রীকে চোরের তাড়ণা করে (অর্থাৎ চোরের ন্যায় প্রহার করে) অনেক স্ত্রীই ধর্ম্মভয়ে এ সকলই সহ্য করে।
নারীর মর্যাদা রক্ষায় হিন্দুসমাজের সংস্কারকেরা প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যে দীর্ঘ লড়াই করেছেন। তাতে নারী নির্যাতন, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ প্রভৃতি অভিশাপ থেকে সমাজ অনেকখানি মুক্তি পেয়েছে। নারীশিক্ষা ব্যাপক বিস্তারিত হয়েছে, নারীকে পর্দার কারাগার থেকে বের করে আনা হয়েছে, সমাজের সব ক্ষেত্রে নারী তার মেধা ও প্রতিভার পরিচয় দিচ্ছে। এখন দরকার নারীর অগ্রযাত্রার পথকে আরও সহজ করা। যেসব বাধা এখনো আছে তা তার সামনে থেকে সরিয়ে ফেলা। সব ধর্মের নেতাদেরই উচিত তাদের পূর্বসূরিদের ভুল স্বীকার করে নারীর চলার পথকে আরও সহজ করা।"
                           ©️রানা চক্রবর্তী©️
(তথ্যসূত্র:
১- আনন্দলোক-আচার্য সুভাষ শাস্ত্রী পৃঃ-৭৭, বৈদিক সাহিত্য কেন্দ্র, যশোর।
২- ATHARVA VEDA, vol. II, page 552, English translation by Dr. Tulsi Ram.
৩- ATHARVA VEDA, vol. II, page 553, English translation by Dr. Tulsi Ram.
৪- Central Sati Act - An analysis by Maja Daruwala is an advocate practising in the Delhi High Court. Courtsy: The Lawyers January 1988.
৫- Economic and Social Developments under the Mughals" from Muslim Civilization in India by S. M. Ikram edited by Ainslie T. Embree New York: Columbia University Press, 1964.
৬- রামমোহন রচনাবলী (১৯৭৩)।
৭- সতী, স্বপন বসু, সুবর্ণ (২০১১)।
৮- বাংলায় নবচেতনার ইতিহাস (২০১৬), স্বপন বসু, পুস্তক বিপণি (২০১৪)।
৯- বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা (২০০৯), বিনয় ঘোষ
১০- বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ (২০১১), বিনয় ঘোষ
১১- তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ১৯কল্প দ্বিতীয় ভাগ, ১৮৩৮
১২- Parliamentary Papers (HOC),1825, Vol-XXIV
১৩- Parliamentary Papers (HOC), 1825, Vol-XVIII.
১৪- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩রা ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সাল।)
                              ©️রানা চক্রবর্তী©️

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ