'বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহ বিরোধী আন্দোলন' - চাপা পড়ে যাওয়া এক ইতিহাস ।। রানা চক্রবর্তী


বিধবা বিবাহ আন্দোলনের সাথে বিদ্যাসাগর বঙ্গদেশে কুলীনদের বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধেও আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তিনি নিজে ছিলেন কুলীন ব্রাহ্মণ, তাই এই প্রথার কুফল তিনি ভালো ভাবেই জানতেন। তাঁর আত্মীয়দের মধ্যে অনেকে এই কুপ্রথার ফল দুঃখভোগ করেছিলেন। এই প্রথার জন্য দেশে বিধবার সংখ্যা বেড়ে গিয়ে একটি গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। তাই বিধবা বিবাহ আন্দোলনের সাথে এই বহুবিবাহ প্রথার বিষয়টি ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত ছিল।

বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে আইন তৈরি করার জন্য সরকারের কাছে দরখাস্ত দেবার কয়েক মাসের মধ্যেই বিদ্যাসাগর ১৮৫৫ সালের ২৭শে ডিসেম্বর বহুবিবাহ বন্ধ করার জন্য আরেকটি দরখাস্ত দিলেন। এই আবেদনপত্রে ২৫ হাজার ব্যক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে বর্ধমানের তৎকালীন মহারাজা মেহতাবচাঁদ ও বঙ্গদেশের অন্যান্য কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। বিদ্যাসাগর তাঁর নিজের তৈরি দরখাস্তে লিখেছিলেন,

"কুলীনেরা কেবলমাত্র অর্থের জন্য বিবাহ করে। বিবাহ বলতে যেসব দায়িত্ব বোঝায় সেসব পালন করার বিন্দুমাত্র উদ্দেশ্য তাদের থাকে না। এই নামমাত্র বিবাহে স্ত্রীলোকেরা বিবাহিত জীবনের সকল রকমের সুখ থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের হৃদয়ের স্বতঃস্ফূর্ত স্নেহ ভালোবাসা অর্পণের জন্য যোগ্য পাত্রের অভাবে তিলে তিলে তারা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। কিংবা কামনার আবেগে বা শিক্ষার অভাবে তাদের নৈতিক অধঃপতন ঘটে। ... এর প্রতিকার কি তা স্পষ্ট জানা থাকলেও এবং সে ব্যবস্থা হিন্দুধর্ম-সম্মত হলেও হিন্দু সমাজের বর্তমান সংঘবদ্ধহীন অবস্থার মধ্যে জনমতের সাহায্যে বা অন্যভাবে সে ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব নয়। একমাত্র আইনের শক্তির দ্বারাই তা করা সম্ভব।"

উপরোক্ত বক্তব্যের প্রথম বাক্য দুটির অর্থ ভালো করে বুঝতে গেলে বঙ্গদেশের কুলীন প্রথা ও বহুবিবাহের ইতিহাস সংক্ষেপে আলোচনা করা প্রয়োজন।

সম্মানলাভার্থে প্রজারা সৎপথে চলবে, এই উদ্দেশ্যে বাংলার সেন বংশের রাজা বল্লালসেন কৌলিন্য প্রথা সৃষ্টি করেছিলেন। ক্ষত্রিয়দের মধ্যে যাঁরা নবগুণবিশিষ্ট ছিলেন, বল্লাল তাঁদের কুলীন উপাধি দিয়েছিলেন। এই নবগুণগুলো হল: আচার, বিনয়, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, তীর্থ দর্শন, নিষ্ঠা, শান্তি, তপ ও দান। এগুলি 'কুল লক্ষণ' নামে পরিচিত।

বল্লাল সেন কনৌজের ভট্টশালীগ্রাম-নিবাসী শ্রোত্রিয়দের বসবাসের অসুবিধা দূর করার জন্য নিজের প্রকান্ড রাজ্যের নানা স্থানে পাঠিয়ে তাঁদের ভরণ-পোষণের যোগ্য ব্রহ্মত্র দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে একশ ঘর গঙ্গার বাম পারে বরেন্দ্রভূমিতে বাসস্থান পেয়ে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ নামে খ্যাত হন আর ছাপ্পান্ন ঘর গঙ্গার অপর পারে রাঢ়দেশে ব্রহ্মত্র লাভ করে রাঢ়ী ব্রাহ্মণ আখ্যা প্রাপ্ত হন।রাঢ়ী ও বারেন্দ্র বিভাগ ব্রাহ্মণ ছাড়াও বৈদ্য, কায়স্থ ও অধিকাংশ অপর জাতীর মধ্যেও ছিল।

বৈদ্যদের মধ্যে যারা ধার্মিক ও গুণবান এবং কায়স্থদের মধ্যে যারা শ্রোত্রিয়দের পরিচারক-সন্তান তারা কুলীন উপাধি পেয়েছিলেন। এভাবে ঘোষ, বসু, গুহ ও মিত্র বংশীয়রা কায়স্থরা কুলীন হল; তিলী, তাঁতি, কামার, কুমোর প্রভৃতি সৎশূদ্রদের গুণ ও সঙ্গতি দেখে বল্লাল তাদের শ্রেষ্ঠ লোকদের কুলীন করেছিলেন, এরাই মানী বা পরামানিক নামে পরিচিত হয়।

বঙ্গরাজ দেবপাল গৌড় নগর থেকে কয়েক ঘর কায়স্থ এনে বঙ্গদেশে স্থাপন করেন। তাদের সঙ্গে তিনি বিবাহ আদান প্রদান করে নিজে তাদের সমাজে মিলিত হন। সেই বঙ্গজ কায়স্থরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে বঙ্গজ ও দক্ষিণ রাঢ়ী কায়স্থ বলে পরিগণিত হয়। এদেরকে বল্লাল সেন কৌলিন্য মর্যাদা দেন।

বল্লাল নিয়ম করেছিলেন যে, প্রতি ছত্রিশ বছরের শেষে এক এক বার বাছাই হবে, এবং গতে গুণ ও কর্ম অনুযায়ী কুলীন ও অকুলীন নির্বাচিত হবে।সুতরাং কুলমর্যাদা লাভার্থে সবাই ধার্মিক ও গুণবান হতে চেষ্টা করবে। বল্লালের সেই আশা প্রথম প্রথম সফল হলেও লক্ষণসেনকৃত ব্যবস্থায় তা বংশানুক্রমিক হয়ে গিয়ে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

কৌলিন্য প্রথার সৃষ্টি সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন কুলশাস্ত্রে বিভিন্ন মত দেখা যায়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামগতি তর্করত্ন প্রভৃতি বিজ্ঞ রাঢ়ীয় পন্ডিতেরা বল্লাল সেনকেই কৌলিন্যের সৃষ্টিকর্তা বলেছেন। অথচ কোন কোন রাঢ়ীয় কুল শাস্ত্রে ধরাধর কর্তৃক রাঢ়ীয় শ্রোত্রিয় মধ্যে কুল মর্যাদা সৃষ্টি দেখা যায়। বাচস্পতি মিশ্র কৃত কুল শাস্ত্রের সাথে বারেন্দ্র কুল শাস্ত্রের কিছু ঐক্য আছে।

কৌলিন্য মর্যাদা বাঙালীদের জীবনাধিক গুরুতর গণ্য ছিল। অনেকে সর্বস্ব বিক্রয় করে কুলমর্যাদা রক্ষা করতেন। কেউ কেউ অশীতিপর বৃদ্ধের সাথে সপ্তবর্ষীয় কন্যার বিবাহ দিয়ে কুল বাঁচাতেন।এমনকী রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের মধ্যে অনেক সময় কুল মর্যাদা রক্ষায় ধর্মশাস্ত্রের বিধান লঙ্ঘিত হত এবং পঞ্চাশ বছর বয়স্কা কুমারীকে দশবর্ষীয় বালকের সাথে নামমাত্র বিবাহ দিয়ে কুলমর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে হত।পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরু থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ অবধি সুদীর্ঘ চারশ বছর বল্লালী কুলমর্যাদাই উচ্চ শ্রেণীর বাঙালীদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য ছিল।

কৌলীন্য প্রথা যে কোনো জাতি বা গোষ্ঠী বা বর্ণ বা সম্ভ্রান্ত বংশ যারা সামাজিক সম্মান ভোগ করে এবং ঐতিহ্যগতভাবে নিজেদের সামাজিক অবস্থান এবং ‘কুল’ পরিচিতি ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর। এ আকাঙ্ক্ষার পরিচয় পাওয়া যায় রামায়ণএর (খ্রিস্টপূর্ব দু শতক থেকে দু খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) সময় থেকে। তাই কুলীন অর্থ হলো উত্তম পরিবার বা সম্ভ্রান্ত বংশজাত। বাচস্পতি মিশ্র-এর মতে, এটি চিহ্নিত হয় আচার (শুদ্ধতা), বিদ্যা (জ্ঞান), বিনয় (শৃঙ্খলাবোধ), প্রতিষ্ঠা (শুদ্ধতার খ্যাতি), তীর্থ-দর্শন (তীর্থযাত্রা), নিষ্ঠা (কর্তব্যনিষ্ঠা), তপস্যা (কঠোর ধ্যান), আবৃত্তি (সমবর্ণে বিবাহ) এবং দান (উদারহস্ত) দিয়ে। সাধারণত এধরনের গুণাবলি দেখা যেত ব্রাহ্মণ পরিবারে, যদিও কায়স্থ এবং বৈদ্যগণ এসব গুণ অর্জন করে তাদের সম্পদ, শিক্ষা, উত্তম ব্যবহার সংযোজিত করে কুলীন হিসেবে গণ্য হতো। এরূপ যোগ্য পরিবারের সাথে বৈবাহিক সূত্র স্থাপনের মাধ্যমে সাধিত হতো জাত্যৎকর্ষ এবং এর ফলে কোনো একটি বর্ণের ব্যক্তির জন্য কুলীন সমাজে প্রবেশের দ্বার উন্মোচিত হতো। সমাজে কৌলীন্য প্রথার উদ্ভব ঘটেছে সম্ভবত এ ভাবেই।

রাঢ় ও বরেন্দ্র এর ব্রাহ্মণদের মধ্যে কৌলীন্য প্রথা অধিক মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করেছিল। তারা সম্ভবত কান্যকুব্জের পাঁচ ব্রাহ্মণ-রক্ষিতীশ, মেধতিথী, বিতরগ, সুধনিধি এবং সম্ভরি-এর উত্তরসূরি। বলা হয়ে থাকে যে, রাজা আদিশূর-এর নিমন্ত্রণে তাঁরা এখানে আসে। তবে উল্লেখ্য, আদিশূরের ঐতিহাসিকতা তর্কের উর্ধ্বে নয়। গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক এবং বর্মণ রাজা হরিবর্মণ উভয়েই যথাক্রমে শকদ্বীপী ও বৈদিক ব্রাহ্মণ নিয়ে এসেছিলেন বলে জানা যায়। বলা হয়ে থাকে, এ ব্রাহ্মণদের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির ফলস্বরূপ বাংলায় সামাজিক প্রথা হিসেবে কৌলিন্য প্রথার সূত্রপাত হয়েছে। সেন রাজা বল্লালসেনকেও কৌলিন্য প্রথার স্রষ্টা হিসেবে কৃতিত্ব দেওয়া হয়, যদিও এ দাবির সমর্থনে সেন যুগের কোনো সাহিত্যিক ও উৎকীর্ণলিপি প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তৃতীয় বিগ্রহপালের বনগাঁ তাম্রশাসনে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তাঁর কর্মকর্তা ঘন্তিস-এর প্রো-পিতামহের মাধ্যমে তাঁর পূর্বপুরুষের সাথে কোলঞ্চ (কান্যকুব্জ) ব্রাহ্মণ কচ্ছ-এর যোগসূত্র ছিল। ফলে কৌলীন্য প্রথার উদ্ভব পাল শাসনামলে হয়েছিল বলে মনে করা হয়।

ছয় ও সাত শতকের মধ্যে বৈদিক ব্রাহ্মণদের বিভিন্ন গোত্র, প্রবর এবং শাখা এবং শ্রৌত আচার-অনুষ্ঠান পালনকারী ব্রাহ্মণ ব্যাপক সংখ্যায় বাংলায় বসতি গড়ে তোলে। উত্তর ভারত থেকে আরও কিছু নতুন অভিবাসীর কারণে তাঁদের সংখ্যা নিয়মিত হারে বাড়তে থাকে, যার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রচুর লেখ তথ্যের মাধ্যম। আট থেকে বারো শতক পর্যন্ত সময়ে উৎকীর্ণ বহু লিপি থেকে জানা যায়, লাট (গুজরাট), মধ্যদেশ এবং স্বতন্ত্র কিছু লোকালয় যেমন ক্রোদঞ্চি বা ক্রোদঞ্চ (কোলঞ্চ), তরকরি (শ্রাবস্তি-র), মুক্তবস্ত্ত, হস্তিপদ, মৎস-বস, কুন্তির এবং চন্দবর থেকে আগত ব্যাপক সংখ্যক ব্রাহ্মণ বাংলায় বসতি স্থাপন করে। কালক্রমে বাংলায় ব্রাহ্মণরা রাঢ়ীয়, বারেন্দ্র, বৈদিক এবং শকদ্বীপী প্রভৃতি শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে।

বাংলার ঘটকদের (বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপনকারী) কুলজি গ্রন্থে ব্রাহ্মণ আমদানির কথা উল্লেখ রয়েছে। এ গ্রন্থগুলি বিভিন্ন নামে, যেমন কুলশাস্ত্র বা কুলগ্রন্থ বা কুলপঞ্জিকা হিসেবে পরিচিত। যদিও গ্রন্থগুলিকে একটি আলাদা শাস্ত্র হিসেবে গণ্য করা হয়, তথাপি প্রামাণিক ইতিহাসের উৎস হিসেবে পন্ডিতদের মধ্যে এগুলির প্রাচীনত্ব ও সত্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বেশিরভাগ কুলশাস্ত্রে অবশ্য কনৌজ বা কোলঞ্চ থেকে আদিশূর কর্তৃক পাঁচ ব্রাহ্মণ আনার কথা উল্লিখিত আছে। রাঢ়ীয় হিসেবে পরিচিত রাঢ়ের ব্রাহ্মণ এবং বারেন্দ্র হিসেবে পরিচিত বরেন্দ্রের ব্রাহ্মণ উভয়ই সে পাঁচ অভিবাসী ব্রাহ্মণকে তাদের পূর্বপুরুষ বলে দাবি করেন। সান্ডল্য নারায়ণ, বৎস্য ধরধর, কশ্যপ সুসেন, ভর্দ্বজ গৌতম এবং সবর্ন পরসর বেশিরভাগ কুলপঞ্জিকা-য় দাবি করা হয় এরাই বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের পূর্বপুরুষ, এবং এরা রাঢ়ীয় পাঁচ পূর্বপুরুষের সন্তান বলে মনে হয়। কিছু কিছু অভিবাসী ব্রাহ্মণের সন্তানের উত্তর বাংলায় চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ দুটি সমগোত্রীয় আলাদা গোষ্ঠীর উত্থান অবশ্য আকস্মিক ছিল না, এর পেছনে বেশকিছু কারণ কাজ করেছে। কালক্রমে বাংলার দুটি অংশে আলাদা দুটি সামাজিক রীতি ও আচার গড়ে উঠেছে এবং সে দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আন্তঃগোত্রীয় বিবাহ উৎসাহ পায় নি।

ঠিক কখন এ দুটি দল আলাদা শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে তা বলা কঠিন, যদিও তাদের পূর্বপুরুষ ছিল এক। লক্ষ্মণসেন এর প্রধান বিচারপতি হলায়ুধের ব্রাহ্মণ-সর্বস্ব থেকে রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র দুটি আলাদা শ্রেণির অস্তিত্ব সম্পর্কে সর্বপ্রথম নির্দিষ্ট করে জানা যায়। তিনি উভয় গোষ্ঠীর বৈদিক শাস্ত্রের মূল অর্থ সংক্রান্ত অজ্ঞতাকে তিরস্কার করেছেন। পশ্চিম ও উত্তর বাংলায় মুসলিম আক্রমণের কারণে বহু ব্রাহ্মণ পূর্ব বাংলার জনপদগুলিতে অভিবাসী হয়ে যায়। বাংলার এ অঞ্চলে এরপরও প্রায় এক শতককালব্যাপী হিন্দু শাসন বজায় ছিল।

পাল রাজারা অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু ছিলেন, এবং তাদের শাসনকালে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতি তাদের খুব একটা উৎসাহ চোখে পড়ে না। মুঙ্গের ও আমগাছি তাম্রশাসনে উল্লেখিত চার বর্ণের সঠিক ক্রম রক্ষার জন্য ধর্মপাল ও দ্বিতীয় বিগ্রহপালের ভূমিকা ও ব্রাহ্মণ্য সমাজের প্রতি পালরাজাদের প্রশাসনিক নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। বর্মণ বংশের সামলবর্মণ বৈদিক ব্রাহ্মণদের বাংলায় বসতি স্থাপনের জন্য নিয়ে আসেন। সেন বংশের বল্লাল সেনকেও কৌলিন্য প্রথার স্রষ্টা হিসেবে কৃতিত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। বর্মণ ও সেন উভয় রাজবংশই বাংলার বাইরে থেকে ব্রাহ্মণ আমদানি এবং বাংলায় ব্রাহ্মণ-প্রাধান্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বর্মণ ও পাল উভয় রাজবংশই বাংলায় বহিরাগত এবং উভয় বংশই বাংলায় ব্রাহ্মণবাদের প্রসারে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, কান্যকুব্জ থেকে পাঁচ ব্রাহ্মণের আগমনের গল্প দক্ষিণ ভারতে ইতোমধ্যেই প্রচলিত ছিল। সেন রাজবংশও দক্ষিণ ভারত থেকে এসেছিল এবং পূর্ব ভারতে তাদের রাজ্য স্থাপনের পর এ গল্পটা বাংলায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, কান্যকুব্জ থেকে ব্রাহ্মণদের নিয়ে আসা হয়েছিল।

তবে উল্লেখযোগ্য যে, সেনগণ ছিলেন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষক এবং তাদের শাসন ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উন্নয়নে বিরাট অবদান রেখেছিল। সমাজে ব্রাহ্মণদের ক্ষমতা ও অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয় এবং প্রথম দিকে এর প্রয়োজন ছিল রাজার ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করতে, কেননা তাঁরা ছিল বাংলায় বহিরাগত। তবে এক পর্যায়ে ব্রাহ্মণদের ক্ষমতা শাসকদের কাছে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই, জনসাধারণ্যে ঘটা করে কৌলীন্যের দোহাই দিয়ে ব্রাহ্মণদের বিভক্তি এবং এর মাধ্যমে শাসক শ্রেণিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো একটি সম্ভাব্য গোষ্ঠীর ক্ষমতাকে খর্ব করা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, এটি ছিল ব্রাহ্মণ সমাজের প্রভাবশালী অংশের সমর্থন নিয়ে রাজকীয় শক্তিকে ক্ষমতাবান করার এক কার্যকর পদ্ধতি। রাঢ়ীয়কুল মঞ্জুরি-তে ব্রাহ্মণদের বিদ্রোহী রূপের প্রকাশ পাওয়া যায়, যেখানে একটি ব্রাহ্মণ (শ্রোত্রিয়) দলের নেতা বিকর্তন পরাক্রম সহকারে রাজার মুখোমুখি হয়েছে এবং ব্রাহ্মণদের যোগ্যতা বা অযোগ্যতার ব্যাপারে রাজার বিচার করার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

রাঢ়ীয় কুলজি অনুসারে আদিশূর কর্তৃক নিয়ে আসা পাঁচ ব্রাহ্মণের সংখ্যা ক্ষিতিশূরের সময়ে ঊনষাটে এসে দাঁড়ায়। রাজা প্রত্যেককে বসবাসের জন্য একটি করে গ্রাম দান করেন, এর মাধ্যমেই রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের গাঞী-র উদ্ভব হয়। অন্যভাবে বলতে গেলে, প্রত্যেক ব্রাহ্মণ ও তাঁদের উত্তরপুরুষ যে গ্রামে বসবাস করত সে নামেই পরিচিত হয়ে ওঠে। এটাই তাঁদের গাঞী (গ্রামের অধিবাসী) হয়ে ওঠে, এবং পরবর্তীকালে এটাই হয়ে যায় পারিবারিক নাম। উদাহরণ স্বরূপ, মুখতি গ্রামে বসবাসকারীর গাঞী ছিল মুখতি এবং তাদের পারিবারিক নাম মুখতি গ্রামের নামের সাথে উপাধ্যায় (শিক্ষক) সংযুক্ত করে মুখোপাধ্যায়। অন্যান্য আরও সুপরিচিত পদবি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং চট্টোপাধ্যায় একইভাবে উদ্ভূত। বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদেরও একশত গাঞী ছিল। স্বাভাবিকভাবে, কুলজি সমূহেও তাদের গাঞী সংখ্যা ও নামের বিভিন্ন রকম উল্লেখ পাওয়া যায়। ক্ষিতিশূরের পুত্র ধরশূর রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের ঊনষাট গাঞীকে মুখ্য-কুলীন, গৌণ-কুলীণ ও শ্রোত্রিয় তিনটি শাখায় ভাগ করে।

ধীরে ধীরে কৌলিন্য প্রথা বৈদ্য ও কায়স্থদেরও প্রভাবিত করে। বৈদ্যগণ রাঢ় বৈদ্য, বারেন্দ্র বৈদ্য ও সিলেটি বৈদ্য এ তিন ভাগে এবং কায়স্থগণ দক্ষিণ রাঢ় কায়স্থ, উত্তর রাঢ় কায়স্থ, বারেন্দ্র কায়স্থ, সিলেটি কায়স্থ এবং গোলাম কায়স্থ (দাস) ভাগে ভাগ হয়ে যায়। রাঢ় ব্রাহ্মণগণ কুলীন, সিদ্ধ-শ্রোত্রিয়, সদ্ধ-শ্রোত্রিয় এবং কস্থ-শ্রোত্রিয়-তে ভাগ হয়ে যায়। বিবাহের আইন অনুযায়ী একজন কুলীন পুরুষ তার নিজের শ্রেণির কোনো নারীকে অথবা তার শ্রেণির উচ্চ কোনো শ্রোত্রিয় শ্রেণির নারীকে বিবাহ করতে পারত। একজন সিদ্ধ-শ্রোত্রিয় পুরুষ তার নিজের শ্রেণির নারীকে বিবাহ করতে পারত। একজন সদ্ধ-শ্রোত্রিয় নারী তার নিজের শ্রেণির মধ্যে অথবা উচ্চ দু শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত পুরুষকে বিবাহ করতে পারত। এভাবেই কুলীন মর্যাদা বজায় রাখার লক্ষ্যে এসব রীতির উদ্ভব ঘটেছিল।

কৌলীন্য প্রথা ধীরে ধীরে সমাজপতি এবং ঘটক (পেশাজীবী ঘটক) কর্তৃক আদর্শায়িত হয়। এ উদ্দেশ্যে তারা কুলপঞ্জিকা গ্রন্থের সূত্রপাত করে। এ গ্রন্থগুলি মূলত তিন ভাগে বিভক্ত (ক) আদিকুলকারিকা এবং ডাক, (খ) কুলপঞ্জিকা, ধাকুরি, সমিকরণকণিকা ও কুলাকুল বিচার এবং (গ) কক্ষনির্ণয়, ভবনির্ণয়, ধাকুর ও আধুনিক কুলপঞ্জিকা। ভরত মল্লিক-এর চন্দ্রপভা কুলপঞ্জিকা (১৬৭৫ খিষ্টাব্দ) এবং কবিকণ্ঠহার-এর সদ্বৈদ্য কুলপঞ্জিকা (১৬৫৩ খিষ্টাব্দ) দুটি গুরুত্বপূর্ণ কুলগ্রন্থ।

কৌলীন্য প্রথা কুলীন ব্রাহ্মণদের মাঝে বহুবিবাহের প্রচলন ঘটায়। কুলীন মর্যাদা এবং সামাজিক অবস্থান টিকিয়ে রাখার নিমিত্তে কুলীন পুরুষদের সাথে শ্রোত্রিয় মহিলাদের বিয়ে দেওয়া হতো। ফলে একই শ্রেণির মধ্যে বিবাহযোগ্য শ্রোত্রিয় মহিলার অভাব দেখা দেয়। এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে ঘটক ব্রাহ্মণ পণ নিয়ে তাদের বিয়ে শ্রোত্রিয় পুরুষের সাথে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করে। অন্যদিকে কুলীনদের মাঝে বিয়ের ব্যবস্থা একটি লাভজনক কর্মে পরিণত হয়। কুলীন মর্যাদা টিকিয়ে রাখতে একজন বয়স্ক পুরুষের সাথে অল্পবয়সী নারীকে যেমন বিয়ে দেওয়া হতো, তেমনি অল্প বয়স্ক একজন পুরুষের সাথে বিয়ে দেওয়া হতো বয়স্কা একজন মহিলার। তারপরও অনেক কুলীন নারী সারাজীবন অবিবাহিতই থেকে যেত। এ ঘৃণ্য প্রথা দীর্ঘ দিন পর্যন্ত চলতে থাকে। এমনকি, এখনও কিছু কিছু পরিবার বিয়ের মাধ্যমে এ কুলীন মর্যাদা বজায় রাখার চেষ্টা করে, যদিও এখন কৌলিন্য প্রথা তার আগের প্রাধান্য হারিয়ে ফেলেছে।

বাংলায় কৌলিন্য প্রথা কিছু নির্দিষ্ট সামাজিক-রাজনৈতিক লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, আঠারো এবং উনিশ শতকে এসে এর দীর্ঘস্থায়ী রূপ যেমন হয়ে পড়ে বিকৃত তেমনি দুর্বল। এটি সমাজের শুধু ব্যাধিতেই পরিণত হয় নি, বরং এটি বাংলার সমস্ত সামাজিক অবস্থাকে বিকৃত করে তোলে। বিদ্যাসাগরকে এ সামাজিক ব্যাধির সাথে অক্লান্ত সংগ্রাম করে যেতে হয়েছিল।

বিনয় ঘোষের লেখা 'ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর' পুস্তকের ১১০ নং পৃষ্ঠায় লেখা আছে,

”ব্রাহ্মণেরা কৌলীন্য প্রথার দোহাই দিয়ে সামাজিক সুবিধা আদায় করতে লাগলেন। ক্রমে এই কৌলীন্য প্রথা থেকে সৃষটি হল কন্যাকে উচ্চবর্নে বিবাহ দেবার রীতি, যার অবশ্যম্ভাবী ফল হল বহুবিবাহ। এক একজন কুলীন ব্রাহ্মণ বহু কন্যার পাণিগ্রহন করতে লাগলেন।
ঋতুমতি হবার আগে বিবাহ দেবার বাধ্যবাধকতা ও বিবাহ দিতে না পারলে পিতামাতার যে সামাজিক অসম্মান হত তা থেকে মুক্তি দেবার জন্য কুলীন ব্রাহ্মণেরা এই সব কন্যাদের বিবাহ করতেন। অতএব বিবাহ বেশ লাভজনক ব্যাবসা হয়ে উঠল। কুলীন ব্রাহ্মণ কন্যাদের অসহায় পিতা মাতার দু তিন ডজন স্ত্রী থাকা সত্বেও, ৭০/৮০ বছরের বৃদ্ধ কুলীন ব্রাহ্মণদের উপযুক্ত পাত্র বিবেচনা করতেন। মৃতপ্রায় ৮০ বছরের ও অধিক বয়স্ক বৃদ্ধের সাথে নিতান্ত বালিকা কন্যাদের বিবাহ হত মৃত্যুর আগে সে বৃদ্ধের লাভ হত সামান্য কয়েকটি টাকা।“

এছাড়া আরো অনেক দৃষ্টান্ত আছে যে যার দ্বারা প্রমান করা যেতে পারে যে কৌলিন্য প্রথা সমাজে ভীষন আকার ধারন করেছিল। যেমন,

(ক) একটি ব্রাহ্মণের যদি ত্রিশটি স্ত্রী থাকে তবে প্রতি মাসে কয়েকদিনের জন্য শ্বশুরালয়ে গিয়ে থাকলে আর খেয়ে ও ঊপহার পেয়ে থাকলে, জীবিকা অর্জনের কোন চেষ্টা না করে তার সারা বৎসর কেটে যেতে পারে। বহুবিবাহ প্রথার ফলে কুলীন ব্রাহ্মণেরা এক নিষ্কর্মা, পরভুকশ্রেণী হয়ে উঠেছে, এবং বিবাহের মত একটি সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান কে নীতি হীনতার উৎস করে তুলেছিল।

(খ) অতএব অনেক কুলীন ব্রাহ্মণের জীবনধারণের একমাত্র উপায় ছিল বহুবিবাহ করা।

(গ) কুলীনরা বৃদ্ধ বয়সে ও বিবাহ করত। অনেক সময় স্ত্রীদের সঙ্গে তাদের দেখা সাক্ষাৎই হত না অথবা বড়জোর ৩/৪ বছর পরে একবারের জন্য দেখা হত।

(ঘ) এমন কথা শোনা যায় যে একজন কুলীন ব্রাহ্মণ ১ দিনেই ৩/৪ টি বিয়ে করেছেন।

(ঙ) কোন কোন সময়ে একজনের সব কয়টি কন্যার ও অবিবাহিত ভগিনীদের একই সঙ্গে বিবাহ দেয়া হত।

(চ) কুলীনের ঘরের বিবাহিত বা কুমারী কন্যাদের খুব দুঃখের মাঝে দিন কাটাতে হত। কুলীনদের এ ধরনের বহু বিবাহের ফলে ব্যাভিচার, গর্ভপাত, শিশুহত্যা ও বেশ্যাবৃত্তির মত জঘণ্য সব অপরাধ সংঘটিত হত।

উপরের (ক) থেকে (চ) পর্জন্ত উদ্ধৃতিগুলো শ্রী বিনয় ঘোষের লেখা ঐ 'ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর' নামক পুস্তক থেকে নেয়া হয়েছে।

মোট কথা কৌলিন্য প্রথা এক শ্রেণীকে একশত খণ্ডে বিভক্ত করে বিভেদের প্রাচীর রচনার ফলে মানুষের মানবিকতাকে দারুনভাবে অপমানিত করা হয়েছিল এবং মানুষের স্বাধীন অধিকারের মূলে কুঠারাঘাত করা হয়েছিল।

কুলীন ব্রাহ্মণদের মধ্যে অনেকে যারা বহুবিবাহের বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁরা তাঁদের পরিবারের শোচনীয় দুর্গতির কথা লিখে রেখে গেছেন। তাঁদের মধ্যে পূর্ব বঙ্গের শ্রী রাসবিহারী মুখোপাধ্যায় ছিলেন কৌলিন্য প্রথা ও বহুবিবাহের বিরোধী একজন বিশেষ উল্লেখযোগ্য নেতা। পন্ডিত বিদ্যাসাগরের নির্দেশে তিনি বিগত শতকের ষষ্ঠ দশকে ঢাকা জেলার আন্দোলন শুরু করেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এই আন্দোলন বঙ্গের অন্যান্য জেলাতেও ছড়িয়ে পড়েছিল। বিদ্যাসাগর তাঁকে এই আন্দোলনের বিবরণ লিপিবদ্ধ করতে বলেছিলেন। সেই কথামতন তিনি নিজের জীবনের কিছু তথ্য দিয়ে এই আন্দোলনের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন। এই ইতিহাস ১৮৮১ সালে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়। এটি বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলনের একটি জরুরি দলিল। তিনি লিখেছিলেন,

" ... পিতাঠাকুর মহাশয় আমাকে অতি শৈশবাবস্থায় রাখিয়া স্বর্গারোহন করেন। তখন পিতৃব্য শ্রীযুক্ত তারক চন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহাশয় আমার অভিভাবক ছিলেন। দারিদ্রতাবশত আমাকে অল্পকালের মাঝেই তিনি ৮টি বিবাহ করান। আমি বাল্যকাল হইতেই বহুবিবাহের প্রতি বিদ্বেষী ছিলাম, সুতরাং সম্বন্ধ নিয়া ঘটক আসিলেই নানা স্থানে পলাইয়া যাইতাম। বহুবিবাহে সম্মতি থাকিলে বোধহয় আমাকে শতাধিক রমণির পাণী গ্রহন করতে হইত। অভিভাবক মহাশয়, প্রতিকূলমতি দেখিয়া প্রায় তিনশত টাকা ঋণভার অর্পণপূর্বক আমাকে পৃথগণ্ন করিয়া দেন। তখন আমার বিদ্যাবুদ্ধি বা এরূপ কোনো ক্ষমতা ছিল না যে ঐ ঋণ পরিশোধ বা পরিজন সকলের ভরণপোষণ করিতে পারি, সুতরাং অনন্যোপায় হয়ে আরো ৬টি পরিণয় স্বীকার করিতে হইল, তাহাতে আমার ঋন পরিশোধ ও পরিবারবর্গের কিঞ্চিৎ কালের ভরণপোষনের সংস্থান হইলে, আমি সাধারণরূপ যতকিঞ্চিৎ বাংলা লেখা শিক্ষা করিয়া পরগণা হোসেন শাহির জমিদারদিগের আশ্রয় গ্রহনপূর্বক তহশিলদারি কর্মে নিযুক্ত হইলাম।"
(রাসবিহারি মুখোপাধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত, ১৮৮১, ভারতীয় জাতীয় গ্রন্থাগারে পাওয়া যাবে।)

গভর্ণমেন্টের কাছে আবেদনপত্রে বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন,

"কুলীনেরা কেবলমাত্র অর্থের জন্য বিবাহ করে। বিবাহ বলতে যেসব দায়িত্ব বোঝায় সেসব পালন করার বিন্দুমাত্র উদ্দেশ্য তাদের থাকে না। ..."

রাসবিহারী মুখোপাধ্যায়ের আত্মকথা থেকে বোঝা যায় যে বিদ্যাসাগরের এই উক্তি সম্পূর্ন সত্য।

১৮৫৬-৫৭ সালে বহুবিবাহের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের ফলে তখনকার মতন ব্যর্থ হয়ে যায়। জে. পি. গ্র্যান্ট প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে বহুবিবাহ রদ করার জন্য তিনি একটি বিল আনবেন। কিন্তু বিদ্রোহের ফলে কাজ আর এগোতে পারে নি। তৎকালীন সরকারি তথ্য অনুসারে, বঙ্গদেশের নানা জেলার অসংখ্য লোকের স্বাক্ষরসহ প্রায় ১২৭টি বহুবিবাহবিরোধী আবেদনপত্র সরকারের কাছে এসেছিল। বেনারস থেকেও একটি অনুরূপ আবেদনপত্র এসেছিল। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের নেতা রাজা রাধাকান্ত দেব যথারীতি বহুবিবাহের সমর্থনে সরকারের কাছে একটি আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন। তৎকালীন ভারত সরকারের কাছে বাংলা সরকার এই বিষয়ে যে সংবাদ পাঠিয়েছিলেন তাতে লেখা ছিল,

"স্যার জে. পি. গ্র্যান্টের সাথে পরামর্শ করে স্বর্গীয় বাবু রামপ্রসাদ রায় যে খসড়া বিল তৈরি করেছিলেন তা পরিষদে উত্থাপন হতে যাচ্ছিল। কিন্তু সে সময়ে বাংলাদেশে সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হওয়াতে এবং তার পরবর্তী ঘটনার ফলে এই ব্যাপারটি তখনকার মতন স্থগিত হয়ে যায়। কিন্তু রাজনৈতিক বিদ্রোহজনিত বিক্ষোভের জন্য আন্দোলনটি একেবারে শেষ হয়ে যায় নি। বিদ্রোহের পর পাঁচ বৎসরের মধ্যে আবার আন্দোলনের ফলে সমস্যাটি সমাজের সামনে উত্থাপিত হল। ১৮৬৩ সালে বহুবিবাহ প্রথার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে আইন তৈরি করার অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশের প্রায় ২১,০০০ ব্যক্তি সরকারের কাছে আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন। এই আবেদনপত্রগুলির একটি তে ছিল, 'এই আবেদনপত্রে স্বাক্ষরকারীদের বিশ্বাস যে হিন্দু রমনীদের জীবনব্যাপী বৈধব্য যন্ত্রণার চেয়েও কষ্টকর এবং গার্হস্থ্য সুখনাশক এই বহুবিবাহের প্রথার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সমাজের সকলের একমত হবার যথেষ্ট কারণ আছে।' ..."

১৮৬৬ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি বিদ্যাসাগর সরকারের কাছে ২১,০০০ ব্যক্তির স্বাক্ষরযুক্ত একটি দরখাস্ত পেশ করেন। এই দরখাস্তে স্বাক্ষরকারী প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন নদিয়ার মহারাজা সতীশ চন্দ্র রায় বাহাদুর, ভূকৈলাসের (খিদিরপুর, কলকাতা) রাজা সত্য শরণ ঘোষাল, ও কান্দির (মুর্শিদাবাদ) রাজা প্রতাপ চন্দ্র সিংহ। এই আবেদনপত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল এইরূপ,

"মাননীয় মহোদয় তাঁর কাজের দায়িত্ব অপরের হাতে অর্পণ করার আগে তাঁর দীর্ঘ ও সফল চাকুরী জীবনের সমাপ্তির স্মারকচিহ্ন হিসাবে বাংলাদেশের নারী জাতিকে বহুবিবাহের ন্যায় ঘৃণ্য কুপ্রথাজনিত দুঃখ, নিষ্ঠুরতা ও অন্যান্য অত্যাচারের হাত থেকে মুক্ত করবেন বলে আবেদনকারীরা সাগ্রহে আশা করছেন ও প্রার্থনা জানাচ্ছেন।"

জাস্টিস দ্বারকানাথ মিত্র, বিখ্যাত শিক্ষা সংস্কারক প্যারীচরণ সরকার, বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা কৃষ্টদাস পাল প্রভৃতিদের নিয়ে ১৮৬৬ সালের ১৯শে মার্চ পন্ডিত বিদ্যাসাগর গভর্ণমেন্টের কাছে উপস্থিত হলেন। দলের নেতা আবেদনপত্রটি পাঠ করে শোনালেন। লেফটেন্যান্ট গভর্নর সিসিল বিডন তার উত্তরে বলেন,

"বহুলোকের স্বাক্ষরযুক্ত এই আবেদনপত্র পেয়ে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হলাম। আপনাকে ও আপনার দলের সম্মানিত ব্যক্তিদের সকলকে আমি আশ্বাস দিচ্ছি যে হিন্দুদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রথার অপব্যবহার বন্ধ করার জন্য আইন প্রণয়নের ব্যাপারে আমি সানন্দে আমার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করব। শিক্ষিত হিন্দু সমাজের যুক্তিপূর্ণ মত ও ইচ্ছার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যতদূর সম্ভব এ প্রথা নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা করব। আমি নিজেও মনে করি যে এই প্রথা মানুষের নীতিজ্ঞান কে নষ্ট করে দিচ্ছে।"

ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের মুখপাত্র 'হিন্দু পেট্রিয়ট' এই আন্দোলনের পুনঃপ্রচেষ্টা সম্পর্কে ১৮৬৬ সালের ২৬শে মার্চ লিখেছিল,

"উৎসাহী সমাজ সংস্কারক পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে কুলীনদের বহুবিবাহ প্রথার অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আবার এক দশক পরে নতুন করে আন্দোলন শুরু হয়েছে। তাঁর এই প্রচেষ্টায় বাঙালি হিন্দু সমাজের ধনী, শিক্ষিত, সনাতনী ও আধুনিক মনোভবাপন্ন সকল ব্যক্তির অনুমোদন আছে। ... লক্ষ্য করা যায় যে আবেদনপত্রে সমাজের সমাজের সকল শ্রেণীর ও সবরকম মতালম্বী ব্যক্তিদের স্বাক্ষর আছে। ... বহুবিবাহ রীতির অপব্যবহারের প্রশ্ন নিয়ে নিয়ে আবেদনপত্রে কোনও যুক্তি তর্ক করা হয় নি। এ বিষয়ে কোনও আলোচনা না করার কারণ এই যে ১৮৬৬ সালে যে ৩২টি আবেদনপত্র দেওয়া হয়েছিল তাতে এ বিষয়ে অনেক আলোচনা ছিল। ... এ অবস্থায় দরখাস্ত টি সংক্ষিপ্ত হবার ফলে যে কেউ কেউ মনে করছেন যে বহুবিবাহ রীতিকে একেবারে তুলে দেবার জন্য আবেদন জানানো হয়েছে, যদিও কেবলমাত্র এই রীতির অপব্যবহার বন্ধ করার জন্য এই দরখাস্ত করা হয়েছে, এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই।"

সরকার যখন দেখলেন যে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বেশ বৃহৎ একটি অংশ বহু বিবাহ রীতিকে সংযত করার বিষয়ে মধ্যবর্তী পথ নিতে চান, তখন তারা এই বিষয়ে কোনও আইন প্রণয়ন করতে চাইলেন না। সপরিষদ গভর্নর জেনারেল ইচ্ছা প্রকাশ করেন যে এখনই কোনও বিল না এনে এবিষয়ে আরও অনুসন্ধান করা হোক। ভারত সরকারের নির্দেশে বাংলাদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নর কয়েকজন বিশিষ্ট বাঙালি কে নিয়ে তৈরি একটি কমিটি নিয়োগ করলেন। এই কমিটি তে সি.হবহাউস আর এইচ.টি প্রিন্সেপ কে রাখা হয়েছিল। হিন্দুদের একাধিক স্ত্রী গ্রহনের স্বাধীনতা কে খর্ব না করে বহুবিবাহ প্রথা রদ করার জন্য কোনও আইন তৈরি সম্ভব কিনা, এই কমিটিকে সেই বিষয়ে তদন্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৮৬৭ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। রিপোর্টে হিন্দুশাস্ত্র থেকে প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি দিয়ে কমিটি পরিষ্কার ভাবে প্রমান করে যে, যেসব ধর্মশাস্ত্র হিন্দুরা মেনে চলেন তার মধ্যে কোথাও এই প্রথার কোনও বিধান বা নির্দেশ নেই। কমিটির মতে এই সম্বন্ধে একটি ঘোষণামূলক আইন করা কঠিন নয়। এই আইন অমান্য করলে শাস্তি দেওয়া হবে। কিন্তু কমিটি দুঃখের সাথে এটাও জানায় যে তাঁদের সীমাবদ্ধ ক্ষমতার দরুন একটি ঘোষণামূলক আইন প্রণয়ন করার সুপারিশও তারা করতে পারছেন না। কমিটির বাঙালি সভ্যদের মধ্যে রামনাথ ঠাকুর, জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ও দিগম্বর মিত্র মত দেন যে হিন্দুদের বহুবিবাহ প্রথার ওপরে কোনও আইনগত বাধা আরোপ করার প্রয়োজন নেই। তাঁদের মত ছিল, শিক্ষার ফলে ও সামাজিক চাপে কুলীন ব্রাহ্মণেরা ক্রমে এক বিবাহে অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন।

বিদ্যাসাগর এই বিষয়ে নিজের মতানৈক্য জানিয়ে নিম্নলিখিত মন্তব্যসহ নিজের নাম স্বাক্ষর করেন। তিনি লিখেছিলেন,

"আমার মতে বহুবিবাহ প্রথার কুফল সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে তা মোটেও অতিরঞ্জিত নয়। এই কুফল কিছু হ্রাস পেলেই যে আইন করার প্রয়োজন থাকবে না তা আমি মনে করি না।
কমিটির অন্যান্য সদস্যদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমি একমত হতে পারছি না। আমার মতে হিন্দুদের এখন একাধিক বিবাহ করার যে স্বাধীনতা আছে তাকে ক্ষুন্ন না করে একটি ঘোষণামূলক আইন করা যেতে পারে।"

বাংলাদেশের তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর অন্ততপক্ষে একটি ঘোষণামূলক আইন করে বহুবিবাহ প্রথার বাড়াবাড়ি বন্ধ করার পক্ষপাতী ছিলেন। ভারত সরকারের কাছে ১৮৬৭ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি কমিটির পাঠানো রিপোর্টের সাথে তিনি যে মন্তব্য করেছিলেন তা থেকে জানা যায় যে তিনি বিদ্যাসাগরের মতের প্রতিই বেশি সহানুভূতিশীল ছিলেন।

বাংলাদেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ কমিটির উপরোক্ত তিনজন ভারতীয় সদস্যের অনুরূপ মনোভাব পোষণ করেন দেখে ভারত সরকার বহুবিবাহের বিরুদ্ধে কোনও ঘোষণামূলক আইন করতে রাজি হলেন না। ইতিমধ্যে ভারত সচিবের কাছ থেকে একটি সরকারি বার্তা পাওয়া গেল। তিনিও আইন করার ব্যাপারে অগ্রসর হতে আপত্তি জানালেন। কারণ কুলীন ব্রাহ্মণদের বহুবিবাহের অপব্যবহারের কথা ছেড়ে দিলে, এমনকি বাংলাদেশের একটি বড় অংশ বহুবিবাহ প্রথার বিরোধী বলে তাঁর মনে হয় নি।

কিন্তু বিদ্যাসাগর এতে নিরস্ত হলেন না। যদিও ১৫ বছর ধরে বিধবা বিবাহ আন্দোলন নিয়ে যে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন তিনি হয়েছিলেন তাতে সমাজ সংস্কার সম্বন্ধে দেশের লোকের মত গড়ে তোলার বিষয়ে তাঁর সম্পূর্ণ হতাশ হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু দেখা গেল যে তিনি লেখার মাধ্যমে বহুবিবাহের বিরুদ্ধে বিশাল আন্দোলন শুরু করলেন।

১৮৭১ ও ১৮৭৩ সালে বহুবিবাহ সম্বন্ধে তিনি দুটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা প্রকাশ করেন। বিভিন্ন শাস্ত্র থেকে অসংখ্য উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি প্রমান করে দিলেন যে কৌলিন্য প্রথা ও বঙ্গদেশের কুলীন ব্রাহ্মণদের মধ্যে যে উচ্চবর্ণের কন্যাদানের বিশেষ রীতি রয়েছে তার পিছনে কোনও শাস্ত্রীয় বিধান নেই। কলকাতা শহরের সবচেয়ে নিকটবর্তী হুগলি জেলায় কুলীনরা কিভাবে বহুবিবাহ করে থাকেন তার একটা তথ্য তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। এইসব কুলীনদের নাম ও তাঁদের স্ত্রী'র সংখ্যা তালিকা তিনি তাঁর বইতে সংযোজন করেছিলেন। অনেক কুলীন ব্রাহ্মণ নিজেও হিসাব রাখতেন না যে তাঁরা কয়টি মেয়েকে বিবাহ করেছেন। তাঁদের মধ্যে আবার কেউ কেউ একটি ছোট খাতায় বিয়ের ও বিয়েতে পাওয়া যৌতুকের তালিকা লিখে নিজেদের কাছে রেখে দিতেন। পর্যায়ক্রমে তাঁরা শ্বশুরবাড়ি গেলে শ্বশুররা তাঁদের কিকি যৌতুক দিতেন, সেটারও একটা তালিকা তৈরি করে নিজের কাছে তাঁরা রাখতেন। বহুবিবাহ বিরোধী দরখাস্তের সঙ্গে এসব তথ্যও সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পরে সরকার সতর্ক ছিল। তাই ভারতবাসীর ধর্ম ও সংস্কারে আঘাত করে এমন কোনও আইন তারা করতে চান নি।

বহুবিবাহ সম্বন্ধে ১৮৭১ সালে প্রকাশিত প্রথম পুস্তকে তিনি লিখেছিলেন,

"বহুবিবাহ প্রচলিত থাকাতে অশেষ প্রকারে হিন্দুসমাজের অনিষ্ট ঘটিতেছে। সহস্র সহস্র বিধবা নারী, যারপরনাই, যন্ত্রনা ভোগ করিতেছেন। ব্যভিচারদোষের ও ভ্রূণহত্যাপাপের স্রোত প্রবলবেগে প্রবাহিত হইতেছে। দেশের লোকের যত্নে ও চেষ্টায় ইহার প্রতিকার হওয়া কোনও মতে সম্ভাবিত নহে। সম্ভবনা থাকিলে, তদর্থে রাজদ্বারে আবেদন করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন থাকিত না। এক্ষণে, বহুবিবাহ প্রথা রদ হওয়া আবশ্যক, এই বিবেচনায় রাজদ্বারে আবেদন করা উচিত; অথবা এরূপ বিষয়ে রাজদ্বারে আবেদন করা ভালো নয়, অতএব তাহা প্রচলিত থাকুক, এই বিবেচনায় ক্ষান্ত থাকা উচিত। এই জঘন্য ও নৃশংস প্রথা প্রচলিত থাকাতে, সমাজে যে গরীয়সী অনিষ্ট পরম্পরা ঘটিতেছে, যাঁহারা তাহা অহরহ প্রত্যক্ষ করিতেছেন এবং তাহা প্রত্যক্ষ করিয়া যাঁহাদের অন্তঃকরণ দুঃখানলে দগ্ধ হইতেছে, তাঁহাদের বিবেচনায় যে উপায়ে হউক এই প্রথা রহিত হইলেই, সমাজের মঙ্গল। বস্তুতঃ, রাজশাসন দ্বারা এই নৃশংস প্রথার উচ্ছেদ হইলে, সমাজের মঙ্গল ভিন্ন অমঙ্গল ঘটিবেক, তাহার কোনও হেতু সম্ভাবনা দেখিতে পাওয়া যায় না। আর যাঁহারা তদর্থে রাজদ্বারে আবেদন করিয়াছেন, তাঁহাদের যে কোনও প্রকারে অন্যায় বা অবিবেচনার কর্ম করা হইয়াছে, তর্ক দ্বারা তাহা প্রতিপন্ন করাও নিতান্ত সহজ বোধ হয় না। আমাদের ক্ষমতা গভর্ণমেন্টের হস্তে দেওয়া উচিত নয়, এ কথা বলা বালকতা প্রদর্শন মাত্র। আমাদের ক্ষমতা কোথায়। ক্ষমতা থাকিলে ঈদৃশ্য বিষয়ে গভর্ণমেন্টের নিকটে যাওয়া কদাচ উচিত ও আবশ্যক হইত না; আমরা নিজেরাই সমাজ সংশোধন কার্য সম্পন্ন করিতে পারিতাম। ইচ্ছা নাই, চেষ্টা নাই, ক্ষমতা নাই, সুতরাং সমাজের দোষ সংশোধন করিতে পারিবেন না; কিন্তু তদর্থে রাজদ্বারে আবেদন করিলে অপমানবোধ বা সর্বনাশ জ্ঞান করিবেন, এরূপ লোকের সংখ্যা বোধ করি অধিক নহে এবং অধিক না হইলেই মঙ্গল।"

কিন্তু তাঁর এই আবেদনে কেউ কর্ণপাত করলেন না। কেবল তাঁর ওপরে নিন্দা ও গালি বর্ষিত হল। তখনকার বিখ্যাত পন্ডিতেরা তাঁদের লেখনীর মাধ্যমে এই গালি বর্ষণ করতে লাগলেন। তখন বিদ্যাসাগরের বয়স ৫২ বৎসর, তিনি নানারূপ ব্যাধিতে ভুগছিলেন। ১৮৫৫-৫৬ সালের বিধবা বিবাহ আন্দোলনের সময় তাঁর মধ্যে যে যৌবনসুলভ উৎসাহ ও শক্তি ছিল, পরে তা অন্তর্হিত হয়েছিল। ঋণের দায় ও হতাশার দুঃখ তাঁর ওপরে ভারী বোঝার ন্যায় চেপে বসেছিল। কিন্তু যখন তাঁর উদ্দেশ্য সাধনে বাধা আসতে লাগলো এবং চতুর্দিক থেকে সমালোচকের দল বহুবিবাহ প্রথা রদ করার আন্দোলনের জন্য তাঁকে আক্রমণ করতে লাগলো, তখন তিনি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে সকল শক্তি দিয়ে নিজেকে সমর্থন করলেন। বহুবিবাহ সম্বন্ধে তাঁর দ্বিতীয় পুস্তক ১৮৭৩ সালে প্রকাশিত হয়। এই পুস্তকে তিনি তাঁর সমালোচকদের মতন রূঢ় ভাষা ব্যবহার না করেই, তাঁদের গালির উচিত জবাব দিলেন। কিন্তু গত শতাব্দীর অষ্টম শতকে হিন্দু ধর্মের পুনরভ্যুত্থান যখন চরম সীমায় পৌঁছালো, তখন সেই উত্তেজনার মধ্যে বিদ্যাসাগরের এই প্রচেষ্টা আর অগ্রসর হতে পারলো না। বিদ্যাসাগরের তখন শেষ জীবন। তাঁর এই প্রচেষ্টাই ছিল সেই শতাব্দী তে প্রগতিশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মধ্যে শেষ সংগ্রাম। অবশ্য ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আবার আমরা এই সংগ্রাম শুরু হতে দেখি। কিন্তু তখনও প্রগতিশীল শক্তি সম্পূর্ণভাবে জয়ী হতে পারে নি।

পরবর্তীতে বহুবিবাহ নিষেধক যে বিলটির খসড়া প্রস্তুত হয়েছিল, সেটি ছিল এরকম,

‘Whereas the institution of marriage among Hindus has become subject to great abuses, which are alike repugnant to the principles of Hindu Law and the feelings of the people generally; and whereas the practice of unlimited polygamy has led to the perpetration of revolting crimes; and whereas it is expedient to make Legislative provision for the prevention of those abuse and Crimes, alike at variance with some policy, justice and morality; it is a enacted as follows—
No marriage, contracted by any male person of the Hindu religion, Who has a Wife alive…’

সেদিন হয়ত বীরসিংহ গ্রামের পন্ডিতের মুখে শেষ পর্যন্ত হাসি ফুটেছিল, পরপারের জগতে।

(তথ্যসূত্র:
১- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিনয় ঘোষ, ভারত সরকারের প্রকাশনা বিভাগ, এপ্রিল ১৯৫৭ সাল (চৈত্র-বৈশাখ, ১৮৯৭ বঙ্গাব্দ), বাংলা অনুবাদ: শ্রীমতী অনিতা বসু।
২- যুগপুরুষ বিদ্যাসাগর, বিনয় ঘোষ, পাঠভবন (জানুয়ারি, ১৯৬০ সাল), শ্রীমতী দীপা সান্যাল।)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ