হিজড়া কী?।। দারা চৌধুরী


হিজড়া কী?  পর্ব ১
----------------------------
আমাদের মাঝে এখন একটা নতুন উপদ্রবের নাম হচ্ছে হিজড়া সম্প্রদায়ের চাঁদাবাজি । দল বেঁধে এসে হাজির হয়ে এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে,  চাঁদা না দিয়ে উপায় থাকে না । নইলে চিল্লাচিল্লি, হৈচৈ আর খিস্তি খেউর।
আসলে এই হিজড়া কি? এই নিয়ে নানা কৌতুহল,  নানা প্রশ্ন, নানা কুসংস্কার মানুষের মনে। যেমন হাদিসে পাওয়া গিয়েছে যে স্ত্রীর মাসিক চলাকালীন সময়ে সহবাস করলে শয়তান এসে আগে আগে সহবাস করে ফেলে,  ফলে হিজড়া সন্তানের জন্ম হয়। (এক্ষেত্রে হাদিস টি মিথ্যা হতে পারে) কারন ঋতু চলাকালীন সময়ে সহবাসের ফলে সন্তান জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। কারণ ঐটা সবচেয়ে সেফ পেরিয়ড। ডিম্বানু নিঃসৃত হয় ঋতুর ঠিক চৌদ্দ দিন পূর্বে,  যা ঋতু অবধি বেচে থাকার প্রশ্নই ওঠে না।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ক্রোমোজোমের ও অন্যান্য হরমোন ও জিন(gene)গত  ত্রুটির কারণে জন্মগত যৌনাঙ্গ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যাদের জন্মপরবর্তী লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয়, মূলত তারাই হিজড়া (hermaphrodites)। কিন্তু আমাদের সমাজে অনেক সময়ই সমকামী (gay) এবঙ রুপান্তরকামী (transsexual) পুরুষদের কেও হিজড়া বলে ভাবা হয়। যেটি সম্পূর্ণ ভুল। এই গুলির মধ্যে বিস্তর ফারাক,  যেটি নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করা যাবে। আজ শুধু হিজড়াদের নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব। 

চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী মাতৃগর্ভে একটি শিশুর পূর্ণতা প্রাপ্তির ২৮০ দিনের মধ্যে দুটো ফিমেল বা স্ত্রী ক্রোমোজোম এক্স-এক্স প্যাটার্ন ডিম্বানু বর্ধিত হয়ে জন্ম হয় একটি নারী শিশুর এবং একটি ফিমেল ক্রোমোজোম এক্স ও একটি মেল বা পুরুষ ক্রোমোজোম ওয়াই মিলে এক্স-ওয়াই প্যাটার্ন জন্ম দেয় পুরুষ শিশুর। ভ্রূণের পূর্ণতা প্রাপ্তির একটি স্তরে ক্রোমোজোম প্যাটার্নের প্রভাবে পুরুষ শিশুর মধ্যে অণ্ডকোষ এবং মেয়ে শিশুর মধ্যে ডিম্বকোষ জন্ম নেয়। অণ্ডকোষ থেকে নিঃসৃত হয় পুরুষ হরমোন এন্ড্রোজেন এবং ডিম্বকোষ থেকে নিঃসৃত হয় এস্ট্রোজন। পরবর্তী স্তরগুলোতে পুরুষ শিশুর যৌনাঙ্গ এন্ড্রোজেন এবং স্ত্রী শিশুর যৌনাঙ্গ এস্ট্রোজনের প্রভাবে তৈরি হয়। 

♧ ভ্রূণের বিকাশকালে এই সমতা নানাভাবে বিঘ্নিত হতে পারে। প্রথমত ভ্রূণ নিষিক্তকরণ এবং বিভাজনের ফলে কিছু অস্বাভাবিক প্যাটার্নের সূচনা হতে পারে। যেমন এক্স-ওয়াই-ওয়াই অথবা এক্স-এক্স-ওয়াই। এক্স-ওয়াই-ওয়াই প্যাটার্নের শিশু দেখতে নারী-শিশুর মতো। কিন্তু একটি এক্সের অভাবে এই প্যাটার্নের স্ত্রী-শিশুর সব অঙ্গ পূর্ণতা পায় না। একে স্ত্রী-হিজড়াও বলে। আবার এক্স-এক্স-ওয়াই প্যাটার্নে যদিও শিশু দেখতে পুরুষের মতো, কিন্তু একটি বাড়তি মেয়েলি ক্রোমোজম এক্সের জন্য তার পুরুষ অঙ্গ সমূহ প্রকাশে বিঘ্ন ঘটে। একে পুরুষ হিজড়াও বলে।
♧  ভ্রূণের বৃদ্ধি কালে ভ্রূণের অন্ডকোষ (testes) বা ডিম্বকোষ (ovaries) থেকে নিঃসৃত     
●হরমোনের স্বল্পতার কারণে 
●অথবা হরমোনের গঠনের ত্রুটির কারণে
●অথবা বহির্জননেন্দ্রিয় যেখান থেকে উৎপন্ন হয় (mullarian ducts) এর উপর সঠিক ভাবে কার্যক্ষম না হবার কারণেভিতরে অন্ডকোষ বা ডিম্বকোষ যাই হোক না কেন বাইরের জননেন্দ্রিয় গঠিত হয় না,  অথবা হলেও বিকৃত ভাবে গঠিত হয়। Congenital adrenal hyperplasia এবং Androgen insensitive syndrome এমন দুটি অবস্থা।

যখন দেহের অভ্যন্তরে অন্ডকোষ ও ডিম্বকোষ উভয়েই অনুপস্থিত থাকে (I.e. gonadal agenesis) অথবা উভয়েই উপস্থিত থাকে (ovotestis) তখন তাদেরকে 'সত্য' হিজড়া ( True Hermaphrodite ) বলে। আর যখন অন্ডকোষ বা ডিম্বকোষ এর যেকোন একটা উপস্থিত থাকে তখন তাকে 'মিথ্যা' হিজড়া (Pseudo hermaphrodite) বলে। বৈশিষ্ট্যগতভাবে  'মিথ্যা' হিজড়াদের মধ্যে দুইটি ধরন রয়েছে, নারী ও পুরুষ। নারী হিজড়ার (ডিম্বকোষ ধারনকারী) মধ্যে নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য থাকলেও স্ত্রীজননাঙ্গ না থাকায় তার শারীরিক গঠন অনেকটাই পুরুষালী । পুরুষ হিজড়াদের (অন্ডকোষ ধারনকারী)  ক্ষেত্রেও একই অবস্থা, ঠিক তার বিপরীত, পুরুষ সুলভ বৈশিষ্ট্য থাকলেও পুরুষ জননাঙ্গ না থাকায় তার শারীরিক গঠন অনেকটাই মেয়েলী। তবে হিজড়ারা নারী বা পুরুষ যাই হোক, নিজেদেরকে নারী হিসেবেই এরা বিবেচনা করে থাকে। এরও একটা কারন আছে,  সেটা কাল আলোচনা করা যাবে।
 জীবনের স্বাভাবিক আনন্দ থেকে বঞ্চিত হিজড়াদের কামনা বাসনা আছে ঠিকই, ইচ্ছাপূরণের ক্ষেত্রটা নেই কেবল।



হিজড়া কী? পর্ব ২
রুপান্তরকামী ( transsexual )
-------------------------------------------
আরো এক শ্রেণীর পুরুষ আমাদের সমাজে অহরহ দেখা যায়, যারা মেয়েদের মত হাঁটে, চলে, কথা বলে, কখনো কখনো মেয়েদের মত সাজে,  অন্তিম পর্যায়ে নারী দের মত পোশাক ও পরিধান করে এবং নানা রকম মেয়েলী কাজকর্ম করতে বেশ উৎসাহ বোধ করে (যেমন রান্না করা,  নৃত্যের প্রতি আগ্রহ, বাচ্চা লালন পালন করা, সূচী কর্ম ইত্যাদি)। তাদেরকে ও আমরা ভুল করে হিজড়া ( hermaphrodites ) বলে থাকি। কিন্তু এরা আদতে হিজড়া নয়। কারণ এদের অনেকেই (বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের চাপে) আবার বিয়ে শাদী ও করে থাকে । অনেকেরই বাচ্চা কাচ্চা ও হয়ে থাকে। এদের পুরুষ জননাঙ্গ (male external genitalia) একদম স্বাভাবিক থাকে, যৌন কর্ম ও মোটামুটি চলনসই থাকে। যা হিজড়াদের থাকে না। এরা মূলত রুপান্তরকামী ( transsexual  বা transgender)। 

ইংরেজী তে দুটো শব্দ আছে- sex এবঙ gender । বাঙলায় দুটি শব্দের অর্থ এক (লিঙ্গ) হলেও ইংরেজিতে এটি দুইটা ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে থাকে । Sex হচ্ছে দৈহিক লিঙ্গ যা নিয়ে একটা মানুষ জন্মগ্রহণ করে। সেটা নারী অথবা পুরুষ হতে পারে। বাইরের জননেন্দ্রিয় দেখে সবাই এটা নির্ধারণ করে ফেলে। কিন্তু Gender হচ্ছে মনোলিঙ্গ,   লিঙ্গের প্রকাশের ঝোঁক বা প্রবণতা (sexual orientation)। যখন দৈহিক লিঙ্গ এবং মনোলিঙ্গ একই হয় তখন তাকে বলা হয় cysgender।এটি ই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন দৈহিক লিঙ্গ এক আর মনোলিঙ্গ হয় অন্য কিছু তখন তাকে বলে pargender। এ শুধু দুই প্রকার নয়। এটি নানা ধরনের হতে পারে। যেমন agender,  bigender, trigender, polygender, transgender,  queergender প্রভৃতি। অর্থাত্ দৈহিক লিঙ্গ (sex) নারী/পুরুষ যাই হোক না কেন,  তার মনোলিঙ্গ ( gender ) বা লিঙ্গ প্রকাশের ঝোঁক বা প্রবনতা,  নারীদেহ নিয়ে জন্ম নিয়ে নারীর মত নাও হতে পারে ; পুরুষদেহ নিয়ে জন্ম নিয়ে পুরুষের মত নাও হতে পারে। এই রকমই একটি orientation এর নাম transsexual বা transgender।

এরা পুরুষ হিসেবে জন্ম নিয়ে ও এরা মানসিক ভাবে নিজেদের কে নারী ভাবে। এরা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করে যে এরা মূলত নারী,  ভুল বশত এদের দেহে পুরুষাঙ্গ  তৈরি হয়েছে বা ভুল করে ওদেরকে পুরুষের দেহে প্রবিষ্ট করা হয়েছে। ওরা ওদের পুরুষ পরিচয়টাকে তথা ওদের দেহের পুরুষাঙ্গ কে প্রচন্ড ভাবে ঘৃণা করে। তাই ওরা প্রতিনিয়ত তাদের লৈঙ্গিক পরিচয়টাকে পাল্টে ফেলে দিয়ে নারী হয়ে যেতে চায়। পুরুষাঙ্গ কে কেটে ফেলে দিয়ে নারীঅঙ্গ স্থাপন করে নারীতে রুপান্তরিত হতে চায়। এইজন্য বাংলায় এদেরকে রুপান্তরকামী বলা হয়ে থাকে। ঠিক একই ভাবে,  নারীর বেলাতেও এই রকম পুরুষ হবার প্রবণতা দেখা যায় । কিন্তু আমাদের সমাজে নারী রুপান্তরকামীরা যত না সামাজিক লাঞ্ছনার শিকার হন তার চেয়ে বহু গুনে নির্যাতন ও লাঞ্চনার পুরুষ রুপান্তরকামীরা। তার কারণ সম্ভবত পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষ জাত্যভিমান। নারী যেহেতু অধস্তন,  সেহেতু নারী পুরুষের পোশাক পরতে চাইবে,  পুরুষের ভঙ্গিমা ধরতে চাইবে,  এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তুমি পুরুষ হয়ে নিম্নশ্রেণীর পোশাক পরবে, ঐ শ্রেণীর ভঙ্গিতে চলাফেরা করবে,  আমি পুরুষ হয়ে সেটা মেনে নিব? অতএব লাঞ্চনার গন্জনার শিকার তোমার হতেই হবে। হচ্ছেও তাই প্রতিনিয়ত। 

এ এক অসম্ভব কষ্টের বিষয়, যা cysgender লোকজন বুঝতেও পারবে না। প্রতিদিন,  প্রতিক্ষণ নিজের ভেতরে নিজের সাথে যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব,  সংঘাত। যার শরীরটা পুরুষের, কিন্তু বাকি সব নারীর -ভাবনা,  চিন্তা,  প্রত্যাশা, ভালবাসা, যৌনাকাঙ্খা, যৌনকর্ম (নারীর মত ব্যবহৃত হওয়া),  দৃষ্টি, আকর্ষণ- সব, সবকিছু। রুপান্তরকামী দের সাথে কথা বললে এমন কষ্ট আর হাহাকারের কথাই শোনা যায়। কখনো কখনো এই কষ্ট এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে,  ডাক্তার দিয়ে পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলে পর্যন্ত। কেউ কেউ সমাজের সকল টিটকারী টিপ্পনি কে উপেক্ষা করে নারীদের পোশাক পরিধান পরে বেড়ায়। বিদেশে এরা অবশ্য অপারেশন করে লিঙ্গ পরিবর্তন করে ফেলে।

 কিন্তু এই transsexuality র আসল কারণ কি? এটি এখনো একটি রহস্য। ওদের হরমোন,  জিন ও অন্যান্য মানসিক parameters গুলি মেপে দেখা হয়েছে,  নানা গবেষণায়। কিন্তু কোথাও কোন অসুবিধা বা ব্যতিক্রমী কিছু পাওয়া যায়নি। এক সময়ে Psychiatry ও Forensic Medicine এ এইগুলো (transsexuality বা homosexuality) কে যৌন বিকৃতি (sexual perversion) বলা হত। কিন্তু নতুন প্রকাশনা এইগুলো কে আর বিকৃতি বা মনোবৈকল্য বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে লৈঙ্গিক বৈচিত্র্য বা sexual diversity or plurality।

যেহেতু হিজড়া ও রুপান্তরকামীদের যৌন চাহিদা মেটাতে আর কোন বিকল্প উপায় থাকে না,  তাই এই উভয় শ্রেণীর মানুষের যৌনতা পূরণের এক মাত্র উপায় পাযুকাম (Sodomy)। মূলত এই কারনেই এই দুই শ্রেণীর মানুষ কে এক কাতারে ফেলা হয়। সামাজিক, আইনগত ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যেহেতু  Sodomy একটি জঘন্য অপরাধ,  তাই এদের কষ্টের মাত্রার পাশাপাশি নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে ভয়াবহ রকমে।



হিজড়া কী? পর্ব ৩
---------------------------
প্রকৃতির খেয়ালে হোক আর অভিশাপেই হোক, এই হিজড়াত্ব ঘোচাবার উপায় এখন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের নাগালে। চিকিৎসকদের মতে শিশু অবস্থায় চিকিৎসার জন্য আনা হলে অপারেশনের মাধ্যমে সে স্বাভাবিক মানুষের মতো পরিবারের মধ্যে থেকেই জীবন-যাপন করতে পারে। হয়তো সে সন্তান ধারণ করতে পারবে না, কিন্তু পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে না হয়তো। 

মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা হলো- দাসত্ব থেকে মুক্তির অধিকার, ভোটের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, কাজের অধিকার, মানসম্মত জীবন-যাপনের অধিকার, আইনের আশ্রয় ও নির্যাতন থেকে মুক্তির অধিকার এবং বিবাহ ও পরিবার গঠনের অধিকার। এইসব অধিকার পরিপন্থি কর্মকাণ্ডকে প্রতিরোধের জন্য আরো বহু চুক্তি ও সনদও রয়েছে। কিন্তু এসব অধিকারের ছিটেফোটা প্রভাবও হিজড়াদের জীবনে কখনো পড়তে দেখা যায় না। মানবাধিকার বঞ্চিত এই হিজড়ারা তাহলে কি মানুষ নয় ?

মানুষের জন্মদোষ কখনোই নিজের হয না। আর হিজড়ারা নিজেরা বংশবৃদ্ধিও করতে পারে না। এ অপরাধ তাদের নয়। স্বাভাবিক পরিবারের মধ্যেই অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে তাদের জন্ম। তবু প্রকৃতির প্রহেলিকায় কেবল অস্বাভাবিক লিঙ্গ বৈকল্যের কারণেই একটা অভিশপ্ত জীবনের অপরাধ সম্পূর্ণ বিনাদোষে তাদের ঘাড়ে চেপে যায়। প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালে একটা মেয়ে যদি ছেলে হয়ে যায়, কিংবা একটা ছেলে ঘটনাক্রমে মেয়ে হয়ে গেলেও এরকম পরিণতি কখনোই নামে না তাদের জীবনে, যা একজন হিজড়ার জীবনে অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া হয়। খুব অমানবিকভাবে যৌনতার অধিকার, পরিবারে সম্মানের সঙ্গে বসবাসের অধিকার, চাকরির অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার ইত্যাদি মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে যায় এরা। কিন্তু এসব অধিকার রক্ষা ও বলবৎ করার দায়িত্ব ছিলো রাষ্ট্রের। কেননা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযাযী রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে- ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতৃপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আওতাধীন কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার’ প্রতিষ্ঠা করা। আদৌ কি কখনো হয়েছে তা ? অথচ পরিবার হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া হিজড়ারা প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তার অভাবে পৈতৃক সম্পত্তির বা উত্তরাধিকারীর দাবি প্রতিষ্ঠা থেকেও বঞ্চিত থেকে যায়। এমন বঞ্চনার ইতিহাস আর কোন জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের হয়েছে কিনা জানা নেই।

প্রকৃতির নির্দয় রসিকতার কারণে হিজড়াদের গতানুগতিকতার বাইরে ভিন্ন পদ্ধতির অনিবার্য যৌনতাকেও ইসলাম প্রধান দেশ হিসেবে সহজে মেনে নেওয়া হয় না। এমনকি ব্রিটিশ আমলেও এদেশে হিজড়াদের বিতাড়িত করা হয়েছে বলে জানা যায়। যৌনতার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ ভারতীয় আইনে হিজড়াদের যৌনতাকে ‘সডোমি’ অর্থাৎ অস্বাভাবিক ও অনৈতিক হিসেবে চিহ্ণিত করে পেনাল কোড (১৮৬০) এর ৩৭৭ ধারায় এটাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু তাদের মানবাধিকার রক্ষাকল্পে রাষ্ট্রীয় কোন উদ্যোগ কখনো হাতে নেয়া হয়েছে বলে শোনা যায় নি।

তবে খুব সম্প্রতি গত ০২ জুলাই ২০০৯ ভারতে দিল্লী হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ যুগান্তকারী এক রায়ের মাধ্যমে ‘প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে সমকামী সম্পর্ক’ ফৌজদারী অপরাধের তালিকাভুক্ত হবে না বলে ঘোষণা করেছে। রায়টির অব্যবহিত পরেই ভারত সরকারের পক্ষ থেকে রায়টিকে স্থগিত করার জন্য সুপ্রীম কোর্টের কাছে আবেদন করা হয় যা মঞ্জুর হয়নি (সূত্রঃ http://www.nirmaaan.com/blog/admin/4728 )। এই রায় ভারতের হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য এক বিরাট আইনি সহায়তার পাশাপাশি আমাদেরর দেশের জন্যেও একটা উল্লেখযোগ্য নমুনা হিসেবে উদাহরণ হবে। কেননা সেই ব্রিটিশ ভারতীয় এই আইনটিই আমাদের জন্যেও মৌলিক অধিকার পরিপন্থি হয়ে এখনো কার্যকর রয়েছে। তাই রাষ্ট্রের কাছে হিজড়াদের প্রধান দাবি আজ, তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি। কেননা এই লিঙ্গস্বীকৃতি না পেলে কোন মানবাধিকার অর্জনের সুযোগই তারা পাবে না বলে অনেকে মনে করেন।

তবে আশার কথা যে, এবারের ভোটার তালিকায় এই প্রথম হিজড়াদেরকে অন্তর্ভূক্ত করার প্রশংসনীয় একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের এই উদ্যোগ বিবেকবান মানুষের সমর্থনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থারও প্রশংসা কুড়িয়েছে। আমরাও এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। তবু প্রায় এক লাখ হিজড়াকে এবারের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্তির ক্ষেত্রে বেশ কিছু জটিলতা এখনো রয়ে গেছে বলে জানা যায়। ফলে হিজড়াদের প্রাপ্য অধিকার ও মানুষ হিসেবে পুনর্বাসনের জন্য বিশেষ আইনের দরকার হয়ে পড়েছে আজ, যেখানে যৌক্তিক কারণেই তাদের হোমোসেক্স বা সমকামিতার অধিকার প্রতিষ্ঠাও জরুরি বৈ কি। আর এজন্যেই আজ অনিবার্য হয়ে উঠেছে হিজড়াদেরকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার মানবিক দাবিটাও।

প্রিয় পাঠক, আপনার স্বাভাবিক কর্মব্যস্ততার ফাঁকে হঠাৎ করেই কোন হিজড়ার সাথে দেখা হয়ে গেলে হয়তোবা স্বতঃকৌতুহলি হয়ে ওঠবেন আপনি। এই কৌতুহলের মধ্যে অজান্তেও কোন কৌতুক মেশাবার আগেই একটিবার অন্তত ভেবে দেখবেন কি, এই না-পুরুষ না-স্ত্রী সত্তাটি আপনার আমার মতোই সবক’টি নির্দোষ দৈহিক উপাদান নিয়েই কোন না কোন পারিবারিক আবহে জন্মেছিলো একদিন। মানবিক বোধেও কোন কমতি ছিলো না। কিন্তু প্রকৃতি তাকে দিয়েছে ভয়াবহ বঞ্চনা, যা আপনার আমার যে কারো ক্ষেত্রেই হতে পারতো ! অসহায় পরিবার ত্যাগ করেছে তাকে, অবিবেচক সমাজ করেছে প্রতারণা। নিয়তি করেছে অভিশপ্ত, আর রাষ্ট্র তাকে দেয়নি কোন সম্মান পাবার অধিকার। কোন অপরাধ না করেও ভাগ্য-বিড়ম্বিত সে কি আপনার আমার একটু সহানুভূতি থেকেও বঞ্চিত হবে ?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ