'হিন্দু’ - সম্পাদক, ‘বঙ্গযান’’



‘হিন্দু’ধর্ম্ম, ‘হিন্দু’স্থা্‌ন, ‘শের-এ-হিন্দ্’, ইত্যাদি শব্দের ভিত্তিমুলে রয়েছে ‘হিন্দ্‌’ শব্দাংশ ও ‘হিন্দু’ শব্দটি।  কথিত আছে এই শব্দ বা ধারণার স্রষ্টা হলেন সেই বিদেশীবৃন্দ যাঁরা নাকি ‘সিন্ধু’ শব্দের সঠিক উচ্চারণে অপারগ ছিলেন। পৃথিবীতে বহু দেশই দুটো নামে উচ্চারিত ও সম্বোধিত হয় [ একটি স্বদেশীয় জনগণের দ্বারা সম্বোধিত অপরটি বিদেশীদের দ্বারা সম্বোধিত। উদাহরণ - ডয়েশল্যাণ্ড ও জার্ম্মানী, নেদারল্যাণ্ডস ও হল্যাণ্ড, মিশর ও ঈজিপ্ট, ইরাণ ও পারস্য, মায়ানমার ও বার্ম্মা ইত্যাদি। তেমনি ভারতবর্ষ সম্ভবত একমাত্র দেশ যাকে বিদেশীরা দু’টি নামে উচ্চারণ ও সম্বোধন করতেন - [ এক ] - হিন্দুস্থান [ হিন্দুদের-(আবাস)-ভূমি; [ দুই ] - ইণ্ডিয়া ( ইন্দ্রিয়সমূহের অধিপতি ‘ইন্দ্রিয়ের বা ইন্দ্রিয়ার দেশ ইন্দ্রিয়া> >ইণ্ডিয়া ]।

আমরা ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির সাহায্যে ‘হিন্দু’ শব্দের মর্ম্মার্থ ব্যাখ্যা করতে চাই।

‘হিন্দু’ শব্দের অর্থ বুঝতে হলে ‘হ’, ‘হন’, ‘হিন’, ‘হিন্দ’ এই চারটি শব্দাংশের অর্থব্যাখ্যা বুঝে নিলে ‘হিন্দু’ শব্দের অর্থ বুঝতে সুবিধা হবে।  ‘হিন্দু’ -- [ হ+অন = হন। হন > হিন > হিন্দ > হিন্দু ]

“হ = ‘হ’-করণ যাহাতে; অথবা হওয়া-(being)-করণ হইতে অত্যন্ত ‘হওয়াকরণ ( =না-হওয়াকরণ ) অবধি সর্ব্বপ্রকারের ‘হ’-করণ থাকে যাহাতে; কিংবা, অতিসচল অবাস্তবকে  [ ‘হ’ বলিয়া দাঁড় করানো বা ] স্থিরকরণ [ = ভবকরণ, ভবিতকরণ, বা ভূতকরণ, বাহ্যরূপীকরণ ] এবং সেই ভাবে স্থিতকারী আত্মকেন্দ্রে আবর্ত্তনকারী অচলকে আরও আরও হওয়াকরণ [ আত্মকেন্দ্রে সংহতকরণ ] করিতে করিতে ‘অত্যন্ত হওয়াকরণ’          [ স্তব্ধকরণ, বিলুপ্তকরণ, হনকরণ ] করা হয় যাহাতে; অথবা, সর্ব্ব প্রকারের ক্রিয়া ও ক্রিয়াকারীর হওয়াকরণ হইতে না-হওয়াকরণ অবধি প্রত্যেক সত্তার হ-করণ যাহাতে। প্রতীকী অর্থসমূহ - ভবিত, ভূত, উদ্ভূত, জাত, স্থিতি, স্থির, উদ্ভুত হওয়া, জন্মগ্রহণ করা, সঙ্ঘটিত হওয়া...।”

“হন = ‘হ’-করণ [ স্তব্ধকরণ ] অন-কৃত যাহাতে; অথবা, কোনো সত্তাকে স্তব্ধ করিয়া দিবার জন্য আঘাত করিতে যায় যে বা আঘাত করে যে বা আঘাত করা হয় যাহাতে; কিংবা অস্তিত্বের হওয়া’কে না-কৃত করিয়া দেওয়া হয় যাহাতে। প্রতীকী অর্থসমূহ -  হিংসা, বধ, হন্তা, ঘাতক।”

একটি আবশ্যকীয় সতর্কীকরণ - “হন মানে কিন্তু হত্যা নয়। কোন কিছুকে স্থির করে দেওয়াই ‘হন’ করা। কিছু বানাতে হলে তাকে নতুন স্থিররূপে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেটিও ‘হনন’ করা। এরূপ হননের আশ্রয় যাহাতে তাকে ‘আহনন’ বলে। তবে কিনা, প্রতীকী অর্থের দ্বারা আমাদের মস্তিষ্ক এতই অব-স্থাপ্রাপ্ত হয়ে রয়েছে যে হনন শুনলেই আমরা হত্যা বুঝে ফেলি। সেটি শব্দটিকে তার স্বরূপে বোঝার পথে একটি বড় বাধা।”

“হিন = হন-এর সক্রিয়ণ বা বিকাশসাধন”।

“হিন্দ = হিন [ স্থিতের সক্রিয়তা বা নড়ানডিকে অন-করণ বা না-করণ ] দান করে যে; অথবা, যে দেশ তাহার দেশবাসীকে সচল করে, অচলও করে।”

“হিন্দু = হিন্দ [ … অগ্রগতি অন-করণ না-করণকারী দেশবাসী ] নবরূপে উত্তীর্ণ যাহাতে; অথবা, যে ভারতবর্ষীয় জনগোষ্ঠী অগ্রগতিকে অন-করণ  [ সচল ] করে না, না-করণও [ অচল ] করে না, সচল-অচল করার বাইরে অন্য কিছু করে; কিংবা যে ভারতবর্ষীয় জনগোষ্ঠী বৈদিক-পূর্ব্ব সনাতন [ নিত্য ও চিরন্তন ] পথে হাঁটে; অথবা, হীনতার দ্বারা দুষ্ট বা নষ্ট হইয়া অন্যকে হীন [ অস্পৃশ্য ] করে এবং ফলত নিজেও হীন হইয়া থাকে। / ‘হীন দুস্‌ যাহাদের তাহারা’ - [ ছাত্রবোধ অভিধান ]। প্রতীকী অর্থসমূহ - সনাতন-হিন্দু, সনাতন-হিন্দুধর্ম্মাবলম্বী জন, হিন্দুধর্ম্মাবলম্বী জন।”

- [ উদ্ধৃতাংশগুলি কলিম খান এবং রবি চক্রবর্ত্তী প্রণীত “সরল শব্দার্থকোষ” থেকে গৃহীত। ]

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ