রবীন্দ্রনাথের আসন।। রবি চক্রবর্ত্তী




[ ...রবীন্দ্রনাথকে বোঝা মানে মানুষকে বোঝার নতুন মাপকাঠি নিয়ে আসা। তাঁর জীবনের উদাহরণে দেখি, এক মানুষ এক সঙ্গে কত কী পারে, এবং তার ক্ষমতার কতখানি ব্যাপ্তি সম্ভব। তাঁকে দেখেই আমরা আরও বুঝি মানুষের জীবন তখনই দীপ্ত হয়, যখন সে অভ্যাসের দাসত্ব ছাড়ে, যখন সে মাথাটা উঁচু করে তোলে আর যখন সে সকল মানুষের মধ্যে সাম্য ও সহযোগিতা দুটোকেই একান্ত সত্য মনে করে, আর বিশ্বচরাচরের আনন্দময় ছন্দের সঙ্গে নিজেকে মেলায়। রবীন্দ্রনাথকে আমরা উপযুক্ত মর্য্যাদা তখনই দিই যখন আমরা ক্ষুদ্র অস্তিত্বের বেড়া ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারি। আর তখনই রবীন্দ্রনাথের যথার্থ আসন পাতা হয় আমাদের মনে, জীবনে। সেটি শুধু আনন্দ নয়, সেটি একটি দায়ও। সে দায় হল নিজেকে, আর নিজের সঙ্গে সকল মানুষ তথা বিশ্বচরাচরের সম্পর্ককে, সত্যের ভিত্তিতে বারে বারে প্রতিষ্ঠা করানোর।... ]   


[ এক ]

প্রশ্নটা এই : রবীন্দ্রনাথকে আমরা কেন স্মরণ করব এবং কীভাবে স্মরণ করব? কী ভাবে, অর্থাৎ কী মনন বা কী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাঁর স্মৃতি উদ্‌যাপন করব? নিবন্ধের শিরোনামে সেই প্রশ্নটিকেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, বাংলা ভাষার সাবেকী চালে। আসন বললে শুধু স্থূল বসার জায়গাটুকু তো বোঝায় না। আমাদের ব্যক্তিমনে বা সমাজমনে রবীন্দ্রনাথকে যে মর্য্যাদায় স্থিত করব, সেটাই রবীন্দ্রনাথের আসন। এ রকম অর্থে ‘আসন’ কথাটি রবীন্দ্রনাথ নিজে ব্যবহার করেছেন তাঁর গানে ঃ “ওই আসনতলের মাটির’পরে”, “তোমার আসন শূন্য আজি”, “তব সিংহাসনের আসন হতে’ প্রভৃতি গানে।

সাহিত্যের ছাত্ররা, যাঁরা কিনা সাহিত্যজ্ঞানের তক্‌মা নিয়ে বাড়ী যেতে চান, তাঁরা জানেন - দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর কবি ও লেখকদের নিয়ে পরীক্ষা পাশের হ্যাপাটা কম। এই রকম কবি বা লেখকদের সারা জীবন কেটে যায় এক রকমের চর্চ্চায়; তাঁরা বরাবর এক কথা বলে যান; তাঁদের সৃজনধারা একই খাতে চলে যায়। একই কারণে জীবনীলেখকরা জানেন, যাঁদের জীবন এক ধরনের সাধনায় কেটেছে, তাঁদের জীবনের আলেখ্য তৈরী করা সহজ। কিন্তু যেখানে কবি বা লেখক ভূমিকা পাল্টেছেন একাধিকবার, সেখানে সমালোচক, গবেষক, আর ছাত্ররা পড়েন মুশকিলে। মানুষটাকে কোন খোপে ফেলা হবে? কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পলেখক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক ইত্যাদির কোন দলে তাঁকে সামিল করা হবে? তারপর আবার তিনি যদি রাজনীতি, শিল্পকলা, বা আর কোনো রকমের সাধনায় মাঝেমাঝে লিপ্ত হয়ে থাকেন - তবে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়। সমস্যাটা আরো ঘোরালো হয় যদি তাঁর মতামতের ক্ষেত্রে পর্য্যন্ত হেরফের ঘটে যায় মাঝেমধ্যে।

এ রকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার সোজা পথ হল সেই কবি, লেখক বা শিল্পীকে স্ববিরোধিতার দোষে দাগী করে দেওয়া। তাতে স্রষ্টা সম্বন্ধে আলোচনাও হল, আবার নিজের চিন্তাকাঠামোকে পালটে নেওয়ার ঝক্কিতেও যেতে হল না সমালোচককে। একথা অবশ্য বলা হচ্ছে না যে, মানুষের মধ্যে স্ববিরোধিতা থাকে না। বহু মানুষই তাঁদের জীবনে পরস্পরবিরোধী ধারার আবর্ত্তে পড়ে যান, আর শত চেষ্টাতেও তার থেকে বেরোতে পারেন না। তখন তাঁদের চিন্তা বা কর্ম্মের সমষ্টির মধ্যে পাওয়া যায় discord বা অসঙ্গতির উপদ্রব। কিন্তু যদি সংবেদনশীল মানুষ অনুভব করতে পারেন, এই সব আপাতবিরোধিতার মধ্যে একটি সঙ্গতি (harmony) বা সমন্বয়ী প্রবাহ আছে, তবে কি বলা যাবে, আলোচ্য প্রতিভাটি  স্ববিরোধিতায় দোষী? অবশ্যই না। বরং আমাদের তখন নজর দিতে হবে তাঁর অনন্যতার দিকে, আমাদের লক্ষ্য হবে সেই অনন্যতার উৎসে পৌঁছানো। আর ভেবে দেখতে হবে আমাদের নিজেদের ভাবনাচিন্তার কাঠামোকে নতুন করে গড়ে নিতে হবে কি না। এবং নিতে হলে, কীভাবে তা গড়তে হবে।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অসামান্য সৃজনশীল মানুষ। তাঁর সত্যোপলব্ধি যে কত বিচিত্র পর্য্যায় উত্তরণ করে উত্তুঙ্গ মহিমায় পৌঁছায়, তা বিস্ময়কর। আবার তাঁর সৃজনকর্ম্ম যে শতধারায় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার তুলনা কোথায়? তাঁর ভাবনা আর উপলব্ধিকে কবিতা, ছোটোগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ইত্যাদি নানা আকারে তিনি পাঠক বা শ্রোতার সামনে তুলে ধরেছিলেন। এর পাশেই পাচ্ছি তাঁর জীবনভোর গানের ঝর্ণাধারা। আর জীবনের শেষ পাদে চিত্রাঙ্কনের বিস্ময়কর কলাপবিস্তার। প্রতিভাস্ফূরণের তীব্রতা সর্ব্বত্র সমান নয়, কিন্তু এর একান্ত মৌলিকতা, দিগন্ত প্রসারিত ব্যাপ্তি আর চোখধাঁধানো ঔজ্জ্বল্যের তুলনা কোথায়? শুধু গানের বা আরও ভেঙে বলতে গেলে সুর আর কথার মিলনে যে অদ্বৈত হল রবীন্দ্রনাথের গান, তার সুবাদেই তো নান্দনিক ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ অদ্বিতীয়, আর কথা বা সুরে তাঁর মানসের যে অংশের প্রকাশ ঘটেনি, তাকেই তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর চিত্রকলায় - বিদগ্ধ চিত্রসমালোচকরা তো এমন কথাই বলেন। এর পাশেই দেখছি, কবিতা ও গানের ডালি নিয়ে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জোরালো অংশগ্রহণ, শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীতে নতুন রীতিতে বিদ্যাচর্চ্চা ও শিক্ষাদান চালু করার উদ্যোগ, এবং পল্লীবাসীর জীবনে সমৃদ্ধি আনার নানান চেষ্টা। এর পাশে রয়েছে আমাদের জাতীয় ইতিহাস, সামাজিক দুর্গতি, এবং ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন দিককে বোঝার প্রয়াস, এবং নানা পথে দেশের মানুষ ও সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। এবং সবশেষে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল বিজ্ঞান, ধর্ম্ম, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি বিপুলগ্রাসী আদর্শের মোকাবিলায় নামা। এ কথা রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধে ভালোাভাবে খাটে - ‘হায় গগন নহিলে তোমারে ধরিবে কেবা?’ কোন লেবেল লটকে এই মানুষের মূর্ত্তিকে রেখে দেওয়া যাবে মিউজিয়ামের হিমঘরে?

একটা কাজ অবশ্য অনেকে করেছেন। তা হল রবীন্দ্রনাথকে মহাপুরুষ পদে অভিষিক্ত করে দেওয়া। তাঁর অলোকসামান্য প্রতিভার কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন থাকে না। যে ব্যক্তিরা তাঁকে গুরুদেব বলে অভিহিত করেছেন, জেনে বা না-জেনে তাঁরা ঠিক সে কাজটিই করেছেন। কিন্তু মুশকিল হয় বাস্তব রবীন্দ্রনাথের মানবিক দুর্ব্বলতা নিয়ে। তাঁর পুত্রকন্যাদের মুখ চেয়ে তিনি আমাদের সাথে আপোষ করেছেন অনেকবার। আর তিনি নিজেও কি মানুষের ভালোবাসা আর সমাদরের প্রত্যাশী ছিলেন না? আত্মসংযমের মাত্রায় রুচিবোধের শালীনতায় তিনি অনেক উপরে, তবু ক্ষোভ বা আকুলতার প্রকাশ কি তাঁর পরিণত বয়সেও ঘটেনি? যত অসাধারণই তিনি হোন, তিনি মানুষের সীমার মধ্যেই। গীতাকথিত স্থিতপ্রজ্ঞ পুরুষ বা উপনিষদের ঋষি বলে রবীন্দ্রনাথকে পূজোর আসনে বসালে আর যাই হোক সত্যের মর্য্যাদা রক্ষা হয় না।

তার চেয়ে বরং রবীন্দ্রসূত্রে আমাদের যাবতীয় প্রাপ্তিকে একত্রে দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে। প্রথমত, পাশ্চাত্যের ভাবধারায় পুষ্ট ভারতীয় রুচির সুতৃপ্তি হয়, এমন সাহিত্য তিনিই আমাদের দিয়েছেন। অনুরূপ চেষ্টা তাঁর জীবনের সকল ক্ষেত্রে। ধর্ম্ম ও বিজ্ঞান, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, জাতিয়তা ও আন্তর্জাতিকতা - বিভিন্ন রকমের পরস্পরবিরোধী আদর্শের সমন্বয় ঘটাতে পারে, এমন এক দৃষ্টিভঙ্গী ফুটে উঠেছে তাঁর সকল ভাবনায়। বাঙালিত্ব ও ভারতিয়ত্বের সামঞ্জস্য তিনি ঘটিয়েছিলেন তাঁর প্রবন্ধে, কবিতায় ও গানে। এটা নেহাত কাকতালীয় নয় যে ভারত এবং বাংলাদেশ, দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত তাঁর রচনা। সকল বাংলাভাষীকে তিনি এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে বেঁধে দিয়েছেন তাঁর গান দিয়ে। বিখ্যাত মার্কিন কবি এজরা পাউণ্ড বলেছিলেন - ‘He sang Bengal into a Nation’। মূলত গান দিয়েই আবার তিনি এ যুগের বাংলাভাষীকে দিয়ে গেছেন প্রায় পূর্ণ একটি সংস্কৃতি। মানুষের জীবনে যে প্রাত্যহিকতা ও আনুষ্ঠানিকতা, তাকে বিশ্বচরাচরের পটভূমিতে বিদ্ধৃত করে তার মধ্যে তিনি এনেছেন অমৃতের ছোঁয়া তাঁর গান দিয়ে। গ্রাম্যজীবন ও তার আচার থেকে বিচ্ছিন্ন ইংরেজী শিক্ষিত বাঙালীর জীবনে যে শূন্যতা, সেটাও যেন ভরাট করে দেয় রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা, গীতিনাট্য ইত্যাদি। আমাদের বিশ্বায়নের যুগে পশ্চিমী ঢঙের চটুল সংস্কৃতি যে উত্তর-ভারতীয়ের তুলনায় বাঙালীকে কম গ্রাস করতে পেরেছে, তার মূলেও আছে রবীন্দ্রসংস্কৃতির জোরালো প্রভাব।

তবু রবীন্দ্রপ্রতিভাকে তার সমগ্রতায় বোঝার চেষ্টাও অনেকের কাছে দুঃসাহসের আর এক নাম। তাঁদের চোখে কাজের কাজ হল রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর কীর্ত্তিকে খণ্ড খণ্ড করে দেখা, শিবের কাঁধ থেকে ঝোলা সতীর দেহকে যেমন খণ্ড খণ্ড করা হয়েছিল, তার মতো করে। তাতে লাভ এই যে, আলোচক এবং তাঁর পাঠক বা শ্রোতার ওপর চাপ পড়ে কম। তাঁদের ভাবনাচিন্তার অভ্যস্ত এবং সঙ্কীর্ণ কাঠামোর মধ্যে তাঁরা স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে পারেন। আর যেমন সিদ্ধান্তে তাঁরা আসতে চান, সহজেই তেমন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন। প্রসঙ্গত, অস্বীকার করা যাবে না, রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। দীর্ঘ জীবনের লেখালিখিতে আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী বহু কথা রবীন্দ্রনাথ নিজে লিখে রেখে গেছেন। সুতরাং তার সম্বন্ধে আমাদের অভিরুচি মতো সিদ্ধান্তে আসতে বাধা কোথায়? - কিন্তু এরকম কোনো রাস্তাতে আমরা যাব না। আমরা বরং রবীন্দ্রনাথের বিকৃত বা অবহেলিত কয়েকটি দিক তুলে ধরব। আর হয়তো এই সূত্র ধরে আমরা রবীন্দ্রপ্রতিভার উৎসের কাছে পৌঁছাব আর রবীন্দ্রনাথের সাধনাকে তার প্রাপ্য মর্য্যাদা দিতে পারব।

রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ। কয়েকটি বিষয় তাঁর সাহিত্যকীর্ত্তির অসম্পূর্ণতা, আর কয়েকটি মানুষ রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে। মনুষ্যত্ব নিয়ে বড়ো অভিযোগ এই কয়টি ঃ 

ক) তিনি অতি চতুর জমিদার ছিলেন;
খ) তাঁর কাছে আসতে চান এমন মানুষকে তিনি অবলীলায় দূরে ঠেলেছেন;
গ) বিদেশী সাহিত্য থেকে যে উপাদান তিনি আহরণ করেছেন, তাদের তিনি স্বীকার করে যাননি।

কিন্তু ভালো করে বিচার করলে দেখা যাবে, যে সব তথ্য প্রমাণের ওপর অভিযোগগুলি দাঁড় করানো হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেগুলি থেকে কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা যায় না। অনেক সময় তথ্যগুলিতেই ভুল আছে। বরং যথোচিত বিচারে রবীন্দ্রনাথের মহত্ত্বই বড়ো হয় ফুটে ওঠে। বিদেশী সাহিত্য থেকে ঋণ স্বীকার করার রেওয়াজ সাহিত্যিকদের মধ্যে নেই। 

রবীন্দ্ররচনার সাহিত্যমূল্যের প্রশ্নটি বাদ দিলেও রবীন্দ্রনাথের লেখা সম্বন্ধে সাধারণভাবে কয়েকটি অভিযোগ বারবার উঠেছে। তার সম্পর্কে বলা হয়েছে ঃ

ক)  তিনি সমাজের উঁচুলতার মানুষের কবি, এবং তিনি তাদের জীবনেরই ছবি এঁকেছেন;

খ)  হিন্দু-ম্সলমান বিভেদের ক্ষেত্রে তিনি হিন্দুঘেঁষা;

গ)  তিনি যথেষ্ট মাত্রায় দেশপ্রেমিক নন, এমনকি তাঁকে স্বাদেশিকতা-বিরোধীও বলা চলে।

এই প্রসঙ্গে প্রথমে দু-একটি কথা বলা দরকার। সমাজতন্ত্রের যুগে অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে, সাহিত্যে শ্রমিক-কৃষক জীবনের উপস্থাপনকে - তা সে যে ভাবেই হোক না কেন - সৎসাহিত্যের আবশ্যিক অঙ্গ মনে করা হত। কিন্তু সে রকমের মতবাদ আজ অনেক ক্ষীণধারা। আজ বরং মনে করা হয়, শ্রমিক-কৃষক জীবনের যান্ত্রিক প্রতিচ্ছবির চেয়ে বড়ো কথা হল - জীবন সম্বন্ধে কী দৃষ্টিভঙ্গী ফুটে উঠেছে কোনো সৃষ্টিতে এবং সেই সৃষ্টি যথার্থ শিল্পকর্ম্ম হয়ে উঠেহে কি না। এই দিক থেকে বিচার করলে রবীন্দ্রনাথের বরং তারিফই করতে হয়। কোনো সাময়িক খ্যাতির লোভে তাঁর সাহিত্যের সত্যমূল্য থেকে তিনি কখনো বিচ্যূত হননি। জন্মসূত্রে পাওয়া পরশ্রমজীবিতার অগৌরব তিনি স্বীকার করেছেন নানা লেখায়। নীচুতলার মানুষের প্রাপ্য মর্য্যাদা তিনি দিতে পারেননি, এ নিয়ে তাঁর কুণ্ঠা ও লজ্জা। মেহনতী মানুষের জীবনের আন্তর সত্য তাঁর উপলব্ধির মধ্যে অনায়ত্ত, এ সত্যেরও স্বীকৃতি তাঁর একাধিক লেখায়। শ্রমিক-কৃষকের প্রত্যাশিত কবির পদধ্বনি শোনার জন্য তিনি মাটির কাছে কান পেতে আছেন ঃ কিন্তু যা দিতে তিনি অপারগ, তা দেওয়ার চেষ্টা তিনি করেননি। যাঁরা কথায় ও কাজে শ্রমিক-কৃষকের আত্মীয় হয়ে ওঠেননি, তাঁরা যদি শ্রমিক-কৃষকের মুখপাত্র হওয়ার ভান করেন, তবে তার সম্বন্ধে কবি বলেন, ‘সত্য মূল্য না দিয়েই সাহিত্যের খ্যাতি করা চুরি / ভালো নয়, ভালো নয় নকল সে শৌখিন মজদুরী’।

আবার অন্য দিকে মানবজীবনের ক্লেদাক্ত রূপ - ক্রূরতা, হিংসা, রিরংসা যাই হোক না কেন, তাকে তিনি সাহিত্যে পরিস্ফূট করেননি, তার চেষ্টাও করেননি। আমরা জানি, জীবনের ক্লেদাক্ত দিক নিয়ে মাথাব্যথা আসলে মাত্রাতিরিক্ত বাস্তববাদের নতুন প্রবণতা, এবং এটি উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে পশ্চিমী সাহিত্যে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। কিন্তু মানুষের শারীর জীবনের স্থূল চিত্রণ অথবা ক্রূর হিংসার অবতারণা না করেও সাহিত্যের মহারথিরা জীবনের একান্ত সত্যকে পরিবেশন করেছেন। শ্লীলতা বজায় রাখাকে যাঁরা শুচিবায়ু বলে মনে করেন, সে রকম আধুনিক লেখকদের চেয়ে বরং বেশী করেই - বেশী ব্যাপ্তি ও গভিরতার সঙ্গে - মানবজীবনকে স্ফূট করেছেন তাঁদের লেখায়। রবীন্দ্রনাথ সচেতনভাবেই শ্লীলতাকে লালন করেছেন তাঁর সাহিত্যে। কিন্তু জীবনের নিষ্ঠুর সত্যকে তিনি এড়িয়ে গেছেন, এমন কথা কোনো মতে বলা যায় না। চোখের বালি, ঘরে বাইরে, চতুরঙ্গ, যোগাযোগ-এর মতো উপন্যাস বা নষ্টনীড়-এর মতো ছোটগল্প থেকে বোঝা যায়, বাস্তবকে তিনি নিজে ভোলেননি বা অন্যকে ভোলানোর চেষ্টাও করেননি।

অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের তথাকথিত হিন্দুভাবনা তাঁর স্বদেশচেতনা ও জীবনদর্শনের সঙ্গে একান্তভাবে সংশ্লিষ্ট। একথা ঠিক যে, হিন্দু নামটি ভারতের প্রাচীন সাহিত্যে পাওয়া যাবে না। বিদেশিরা এই নামটি ব্যবহার করত এই উপমহাদেশ, তার অধিবাসী এবং বড়ো জোর তাদের কোনো ভাষার নাম হিসেবে। কিন্তু কালক্রমে হিন্দু নামটি অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে যায় এই উপমহাদেশের কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন উত্তরাধিকারের সঙ্গে। অনিবার্য্যভাবে ভারতবর্ষের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে উপলব্ধি করার যে সাধনা ছিল রবীন্দ্রনাথের, তাকে প্রায়ই হিন্দুভাবনা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। অপর দিকে, ইতিহাসের নিয়ম অনুসারে বহিরাগত ইসলাম ও এদেশে উদ্ভূত নানা ধর্ম্মের অনুগামিদের মতো তৈরী হয়ে যায় পরস্পরের সম্বব্ধে অজ্ঞতা ও অবিশ্বাসের দুস্তর এক ব্যবধান। রবীন্দ্রনাথও এই ব্যবধান অতিক্রম করতে পারেন নি। কিন্তু যেখানে পারস্পরিক সম্পর্কের প্রশ্ন, সেখানে রবীন্দ্রনাথ অতি সহজেই মানবিকতার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছেন। মুসলমান যেখানে অপমানিত বা বঞ্চিত সেখানে রবীন্দ্রনাথ সুষ্পষ্টভাবে সেই অসাম্য বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব ও সক্রিয় হয়েছেন। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন (১৯০৫-১৯১১) শিক্ষিত বাঙালী হিন্দুর মনে উদ্দীপনা আনল। কিন্তু নানান কারণে - অর্থনৈতিক, সামাজিক, এবং সাংস্কৃতিক কারণে - বাঙালী মুসলমান এ আন্দোলনে তেমন সাড়া দেননি। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ প্রথমে পূর্ণ উৎসাহে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু এর পর তিনি সে আন্দোলন থেকে সরে এলেন। তার একটি বড় কারণ মুসলিমদের সম্পর্কে স্বদেশী নেতাদের সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী ও আচরণ। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে প্রথম দিকে শিবাজীর ঐতিহাসিক ভূমিকাকে স্বাদেশিকতার আদর্শ বলে গ্ররণ করলেও, পরে এই অবস্থান থেকে তিনি সরে আসেন।

একটি সত্যকে তার সামগ্রিকতায় ধরবার সাধনায় রবীন্দ্রনাথ কতখানি সিদ্ধ ছিলেন, সেটি না জানলে রবীন্দ্রনাথকে ভালো করে বোঝা হয় না। দুটি কবিতার উদাহরণে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে ঃ ভারততীর্থ ( ‘হে মোর চিত্ত পূণ্যতীর্থে জাগো রে ধীরে’) এবং দুর্ভাগা দেশ (‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান’)। প্রথমটি প[ড়ে মনে হবে রবীন্দ্রনাথ যেন ভারতবর্ষের মহিমান্বিত রূপের কল্পনায় আপ্লুত। ভারতবর্ষ যেন এক পূণ্যতীর্থ, যেখানে মানুষের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটে। কবিতাটির মধ্যে কিছু বেদনা ও ক্লেশের আভাস থাকলেও ভারতকে দেখা হচ্ছে মহান জননী রূপে। মনে হবে কবি স্বল্পদৃষ্টি আত্মসন্তুষ্ট জাতিয়তাবাদিদের একজন। এই ভুল কেটে যাবে যদি ঠিক দু-দিন১ বাদে, ২০-শে আষাঢ় ১৩১৭ তারিখে - ( অর্থাৎ ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসের একেবারে প্রথম দিকে) লেখা দুর্ভাগা দেশ কবিতাটি আমরা পড়ি। এ কবিতায় ভারত হল দুর্ভাগা দেশ, যেখানে মানুষের সম্মান নিত্য পদদলিত, যেখানে মানুষের অন্তরস্থিত সত্য নিত্য লাঞ্ছিত। এবং এখানে কী কঠোর ভবিষ্যদ্বাণী দেশের সম্বন্ধে এবং কী তীব্র কশাঘাত দেশের নিদ্রিত বিবেকের ওপর। ১৯৪৬, ১৯৪৭ সাল যেন সুদে-আসলে এই হৃদয়হীনতার মূল্য আদায় করে নিল মানুষের রক্তস্রোত, দেশভাগ, ও লাখো লাখো মানুষের ঘরছাড়া হওয়ার মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ যে দ্রষ্টাও ছিলেন তা প্রমাণ হয়ে গেল।

প্রসঙ্গক্রমে, ভারতবর্ষকে সম্যক বোঝার চেষ্টায় রবীন্দ্রনাথ তুলনাহীন। এরকম মনে করার অনেক কারণ। বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্যের চর্চ্চা যতই তিনি করে থাকুন, ইংরেজী তথা পাশ্চাত্যের ভাবলোকে তাঁর অধিকার ছিল অতি উচ্চ মানের। সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিচারের পশ্চিমী যে মানদণ্ড সেটির মাপে ভারতবর্ষকে বুঝে নেওয়ার চেষ্টায় তিনি ছিলেন একেবারে প্রথম  সারিতে। ভারতবর্ষে ইতিহাসের ধারা ইত্যাদি প্রবন্ধ থেকে বোঝা যায় তাঁর বিচারের সাফল্য। তিনি বলেছিলেন - পশ্চিমের রাষ্ট্রতত্ত্ব দিয়ে আমাদের দেশের ইতিহাস বোঝা যাবে না। আমাদের দেশে সমাজ নামে একটি সক্রিয় সত্তা আছে, পশ্চিমী ইতিহাস বা রাষ্ট্রতত্ত্ব তার কোনো হদিশ পায় নি। তিনি বুঝেছিলেন, ভারতবর্ষের বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার তত্ত্ব ও প্রয়োগকে না বুঝে ভারতীয় ইতিহাসের কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। তাঁর সুষ্পষ্ট মত ছিল, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থের মধ্যেই ধরা আছে ভারতের যথার্থ প্রাচীন ইতিহাস। তিনি বুঝেছিলেন, বুদ্ধের পরবর্ত্তী হাজার বছর যাকে বৌদ্ধযুগ বলা যেতে পারে, সেই সময় ভারতীয় সভ্যতা তার তুঙ্গে পৌঁছেছিল। তিনি আরও বলেন যে, বৌদ্ধযুগের পরবর্ত্তী কালটি হল প্রতিক্রিয়ার যুগ, যখন অনুশাসনের চাপে ভারতীয় সমাজ গতিহীন অচলায়তনে পরিণত হয়ে যায়। … আর আধুনিক ভারতবর্ষ তো তাঁর ধ্যানে সদাই উপস্থিত। ভারতবর্ষের পুনরুজ্জীবনের রাস্তার খোঁজ তাঁর গোরা উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু। দেশের বৃহত্তর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন শহুরে সমাজসংস্কারকদের সম্বন্ধে বীতশ্রদ্ধ গোরা শেষ পর্য্যন্ত বোঝে যে কোনো সঙ্কীর্ণ হিন্দুয়ানী নয়, মহত্তর মানবধর্ম্ম ও মানবপ্রেমই এই সমাজ, এই দেশকে নতুন জীবন দেবে।

রবীন্দ্রনাথের অসামান্যতার এটিই ছিল এক দিক যে, তিনি সদাই প্রস্তুত ছি্লেন তাঁর বিচারে সম্পূর্ণতা আনার ব্যাপারে। তার উজ্জ্বল উদাহরণ হল রুশ দেশের কমিউনিষ্ট ব্যবস্থা সম্বন্ধে তাঁর মতামত। রাশিয়া দর্শনের পর তাঁর মনে হয়েছিল, ওখানে না গেলে তাঁর জীবনের তীর্থদর্শন বাকী থাকত। ওখানে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে উদ্দীপনা তিনি দেখেছিলেন, তাকে তিনি অন্তর থেকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। ও দেশে জনশিক্ষার বিপুল আয়োজনেরও তিনি অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন। এর অব্যবহিত পরেই তিনি ধ্বংসের বীজ দেখতে পান ওদেশের সর্ব্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণ চেষ্টার মধ্যে। কিন্তু এরকম আপাতবিরোধী মতামত থেকে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে স্ববিরোধিতার অভিযোগ আনা যায় না। সত্যকে তার সামগ্রিক জটিলতায় বুঝে নেওয়াটাই ছিল তাঁর সাধনা। সত্য যত কঠিনই হোক, তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নিতে হয়, এই ছিল তাঁর অবিচল বিশ্বাস। গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর একাধিক বিষয়ে মতপার্থক্য সত্ত্বেও তিনি গান্ধীজিকে মহাত্মা এবং ক্ষণজন্মা পুরুষও বলেছেন। কিন্তু যখন গান্ধী নেতৃত্বের চূড়ান্ত প্রতিকূলতা সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেসের বাইরে ঠেলে দিল, তখন তিনি নির্দ্বিধায় সুভাষচন্দ্রকে দেশনায়ক পদে বরণ করে নিলেন। পরবর্ত্তী কালের ঘটনা প্রমাণ করে দিল, রুশ দেশ এবং সুভাষচন্দ্র, দুয়ের সম্বন্ধে শেষ বিচারে তাঁর ভুল হয়নি। দুটিই তাঁর দূরপ্রসারী প্রজ্ঞার উজ্জ্বল উদাহরণ। দুই ক্ষেত্রেই লক্ষণীয়, সত্যের মূল্যে খ্যাতির সাধনা রবীন্দ্রনাথ করেননি। লোকে ভুল বুঝতে পারে এই ভেবে নিজের মত পরিবর্ত্তনকে গোপন রাখার চেষ্টাও করেননি। 

সত্যের প্রেরণায় এক মত ছেড়ে অনায়াসে আর এক মতে চলে আসার চেয়ে বিস্ময়কর হল রবীন্দ্রনাথের কান্য, উপন্যাস, ছোটোগল্প, নাটক প্রভৃতিতে - এক হিসাবে তাঁর সকল শিল্পকর্ম্মে অবিরাম দুঃসাহসী রূপান্তরের ধারা। বিষয়বস্তুর নির্ব্বাচন এবং উপস্থাপনের অঙ্গিক, দুই ক্ষেত্রেই নিত্য পরিবর্ত্তনের সুষ্পষ্ট স্বাক্ষর। এ বিষয় রবীন্দ্রনাথ নিজে কোনো স্থূল ঘোষণা না করে থাকলেও, মনে হয় তাঁর কোনো গূঢ় কিন্তু নিশ্চিত দায়বদ্ধতা ছিল, এবং তারই প্রেরণায় শিল্পী হিসেবে তিনি নিজেকে আজীবন ভেঙেছেন আর গড়েছেন। কবিতা, গান, গদ্যকাহিনী, নাটক - সব কিছুতে তিনি পর্য্যায়ের পর পর্য্যায় পার হয়ে গেছেন। আর জীবনের শেষ পাদে চিত্রকর হিসেবে আত্মপ্রকাশ বোধ করি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রূপান্তর গ্রহণ। এই সময়েই কবিতা, গল্প, নাটক সব কিছুতে নতুন সৃষ্টির উল্লাস। তাসের দেশ, রক্তকরবী’র মতো নাটক, ল্যাবরেটরি, রবিবার-এর মতো গল্প, এবং  বলাকা, পূরবী, পুনশ্চ প্রভৃতির মতো কবিতা পার হয়ে শেষ লেখা-য় সমাপ্তি টানা - এ এক অফুরন্ত সৃষ্টিধারা। মনে হতে থাকে জীবন ও শিল্পের কোনো আদর্শের প্রতি সম্পূর্ণ আত্মনিবেদিত থাকায় জীবনের শেষ দিন পর্য্যন্ত রবীন্দ্রনাথ নিজেকে নিয়ে ক্লান্তিহীন রূপান্তরের সাধনা চালাতে পেরেছিলেন। বারে বারে নিজেকে নতুন করে নেওয়া, সেটা কোনো কৃৎকৌশলগত চমকের চেষ্টায় সম্ভব হয় নি। তা যদি হত, তবে কোনো না কোনো সময়ে এই সৃষ্টিধারার অন্তঃসারশূন্যতা ধরা পড়ে যেত। তাহলে রবীন্দ্রপ্রতিভার এই বর্ণাঢ্য বৈচিত্র্য, এবং বারে বারে নতুন করে জ্বলে ওঠা, এর ব্যাখ্যাটা কী?

এই প্রশ্নের উত্তরের চেষ্টায় সাহিত্য ও শিল্পে রবীন্দ্রনাথের বহু বছরের ঐকান্তিক চর্চ্চার উল্লেখ করা যায়। কিন্তু শুধু দীর্ঘকালীন চর্চ্চায় কোন শিল্পীর অসাধারণ মহত্ত্ব আসে না। সে চর্চ্চায় তিনি উঁচু মানের কৃৎকৌশলবিদ হতে পারেন, তার বেশী কিছু নয়। ভারতের এবং পাশ্চাত্যের, দুই দেশের সাহিত্য সংস্কৃতির ঐতিহ্য থেকে তিনি উপকরণ ও প্রেরণা দুই-ই পেয়েছিলেন। সে ঋণ তাঁর শোধ হয়েছিল, যদিও তাঁর ভাগ্যে জুটেছিল বেশ কিছু অপ্রাপ্য সমালোচনা। তাঁর সাহিত্যের সমাজবাস্তবের উচ্চকিত উপস্থিতি নেই, তাঁর কাব্যে পাশ্চাত্যের সমাদৃত চিত্রধর্ম্মিতা অনুপস্থিত, এবং পাশ্চাত্যের রোমাণ্টিক ধারায় চলে আসা প্রতিবাদী  বিলাপও সেখানে নেই। এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে অনেকে তাঁর সাহিত্যের ত্রুটি বলে দেখেছেন, কিন্তু এগুলি তাঁর উদ্দিষ্ট ছিল, আদৌ এমন মনে হয় না। প্রাতিষ্ঠানিক সমালোচকরা প্রায়ই ভুলে যান, সাহিত্যের রূপান্তর সভ্যতার রূপান্তরের অংশ হিসেবেই সম্ভব। তাঁরা আরও ভোলেন, লেখক-শিল্পী শিল্পচর্চ্চা ছাড়া অন্যান্য সামাজিক দায় কতটা নেবেন তা নির্ভর করে সামাজিক পটভূমির ওপর। এই সামাজিক দায়ই বহু লেখক-শিল্পীর সময় ও শ্রমের ধারাকে শিল্প ছাড়া অন্য খাতে টেনে নিয়ে যায়। উপরন্তু, বহু সময় সামাজিক দায়ের চাপে শিল্পী তার সৃষ্ট শিল্পকর্ম্মের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অংশের ওপর নিবিড় নজর দিতে পারেন না; ফলে শিল্পকর্ম্মে থেকে যায় ত্রুটি। এমনটি ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের বেলায়, ঘটেছে মহামতি দান্তে বা মিল্টন, অথবা আমাদের কাছের কবি নজরুল বা এমনকি সুকান্তর বেলায়। 

তবে যে ক্ষেত্রে সমালোচনা বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, তা হল রবীন্দ্রসৃষ্ট সঙ্গীতের বেলায়। মনে হয় ভারতের দরবারী এবং লোকায়ত সঙ্গীতের ঐতিহ্যকে বুদ্ধি এবং সমগ্র চেতনা দিয়ে আজ পর্য্যন্ত কেউ রবীন্দ্রনাথের মতো বুঝতে পারেননি। এবং সেটা হয়েছিল বলেই শতাব্দীর অধিককাল ধরে তাঁর গান বেঁচে আছে এবং আজও দিকে দিকে ব্যাপ্ত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, তৎকালের পূর্ব্বপাকিস্তানের বাংলাভাষী মুসলমানের নিজের জাতীয় সত্তা আবিষ্কার করায় বড়ো অবলম্বন ছিল রবীন্দ্রনাথের গান। বিনা কারণে আয়ুবশাহী জমানায় পূর্ব্বপাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা নেমে আসেনি। 

কিন্তু ঐতিহ্যের সঙ্গে যত সংযোগই থাকুক, সৃষ্টিটা করে মানুষ। ঐতিহ্যকে গভীরভাবে বুঝতে এবং তার ভিত্তিতে নতুন সৃষ্টি আনতে মানুষের নিজের ভিতরকার প্রেরণা আরও বেশী করে প্রয়োজন। সেই প্রেরণা, প্রতিভার সেই স্ফূরণকে যদি প্রকৃতির আকস্মিক দান বলে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাতে রবীন্দ্রপ্রতিভার যথেষ্ট ব্যাখ্যা হয় না। বরং বলা যেতে পারে, মানবসমাজ তথা বিশ্বচরাচরের ছন্দের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে২ ঐকান্তিক সততার সঙ্গে শিল্পসাধনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এবং তারই পুরস্কার হিসেবে এই চিরসৃষ্টিশীলতা তিনি পেয়েছিলেন প্রকৃতির কাছ থেকে। একথা মানতে বাধাই বা কোথায়? মানুষের দেহ এবং সেই সূত্রে মানুষের মনও প্রকৃতির রাজ্যের মধ্যে পড়ে। রবীন্দ্রনাথকে দেখে আমরা আরও বুঝি Being অর্থাৎ কোনো কিছু হয়ে থাকার চেয়ে Becoming অর্থাৎ কোনো কিছু হয়ে ওঠা আরও বড়ো সত্য। রবীন্দ্রনাথ নিজেকে বিকাশ করেছেন অনেক রূপে, নিজেকে নিজে ছাড়িয়ে গেছেন বারে বারে - তাঁর কর্ম্মে, শিল্পে, চিন্তায়, ভাবনায়। তাঁকে দেখে আমরা বুঝতে পারি, প্রতিটি মানুষই জীবনের অর্থ বেশী করে খুঁজে পায় নিজের পুরনো মাপকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মধ্যে।

রবীন্দ্রনাথকে বোঝা মানে মানুষকে বোঝার নতুন মাপকাঠি নিয়ে আসা। তাঁর জীবনের উদাহরণে দেখি, এক মানুষ এক সঙ্গে কত কী পারে, এবং তার ক্ষমতার কতখানি ব্যাপ্তি সম্ভব। তাঁকে দেখেই আমরা আরও বুঝি মানুষের জীবন তখনই দীপ্ত হয়, যখন সে অভ্যাসের দাসত্ব ছাড়ে, যখন সে মাথাটা উঁচু করে তোলে আর যখন সে সকল মানুষের মধ্যে সাম্য ও সহযোগিতা দুটোকেই একান্ত সত্য মনে করে, আর বিশ্বচরাচরের আনন্দময় ছন্দের সঙ্গে নিজেকে মেলায়। রবীন্দ্রনাথকে আমরা উপযুক্ত মর্য্যাদা তখনই দিই যখন আমরা ক্ষুদ্র অস্তিত্বের বেড়া ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারি। আর তখনই রবীন্দ্রনাথের যথার্থ আসন পাতা হয় আমাদের মনে, জীবনে। সেটি শুধু আনন্দ নয়, সেটি একটি দায়ও। সে দায় হল নিজেকে, আর নিজের সঙ্গে সকল মানুষ তথা বিশ্বচরাচরের সম্পর্ককে, সত্যের ভিত্তিতে বারে বারে প্রতিষ্ঠা করানোর।

[ দুই ]

এবার আমরা যে আলোচনায় প্রবেশ করব, তার শিরোনাম হতে পারে ‘রবীন্দ্রনাথের ঠিকানা’। আর বিশেষ কিছু নয়, জাতির জীবনে কোথায়, কীভাবে রবীন্দ্রনাথ বেশী করে ছিলেন, তারই ওপর কিছুটা চোখ চারিয়ে নেওয়া। দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে সমালোচনা যেখানে যেখানে মুখর, সেখানেই যেন বেশী করে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি। রবীন্দ্রবিরোধিরা এখানে আমাদের সাহায্যই করেন। এ কথা মনে করার দরকার নেই, ব্যক্তিগত ঈর্ষার কারণে তাঁরা সকলে সমালোচনায় নেমেছিলেন। তাঁদের সমালোচনাকে তারিফ করার লোকও তো থাকত, আছেও। তবে এটা ঠিক যে, পূর্ব্বের পুনরাবৃত্তিতে কেউ রে রে করে আসে না, নূতনের আবির্ভাব হলেই চলে আসে সমালোচনার ঝড়। সুতরাং কোথায়ও কিছু নূতনত্ব এসেছে কি না, সেটা বুঝতে আমাদের বিশেষ সাহায্য করে প্রতিকূল সমালোচনা।

রবীন্দ্রনাথের কবিজীবনের প্রথমার্দ্ধে, বলতে গেলে নোবেল পুরস্কার পাওয়া পর্য্যন্ত, তাঁর বিরুদ্ধে প্রধান সমালোচনা ছিল, তিনি যথেষ্ট মর্য্যাদাপূর্ণ চালে কবিতা লেখেন না। তাঁর কবিতায় অস্পষ্ট কথার আধিক্য, বহুক্ষেত্রে কোনো সরল বুদ্ধিগ্রাহ্য মানে না থাক, এমনকি স্ববিরোধী, বা দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বলা - এই সব হল তাঁর কবি হিসেবে ত্রুটি। কোন নিয়ম না মেনে চলার প্রবণতা তাঁর প্রধান দোষ। আর এটা তো সত্যি যে, তাঁর সময়ের সম্মানিত কাব্যরীতি, অর্থাৎ মাইকেলী কাব্যরীতি থেকে বেরিয়ে এসে তিনি নতুন রীতির প্রবর্ত্তন করেন। তাঁর এই রীতিতে বুদ্ধির পাশাপাশি কল্পনাকেও প্রাধান্য দেওয়া হয়। এবং এটাও ঠিক যে, কবিতায় যেমন তেমনি সমাজসঙ্গঠনেও রবীন্দ্রনাথ আমাদের দেশের লোকাচারের, অন্ধ বিশ্বাসের ভিতের ওপর দাঁড় করানো সামাজিক অচলায়তনকেও ভেঙে ফেলার ডাক দিয়েছেন বারে বারে। এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ নিন্দার্হই হয়েছিলেন, পুরোনো অনেক কিছুকে ভেঙে ফেলতে বা বিদায় করতে চেয়েছিলেন বলে।

ঘটনাচক্রে দেশের জীবনে এবং কবির জীবনে কালান্তর যেন একই সঙ্গে ঘটে গেল।  ১৯১৩-তে নোবেল পুরস্কারের সামনে দেশের পুরাতনপন্থিদের সমালোচনা স্তিমিত হয়ে গেল, সবাই উদ্গ্রীব কবির কপালে জয়টীকা পরাতে। পর পরই এল ১৯১৪-১৯১৯-এর প্রথম মহাযুদ্ধ এবং ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব। মহাযুদ্ধ দেখিয়ে দিল পশ্চিমী গণতন্ত্র তথা পশ্চিমী সভ্যতার দেউলিয়াপনা, রুশ বিপ্লব তুলে ধরল এক নতুন সামাজিক আদর্শের পতাকা। আগের শাসকদের দর্প এখন অনেক কম, আর বিদ্রোহিদের স্বরে নতুন আত্মবিশ্বাসের ঘোষণা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কাল ছিল বিদ্রোহের কাল। শ্রমিক-কৃষককে নতুন মর্য্যাদায় অভিষিক্ত করা হল। ধরে নেওয়া হলো যে, শ্রমিকশ্রেণীর অধিকার-প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পরিণতিতে গড়ে উঠবে সমাজতন্ত্র। আর কবি-লেখকদের কর্ত্তব্য হবে তাঁদের সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে সমাজের এই রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করা। পাশাপাশি দাবী উঠল মানুষের স্বাভাবিক জীবধর্ম্মের স্বীকৃতিতে সাহিত্য ও শিল্পে শ্লীল ও অশ্লীলের মধ্যেকার সীমারেখাকে ঘুচিয়ে দেওয়ার। দাবী উঠল সাহিত্যে বাস্তবের প্রতিষ্ঠা হোক, আর সাহিত্য এসে তার স্থান খুঁজে নিক সাধারণ মানুষের জীবনে। কবিতার জন্য আলাদা কাব্যিক বিষয়, বা কাব্যিক ভাষাও চলবে না। আর গদ্যছন্দের ব্যবহারে কবিতার চালচলন সহজ হয়ে আসুক - এ সবও এই কালের দাবী।

রবীন্দ্রজীবনের প্রথমার্দ্ধে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সাহিত্যের মর্য্যাদাকে ক্ষুণ্ন করেন। সাহিত্যের মধ্যে অর্ব্বাচিনতা, ও উচ্ছৃঙ্খলতাকে প্রতিষ্ঠা দিয়ে দেন। এবার জীবনের দ্বিতীয়ার্দ্ধে তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনা হল, তিনি নতুন যুগের সঙ্গে সমতালে চলতে অপারগ এবং অনিচ্ছুক। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ঠিকই সাড়া দিয়ে গেলেন যুগের ডাকে। তিনি কবিতায় সাধারণ বিষয়বস্তু নিয়ে এলেন, গদ্যছন্দের কবিতাকে তাঁর কাব্যসৃষ্টির প্রধান ধারাও করে নিলেন। আধুনিক মনস্তত্ত্বের খোরাক হবে এমন ছোটগল্প লিখলেন, পুঁজিবাদী শোষণ নিয়ে রক্তকরবীর মতো নাটকও লিখলেন। কিন্তু নব্য সমালোচকদের সন্তুষ্টি হয় এমন ভাবে তিনি আধুনিকতাকে মেনে নিলেন না। তাঁর অজানা শ্রমিকবস্তির জীবন নিয়ে কিছু লিখলেন না, ‘শৌখিন মজদুরি’ করলেন না এবং শ্লীলতার মাত্রাও লঙ্ঘন করলেন না। 

বোঝা গেল নতুনকে মেনে নিতে সদাই প্রস্তুত রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু পুরাতনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না করে। পুরাতনের শ্রেষ্ঠ সম্পদকে সংরক্ষণ করা আর প্রাণময় নূতনকে স্বাগত জানানো। তাঁর জীবন থেকে দুটি উজ্জ্বল উদাহরণ আনা যায় - এক, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ প্রণয়ন, আর দুই, রামকিঙ্কর বেজ-এর মতো গ্রামের মাটি থেকে উঠে আসা শিল্পীকে তাঁর উপযুক্ত ক্ষেত্রে বসিয়ে যাওয়া। রবীন্দ্রনাথের প্রেরণা ও সমর্থন ছাড়া ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ প্রণয়ন কখনোই সম্ভব হত না। যাঁরা ভারতের অতীতকে তার ভাষা ও সাহিত্যের ভিতর থেকে উদ্ধার করে নিতে চান, তাঁদের কাছে বঙ্গীয় শব্দকোষ এক অমূল্য সম্পদ। যত দিন যাবে, তাত এর গুরুত্ব স্পষ্ট হতে থাকবে। নূতন আর পুরাতনের আর এক প্রতিভাদীপ্ত সমন্বয় শান্তিনিকেতনের শিক্ষাদর্শ। আজ সে আদর্শ ধুলোয় লুটোতে পারে, কিন্তু তার গৌরবের দিন এ আদর্শের আলো পেয়ে নিজেদের ধন্য বলে মেনেছিলেন অসঙ্খ্য মানুষ।

সাহিত্য শিল্প সহ জীবনের নানা দিক ব্যেপে তাঁর সাধনার জন্য তাঁর অন্তর্ধানের পরও রবীন্দ্রনাথ ভালভাবে বেঁচে রইলেন মানুষের মনে। মৃত্যুর দশ বছরের মধ্যে রবীন্দ্রপ্রতিভাকে খর্ব্ব করার চেষ্টা হয়েছিল ‘ধনিকের কবি’, ‘বুর্জ্জোয়া কবি’ ইত্যাদি পরিচয়ে। কিন্তু সে মূল্যায়ন বাঙালী মেনে নিল না। তিনি যে সত্যিই দিশারী, তার প্রমাণ হয়ে গেল বাংলাদেশ সৃষ্টির লগ্নে বাংলাভাষী-মুসলমানের আত্মপরিচয় আবিষ্কারে। রবীন্দ্রনাথ থেকে গেলেন আমাদের জীবনে - দিগন্তরেখায় শুধু নয়, একেবারে পথ জুড়ে, গ্রীক পুরাণের স্ফিঙ্কস্‌ বা মহাভারতের বকরূপী ধর্ম্মের মতো। পাশাত্যের থেকে আমদানী কোনো তত্ত্ব দিয়ে তাঁকে মাপা যাচ্ছে না, এবং প্রাচ্যের তত্ত্ব যতটা জানা আছে তা দিয়েও নয়। এটুকু শুধু বোঝা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথকে হৃদয়ঙ্গম এবং আত্মসাৎ করার পরেই আমাদের ঘটবে স্বাধিকারে প্রতিষ্ঠা, তার আগে নয়। (রবীন্দ্রনাথের সেই অব্যাখ্যাত দিকটির ওপর আলো ফেলা হয়েছে এই সঙ্কলনের কলিম খান লিখিত ‘বাংলাভাষার সমস্যা ঃ প্রাচ্যের সম্পদ ও রবীন্দ্রনাথ’ নিবন্ধে।} আমাদের এই উপলব্ধির কারণে এই সঙ্কলনগ্রন্থ যার নাম হতে পারত ‘আমাদের আত্মপরিচয় আবিষ্কার / পুনরুদ্ধার’ তার শিরোনামের মধ্যে সেকারণেই আনা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের নাম।

শেষ কথা এই যে, আমরাই শুধু নয়, আজকের সারা পৃথিবীর মানুষই বুঝিবা এমন এক কঠিন সময়ে এসে হাজির হয়েছি, যখন রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর বিকল্প দেখতে পাই না। শরীরের প্রয়োজন মিটে গেলে, তারপর মানুষ কী নিয়ে বাঁচবে? তার জীবনের ৭৫ শতাংশই তো মন, সে মনের ক্ষুধার অন্ন কই? পেটের শান্তির পরেই যে মনের শান্তির উপায় চাই। সে শান্তি কোথায়! এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য সারা দুনিয়া আজ পাগল, পাগল হয়ে চরম আত্মকলহে লিপ্ত। এত পাগল যে, কেন-যে পাগল, কেন-যে আত্মকলহে লিপ্ত, তার যাথার্থ্য উপলব্ধি করতেও সে অক্ষম। 

আজ আমরা জানি, এ প্রশ্নের উত্তর জানত প্রাচ্য, জেনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, আর সেকথাই ছিল তাঁর প্রাণের কথা। তিনি নিজে জানতেন, তাঁর সেই প্রাণের কথা তাঁর গানের মধ্যেই সবচেয়ে বেশী করে তিনি রেখে যেতে পারছেন। তাই, গানকেই তিনি বলেছেন ‘আমার শেষ পারানির কড়ি’, বলেছেন, ‘গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি, তখন তারে চিনি’। এই জগৎসংসার তাঁর কাছে বিশ্ববিধাতার গান, তিনি বলেন, ‘তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী, আমি অবাক হয়ে শুনি’। তিনি অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন, বিশ্বচেতনার সঙ্গে স্বচেতনার লীলাতেই মানুর মানুষের চরম শান্তি। সেই লীলাতেই মানুষের সব আবিষ্কার, সকল উদ্ভাবন, সমস্ত সৃষ্টি। সেই লীলাতেই রূপের সমস্ত ধাপ পেরিয়ে অরূপরতনকে ছোঁয়ার শিহরণ, গুণের ও আকারের সকল ধাপ পেরিয়ে নির্গুণের নিরাকারে পৌঁছানোর অপরিমেয় আনন্দ, এবং তাতেই অমৃতলাভ বা মোক্ষলাভ - এ তিনি অত্যন্ত স্পষ্ট অনুভব করেছিলেন, আত্মসাৎ করেছিলেন এবং সকলের জন্য সেই অমৃত, তার স্বাদ ও গন্ধ পূর্ণমাত্রায় পরিবেশন করে রেখে যেতে পেরেছিলেন, সবচেয়ে বেশী করে গানের মাধ্যমে। সেই অমৃতের কয়েক কণা এখানে উল্লেখ করে যাওয়া যাক -

‘আমার বেলা যে যায় সাঁঝবেলাতে, তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে …’
‘রূপসাগরে ডুব দিয়েছি অরূপরতন আশা করি …’
‘যাবার আগে এই কথাটি বলে যেন যাই, যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই …’
‘এই কথাটি মনে রেখো আমি যে গান গেয়েছিলেম …’
‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে, জানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে …’
‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা …’
‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে…’

এমনকি মৃত্যুশয্যায় শুয়েও সেই লীলার কথাই তিনি বলে গিয়েছেন তাঁর জীবনের সব শেষ কবিতায় -

“তোমার সৃষ্টির পথ”

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি 
বিচিত্র ছলনাজালে 
হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে 
সরল জীবনে।

এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত;
তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি।
তোমার জ্যোতিষ্ক তারে
যে পথ দেখায়
সে যে তার অন্তরের পথ, 
সে যে চিরস্বচ্ছ, 
সহজ বিশ্বাসে সে যে 
করে তারে চিরসমুজ্জ্বল।
বাহিরে কুটিল হোক, অন্তরে সে ঋজু
এই নিয়ে তাহার গৌরব।

লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত।

সত্যেরে সে পায়
আপন আলোকে-ধৌত অন্তরে অন্তরে।
কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে,
শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে
আপন ভাণ্ডারে।

অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে 
শাস্তির অক্ষয় অধিকার।

টীকাটিপ্পনী -

‘১।  ’ভারততীর্থ’ কবিতাটির ঠিক পরের দিন রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘দীনের সঙ্গী’ শীর্ষক কবিতাটি। এর প্রথম দুই পঙ্‌ক্তি হল - ‘যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন / সেইখানে যে চরণ তোমার রাজে’

২। এরই সচেতন অংশটিকে বলা যায় রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন। তার আলোচনা এ প্রবন্ধে নাই বা হল। আর কারও কাছ থেকে সেটি আসুক। 

[ নিবন্ধটি পূর্ণেন্দু মিত্র সম্পাদিত ‘রবীন্দ্রনাথ’ পত্রিকার ১৬ নম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত। এখানে তা কিছুটা পরিবর্দ্ধিত ও পরিমার্জ্জিত করা হল। ]

কৃতজ্ঞতাঃ নারায়ণ চন্দ্র দাস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ