গো শব্দের বহু অর্থবাচকতা।। শ্রী শুভাশিস চিরকল্যাণ পাত্র।



গো শব্দের বহু অর্থবাচকতা প্রসঙ্গে সুকুমার রায়, কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী


বাংলা শব্দগুলির বহুঅর্থবাচকতা (polysemy) একটি আকর্ষণীয় বিষয়। বাঙালী কবি সুকুমার রায় গো শব্দের বহু অর্থে অবাক হয়েছিলেন। সুকুমার রায়ের 'চলচ্চিত্ত চঞ্চরী' নাটিকার শ্রীখণ্ডদেব বলেছিলেন যে, গো শব্দের অর্থ বুঝলে বিশ্বরূপ দর্শন করা যায়। শ্রীখণ্ডদেব (সুকুমার রায়) রচিত গো শব্দের সূত্রটি এখানে তুলে দিচ্ছি।

খণ্ডিত গোধন মণ্ডল ধরণী
শবদে শবদে মন্থিত অরণী, 
ত্রিজগত যজ্ঞে শাশ্বত স্বাহা – 
নন্দিত কল কল ক্রন্দিত হাহা
মৃত্যু ভয়াবহ হম্বা হম্বা
রৌরব তরনী তুহুঁ জগদম্বা
শ্যামল স্নিগ্ধা নন্দন বরণী।
খণ্ডিত গোধন মণ্ডল ধরণী।

নাটিকায় বলা হয়েছে যে, শ্রীখণ্ডদেবের রচিত 'শব্দার্থখণ্ডিকা' বইয়ে এই সূত্রটি আছে। আমার মতে সূত্রটি একটু প্রহেলিকাময় হলেও গরুর লেজ ধরে নরকের বৈতরণী নদী পার হওয়ার মতো এখানে গো শব্দ জপ করে বিশ্বতত্ত্বে উপনীত হবার চেষ্টা বেশ বুঝা যাচ্ছে। এখন আমরা গো শব্দের বহুঅর্থবাচকতা আলোচনা করব। এই আলোচনায় কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর 'বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ' আমার প্রধান অবলম্বন।

গো মানে শুধু গরু নয়। অমরকোষের গান্ত বর্গে গো শব্দের মানে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে; "স্বর্গেষু পশুবাগ্বজ্রদিঙ্‌নেত্রঘৃণিভূজলে"। এর অর্থ হল গো শব্দের অর্থ স্বর্গ, পশু, বাক, বজ্র, দিক, নেত্র, ঘৃণি (সূর্য্য), ভূ (পৃথিবী), জল ইত্যাদি। তাহলে বুঝুন গো মানে কত কী! অতএব গো কথার মানে বুঝলে বিশ্বদর্শন হয়ে যাবে। এখন উদাহরণ সহযোগে ধীরে ধীরে গো শব্দের মানেগুলির কিছু কিছু ব্যাখ্যা করছি।

গো মানে কিরণ, অক্ষি মানে ছিদ্র বা রন্ধ্র। গো ও অক্ষি শব্দের সন্ধি করলে হয় গবাক্ষ। গবাক্ষ মানে রন্ধ্র বা জানালা, যে পথ দিয়ে আলোক রশ্মি (গো) যায়। সমাসবদ্ধ হওয়ার সময় অক্ষি শব্দটি অক্ষ হয়ে আয়। আাবার গো মানে পৃথিবী, গোত্র মানে যে পৃথিবীকে ত্রাণকারী বা রক্ষাকারী পর্ব্বত। গোত্র মানে গোষ্ঠ, গোশালা ইত্যাদিও হতে পারে যা গরুকে রক্ষা করে। বংশধারাকে রক্ষা করে যে সন্তান তাকেও গোত্র বলে। ছাতাও গোত্র, কারণ তা গো বা রোদ থেকে আমাদের রক্ষা করে। ফাইলেরিয়া রোগে পা ফুলে হাতীর (elephant-এর)মত গোদা হয়। একে গোদ বা elephantiasis বলে। গোদ শব্দে গো মানে জল। গোদ মানে গোদাতা, পায়ে রস জমা রোগ বিশেষ, শ্লীপদ (elephantiasis) (ব. শ.)। গোদাবরী [গো+দা+বর্+ঈ] মানে 'জলদাত্রী', দাক্ষিণাত্যের পবিত্র নদীবিশেষ (ব. শ.)। এখানেও গো মানে জল।

'সরল শব্দার্থকোষ'-এ বলা হয়েছে যে গোবিন্দ মানে যিনি (সর্ব্ব-প্রকারের) গোগণ (গতিশীল সত্তাগণ) বিষয়ে বিদিত (ও তাহাতেই বিদ্ধৃত থাকেন); অথবা, (সর্ব্বোচ্চ অর্থে) চাইলে যিনি তত্ত্বজ্ঞানসমূহের রস দান করেন এবং (সর্ব্বনিম্ন অর্থে) যে রাখাল ভাল দুধ যোগাইতে পারে। তারা গোবিন্দ শব্দের প্রতীকী অর্থ করেছেন শ্রীকৃষ্ণ, বৃহস্পতি; (সাদৃশ্যে) বহু গরুর স্বত্ত্বাধিকারী ইত্যাদি। এখানেও গো মানে শুধু গরু বুঝলে চলবে না।

গোপাল শব্দে পণ্যের পালক বুঝতে হবে। এখানে গো মানে পণ্য বুঝতে পারেন। কৃষ্ণকে গোপাল বলা হয়। তাঁকে একজন গরুর রাখাল ভাবলে চলবে না (সেটি প্রতীকী অর্থ)। গোবর্দ্ধন গিরি হল সেই সংস্থা (বা পর্ব্বত) যা পণ্য (গো) উৎপাদন বৃদ্ধি করে ও নির্গত করে। কৃষ্ণ গোবর্দ্ধন গিরি ধারণ করেছিলেন। কংসকে ফাঁকি দিয়ে গোকুলে সেই পণ্যোৎপাদন সম্ভব হয়েছিল। 'গো'বর মানে গো-এর বরণীয় অংশ বা পণ্যমূল্য এবং সাদৃশ্যে গোরুর বিষ্ঠা। যজ্ঞে 'গো'বর খাওয়া কর্ম্মে টাকা ঢালার প্রতীক। হিন্দুশাস্ত্রে গোবর বরণীয় হলেও গোমাংস ভক্ষণ নিষেধ। এর অর্থ হল পণ্য বেচে টাকার পাহাড় করা চলবে না। বাহ্যিক গোমাংস ভক্ষণ করলে (beef খেলে) অবশ্য তত পাপ হয় না (মুসলমানরা তো দিব্যি beef খান)। ছাগল মাংস ( mutton) বা শুয়ারের মাংস (pork) খেলে যতটা পাপ বা পুণ্য হয়, beef খেলে প্রায় ততটাই হয়। মানসিক গোমাংসে (ব্যক্তিমালিকানায়) মজে থাকলে মাহাপাপ।

কৃত্তিবাস রামায়ণের প্রথম লাইনটি হল : "গোলোকে বৈকুণ্ঠপুরী সবার উপর/লক্ষ্মীসহ বৈসে তথা দেব গদাধর।" এখানে গোলোক মানে গোয়ালঘর নয়, বরং সর্ব্বপ্রকার গো বা ধনসম্পদের মালিক বা জ্ঞানসম্পদের মালিকদের ঘর; যে লোকে বা স্ফীয়ারে শ্রেষ্ঠ গামিগণের বাস। এবার গবেষণা শব্দে গো মানে বলি। গো এবং এষণা মিলে গবেষণা। এখানে গো মানে গরু নয়, জ্ঞান। গবেষণা মানে গরু খোঁজা নয়, জ্ঞানাণ্বেষণ। এখন পদ্যাভিধান 'বর্ণসঙ্গীত'-এর 'গো' পদাবলী উদ্ধৃত করে গো শব্দের নানা অর্থ বর্ণনা করা হচ্ছে :

গো

শ্রীখণ্ডদেব বলিয়া গেলেন গো মানে কত কী হয়;
গো মানে স্বর্গ, ভূ, বাক, বজ্র – অমরকোষেতে কয়।
শুধু গরু নয়, গো মানে 'যে যায়', 'যা দিয়ে স্বর্গে যায়';
বুঝে খণ্ডিত গোধনের কথা বিশ্বকে বোঝা যায় ।

গোমানে কিরণ, অক্ষি শব্দে রন্ধ্রতুল্য হয়;
দুই জুড়ে দিলে গবাক্ষ হয়, তাকে বাতায়ন কয়। 
বড় ভাল লাগে সেই জানালায় সূর্য্যকিরণ এলে; 
সেই কিরণেতে ভাসে ত্রসরেণু, দেখি তা অক্ষি মেলে।

গো অথবা রোদ থেকে ত্রাণকারী ছত্ত্র গোত্ত্র হয়;
পর্ব্বত করে পৃথিবী রক্ষা, তাহাকে গোত্ত্র কয়।
গোশালা এবং বংশ গোত্ত্র, কোন সন্দেহ নাই;
সন্তান করে বংশ রক্ষা, গোত্ত্র হইবে তাই ।

একসাথে বহু গো দান হইলে গোদ বলা হয় তায়;
অনেক বস্তু একসাথে জমে সে স্থান ফুলিয়া যায়।
লসিকার নালী রুদ্ধ হইয়া পা দু'খানি যায় ফুলে;
সে হল শ্লীপদ, রসজমা রোগ, গোদ নামে তাহা চলে।
,
গোদ-এর আধার গোদা হয়ে যায়, গোদা ছেলে খুব ভারী;
গোদা হতে পারে দলপতি আর যে করে মজুতদারী।
পালের গোদাকে ধরিতে পারিলে তবে বুঝি বাহাদুরি, 
গো অথবা জল দান করে ওই বরণীয় গোদাবরী।

গোঁ মানে হইল একরোখাভাব, নির্ব্বন্ধাতিশয়;
গোঁ ধরিয়া চলে যায় গো যেজ্‌ন, তাহাকে গোঁয়ার কয়।
ওরা একরোখা, বড় একঝোঁকা, মহা ঝামেলায় ফেলে;
এঁড়ে গরুটির মতো দড়ি ছিঁড়ে গোঁয়ারেরা যায় চলে।

সব গো বিষয়ে বিদিত যে জন সে তো গোবিন্দ হয়;
গোপাল কৃষ্ণ গোবিন্দ হয়, অমরকোষেতে কয়।
বৃহস্পতিও গোবিন্দ হয়, বলেন মেদিনিকার; 
তবে গোবিন্দ গোঁয়ার হইলে, তাঁকে সামলানো ভার।

সদগোপগণ অতি প্রকাশ্যে পোষে গোরু আর মোষ, 
গোপেরা গোপনে পণ্য বেচিলে তাতে হয় বুঝি দোষ?
গো পালন যদি অন হয়ে যায় তাহাকে গোপন কয়, 
রাষ্ট্রের ভয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে পণ্যের বিনিময়।

গো-এর পালন করে যেই জন তাহাকে গোপাল কয়;
গোপাল গোয়ালা, কৃষ্ণ, রাখাল এবং ভূপাল হয়। 
বৃন্দাবনেতে কৃষ্ণ বাবাজী চরাত গরুর পাল-
অর্থাৎ কি না পণ্য পালন করিত নন্দলাল।

গোপিনী শব্দে গোপের আধার অথবা পত্নী হয়, 
কংসের ভয়ে কৃষ্ণের কাছে ওরা আশ্রয় লয়।
বৃন্দবনেতে গিরি ছিল এক, নামটি গোবর্দ্ধন; 
কৃষ্ণ তাহাকে ধরিল, হইল পণ্য উদ্গীরণ।

যজ্ঞে গোবর খাইতে হইবে, শাস্ত্রজ্ঞানীরা কয়;
তবে সে গোবর প্রকৃত অর্থে গরুর বিষ্ঠা নয়।
গো সেই দ্রব্য যাহা হাটে যায়, মূল্য তাহার পাই; 
যজ্ঞের কালে কালে সেই মুল্যকে বরণ করিতে চাই।

গোবর খাইলে পুণ্য হইবে, গোমাংসে হয় পাপ; 
মাংস নিজের মালিকানা, উহা সামাজিক অভিশাপ।
টাকার পাহাড় জমাইলে হয় গোমাংস ভক্ষণ, 
বেশী মালিকানা কেহ কোনও দিন করিও না রক্ষণ।

গোলোকে প্রচুর ধনসম্পদ, সেই লোক তেজোময়; 
শুধু গরু নয়, সেইখানে আরও নানা ধন জমা হয়।
সে গোলোকে বৈকুণ্ঠপুরীতে, বিষ্ণু বসিয়া রয়, 
তবে তার মনে কুণ্ঠা হইলে সেও অবতার হয়।

গবেষণা মানে জ্ঞানের এষণা, গরুর এষণা নয়;
রূপ-সনাতন মহাজ্ঞানী বলে ওরা গোস্বামী হয়,
গোস্বামিগণ জ্ঞানের মালিক এবং দীক্ষাগুরু, 
গরুতে গোবর সার দেয় আর জ্ঞানসার দেয় গুরু।

সঙ্গের একটি ছবিতে গো শব্দের বহুঅর্থবাচকতা দেখানো হয়েছে। ছবিটি কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর 'বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ' থেকে গৃহীত। যারা বাংলা শব্দগুলির বহুঅর্থবাচকতা বুঝতে চান এবং ভাষার আলোয় বিশ্বরূপ দর্শন করতে চান তারা ওই গ্রন্থ পাঠ করুন। আমার মতে খান-চক্রবর্তীর এই গ্রন্থটিকে শ্রীখণ্ডদেব পরিকল্পিত শব্দার্থখণ্ডিকা গ্রন্থের বাস্তব রূপায়ন বলা চলে। গো শব্দের বহু ব্যাপ্ত অর্থ নিয়ে অসুবিধা হয় না, প্রেক্ষিত অনুযায়ী কখন কোন মানেটি লাগবে তা বুঝে নিতে হয়। গো শব্দের বহু বিচিত্র অর্থ আমাদের মনকে অসীমের দিকে নিয়ে যায়। সবাই গো শব্দ জপ করে এবং ক্রিয়াভিত্তিক নিয়মে শব্দের বহুঅর্থবাচকতা বুঝে মোক্ষলাভের পথ প্রশস্ত করুন। ধন্যবাদ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

Unknown বলেছেন…
গো মাতা হলো পানি।।।