যুক্তিবাদ প্রসঙ্গে...।।ধৃতিমান ভট্টাচার্য


এই নিবন্ধটি যখন লিখতে চলেছি, তখন হাজার একটা প্রশ্ন উঠে আসবে, এটাই স্বাভাবিক।
বর্তমান অবস্থায় দাঁড়িয়ে যখন দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রের ক্ষমতায় থাকা একটি ফ্যাসিস্ট দল দিনের পর দিন হিন্দুত্ববাদের প্রচার, ‘সবই ব্যাদে আছে’ এমন আখ্যা দিয়ে একের পর এক অবৈজ্ঞানিক ভাবনাকে তুলে ধরছে, অন্ধ কুসংস্কার, ধর্মীয় ভাবাবেগকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে দিনের পর দিন। তখন ‘যুক্তিবাদ’ নামক এমন একটা প্রগতিশীল দর্শন কে কেন কাঁটাছেড়া করছি ? 
অবশ্যই কারণ আছে, নিম্নে আমার সাধ্য অনুযায়ী ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলাম।
প্রথমেই ধরা যাক, দর্শন কথাটি! খুব সহজ ব্যাখ্যা করলেও, যেই অর্থটি সবার সামনে উঠে আসে, তা হল জ্ঞানের ভালবাসা। তাহলে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, কোন জ্ঞান? 

এই জ্ঞান বলতেই বা আমরা কি বুঝি! যখন আমরা কোনও না কোনও কাজ করি, তখন সেই কাজ সম্বন্ধে আমাদের একটি সাধারণ ধারণা জন্মায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, একটি আম গাছের নিচ দিয়ে কয়েকজন স্কুল-ফেরত শিশু বাড়ি ফিরছে। তাদের ইচ্ছে হল, সেই আম খাওয়ার। তারা গাছে উঠে সেই আম চেখে দেখে সিদ্ধান্তে এলো, তা মিষ্টি বা টক কিনা!
তাহলে এর থেকে বোঝা যায়, সেই আম দেখে তাদের যে ইচ্ছে হয়েছিল তার স্বাদ নেওয়ার। তা, সেই স্বাদের জ্ঞান তারা গ্রহণ করল সেই আমকে চেখে দেখে। এখান থেকে বোঝা যায়, কোনও বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করতে গেলে সেই কাজে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে লিপ্ত হতেই হবে।

অর্থাৎ, কোনও বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করতে গেলে ব্যক্তিকে প্রয়োগে যেতেই হবে। মানুষ যখন প্রথম আগুন জ্বালাতে শিখল, সেটাও করেছে প্রয়োগের মধ্যে দিয়েই। তার ধারণাগত জ্ঞানকে সে আগুনের মধ্যে দিয়েই প্রয়োগ করে  প্রথম সভ্যতার আলো জ্বেলেছিল। আদিম মানব সভ্যতার সেই থেকেই জ্ঞান আর প্রয়োগের মেলবন্ধনে পথ চলা শুরু। তবুও বর্তমানে এসে বিজ্ঞান যে স্তরে পৌঁছেছে, এই ভারতের মত দেশেই জায়গায় জায়গায় অন্ধ কুসংস্কার এবং ধর্মীর উন্মাদনার বাড়বাড়ন্ত দেখা যাচ্ছে। এবং তাকে ব্যবহার করে ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে কিছু রাজনৈতিক দল লুটেপুটে খাচ্ছেও।

এবার আসা যাক, যুক্তিবাদ প্রসঙ্গে। যুক্তিবাদ কি আদৌ এই প্রয়োগের পথ ধরে এগোয়! যদি এগোতই! তাহলে যুক্তিবাদ নির্দিষ্ট একটি শ্রেণীর প্রগতিশীলতার বাইরে আজও কেন সর্বহারা শ্রেণীর দর্শন হয়ে উঠতে পারল না? ইতিহাস সাক্ষ্য যে, পুঁজিবাদ নিজের স্বার্থেই যুক্তিবাদকে সামনে রেখেছিল সামন্ততন্ত্রকে উচ্ছেদ করার জন্য। একদিকে যখন বৃহৎ পুঁজি বিগ মেশিনাইজেশনের মাধ্যমে সর্বহারা শ্রেণীর সৃষ্টি করছে, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে নবজাগরণের পতাকা তলে ভারতের মাটিতে রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও আমূল সমাজ সংস্কারকের ভূমিকা পালন করছেন। তাঁদের সৎ চেষ্টা সত্বেও তাঁরা এই সমাজ সংস্কার আন্দোলনকে সমাজের প্রত্যেক শ্রেণীতে ছড়িয়ে দিতে পারেননি। কারণ সেই আন্দোলনও ছিল নির্দিষ্ট শ্রেণীর কুক্ষিগত।

যে উৎপাদন শক্তি ও সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে মানুষের উপরি-কাঠামোগত সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, সেই ভিত্তিকে জেনে বা না জেনেই যদি কেউ মনে করে শুধুই সাংস্কৃতিক আন্দোলন দ্বারা মানুষের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব, তাহলে তার বাস্তবিক বোধ সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। 
তবুও এই বাংলার বুকে এমন কিছু যুক্তিবাদী গোষ্ঠী আছে, যারা মনে করে তাদের দেখানো সমাজ সংস্কারের আন্দোলন বা সাংস্কৃতিক আন্দোলন মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণকে মুছে দিতে সক্ষম। আমার জানা নেই, তারা এমন দাবি করেন কিভাবে? এই মারাত্মক সিদ্ধান্তে আসতে গেলে, সেই তত্বকে বিস্তর প্রয়োগ, বিফলতার মধ্যে দিয়ে ঠেকে শেখার মাধ্যমে যে জ্ঞানার্জন পদ্ধতি, তা কি অবলম্বন করা হয়েছে? কখনই না।

লেনিন বলেছিলেন, ‘প্রয়োগ (তত্বগত) জ্ঞানের চেয়েও অনেক বড়, কারণ তার যে শুধু সর্বজনীনতার গুনই আছে তাই নয়, তাতে আছে আশু বাস্তবতার গুনও।’ এই শিক্ষাকেই যদি সামনে রেখে সেই সেই যুক্তিবাদী গোষ্ঠীগুলি তাদের তত্বগত জ্ঞানের আত্মম্ভরিতাকে কাঁটাছেরা করতেন! তাহলে  শুধুই সংস্কৃতি বদলের মধ্যে দিয়েই শোষণহীন সমাজ গড়া সমাজ সম্ভব। এমন হাস্যকর দাবি তারা (যুক্তিবাদীরা) রাখতেননা কখনই। 

অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের বিরুদ্ধে মোটা অংকের আর্থিক চ্যালেঞ্জ দিয়ে যেইসব যুক্তিবাদীরা ছায়ার বিরুদ্ধে মুষ্টিযুদ্ধে জিতে গেছে বলে মনে করে, তাদের কি এতটুকুনিও ধারণা নেই! এই ঈশ্বর বিশ্বাস, অলৌকিকতার অস্তিত্ব সমাজে রয়ে গেছে আর্থিক অনিশ্চয়তা, অসাম্যের কারণে। শ্রেণীচেতনা বোধ নেই বলেই তারা বুঝতে অক্ষম, যে এক শ্রেণীর মানুষের ক্রমবর্ধমান সম্পত্তির কারণেই পড়ে থাকা কয়েক আনা সম্পদ নিয়ে বাকি মানুষগুলো নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরছে। লোভের জন্য অসাম্য নয়, অসাম্যের জন্যই যে লোভের সৃষ্টি, এই সাধারণ জ্ঞানকে বিসর্জন দিয়ে তারা অরণ্যদেব হয়ে চলেছে শোষিত মানুষের রক্ষাকর্তা হতে। এই অসাম্যই যে  বাধ্য করছে সেই সংখ্যাগুরু মানুষকে ঈশ্বর, জ্যোতিষ, বাবাজি-মাতাজিদের খপ্পরে পড়ে নিজের সঞ্চিত সম্পদটুকুনি হারাতে। তাদের (যুক্তিবাদীদের) কর্মসূচি অনুযায়ী যদি একজন বড় মাপের জ্যোতিষী বা কোনও অলৌকিক ক্ষমতাধারীর দাবিদার জেল খাটেও, তাতেও কি এই চেতনা তারা পারবে, সমগ্র শোষিত শ্রেণীর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে? এখানেও তারা অক্ষম, কারণ যুক্তির অহমিকা বোধে তাদের মনে হয় শোষিত সর্বহারা শ্রেণী বড়ই বোকা, সরল। তাদের নিজস্ব কোনও জ্ঞান বুদ্ধি নেই। বরঞ্চ উল্টো দিক থেকে দেখা যাবে, জীবনের প্রত্যেক পদে এই শোষিত লাঞ্ছিত শ্রেণী সে কৃষক, মুটে বা শ্রমিক যেরকম পেশারই হোক না কেন! তারা নিজেদের জ্ঞানকে যতটা প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে জীবন্ত রাখে, সেখানে এই যুক্তিবাদী বন্ধনীতে আবদ্ধ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষগুলি নিজের প্রগতিশীলতার বিলাসিতা প্রদর্শনে সবসময়ই উন্মুখ এবং পরিশ্রম বিমুখও। তাদের ধারণা, একমাত্র যুক্তির আলোর দিশাই শোষিতদের হাজার বছরের বয়ে চলা সংস্কৃতি দুম করে বদলে দেবে। 

আবার এটাও ঠিক, সংস্কৃতিও একটা জামার মতনই মানুষের শরীরে থাকে, সেটা ধরে যতই টানাটানি হোকনা কেন! তাতে মানুষটির পরিবর্তন কিছুই হয়না। কিন্তু এই মোটা রেখার বিষয়টি তাদের মাথায় ঢুকলে তো? 
এই বিষয়ে মাও খুব প্রাঞ্জল ভাবে দেখিয়েছিলেন উৎপাদিকা শক্তি, অনুশীলন, বস্তু, অর্থনৈতিক ভিত্তি, অভ্যন্তরীণ শর্ত ইত্যাদি সাধারণভাবে দ্বন্দ্বের প্রধান দিক হিসেবে থাকে, কিন্তু কোনও কোনও নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে উৎপাদন সম্পর্ক, তত্ব, চেতনা, উপরিকাঠামো, কিংবা বাহ্যিক শর্ত প্রধান ভূমিকায় চলে যেতে পারে এবং নির্ধারক ভূমিকায় চলে যেতে পারে। তিনি দেখাচ্ছেন, যেকোনো নির্দিষ্ট দ্বন্দ্বে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী দিককে সাধারণভাবে সমান হিসেবে দেখা যায় না। কখনো তাদের মধ্যে একটা ভারসাম্য লক্ষ্য করা গেলেও, তা সাময়িক ও আপেক্ষিক মাত্র, অসমতাই মৌলিক। ‘দুটি দ্বন্দ্বমান দিকের মধ্যে একটি দিক অবশ্যই প্রধান, অপরটি গৌণ। যেটি প্রধান দিক সেটি দ্বন্দ্বে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে’, বস্তুর প্রকৃতি সাধারণত নির্ধারিত হয় দ্বন্দ্বের প্রধান দিকের দ্বারা, যে দিকটি কর্তৃত্বের স্থান লাভ করেছে। কিন্তু এই অবস্থাটা স্থাণু নয়, দ্বন্দ্বে প্রধান দিকগুলো একে অপরের রূপান্তরিত হয় এবং তদনুসারে বস্তুর প্রকৃতিও পরিবর্তিত হয়। কেউ কেউ মনে করে, কোনও কোনও দ্বন্দ্বের বেলায় এই নিয়ম খাটে না। যেমন উৎপাদিকা শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে দ্বন্দ্বের উৎপাদিকা শক্তিই হচ্ছে প্রধান দিক। তত্ব ও অনুশীলনের মধ্যকার দ্বন্দ্বে অনুশীলন হচ্ছে প্রধান দিক। অর্থনৈতিক ভিত্তি এবং উপরিকাঠামোর মধ্যকার দ্বন্দ্বে অর্থনৈতিক ভিত্তিই হচ্ছে প্রধান দিক। এবং তাদের পারস্পরিক অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়না। এটা যান্ত্রিক বস্তুবাদীর ধারণা, দ্বান্দিক বস্তুবাদী ধারণা নয়। সত্য বটে, উৎপাদিকা শক্তি অনুশীলন ও অর্থনৈতিক ভিত্তি সাধারণ ভাবে মুখ্য ও নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে। যে এটা অস্বীকার করে সে বস্তুবাদীই নয়। কিন্তু এটাও স্বীকার করতে হবে যে নির্দিষ্ট অবস্থায় উৎপাদন সম্পর্ক, তত্ব, উপরিকাঠামোও পর্যায়ক্রমে মুখ্য ও নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে। (দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে)
তাহলে যুক্তিবাদীদের মতে সেই নির্দিষ্ট অবস্থার সময়সীমা কতটা? যার ফলে এমনও দাবি তারা করে বসেন যে, উপরিকাঠামো পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে মূল কাঠামোকে পরিবর্তন করা সম্ভব। এবং তার প্রয়োগ কি? নিজেদেরই কি জানা আছে এর উত্তর! 

এই যুক্তিবাদী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে একটা বিষয়ের খুবই মিল পাওয়া যায়, সেটা হল ব্যক্তিকেন্দ্রিক নির্ভরতা। নেতাই সব, নেতাই ঠিক, নেতাই একমেব দ্বিতীয়ম। জানিনা এরা আদৌ মার্ক্সবাদকে সঠিক ভাবে আত্মস্থ করতে পেরেছে কিনা! উলটে আবার যুক্তিবাদীদের এও বলতে শোনা যায় যে, মার্ক্সবাদ সামগ্রিক দর্শন নয়? তা দিয়ে নাকি সবকিছুকে বিচার করা যায়না।

এখানেও ‘মাও গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা, সমালোচনা ও আত্ম-সমালোচনা’ প্রসঙ্গ সম্বন্ধে যা বলছেন, তা অবশ্যই শিক্ষণীয়। মাও দেখাচ্ছেন, গণতন্ত্র ও কেন্দ্রিকতার প্রশ্নে সর্বহারা দৃষ্টিভঙ্গি হল- প্রশস্থ গণতন্ত্রের উপর দাঁড়িয়ে কেন্দ্রিকতা। পার্টি কমিটিগুলো সর্বস্তরে নেতৃত্বের কেন্দ্রিকতাকে অনুশীলন করে, কিন্তু সেই নেতৃত্ব হল যৌথ নেতৃত্ব। সর্বহারাশ্রেণী মনে করে, গণতন্ত্র বাদ দিয়ে কেন্দ্রিকতাকে সঠিকভাবে অনুশীলন করা যায় না। কারণ, সঠিক চিন্তার ঐক্য, যা কিনা সঠিকভাবে কেন্দ্রিকতাকে অনুশীলনের ভিত্তি, তা তৈরি হয় পার্টির ভেতরের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে। গণতন্ত্র বাদ দিয়ে কেন্দ্রিকতা হয়ে পড়ে ভুয়ো, শূন্যগর্ভ এবং বেঠিক। কেন্দ্রিকতা সঠিক ভাবে প্রয়োগ হতে পারে, যদি তাতে সঠিক ধারণার সমন্বয় থাকে। যদি নীতি, পরিকল্পনা, কৌশল, লাইন ও পদ্ধতির ক্ষেত্রে সঠিক বোঝাপড়ার ঐক্য থাকে- একমাত্র তাহলেই কেন্দ্রিকতা সঠিকভাবে অনুশীলিত হয়। কিন্তু গণতন্ত্রের পূর্ণ অনুশীলন ছাড়া, ধারণা তথা বোঝাপড়ার সঠিকতা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আবার এটাও ঠিক যে, কমিউনিস্টরা অবাধ গণতন্ত্র তথা উগ্র গণতন্ত্রের বিরোধী। কেন্দ্রিকতা ছাড়া গণতন্ত্র সুরক্ষিতও থাকতে পারে না। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রতিটি নেতৃত্বকারী সদস্যকে অবশ্যই আন্তঃপার্টি গণতন্ত্রকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং জনগণকে বলার অধিকার দিতে হবে’।

মাও-এর এই কথাগুলি যুক্তিবাদীরা বিপ্লবী মানসিকতা না রেখেও শুধুই যদি সাধারণ পাঠক হিসেবেই পড়েন। বুঝবেন, একটা দল বা সংগঠনে গণতন্ত্রের পরিবেশ কতটা আবশ্যিক। 

চলমান সমাজের যে শোষণ ব্যবস্থা, তাকে যদি একটি ক্যানসার রুগির সাথে তুলনা করা যায়, তাহলে তার মূল কারণ হতে পারে অর্থনৈতিক বৈষম্য বা অসাম্য। এবং সেই ক্যানসার রোগের সাইডএফেক্ট হিসেবে দেখা দেবে সংস্কৃতির পচনশীল দিকের অন্ধ কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস, অলৌকিকত্বের রমরমা, জ্যোতিষচর্চা ইত্যাদি। যুক্তিবাদীরা কিন্তু এই সাইড এফেক্টকেই প্রধান শত্রু হিসেবে ধরে বসে আছে, তাদের ধারণা নেই যে উপরিকাঠামো গত এফেক্ট রূপ বদলায় মেইন এফেক্ট বা কাঠামোকে কেন্দ্র করে। এতে প্রকৃতপক্ষে লাভ হয় মূলত পুঁজিপতি শ্রেণীর। তারা জানে, মানুষ যতদিন না তাদের চরিত্র ঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারছে, প্রতিলিপি তৈরি করে নিজেরা ঠিক বেঁচে যাবে, এবং দিনের পর দিন তাদের শোষণপদ্ধতি আরও কঠোর হবে। এই কারণে বলাই যায়, জ্ঞানের একটি নির্দিষ্ট স্তর অব্ধি এই দর্শনকে প্রগতিশীল মনে হলেও, আদতে তা ইউটোপীয়। 

জ্ঞান ও প্রয়োগ সম্বন্ধে মাও কি বলছেন তা আরেকবার দেখে নেওয়া যাক।
 আপনি যদি কোনও একটি বস্তু বা বস্তুশ্রেণীকে প্রত্যক্ষভাবে জানতে চান, তবে বাস্তবকে পরিবর্তন করার, সেই বস্তু অথবা বস্তুশ্রেণীকে পরিবর্তন করার বাস্তব সংগ্রামে আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে অংশ গ্রহণ করতে হবে, কারণ কেবল এইভাবেই আপনি সেই বস্তু বা বস্তুশ্রেণীর বাহ্যরূপের সংস্পর্শে আসতে পারেন ; এবং বাস্তবকে পরিবর্তন করার বাস্তব সংগ্রামে ব্যক্তিগত অংশ গ্রহণের মাধ্যমেই কেবল আপনি সেই বস্তু বা বস্তুশ্রেণীর সারমর্মকে অনাবৃত করতে বা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন। আসলে প্রত্যেক মানুষই জ্ঞানলাভের জন্য এই পথেই চলে, যদিও কিছু লোক ঘটনাকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত ক'রে বিপরীত তর্ক করে।

দুনিয়ার সবচেয়ে উপহাসাস্পদ ব্যক্তি হচ্ছে সেই "সবজান্তা" যে জনশ্রুতি থেকে ভাসা ভাসা জ্ঞান সংগ্রহ ক'রে নিজেকে "দুনিয়ার পয়লা নম্বরের জ্ঞানী" বলে জাহির করে ; এতে শুধু এটাই প্রমাণিত হয় যে, নিজের সম্পর্কে তার যথাযথ ধারণা নেই। জ্ঞান হচ্ছে বিজ্ঞানের ব্যাপার, এ ব্যাপারে কোনরকম কপটতা কিংবা অহমিকার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে না ; যা দরকার তা ঠিক এর বিপরীত --- অর্থাৎ সততা ও বিনয়। যদি আপনি জ্ঞানার্জন করতে চান তা'হলে বাস্তবকে পরিবর্তন করার অনুশীলনে আপনাকে অবশ্যই অংশ গ্রহণ করতে হবে। যদি আপনি নাশপাতিটার স্বাদ জানতে চান, তবে আপনাকে অবশ্যই খেয়ে নাশপাতিটার বাস্তব রূপের পরিবর্তন করতে হবে। যদি আপনি পরমাণুর গঠন ও গুণাগুণ সম্পর্কে জানতে চান, তাহলে পরমাণুটির অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর জন্য পদার্থবিজ্ঞানের ও রাসায়নিক পরীক্ষা- নিরীক্ষা করতেই হবে। যদি আপনি বিপ্লবের তত্ত্ব ও পদ্ধতি জানতে চান তা'হলে আপনাকে অবশ্যই বিপ্লবে অংশ গ্রহণ করতে হবে।
মস্ত জ্ঞানের উৎস হচ্ছে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। কিন্তু একজনের পক্ষে সবকিছুর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করা সম্ভব নয় ; বাস্তবিকপক্ষে, আমাদের জ্ঞানের অধিকাংশই আসে পরোক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে, যেমন, প্রাচীন কালের ও বিদেশের সকল জ্ঞান। আমাদের পূর্বপুরুষ এবং বিদেশীদের কাছে এই জ্ঞান ছিল --- বা এখনও --- প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিষয়। তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সময় এই জ্ঞান যদি লেনিনের উল্লিখিত "বিজ্ঞানসম্মত বিমূর্তকরণের" শর্ত পূরণ এবং বিষয়মুখী বাস্তবকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রতিফলিত করে, তাহলে এই জ্ঞান নির্ভরযোগ্য ; অন্যথায় নয়। সুতরাং একজন মানুষের জ্ঞান কেবল দু'টি অংশ নিয়ে গঠিত, একটি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আসে, আরেকটি পরোক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে। অধিকন্তু, যেটা আমার কাছে পরোক্ষ অভিজ্ঞতা, অন্য লোকের কাছে সেটা  প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। অতএব, সমগ্রভাবে বিচার করলে, যে কোনও ধরনের জ্ঞানই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে অবিচ্ছেদ্য। মানুষের দৈহিক ইন্দ্রিয়গুলির দ্বারা বিষয়মুখী বহির্জগতকে  অনুভব করার মধ্যেই সকল জ্ঞানের উৎপত্তি। যে ব্যক্তি এরূপ ইন্দ্রিয়-অনুভূতিকে অস্বীকার করে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করে, অথবা বাস্তবকে পরিবর্তন করার অনুশীলনে ব্যক্তিগত অংশগ্রহণকে অস্বীকার করে, সে বস্তুবাদী নয়। এই কারণেই, "সবজান্তা" ব্যক্তি উপহাসাস্পদ। একটা পুরনো চিনা প্রবাদ আছে : "বাঘের গুহায় না ঢুকে কি বাঘের বাচ্চা ধরা যায় ?" কথাটা মানুষের অনুশীলনের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনই সত্য জ্ঞানতত্ত্বের ক্ষেত্রেও। অনুশীলন থেকে বিচ্ছিন্ন জ্ঞান অসম্ভব।(মাও-সে-তুং রচনাবলী)

শেষমেশ এটাই বলা যায়, যতক্ষণ না যুক্তিবাদ দ্বন্দ্বের পথ অবলম্বন করে দ্বান্দিক বস্তুবাদের স্তরে উন্নত হচ্ছে, ততক্ষণ সেই দর্শন ভাববাদের কানাগলিতে ঘুরে বেড়াতে বাধ্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ