পর্ব- সাম্প্রদায়িক বীজবপনের সংক্ষিপ্তনামা..!।। চার্বাকী...!


সময় এগুচ্ছে, সামনে চলাই তার ধর্ম, সে চলার পথে কখনোই ভুলেনা তার অতীত; আমরাও চলছি, কিন্তু এগুচ্ছি আমরা কতটা? আমাদের নতুন প্রজন্মকে কি শেখাচ্ছি আমরা! আমরা প্রায়শই ভেবে থাকি- ভালো বিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি, একদিন ভালো কাজ করবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে; আরো বেশি ভাবলে ভাবি দশজনের একজন হবে; কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা কি আসলেই তাই, আমরা হয়তো ভুলে গেছি;

আমাদের নিজেদের মধ্যকার সুপ্ত গুণাবলীর বিকাশই শিক্ষা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে আমরা বিদ্যা অর্জন করি, আর তা আমাদের সাহায্য করে নিজের ভিতরের গুণাবলীকে চিনতে। একটি মজার ঘটনা দিয়ে প্রকৃত শিক্ষাকে একটু দেখাতে চেষ্টা করি- আমার এক বন্ধু আমাকে বলেছিলো- তাঁর এক শিক্ষার্থী খুব মেধাবী, পাশাপাশি ধার্মিকও; তা একদিন জিজ্ঞেস করলো যে 'সরস্বতী দেবী'কে বিদ্যার দেবী বলে তুমি পূজাদি করো, সাথে দেখি একটি হাঁসও থাকে, সেটিরও কেন পূজা কর? শিক্ষার্থী পুরো বাসায় এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য হন্যে হয়ে একদিন পর বললো- স্যার কেউ উত্তর পারেনা, বললো তোর স্যারতো ধর্ম-টর্ম করেনা তাই উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করে; তখন আমার বন্ধু বললো- তুমি বাসার সবাইকে ডেকে নিয়ে এসো, কথা বলবো; এ কথা শুনে স্বভাবতই অভিভাবকগণ কিছুটা বিব্রত, তারপরও আসলো; বন্ধু বললো- সরস্বতীর বাহন যে হাঁস তা কিন্তু শ্বেত রাজহংস, রাজহংসী নয়; শ্বেত বা সাদা রং কে শুদ্ধতার প্রতীকরূপেই গণ্য করা হয়, যদিও সনাতনী সংস্কৃতিতে বিভিন্ন রংয়ের আলাদা গুরত্ব রয়েছে; এরপর বলতে থাকলো- হাঁসকে লক্ষ্য করবেন যখন সে কাদাজল ঘেটে খাবার সংগ্রহ করে তখন কিন্তু সে শুধু খাদ্যটাকেই খায়, কাদাজল নয়; আর সাধারনত পালকগুলো জলে ভেজেনা কারণ এটি কিছুটা আমাদের ব্যবহৃত প্লাস্টিক টাইপ( জৈব পলিমার বললে কেউ কিছুই বুঝতো না, তাই এড়িয়ে গেলো!); তাই পুকুর জল থেকে উঠে আসলে সে পরিষ্কারই থাকে; এতোগুলো কথা বললাম এজন্য যে- এখানে রাজহংসকে একটি উদাহরণ বলতে পারেন, সে যেমন তার পরিশ্রম ও কৌশলে কাদাজল ঘেটে খাদ্য সংগ্রহ করে, নিজেও পরিষ্কার থাকে, বিদ্যাও তেমনও পরিশ্রম করে শুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করতে হয়, যা ভালোমন্দের মাঝ হতে ভালোটা গ্রহণের ক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করে, অর্থাৎ যাচাই করার সামর্থ্য অর্জিত হয়; তাহলে বুঝতেই পাচ্ছি প্রকৃত শিক্ষা কেমন হতে পারে;

কোথাও পড়েছিলাম- "Coins always make sounds, but paper moneys are always silent. So when your value increases keep yourself silent and humble."; অর্থাৎ  যখন তোমার ভিতরের গুণাবলী যত জ্ঞানেগুণে সমৃদ্ধ হবে তোমার বিনয়ও বাড়বে তত বেশি। বোধকরি গুরুদেব হয়তো শিক্ষার প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করতে পেরেছিল, তাই তাঁর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামকরণের মাধ্যমেই তাঁর চর্চা করে গিয়েছিলেন; তাই শান্তিনিকেতন-এ গেলে আমরা দেখতে পাই- শিশুভবন, পাঠভবন, বিদ্যাভবন এবং সর্বশেষ বিনয়ভবন; অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্দেশ্য ছিল শিশুকাল থেকে পাঠ নিয়ে একজন শিক্ষার্থী সর্বশেষ হয়ে উঠবে বিনয়ী।

প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রভাব মানব সমাজে ৬হাজার বছরে রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাঁর শেকড়বাকড় ছড়িয়ে রয়েছে, আর তাঁর নেতিবাচক ফলাফল আমরা বর্তমান সময়ে গড়ে উঠা ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ ও তার উগ্র প্রতিফলন লক্ষ্যণীয়; ঐতিহাসিক চর্চা রয়েছে ইংরেজরা ভারতবর্ষ ত্যাগের করার সাথে সাম্প্রদায়িকতার বীজবপন করে রেখে গিয়েছিলো, সে নিয়ে অন্য একসময় লিখবো; সেই সাম্প্রদায়িক ফলাফল আমাদের ভারত ও বাংলাদেশে কতটা চরমে তা দৃশ্যমান; বাংলাদেশে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক ৩য় শ্রেণি হতে বাধ্যতামূলক ধর্মশিক্ষা বই পাঠ্য করা হয়েছে, তার সাথে সংযোজিত হয়েছে নৈতিক শিক্ষা; মজার বিষয় হচ্ছে ভারতে এরকম বাধ্যতামূলক ধর্মশিক্ষা পাঠ্যবই করা হয়নি, তা ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে পাঠ্য; এ নিয়ে আমার ছোটবেলার একটি ছোট্ট ঘটনা বলি- আমি সেই ঐচ্ছিক বিষয় নিয়ে পড়েছিলাম, কারণ এটি সাধারণত ছুটিরদিনে পড়ানো হতো, পরীক্ষাও হতো; প্রশ্ন এসেছিলো- ধর্ম কি? উত্তরে লিখেছিলাম- যা পড়লে খাবার পাওয়া যায়; লক্ষ্য কি? উত্তর ছিলো- পাউরুটি ও কলা; ঘটনাটি হচ্ছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঐচ্ছিক বিষয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ঐ দিনগুলিতে পাউরুটি ও কলা দিয়ে আপ্যায়ন করতো যেহেতু বাড়তি একটি বিষয় পড়া হচ্ছিলো, আর আমার খেতে ভালোই লাগতো; এখন মূলঘটনায় চোখ ফেরাই- যে বয়সে একটি শিশুমন নিজের ভালোমন্দ বোঝার সামর্থ্য রাখেনা সে বয়সে তাদের মাঝে যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করা হচ্ছে, সবগুলো সবাই পড়তে পাচ্ছে কিন্তু ঐ একটি বই যখন আলাদাভাবে শ্রেণিকক্ষগুলোতে নেয়া হয় শিশুমন নিশ্চয় এ বিষয়ে দ্বিধান্বিত হয়, আর এ জায়গাতে ও প্রথম ভাবতে শিখে ও আর আমি এই ধর্মের জায়গায় আলাদা; আরো যখন সেখানো হয়- আমার প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অনুসারীরাই স্বর্গীয় সুখ পাবে, বাকিরা সব জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে, এমন অনেক ভাবনা সেই শিশুমনে প্রবেশ করানো হয় তার কাছ থেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ প্রত্যাশা করা নিশ্চয় দুঃসাধ্য; যেখানে ভারতে কথিত ধর্মনিরপেক্ষতার ফলে হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মশিক্ষা বিষয়টি এখনো বাধ্যতামূলক করতে পারেনি তারপরেও যে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হচ্ছে, তাতেই রাষ্ট্রযন্ত্র সর্বদা তটস্থ হয়ে রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশে তো অনুমোদিত সাম্প্রদায়িকতা সেখানো হচ্ছে, সেখানে ধর্মানুভূতি প্রবলতর হওয়াতো স্বাভাবিকতা, আর রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা থাকলে তো কথাই নেই, যেমনটা ভারতে হচ্ছে, তবে বিচ্ছিন্নভাবে ক্ষুদ্র পরিসরে; 

ধর্ম যদি নৈতিক শিক্ষা দিতো তাহলে মাদ্রাসা শিক্ষক ধর্ষক, বলাৎকারী হয় কি করে? প্রশ্ন আসতেই পারে তাহলে যারা মাদ্রাসায় পড়েনি তারা কি সবাই ভালো? অবশ্যই না, তাহলে গলদ তা কোথায়? আমরা যদি বহির্বিশ্বে উন্নত রাষ্ট্র গুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি তাহলে সহজে উপলব্ধ হয় যে সেখানে ধর্মীয় শিক্ষা কখনোই নৈতিকতা শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে ছিলোনা, যার দরুন সুখী রাষ্ট্র হিসেবে যে কয়টি দেশের নাম গণ্য হয় তন্মধ্যে বেশিরভাগ পশ্চিমা বিশ্ব, সেটা কেউ মানুক বা না মানুক কিচ্ছু যায় আসেনা, অপরাধ ও দুর্নীতি সেখানে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় রয়েছে, এখানে কাল্পনিক সত্ত্বার অস্তিত্ব বা কোন প্রাচীন কিতাব/গ্রন্থ সেখানকার সামাজিক পরিস্থিতির পরিবর্তনে ন্যূনতম ভূমিকাও রাখেনি; কারণ নৈতিকতা কখনোই ধর্মের আনুগত্যে নিয়ন্ত্রিত নয়, এমনকি আস্তিক/নাস্তিক হওয়ার উপরও নির্ভর করেনা; একটি মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠনে ঐ দেশের আর্থসামাজিক প্রক্ষাপট আর সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশের উপর নির্ভর করে, যা তত্ত্ব ও তথ্যগত প্রমাণিত স্বতঃসিদ্ধ; প্রখ্যাত দার্শনিক ও মনোবিদ ড. শারমার লিখেছিলেন- "Do unto others, as you would have them do unto you"; অর্থাৎ- অন্যদের প্রতি সেরকম ব্যবহারই করো যা তুমি তাদের থেকে পেতে চাও; গুরুদেবের কথার যথার্থতা এখানেই প্রতিফলন ঘটছে- প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে বিনয়ী করে, যা তাঁর চরিত্রের নৈতিকতার ভিত্তিমূল গড়ে তোলে;

যারা ধর্ম ধর্ম করে মাতামাতি করে তারা ধর্মকে যতটুকু না মানে, তার থেকে বেশি মানে ধর্মান্ধতাকে; আরো মজার বিষয় হচ্ছে- বেশিরভাগ মানুষ শুনেশুনে ধর্মচর্চা করতে অভ্যস্ত, পড়ে জানার সুযোগ কোথায়; যেখানে বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করতে দিন ফুরিয়ে কখন রাত হয় বোঝার সুযোগ থাকেনা, সেখানে অত যাচাই করার সুযোগ কোথায়; আর মৌলবাদী ধর্মান্ধগোষ্ঠি সে সুযোগকে কাজে লাগায়; ঐতিহাসিক সত্যতা হচ্ছে- ধর্মগ্রন্থগুলোয় বর্ণিত কাল্পনিক সর্বশক্তিমান সত্ত্বা যতটা না মানবতাকে ভয়ঙ্করতম পরিস্থিতিতে ফেলেছে, বরং তার থেকে দূর্গতি ও যুদ্ধবিগ্রহ সৃষ্টিতে এসব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রবর্তক ও প্রচারকেরাই প্রধানতম কারণ; আর এখন হচ্ছে সে সকল আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার কাজে লিপ্ত মৌলবাদী রক্ষাকর্তারা কারণ; আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে ধর্মান্ধতাকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলসূত্রে পরিণত হয়েছে; আসলে মৌলবাদী ধর্মান্ধরাই রাষ্ট্রনেতাদের চালিকা শক্তি, একার্থে তারাই রাষ্ট্রের নেতা; যখন মন্ত্রিসভা গঠন হয় বা রাষ্ট্র গঠন হয় তখন তারা এদের মধ্যে ধর্মান্ধগোষ্ঠীর কাঠপুতুল নেতাগুলোকে ঢুকিয়ে দেয়; এদের মাঝেই থাকে সন্ত্রাসবাদী, যারা ধর্মের নামে সন্ত্রাস পরিচালনা করে, আর রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায়। ফলে তখন রাষ্ট্রের বাকী মন্ত্রিরাও হয়ে ওঠে কাঠপুতুল, তারা নির্বাচিত হয় দেশের আইন মেনে কিন্তু পরে তারাই আইন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা সবকিছুই টাকাপয়সা বা ভয় দেখিয়ে দখল করে নেয়, নিতে বাধ্য হয়;

কোন দেশের রাষ্ট্রধর্ম থাকলেও সংবিধানে ভিন্ন ধর্মকে দ্বিতীয় শ্রেনির ধর্ম বলেনা। অথচ যে এইভাবে নির্বাচিত হল সে রাষ্ট্রনেতা, মুখে সে সাংবিধানিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখছে অথচ মুখোশের আড়ালে থেকে তারই বিপরীত কাজ করছে; তা না করলে তাকে যারা ঢুকিয়েছে সেই সন্ত্রাসবাদীরা জীবননাশের ভয় দেখাবে, এমন কি তাদের শর্ত না মানলে পুরো মন্ত্রিসভা পাল্টে সরকার পরিবর্তনের ডাক আসতে পারে; আদর্শ নেতার, একটি রাষ্ট্রের লড়াই থাকবে অসাম্যের বিরুদ্ধে, আমাদেরকে চিনতে হবে নির্বাচনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেই ছদ্মবেশী অর্থনৈতিক সুবিধাভোগী ব্যবহারকারীদের;

আমরা জানি যে, লোহাকে লোহার আঘাত সইতে হবে বলেই আমরা উপযোগিতা পাই, গাছকে কাটলে গাছের কষ্ট হয়, কিন্তু সেই কাঠেই কিন্তু আমরা ঘর বানাই, আবার বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন, খাদ্য সংগ্রহের জন্য অর্থের প্রয়োজন, আর অর্থের জন্য আমরা শত কষ্টে পরিশ্রম করে সেটা অর্জন করি; ছুড়ি কর্তনের জ্ঞান দেয়, আগুন দহনের জ্ঞান, আর মানুষের অর্জিত প্রকৃত শিক্ষা তাকে মনুষ্যত্বের জ্ঞান দেয়; আমাদের শিক্ষাই পারে আমাদেরকে প্রকৃত ধর্মকে চিনিয়ে দিতে, প্রকৃত শিক্ষাই যদি ধর্ম হয়, তা যদি জীবনে গ্রহণ করি তাহলে ন্যায়নিষ্ঠা বিনয়াবনতার মাধ্যমে আমরা সবাই এক অভিন্ন সমাজকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার পথে এগোতে একে অপরকে সাহায্য করতে পারবো, সেই হবে আমাদের প্রকৃত শিক্ষার অর্জন...!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ