মানবতার অপমৃত্যু।। সব্যসাচী সরকার



   বিচ্ছিন্নতার জালে জড়ানো রোহিঙ্গা!

রোহিঙ্গা নিয়ে কথা বলা নেহাত মুশকিলই নয়, বলতে পারেন ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনাই অনেক বেড়ে গেছে; প্রশ্ন হতে পারে কেন? এই কেন'র উত্তর দেয়া একটু কঠিনই লাগছে তবু বলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি; তার আগে বলে নিই এটি কোন মৌলিক লেখা বলবোনা, শুধু বলবো ছড়িয়ে থাকা কিছু তথ্যের সংযোজন ও বিস্তারণ; তার আগে মায়ানমার ও আরাকান সম্পর্কিত কিছু তথ্য জেনে নিই-


মায়ানমার দেশটি মূল মায়ানমার অঞ্চল এবং আরও ৭টি রাজ্য নিয়ে গঠিত; এগুলি হল- চিন, কাচিন, কারেন, মন, আরাকান(রাখাইন) এবং শান; আর মূল মায়ানমার ৭টি বিভাগে বিভক্ত-ইরাবতী, মাগোয়ে, ম্যান্ডালে, পেগু, রেংগুন, সাগাইং এবং তেনাসসেরিম।

মায়ানমার ৬৭৮,৫০০বর্গকিমি এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এবং এর রাজধানী- নেপিদ;
ভৌগলিক অবস্থান- পশ্চিমে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগ ও ভারতের মিজোরাম;
উত্তর-পশ্চিমে ভারতের আসাম, নাগাল্যান্ড ও মণিপুর;
উত্তর-পূর্বাংশে ২,১৮৫ কিমি জুড়ে আছে তিব্বত ও চীনের ইউনান প্রদেশ;
দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে লাওস ও থাইল্যান্ড;
দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর;
আন্দামান সাগরের সাথে মায়ানমারের ১,৯৩০ কিমি উপকূল রেখা রয়েছে;
জনসংখ্যা- ৬,০০,৭৭,৬৮৯জন(২০১৫/জুলাই);

আরাকান রাজ্য (রাখাইন রাজ্য) মায়ানমারের একটি প্রদেশ, যার আয়তন ৩৬৭৭৮বর্গকিমি, যা মায়ানমারের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত; এর রাজধানী- সিত্তে;
ভৌগলিক অবস্থান- উত্তরে চীন;
পূর্বে ম্যাগওয়ে, ব্যাগো ও আয়েইয়ারওয়াদি অঞ্চল;
পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর;
উত্তর-পশ্চিমে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগ;
জনসংখ্যা- ৩১,১৮,৯৬৩জন(২০১৪);

আরাকান ইয়োমা পর্বতমালাটি মায়ানমার ও ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে একটি প্রাচীরের সৃষ্টি করেছে; এর পর্বতগুলির উচ্চতা প্রধানত ৯১৫ মিটার থেকে ১,৫২৫ মিটার পর্যন্ত হয়; আরাকান পর্বত, যার সর্বোচ্চ চূড়া ভিক্টোরিয়া শৃঙ্গের উচ্চতা ৩,০৬৩ মিটার (১০,০৪৯ ফু),  যা আরাকান প্রদেশকে মূল বার্মা থেকে পৃথক করে রেখেছে। এ প্রদেশে চেদুবা ও মাইঙ্গান দ্বীপের মত বড় কিছু দ্বীপ আছে;

ভৌগলিক অবস্থানই বর্তমান সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু, কিভাবে তার তথ্য সংযোজন করছি-

১৯৪৯ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত চীনের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক ছিল মায়ানমারের; মায়ানমারের অভ্যন্তরে বিদ্রোহী কমিউনিস্ট পার্টি অব বার্মা (সিপিবি)-এর মূল পৃষ্ঠপোষক ছিল চীন; ১৯৭৮ সালে চীনা নেতা দেং জিয়াও পেং মায়ানমার সফরে আসেন এবং ১৯৮৬ তে সিপিবির ওপর থেকে সম্পূর্ণ সমর্থন তুলে নেয় চীন; বৈরী সম্পর্ক দারুণভাবে সহযোগিতার দিকে নতুন মোড় নেয়; তারা তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগসহ বাণিজ্যিক সুবিধা পায়; এ সময় চীন সামরিকভাবে মায়ানমারকে সহায়তা করতে থাকে; ১৯৮৯ সালে মায়ানমার চীন হতে ১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করে; ভারতের ওপর ভূরাজনৈতিক কৌশলগত সুবিধা বাড়াতে মায়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয় চীনের; মায়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিগত বিদ্রোহ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমনে মায়ানমারকে বহুমুখী সাহায্যের হাত খুলে দেয় চীন; চীনের সমর্থন মায়ানমারের সামরিক জান্তাকে অধিকতর শক্তিশালী করে; তারা এই সুযোগকে ব্যবহার করে দেশের মধ্যে যেমন তাদের ক্ষমতা বাড়ায়, তেমনি একটি শক্তিশালী সমরশক্তির দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে চীনের সর্বোচ্চ সহায়তা পেতে থাকে;


১৯৮২সাল হতে রোহিঙ্গা সমস্যা চরমে উঠেছে; বহির্বিশ্ব এ নিয়ে যতটা না মাথা ঘামিয়েছে সমাধানের জন্য, তার চেয়ে বেশি রাজনীতি আর দখলদারিত্বের চর্চাই বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে; যখনই মায়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিক সকল অধিকার হরণ করে তাদের বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনটুকু কেড়ে নিচ্ছিলো তখন জাতিসংঘ বা মুসলিমবিশ্ব কতটা আর, কি ভূমিকা রেখেছে তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ; আজ যখন জাতিবিদ্বেষ চরমে, অধিকার আদায়ের জন্য অস্ত্রের সহযোগিতা নিতে হচ্ছে, তখনই রোহিঙ্গাদের পুশইন করছে মায়ানমার সামরিক সরকার, বলতে পারি বাধ্য করছে; প্রাসঙ্গিকতার স্বার্থেই বলি- আমি এবার বান্দরবন কেওক্রাডং পর্বতশৃঙ্গ ভ্রমণকালীন সময়ে কেওক্রাডং-এর ভূমি মালিক লালা ও ওখানকার সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তার সাথে আলাপকালে জানা যায় যে- আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি স্বপ্নের বীজ রোপণ করা হয়েছে আর তা হচ্ছে- আরাকান ও পার্বত্যচট্টগ্রাম মিলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, যা ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ পুরো অঞ্চল জুড়ে; রোহিঙ্গারা যখন প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছিলো, বঞ্চিত হচ্ছিলো আধুনিক সকল সুযোগসুবিধা হতে, তখনই জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো তাদের আর্থিক সুবিধাদি প্রদান এবং মায়ানমার হতে আরাকানকে পৃথক করার জিহাদী কার্যক্রমে লিপ্ত হয়; তাদের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণের উত্তম ক্ষেত্র হচ্ছে মাদকদ্রব্য ও অস্ত্র চোরাচালান; লালা'র কাছে জানতে পারি যে, মায়ানমারে মাদকদ্রব্য সংশ্লিষ্ট আইনকানুন যথেষ্ট কড়া; এরজন্য ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদন্ডের ঘটনাও আছে, আর জেল জরিমানা, নির্যাতন সইতে হবে যদি কারো কাছে মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়; তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে- ইয়াবা'র মতো মাদকদ্রব্য কিভাবে প্রস্তুত হয় সেখানে? এ প্রশ্নের উত্তরে লালা জানায় যে- আরাকান পর্বত মূল মায়ানমার হতে এদের পৃথক রেখেছে, আর তাছাড়া রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার হরণের পর তাদের উন্নয়নে সামরিক সরকার তেমন কোন ব্যবস্থাও নেয়নি, যার ফলশ্রুতিতে প্রত্যন্তপর্বত অঞ্চলগুলো সামরিক বাহিনীর নজরদারী সেরকমভাবে ছিলোনা, আর এ সুযোগে আরাকানের দ্বীপসমূহ ও গভীর পার্বত্যভূমি হয়ে উঠেছিলো মাদকদ্রব্য প্রস্তুত ও সরবরাহের উত্তম স্থান; আর আন্তর্জাতিক রুট হিসেবে বাংলাদেশ ছিলো নিরাপদ মাধ্যম; সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা আমাদের জানায়- কেওক্রাডং-এর নিকটতম পাসিং পাড়ায় অনেক রোহিঙ্গা দীর্ঘসময় যাবত বসবাস করে আসছে, যাদের যাবতীয় সুযোগসুবিধা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বহন করছে, অথচ এতো কিছুর পরও হেন অপকর্ম নেই যে এরা সুযোগ পেলে করেনা; এদের এ অপকর্মের সাথে বেশিরভাগ সময় সংযুক্তি পাওয়া যায় স্যাটেলার পাহাড়ি বাঙালী গোষ্ঠীর, যারা এদের মাধ্যমে সকল অপতৎপড়তা চালাচ্ছে; আমাদের সেনাবাহিনী ও বিজেবি যথেষ্ট সজাগ থাকার কারণে এখনো অনেক ভয়াবহ ঘটনা ঘটেনি;

আজ মায়ানমারে যে জাতিনিধনে সামরিক জান্তা নেমেছে তার জন্য আজ মানবতা লজ্জিত, কিন্তু আজ রোহিঙ্গাদের জঙ্গি আখ্যায়িত হওয়ার জন্য এর চারপাশে অবস্থানরত প্রতিটি দেশকে দায়ী করলে নেহাত ভুল হবেনা; আমি লেখার শুরুতে ভৌগলিক অবস্থান দেখিয়েছিলাম, আর জনসংখ্যার সম্ভাব্য হিসেব দেখিয়েছিলাম; এত বিশাল আয়তনের দেশে এ মানুষগুলোর স্থান না দেয়ার যে অপচেষ্টা মায়ানমার সরকার চালিয়েছে তার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের চাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে; আজ ওদের বাঙালি বলে দেশ ছাড়া করার মানে একটি জাতিকে হেয় করা, তাদের উদ্বাস্তু বানিয়ে অপরাধের জগতকে সম্প্রসারিত করার সুযোগ করে দেয়া;

আর বাংলাদেশে রাজনৈতিকদের গল্প বলি- আরো কিছু পাহাড়ীর সাথে যখন কথা হয় তারা জানায়- রোহিঙ্গা প্রবেশ আজ থেকে নয়, বহুপূর্ব থেকে প্রবেশ চলছে, ধীরলয়ে হওয়ার জন্য চোখে পড়েনি; চট্টগ্রাম শহরসহ বিভিন্ন জায়গায় এরা আগে হতেই বসতি স্থাপনের চেষ্টা করছে, করেছে; আর এদের সহায়তা করছে স্যাটেলার বাঙালিরা; তারা এদের জন্মনিবন্ধন করে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান করছে, তাদের সামর্থ্যানুযায়ী ভোটার বৃদ্ধির জন্য এ কাজ করে যাচ্ছে; যেহেতু রোহিঙ্গাদের আচারব্যবহারে পৃথক করে বোঝার সুযোগ কম, তাই তারা সহজে ছড়িয়ে পড়েছে; আমরা জানি যে, এরা শিক্ষা, সংস্কৃতিতে এমনভাবে বড় হয়েছে যে তারা যথেষ্ট উগ্র মেজাজী, তাদের বেশিরভাগ পুরুষ জঙ্গিবাদী বা মাদকদ্রব্য ব্যবসার সাথে জড়িত; এর কারণও রয়েছে, সেখানে তাদের ন্যূনতম মূল্যে কাজ করতে হতো, বিনা প্রতিবাদে; কথায় বলে- অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়; এদের ক্ষেত্রেও ভিন্ন কিছু নয়, এরাও সহজেই সেই জিহাদীদের সহজ ব্রেনওয়াশের শিকার হয়েছে, জড়িয়েছে চরম অপরাধের সাথে, আক্রমণ করেছে বারবার মায়ানমার ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপর; গঠন করেছে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী; যারা এখনো তৎপর, ভয়ের বিষয় এরা যদি শরণার্থী বেশে বাংলাদেশে ঢুকে, তবে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবেনা কে বলতে পারে; আমাদের দেশে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ হুজুগে মাতাল, তারা মানুষ হত্যার বিচার চাওয়ার সাথে নিজেরাই শাস্তি নির্ধারন করে ফেলে; আমাদের দেশের কোন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এ যাবত কোন সংখ্যাগুরুর সাথে ঝামেলায় জড়িয়েছে কিনা তা সন্দেহ, অথচ বারবার কোনদেশে কিছু হলে প্রথমেই কোপানলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়; তখন মানবতা কোথায় ছিলো যখন নিজের দেশের সংখ্যালঘু নির্যাতিত, ধর্ষিত, দেশত্যাগী হয়েছিলো; কিছু নিকৃষ্ট জীব যারা রোহিঙ্গা সমস্যা কে আমাদের ১৯৭১'র স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়কার ঘটনার সাথে তুলনীয় মনে করে; তাদেরকে সত্যি আমার মানুষ ভাবতে লজ্জা লাগে, আসলে পাকিস্তান চলে গেছে কিন্তু পাকি বীজ এখনো রয়ে গেছে; যারা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে বিরোধ করে, চীনের সাথে, পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহ রাখে; তাদের স্বপ্ন কবে চীন ভারত দখল করবে, আবার বাংলা পাকিস্তান হবে, মুসলিম-মুসলিম ভাই ভাই! এরা ইতিহাস বা বর্তমান মুসলিমবিশ্বগুলোর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মুভমেন্ট দেখেও শিক্ষা নেয়না, নেয়না বলেই বাংলাদেশে যে গোষ্ঠী একসময় বলেছিলো "আমরা হবো তালেবান", তারাই আজ স্লোগান তুলছে "আমরা হবো আরাকান"; এখানে জিহাদি চেতনার পূর্ণ স্ফুরণ দেখা যায়; আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশ একটি আগ্রহের তুঙ্গে ছিলো ভারত উপমহাদেশীয় ঘাঁটি গড়ার জন্য, আর আমাদের রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী মানুষগুলো ধর্মের লেবাজে সে প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে লেগে আছে; ভেবেও দেখেনা এর পরিণতি কি হতে পারে?

বর্তমান পরিস্থিতির দ্রুততর সমাধান হওয়া প্রয়োজন, উগ্রতা আর ধর্মের ধোঁয়া তুলে নিজ দেশের সর্বনাশ ডেকে আনবেন না, রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে প্রত্যাবর্তন করার সুযোগ সৃষ্টির দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরই; পৃথিবীব্যাপী জঙ্গিবাদী কার্যক্রম মুসলিমদের দোষী সাব্যস্ত করছে প্রতিদিন, আমাদের দেশের মুসলিমরা কি উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেনা না সকল উগ্রতা পরিহার করে ধর্মের ভিত্তিতে নয়, মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি মানবতা দেখাতে; আমরা আশাবাদী যে এ পরিস্থিতি সকলে মিলে মোকাবিলা করবো, তার সবুজ সংকেতও কিন্তু মিলছে, তারই তথ্য সংযোজন করছি-

বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপের মুখে পড়ে খানিকটা দেরিতে হলেও টনক নড়েছে মায়ানমার সরকারের; আরাকান প্রদেশের রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশনের দেওয়া ৮৮ দফা সুপারিশমালা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করেছে তারা; এই কমিটি গঠনের ব্যাপারে মায়ানমারের প্রেসিডেন্টের দফতর থেকে বলা হয়েছে- রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক বিষয়াদির উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে; বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আরাকান নিয়ে জরুরি বৈঠকের আগে আকস্মিক এই কমিটি গঠনের কথা জানায় প্রেসিডেন্ট দফতর; তার আগে জানানো হয়- দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফেরানোর কাজে ব্যস্ত থাকা স্টেট কাউন্সেলর (কার্যত সরকারপ্রধান) অং সান সু চি এবারের জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন না; আনান কমিশন বাস্তবায়নে কমিটি গঠনের বিষয়ে মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে- ১৫ সদস্যের এ কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী উইন মিয়াত আয়, আর কো-চেয়ার হিসেবে থাকছেন রাখাইন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নি পু; এই কমিটি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে কাজ করবে; পাশাপাশি তারা কাজ করবে আরাকানে সহিংসতা ও হামলার অভিযোগ তদন্তে গঠিত দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বিতর্কিত জেনারেল মিন্ট সুয়ের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সুপারিশগুলোও; আনান কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়ন কমিটির কাজের বিষয়ে বলা হয়েছে- এটি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক বিষয়াদির উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে এবং জাতিগত গ্রামগুলোতে স্থিতিশীলতা ব্যবস্থাপনা ও উদ্বাস্তুদের জন্য শরণার্থী শিবির সরিয়ে ফেলতে কাজ করবে; রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে দেশের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী যাচাই কার্যক্রমে গতি আনতেও কাজ করবে এ কমিটি; বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইনে বসবাসরত ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে ‘বাঙালি’ আখ্যা দিয়ে তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে মায়ানমার; এজন্য তাদের নাগরিক অধিকার-বঞ্চিত করা হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে; এ নিয়ে বারবার সহিংসতা ছড়ালেও বিষয়টির কোনো সুরাহা হয়নি; এ নিয়ে সমালোচনার প্রেক্ষিতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে কফি আনানের নেতৃত্বে মায়ানমারের ৬ জন, লেবানন ও নেদারল্যান্ডের ২ নাগরিককে নিয়ে ৯ সদস্যের ওই কমিশন গঠিত হয়। অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট’ শীর্ষক ওই কমিশন মিয়ানমার ও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে ১৫৫টি বৈঠক করে ১১০০ ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা করে গত ২৪ আগস্ট অং সান সু চি’র হাতে ৮৮ সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন তুলে দেয়; একই দিন তা প্রকাশ হয় কমিশনের ওয়েবসাইটেও; এতে মোটাদাগে রাখাইনদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, মানবিক সহায়তা, লোকজনের অবাধ চলাচল ও নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী রাখাইনের বাসিন্দাদের অধিকারের বিষয়টি সুরাহা করার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়। প্রতিবেদনে আরাকানের জনগণকে ‘রোহিঙ্গা’ও বলা হয়নি, মায়ানমার সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী- ‘বাঙালি’ও বলা হয়নি; বলা হয়েছে ‘রাখাইনের মুসলমান সম্প্রদায়’ হিসেবে; আনান কমিশনের ওই সুপারিশমালা বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেসময় থেকেই আহ্বান জানিয়ে আসছে; এখন হাজারো রোহিঙ্গাকে হত্যা এবং লাখো রোহিঙ্গাকে বিতাড়নের পর মায়ানমারের এই সুপারিশমালা বাস্তবায়নের বিষয়ে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চাপে পড়েই মায়ানমার এ ঘোষণা দিয়েছে বলে স্পষ্ট; তারপরও আনান কমিশনের সুপারিশগুলো দ্রুত ও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে প্রত্যাবাসন এবং এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত হতে পারে;
যদিও বিতর্কিত জেনারেল সুয়ের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সুপারিশগুলোর বেশিরভাগই রোহিঙ্গাদের ওপর বৈষম্যমূলক বলে সেগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে বাস্তবায়ন করতে গেলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ; আরাকানের জনগণের শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য চূড়ান্ত প্রতিবেদনে- আরাকানের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন, নাগরিকত্ব, চলাফেরার স্বাধীনতা, অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি, মানবিক সহায়তায় প্রবেশাধিকার, গণমাধ্যমের প্রবেশাধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মাদক, সাম্প্রদায়িক অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব, আন্তঃসাম্প্রদায়িক পছন্দের অধিকার, আন্তঃসাম্প্রদায়িক সংহতি, নিরাপত্তা খাত, ন্যায়বিচার, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত ইস্যু এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, আঞ্চলিক সম্পর্ক পয়েন্টে সুপারিশ করা হয়েছে।
 
সুপারিশমালায় বলা হয়েছে :-
    ** রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান এবং মায়ানমার ও বাংলাদেশ মিলে যৌথ যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের নিরাপদে ( থেকে) প্রত্যাবাসন করতে হবে।
    ** ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী নাগরিকত্ব যাচাইপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে। এরই মধ্যে নাগরিক হিসেবে যাচাই হওয়া ব্যক্তিদের সব ধরনের অধিকার ও স্বাধীনতা দিতে হবে।
    ** মায়ানমারের নাগরিকত্ব আইনটি আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, নাগরিকত্ব ও জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে।
    ** যারা মায়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি তাদের ওই দেশটিতে অবস্থানের বিষয়টি হালনাগাদ করে ওই সমাজের অংশ করে নিতে হবে।
    ** জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার অবাধ চলাচলের সুযোগ দিতে হবে।
    ** রাখাইনে উন্নয়ন ও বিনিয়োগের পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীগুলোও উপকৃত হতে পারে।
    ** মায়ানমারের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সব গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সদস্যদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
    ** অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুহারাদের শিবিরগুলো বন্ধ করে সমাজেই তাদের সম্পৃক্ত করার নীতি নিতে হবে।
    ** সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে সুসম্পর্ক সৃষ্টি এবং সমাজের সব সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
    ** সীমান্ত ইস্যুসহ অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ-মায়ানমার সুসম্পর্ক জোরদার করতে হবে
    ** সুপারিশ বাস্তবায়নে মিয়ানমারে কাঠামো সৃষ্টি এবং মন্ত্রী পর্যায়ের কাউকে দায়িত্ব দিতে হবে।
 মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, সুপারিশ বাস্তবায়নে গঠিত কমিটি বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) বৈঠকে বসে দু’টি কমিশনের সুপারিশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে এবং যত দ্রুত সম্ভব সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের কাজ শুরু করবে। ৪ মাস পর পর কমিটি এ সংক্রান্ত অগ্রগতি জনগণের সামনে তুলে ধরবে।

উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপট সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতা দেশসমূহ, গোষ্ঠীসমূহ যাতে আমাদের দেশকে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়ার মতো অবস্থায় না ফেলতে পারে; ধর্মীয় উগ্রতার জন্য যত মানুষ হত্যা হয়েছে তার সাক্ষী ইতিহাস; আর আমরা আবেগ তাড়িত হয়ে কি করতে পারি তার প্রমাণ গত কয়েক বছরের সংবাদপত্র ঘাঁটলে জানা যাবে; তাই এটাকে আমাদের ধৈর্য্যের পরীক্ষা বলে মেনে নিয়ে সরকার ও প্রশাসনকে এ বিষয়ে আশু পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করার জন্যই আন্দোলন চালিত হবে; আমরা নিম্ন আয়ের দেশ হতে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হয়েছি, আমাদের অর্থনীতি এখন যে পর্যায়ে আছে একটি সংঘাত বা যুদ্ধ পরিস্থিতি আমাদের নিশ্চিহ্ন করে দিবে; যে সকল ব্যক্তিবর্গ এমন ভাবনা বহিঃপ্রকাশ করছেন সেটা হয় আবেগ তাড়িত হয়ে নতুবা দূরদর্শী ভাবনার অভাব হতে করছে; পদ যাত্রা করে মায়ানমার দখল, আমাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিন লক্ষ তরুন যোদ্ধা সাপ্লায়ার, মায়ানমারকে আক্রমণ করা, বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর সাধুবাদ- এগুলো দেখেও যদি মানুষ বুঝতে না পারে যে আমাদের চারপাশে কত উগ্রবাদী অমানবের অবস্থান, তাহলে আর বলার কি'ই বা থাকতে পারে; দেশটা স্বাধীন হয়েছে, স্বাধীনতার স্বাদ বুঝতে না পারা মানুষগুলোই এমন হঠকারী বক্তব্য দিতে পারে, স্বাধীনতা আন্দোলনকে জাতিবিদ্বেষের আন্দোলনের সাথে গুলিয়ে ফেলতে পারে, তারা আরেক দেশে মুসলিম হত্যা হলে এদেশে কোন সংখ্যালঘু হত্যা করে তার প্রতিশোধ নিতে পারে, আবার তাকে জায়েজ করতে পারে; আমরা সবকিছুর ঊর্ধ্বে মানবতাকে ধারণ করবো বলেই বিশ্বাস ও আস্থা রাখি আজো...!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ