রোহিঙ্গা সমস্যাঃ অন্য চোখে || সুসুপ্ত পাঠক


কয়েকদিন আগে ঢাকায় একটা সেমিনার হয়েছে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে। সেখানে বক্তারা বাংলাদেশকে মধ্যপাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে জোট করে বার্মাতে হামলার করার পরামর্শ দিয়েছে। একটা দেশের বুদ্ধিজীবী লেবেল যদি এরকম বালখিল্যতার পরিচয় দেয় তাহলে বাংলাদেশের নেতৃত্ব নিয়েও এই আশংকা জাগা অমূলক নয়- আগামী দিনের আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে চরম মার খেয়ে বাংলাদেশ নিজের অখন্ডতাকে অনিরাপদ করে ফেলবে কিনা। চীন বার্মাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ লগ্নি করেছে কেবল এটাই চীনের বার্মাকে সমর্থনের একমাত্র কারণ নয়। আসল কারণ আরো বড়। দক্ষিণ এশিয়াতে বিশ্বের সুপার পাওয়ারদের নিয়ন্ত্রণ রক্ষার ঠান্ডা লড়াই চলছে। বার্মিজ নিরাপত্তা চৌকিতে আরসার হামলা সেই লড়াইয়ের একটা দাবার চাল ছিল মাত্র…।

পৃথিবীর ক্ষমতার একাংশ চাইছে আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (এআরএনও), আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) মত সংগঠনগুলো বার্মাতে ঢুকে বার্মিজ সেনাবাহিনী ঘাটিতে হামলা চালাক। আরাকানকে আলাদা করে রোহিঙ্গা রাজ্য করার সশস্ত্র লড়াইকে বার্মিজরা কোনদিন মেনে নিবে না। বার্মার মিত্ররাও চাইবে না তাদের স্বার্থের জায়গাটা অস্থিতিশীল থাকুক। বার্মার মিত্র চীন। চীনের মিত্র রাশিয়া এবং তার গ্রুপের অন্যান্য দেশ। বার্মাতে নিজেদের ঘাঁটি মজবুত করতে চীন রাশিয়া আমেরিকা চেষ্টা করে যাচ্ছে। ঠান্ডা লড়াইটা মূলত আমেরিকার সাথে বাকী দুই দেশের। বিশ্বের বড় বড় সংবাদ মাধ্যম পর্যন্ত ‘বৌদ্ধ সন্ত্রাসী’ বলে রোহিঙ্গা সমস্যাকে ইসলামের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের সংঘাত বানিয়ে ফেলছে। এই মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের মুসলমান হিসেবে নিপীড়ত হওয়া প্রমাণ করা বিশ্বনেতাদের একাংশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি চাল। রোহিঙ্গাদের নেতৃত্ব আইএস, আল কায়দা, তালেবানদের আর্শিবাদপুষ্ট আরসা বা এআরএনও হাতে চলে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশে এই আন্তর্জাতিক জিহাদী দলগুলোর শক্তিশালী একটি অবস্থান গড়ে উঠা। এটা গড়ে উঠলে বড় বিপদ ভারতের। কারণ ভারতের সীমান্ত এলাকাগুলোতে তখন বাংলাদেশের জিহাদী গ্রুপগুলো আরামসে চোরাগুপ্তা হামলা চালাতে পারবে। এরিমধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ধন্যবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দানের জন্য। এটা অনেকটা তালেবানের কোন সরকার প্রধানকে ধন্যবাদ জানানোর মতই…।

এখন পর্যন্ত চীন ও রাশিয়া বার্মাকে সব রকম সমর্থন জানিয়ে আসছে। ভারতও বার্মাকে সমর্থন জানিয়েছে নিজেদের ভবিষ্যত চিন্তা করেই। রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যত কি হবে জানি না, তবে বাংলাদেশের ভবিষ্যত যে অন্ধকার তাতে কোন সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ তার ল্যাজের অংশটুকু অদূর ভবিষ্যতে হারাতে পারে। এটি করতে পারলে আন্তর্জাতিক পরাশক্তিদের বড় ধরণের লাভ হবে। বাংলাদেশ থেকে এখন যারা বার্মাতে মুক্তিযুদ্ধ করতে ইচ্ছুক তাদের জন্য আশার কথা হচ্ছে, ইচ্ছা করলে তারা অদূর ভবিষ্যতে দীর্ঘমেয়াদী গৃহযুদ্ধে আশ মিটিয়ে লড়াই করতে পারবেন। কষ্ট করে বার্মা যেতে হবে না। গণমাধ্যমের খবর দেড় লাখ রোহিঙ্গা যুবক তাদের সশস্ত্র দলে নাম লিখিয়েছে। এরা এখন কোথায় সেটা চিন্তা করা দরকার। রোহিঙ্গা শরণার্থী নারীরা বলেছে তাদের ছেলে-স্বামীরা তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়ে তারা বার্মাতে লড়াই করতে রয়ে গেছে। বার্মাতে রোহিঙ্গাদের যে অবস্থা তাতে কি করে তারা এখনো বার্মাতে থেকে যেতে পারে? তার মানে এই দেড় লাখ যোদ্ধা (মতান্তরে মুজাহিদ) বাংলাদেশ সীমান্তের বনজঙ্গল পাহাড়পর্বতেই ঘাঁটি গেড়েছে। এই আরসা এবং এআরএনও সৌদি কাতার জিহাদী ফাউন্ডেশনে চালিত এবং মতাদর্শী। এদের এখন ফাউন্ডিং করার জন্য পশ্চিমাদের এজেন্টরা খুঁজে ফিরবে। এদিকে চীন আরাকানের খনিজ সম্পদ এবং তার বিনিয়োগের চারা দুই পয়সার কোন ছাগল খেয়ে ফেলবে এটা চেয়ে চেয়ে দেখবে না। চীনের ভয়ে তুরস্কের যুদ্ধজাহাজ চিরকালই সমুদ্রে ঘুরপাক খাবে কিন্তু বার্মিজ বন্দর খুঁজে পাবে না। অবশ্য চীনকে অস্থির রাখতে এটুকুই দরকার। রোহিঙ্গা মুজাহিদদের তখন আশ্রয় হবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তো ফাটা বাঁশের চিপাতে তখন। বাংলাদেশকে তখন বার্মার মিত্র চীন রাশিয়া (এখানে রাশিয়ার বন্ধু হিসেবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানও বার্মার বন্ধু!) বাংলাদেশকে বার্মার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করবে। আমেরিকা বাংলাদেশে ইসলামী টেরোরিস্টদের হাতে সীমান্তগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেবার অপেক্ষাতেই থাকবে। ভারত তখন বাধ্য হবে তার নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশের প্রতি কঠর হতে। কার্যত বাংলাদেশ বন্ধুহীন একটি রাষ্ট্র তখন। নিজের অভ্যন্তরে ইসলামী শক্তি এবং প্যান ইসলামিজম সুটেডবুটেড বুদ্ধিজীবীরা। এই শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরাই বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশের প্রধান বুদ্ধিজীবী সমাজ। বার্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কেন আসছে না সেমিনারে তাদের আহাজারি অনভিপ্রেত নয়।

বাংলাদেশে এখন দুটো শক্তিই রয়েছে। একটা ফান্ডামেন্টালিস্ট ইসলামিজম এবং প্যান ইসলামিজম। এই প্যান ইসলামিজমের পরিধিটাই বড়। এখানে বাম নাস্তিকরা পর্যন্ত আছে। এই দুই শক্তি বাংলাদেশের সেক্যুলার মুক্তচিন্তার শক্তিকে দুর্বল করতে কাজ করে গেছে। প্যান ইসলামিজম বুদ্ধিজীবীরাই নাস্তিক লেখকদের যখন ফান্ডামেন্টালিস্ট ইসলামিস্টরা হত্যা করছিলো তখন তারা নাস্তিক লেখকদের লেখার সীমানা নিয়ে প্রশ্ন তুলে হত্যাকেই জাস্টিফাই করে তুলেছিলো। রোহিঙ্গা ইস্যুতে এরা কেবল শরণার্থী শিবিরে দুর্দশাগ্রস্থ শিশু নারীদের ছবি দেখিয়ে যাচ্ছে। সৌদি বাদশার বার্মা আক্রমণের রঙ্গিন স্বপ্ন দেখছে। আসল বিপদটা দেখতে পাচ্ছে না। এটাই প্রত্যাশিত। প্রগতিশীলতার অর্থই হচ্ছে সামনে এগিয়ে যাওয়া। যে কোন সংক্রীর্ণ ধর্মীয় বা জাতিগত জাতীয়তাবাদীরা তাই প্রগতির বিপরীত। ভয়ংকর সত্য হচ্ছে, বাংলাদেশের রজ্জু এখন তাদের হাতেই…।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

X

Never Miss an Update!

Join my newsletter to get the latest posts from littlemag.in directly to your inbox.