মৃত্যুর আয়নায় জীবনের নক্ষত্র || কাজী মাহবুব হাসান



আবুল আলা আল-মারি ছিলেন ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়ায় জন্ম নেয়া একজন আরব দার্শনিক ও কবি। কর্ম জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় তিনি সেই সময়ের পৃথিবীর সেরা শহর বাগদাদে কাটিয়েছিলেন। অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও তিনি কখনোই তাঁর কোনো লেখা অর্থের মূল্যে বিক্রি করতে রাজী হননি। ১০১০ এ তিনি আবার সিরিয়ায় ফিরে এসেছিলেন। নৈরাশ্যবাদী মুক্তচিন্তার যুক্তিবাদী দার্শনিক হিসাবে পরিচিত আল-মারি নিজেকে দুই জগতের বন্দী হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন… তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা- অন্ধত্ব এবং তাঁর একাকীত্বের জগত।

চার বছর বয়সে গুটি বসন্তের কারণে তিনি তাঁর দৃষ্টি শক্তি হারিয়েছিলেন। তবে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে তাঁর অন্ধত্ব কোনো বড় বাধা হয়ে দাড়ায়নি। আল-মারি মূলত বিতর্কিত ছিলেন তাঁর যুক্তিবাদী দর্শনের কারণে। তিনি ধর্মের মতবাদ নির্ভর ভাবজড়তা আর ইসলামকে অস্বীকার করেছিলেন – ইসলামের কিছু কেন্দ্রীয় মতবাদ যেমন হজ্জ্ব, মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে তিনি সমালোচনা করেছিলেন। তাঁর শ্লেষাত্মক মন্তব্য অন্যান্য ধর্মগুলোকেও রেহাই দেয়নি। তিনি সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলতেন, কঠোরভাবে নিরামিশাষী ছিলেন, কারণ জবাই করে হত্যা করা কোন মাংস তিনি খাদ্য হিসাবে গ্রহন করতে অস্বীকার করেছিলেন। নৈরাশ্যবাদী হিসাবে তাঁকে যে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছিল, সেটি হলো তাঁর অ্যান্টি-ন্যাটালিস্ট দৃষ্টিভঙ্গী, তিনি প্রস্তাব করেছিলেন জীবনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবার জন্য কোনো শিশুরই জন্ম দেয়া অন্যায়। তাঁর তিনটি প্রকাশনা খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল তাঁর সময়েই “The Tinder Spark”, “Unnecessary Necessity”, এবং “The Epistle of Forgiveness”।

(The Tinder Spark, a collection of Al-Ma’arri’s poetry from Syria, circa 1300 CE)

বর্তমানে যদিও ইসলামী বিশ্বকে মুক্ত চিন্তার কোনো উর্বর ক্ষেত্র হিসাবে ভাবা খুব কঠিন, তবে একটা সময় ছিল, বিশেষ করে অষ্টম শতাব্দীর পর কয়েকশ বছর, যখন বিস্ময়কর দার্শনিক বিতর্ক আর মুক্তচিন্তায় উর্বর হয়েছিল সেই বিশ্ব, যা এর আগে কেবল গ্রীক দর্শনের শীর্ষ সময়েই দেখা গিয়েছিল। সেই সময়ের চিন্তার জগতে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন যুক্তিবাদীরা, যারা ফালসাফা (falsafah বা (فلسفة)) র আদর্শে প্রতি নিবেদিত ছিলেন, এই শব্দটির মানে শুধু দর্শন শিক্ষা না, এই মহাবিশ্বের নিয়ম মেনেই যুক্তির সাথে জীবন কাটানোর একটি পদ্ধতির প্রতি প্রতিশ্রুতি। ফালসাফা মূলত গ্রীক দর্শনের পদ্ধতি আর আধেয় যা ইসলামে নিয়ে আসা হয়েছিল। আর যে ব্যক্তি ইসলামকে যুক্তিবাদী দর্শনের সাথে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন তাদের বলা হতো ফেলাসুফ (فيلسوف);

Faylasuf রা মনে করত জ্ঞান অর্জন করা হচ্ছে তাদের নৈতিক দ্বায়িত্ব। এই আন্দোলনটি গড়ে উঠেছিল, যখন নব সৃষ্ট ইসলামিক সাম্রাজ্য হঠাৎ করেই এর সীমানার মধ্যে আবিষ্কার করেছিল গ্রীক আর পারস্যের জ্ঞানের বিপুল এক ভাণ্ডার, এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সেখানে শুরু হয়েছিল অভূতপূর্ণ বিস্ময়কর এক অনুবাদ আন্দোলনের; faylasuf রা গ্রীকদের থেকে শুধুমাত্র যৌক্তিক অনুসন্ধানের সেই প্রাণশক্তিটি ধারণ করেননি, তারা তাদের সেই বিশ্বাসটিকেও ধারণ করেছিলেন যে, মানুষের বুদ্ধিমত্তার আছে সীমাহীন শক্তি, এবং শুধুমাত্র যুক্তি ব্যবহার করে সত্য উদঘাটন করা ক্ষমতা রাখে। যদিও তাদের অনেকেই গভীরভাবে ধার্মিক ছেলেন, এবং মনে করতেন কোরান হচ্ছে আল্লাহ প্রেরিত শব্দমালা, তবে তারা, ধর্মীয় সত্যকে শুধুমাত্র স্বর্গীয় আর ঐশী প্রত্যাদেশের প্রত্যাদেশের মাধ্যমে জানতে পারি, সেই ধারণাকে চ্যালঞ্জ করেছিলেন, তারা বরং দাবী করেছেলিনে এই কাজটি করার জন্য যুক্তি যথেষ্ঠ হবার কথা। সবচেয়ে প্রাচীন ইসলামী যুক্তিবাদী আন্দোলন ছিল মুতাজিলাইট (Mu’tazilite), যার একেবারে কেন্দ্রেই আছে মানব যুক্তি আর ঈশ্বরের ইচ্ছা আর তার কর্মপদ্ধতির যৌক্তিকতার ধারণাটি ; Mu’tazilah আন্দোলসের সূচনাপর্বের অন্তর্দৃষ্টিগুলো এনেছিল এই আন্দোলনের ধারায় বেশ কিছু অসাধারণ চিন্তাবিদদের কাছ থেকে, তাদের মধ্যে আল কিন্দি ( ৮০১-৮৭৩), আল-ফারাবী (৮৭২-৯৫১) কে মনে হয়ে falsafah স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে, যাদের মনে করা হতো দ্বিতীয় গুরু ( দ্বিতীয় কারণ, অ্যারিস্টোটল ছিলেন প্রথম গুরু), পরে এসেছিলেন আরো দুজন অসাধারণ দার্শনিক – ইবন সিনা ও ইবন রুশদ। ইসলামী যুক্তিবাদীতার এই ধারাটি এখন যেমন পশ্চিমে প্রায় বিস্মৃত , তেমনি আরো বিস্মৃত ইসলামিক বিশ্বে), যদিও এই ধারার গুরুত্ব ও পরবর্তী সব চিন্তার আন্দোলনের ক্ষেত্রে অবদানগুলোকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা সম্ভব না। হয়তো সেকারণে দর্শনের ইতিহাস চর্চার একটি বিশাল যোক্তিকতা রয়ে গেছে। যুক্তিবাদীদের এই ধারাই সুচনা করেছিল মানবতাবাদী আন্দোলনের যার সমতূল্য কিছু দেখা গেছে আরো পরে পঞ্চদশ শতকের ইতালীতে। আর ইসলামী সাম্রাজ্য এর প্রভাবে ব্যপকভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল, জ্যোর্তিবিজ্ঞান সহ মানব জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা।

যদিও যুক্তিবাদীদের সূচনা বিন্দু ছিল ধর্মগ্রন্থ। তবে যুক্তির উপর তাদের সেই বিশেষ গুরুত্ব আরোপ খুব শীঘ্রই জন্ম দিয়েছিল নানা প্রশ্নের, বিশেষ করে এই গ্রন্হের প্রকৃতি ও প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে – এখানে সূচনা হয় আরব মুক্তচিন্তা আন্দোলনের – zindiq বা heretics বা ভিন্ন মতাবলম্বী হিসাবে তাদের বলে পরিচিত ছিল কর্তৃপক্ষের কাছে, এই মুক্ত চিন্তকরা ইসলামী মতবাদের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে আবির্ভুত হয়েছিলেন – তবে বিস্ময়করভাবে দ্বাদশ শতক অবধি তাদের অবস্থানকে সহিষ্ণুতার সাথে দেখা হয়েছিল।

তাদের একজন যেমন আল-মারি, তিনি বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন অনেক অনুসারী সহ। শুধু দর্শন না আরব ঐতিহ্যবাহী কবিতার ধারায় তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন কবিও ছিলেন। তার সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা The Epistle of Forgiveness, যেখানে তিনি তার স্বর্গ ভ্রমনের কাহিনী বর্ণনা করেছিলেন, যেখানে তিনি প্যাগান পর্বের আরব কবিদের সাথে সাক্ষাতের কথা লিখেছিলেন, ধারণা করা হয় এটি দান্তের ডিভাইন কমেডির প্রকৃত পূর্বসূরি।

আল-মারি তার কবিতায় আপোষহীন ধর্মীয় সংশয়বাদী ছিল –

তারা সবাই ভুল করে – মুসলিম, ইহুদি
খ্রিস্টান, আর জরথুস্ট্রীয়রা;
বিশ্বব্যাপী মানবতা অনুসরণ করে দুটি সম্প্রদায় :
প্রথমটি, ধর্মহীন বুদ্ধিমানদের,
আর দ্বিতীয়টি, বুদ্ধিহীন ধার্মিকদের।

যুক্তি অনুসরণ না করা মানে আল- মারি দাবী করেন, অত্যাচার আর অবিচারের প্রতি আত্মমসমর্পন করা –

অনেক, অনেক দিন ধরেই তোমাদের ইচ্ছামতই চলেছো তোমরা,
সব রাজা আর অত্যাচারীর দল,
আর তারপরও প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় অবিচারের করে চলেছো।
আর তোমাদের নাকি যন্ত্রণা দেয়, কারণ গৌরবের পথ নাকি অনুসরণ করতে পারছো না?
মানুষ তার ছায়ায় ঢাকা আশ্রয় ভালোবাসলেও সে মাঠে নামে।
কিন্তু কেউ কেউ আশা করছো, দৈব কন্ঠ সহ কোনো স্বর্গীয় নেতার
জন্ম হবে নীরবে তাকিয়ে থাকা মানুষের মধ্যে;
কি অলস সেই ভাবনা! যুক্তি ছাড়া পথ দেখানোর আর কেউ নেই,
যা দিন কিংবা রাতে তোমাদের দিতে পারে পথ নির্দেশ।

আল-মারি মনে করতেন যুক্তি হতে পারে সবচেয়ে সেরা নৈতিক পথপ্রদর্শক আর সদগুণ হচ্ছে এর নিজের উপহার:

যুক্তি নিষেধ করেছে অনেক কিছুই,
সহজাতভাবে, আমার প্রকৃতি যার প্রতি আকৃষ্ট।
আর অন্তহীন একটি ক্ষতি আমি অনুভব করি, যদি জানি,
আমি মিথ্যাকে বিশ্বাস করি অথবা সত্যকে অস্বীকার করি।

ধর্ম ছিল আল-মারির চোখে অনেকটা ‘আগাছায় ভরা মাঠের মত’, বা,‘ প্রাচীন মানুষদের আবিষ্কার করা একটি রুপকথার মত’, যা মানুষকে মোহাবিষ্ট করে রাখে।

যদি তাদের যুক্তি সহ ভাবার সুযোগ দেয়া হতো,
তারা কখনোই কথিত একটি মিথ্যাকে গ্রহন করতো না,
কিন্তু তাদের প্রহার করার জন্য চাবুক তোলা হয়েছে,
প্রথা আর আচার তাদের কাছে নিয়ে এসেছে
এবং তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলার জন্য,
‘আমাদের সত্য কথা বলা হয়েছে’।
যদি তারা অস্বীকার করে, তরবারী ভিজেছে তাদের রক্তে,
আতঙ্কিত ছিল তারা দুর্যোগের তরবারীর খোলসে,
খাদ্য দিয়ে তাদের প্রভোলিত করা হয়েছে,
যা তাদের দেয়া হয়েছে অহংকার আর অবজ্ঞার সাথে।

আল-মা’রির কাছে কোরান ও অন্যান্য পবিত্র বইগুলো শুধুমাত্র ছিল , একগুচ্ছ অলস কাহীনি, যা যে কোনো যুগেই থাকতে পারে এবং আসলেই যা তৈরী করা হয়েছে –

সুতরাং, মানুষের বিশ্বাসও : যা প্রাধান্য বিস্তার করেছে
অন্য আরেকটি সেই জায়গা নেবার আগে, এবং এটি ব্যার্থ হয়
যখন অন্যটি জয় লাভ করে: হায়, এই নির্জন পৃথিবীর
সবসময়ই দরকার হবে সাম্প্রতিক রুপকথার;
আর ধর্মীয় আচার হচ্ছে জনগণকে দাসত্বে বাধার একটি উপায়:
শোনো নির্বোধরা, জেগে ওঠো! যে আচারকে তুমি প্রবিত্র মানো
সেগুলো আর কিছু না, বরং প্রতারণা যা প্রাচীন মানুষেরই কল্পিত,
যারা লালায়িত ছিল সম্পদে এবং তারা সেই লালসা মিটিয়েছেও,
এবং তাদের মৃত্যু হয়েছে নীচতায় – আর তাদের আইন হচ্ছে ধূলো।

আল-মারির কবিতায় গভীর নৈরাশ্যবাদও ছিল, যা পৃথিবী সম্বন্ধে স্টয়িক বা বৈরাগ্যবাদী দর্শনের কথা মনে করিয়ে দেয় –

আমরা হাসি, কিন্তু হাসিতে আমরা অদক্ষ
আমাদের কাঁদা উচিৎ, অনেক বেশী করে কাঁদা,
এমন কারো মত, যে কাচের মতো বহু টুকরো হয়ে ভেঙ্গে গেছে
আর কখনোই যা জোড়া লাগবে না।

আল-মারির জীবনের পবিত্রতার বিশ্বাসী ছিলেন – তিনি মাংস খাওয়া ছেড়েছিলেন, কারণ কোনো জীবিত প্রাণির ক্ষতি করার ইচ্ছা পোষণ করতেন না। কিন্তু যন্ত্রণাময় মানব জীবনের ক্ষণস্থায়ী চরিত্র মাঝে মাঝে তাকেই আপ্লুত করেছে –

আমি ভাবি, পৃথিবী পৃষ্ঠ আর কিছু না, মৃতদেহ ছাড়া,
বাতাসে সাবধানে হেটো, ঈশ্বরের দাসদের অবিশিষ্ঠাংশ যেন তুমি পায়ে না মাড়াও।

তিনি ভাবতেন জীবনের দুটি উপহার – কষ্ট আর মৃত্যু –

বহু জাতির উপর সূর্যের আলোর জাল ছড়ানো,
আর ছড়িয়ে আছে মুক্তোদানা, তবে বাধার জন্য দেয়া হয়নি কোনো সুতো,
এই কঠিন পৃথিবী আমাদের মুগ্ধ করে, যদিও সবই চুমুক দেয় –
– সবাই যাদের পৃথিবী জন্ম দেয় – একটি মরণশীল পেয়ালায়।
দুটি দূর্ভাগ্য থেকে বেছে নিতে হয়: কোনটা আসলেই
আপনাকে মানায়? ধ্বংস হয়ে যাওয়া নাকি কষ্টে বাঁচা?

কখনো তিনি ভাবতেন মানুষের জন্ম না হওয়াই ভালো ছিল –

আদমের আর সবাই যারা তার ঔরসজাত, তাদের জন্য উত্তম ছিল
সে এবং তারা, আর যাদের এখনও এখনও জন্ম হয়নি – কখনোই সৃষ্টি না করা,
কারণ যদিও তার শরীর এখন ধুলো, আর পৃথিবীতে তার পচনশীল অস্থি,
আহ, তিনি কি অনুভব করেছেন তার সন্তানরা কি দেখেছে, আর যন্ত্রণা সহ্য করেছে।

আল-মা’রির দৃষ্টিভঙ্গির প্রায় অপরিমেয় গভীরতা আর অন্ধকার রুপটি উন্মোচন করে দশম শতকের আরবে নিরীশ্বরবাদী হয়ে জীবন কাটানোর ভয়ঙ্কর সমস্যাটিকে। আধুনিক মানবতাবাদের বস্তুবাদী শিকড়টি আছে সেই বিশ্বাসে যে তাদের জগত বদলে দেওয়া সম্ভব মানুষের ক্ষমতায়, একটি পৃথিবী যেখানে ঘটেছে বহু বিপ্লব – বৈজ্ঞানিক, শিল্প আর রাজনৈতিক; তারা যোগান দিয়ে মানব পরিচালিত প্রগতির একটি শক্তিশালী ভিতের প্রতি আস্থার। তবে আল-মারির জগত কিন্তু তেমন ছিল না। তিনি সেই পৃথিবীর, যেখানে জীবন মনে হতো চিরন্তনভাবে স্থবির আর অপরিবর্তনযোগ্য, যেখানে প্রকৃতির নিষ্ঠুর সত্যে কাছে জীবন নত হতো শুধু, আর সেখানে মানুষ তাদের পৃথিবীকে রুপান্তরিত করতে পারে এমন ধারণা শুধুমাত্র বাড়াবাড়ি মাত্রায় ঔদ্ধত্যপূর্ণ ছিলনা শুধু বরং অযৌক্তিক এবং পাগলামীও ছিল। যেখানে দুঃখ আর উদ্বেগ সকালবেলার সূর্য ওঠার মতই অবিচ্ছেদ্যভাবেই জীবনের অংশ। এটি সেই পৃথিবী, যেখানে ঈশ্বর ছাড়া আর কিছু ছিল স্বস্তি আর সান্ত্বনার জন্য, কোনো কিছুই ছিল না, যা দিয়ে জীবনকে অর্থবহ করা যেতে পারে। এমন একটি পৃথিবীতে শূন্যতার দিকে তাকানো আর অন্ধকারকে গ্রহন করে নেবার জন্য নিজের জীবনকে নীরিক্ষা আর এর অনিঃশেষ যন্ত্রণাকে কোনো ইতস্ততা ছাড়াই মেনে নেবার জন্য দরকার প্রচুর পরিমানে। বেশীরভাগ যুক্তিবাদীরা সেই যন্ত্রণাটি ত্যাগ করেছিলেন ঈশ্বরকে মেনে নিয়ে, ধর্মগ্রন্থের জন্য যুক্তিকে কোনো চ্যালেঞ্জ হিসাবে স্বীকৃতি না দিয়ে, বরং সেটিকে তারা শাস্ত্রের ব্যাখ্যায় একটি বিকল্প পথ হিসাবে বেছে নিয়ে ছিলেন। কিন্তু আল-মারি – সেই আপোষ করেননি।

(ভাস্কর ফাথি মুহাম্মদ (১৯৪৪) আল মারির ভাস্কর্য সহ)
দ্বাদশ শতাব্দীতে যুক্তিবাদীরা আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নিতে শুরু করে, প্রথাগত চিন্তাবিদদের ক্রমাগত সমালোচনা মুখে – যারা বিশ্বাস করতেন মানব যুক্তি মানুষের মতই দূর্বল আর দূর্নীতি পরায়ন, যাদের জন্য ধর্মগ্রন্হের ঐশী প্রত্যাদেশে ছিল সত্য অনুসন্ধানের একটি মাত্র পথ। যুক্তিবাদীদের সাথে প্রথাগত চিন্তকরা বাধ্য হতো দার্শনিক বিতর্কে জড়াতে, এবং তারা বহু প্রাচীন দার্শনিকের বহু যুক্তিও তাদের চিন্তায় যুক্তও করেছিলেন। কিন্তু বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তারা falsafah থেকে নিজেদের দূরে রেখেছিলেন, তাদের অধার্মিক অথবা বিজাতীয় চিহ্নিত করে। আরবের প্রথম দার্শনিক বলে পরিচিত আল-কিন্দি বলেছিলেন – ‘আমাদের লজ্জা পাওয়া উচিৎ না সত্যটাকে স্বীকার করে নিতে এবং আত্মীকৃত নেবার জন্য, আমাদের কাছে জ্ঞান যে উৎস থেকেই আসুক না কেন, এমনকি যখন সেটি আমাদের কাছে এসেছে প্রাক্তন কোনো প্রজন্ম আর ভীনদেশী মানুষদের কাছ থেকে’। আর ঠিক এই উন্মুক্ততাই পছন্দ করেননি প্রথাগত চিন্তাবিদরা। ইসলামী যুক্তিবাদী চিন্তার রুদ্ধ হয়ে যাবার ইঙ্গিত দিয়েছিল প্রথাগত চিন্তার বিজয় । যুক্তিবাদী চিন্তা ক্রমশ নিমজ্জিত হতে থাকে, মুক্ত চিন্তকরা ও অন্য ভিন্নমতাবলম্বীদের খুজে বের করা হয়, তাদের নির্যাতন করা হয়, প্রায়শই তাদের হত্যা করা হয়। অবশ্যই ইসলামের মধ্যে বহু ভিন্ন বিশ্বাস আর আচার ও প্রথার অস্তিত্ব আছে ঠিকই, কিন্তু আর কখনোই সেই অনুসন্ধান আর বিতর্কের মুক্ত পরিবেশ ফিরে আসেনি, যেমনটা ছিল ইসলামী সম্রাজ্যের সেই শুরুর শতাব্দীগুলোয়।

ইবনে সিনা, ইবনে রুশ ও আল-মারি প্রভাবশালী হয়েছিলেন, তবে ইসলামী জগতে না। বরং খ্রিস্টীয় ইউরোপে তাদরে দর্শন বেশী অনুসারী পেয়েছে। খ্রিস্টান ধর্মীয় ঐতিহ্যে যেখানে কখনোই মুক্ত চিন্তার ধারা দেখতে পাওয়া যায়নি, দ্বাদশ শতাব্দীতে সেখানেই খ্রিস্টীয় চিন্তাবিদরা, বিশেষ করে টমাস অ্যাকোয়াইনাস, তাদের অ্যারিস্টোটল আর অন্য গ্রীক দার্শনিকদের খুঁজে পেয়েছিলেন আরব সেই দার্শনিকদের ব্যাখ্যা আর অনুবাদের মধ্যে, যা একসময় সূচনা করেছিল রেনেসা পর্বের, এনলাইটেনমেন্ট আর বৈজ্ঞানিক বিপ্লবে – যা চিরকালের জন্য উন্মুক্ত করেছিল এযাবত বন্ধ থাকা খ্রিস্টীয় জগতকে।

যদিও প্রভাবশালী, তারপরও মুসলিম যুক্তিবাদী ও মুক্ত চিন্তকরা আজ মূলত বিস্মরিত। আল-মারির কবিতায় দিয়ে শেষ করি –

প্রথা আসে অতীত থেকে, মূল্যবান আমদানী, যদি তারা সত্যি হয়,
হায়, কিন্তু দূর্বল সেই মানুষগুলোর শৃঙ্খল যারা তার সত্যতা দাবী করে,
নিজের যুক্তির সাথে পরামর্শ করো এবং অন্যদের গ্রাস করুক নরক:
সব আলোচনায় যুক্তি শ্রেষ্ঠ উপদেশে আর পথ দেখাতে।

(আল নুসরা ব্রিগেডের হাতে শিরোচ্ছেদ হওয়া আল মারি’র ভাস্বর্য)
চিরকুমার এই অন্ধ কবি ৮৩ বছর বেঁচে ছিলেন তাঁর জন্মের শহর মারাত আল-নুমান এ। যদিও ইসলামকে অস্বীকার করা এই কবিকে তার সেই সময়ে হত্যা করতে উদ্যত হয়নি কোনো উগ্রবাদী.. তবে ২০১৩ সালে সিরিয়ায় তার সন্মানে নির্মিত ভাস্কর্যটির শিরোচ্ছেদ করে ইসলামবাদী আল-নুসরা ব্রিগেড এর জিহাদীরা। বর্তমান সময়ে তার জন্ম হলে তার পরিণতি কি হতে পারতো সেটা সহজেই অনুমেয়।

শত বিতর্ক সত্ত্বেও আল-মারিকে ধ্রুপদী আরবী ভাষার অন্যতম সেরা কবি হিসাবে মনে করা হয়।

( লেখাটি কিছু অংশ কেনান মালিকের একটি লেখা অবলম্বনে লেখা – বিশেষ করে ব্যবহৃত কবিতাগুলো, যার সূত্র আবার রেনল্ড নিকলসনের এর Studies in Islamic Poetry, নিবন্ধটির শিরোনাম কবি ও শিল্পী আসমা সুলতানার একটি কবিতার পংক্তি থেকে ঋণ নেয়া।)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

X

Never Miss an Update!

Join my newsletter to get the latest posts from littlemag.in directly to your inbox.