মাথায় হেলমেট না থাকলে বিনয়ের নামের সামনে থেকে হয়তো শ্রীটুকু বাদ চলে যেত। বোধহয় তার আত্মীয়স্বজনও কিছুটা নিষ্কৃতি পেত। ওরকম একটা হতচ্ছাড়া ছেলে যে কীভাবে তাদের বংশে জন্ম নিল তা ভেবে পায় না রায়বাড়ির লোকজন! এখন আঙুল কামড়ান বিনয়ের বাবা-মা, কেন যে তাকে কলকাতার হস্টেলে রেখে পড়িয়েছেন! তাদেরও দোষ দেওয়া যায় না। তারা ছাপোষা সাধারণ মানুষ। বিনয়ের জন্য তো কম শুনতে হয় না তাদের। সত্যিই যদি তেমন কোনো ঘটনা ঘটত, তাহলে সুখবরটি পাওয়ার পরে পরে হয়তো পাড়ার চা দোকানটি সরগরম হয়ে উঠত। যতদূর অনুমান করা যায়, বয়স্কদের আড্ডায় সম্ভবত নিম্নলিখিত কথাবার্তাই চালাচালি হতো।
—‘নিয়তি কে ন বাধ্যতে, বুঝলে ভায়া!’
—‘দেব-দ্বিজে ভক্তি-শ্রদ্ধা না-থাকলে যা হওয়ার তাই-ই হয়েছে!’
—‘ইশ্বর সব সহ্য করে কিন্তু অহংকার নয়। পচ ব্যাটা এবার নরকে গিয়ে।’
—‘চাকরির গরম তোর এখন কোথায় থাকল রে বিনু!’
না, শেষমেশ এসব কিছুই হল না। বিনয়ের নামের আগে আপাতত চন্দ্রবিন্দুটা বসতে পারল না। তাকে আবারও সুযোগ খুঁজতে হবে।
ইনজেকশন, ড্রেসিং, অ্যান্টিবায়োটিক, অয়েনমেন্ট ইত্যাদির কৃপায় পাঁচদিনের মাথায় বিনয় উঠে বসে, হাঁটাচলাও শুরু করে। সকালবেলা চায়ে চুমুক দিয়ে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবে, যাক এযাত্রায় ...। হঠাৎ বাম হাতের কনিষ্ঠা ও অনামিকার দিকে নজর পড়ে তার, মনটা খারাপ হয়ে যায়। নিয়মিত ড্রেসিং করা সত্ত্বেও এখনও কালো হয়ে থাকা নখদুটি থেকে রক্তরস গড়াচ্ছে। নখদুটি বোধহয় গেল !
—‘এখন কেমন বোধ করছিস বিনু?’
—‘দিদি, কখন এলি?’
—‘এই তো এলাম। মা ফোন করেছিল। তোর নাকি বাম হাতের দুটো নখ নষ্ট হয়ে যাবে! কই দেখি একবার।’
বিনয়ের নখদুটি ভালো করে দেখেন বিনতাদি। তারপর মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলে, এ আর এমন কী! গতবছর আমার দেওর সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড। কিন্তু ডাক্তার দেখাতে হয়নি। বামুনগাজির কৃপায় সে সেরে উঠেছে। নরেশের তুলনায় এতো কিছুই নয়!’
বিনতাদি হাতে ঝোলানো চটের ব্যাগ থেকে কলাপাতা জড়ানো ছোট্ট একটি মাটির ভাঁড় বের করে কপালে ঠেকান, তারপর কিছুটা কাদা বের করে সেই তৈল ভাণ্ডটিকে সযত্নে টেবিলের উপর স্থাপন করেন।
—‘শোন বিনু,গামছা পরে প্রতিদিন দুবার করে এই তেল আঙুলদুটোতে, বিশেষ করে নখের উপর লাগিয়ে দিবি। একেবারে ধন্বন্তরী এই বামুনগাজির তেল। দেখবি বাবার কৃপায় তোর আবার নতুন করে নখ গজাচ্ছে। নরেশ তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।’
—‘আচ্ছা দিদি তুই তো জানিস ওসবে আমার আদৌ বিশ্বাস নেই। কিছু মনে করিস না, ওই তেল আমি লাগাতে পারব না।’
—‘হ্যাঁ রে বিনু, তুই একাই শিক্ষিত তাই না! আমরা তো আর পড়াশোনা করিনি! করিস তো প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি। তোর সুরেশদাকে তো দেখেছিস, আংটি-মাদুলি-ঘুনসি কী নেই তার শরীরে! দেখে কে বলবে অত ফিজিক্সের অত বড়ো প্রফেসর! এইজন্য বলে অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী!’
বিনয় কী বলতে যাচ্ছিল। পাশের ঘর থেকে মা এসে বিনতাকে ডেকে নেন। বিনতা তখনও গজগজ করে যান।
—‘ডাঁট ফলিয়ে নে। আর বা কতদিন! বিয়ের পর তো বউয়ের গোলামি করে বেড়াবি।’
—‘হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস, সুরেশদা যেমন তোর গোলামি করে চলেছেন।’
আবার শুরু হয় আর এক প্রস্থ। সকালটা কেমন যেন বিস্বাদ হয়ে যায়। টেবিলে পড়ে থাকে আধ-খাওয়া চা। দিদির সঙ্গে এই মনোমালিন্যে বিনয় দুঃখ পায়।
বেশ কয়েকদিন পর আজ সে কম্পিউটারটা অন করে। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় গেয়ে ওঠেন— ‘দূরে কোথায় দূরে দূরে ...।’ বিনয় জানত না, সকালের মতো বিকালটাও তার বিধ্বস্ত হবে। দুপুরের ঘুমের রেশ তখনও পুরোপুরি কাটেনি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে ধীরেসুস্থে আড়মোড়া ভেঙে শরীরের অবস্থা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এমন সময় দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকেন নিতাই মেসো। মস্ত বড়ো হোমিওপ্যাথি ডাক্তার তিনি। এলাকায় নামডাক যথেষ্ট। ডাক্তারির সুবাদে ক্ষমতাসীন বিভিন্ন মহলে তাঁর ভালো দহরম-মহরম আছে। ছ-সাত কিলোমিটার দূরে মাসির বাড়ি হলেও নিতান্ত বাধ্য না-হলে বিনয় ওবাড়িতে যায় না। আসলে ভালো মানুষ না-হলে বিনয় কারোর সঙ্গেই সম্পর্ক রাখতে চায় না, তা সে আত্মীয়স্বজন হলেও ছাড় নেই।
—‘বিনয় শোন। এই ওষুধটা সকালে খালি পেটে দু-ফোঁটা করে দশদিন খাবি। এক মাসের মধ্যে নতুন নখ গজিয়ে যাবে।’
—‘আমি তো ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাচ্ছি। নিয়মিত ড্রেসিং করাচ্ছি। আবার ওষুধ কী হবে!’
—‘তোর এই বেয়াদবির জন্যই আমি তোদের বাড়িতে আসতে চাই না। নেহাত তোর মা আমাকে ফোন করে কান্নাকাটি করল তাই! তুই কী ভেবেছিস আমার কোনো কাজ নেই! আমি জানি তুই হোমিওপ্যাথিতে বিশ্বাস করিস না, এই ওষুধটা খেয়ে দ্যাখ, প্রমাণ না-পেলে বিশ্বাস করার দরকার নেই।’
—‘শুনুন মেসো, হোমিওপ্যাথ বা তেল পড়া, জল পড়ার বিষয় নয়; আমি কোনোরকম প্লেসিবোকেই গুরুত্ব দিই না। আমাদের শরীর নিজে নিজেই অনেক অসুখবিসুখ সারিয়ে নিতে পারে। সেসব ক্ষেত্রে প্লেসিবোর ব্যবহার অনেকটাই ঝড়ে কাক মরে, ফকিরের কেরামতির মতো ব্যাপার। দেখিই না আমার নখদুটোর ক্ষেত্রে কী হয়!’
—‘বুঝেছি মাস্টারির জ্ঞান ঝাড়ছিস। এই আমি কী তোর ছাত্র! তুই ওইসব জ্ঞান বাচ্ছাদের দিবি বুঝলি! ক-পয়সা মাইনে পাস অ্যাঁ, আমার সঙ্গে টক্কর নিচ্ছিস! আমার একদিনের ইনকাম দেখে আসবি!’
ডাইরির পাতা ওলটাতে ওলটাতে একবছর আগের এই ঘটনার খসড়াতে চোখ আটকে যায় বিনয়ের। মনটা বেশ ফুরফুরে লাগে তার। সবাইকে চমকে দিয়ে শেষ হাসিটা সেই-ই হেসেছিল শেষমেশ। আচমকা বামহাতের অনামিকা ও কনিষ্ঠাতে চোখ চলে যায় বিনয়ের; সেখানে ঝকঝক করছে দুই নবাগত।
0 মন্তব্যসমূহ