পুরানো সেই দিনের কথা: বঙ্গের মৃৎশিল্পের ইতিবৃত্ত ।। রাণা চক্রবর্তী



● ছবিতে - মাটির বাসনপত্রের দোকান। চৌরঙ্গী অঞ্চল, কলকাতা। ১৯৪৪ সালে ফ্র্যাঙ্ক বন্ডের তোলা ছবি।

মৃৎশিল্পের যাত্রা শুরুর ইতিহাস মানব সভ্যতা শুরুর ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত। তবে এই শিল্প সম্পর্কে পনেরো হাজার বছরের তথ্য দেশের গবেষকদের কাছে রয়েছে। ভারতবর্ষসহ বাংলাদেশেরও রয়েছে মৃৎশিল্পের আদি চর্চার ইতিহাস। গত অর্ধদশকেরও বেশি সময় ধরে দেশে এই শিল্পে অনেক ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিবর্তন ঘটেছে।

সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে মানুষ তার প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরির উপকরণ প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করতে থাকে। তেমনি খাবার ও পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার জন্য পাত্র তৈরির ধারণা থেকে মাটির ব্যবহার শুরু করে মানুষ। এমনকি নিজেদের নিরাপদে থাকা নিশ্চিত করতে মাটির ঘর তৈরির সংস্কৃতি আদিকালে বিশ্বজুড়েই ছিল। যা আজও পৃথিবীর নানাপ্রান্তে রয়েছে। তবে সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে মাটি দিয়ে তৈরি পণ্য শিল্পের ছোঁয়া পেতে থাকে।

শিল্পের ছোঁয়া লাগার আগে মাটি দিয়ে সামগ্রী তৈরির যে চর্চা ও সংস্কৃতিতে মানুষ অভ্যস্ত হতে শুরু করে তখন এর নির্মাণ প্রক্রিয়াটি ছিল একেবারেই ভিন্নধাচের।

তবে কালের পরিক্রমায় মানুষ নিজের সৃজনশীল চিন্তাকে অব্যাহতভাবে শাণিত করে এই শিল্পের ধারাবাহিক উন্নয়ন সাধন করে। বাংলাসহ গোটা ভারতবর্ষে এক সময় মানুষের ঘরের পাশাপাশি দৈনন্দিন ব্যবহারে প্রায় সব ধরনের সামগ্রী তৈরি হত মাটি দিয়ে। এ ধরনের নির্মাণ ও শিল্পকর্মের সাথে যারা যুক্ত তারা কুমার হিসেবে পরিচিত। বংশ পরিক্রমায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পারিবারিকভাবে কুমারদের মৃৎশিল্পে হাতে খড়ি ও প্রশিক্ষণ হয়ে থাকে। সমাজের যে জনগোষ্ঠি মৃৎশিল্পের সাথে আদিকাল থেকে যুক্ত তারা পাল বংশীয় হিসেবেও পরিচিত।

মাটির তৈরি জিনিসের ব্যবহারিক যাত্রা শুরুর প্রারম্ভে যারা এগুলো বানাতে পারতেন না তারা কুমারদের কাছ থেকে অন্য পণ্যের বিনিময়ে তাদের প্রয়োজনীয় মাটির সামগ্রী সংগ্রহ করতেন।

সমাজ ব্যবস্থার গোড়াপত্তনের সময় থেকেই থালা-বাসন হিসেবে মাটির তৈজসপত্র ব্যবহারের নজির মেলে। এমনকি আজকের উন্নত বিশ্বেও শস্য রক্ষণে মাটির হাড়ি-কোলার জুড়ি নেই। হাজার বছর ধরে কুমারের হাতের পরম মায়ায় টিকে থাকা মৃৎশিল্প এখন ভিন্নরূপে ফুলদানি আর টবে শোভিত হয়ে অফিস বা বাড়ির শিল্পমূল্য যোগ করে।

মাটি প্রকৃতির উপাদান। মানুষের উদ্ভাবন ও সৃজন প্রক্রিয়ার অন্যতম বিকাশ মৃৎশিল্প। এই তত্ত্বের প্রমাণ মেলে বিশ্বের প্রধান সভ্যতাসমূহের প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় পাওয়া মৃৎশিল্পের নিদর্শনসমূহে। মাটির অন্যতম প্রধান উপাদান জলীয় পদার্থ নিয়মিত তাপ দিয়ে অনার্দ্রকরণ ও নমনীয়তা দূর করে যে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটানো হলো, তার ফলেই বিকাশ হলো মৃৎশিল্পের। প্রত্নতত্ত্ববিদ ও নৃতত্ত্ববিদদের মতে মানব সমাজের প্রথম বা আদি মৃৎশিল্পী নারী। কৃষকের ঘরের মেয়েরা এই মৃৎশিল্প নির্মাণে প্রধান ভূমিকা পালন করে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে অনুকূল প্রাকৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র ধারায় চাকে গড়া, হাতে ও ছাঁচে গড়া মৃৎশিল্পের বিকাশ ঘটেছে। মিশরে সর্বপ্রথম প্রায় তিন হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মৃৎশিল্পীর চাকা আবিস্কৃত হয়। আদিকালের মৃৎশিল্প স্বভাবতই প্রথমে কৃষিপূর্ব যুগের ঝুড়ি, নানা রকমের বল্কলপাত্র, কাঠপাত্র, পাথরপাত্রের অনুকরণে গড়ে উঠে। পরে ধীরে ধীরে উপাদানের ব্যবহার ও প্রয়োগরীতির ক্রমোন্নতির ফলে মৃৎশিল্পের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পায়। কৃষি প্রধান অর্থনীতির দৃঢ় প্রতিষ্ঠা ও ক্রমোন্নতির ফলে মৃৎশিল্পের আঙ্গিক, নক্সা ও কারুকুশলতারও উন্নতি হয় এবং মৃৎশিল্প বংশগত পারদর্শিতানির্ভর বিশিষ্ট কারুশিল্পে পরিণত হয়। বিশেষ ধরণের মাটি, উচ্চতর কৌশল ও দক্ষতা দিয়ে এই মৃন্ময় সৌন্দর্যকে অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। পোড়ামাটির ফলক দু’ভাবে তৈরি হতো- কাঁদামাটি থেকে সরাসরি হাতে তৈরি এবং ছাঁচের সাহায্যে। মূল ফলকগুলোর ভেতরের নতোন্নত ভাস্কর্যসমূহ হাতে কুঁদে রূপায়ণ করতেন প্রথম কুলিক বা প্রধান স্থপতি (পাল রাজসভায় প্রথম কুলিকের সম্মানজনক আসন নির্ধারিত ছিল বলে ইতিহাস পাঠে জানা যায়) ও দক্ষ মৃৎভাস্করগণ। পরবর্তী ধাপের শিল্পীরা স্থাপত্যের গাত্রালঙ্কার হিসেবে ব্যবহৃত অজস্র ফলক আগে থেকে প্রস্তুত চমৎকার কারুকাজ করা ছাঁচে ফেলে তৈরি করতেন।

পোড়ামাটির ভাস্কর্য, ফলক নির্মাণ বাংলা তথা ভারতবর্ষে বহু প্রাচীন কাল থেকেই চর্চিত হয়ে আসছে। কিন্তু খুবই আশ্চর্যের বিষয় এ সম্পর্কিত করণ-কৌশল, পদ্ধতি নিয়ে বেদ বা বেদপূর্ব শাস্ত্রকারগণ বিস্তারিত কিছু লিখে রেখে যাননি। ফলক নির্মাণপদ্ধতি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো গ্রন্থ আজ অবধি বাংলা ভাষাতেও পাওয়া যায়নি। তবে কিছ পুরাণ, ইতিহাসাশ্রয়ী গ্রন্থ ও চিকিৎসাশাস্ত্রীয় সংকলন পোড়ামাটির মূর্তি নির্মাণ বিষয়ক পদ্ধতি ও কৌশল যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে লিপিবদ্ধ করে গেছেন।

বাংলায় ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে স্থাপত্যেও গাত্রালঙ্কার হিসেবে পোড়ামাটির ফলকের ব্যবহার শুরু হয়েছে দেখতে পাওয়া যায়। উদাহরণ স্বরূপ মহাস্থানগড়ে অবস্থিত বাসু বিহার, গোবিন্দ ভিটা, পলাশ বাড়ি, ট্যাংরা প্রভৃতি প্রত্নস্থানে প্রাপ্ত পোড়ামাটির ফলকের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। পোড়ামাটির ফলক প্রস্তুত করতে মৃৎশিল্পীগণ সম্ভবত তাদের সমকালে বিশেষ ধরণের উন্নত পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। যে জন্য এখন পর্যন্ত পোড়ামাটির ভাস্কর্যসমৃদ্ধ স্থাপত্যসমূহ এদেশের জল-হাওয়ায় নিজেদেরকে রক্ষা করতে পেরেছে।

প্রাচীন বাংলার স্থপতিগণ প্রস্তর ভাস্কর্য তক্ষণে অসাধারণ দক্ষতা দেখালেও উপাদানজনিত কারণে স্থাপত্য নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রাচীন বাস্তুশাস্ত্রে বর্ণিত নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করার চেষ্টা হিসেবে পোড়া ইটের মাধ্যমে উঁচুশীর্ষ রেখ দেউল নির্মাণ করতে গিয়ে বার বার গণ্ডির কাছে ভেঙ্গে যেতে দেখেছেন। পোড়া ইট দিয়ে অভ্রভেদি চূড়ার কোনো দেব-দেউল নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। এই সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বাংলার স্থপতি তথা ভাস্কর ফিরে গেছেন মৃত্তিকার কাছে। তার ভাবাবেগের সাথে যুক্ত হয়েছে শিল্পমনস্বিতা। পরবর্তী সময়ে নতুন নতুন স্থাপত্যরীতির উদ্ভাবন ঘটিয়েছেন তারা, সংযোজন করেছেন নতুন নতুন স্থাপত্য কৌশল।

বাংলায় (পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলা) মন্দির নির্মাণের ক্ষেত্রে বাঙালি স্থপতিগণও তাই স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার যে নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস ভারতের সর্বত্র অনুসৃত হয়েছে সেই রীতিকে রক্ষা করার জন্য নানা পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে পোড়ামাটির ফলক ও মূর্তি নির্মাণে সচেষ্ট হয়েছিলেন। পোড়া ইটের ভবনগাত্রকে বৈচিত্র্যময় পোড়ামাটির ফলক দিয়ে অলঙ্কৃত করাকেই সাজুজ্যপূর্ণ বলে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পেরেছিলেন পরম্পরার মৃৎভাস্করগণ। পোড়া ইটের উপাসনালয়কে পোড়ামাটির ফলক দিয়েই সজ্জিত করার শিল্পপদ্ধতি বাঙালি মৃৎশিল্পীর ব্যাপক ও গভীর মনস্বীরই পরিচায়ক।

চন্দ্রকেতুগড় বাংলার ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ । বাংলার ২৪ পরগনা এবং কোলকাতা শহর থেকে উত্তরপূর্ব দিকে একদা ভাগীরথি নদীর শাখা নদী বিদ্যাধরী নদীর কূল ঘেঁষে এর অবস্থান। এই অঞ্চলে একাধিকবার খনন করা হয়েছে। খননে প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রী চন্দ্রকেতুগড়ের প্রাচীনত্ব ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব প্রমাণ করে। এখানকার নিদর্শনাবলির প্রধান অংশ কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়াম ও প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। এছাড়া বেশ কিছু নিদর্শন শহর এবং শহরের বাইরে ব্যক্তিগত সংগ্রহেও রয়েছে।

প্রত্নস্থলটিতে বর্তমানে দেবালয়, হাদীপুর, বেড়াচাঁপা, শানপুকুর, ঝিক্‌রা ও ইটাখোলা গ্রামের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে বসতির চিহ্ন পাওয়া যায়। মাটির তৈরি বিশাল দুর্গপ্রাচীর প্রত্নস্থলটির মূল কেন্দ্র ঘিরে আছে; আকৃতিতে আয়তাকার এবং মোটামুটিভাবে এক বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। মাটির তৈরি এ দুর্গপ্রাচীরের অভ্যন্তরেই চন্দ্রকেতুগড়, খনা মিহিরের ঢিবি, ইটাখোলা এবং নুনগোলা ইত্যাদি স্থানে খননের মাধ্যমে পাঁচটি পৃথক সাংস্কৃতিক স্তর বা পর্বের সন্ধান পাওয়া গেছে।

প্রথম পর্বটি প্রাক্‌-‘উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র’ পর্যায়ের স্তরকে নির্দেশ করে। দ্বিতীয় পর্বটি ৪০০ থেকে ১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কালের। এই স্তরে লম্বা গলার লাল মৃৎপাত্র; কানাবিহীন বড় গোলাকার পেয়ালা ও বাটি; কালো, সোনালি এবং বেগুনী রং-এর উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র; ধূসর রং-এর সাধারণ মৃৎপাত্রের টুকরা; তামার তৈরি চোখে সুরমা লাগাবার দণ্ড ; ও হাতির দাঁতের সামগ্রীর খণ্ড; ছাপাঙ্কিত তাম্র মুদ্রা; লিপিবিহীন ছাঁচে ঢালা তাম্র মুদ্রা; এবং বেশ কিছু পোড়ামাটির সামগ্রী যার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে পুঁতি, নামাঙ্কিত সীল ও সীলমোহর রয়েছে। তৃতীয় স্তরটি কুষাণ যুগের সমসাময়িক এবং স্তরটি আপাতদৃষ্টিতে সমৃদ্ধ। এ স্তর হতে রোমক ‘রুলেটেড’ (নকশা করা) পাত্রের অংশ বিশেষ; কালো অথবা অনুজ্জল লাল রং-এর ‘অ্যামফোরা’ বা গ্রিস দেশীয় মৃৎপাত্রের বেশ কিছু ভাঙ্গা অংশ; ছাপাঙ্কিত নকশাযুক্ত মনোরম লোহিত মৃন্ময়; ধূসর মৃৎপাত্র; এবং নিখুঁতভাবে ছাঁচে তৈরি পোড়ামাটির ক্ষুদ্র মূর্তি পাওয়া গেছে। এ পর্বকে খ্রিষ্টীয় প্রথম তিন শতাব্দীর মধ্যে ধরা হয়। চতুর্থ স্তরটিকে গুপ্ত এবং গুপ্তোত্তর যুগের বলে চিহ্নিত করা হয়। এ স্তরের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে সীল ও সীলমোহর; পোড়া মাটির সামগ্রী; ছাপাঙ্কিত নকশাযুক্ত ও ছাঁচে নির্মিত মৃৎপাত্র। এ স্তরের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হচ্ছে ১৪ ফুটের বেশি উচুঁ ‘সর্বত-ভদ্র’ রীতির ইট নির্মিত বিশাল একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। কোন বিশেষ দেব-দেবীর সঙ্গে সম্পর্কিত করা যায় ধর্মীয় এমন কোন নমুনা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া যায়নি। তবে, গুপ্ত স্তর থেকে সূর্য্য দেবতার প্রতিকৃতি একটি বেলে পাথর ফলকের নিম্নাংশে পাওয়া গেছে। পঞ্চম স্তরের প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ খুবই কম, এগুলি সম্ভবত পাল যুগের বলে ধরে নেওয়া হয়। শিল্প নিদর্শনের ভিত্তিতে সুস্পষ্ট যে, মৌর্য থেকে গুপ্ত যুগ পর্যন্ত এ প্রত্নস্থলের প্রধান শিল্প মাধ্যম ছিল ছাঁচ নির্মিত পোড়ামাটির সামগ্রী। সার্বিক বিবেচনায় এ শিল্পটি শিল্পরীতিতে ৩৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে গাঙ্গেয় ভারতের শিল্পকলার নিদর্শনাবলির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে মনে হয়। এগুলির বিস্ময়কর বিষয় বৈচিত্র্য এই অঞ্চলের শিল্পরীতির বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে প্রকাশ করেছে। এখানে ধর্মীয় ও আচার সংক্রান্ত নিদর্শনাবলি যা পাওয়া গেছে তার মধ্যে আদিম ধরিত্রি-দেবী, যক্ষ, যক্ষিণী, নাগ, পুরুষ বা নারী মুর্তি, কখনও পশুচালিত যানে দণ্ডায়মান এবং পাখাযুক্ত দেব-দেবী রয়েছে। আবার ধর্মের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই এমন বস্তুও পাওয়া গেছে। পোড়ামাটির সামগ্রীতে বিশেষ করে পোশাক অথবা শারিরীক সাধারণ বৈশিষ্ট খ্রিষ্টীয় প্রথম তিন শতাব্দীর গ্রেকো-রোমান যোগাযোগের গভীর প্রভাব দেখা যায়। প্রেমবিলাসী কামার্ত যুগলের কিংবা ‘মৈথুন’ ভঙ্গিতে চন্দ্রকেতুগড় প্রত্নস্থল থেকে অগণিত পোড়া মাটির মূর্তি পাওয়া গেছে। অলঙ্কারযুক্ত পুরুষ ও নারী মূর্তিসমূহ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে স্বর্ণকারের শিল্পের অনুকরণ করা হতো।

বর্তমানে প্রত্নস্থলটি সুনিশ্চিতভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এমন বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, চন্দ্রকেতুগড়ই সম্ভবত ‘পেরিপ্লাস’ এবং টলেমী সূত্রে উল্লিখিত প্রাচীন ‘গাঙ্গে’ বা গঙ্গারিডাই।বাংলার পোড়ামাটি শিল্পের ইতিহাসের ক্ষেত্রে চন্দ্রকেতুগড়ের ভূমিকা অনস্বীকা‍‌র্য।

বাংলার বিভিন্ন জায়গায় বহু বছর ধরেই মৃৎশিল্পের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। তবে তাদের মধ্যে কুমারটুলি, মঙ্গলকোট, কৃষ্ণনগর, দত্তপুকুর বিখ্যাত।

কুমারটুলি (কথ্য উচ্চারণে কুমোরটুলি) উত্তর কলকাতায় অবস্থিত একটি অঞ্চল। এই অঞ্চলটি ‘পটুয়া-পাড়া’ বা মৃৎশিল্পীদের বসতি অঞ্চল হিসেবে বিখ্যাত।

কুমারটুলি অঞ্চলের মৃৎশিল্পীদের দক্ষতার কথা সর্বজনবিদিত। কলকাতার এই অঞ্চল থেকে দেবদেবীর প্রতিমা কেবলমাত্র শহরের সর্বজনীন ও ঘরোয়া পূজার জন্যই সরবরাহ করা হয় না, অনেক ক্ষেত্রেই তা দেশের বাইরেও রপ্তানি করা হয়। কুমারটুলি পশ্চিমবঙ্গের একটি বিখ্যাত হস্তশিল্প (মৃৎশিল্প) কেন্দ্রও বটে।

ইতিহাস অনুযায়ী, ইংরেজরা কোম্পানির মজুরদের জন্য পৃথক পৃথক অঞ্চল ভাগ করে, এইভাবে কলকাতার দেশীয়দের অঞ্চলগুলি বিভিন্ন পেশাভিত্তিক পাড়ায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এইভাবেই শুঁড়িপাড়া, কলুটোলা, ছুতার-পাড়া, আহিরীটোলা ও কুমারটুলি প্রভৃতি অঞ্চলের উৎপত্তি ঘটে। ঊন-বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বড়বাজার অঞ্চলের আগ্রাসনের শিকার হয়ে উত্তর কলকাতার মৃৎশিল্পীরা শহর ছেড়ে চলে যান। কিন্তু কুমারটুলির পটুয়ারা, যারা গঙ্গা-মাটি সংগ্রহ করে মাটির পাত্র ইত্যাদি তৈরি করে সুতানুটি বাজারে (এখন বড়বাজার) বিক্রি করতেন, তাঁরা টিকে যান। পরবর্তীকালে তাঁরা ধনী সম্প্রদায়ের বাড়ির পূজার নিমিত্ত দেবদেবীর প্রতিমা নির্মাণ করতে শুরু করেন। কলকাতা ও বাইরে বারোয়ারি বা সার্বজনীন পূজার প্রচলন হলে পূজা-কমিটিগুলি কুমারটুলি থেকে প্রতিমা সংগ্রহ করতে থাকেন।

মঙ্গলকোট পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমাধীন কুনুর নদীর ডান তীরে অবস্থিত। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল। অজয় নদের সঙ্গে কুনুর নদীর মিলনস্থল পর্যন্ত এর ধ্বংসাবশেষ বিস্তৃত।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৮৬-৯০ সালের মধ্যে এই প্রত্নস্থলটিতে উৎখনন কার্য পরিচালনা করে।

মঙ্গলকোটে পাঁচটি প্রধান সাংস্কৃতিক স্তর বা পর্বের সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রথম স্তরে তাম্র-প্রস্তর যুগীয় সংস্কৃতির নিদর্শন হিসেবে কালো ও লাল রঙের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত মৃৎপাত্রের সন্ধান মিলেছে। অন্যান্য নিদর্শনাদির মধ্যে রয়েছে লাল মৃৎপাত্রের টুকরা বা ফালি; সঙ্গে তামাটে, কমলা, গাঢ় বাদামি এবং দীপ্তিমান লোহিত মৃন্ময়। তবে কালো মসৃণ ও অমসৃণ মৃৎপাত্রের টুকরার সংখ্যাই অধিক। কিছু মাটির পাত্র সাদা বা কালো রঙের চিত্র দ্বারা অলঙ্কৃত। রেডিওকার্বন পদ্ধতির ভিত্তিতে এ পর্বের সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে মৃৎশিল্প জাতীয় নিদর্শন হিসেবে লাল, বাদামি, ধূসর ও কালো রঙের সাধারণ মানের মৃৎপাত্রের টুকরা; কালো ও লাল রঙের অপকৃষ্ট শ্রেণির মৃৎপাত্রের টুকরা এবং পূর্ববর্তী স্তরের মৃৎপাত্রের নিদর্শন পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় স্তরের প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে লৌহ নির্মিত বিপুল সংখ্যক তীরের অগ্রভাগ, বাটালি ও ছুরির ফলা ইত্যাদি। এ সামগ্রীগুলি থেকে লোহা ব্যবহারের ক্রমবৃদ্ধি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। অবশ্য এ সময় হাড়ের সামগ্রী ব্যবহারেরও প্রচলন ছিল।

একদিকে কালো ও লাল মৃৎপাত্রের অনুপস্থিতি এবং অন্যদিকে কয়েক ধরনের নতুন মৃৎশিল্পের উদ্ভব তৃতীয় সাংস্কৃতিক স্তরকে (মৌর্য-শূঙ্গ আমল: আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১ম খ্রিস্টপূর্বাব্দের শেষ পর্যন্ত) বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছে। নতুন মৃৎ সামগ্রীর মধ্যে নকশাবিহীন ও নকশাঙ্কিত উভয় প্রকারের লাল, ধূসর ও কালো মৃৎপাত্রের টুকরা এবং উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্রের (Northern Black Polished Ware) অপকৃষ্ট ধরনের অল্প কিছু নমুনা রয়েছে। এ স্তরের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে একটি ছাপাঙ্কিত তাম্র মুদ্রা, লেখবিহীন তাম্র মুদ্রা এবং মৌর্য-শূঙ্গ শিল্পরীতির বেশ কিছু পোড়া মাটির মূর্তি। চতুর্থ স্তরটি কুষাণ সাংস্কৃতিক পর্বের একটি সমৃদ্ধিসূচক সময়কে তুলে ধরে। এ স্তরে মঙ্গলকোট প্রত্নস্থলে সম্ভবত সর্বপ্রথম ইটের রৈখিক বা লম্বালম্বি কাঠামো দৃষ্টিগোচর হয়। ফুল ও জ্যামিতিক অলঙ্করণের সুস্পষ্ট ছাপ সম্বলিত শক্ত লাল মৃৎপাত্র হচ্ছে এ যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্যসূচক মৃৎ-সামগ্রী। এ পর্বের প্রাপ্ত আকর্ষণীয় প্রত্নসামগ্রীর মধ্যে বেশ কিছু সিলমোহর, নির্ধারিত ছাঁচে নির্মিত পোড়ামাটির মূর্তি (কোন কোন মূর্তি স্বচ্ছ বস্ত্র পরিহিত) রয়েছে। হাতে গড়া পুরুষ ও মহিলা উভয়েরই বেশ কিছু মূর্তি এই স্তরে পাওয়া যায়। পঞ্চম স্তরটি গুপ্তদের সমসাময়িক এবং একটি সমৃদ্ধ বস্ত্তগত জীবনের চিত্র তুলে ধরে। পূর্ববর্তী সময়ের মতো এ পর্বেও ব্যাপক নির্মাণ কর্মকান্ড দেখা যায়। লালচে বাদামি রঙের অলঙ্কৃত পাতলা মৃৎসামগ্রী এ যুগের বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করে। এ স্তরে নানা ধরনের প্রতীক সম্বলিত বহুসংখ্যক সিল পাওয়া গেছে।

মৃৎশিল্পের ক্ষেত্রে বহু জিনিসের চাহিদা অনেকটাই কমেছে। যেমন মাটির হাড়ি, কলসির জায়গায় এখন এসেছে স্টিল বা অ্যালুমিনিয়ামের বাসনপত্র। চাহিদা বেড়েছে মাটির মূর্তি, ঘর সাজাবার নানা উপকরনের। সেই কারনেই মৃৎশিল্পীরা টব, ফুলদানী, মূর্তি, প্রদীপ, অ্যাশট্রে, ধূপ দানি, মোমদানি, কফি মগ ইত্যাদি তৈরিতে বেশী মন দিয়েছেন। বর্তমানে এগুলির চাহিদা বেশি থাকায় মৃৎশিল্পীদের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে তা এখনো আশানুরুপ নয়।

 

(তথ্যসূত্র - Handmade in India: Crafts of India by Aditi Ranjan and M.P Ranjan.)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ