কুসংস্কার-বিরোধী আইনের সাংবিধানিক ভিত্তি প্রসঙ্গে || দেবাশিস ভট্টাচার্য

কুসংস্কার ও ধর্মের ভিত্তিতে লোক ঠকানো আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমাদের প্রচলিত আইনগুলো কতটা কী করতে পারে, আর সে ব্যাপারে নতুন আইনই বা কতটা কী হতে পারে, তার কিছু ইঙ্গিত আগে আমার একটি লেখায় দিয়েছি, এখন আরও কিছু কথা বলা হয়ত বা জরুরি । 

কিন্তু, সে সব কথায় যাবার আগে কয়েকটি মৌলিক প্রশ্নে একটু ভাবনাচিন্তা করে নেওয়া যাক । আচ্ছা, ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট ও কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এমন আইন আমাদের রাষ্ট্র আদৌ বানাতে যাবে কেন ? তার জন্য প্রয়োজনীয় দার্শনিক/রাজনৈতিক/প্রশাসনিক ভিত্তিটুকু তৈরি আছে কি ? প্রশ্নটাকে আরেকটু পরিষ্কার করা যাক । 

ধরুন, আমি চাইছি, কারুকে সাপে কামড়ালে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে অ্যান্টি-ভেনম সিরাম দিয়ে আধুনিক চিকিৎসা করা হোক, এবং ওঝা-গুনিন ডেকে তন্ত্র-মন্ত্র-ঝাড়-ফুঁক এইসব করে সময় নষ্ট না করা হোক । তাহলে আমি নিশ্চয়ই দাবি করব, এমন আইন বানানো হোক যাতে সাপে কাটা রুগিকে হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে তন্ত্র-মন্ত্র-ঝাড়-ফুঁক এইসব ক্রিয়াকলাপ নিষিদ্ধ করা হবে, এবং আইন ভেঙে কেউ এসব করলে তার শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে । এবার ভাল করে ভেবে দেখুন, এ রকম দাবির পেছনে আছে এই রকম একটা ধারণা যে, তন্ত্র-মন্ত্র-ঝাড়-ফুঁক এইসব দিয়ে রোগ সারানো যায় না, এবং আধুনিক চিকিৎসা দিয়ে রোগটা সত্যিই সারানো যায় । আবার, এই ধারণারও পেছনে একটা দার্শনিক অবস্থান আছে --- সেটা এই যে, অলৌকিকতা বলে কিছু হয়না, জগৎ চলে বৈজ্ঞানিক কার্যকারণের ভিত্তিতে । 

এবার ধরুন, রাষ্ট্র ও তার কর্ণধারেরা যদি বিশ্বাস করে যে, অলৌকিকতার অস্তিত্ব আছে, এবং সেইহেতু দৈবী চিকিৎসা ও তন্ত্র-মন্ত্র-ঝাড়-ফুঁক এইসব দিয়ে রোগব্যাধি সারান সম্ভব, তাহলে তারা কিন্তু কিছুতেই এ রকম কোনও আইনের প্রয়োজনীয়তা মানতে চাইবে না । ধর্মীয় রাষ্ট্রে সেটা অনিবার্য, কারণ, সে সব রাষ্ট্রের নিয়মকানুন রচিত হয় ধর্মীয় শাস্ত্রগ্রন্থ বা সে দেশে চালু ধর্মীয় ধ্যানধারণা ও রীতিনীতির ভিত্তিতে, ঈশ্বর ও অলৌকিকতা যার অপরিহার্য অঙ্গ । কাজেই, এ ধরনের আইন তৈরির জন্য রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় বিন্দুমাত্র পরিসরও যদি থাকতে হয়, তো সে রাষ্ট্রকে ধর্মীয় রাষ্ট্র হলে চলবে না, ‘সেক্যুলার’ বা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হতে হবে । 

হ্যাঁ, আমাদের রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রই বটে । সংবিধানে ভারত রাষ্ট্রকে ‘সেক্যুলার’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে, এবং ‘বৈজ্ঞানিক মেজাজ’ ও ‘জিজ্ঞাসু মন’ তৈরিকে অন্যতম মৌলিক কর্তব্য হিসেবেও ঘোষণা করা হয়েছে । সুতরাং, আমাদের সংবিধানে কোনও মৌলিক পরিবর্তনের দাবি না করেই কুসংস্কার-বিরোধী আইন প্রণয়নের দাবি তুলতে আমাদের বিশেষ কোনও অসুবিধে নেই । 

তবে কিনা, আমাদের এই ধর্মনিরপেক্ষতার দুধটিতে আবার কয়েক ফোঁটা চোনাও আছে, সেটা ভাল করে বুঝে না নিলে এ আইন-ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাটা ঠিকঠাক বোঝা যাবে না ।

আমাদের দেশের সংবিধান প্রথম থেকে ‘সেক্যুলার’ বলে ঘোষিত হয়নি, ১৯৭৬ সালে এর ‘প্রি-অ্যাম্বল’ বা প্রস্তাবনা অংশকে সংশোধন করে সেখানে এই শব্দটি ঢোকান হয়, এটি ছিল আমাদের সংবিধানের বিয়াল্লিশতম সংশোধন । এই ‘সেক্যুলারিজ্‌ম্‌’ বা ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটি আমাদের দেশে এসেছে ইউরোপ থেকে, আধুনিক রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের ধারণার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে । ‘সেক্যুলার’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘ঐহিক’ বা ‘পার্থিব’, অর্থাৎ, স্বর্গীয় বা অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপার নয়, আমাদের দৈনন্দিন বাস্তব জীবনের লৌকিক ব্যাপার-স্যাপার । মানে, স্বর্গ-নরক-ঠাকুর-দেবতা-পাপ-পুণ্য-ভক্তি-পুজো-আর্চা নীতিকথা ধর্মতত্ত্ব এইসব জিনিস নয় । খাওদাওয়া, শরীর-স্বাস্থ্য, বাড়িঘরদোর, রুজি-রোজগারের কাজকর্ম, জমি-জিরেত-সম্পত্তি, টাকাকড়ি, প্রজাশাসন, যুদ্ধবিগ্রহ এইসব । 

সেই শব্দটাই পরে প্রশাসন ও রাজনীতিতত্ত্বের আঙিনায় এসে গেল, এবং তার মানে দাঁড়াল রাষ্ট্র থেকে ধর্মের বিচ্ছিন্নতা । অর্থাৎ, আধুনিক রাষ্ট্রে ধর্ম হবে ব্যক্তিগত বিষয়, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যাপারে ধর্মের নাক গলান হবে নিষিদ্ধ, এবং রাষ্ট্রপোষিত শিক্ষা-ব্যবস্থাও হবে ধর্মের প্রভাবমুক্ত । ষোড়শ শতক থেকে ইউরোপ এবং তারপর আস্তে আস্তে সমগ্র আধুনিক পৃথিবীই এই পথে এগিয়েছে, যদিও বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শোনা গেছে কিছু উল্টো সুরও । সমস্যা হচ্ছে, ভারতে এসেও এই শব্দটি কিঞ্চিৎ প্রতিষ্ঠা ও সমীহা পেয়েছে বটে, কিন্তু তার ভেতরকার ধ্যানধারণা কিঞ্চিৎ ঘেঁটে গেছে । 

এখানে ‘সেক্যুলার’ শব্দটি সংবিধানে ঢুকেছে, এবং কোনও বিশেষ ধর্মকে ‘রাষ্ট্রীয় ধর্ম’ বলেও ঘোষণা করা হয়নি । কিন্তু আবার, ধর্মগুলোর সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্কটাও সুস্পষ্টভাবে নির্ণয় করা হয়নি, যদিও আইনগুলো যেভাবে বানানো হয়েছে তার মধ্যে একটা বহুত্ববাদ এবং ‘সব ধর্মের প্রতি সমান মর্যাদা’ গোছের মেজাজ আছে । ফৌজদারি আইনকে সবার জন্যই সমান রাখা হয়েছে, কিন্তু মুসলমানদের জন্য আলাদা দেওয়ানি আইন আছে । সংবিধানের পঁচিশ নম্বর ধারায় যে কোনও ব্যক্তিকে নিজের বিবেকবুদ্ধি অনুযায়ী যে কোনও ধর্ম পালন ও প্রচারের অধিকার দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কারুকে কোনও না কোনও ধর্ম মানতেই হবে এমন বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি । সেখানে নাস্তিকতা বা ধর্মহীনতা বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি, আবার তাকে নিষিদ্ধও করা হয়নি । বোঝা যাচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা এখানে দুর্বল ও অপুরুষ্টু, খাঁটি ইউরোপীয় ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ এখানে সেভাবে শিকড় গাড়তে পারেনি । এখন লাখ টাকার প্রশ্ন হচ্ছে, অলৌকিকতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এই আধো আধো ধর্মনিরপেক্ষতা কতখানি দৃঢ় অবস্থান নিতে পারে, এইসবের বিরুদ্ধে আইন তৈরি করবার দাবিকে কতটা পরিসর ছাড়তে পারে, যেখানে ভারতীয় সমাজে ধর্ম ও কুসংস্কারের প্রভাব সমুদ্র-গভীর ? 

সন্দেহ নেই, এ এক কঠিন প্রশ্ন । এমনিতে আজকের দিনে যে কোনও রাষ্ট্রের আইন অলৌকিকতা-বর্জিত হতে বাধ্য, তা না হলে কোনও অর্থপূর্ণ আইন-ব্যবস্থা তৈরি করাই মুশকিল । খুন-জালিয়াতি-চুরি-ডাকাতি এইসবের মধ্যে অলৌকিকতার হস্তক্ষেপ মেনে নিলে তদন্ত বিচার এইসব জিনিসের আর কোনও মানেই থাকবে না, কারুরই কোনও অপরাধ প্রমাণ করা যাবে না । স্বভাবতই, আমাদের দেশের আইনও অবশ্যই অলৌকিকতা-বর্জিত । 

কিন্তু, ধর্মনিরপেক্ষতার মৌলিক ভিত্তিটি নড়বড়ে হওয়ায় পেছনের দরজা দিয়ে অলৌকিকতা আমদানির সুযোগ থেকে যায়, বিশেষত যদি ধর্মীয় কোনও রাঘব বোয়াল জড়িত থাকেন । এ ধরনের একটি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮৯ সালে, যখন কেরলের যুক্তিবাদী আন্দোলনের এক প্রধান পুরুষ বাসব প্রেমানন্দ একটি মামলা করেন প্রভাবশালী ধর্মগুরু ‘সাঁই বাবা’-র বিরুদ্ধে । 

সকলেই জানেন, এই ‘সাঁই বাবা’ ভক্তদের ‘দর্শন’ দেবার সময়ে নিয়মিত নানা কৌশলে তাঁর পোশাক ও শরীরের মধ্যে লুকোনো জিনিসপত্র বার করে ভক্তদের মধ্যে বিলি করতেন, যাতে ভক্তেরা তাঁর ‘অলৌকিক’ ক্ষমতায় আবিষ্ট হয়ে পড়েন । সাধারণ ভক্তদের জন্য থাকত পবিত্র ছাই বা ‘বিভূতি’, আর প্রভূত ক্ষমতা ও বিত্তের অধিকারী হোমরাচোমরা ভক্তদের জন্য বরাদ্দ ছিল শূন্য থেকে ‘সৃষ্টি’ করা দামি সোনার অলঙ্কার ! ‘গোল্ড কন্ট্রোল আইন’ অনুযায়ী সোনার জিনিস বানানো ও ব্যবসার জন্য লাইসেন্স চাই, এবং ‘সাঁই বাবা’-র সে লাইসেন্স মোটেই নেই, কাজেই ওইভাবে সোনার জিনিসের লেনদেন করে তিনি ‘স্বর্ণ নিয়ন্ত্রণ আইন’ ভাঙছেন, এই ছিল বাসব প্রেমানন্দের অভিযোগ । বারবার অভিযোগেও সরকার ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রেমানন্দ হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন, এবং অন্ধ্রপ্রদেশ হাইকোর্ট একটি অবাক করা রায়-এর মাধ্যমে সে অভিযোগ খারিজ করে জানায় যে, যেহেতু ‘সাঁই বাবা’ দৈবী ক্ষমতায় শূন্য থেকে স্বর্ণালঙ্কার সৃষ্টি করে (‘মেটিরিয়ালাইজ’) ভক্তদেরকে বিলি করছেন, কাজে কাজেই তাকে সোনার উৎপাদন বা ব্যবসা এইসব বলা যায় না, এবং সেইহেতু তা ‘স্বর্ণ নিয়ন্ত্রণ আইন’-এর আওতাতেও পড়তে পারে না । এইভাবে সেদিন রাজ্যস্তরের একটি ভারতীয় আদালত আইনের ‘টেকনিক্যাল’ যুক্তির আড়ালে অলৌকিকতাকে ঠারেঠোরে মেনে নিয়েছিল । 

অলৌকিকতাকে এইভাবে স্বীকার করে নেওয়ার দৃষ্টান্ত হয়ত বা অপেক্ষাকৃত বিরল, যদিও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে জলাঞ্জলি দেবার ঘটনা আমাদের রাষ্ট্র ও তার কর্ণধারদের কাছে জলভাত, এবং তেমন ঘটনা প্রায় রোজই ঘটছে । রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে দলিত ও সংখ্যালঘু নির্যাতন, শিক্ষাব্যবস্থার ধর্মীয়করণ, প্রায় প্রতিদিনই রাষ্ট্রচালকদের তরফে ধর্মান্ধ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন উক্তি, নির্বাচনী প্রচারে ধর্মীয় ঘৃণার ব্যাপক ও অবাধ ব্যবহার --- বিগত কয়েক বছরে এইগুলোই হয়ে উঠছে ভারতীয় রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য, এর সমালোচনা ও বিরোধিতাও হচ্ছে প্রবলভাবেই । 

কিন্তু, এই ধরনের উন্মত্ততার হাওয়া যখন নেমে যায়, সেই অপেক্ষাকৃত ‘সাধারণ’ সময়েও নিঃশব্দে ও নিচুমাত্রায় ধর্মনিরপেক্ষতার জলাঞ্জলি চলতেই থাকে । রাষ্ট্রনেতারা সাড়ম্বরে মন্দিরে পুজো দিয়ে আসছেন, বাবাজি-মাতাজির পায়ে প্রকাশ্যে মাথা ঠেকাচ্ছেন, সাবমেরিন বা মহাকাশযান উদ্‌বোধনের সময় নারকোল ফাটানো ও সিঁদুর মাখানো চলছে, এইসব খবরে রোজই ভরে থাকে গণমাধ্যম । নিয়মিত ধর্মীয় প্রতারকদের হাতে অসংখ্য মানুষ যে প্রতারিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছেন, সে ব্যাপারে রাষ্ট্র ও গণমাধ্যমের চোখ বুজে থাকাটাও এ রোগেরই আরেক উপসর্গ । 

আমাদের আইন-ব্যবস্থায়, তাহলে, যুক্তিবাদী আইনের দাবি-দাওয়ার জন্য প্রাপ্য পরিসরের হিসেবনিকেশটা শেষপর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াল ? 

নাঃ, তেমন উল্লসিত হওয়ার মত কিছু নিশ্চয়ই নয়, আবার হতাশায় ভেঙে পড়ার মতও কিছু নয় ।

পা রাখার পা-দানিটুকু তৈরি আছে । বসার আসনটুকুও নিশ্চয়ই হবে একদিন । 

হাল ছেড়ো না, বন্ধু !

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ